Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

গ ল্প

ফা ল্গু নী ঘো ষ

falguni

ভিড় ও মায়াপদ্ম

ক্লাবে আজকাল ভিড় বেড়ে গেছে। তিনজনের দল ফুলেফেঁপে উপচে পড়ছে। হিন্দোল, রৌণক আর পিকলু। এরা পাড়াতুতো বন্ধু, আবার এক স্কুলের জুড়িদার। তিনজন মিলে গাছতলায় বসে একদিন আড্ডা দিতে দিতে মনে হয়েছিল স্কুল-টিউশনির বাইরে এরকম আড্ডা মাঝে মধ্যে আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী! মন্দ হয় না! জীবনের প্রথম পরীক্ষা অর্থাৎ দশমের পরীক্ষা এরা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের হক আছে একটু আধটু নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার। এই দলে পিকলুটাই পড়াশোনায় কমজোরি। কিন্তু পিকলুর সাজ, পোশাক কেতাদুরস্ততায় তা বোঝবার কোনো উপায় নেই। পিতৃপ্রদত্ত একটা নাম পিকলুর আছে। সে নাম নিয়ে বন্ধুরা এত হাসি ঠাট্টা করে যে সে নামের প্রাচীনত্ব ঘরের কোণে মুখ লুকোয়। এর চেয়ে পিকলু নামটাই ভালো, স্বয়ং নামের অধিকারীর এটাই মতামত। 

তো, এদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার শখ পিকলুরই সবচেয়ে বেশি। ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু তার সমান সমান। উল্টে মেয়ে বন্ধু একটু বেশি হবে বৈ কম নয়। পিকলুর মেয়ে বন্ধুগুলোকে দেখে হিন্দোল ভাবে প্রায়ই, কী করে যে পিকলু পটায় মেয়েগুলোকে! এদিকে রৌণক চায়, পিকলুর মেয়ে বন্ধুগুলোর দু’একটাকে ভাঙিয়ে নিজের দলে নিতে। এমন পটাবে যেন পিকলুর সামনেই তার বন্ধুনীর দল রৌণকের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কিন্তু চাইলেই কি আর সব আশা পূরণ হয়! বইখাতা, স্কুল, টিউটোরিয়াল, এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি এদেরকে যেভাবে মাপে মাপে ঘিরে রাখে, সেসবের ফাঁক গলে অবসর মুহূর্তের মজা বা গভীর গুরুতর জীবনবোধ কোনোটাই এদের কাছে ঘেঁষতে পারে না। তাও যে পিকলুটা কী করে মেয়েদের মধ্যমণি হয় সেকথা ভেবে ভেবে অন্তরে অন্তরে জ্বলে রৌণক। 

হিন্দোলও ভাবে তার নিজের মতো করে। আড়চোখে দূর থেকে দেখে সুন্দরীদের। তার না আছে আফশোস, না আছে ঈর্ষা। শুধু আছে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যাতীত অস্বস্তি। যে অস্বস্তি তাকে সোজা চোখে তাকাতে দেয় না। কোনো সুন্দরীর চোখে রাখতে পারে না চোখ। অথচ সুন্দর মুখ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মনের মধ্যে অচেনা এক গুবরে পোকা অযথা ভিড় করে। ক্লাব গঠনের প্রস্তাবে হিন্দোলের সায় ছিল সে কারণে সব থেকে বেশি। জোর সওয়ালও করেছিল ক্লাব গঠনের পক্ষে। যদিও রৌণকের সঙ্গে এই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হয়েছিল হিন্দোলের। 

“ওরে দোল দোল! এরকম ক্লাব তৈরি করে লাভের লাভ কিচ্ছু হবে না।” এই ছিল রৌণকের মতামত। হিন্দোলের নাম নিয়েও বন্ধুমহল যথেষ্ট মজা করে। ওর লাজুক স্বভাবের জন্য কেউ ডাকে দোলা, আবার কেউ কেউ বলে দোল দোল! বয়ঃসন্ধিজনিত বড় হয়ে ওঠার চালচলন ঢংঢাং-এ হিন্দোল ততোটাও দুরস্ত নয়! তথাকথিত ছেলেমানুষী স্বভাব বোধহয় তার সহজাত। অবশেষে এই শর্তে ক্লাব গঠন হয় যে, ক্লাবের তিনজন মেম্বার যার যত ইচ্ছে চেনাজানা পরিচিতদের ক্লাবে যোগদান করাতে পারবে। শর্তকে কেন্দ্র করে শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা রৌণক আর পিকলুর মধ্যে। যে যতো পারে সুন্দরী মহিলা বন্ধুদের ক্লাবে সদস্য করতে শুরু করে।  

সপ্তাহে একদিন এদের মিটিং হয়। ক্লাব গঠনের সময় সেরকমই নিয়ম কানুনের লিস্টি তৈরি হয়েছিল। মিটিং-এর দিন মোবাইলের পর্দা জুড়ে শুধু সবুজ বিন্দুর সজীব উপস্থিতি। রঙিন মনভোলানো কিছু মুখ চকিতে জেগে ওঠে, আবার স্তব্ধ হয়। কিছু পরে আবার ফিরে আসে, কোনো কোনো বিন্দু হয়তো আর আসেই না। এসব মুখের অবয়বের উপস্থিতি এখানে জরুরি নয়। হয়ত তারা অবয়বহীন নয়। নয়তো অবয়ব আর বাহ্যিক পরিচয়ের সামঞ্জস্যহীন সে মুখগুলি উজ্জ্বল ধাতব আলোয় জেগে থাকে। আলোকবিন্দুর কেন্দ্রস্থলে সারি সারি সাজানো সুন্দর মুখ হিন্দোলের দৃষ্টিপথে আটকে দাঁড়ায়। মিটিং-এ কী কথা হয় কানে ঢোকে না তার। ইচ্ছেও করে না সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতে।  সুন্দরী মুখে চোখের ইশারা, নিপুণ হাতে আঁকা চোখ ও রাঙানো ঠোঁট, ভ্রু, চুলের রঙ এসব মন ভরে দেখে হিন্দোল। মিটিং ভেঙে গেলে আলোরা ঝুপঝাপ নিভে যায়। নিথর ছবির সারি তখন তারা। মোবাইল দূরে ঠেলে হিন্দোল পড়ার  টেবিলে উঠে যায়। টেনে নেয় বইখাতা। 

পাতার পর পাতা খোলে। খাতার পাতা সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে। খেলতে খেলতে হাওয়ায় অক্ষরেরা উড়ে যায় কাঁধে ডানা নিয়ে। হিন্দোল দেখে। তার চোখের পলকে বয়ে যায় কালো স্রোত। একের পর এক কালো অক্ষরেরা ঢেউ হয়ে ধাক্কা দেয় দৃষ্টিপথে। মাঝে মাঝে সে ঢেউয়ের  চূড়োয় ফসফরাসের মত জ্বলে ওঠে সুন্দর মুখেরা। হিন্দোল স্পষ্ট দেখতে পায়। খাতার পাতায় কালো অক্ষরের স্রোতে যে সাদা ফেনা জমছে, সুন্দরী মুখেরা সে ফেনার অবয়ব পাচ্ছে। ভিজে কাপড়ে শরীরী বিভঙ্গে তিরতির করে  কাঁপছে সে অবয়বগুলি। দেখতে দেখতে নেশা ধরে। গা ঝিমঝিম করে হিন্দোলের। দুলে যায় পড়ার চেয়ার টেবিল। টেবিল ল্যাম্পের সুইচ বন্ধ করে বড় টিউবলাইট জ্বেলে আলোর বন্যা বইয়ে দেয় সে ঘরময়। বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। বুকে ও মুখে চাপা দেয় বই। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। যেন অবয়বগুলি আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে হিন্দোলকে। কানে কানে ফিসফিস করে বলে,  

“ওগো শুনছ! এস, দোল দোল খেলি!”

কান গরম হয়ে ওঠে হিন্দোলের। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয় । দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তার সঙ্গেই বা কেন এরকম হচ্ছে! মেয়েগুলোকে সে চেনে না, জানে না। শুধুমাত্র একটা ভার্চুয়াল ভিড়ের অংশ যারা, যাদের অস্তিত্ব ডিজিট্যাল, তাদের মুখ দেখে এরকম আজেবাজে ভাবনা হিন্দোলের মাথায় আসবেই বা কেন! এরা সবাই আসলে অধরা। এমনকি আসল না নকল তাও জানে না সে। এতো যুক্তির পরে কেন তার মন ভয়ঙ্কর মাদকতায় মেতে উঠছে! বেশ কিছুদিন থেকে পড়াশোনা যেন তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। টপ টপ করে দু’চোখ থেকে জল ঝরে তার। সে অশ্রু বই-এর কালো অক্ষরেরা শুষে নেয় নিজের ঠোঁটে। 

এদিকে তার প্রাণের বন্ধুরা চায় ভার্চুয়ালের অবয়বগুলি রিয়ালে নেমে আসুক। কিন্তু হিন্দোলের মন সায় দিতে গিয়েও দিতে পারে না। দুলে যায় আশঙ্কার দোলায়— ভার্চুয়াল সুন্দরী মুখের অধিকারিণীরা যদি সত্যিই বাস্তবে আসে! কী হবে তখন তার! সে নিজেও নিজেকে জানে না! ভরসা করতে পারে না আজকাল নিজেকে!

এখন ভরপুর শীতকাল। হিন্দোলরা যে আবাসনে থাকে সেখানেই ভিতরের দিকে একটি বাচ্চাদের খেলার পার্ক আছে। একপাশে কোয়ারি করা শীতকালীন ফুল। গাঁদা, গোলাপ, জিনিয়া, সূর্যমুখী ডালিয়ার বাহার। সামনেই সবুজ মাঠে রঙ বেরঙের সোয়েটার টুপির কচি মালিকেরা ঠিক ফুলের মতোই ফুটে থাকে প্রায় দিনভর। ইদানীং এখানে এসেই বসছে  হিন্দোল। ঠিক এখন এই মুহূর্তে তার কোনো বন্ধু নেই। রৌণক, পিকলু তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে ক’দিন বিশ্রাম চাইছিল। কিন্তু পিকলুরা বুঝতে চায় না। তর্কাতর্কি হতে হতে শেষে গ্রুপ লিভ করল হিন্দোল। এসবই হয়েছে সেদিনের পিকনিকের পর থেকে। 

সবে দিন চারেক আগের কথা। শহরাঞ্চলে আজকাল জমাটি শীত তেমন পড়ে না কয়েক বছর ধরে। এ বছর সেসব রেকর্ড ভেঙে বেশ নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে উত্তুরে হাওয়া। হিন্দোলদের আবাসনের পক্ষ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয় প্রতি বছরই। কিন্তু অফিশিয়াল ব্যস্ততার জন্য এদের পরিবারের যাওয়া হয় না। এবার বাবা-মায়ের অবসর ও পিকনিকের তারিখ-সময় সহাবস্থানে আসায় সকাল ছ’টা থেকেই হাঁকডাক শুরু হয়। রাত জেগে পড়াশোনা করার অভ্যাস থাকায় হিন্দোল ভোর ভোর উঠতে পারে না কখনোই। ফলত পিকনিক যাওয়ার সময়ের কথা শুনেই হিন্দোল বিরক্তি বোধ করে। তাও বাবা মায়ের সঙ্গ ছাড়ে না। পিকনিক বলে কথা। স্বভাবতই ভোর ভোর উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আধা ঘুমন্ত অবস্থায় সে পৌঁছে যায় সবুজবনের ধারেকাছে। 

“কী হিন্দোল, জায়গাটা কেমন লাগছে বল! আমিই পছন্দ করেছি এই প্লেস!” মুখার্জী আঙ্কেলের গমগমে গলায় চমক ভাঙে হিন্দোলের। এই আঙ্কেল বেশ বন্ধুর মতো সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তার বাবার মত রাশভারী, কম কথা বলা কেজো মানুষ নয়। এমনিতেই এ পিকনিকে তার কোনো জুড়িদার বন্ধু নেই। ফলত মুখার্জী আঙ্কেলের সাহচর্য তাকে স্বস্তি দেয়। পড়াশোনা কেমন চলছে, ফিউচার প্ল্যান কী, এসব টুকরোটাকরা কথা বলতে বলতে আশেপাশে পা চালিয়ে দেখছিল হিন্দোলরা। 

ঘন সবুজ বনের ভিতরে লাল কাঁকুরে মাটি, এবড়ো খেবড়ো নুড়ি বিছানো পথ। সে পথ ধরে ছোট্ট সবুজ বন পেরিয়ে গেলে নাকি ওদিকে একটা টলটলে জলাশয় আছে।

“বুঝলি হিন্দোল! জোরে জোরে শ্বাস টেনে নে! এত তাজা বাতাস তো শহরে পাবি না!” মুখার্জী আঙ্কেলের আকুতি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে হিন্দোল। শ্বাস নেয় আর তন্ময় হয়ে দেখে, গাছপালা পাতালতাকে জড়িয়ে ধরে রোদ ঝুলে আছে পথের উপরে। আলতো চুমু খেয়ে হাওয়ায় পাক দিয়ে উঠছে ধুলোর রেখা। যেন এক গভীর প্রেমের আলেখ্য লেখা হচ্ছে নরম রোদেলা চিঠির পাতায়। অনাবিল আনন্দে মন ভরে ওঠে তার। 

পথের পাশে বসে পড়ে সে। রোদ মাখে গায়ে। হাওয়া আর ধুলোর রেখায় আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলপনা আঁকে জীবনের। সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে বসে। ভুলে যায় নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কথা। মনে মনে কৃতজ্ঞ হয় মুখার্জী আঙ্কেলের কাছে। এতক্ষণ বেশ একা একাই ঘুরছিল। নিজের গহীনে প্রবেশ করে ভুলেই গিয়েছিল আঙ্কেলের কথা। হঠাৎ সামনে থেকে পুরুষালি কণ্ঠের উদাত্ত গান ভেসে আসে। হারিয়ে যাওয়া ঘন সবুজের মধ্যে পুরুষালি গলার সঙ্গতে ভেসে আসে তীক্ষ্ণ সুরেলা নারী কণ্ঠও। প্রবল কৌতূহলে উঠে দাঁড়ায় হিন্দোল। পায়ে পায়ে এগোতে থাকে। 

কিছুটা এগিয়ে দেখে মুখার্জী আঙ্কেলের পাশে টাটকা তাজা এক সুন্দরী কিশোরী। পা আটকে যায় হিন্দোলের। আর যেন পা বশে নেই। মুখার্জীবাবু হিন্দোলের অস্বস্তি উপলব্ধি করে সাদরে টেনে নেন তাকে, “আরে! লজ্জা পাচ্ছিস নাকি! ও তো আমার মেয়ে দেবমৌলি! আমরা মলি বলেই ডাকি…।” এই বলে মলিকে হাঁক দেন, “কই? এদিকে আয় রে মলি। হিন্দোলের সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দিই।”

মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ায়। হিন্দোল আড়চোখে দেখে। চকচকে মার্বেল পালিশের মতো গায়ের রঙ। গাঢ় কাজলের প্রলেপ দেওয়া নেশাধরানো চাউনি! ঠোঁটটা কী লাল! রক্তের মতো। যেন মাংসল জীবনের হাতছানি! ধারালো পালিশ করা হাত আর নখ নিয়ে মেয়েটি এগিয়ে আসে বন্ধুতার সৌজন্যে।

হিন্দোলই তা গ্রহণ করতে পারে না। প্রচন্ড এক অস্বস্তিতে মুখ নামিয়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। উদভ্রান্তের মত এক ছুটে এসে গাড়িতে বসে। গাড়ির সিটে মাথা রেখে এলিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ সময় এভাবে যায় পেরিয়ে। সাময়িক অস্বস্তি কাটে হয়ত, কিন্তু সে ভঙ্গি, সে মুখ, অবয়ব অত সহজে হিন্দোলকে রেহাই দেয় না। 

তারপর থেকেই দেবমৌলির সুন্দর মুখ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। আগে পড়ার টেবিলে, নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে শুলে সুন্দর মুখগুলো তাকে আঁকড়ে ধরত। শিরশির করে উঠত সমস্ত রোমকূপ। অস্বস্তি হত তার। নিজেকে নিয়ে নিজেই লজ্জিতও হত। শাসনও করত নিজেকে। কিন্তু আজকাল অন্য স্তরে পৌঁছে গেছে এ অস্বস্তি। এখন মাঝে মধ্যেই তার গা গুলিয়ে ওঠে। ঘরের দেওয়াল জুড়ে সবুজ ঘন অন্ধকার নেমে আসে প্রায়শই। সে অন্ধকারের উৎসে এক সুতীব্র সুন্দরী অনিঃশেষ জড়িয়ে ধরে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। ঐ অন্ধকার থেকে একছুটে আলোর দিকে মুখ ফিরে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়। হাওয়ায় আঙুল ছুঁইয়ে রোদেলা ধুলোর আলপনা আঁকতে মন চায়, ঠিক যেমন পিকনিকের দিন সকালেই এঁকেছিল। নিজের অন্দরমহলের ভয়ানক অস্বস্তি ভুলে থাকার জন্য হিন্দোল পার্কে বসে রঙ বেরঙের ফুলেদের ফিসফাস কান পেতে শোনে। আবাসনে বাচ্চাদের পার্কে বসে সে প্রহর গোনে, যদি আবার কোনো রোদের চিঠি খাম খুলে তার কাছে ভেসে আসে। 

“বুঝলি হাঁদু, কাল তোকে আরো উত্তরে তিরপিতা নদীর ধারে নিয়ে যাব!”

“ম্যাজিক মামু! আবার তুমি আমাকে হাঁদু বলছ!”

“হা হা হা…” উদার প্রশস্ত গলায় হাসে হিন্দোলের ম্যাজিক মামু। সস্নেহে মাথার চুল ঘেঁটে দেয় তার আদরের হাঁদুর।

ম্যাজিক মামুর একটা নাম থাকলেও লোকে হয়ত ভুলে গেছে।  মিসেস বোসের আপন ভাই সে নয়। পড়শি ভাই বলা যায়। পড়াশোনা শেষ করে গ্রাম ছেড়ে কোথাও গেলই না। সোনাটিয়া অবশ্য ঠিক গ্রাম নয়, গঞ্জ এলাকা। এই এলাকা এবং আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে কার ঘরে মানুষ অসুস্থ, তাকে ডাক্তার বৈদ্য দেখানো, কার বাড়ির ছেলেমেয়ের পরনে কাপড় নেই, কে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে মাঠেঘাটে গোরু চড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে ধরে এনে বইমুখী করা– এসব নিয়েই মেতে থাকে ম্যাজিক মামু। ঘরের মানুষের কাছে এসব বড় বিরক্তির। তারা বলে, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’। কিন্তু সোনাটিয়া অঞ্চলে সে বকলমে ম্যাজিক মানুষ। ম্যাজিক করে সবার মুখে হাসি ফোটায়। 

হিন্দোল ছোট্টোটি থেকেই দেখেছে ম্যাজিক মামুকে হাতসাফাই-এর খেলা দেখাতে। তার মামারবাড়ি আসার অন্যতম আকর্ষণ আজও ম্যাজিক মামু। অবশ্য ছেলেবেলার হাতসাফাই আজ আর নেই। বদলে চেনা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ম্যাজিক মামু কীরকম নতুন নতুন অচেনা দারুণ সব জায়গায় নিয়ে যায় হিন্দোলকে। সেসব জায়গা এলাকার ধারেপাশেই, তবু কেউ কোনোদিন খোঁজ রাখেনি। 

মিস্টার আর মিসেস বোস আর কোনো উপায় না খুঁজে পেয়ে ছেলেকে মামারবাড়ি রেখে এলেন। কিছুদিন থেকেই ছেলেটার পড়াশোনায় মন নেই। চোখমুখ শুকনো। ঘরে থাকতে চায় না। কী যেন এক দমবন্ধকর অবস্থা থেকে সে মনে মনে মুক্তি চাইছে। প্রথমে মা ভেবেছিল, ছেলের উঠতি যৌবনের সমস্যা বুঝি। মন উড়ু উড়ু। মেয়েদের সঙ্গে ঘুরতে চাইছে। এইটাই তো বয়েস দু’চারটে মেয়েবন্ধু জোটানোর। সুতরাং ততোটা আমল দেননি তিনি।

কিন্তু ছেলের বাবা যেদিন বলল সন্ধের ছায়ায় পার্কের আধো আলো আঁধারে ছেলে একা একা বসে আছে, সেদিন বুকের পাঁজর দম ধরে এসেছিল মায়ের। এ আবার কেমন ধরণ! হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ-ফুর্তি কিছুই নেই। কেন এতো অবসাদ ছেলের! জীবনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে এই কচি বয়সে! এই বয়সে কি এত গভীর প্রেম হয় যে এতো অবসাদ আসবে! এ সমস্যা প্রেমঘটিত না হলে আরো গভীর ভাবনার বিষয়। অথচ ছেলেকে কিছু জিজ্ঞাসাও করা যায় না। অনেক ভাবনাচিন্তা করে বাবা-মা ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে। সেখানেই জানতে পেরে তারা অবাক হয়। ভিড়, হৈ-হট্টগোল, ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা এসব থেকে জোর করেই দূরে থাকতে চায় তাদের ছেলে! সব শুনে বাবা মা’র চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। এই বয়সের একটা ছেলে জীবন থেকে পালাতে চাইছে কেন! কী এমন মানসিক রোগে তাদের ছেলে আক্রান্ত! কীভাবেই বা এর সমাধান হবে ভেবে কুল পায় না হিন্দোলের বাবা-মা। 

এদিকে মুখার্জী বাবুর থেকেও মিস্টার এবং মিসেস বোস জানতে পেরেছেন, সেদিন পিকনিকে হিন্দোলের হজমের কোনো সমস্যাই হয়নি। মুখার্জীবাবুর মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় ছেলে! ছেলের বাবা ডাক্তার কনসাল্ট করে। মা রাত্রে ঘুমোতে গিয়েও বিছানা ছেড়ে ছেলের ঘরের পর্দার আড়াল থেকে ছেলেকে দেখে যায়। দেখে ঘরে আলো জ্বলছে, আর ছেলে উপুড় হয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। বোঝবার উপায় নেই ঘুমোচ্ছে কি না! এদিকে পড়াটাও হচ্ছে না। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কোনো পথ থাকে না! সব শুনে ডাক্তারের পরামর্শ ছিল, ছেলের মনের আনন্দ যাতে তাই করুন। ছেলেকে একা থাকতে যেন না দেওয়া হয়। বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে আরো ভালো। সেইমতো ক’দিনের জন্য মামারবাড়ি পাঠানো হয়েছে হিন্দোলকে। 

অবশ্য মামারবাড়ি আসতে ছেলেকে সাধতে হয় না। ম্যাজিক মামুর টান অপ্রতিরোধ্য। ম্যাজিক মামুর সঙ্গ পেলেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো। এবারের আগ্রহ তিরপিতা নদী। সোনাটিয়া এসে এই নামটা শোনার পর থেকে হিন্দোল যেন নিজেকেই ভুলে গেছে। একদিনেই কী ভীষণ হালকা আর ফুরফুরে লাগছে হিন্দোলের নিজেকে। কাল তিরপিতা নদী। আবার নতুন জায়গা, অচিন এক নদী। কে জানে সে কেমন! উত্তেজনায় ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায় তার। সকালের জলখাবার খাওয়া শেষ হতে না হতেই ম্যাজিক মামুর সাইকেলের ঘন্টি ক্রিং ক্রিং সুরে তাড়া লাগায়। একলাফে ছোট্ট হারকিউলিস সাইকেলটিতে চড়ে বসে হিন্দোল। 

লাল উড়ু উড়ু রাস্তা। পাশেই সে রাস্তার সঙ্গী ক্ষীণ এক জলধারা। ম্যাজিক মামুরা বলে, ‘কাঁদর’।  কাঁদরের দু’পাশে সবুজের মেলা বসেছে। চোখেরও আরাম। মনে মনে অধীর হয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে সে, “কী গো মামু, তিরপিতা নদী কখন পৌঁছাব?” 

“আরে হাঁদু , অতো ব্যস্ত করলে হয়! তিরপিতা এক আশ্চর্য নদী। সে নদীর ঘর-বসতে না আছে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি, না আছে কারো হৈ-হট্টগোল! চারদিকে শুধু পাখিদের কিচিরমিচির আর গাছপালার ঢলাঢলি।” 

উত্তেজনায় আরো জোরে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ পড়ে। ফলত শীতের দিন হলেও যুবক সূর্যের তেজে কপালে, চুলের রেখায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে দুই অসমবয়সী পুরুষের, তবু উৎসাহে ভাটা পড়ে না। শুধু একটু শিথিলতা আসে পায়ে। দু’দন্ড বসতে ইচ্ছে করে এদের। ততক্ষণে নড়বড়ে এক আদ্যিকালের লোহার সেতুর বুক চিরে সাইকেল গিয়ে থেমেছে আরো গভীরতর জঙ্গলের কিনারে। সে গভীরতায় সাপের চেরা জিভের মত দুটি রাস্তা গহীন সবুজকে দু’দিকে বিচ্ছিন্ন করেছে। পায়ে চলা হিলহিলে রাস্তা। সেই রাস্তার একটি হেলতে দুলতে সোজা গিয়ে বিঁধেছে তিরপিতার কুমারী হৃদয়ে। অপর রাস্তা  চলে গেছে মা চন্দ্রময়ীর পাহাড়িয়া থান।

অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে হিন্দোলের। অকারণেই রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠছে। শিউরে উঠছে শরীর। পায়ে চলা ঢালু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সজীব লতার মত কিশোরী তিরপিতা নদীর সঙ্গে হিন্দোলের প্রথম পরিচয়। তিরপিতা এক তিরতিরে নদী। তার কাকচক্ষু জল। যেন ঘন সবুজের একটুকরো টলটলে হৃদয় একটু দেখা দিয়েই আবার নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে গহীনের গোপনে। 

“হি হি হি… তু একেনে কেনে… অ বাবু…”

তীক্ষ্ণ নারী কণ্ঠের ঝঙ্কার বিস্ময়ের চমক ভাঙায় হিন্দোলের। এখানেও মেয়ে! সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে হিন্দোলের পুরুষ সত্তা। চমকে ফিরে চায় সে। চকচকে তামাটে বর্ণের খোদাই করা চলমান এক নারীমূর্তি। তিরপিতা নদীর কিনারে কোমরে টুকরি বেঁধে হেলেঞ্চা, কলমি শাক তুলছে। গাছ কোমর আঁটোসাঁটো শাড়ি হাঁটুর প্রান্তসীমায় জলের ঢেউ-এর তালে দুলছে। মাথায় পিঙ্গল কেশরাশির চূড়ো। সে চুলে একটি নরম আলোর মতো পদ্মফুল গোঁজা। গায়ে কোনো বাহারি ব্লাউজ নেই, নেই মেক-আপ, লিপস্টিকের রঙ বাহার। গলায় ঝুটো পুঁতির মালা নেমে এসেছে উদ্ধত যৌবনের দ্বারপ্রান্তে! বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকে হিন্দোল। 

হাঁদুর দিকে একঝলক চেয়ে ম্যাজিক মামু বলে, “আরে! ও হলো বাহা! সরল, সিধা বড় ভালো মেয়ে! তুই এখানে দাঁড়া, আমি নীচে নেমে ওর থেকে চাট্টি টাটকা কলমি শাক চেয়ে নিয়ে আসি…”

মামু হাঁক দেয়– “কি রে বাহা! কলমি শাক দিবি না চাট্টি…”

“হঁ রে বাবু ! লিঁয়ে যা। কথো আছে।” হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে সে। ম্যাজিক মামু যে তাদেরও ম্যাজিক বাবু। তাই মামুকে কষ্ট করে নীচে নামতে হয় না। বাহা-ই নদীর কিনার থেকে পারে উঠে এসে কলমি শাক দেয় ম্যাজিক মামুর হাতে, আর হিন্দোলের হাতে দেয় জল থেকে তোলা সদ্যোজাত একটি পদ্মকুঁড়ি। 

ঐ ঘটনার দু’একদিন পরেই হিন্দোল বাড়ি ফিরে আসে। টনক নড়েছে ছেলের। পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে মামারবাড়ি ঘুরে বেড়ালে– মা বাবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির এটাই উত্তর ছিল। জোর কদমে শুরু করে স্কুল, টিউটোরিয়াল। রৌণক-পিকলুকে ডেকে বলে, “চল, একটা আড্ডা হয়ে যাক। ক্লাবের সব মেয়েগুলোকে ডাকিস কিন্তু! কে কতো স্টাইলিশ আর সাজুনে দেখতে হবে না!” 

হিন্দোলের এই পরিবর্তনে বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মা খুশি হয়। ছেলেকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সব ভুলে যদি ছেলেটা ভালো থাকার মনোবল পায় নিজের মধ্যে তো সেই ভালো। বন্ধুরা বেশ কিছুদিন বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলে না। হিন্দোলের মা-বাবা আড়ালে আবডালে তাদের বারণ করে দেয়। 

হিন্দোল এখন পার্কে যাওয়ার সময় পায় না। পার্কের পাশ কাটিয়ে আসতে আসতে আড়চোখে দুলন্ত ফুলগুলোকে দেখে সে। তারপর মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে নিজের পড়ার টেবিলে ফেরে। ফিজিক্সের সূত্র, কেমিস্ট্রির ইকুয়েশন, অঙ্কের তত্ত্ব পেরিয়ে ক্লান্তি এলে তার ঘরের আদুরে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোয়। কখনও অন্ধকারে ঘ্রাণ নেয় পদ্মবীজের। কখনও ফটফটে দিনের আলো, না হয় টিউবলাইটের আলোয় অপলক চেয়ে থাকে দেওয়ালে ফুটে থাকা পদ্মফুলের দিকে। কী সরল, নিষ্পাপ, অমোঘ সে টান। অথচ শরীরে কোনো অস্বস্তি হয় না। ভালোলাগায় মন ভরে যায়। সমস্ত ক্লান্তি কেটে নতুন করে যেন প্রাণ ফিরে পায় হিন্দোল। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে তিরপিতা নদীকে। হাসতে ইচ্ছে করে ফুলের সঙ্গে। বাহা যে ফুলের মতোই সুন্দর আবার ভাস্কর্যের মতো অমূল্য। এ সৌন্দর্য মোহিত করে কিন্তু অস্থির করে না।

হিন্দোল আজকাল মোহিত হয়েই থাকে। তার নিজের পড়ার ঘরের দেওয়ালে সে একটি পদ্মদিঘি এঁকেছে। ক্লান্তি এলে, মন ভালো না থাকলে তার একান্ত আপন পদ্মদিঘির পারে গিয়ে বসে সে। হাজার ভিড়ের মাঝে অনিঃশেষ চেয়ে থাকে পদ্মমায়ার টানে। যতো ভিড় জড়ো হয় তাকে ঘিরে, ততোই সে মায়াপদ্মের টানে বুঁদ হয়ে থাকে…  টান বাড়তেই থাকে… বাড়তেই থাকে…

আরও পড়ুন...