খে লা ই ডো স্কো প
‘হো’ শব্দের উৎপত্তি ‘হোরো’ থেকে, যার অর্থ ‘মানুষ’। ‘হো’ পূর্ব ভারতের একটি সল্প পরিচিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিম বাসিন্দা এই জনগোষ্ঠী কোল নামেও পরিচিত। সিংভূমের কোলহান অঞ্চলে ছিল এদের বাস। ‘কোল-হান’ শব্দের অর্থ কোল-স্থান। অর্থাৎ কোলদের বাসস্থান। এখন এরা মূলত ছড়িয়ে আছে ওড়িশার কেওঁঝাড় ও ময়ূরভঞ্জ জেলায়। এছাড়া ঝাড়খণ্ডের কিছু জেলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে আছে এ সম্প্রদায়ের মানুষ। হো ভাষা ‘খেরওয়ারী’, অস্ট্রো-এশিয়াটিক শ্রেণীভুক্ত। কোল বিদ্রোহে (১৮৩১-৩২) সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হো জাতির মানুষ এক সময় সুপরিচিত ছিল তাদের লড়াইয়ের দক্ষতা ও দূরদর্শিতার জন্য। প্রায় চার প্রজন্ম আগে একটি দল ময়ূরভঞ্জ থেকে চলে এসেছিলো পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে তারা শুরু করেছিল স্থায়ী চাষবাস।
একসময় হো’দের জীবন ছিল জঙ্গল নির্ভর, কিন্তু এখন বেশিরভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা চাষবাস ও পশুপালন। তাদের একটি অংশের দেখা পেয়েছিলাম পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায়। বেশ কয়েকটি গ্রামে অন্যান্য জাতির মানুষের সাথে বাস হো দের। স্বভাবতই হো সংস্কৃতির অনেকটাই হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে। তবু এরা ধরে রাখতে পেরেছে তাদের নিজেস্ব কিছু খেলা, যা হো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য।
বৌ মারি
এই খেলাটিতে থাকে দুটি দল। একটি দল থাকে একজন বৌ। সেই দলের বাকিদের দায়িত্ব এই বৌ কে রক্ষা করা। খেলার সময় অপর দলের সদস্যরা বৌকে ধরার চেষ্টা করে। এ সময় তাদের স্বাস-প্রস্বাস ধরে রেখে কিত্ কিত্ বলতে বলতে এগিয়ে যেতে হয় বৌ এর দিকে। খেলোয়াড় যদি বৌকে ছুঁয়ে ফেলে তাহলে সেই দলের পয়েন্ট। না ছুঁতে পারলে বৌ পক্ষের পয়েন্ট। এভাবেই খেলা এগিয়ে যেতে থাকে।
অনেকটা এরকমই একটি খেলা দেখা যায় ঝাড়খণ্ডে বসবাসকারী হো দের মধ্যে। তার নাম ‘বহু /বৌ চুরি’ । অনেকে মনে করেন বৌ চুরি খেলাটি রামায়ণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সীতার অপহরণের একরকম ক্রীড়া রূপ। তবে অন্যভাবে দেখলে এই খেলার মধ্যে দিয়ে প্রতিরক্ষা ও অপহৃতকে উদ্ধারের দক্ষতা বোঝানো হয়। এই খেলায় অংশ গ্রহণ করে
চোদ্দ জন। সাত জন করে দুই দলে ভাগ হয়ে যায় তারা। এই খেলার জন্য একটি আয়তাকার ক্ষেত্রে তৈরি করে নেয় ছেলে মেয়েরা। তবে যে কোনো আয়তকার মাঠেও খেলাটি হতে পারে। এই ক্ষত্রের এক প্রান্তে থাকে দুটি বৃত্ত। তার একটিতে থাকে বৌ, বা যে খেলোয়াড়কে বৌ সাজানো হয়েছে সে। অপর বৃত্তটিতে থাকে বৌ পক্ষের সদস্যরা। তারা অপেক্ষা করে। বিপরীত দলের সদস্যরা তখন মাঠে বা আয়তকার ক্ষেত্রটির মধ্যে ঘুরতে থাকে। বৌ পক্ষের সদ্যরা ইশারা পেলে দম বন্ধ করে পৌঁছবে বৌয়ের বৃত্তে। যথারীতি এই কাজটি সম্পূর্ণ করতে বাধা দেবে অপর পক্ষ। যদি ধাবমান খেলোয়াড়টিকে ছুঁয়ে দেয় প্রতি পক্ষ তাহলে সে খেলা থেকে বাইরে চলে যায়, মানে আউট। উল্টো দিকে যদি দম বন্ধ অবস্থায় প্রতিপক্ষের কেউ সামনে চলে আসে ও তাকে ছুঁয়ে দেয় তাহলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় আউট। বৌ এর কাজ হলো প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করা।
মাংস চুরি
এই খেলাটি দেখেছিলাম ডেবরার একটি গ্রামে। এর জন্য উঠোনে ছটি খোপ বা চৌকো কাটা হয়। মাঝের খোপটিতে একটি পাথর রাখা হয়। এটি আসলে মাংস। বাকি খোপ গুলোতে খেলোয়াড়রা থাকে। তারা চোর। প্রত্যেকেই সেই পাথরটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একজন খেলোয়াড় পাহারাদার সাজে। তার কাজ হলো চোরেদের হাত থেকে মাংস রক্ষা করা। যদি কোনো চোর বা খেলোয়াড় পাথরটি নিতে পারে তাহলে তার পয়েন্ট। আর যদি পাহারাদার চোরটিকে ধরে ফেলে তাহলে সেই খেলোয়াড় আউট। এই খেলাটি হো সম্প্রদায়ের মানুষের শিকারের দক্ষতাকে প্রমান করে। ছোটবেলা থেকেই নানান খেলার মাধ্যমে গড়ে ওঠে জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা। ছেলেমেয়েরা সব খেলাতেই একসাথে অংশগ্রহণ করে এবং উপভোগ করে।