Hello Testing

3rd Year | 10th Issue

৩০শে ফাল্গুন, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ | 15th March, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ক্যা ন ভা স

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

suvo

একা মানুষ কর্পোরেট দুনিয়ার উৎকৃষ্ট জ্বালানি। ‘দলবদ্ধ প্রতিবাদের ভাষা’ এই প্রদর্শনীর ছবিগুলির অন্তর্লীন যোগসূত্র...

সম্প্রতি ‘দ্য ফ্রেম’ তাদের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বর্ষব্যাপী কর্মসূচীর সমাপ্তি হিসাবে বিড়লা একাডেমীতে আয়োজন করেছিল এক চিত্র প্রদর্শনীর। শিরোনাম ছিল ‘Quest’। দলবদ্ধ প্রয়াসকে অর্থহীন প্রমাণ করার যে কুটিল চক্রান্ত চলছে  চারপাশে তাকে বুড়ো আঙুল দেখানোই ছিল ‘দ্য ফ্রেম’-এর উদ্দেশ্য। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই এখন কর্পোরেট দুনিয়ার লক্ষ্য। তাহলে তাকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে অনায়াসে। চিরকালই কর্পোরেট দুনিয়ার অলিন্দে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের দল বিপদের কালো ছায়া ফেলে আসে। একক মানুষ বলা ভালো একা মানুষ কর্পোরেট দুনিয়ার উৎকৃষ্ট জ্বালানি। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ‘দলবদ্ধ প্রতিবাদের ভাষা’-ই এই প্রদর্শনীর ছবিগুলির অন্তর্লীন যোগসূত্র। অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের এই প্রদর্শনী উপলক্ষে বলা বিষয় ধারণার লেখাগুলির উপর চোখ বোলালেই তা স্পষ্ট হয়। প্রখ্যাত শিল্পী গণেশ হালুই-এর উপস্থিতি ‘দ্য ফ্রেম’-এর এই উদ্যোগের সফলতারই ইঙ্গিত করে।  তাঁদের এই প্রয়াস জারি থাক। মানুষ বাঁচুক সংঘবদ্ধ ভাবে।

অরুণাংশু রায়, আধুনিকতাকে দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করতে চাইছেন। আধুনিক সমাজের জটিল বিন্যাস, কুটিল গতিবিধি এড়িয়ে প্রাক আধুনিক সমাজ জীবনের সহজ যাপনের হদিস পেতে চাইছেন, যে আধুনিকতা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে যে বিজ্ঞান, রসায়নাগারে মারণ ভাইরাস তৈরি করে সারা পৃথিবীকে এক মৃত্যুউপত্যকায় পরিণত করেতোলে, সেই বিজ্ঞান মনস্ক আধুনিক সমাজের থেকে দুরে সহজ জীবনের খোজ করতে চান। সহজ এক চিত্রভাষা তৈরি করতে চান, যা  আদিম সমাজের চিত্রভাষার লক্ষণ সম্পৃক্ত। যে চিত্রভাষা, রেখায় এবং আকারে আধুনিক সমাজকে বিদ্রুপবিদ্ধ করতে সক্ষম।

বিশ্বজিৎ সাহা তার বর্তমান চিত্রগুচ্ছে ভারতিয় পুরাণের একগুচ্ছ দেবপ্রতিমা নিয়ে ভেবেছেন , মানবেতর প্রাণীর, পক্ষীমস্তক মানবশরীরধারী দেবদেবী চিত্রপ্রতিমা এঁকেতুলেছেন, যে প্রতিমা সেই সমাজের নির্মাণ যেখানে মানুষ,প্রকৃতি,এবং মানবেতর প্রাণের সহঅবস্থান। আরও বিস্তৃত অর্থে এই জল, এই মাটি, এই আলোর উপর সর্বপ্রাণের সমান অধিকার । বিশ্বজিৎ যে রং রেখায় এবং যে আকার ব্যাবহার করেছেন তা আহরণ করছেন উত্তর ধ্রুপদী চিত্রভাষা থেকে।

বিভূতি চক্রবর্তী তার ছবিতে বিষয় হিসাবে ভেবেছেন সমকালের মানুষের সমস্যা। এই বর্তমান সময়ে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ কর্পোরেট দুনিয়ার লাভের জোগানে প্রতিবন্ধক ।একলা, স্বয়ংসম্পূর্ণ,প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন একক মানুষ যন্ত্র বিশেষ। তবে আর এই নতুন সমাজে শিল্প,সাহিত্য চর্চার ভবিতব্য কি? হেতুই বা কি? এই একলা, নিসঙ্গ,স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষকে নিয়ে ছবি আঁকছেন বিভূতি চক্রবর্ত্তী ।

দেবাশিস সামন্ত তার ছবির বিষয়ে বলছেন।যে সচল এবং অচল বস্তু আমার চারপাশে । যে ঘটনার সংঘাত এড়ানো গেল অথবা এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। সেই সংঘাত সংস্পর্শে যে নতুন বোধ জন্মনিলো আমার মনে। সেই বহুধাবিস্তৃত ঘটনা  আমার দিনযাপনের অংশ। সেই সব সংঘাতের সারাৎসার চিত্ররূপে প্রকাশ পায় সহজ সরল আকার , রঙ এর সংঘাতে। সে সব রং এই মাটির। সে সব আকার এই বাঙলার। প্রাচীন অথবা আধুনিক সে সব রেখা লোকশিল্পের ধারা বেয়ে এসে উঠেছে আমার ছবির শরীরে।

জয়ন্ত ভট্টাচার্য তার ভাস্কর্যে সমকালীন সময়ের ফুলে ওঠা,  ফেঁপে ওঠা রঙচংএ বেলুনের মতন অন্তসার শূন্য সমাজের শিৎকার, অর্থহীন সংস্কৃতির ঢঙ্কানিনাদ, নীতিহীন রাজনীতির বজ্রনির্ঘোষ তার ভাস্কর্যে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। বেলুনের মতনই নির্বোধ দম্ভ যেকোন মুহুর্তে ফেঁসে যেতে পারে। চুপসে যেতে পারে রংচংএ ফাঁপা আধুনিকতা ।

প্রাণগোপাল ঘোষ, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তার চিত্রপটে আশ্রয় দিয়েছেন। এই প্রকৃতি যা কিনা সমস্ত জটিলতা থেকে দূরে এক শান্তিনিকেতন রচনা করে।

রবীন রায়, এই বিশ্বজোড়া ক্ষমতার নজরদারির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।  তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন নজরদারি চলছে ক্ষমতার কর্তৃত্ব কায়েম রাখবার স্বার্থে। আপামর জনসাধারণ তাদের নিজের দেহের এবং মনের  অধিকার , ভাবনার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে পুজিবাদি ক্ষমতার আগ্রাসী আক্রমণে । রবিনের কালি তুলির ব্যবহারে মানব শরীর নির্মানের পদ্ধ্তির মধ্যে  চাবুকের ঘায়ে ক্ষত বিক্ষত কীটের জীবন প্রকট হয়ে ওঠে।

সীতাংশু মন্ডল, মানব দেহ, সমাজ দেহ একাকার করে ভেবেছেন। সমাজ দেহ সচল রাখতে রসদ জোগান দেবার, সংযুক্ত রাখবার জন্য জলধার থেকে ঘরে ঘরে বিস্তৃত জলনালির জাল এখানে মানবদেহ অভন্তরে কোষে কোষে রক্তসংবহন তন্ত্রের রূপক । জলের ভাণ্ডার মানব হৃদয়ের রূপক, জলনালিগুলি রক্তনালিকা রূপক । এই বন্টন ছাড়া শরীরের সমস্ত অঙ্গগুলি যেমন বেঁচে থাকতে অক্ষম । সুষম বন্টনও তেমনি সমাজের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে ।

স্বপন কুমার মল্লিকের এই প্রদর্শনীর চিত্রগুচ্ছ তৈরি হয়ে উঠেছে কভিদ পরিস্থিতির আবহে। কভিদ সারা পৃথিবীর মানব জাতির সামনে জীবনের অনিশ্চয়তা উদ্ঘাটিত করে তুলেছে। সেই প্রচন্ড অভিঘাতে মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা মিথ্যা ঠেকে । জীবন এবং মৃত্যুর এই সহাবস্থান মানুষকে জীবনের মূল অর্থ নতুন করে খুঁজে নিতে আত্মগত হতে, নিজের মনের সুশ্রষার কাছে ফিরতে বাধ্য করে তোলে। একজন শিল্পীহিসাবে এই উপলব্ধি উচ্ছল রং,প্রতীকী আকারের আশ্রয়ে চিত্রপটে স্থায়ী করবার প্রেরণা জোগায় তাকে।

শুভ্রকুমার ব্যন্দ্যোপাধ্যায়, নানান মাধ্যমে, বিচিত্র সার্ফেসে, উচকিত রঙের ব্যবহারে, পরস্পর বিরোধী  আকার, ইমেজ ,বস্তুর সমাবেশে দর্শককে, দর্শকের ভাবনাকে ঝাঁকুনি তোলে। সমকালের প্রতি তির্যক খোঁচা শুভ্রর ছবিতে দেখা যাবে ।

সৌমিত্র কর, বর্তমান চিত্রগুচ্ছে প্রাচীন সমাজের থেকে সমস্ত আধুনিকতাকে এড়িয়ে টিকে থাকা অতি আদরের এক রীতি অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। নবান্ন, সে সব পুরাতন গোষ্ঠীজীবনের টিকে থাকা স্মৃতি। যেখানে মানুষ একলা একলা বাঁচে না। মানুষ একক নয়, দেবতা, অপদেবতা, আত্মীয়, অনাত্মীয় থেকে কীট পতঙ্গ অবধি সকলকে নিয়ে বাঁচার, বেঁচে থাকার জীবনদর্শন এই অনুষ্ঠানের শরীরে মিশে আছে। লোকশিল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ট সংসর্গ সৌমিত্র করের ছবির বিষয় এবং চিত্রভাষা নির্মাণে  উল্লেখ যোগ্য উপাদান ।

সুমিতাভ পাল পি ৩ অর্থাৎ পাওয়ার, পার্ভার্সন, পেন নামে একটি বস্তুপুঞ্জের সমাহার পেশ করেছেন। সমকালীন পৃথিবীর সর্বত্র আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, ক্ষমতার অপরিসীম প্রকাশ সে শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন মধ্যকার ক্ষমতার দেখনদারিতে আটকে আছে এমন নয়, আফ্রিকান সমাজের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু নয়। ক্ষমতার নখ দাঁত সর্বত্র প্রকট। শান্তির ললিতবাণী সমৃদ্ধ বৌদ্ধ শাসক অধ্যুষিত দেশের রহিঙ্গা বিতাড়ন সেই একই ক্ষমতার দম্ভের প্রকাশ। যুদ্ধ , মানুষের ধংস প্রবণতার প্রকাশ। কামক্রিয়া এখানে সৃষ্টির জন্য নয়, অন্যের শরীর মনের স্বাধীনতার অধিকার দলনের ক্ষমতার প্রকাশ মাত্র। এই সমস্ত ঘটনার যন্ত্রনার প্রতীকী প্রকাশ মেঝের উপর ছড়ানো ধারালো কিছু আকার।

শেখরবরণ কর্মকার তার ছবির বিষয় ধারনা হিসাবে বলছেন, তার ছবি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিথলজি,এবং সাহিত্যের মিলনে উঠে আসা কিছু চিত্রকল্প। ফুঁসে ওঠা ঢেউ কবন্ধ,পচা মাংস, হাড়,রক্তের স্রোত বেয়ে ঢেউ তোলে আকাশে।বুকের উপর এসে আছড়ে পড়তে চায় । তার সামনে সটান দাঁড়িয়ে একজন মানুষ ট্রাফিক পুলিশের মতন বদলাতে চাইছে ঢেউএর গতিপথ। নাকচ করছে সেই ঢেউয়ে ভেসে যাবার আবদার । পায়ের তলায় স্রোতের টানে বালির শিরশির গতি। সব প্রতিকূল ঢেউ এর সামনে চিরন্তন মানুষের চিরকালীন প্রতিবাদ।

আরও পড়ুন...