প্র চ্ছ দ কা হি নী
বৈদিক যুগের ঘোষা, অপালা, লোপামুদ্রা ও বৈদিক পরবর্তী যুগের গার্গী, মৈত্রী— এই পাঁচ মহীয়সী নারীর কথা আমরা কে না জানি। তবু নারীশক্তিকে খাটো করার প্রবণতা আমাদের চিরদিনের। লিঙ্গ রাজনীতি পৃথিবীর আদিম ব্যাধিগুলির মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর জন্মের পর ‘নারী পুরুষ’— এই বিভাজন রেখাই মানবজাতিকে বিভাজিত করে দুর্বল করে ফেলার প্রথম ও সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য প্রয়াস। এরপর আস্তে আস্তে বর্ণ এলো, ধর্ম এলো, এলো মহদেশ, দেশ, কাঁটাতার আরও কত কী। একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে তার মজা নেওয়া— কিছু বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের চিরদিনের বিনোদন। আর আমরা সবাই সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি।
কিন্তু সব কিছুরই একদিন বদল হয়। বদল হয় দৃষ্টিভঙ্গির। এই কাজ মহিলাদের, এই কাজ পুরুষদের— এমন বিভাজন রেখা যে নিতান্তই এক প্রহসন, এক আদিম ব্যাধি তা আজ প্রমাণিত। আর তা প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু মহিলা পুরুষ উভয়েরই সাহচর্যে। মহিলারা যেমন এগিয়ে এসেছেন, সহকর্মী পুরুষরাও কিন্তু তাঁদের সাদরে বরণ করেছেন। শানিত বাঁকা দৃষ্টি এনেছেন মুষ্টিমেয় কিছু সেই আদিম রিপুর মানুষ। তাদের মধ্যে আছেন মহিলা পুরুষ উভয়ই। আমরা আজ জানব তেমনই পাঁচ নারীর কথা, যাঁরা কাজের জগতে মুছে দিয়েছেন নারী-পুরুষ বিভাজন রেখা। কুর্নিশ সেই সব পুরুষদেরও যাঁরা তাঁদের দেখেছেন একজন সহকর্মী হিসাবেই। পোশাক নয়, আসুন আমরা আধুনিক হই মননে।
শ্মশানে ডোমের দায়িত্বে থাকেন সাধারণত পুরুষেরাই। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর শহরের হরিশচন্দ্র ঘাটের শ্মশানে এই দায়িত্ব পালন করেন একজন মহিলা। বয়স সত্তরের কাছাকছি। এলাকাবাসীর কাছে তিনি গৌরী আম্মা নামেই পরিচিত। আসল নাম গৌরী দেও। মৃতদের নাম নথিভুক্ত করা থেকে কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো, অস্থি নিয়ে আসা— সব কাজই একা হাতে করে এসছেন দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে।
তাঁর স্বামী কাকারু দাও তিন কন্যা রেখে মারা যান অকালে। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে স্বামীর করে আসা কাজটিকেই জীবন ধারণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি। টানা বারো ঘণ্টা এক নাগাড়ে ডিউটি করে যান গৌরী আম্মা। মুখে রা নেই। নেই ভয় বা ভীতি। যদিও এই মহাশ্মশানে ডোমের দায়িত্বে পুরুষকর্মীরাও রয়েছেন। কিন্তু সবাই এখানে কাজে চায় গৌরী আম্মাকেই। তাঁর কাজে নিষ্ঠার তারিফ শ্মশানযাত্রীদের মুখে মুখে। এইটুকুই প্রাপ্তি তাঁর। না, কোনো সর্বভারতীয় চ্যানেল বাইট নিতে ছুটে আসেনি বা ঝলসে ওঠে না আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কাজের শেষে কেউ যদি একটু ভালো বকশিস দেয়, তাতেই খুশি গৌরী দেবী। বর্তমানে বয়সের ভারে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। তবু দিনের খানিকটা সময় এখনও শ্মশানেই কাটান। কাজে হাত লাগান। শ্মশান লাগোয়োই তাঁর বাড়ি। পুরসভা থেকে মাসিক ভাতা পান। কিছুদিন আগে ‘বইতরণী’ পত্রিকা গোষ্ঠীর উদ্যোগে তাঁকে কলকাতা প্রেসক্লাবে সম্মান জানানো হয়। নারীর ক্ষমতায়নে গৌরী আম্মা থুড়ি গৌরী দেও-র জীবন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
‘আস্তে লেডিস কোলে বাচ্চা’— না বরং তাঁকে শুনতে হয়েছিল— ‘আস্তে লেডিস, হাতে স্টিয়ারিং’। প্রথম প্রথম হাসি পেলেও বা কখনো কখনো রাগ হলেও… আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে গেছিল কথাটা প্রতিমা দেবীর। প্রতিমা পোদ্দার। নিমতা-বেলঘরিয়া-হাওড়ার রুটে মিনিবাস চালান তিনি। কলকাতার প্রথম মহিলা বাসচালক।
অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় প্রতিমাদেবীর। বিয়ের পর উচ্চমাধ্যমিকও পাশ করেন প্রতিমাদেবী। অভাব অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী। তবু সুখেই চলছিল ঘর সংসার। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন স্বামী। তিন-চার মাস রোজগারহীন সংসার। স্বামীর চিকিৎসার খরচ। এই দিশাহীন অবস্থায় নিজেই হাতে তুলে নেন স্টিয়ারিং। ২০০৬ সালে লাইসেন্স পান তিনি। শুরু হয় লড়াই। বাঁকা চাহনি, টোন, টিটকারি কোনো কিছুই টলাতে পারেনি তাঁকে। অকুতোভয় প্রতিমাদেবী শুধু বাসই নয়, এর আগে চালিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্সও। করেছেন বাসের কন্ডাক্টারি। এখন মিনিবাস চালান নিমতা-বেলঘরিয়া-হাওড়ার রুটে। হ্যাঁ, সহকর্মীরা কিন্তু সব সময় পাশে থেকেছেন তাঁর এই লড়াই-এ, সাহস যুগিয়েছেন। তারা কিন্তু পুরুষই। খারাপ স্মৃতি নয়, দুঃখের স্মৃতি নয়— আনন্দের স্মৃতি সম্বল করে বাঁচতে ভালোবাসেন তিনি। তাঁর হাসিতে যে আত্মবিশ্বাস লেগে থাকে তা সকালের নরম রোদের মতো।
ভারতীয় পোর্ট সেক্টরের প্রথম মহিলা কমান্ডার শর্বরী দাস। তিনি কখনোই মনে করেননি যে, তিনি পুরুষের জগতে ব্যতিক্রমী এমন কিছু করছেন যা অতিরিক্ত সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বরং তাঁর মতে নারীরা সকল কাজেই স্বয়ংসিদ্ধা। তিনি নিজেকে পুরুষদের থেকে আলাদা করে কখনোই ভাবেননি। নিজেকে একেবারে একজন সাধারণ অফিসার হিসাবে তুলে ধরতেই বরাবর পছন্দ করতেন তিনি। আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করেই তিনি পেরিয়ে গেছেন জীবনে একের পর এক মাইলস্টোন।
ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল নতুন কিছু করার। সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়েই ভাগ্যের মোড় ঘুরল। চোখে পড়ল এয়ারপোর্ট অথরিটির দমকল বিভাগের একটি কর্মী নিয়োগের একটি বিজ্ঞাপন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানে কখনো কোনো মহিলা কর্মীই নিয়োগ হয়নি। কিছুটা জেদের বশেই আবেদন জানিয়ে বসলেন। অনেকেই কপালে চোখ তুললেন। মেয়ে হয়ে আগুন নেভাবে? তানিয়া, তানিয়া সান্যাল কিন্তু পিছু হটলেন না। একে একে কর্মী নির্বাচনের সমস্ত পরীক্ষা, প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সাফল্যের সঙ্গে সব অতিক্রম করে ভারতের প্রথম মহিলা ফায়ার-ফাইটার হিসেবে ‘এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এএআই)’-তে যোগ দিলেন। পূর্ণ করলেন তাঁর স্বপ্ন। এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেই যোগ দিয়ে থেমে থাকেননি, এখন স্রোতের বিপরীতে তাঁরই মতো হাঁটতে চাওয়া আরও একঝাঁক উজ্জ্বল মেয়েকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি।
জীবন মানেই পরীক্ষা। কিন্তু জীবনকে নিয়ে পরীক্ষা করার সাহস ক’জনের আছে? শুধু পরীক্ষা নয়, জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে জীবনকে আলোকিত করা… সেও কি মুখের কথা? এর সঙ্গে আছে সহ্যশক্তি, সততার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মনোবলের মতো আনুষঙ্গিক বিষয়ও। রূপা চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই কথাগুলি প্রথম মনে আসে। তাঁকে সততার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রতীক বলা যায়। তাঁর কাহিনি শুধুমাত্র মহিলাদেরই নয়, প্রেরণা দিতে পারে যে কোনো লড়াকু মানুষকে। কে রূপা চৌধুরী?
সদ্য ত্রিশ পেরিয়েছেন রূপা। জীবনসংগ্রাম চালাতে গিয়ে সুইগি (Swiggy), ওলা (Ola), উবেরের (Uber) প্রথম মহিলা ড্রাইভার তিনি। ২০১৮ সাল থেকে এই কাজ করছেন। সুইগি ডেলিভারির পাশাপাশি বর্তমানে ওলা, উবেরের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহণের কাজও করেন। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নানান সামগ্রী আমাদের ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পর কাজ করেন যাত্রী পরিবহণের। কীভাবে এতোটা ক্লান্তিহীন হন তিনি? লাজুক হেসে জানান, কাজেই তাঁর মুক্তি। সততার সঙ্গে জীবন চালানোর এক উজ্জ্বল রূপকথা রূপা চৌধুরী।