চ রৈ বে তি
খারাপ রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলা হয়ে গিয়েছে। এবার বিরক্ত লাগছে। বাইক চালানোর সময় এমন রাস্তা ক্লান্তি এনে দেয়।
সকাল আটটায় রাঁচি থেকে বেরিয়েছি। এবার লক্ষ্য নেতারহাট। তা, ঘণ্টাখানেক এইভাবে চলার পরে একটি চায়ের দোকান দেখে বিরতি নিলাম। সময়টা ডিসেম্বর, তবে ঠাণ্ডার লেশ মাত্র নেই। দোকানে ঢুকেই জ্যোতিদা ‘পাখা খুলে দিন, পাখা খুলে দিন’ বলতে লাগলো। আমাদের শরীরে বাইক চালানোর নানারকম বর্ম, গরম লাগছিল সবার। একটু ঠাণ্ডা হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। গুগল বাবাজি এমন রাস্তাতে এনে ফেলেছে! ‘আরে আপনারা এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন কেন?’ চায়ের দোকানদারের কথা শুনে আমরা সবাই তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আমাদের রাস্তা বলে দিলেন। কয়েক কিলোমিটার দূরে বজরংবলীর বিশাল মূর্তি আছে, সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে গেলেই হবে।
আমরা যারা বাইক চালাই, তাদের স্বপ্নের কিছু রাস্তা আছে। এই রাস্তাটা অনেকটা সেরকমই। না, ভালো রাস্তা শুধু তো তা নয়, সঙ্গে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও। শাল-মহুয়া-পলাশে ছাওয়া উঁচু নিচু অর্ধবৃত্তাকারে সে রাস্তা এগিয়ে চলেছে নেতারহাটের দিকে। আমরা তখন বাইক নিয়ে নদীর স্রোত হয়ে গেছি। আমি একটা গান ধরলাম।
‘ছোটনাগপুরের রাণী’ নেতারহাট একটা ছোট পাহাড়ি জনপদ। ঝাড়খণ্ডের লাটেহার জেলাতে ১০৭১ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। চোখে পড়ার মতো পাইন আর ইউক্যালিপ্টাস-এর বাহার। আমরা গন্তব্যে প্রবেশ করার আগে খানিক বিরতি নিয়েছিলাম। পাইন আর পাহাড়ি শীতলতার মাঝে ছবি তোলা হলো। গতকাল কলকাতা থেকে সকাল আটটা নাগাদ বেরিয়ে এই প্রথম সবাই যে যার মুঠোফোন বার করে ছবি তোলায় মেতে উঠলাম। নেতারহাট তখন আর মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে।
যাঁরা জমজমাট জায়গা খোঁজেন, নেতারহাট তাঁদের জন্য নয়। মাত্র কয়েকটি দোকানের সমাবেশ, সেটাই বাজার। আমরা বাইক নিয়ে প্রথমে সেখানে থামলাম, চা খেয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলাম। এখানকার সব হোটেলই মধ্যম মানের। বাজারের অনতিদূরে হোটেল রয়্যাল প্যালেস, অবশ্য রাজকীয় কিছু নয়। আমরা বাইক রেখে প্রথমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। মেনুর হিট পার্ট হলো মুরগির ঝোল। সবথেকে বড় কথা ব্রয়লার মুরগির আসাধারন স্বাদ। কলকাতা শহরে এ জিনিস মিলবে না। এরপর সবাই মিলে কোলাহল করতে করতে বাইক বার করলাম, এবারের গন্তব্য যেখানে সূর্য অস্ত যায় সেই জায়গাটা।
ম্যাগনোলিয়া পয়েন্টে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবু ডুবু। এই সময় সূর্যকে খোলা চোখে দেখা যায়, মানে তাকিয়ে থাকা যায় আর কি। চারিদিক কোমল রক্তবর্ণ, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝবেন আমি ঠিক কী বলতে চাইছি। পৃথিবীটা যে গোল তা আবার প্রমাণ পেলাম, যখন নিজের এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে সেখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা হাসাহাসি, আর সঙ্গে চা-পেঁয়াজি। গল্পে গল্পে আঁধার নামল।
সারাদিন বাইক চালানোর পরে শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তবু আমাদের নিয়ম হল এই যে, রাতে খাওয়াদাওয়া করার আগে নিজেদের সারাদিনের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে আলোচনা করা। কেউ তার অভিজ্ঞতা সবার সামনে বলতেও পারে। গঠনমূলক এই আড্ডায় অংশগ্রহণ না করলে এর মজা বুঝতে পারবেন না। পরের দিন পাত্রাতু হয়ে তোপচাঁচি যেতে হবে। খাওয়াদাওয়া করে আমরা পস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে দিলাম। কাল প্রথম ডেসটিনেশন নেতারহাটের সূর্যোদয়।
খুব ভোরে আটটা বাইক একসঙ্গে গর্জন করে উঠল। আমরা প্রস্তুত। এগিয়ে চললাম সূর্যোদয়ের পথে…।