মু ক্ত গ দ্য
যে কথাগুলো লিখতে বসেছি, তারাই নিজে নিজে আমার কাছে এসেছে। আমিও যে তাদের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি বহুকাল ধরে নিচ্ছি সে কথাও মিথ্যে নয়, কিন্তু ওদের তর সইলো না। আর এসে এমন তোলপার বাঁধালো যে, আঙুল থেঁতলে আজ একটা রক্তারক্তি কাণ্ড না বাঁধিয়ে ছাড়বে না বুঝে খানিক ভয়েতেই তড়িঘড়ি লিখতে বসা! জমে থাকা কথা বেরোনোর পথ খুঁজলে কেমন একটা বুকে পেটে জ্বালা ধরে না? তেমন। কথাগুলো কবিতার মত শারীরিক। সে জিনিস আমি কেবল পড়তেই পারি, লিখতে পারি না! কাজেই যা লিখছি তার না আছে সৃজন-মস্তক, না আছে সাহিত্যের মুণ্ডু। না আছে তার গদ্যরূপ, না আছে কাব্যধর্ম। কেবলমাত্র নিজের শরীরকে শান্ত করার প্রয়োজনে এই কয়েটা কথার দলা ছুড়ে দিলাম…
একান্ত মনে এবং একক সত্তায় একটা লেখা পড়তে বসলে তবেই কি কেবল পাঠক হয়ে ওঠা যায়? তবে কি পড়ার পরতে-পরতে দুম করে এই যে রান্নাঘর থেকে চা-টা বা পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে আলুটা-চিনিটা আনতে গেলাম, অথবা বৈঠকখানায় টিভির পর্দায় মেসি-জাদুর ঝড়ের মধ্যেই হঠাৎ মনে পড়া কোনো কবির এক ছটাক পঙক্তিই যখন আমায় স্বপ্ন আর জাদু-বাস্তবতার মধ্যিখানের পানাপুকুরে নোঙর করে রাখলো অনেক্ষণ, সেবেলা আমার কি আর শুদ্ধ পাঠক হয়ে ওঠা হল না? কিন্তু সে কথাটা ঠিক করছে কে? আমার সঙ্গে সে লেখার ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার মালিকানা কার হাতে? বাজার নাকি নিসর্গ? যুক্তি নাকি আবেগ?
বন্ধুবান্ধবরা এ-নিয়ে মাঝেমধ্যে ঝগড়া করি বটে, গলাও হয়তো এক-আধবার সপ্তমে চড়ে যায়, কিন্তু তেমন মাঝি কই যে সৃজন-ভবের পাড়ে এ প্রশ্ন-তরী ভিড়িয়ে আমাদের শান্ত করে? সে প্রশ্ন নিয়ে এই যে আমাদের কথায় কথায় চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি, হপ্তা হপ্তা কথা, বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন, ঘুরেফিরে সবই শেষমেশ সে জ্বালারই প্রগলভ বিচ্ছুরণ! কোথায় সে পাঠক? কে সেই পাঠক? যার এতটুকু আদর-ছোঁয়ায় রাতবিরেতের আঁধার-কোনে একলা-মনে জমতে থাকা বদ্ধ-গলার কান্না-দলা শান্ত হবে?
গুরুজনেরা জানেন হয়তো সত্যিটা কি। কিন্তু আমার শরীর-মনের ভাবনাগুলো বিড়বিড়িয়ে কানের কাছে তাদের মত মন্ত্রনা জুগিয়ে বলে, কোথাও একজন আছেন যিনি বাজারের বাইরে বসে আমার লেখার ক্ষনজন্মা প্রভাব পেরিয়ে তাকে মহাকালের চোখ দিয়ে বিচার করেন, আর আমিও লিখি সে পাঠকের জন্যেই। আমায় অনর্থক ও বড্ড বেশি আশাবাদী ভেবে নেওয়াই যায়, তবে তার মানে এই নয় যে আমি বলছি তিনি এই সমাজের বাইরের লোক। বলতে চাইছি সমাজ মাধ্যম,গণমাধ্যম, শহর, মফস্বল, ককটেল, মাছের-বাজার, বন্ধু, শত্রু, গুরুজন সবাইকে মিলিয়ে-মিশিয়েও এই পাঠকটির এক ও অদ্বিতীয় স্পর্শনাতীত অস্তিত্ব থাকতে পারে। সঙ্গীত আর গদ্যের মাঝে কবিতার মত, বাজার আর নিসর্গের মাঝে সাহিত্যের মত, আবেগ আর যুক্তির মাঝে মধ্যবিত্তের মত, বেগ আর ভর-বেগের মাঝে অনিশ্চয়তার মত, কণা ও তরঙ্গের মাঝে দৈত্বতার মত, সৃষ্টিশীলতা আর পাগলামির মাঝে একটা সরু সুতোর ভারসাম্যহীনতায় তাঁর সেই একান্নবর্তী যাপন। তাঁর দেখা পাওয়ার তৃষ্ণাই আমার লেখার মূলধন, আমার রাস্তা; আবার তাঁর দেখা পেয়ে গেলেই আমার সৃজন-সত্তার মৃত্যু অবধারিত! তিনিই আমার খুড়োর কল, আমার রূপ সাগরের মনের মানুষ, আমার লিপিবদ্ধ বিভ্রম!