ধা রা বা হি ক । পর্ব ৪
একটা খোলা দরজা মুহূর্তের মধ্যে মনে একটা আনন্দ, একটা সম্ভাবনার হাওয়া বইয়ে দিতে পারে। দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে দেখি একটা বাগানে একজন অসুস্থ বৃদ্ধা বসে আছেন। গাছেদের সান্নিধ্য তাঁকে সুস্থতা এনে দেবে এই বিশ্বাসে তিনি বাগানে বসে আছেন।
ভাগ্যিস আমি এই বাড়ির মূল দরজা খোলা পেয়েছিলাম, এবং ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলাম। না হলে এই মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির একটা যৌথ সঙ্গীতের যে আয়োজন চলেছে তা জানতেই পারতাম না। দরজা খোলা পাওয়া, এবং দরজা খুলে কেউ ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে, এ একেবারে গানের মতো আনন্দ। যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে— একজন সুন্দর বা সুন্দরীর বা সাধকের বা একজন কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্যে— তার মনের অবস্থা সেই প্রবেশের মুহূর্তে কী হতে পারে তা ভাবি। নিশ্চয়ই সেই দরজা পেরিয়ে যাওয়া সাক্ষাতকারীর মনে তখন হঠাৎ পাহাড় দেখার আনন্দ হয়, অথবা দরজা পেরোলেই এক অগাধ নীল জলরাশি ও নীল জলরাশির সৈকতে ঝাউবন ও ঠান্ডা বাতাসের ছোটাছুটি।
কিন্তু কারোর মনের দরজা খোলা পেলে আমার সবচেয়ে খুশি লাগে মন। একধরণের শান্তি আসে মনে। যেন হঠাৎ ‘মন্দিরে মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা, দয়াময় দেবতার নামে…’ এইরকম মনে হয়। যে মানুষের মনের দরজা সবার জন্য খোলা, তাকে মানুষ বেশি পছন্দ করে, এটাই স্বাভাবিক। আমি কী ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই মনোভাব নিয়ে নিজের মনের দরজা সবার জন্য খুলে রাখি? রাখি না হয়তো। কারণ এই সমাজের এই পাড়ার সকল মানুষকে আমার ভালো লাগে না। যেমন, আমাকেও সবাই পছন্দ করেন না বলেই, সকলেই তাঁর মনের দরজা আমার জন্যে খোলেন না। এবং এটাই স্বাভাবিক। তবু অন্যজনের মনের দরজা খোলা পেলে, বা এমনটা আমি পেতে চাইছি, কিন্তু অপরপক্ষ দরজা খুলছেন না— ভেজিয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন— তখন আমরা সকলেই ব্যথিত হই। মনের এই ব্যথা, এই বেদনা থেকেই সুরের সৃষ্টি, কবিতার জন্ম, এই অভিমান থেকেই প্রেম আরো তীব্র হয়ে বিকেলের রাস্তায় এলোমেলো পায়চারি করে!
যে বাড়িতে যতো দরজা, সে বাড়ির ততো ছন্দপতন। যেমন আমাদের বাড়ি। অহেতুক অনেক দরজা, ফলত অনেক ছন্দহীনতা, তার ফলে আমাদের বাড়ির কেউ শ্লোকের মতো বা পয়ারে কথা বলে না। সকলেই টানা গদ্যে জীবনযাপন ও নিত্যের রুটিনমাফিক গান গায়। তবু অনেক দরজার একটা সুবিধাও আছে। এ দরজা অতিথির জন্য বন্ধ তো, ওই দিকের দরজা খোলা আগত আত্মীয়ের জন্য, প্রিয়জনের জন্য। নানান দরজার নানান মন। আমি খেয়াল করে দেখেছি। সিঁড়ির দরজা একটু গায়ক টাইপের, কারণ তাকে পেরোলেই ছাদ, এবং বিপুল আকাশের সমুদ্র। ফলত আমাদের ছাদের সিঁড়ির দরজা অনেকটাই উদার উদাসীন ও বাউল টাইপের। সে সবসময় একতারা হাতে আকাশ-প্রবেশের পথে প্রবল সুর নিয়ে যেন গাইছে।
বাড়িতে ঢুকতেই যে দরজা, সে অনেকটাই সাবধানী। একটু কিপটেও। সহজে সে নিজেকে খরচ করতে চায় না। সে সজাগ, সে সন্দেহবাতিক। বাড়িতে কেউ এলেই, সে ‘কে কে’ করে সন্দিহান প্রশ্ন ছুড়ে দেবে, যে এলেন আমাদের বাড়িতে, বাড়ির প্রথম দরজার হাজার প্রশ্নেই – তাঁর ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছেটা চলে যায়। আমি বুঝি। আমাদের বাড়িতে ঢোকার যে প্রথম দরজা, তারও দোষ নয়, কারণ তার হাতে একটা প্রবল ওজনের তালা ঝুলছে সবসময়। আর আমরা তো জানিই, যে তালাচাবি মানেই, সন্দেহ – অবিশ্বাস! সেই সন্দেহের তালাচাবি নিয়ে বেচারা ‘প্রথম দরজা’ জীবনে কোনোদিন ‘উদার’ ও ‘প্রেমিক’ হতে পারল না, সে চিরকাল ‘প্রহরী’ হয়েই জীবন কাটাল আমাদের সঙ্গে।
ওইরকম কঠিন কঠোর আমাদের বাড়িতে ঢোকার প্রথম দরজাকে আমি মাঝে মাঝে কবীর সুমনের গান শোনাই। ‘আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই’ ‘শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই’ তাকে শোনাতেই তার সব স্থবিরতা কেটে যায়। রুক্ষতা ক্রুরতা চলে যায়। সে তখন উদার উদাস মাঝি যেন। সেও ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই’ ‘দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই’ বলে উদাত্ত গেয়ে উঠল । আমি তাকে জিগ্যেস করি, তুমি কাকে চাও গো ‘বাড়িতে ঢোকার প্রথম দরজা?’ সে কিছুতেই তার মনের ‘তোমাকে’-র কথা বলল না। সে যখন গাছ ছিল, সে যখন এক বিশাল অরণ্যের বাসিন্দা ছিল, সেই অরণ্যের ধারে ছিল এক ঝর্না, সেই ঝর্নায় আসত এক গ্রাম্য তরুণী— সেই তরুণীই বোধহয়, আমাদের বাড়ির প্রথম দরজার প্রেমিক ছিল! কিন্তু সে কিছু বললে না। সে শুধু লাজুক হাসল। ‘আমাদের বাড়ির প্রথম দরজা’কে এই প্রথম আমি হাসতে দেখলাম। তাকে এখন, আজ আর প্রহরী লাগছে না, তাকে আমার প্রবল প্রেমিক বলেই মনে হচ্ছে। আসলে দোষ আমাদের। আমরাই ‘আমাদের বাড়ির প্রথম দরজা’-কে প্রেমিক হতে দিইনি, উদার হতে দিইনি। আমরাই ওকে ‘সন্দেহবাতিক— অবিশ্বাসী’ করে গড়ে তুলেছি। এও আমাদের এক সংস্কার, এও এক অলিখিত ডিসিপ্লিন আমাদের হয়তো।
সেদিন দেখলাম— এক বাড়ির দরজায় লেখা আছে, ‘অবনী বাড়ি আছে, আপনি এখন তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন!’ এরকম ‘প্রিয় বন্ধুর মতো দরজা’ আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমার সঙ্গে অবনীর আলাপ নেই, তবু সে বাড়ি আছে। এবং তার সঙ্গে যে কেউ দেখা করতে পারে, এমন আহ্বানে আমার ভিতরের নানান দোষে দুষ্ট, মনের দরজাও হঠাৎ খুলে গেল। অহংহীন ব্যাপক আকাশের মতো সেই মনের দরজার খুলে যাওয়া। আমার খুব হাল্কা লাগল, এবং আমিও নিজের ভিতরের খোলা দরজা নিয়ে, অবনীর বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করি— আরো খোলা মনের একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলব বলে। ভিতরে কেউ এস্রাজ বাজাচ্ছে, ভিতরে ফুলের সুগন্ধ, ভিতরে কেউ খোলা আকাশের ধ্যান করছে, নীরবে, অথচ তার মন সবাইকেই কাছে পেতে চায়। আসলে বাইরের খোলা দরজা দেখেই বোঝা যায়, ভিতরের মানুষেরাও খুব খোলা হাওয়ার গান জানে।
আমাদের বাড়ির সবচেয়ে রসিক ও খোলা মনের দরজাটি হল, আমাদের রান্নাঘরের দরজা। তার মুখে সবসময় হাসি, কোনো অভিযোগ কোনো বিদ্বেষ নেই। কোনো ক্ষোভ নেই তার। সে রান্নার সুবাস ও স্বাদের মতোই সদা হাস্যময় ও সদা খুশি। আমাদের রান্নাঘরের দরজা খুব ভোজন রসিকও, সে অন্যকে খাওয়াতেও খুব ভালোবাসে। দরদী মন তার, স্নেহ ও মায়ায় ভরপুর। অন্যকে ভালোবেসেই তার সুখ, অন্যকে কাছে পেয়েই তার আনন্দ।
অনেক দরজা দেখা যায় না। সে অদৃশ্য দরজা। সবাই মিলে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চাই, কিন্তু সে তো আছেই জেনে— আমরা দেখবো এমন আশায় বেঁচে আছি চিরকাল। কিন্তু সে মেঘে মেঘে নিজেকে আড়াল করে রাখল। সে ধ্যানের উপাসনার দরজা অল্প একটু খুলে রাখল, কিন্তু পুরো খুলল না, ফলে সম্পূর্ণ করে তাঁকে আর পাওয়া হয় না আমাদের। আমরা ওই নিবিড় ভালোবাসার পাহাড়চূড়াটিকে কাছে পেতে চাই, তাকে চাই আপন করে পেতে। কিন্তু সে এক অদৃশ্য দরজার আড়ালে রয়ে যায়, আর আমাদের তাকে পাওয়ার ইচ্ছে আরো প্রবল বেড়ে যায়, আমরা তাঁর অদৃশ্য দরজা খোলার জন্য শিশুর মতো কেঁদে উঠি। কিন্তু তাঁর সেই জয়যাত্রার দরজা একটু খোলে আবার খোলেও না। এ এক পাওয়া— না পাওয়ার মজা— এও এক সাধনভঙ্গী আমাদের।
মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর দরজার প্রয়োজন হয় না। মানুষ সবচেয়ে সংকীর্ণ, সবচেয়ে অবিশ্বাসী ও সন্দেহপ্রবণ এবং লাজুক। তাই তার দরজার প্রয়োজন। মানুষ খুব লাজুক ও অভিমানী বলেও হয়তো তার দরজার দরকার। কারো ওপর অভিমান হল তো, দরজা বন্ধ করে সে কাঁদল অনেকক্ষণ, তারপর গান শুনল রবীন্দ্রনাথের। তারপর চোখের জল, অভিমানের জল মুছে সে আবার দরজা খুলে বাইরে এলো, বাইরে নীল নির্মল আকাশ। অল্প ঠান্ডা বাতাস বইছে, সে দেখল দরজার বাইরে একটা নাম না জানা পাখি এসে বসেছে তার প্রিয় টগর গাছের ডালে। টগর গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় সেই অচেনা ছোট্ট পাখি যেন জলতরঙ্গের মতো গাছতরঙ্গ বাজাচ্ছে। এখন তার আফশোস হচ্ছে, সে কেন দরজা বন্ধ করেছিল একা হওয়ার জন্য! ভাগ্যিস দরজা খুলেছিল বলেই তো, সে দেখল ও শুনল পাখির গাছতরঙ্গের বাজনা!
পৃথিবীর কোনো দরজা নেই, সে উদার উন্মুক্ত ও বিশাল। সমুদ্রেরও কোনো দরজা নেই, সেও বিশাল ও ব্যাপক। এই ছোট্ট পাখিটিরও কোনো দরজা নেই, সে দরজাহীন— আকাশময় এক তীব্র গান ও শুশ্রুষা। সে ঝেঁপে বরষা ও ভালোবাসার বরিষণ, পালকে ডানায় যেন তার খোলা গীতবিতানের পৃষ্ঠা উড়ছে।
ক্রমশ