কে তা বি ক থা
মিথ ও মাশরুমের শহরে
শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশক: ধানসিড়ি
১০০ টাকা
কবি শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়ের এই দু’ফর্মার বইটি যেন এক স্বপ্নচারণ। পুরনো কলকাতা আর নতুন কলকাতার দ্বৈরথ চলতে থাকে এই বইয়ের ছোটো ছোটো লেখাগুলিতে। বইটি সমাপ্ত হবার পরও রেখে দিতে ইচ্ছা করবে না, বরং মনে হবে আবারও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি বৃষ্টির কলকাতা, সন্ধের কলকাতা, রাতের কলকাতা। যে সব নস্টালজিয়া আমাদের মধ্যে এখনো কাজ করে পুরনো কলকাতাকে ঘিরে, তার সব কিছুই প্রায় মানসভ্রমণ করিয়েছেন কবি। সবগুলি লেখা পড়বার পরে মাথায় রয়ে যাবে মন কেমন করা গ্যালিফ স্ট্রিট, কলুটোলা, বাগবাজারের ঘাট অথবা ঝাঁ-চকচকে সেক্টর ফাইভ, নিউটাউন। এইভাবেই কবি কলকাতার গন্ধ, রূপ তুলে এনেছেন সেই সময় থেকে আজকের ধারাবাহিকতায়। সাবেকি, আটপৌরে দিনগুলোর মাঝে আটকে যেতে ইচ্ছে করবে বারবার।
‘কলকাতার কোনখানে ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা হয়?
বাংলা মদের সঙ্গে মারিজুয়ানার আড্ডা হোক
তরল আগুন ঘোরে হাত থেকে হাতে, এসে দেখি গ্লাস হাতে মিটিমিটি হাসছেন ঋত্বিক ঘটক’
(খালাসিটোলা)
এই কবিতাটির সঙ্গে যে কোনো বাঙালি নিজেকে একাত্ম করে ফেলতে পারবেন, সে তিনি খালাসিটোলা যান বা না-ই যান। সুনীল-শক্তি, কমল মজুমদার খ্যাত এই স্থানটির মাহাত্ম্য এমনই যে এই লেখাটি সেই সময়কার আমেজ ধরে রাখতে পেরেছে। অথবা এই বইয়ের ‘ভিক্টোরিয়ার বাগানে’ কবিতাটি দেখে নেওয়া যাক। কোনো এক মেঘলা দিনে ভিক্টোরিয়ার সামনে বা ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে লেখাটির আসল মাধুর্য।
‘আকাশ মেঘলা হলে, পরিটির মনখারাপ হয়
পরিযায়ী পাখিদের মতো সে-ও ডানা ঝাপটিয়ে
একপাক ঘুরে নেয়, উড়ে যাবে… বাগানের ঘাসে কিন্নর-কিন্নরী বসে, এর হাতে ওর মুঠো নিয়ে’
এইভাবেই মনকেমন, মনখারাপ হাত ধরাধরি করে এসে জড়ো হয় কবিতার লাইনগুলির পাশে। আর, এইভাবে স্মৃতিমেদুর করে তুলতে তুলতেই কবি সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমাদের এনে ফেলেন আধুনিক, স্মার্ট কলকাতার অলিগলিতে। প্রাচীনত্বের পোশাক খুলে যে কলকাতা আজ দাঁড়িয়ে আছে ‘চিকেন ফ্রায়েড চুমু’, ‘সামনে ধোঁয়া-ওঠা হুক্কাবার’-এর আহ্বান নিয়ে। সে কলকাতাকেও ঘুরেফিরে দেখতে দিব্বি লাগে। এই কলকাতা আজ জানে ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি’র কথা। আজকের কলকাতার যুবক প্রেম শুরুর প্রথম দিন থেকেই জানে কীভাবে মোবাইলে ‘ট্রায়ো রুম’ বুক করে সে ‘একটানে খুলে দেবে/ বান্ধবীর পাতার পোশাক’…। এই কলকাতাকে ছুঁয়ে দেখতে নিষিদ্ধ এক লোভ হয়।
তবু সব ক’টি কবিতা পড়বার পরে শেষমেশ আশ্রয় নিয়ে ফেলতেই হয় কখনো চোখে না দেখা, অথচ আজকের দিনে দাঁড়িয়েও প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা কলকাতার সমস্ত পুরনো দিনগুলির কাছে। ‘নিমতলা’ হোক বা ‘কেওড়াতলা’, জীবনের এই অন্তিম পর্বের দিকে আসার আগে যদি একবার ফিরে তাকিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে অমোঘ এই পঙক্তিগুলো মনে রয়ে যাবেই—
…‘ধ্বংসের দিনেও এসে দেখি বিষণ্ণ রবীন্দ্রনাথ গান লিখছেন ভোররাতে’