Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

কে তা বি  ক থা

অ নি র্বা ণ   চৌ ধু রী

anirban

যবনিকা পতনের পরেও হাজারবার

পতাকার বদলে দিগন্ত

বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়

প্রকাশক: এবং অধ্যায়

প্রচ্ছদ: সুপ্রসন্ন কুণ্ডু

২০০ টাকা

“সব গোলাপি কম্বলে চাপা দিয়ে/ প্রত্যেকে দেখিয়েছিল এতকাল/ গাঞী, গোত্র, মেল/অর্থাৎ মার্জিত পরিভাষার সুন্দর যবনিকা/ যবনিকা কম্পমান। দেখে যান বার্ট্রাণ্ড রাসেল।”

        নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার ‘নীরক্ত করবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘যবনিকা কম্পমান’ কবিতায় এমনটাই একদা লিখেছিলেন। কবিতায় কি আদতে কোনও ক্লাইম্যাক্স বা যবনিকা পতনের কোন প্রয়োজন আছে? জানি না। তবে বাস্তব জীবনের রঙ্গমঞ্চে কিছু কিছু মুহূর্তে সত্যিই এমন অনেক ব্যাপার ঘটে যায়, যাকে কখনও সখনও সেই মুহূর্তের চরমতম ক্লাইম্যাক্স হিসেবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে। আর জীবনের সেই রঙ্গমঞ্চে বহুবার যবনিকা পতনের পরেও হাজারবার কান পাতলে যাঁর কবিতার এক একটি লাইন বারবার মনে পড়ে যায়, বারবার নতুন করে ভাবিয়ে তোলে, তিনি শ্রী বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।            

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হয়তো এখন দেখতে পাচ্ছেন যে বাস্তবের উলঙ্গ রাজারা দিব্যি দিনের দিন প্রতি মুহূর্তে এখন কীরকম দ্রুত নিজেদের পোশাক পাল্টে নিচ্ছেন। ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিজেদের ক্রমশ বাম থেকে ডান দিকে, পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের সর্বত্র। সত্যিই তো কে এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রশ্ন করবে – “রাজা তোর কাপড় কোথায়?” আর বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় ‘উলঙ্গ রাজা’ প্রকাশিত হবার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও বাংলা কবিতায় তুলে ধরছেন সেই একই সমাজচিত্র। কলকাতার যীশুরা যেখানে ছিল সেখানেই এখনও রয়ে গেছে। তাই বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কবিকে এই সময়ে দাঁড়িয়েও লিখতে হচ্ছে – “পিয়ানো মাথায় রেখে ঘুমিয়ে গেছেন সরস্বতী/ দু তিনটে লুম্পেন মিলে চুরি করে নিয়ে গেল বীণা/ সে বীণার তার যদি বিক্রি হয় মল্লিকবাজারে/ পাগলু ড্যান্স করে যদি কিছু বখশিস পাওয়া যায়” (শূন্যতা যদি না পিছু ডাকে)। সরস্বতীর বীণা সত্যি করেই যেন চুরি হয়ে গেছে, আর বাস্তবের সেই উলঙ্গ রাজারা বসে আছেন সাজানো মঞ্চের ওপর, পোশাকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছেন নিজেদের আসল চেহারা, সত্যিই তো তাঁরা কীভাবে সবার সামনে নিজের মুখ ফুটে সত্যি কথা স্বীকার করবেন? তাঁরা তো আদতে সেজেগুজে বসে রয়েছেন রাজার পোশাক পড়ে!

২০২২ সালে চোদ্দোতম চুঁচুড়া বইমেলায় ১৮ ই ডিসেম্বর ‘এবং অধ্যায়’ প্রকাশনার পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয় বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘পতাকার বদলে দিগন্ত’। বইয়ের প্রথম অংশ ‘শূন্যতা যদি না পিছু ডাকে’ অংশটি কয়েকটা ছোট ছোট কবিতার সমগ্র সংকলন। শূন্যতা আসলে হলো একখণ্ড বাস্তব, কিন্ত স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক – এই দুই বর্তমানের মধ্যবর্তী এক অবিমিশ্র প্রেক্ষাপট। এ কথা স্বাভাবিক, যে শূন্যতা আমাদের পিছু ডাকবেই, তার হাত থেকে কারুরই নিস্তার নেই। সেই জন্যই আমরা কবির কাছ থেকে এরকম স্তবক উপহার পাই – “একটা ভালো শ্যাম্পু পেলে পরিষ্কার হয়ে যাবে সব/তেমন পুরুষ পেলে মেয়েরা উঠিয়ে নেবে চিক/মেথর উঠিয়ে নেবে শহরের সব আবর্জনা/ যদি না ড্রেনের মুখ আটকে রেখে ঘুমোয় প্লাস্টিক”। এই অংশটুকু যেন একুশ শতকের সভ্য নাগরিক সমাজের মুখে সপাটে কষানো একটা বিরাশি সিক্কার চড়! অথচ কী শান্ত, ধীর, স্থির তার স্বভাবচরিত্র। ‘বাতাসে বুলেট, ঘরে হাসি, মজা, গান…’ – এসব শব্দের ভিতরেও যে শব্দ ক্রমাগত আমাদের কানের ভিতর কোথাও নিঃশব্দে বাজতেই থাকে। “না এ কোনও শিল্প নয়, কেবলই না পাওয়ার অসুখ/বলামাত্র সুর একশো শব্দে ফেটে গিয়ে বলে ওঠে -/ বেসনে চোবালে পরে যদি সুখ তাহলে প্রতিভার টিপছাপ অসুখ; সেই অসুখের দিব্যি করে বলো শিল্প কাকে বলে – / ভরা জোছনায় যদি ফোটাতে না পারি সূর্যমুখী?” যে যার রসদ কিনতে বাজারে যাক, আলুপটলের দরদাম নিয়ে ব্যস্ত থাকুক; পেটপুরে চর্বচষ্য, লেহ্যপেয় খেয়ে নিন্দেমন্দ করতে করতে তারা বাড়ি ফিরে যাক! আমরা বরং নিশ্চিন্তে সেই সূর্যমুখীর চিত্রকল্পে নিলাম হই নিজস্ব ব্যথাগুলোর কাছে।

“আমি কি ওদেরই মতো ছবি দেখতে গিয়ে চেয়েছি নিটোল গল্প, জটিলতাহীন/তাহলে আমাকে তুমি কখনও বোলো না – / চুল কেন সাদা – কালো, চাদর রঙিন” – সবাই আমরা তো সেরকমই জটিলতাহীন নিখুঁত জীবন পেতে চাই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে চেষ্টা করি নিটোল সুন্দর, কালিমাহীন করে তুলতে। কিন্ত আদতে জীবনকে এই গড়পড়তা ছকে বাঁধতে গিয়ে কখন যে বিছানার চাদরের রং ফ্যাকাসে হতে থাকে, তা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা প্রত্যেকেই ভেবে পাই না কোন দিকে যাব? কোন দিকে আদতে পা বাড়ানো উচিত? আসলে আমরা এইভাবেই এক একটি সুসজ্জিত মিথ্যের মোড়কে একটা সুশীলবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি যেখানে আমরা নিজেরাই দিশাহীন। কবি সামান্য একটা স্তবকে এই সহজ সত্যিটা আমাদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেন, কী লাগে সেই নিটোল গল্প খুঁজতে গেলে? সেই মিথ্যের মোড়কে চাপা পড়ে যাওয়া সত্যিকে খুঁজতে গেলে? সে প্রশ্নের উত্তর কবি নিজেই আর একটি অসামান্য স্তবকে বিবৃত করেছেন খুব সাবলীল স্বীকারোক্তির ভাষায় –“আমার তো শুধু তুমি থাকলেই চলে/যুদ্ধে বা বিপ্লবে, জলোচ্ছ্বাসে, দাবানলে/গাড়ির তলায় থাক চার চারটে চাকা/আমার শরীরে দিও তোমার পতাকা”। কী অকপট স্বীকারোক্তি!

“বাঘ শিকারের জন্য তৈরী করা মাচা যখন মাটিতে ভেঙে পড়েছে, তখন সামনেই বাঘ আর বাঘের গর্জন/ জল স্থল অন্তরীক্ষ বিপর্যস্ত করে চলেছে, জঙ্গল ছেড়ে, কলকাতা শহরে/কলকাতা যদি কল্লোলিনী তিলোত্তমা/সেখানে কি বাঘ পেতে পারে কোনও ক্ষমা” – ভীষণ কঠিন প্রশ্নের মুখে এবার বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড় করালেন আমাদের। বিশেষ করে সেই সভ্য নাগরিক সমাজকে, যাদের কথা একটু আগেই বলছিলাম। এর উত্তর যদিও তিনি এই কবিতার শেষ তিন লাইনে নিজেই দিয়েছেন। তবুও এ কথা আমরা সকলে সহজেই অনুমান করতে পারি যে, মানুষই যখন এই শহরের বেপরোয়া আইনকানুন থেকে রেহাই পায় না, সেখানে বাঘও যে ক্ষমা বা নিস্তার কোন কিছুই পাবে না – সেটা বলাই বাহুল্য।। কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্যের এই বিপুল ঐশ্বর্য্যের শহর বাঘের শরীরকে ঝাঁঝরা করবেই, ধাপার মাঠে চামড়া ছাড়িয়ে দেহটা ভাসাবে গঙ্গায়, আর সেই চামড়া একদিন চড়া দামে বিক্রি হবে কোন নামী অকশন হাউসে। যার বিবরণ আজীবন লেখা থাকবে বাংলা কবিতায়, যতদিন বিনায়কের মতো কবিকে আমরা পাব। আর এই একুশ শতকের কল্লোলিনী কলকাতা শহরকে নিয়ে বিনায়ক আবারও লিখলেন – “স্মৃতির ভিতর কোনও পাঁচিল থাকে না/ সবাই সবার হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে/ দিন আনি, দিন খাই, নিরুত্তাপ থাকি/ কারণ গ্যাসের দাম আমার শহরে জেব্রার গলার মত উঁচু হয় শুধু/ আজ বাড়ল আরও একটু বেড়ে যাবে কাল/ আমার সমস্ত সংকল্প বুকে করে এগোলো ধাপার দিকে, গাড়ি ও জঞ্জাল….”। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষাতেই এই প্রসঙ্গ শেষ করি – “যদি ধরা যাক এসবের কিছুই না থাকে, সন্দেহ হবে না, না থাকাকে/ সম্পূর্ণ হবে কি কলসি ভরা, শূন্যতা যদি না পিছু ডাকে?” শূন্যতা পিছু ডাকবেই, প্রকৃতির নিয়মে, আমরা শুধু বুঁদ হয়ে শুনতে থাকবো ঘুমপাড়ানি গান, শিখব শরীরের মধ্যে মন থাকলে মন কীভাবে শিখে নেয় শরীর আর মনের ব্যাকরণ।

 

বইয়ের দ্বিতীয় অংশ ‘নাম লিখেছে গাড়ির কাচে’ কয়েকটি আলাদা আলাদা কবিতার সংকলন। এই অংশের কবিতাগুলোয় কবি একটু অন্য আঙ্গিকে তুলে ধরলেন সেই একই প্রেক্ষাপট। প্রেম থেকে প্রতিবাদ, কলকাতার দৃশ্য থেকে বিদেশনীতি সবকিছুই মিলেমিশে এক করে দিলেন এক আত্মস্বীকারোক্তিমূলক পরিভাষায়। ‘সর্বত্র’ কবিতায় বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর কলকাতাকে মিশিয়ে দিলেন দক্ষিণ কলকাতায়, রক্ত আর টিয়াপাখিকে মিশিয়ে দিলেন মাটি আর পাতার সবুজে, বুঝিয়ে দিলেন তেল আর জলের দূরত্ব। ‘প্রতিক্রিয়া’ কবিতায় আবারও তুলে ধরলেন সাম্প্রতিক কলকাতা শহরের একটি অন্য দিক সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে –“গুপ্তচরেরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে/ আর ওদের স্বপ্নের ভিতর নেমে আসছে যে সব ঝিল/ এখন টোডি, আগরওয়ালা, ঝুনঝুনওয়ালার”। ঘণ্টা নাড়লে যে কুকুরটার খিদের চোটে মুখ দিয়ে লালা ঝরত, তাকে পাহারাদারের কাজ দিলেই বরং আমরা ভালো করতাম। সত্যিই কি কেউ এসে সব প্রশ্নের মধ্যেও চার আঙুল জিভ দিয়ে চার আঙুল জিভকে বন্ধ করে দিতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যখন বইয়ের পাতা আরও ওলটাচ্ছি তখন সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া একটি সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আমেরিকার মানচিত্রে ‘একটি শিশুপাঠ্য কাহিনী’ কবিতায় দেখলাম সেই খাস দক্ষিণ কলকাতার কবিই হাতিয়ার করে তুললেন নিজের ভাষাকে স্বকীয় মহিমায় প্রতিবাদস্বরূপ –“আমি ওর কথার কোনও উত্তর দিতে পারি না/ কেবল হাওয়ায় আঙুল চালিয়ে আঁকতে চেষ্টা করি আমেরিকার মানচিত্র; লক্ষ লক্ষ মাইল গমক্ষেতের পর আরও লক্ষ লক্ষ মাইল গমক্ষেত/ চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যে গম ওরা জাহাজসুদ্ধু আটলান্টিকে ডুবিয়ে মারে/ বুলবুলিদের খেতে দেয় না”। আবার এই কবিই কী অবলীলায় ফিরে এলেন সেই প্রতিবাদকে প্রেমের মোড়কে ‘অপূর্ব সেই ফুলটি’ কবিতার শেষ দু’লাইনে – “ভুলেই যাব ভালোবেসেছিল কবে/ অপূর্ব সেই ফুলটি সেদিন আমার হবে”।

 

এবার আসা যাক বইয়ের একদম শেষ অংশে, ‘যবনিকা পতনের পরেও হাজারবার’। যেখানে দু’টি দীর্ঘ কবিতায় বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও সম্পূর্ণ নতুন ভূমিকায় আবারও তুলে ধরলেন এক টুকরো চারপাশকে। সব ডাইমেনশন থেকেই – যতগুলো ডাইমেনশনে একটা আদর্শহীন, মৃতপ্রায়, দিকভ্রান্ত সময়কে তুলে ধরা যেতে পারে – “অসম্ভব! বস্তুবিশ্ব বৈপরীত্যে বলীয়ান/ চোখ নিজ অন্ধকার ভিতরে ধারণ করে/ গা এলানো হিংস্রতাকে সোফা কাম বেড দিয়ে আপ্যায়ন করে না সে। পরান্মুখ সব বোধ…”। কনট্রাস্ট! বৈপরীত্যই জীবনের মূল ধর্ম। যে কারণে আমরা প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকটি আলাদা সত্তা, যাকে বলে এনটিটি বা বলা ভালো প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে এই বাস্তবের দুনিয়ায় প্রতিদিন কোনোরকমে টিকে আছি। কবি তাই লিখতে বাধ্য হন – “আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে ওঠে/ আমতা আমতা করতে থাকে যেন ফাঁদে পড়া কোনও বগার নিঃশব্দ কান্না, ওদের মত তো নয়, উঁচু মানসিকতার দলে নাম লিখিয়েছি”।

“আত্মাই অ্যালার্ম ঘড়ি, বালিশ পিছনে রেখে নিজের ধোঁয়ায় যদি বানাই নিজের র’চা/তুমি কি চুমুক দেবে? না দিলেও জেনে গেছি সপাটে থাপ্পড় খেয়ে শিস দিতে দিতে হাঁটা/এর বেশি পৃথিবীকে দেওয়ার কিছু নেই” – সত্যি এই বিপুল পৃথিবীকে আর কীই বা দেবার আছে আমাদের? এক একটি মহাজাগতিক বিপন্নতার মধ্যে কত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমরা ঝগড়া করি, আলুপটলের দাম কমলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই, “চাকুর চুম্বন লাগে পাঁঠার প্রথম রাঙে/মালিকের গলা শুনে কুকুরের ঘুম ভাঙে”। অঙ্কের হিসেবের বাইরে ব্যাপ্ত ইউনিভার্সের একটি ছোট কোণায় একটি সামান্য জন্তু হিসেবে আমরা নিজেরা বেঁচে আছি নিজেদের নিজস্ব গল্পে – “গল্পের স্বভাবে গল্প চরিত্র বানিয়ে নেবে/ দেবগণ, নরগণ সব হবে জনগণ/ মাছের বাজারে আমি যদি কপকপ করি/ আমাকেও জ্যান্ত ভেবে কিনে নিয়ে গৌড়জন।” হায় হতভাগ্য জীবন! সত্যিই তো –“কী হবে আত্মা দিয়ে? কোন গাব জ্বাল দেব? আত্মার ভিতরে নেই ক্রমবিকাশের বীজ”। তার থেকে বরং “দু’পা এগোনোর পর তিন’পা পেছোতে বলে সে কেবল। চাই না তাকে। বরং তোমার ওই মাটিরঙা গোলার্ধের টানে আমি ভেসে যাই, একটা চটি ফেলে আসি সবকটা জাহান্নামে…”!

 

বইয়ের নামকরণ যে কবিতার নাম দিয়ে, একদম পরিশেষে আসে সেই কবিতাটি – ‘পতাকার বদলে দিগন্ত’। “বিরামহীন স্মৃতিশক্তির ভিতর জেগে উঠলে তুমি, আমার একমাত্র দুর্বলতা –ওগো ভুলে যাওয়া/আমি কেমন করে আদর করি তোমায়”। চিরাচরিত কবিতার ধারাকে ভেঙে নতুন ছন্দে কবি শুরু করলেন এই কবিতা, যাতে সেই একই স্বপ্রতিভতায় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক কলমে এঁকে চললেন সেই জাদু পৃথিবীর বাস্তবতার দৃশ্য যে ভিতরের সিমেন্ট খুলে জেগে উঠছে সুন্দরী কঙ্কালির বেশে। ভয়ংকর সব ইমারতে বেড়ে উঠছে স্মৃতিশক্তি, রাস্তার গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির জলে যেখানে আকাশেরও মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবুও ভবিতব্য আমাদের ধাক্কা দেবেই, একটা কিনলে আর একটা ফ্রিয়ের আশায় আমরা সম্মোহনের সঙ্গে ছলনা, আন্তরিকতার সঙ্গে দুরভিসন্ধি আর দীর্ঘশ্বাস আর দমের কষ্টে ভর্তি নোয়ার নৌকায় উঠে পড়েও মাঝপথে আর নামতে পারবো না। সমুদ্রের জলে কেবলই নুন, নাটকে কেবলই সংলাপ, ঈর্ষায় শুধুই হীনমন্যতা, ক্যামেরায় শুধুই লেন্স থেকে যাবে। আর কবি সবশেষে সেই লেন্সের শাটারে আঙুল রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরবেন সেই ধ্রুব সত্যের চিত্রকল্প – “নেটওয়ার্ক না থাকলেও পাখির ডাক/ কবরের মধ্যেও নাগরদোলা/ উন্নয়নের হৃদয়ে জলাজমি/ ধর্ষিতার আত্মায় শ্যামা/ পুঁতে রাখা হাড়গোড় ফুঁড়ে মানুষ/ পতাকার বদলে দিগন্ত/ পরিবর্তনের পরেও পরিবর্তন”।

আরও পড়ুন...