ধা রা বা হি ক । পর্ব ৬
রূপে মোহিত কে না হয়? সে শুধু নর বা নারীর রূপ নয়, আমি তো জলের রূপেও মুগ্ধ হয়ে যাই।
‘রূপ’ এক পাখি যেন, যুগযুগান্ত ধরে ‘রূপ’ পাখির মতো উড়ে চলেছে মন থেকে মনে, বিস্ময় থেকে আরো কোনো গোপন বিস্ময়ের দিকে। রূপে তোমায় ভুলেছি বলেই তো আমি এমন উদাস, আনমনা। মন পড়ে থাকে তোমার রূপের নানান সত্যের ছটার দিকে, তোমার রূপের নানান ইশারার দিকে! অমন নিবিড় ও স্নিগ্ধ রূপ তোমার, আছে বলেই, আমি ভাবি– এ অশ্রু নদী সাঁতরে পার হয়ে যাব একদিন– ‘আনন্দ’ তোমার কাছে।
এই যে রোদের রেখা এসেছে পড়েছে আমাদের সংসারে– এই রোদের রেখার মধ্যেই তো তাঁর ‘রূপ’ ও রূপের ঐশ্বর্য আমাদের মুগ্ধ করে, এবং এই মুগ্ধতা নিয়েই আমরা তোমার ‘রূপ’-রাস্তায় হেঁটে চলেছি অনেকদূর যাবো বলে।
অনেকদূর আমরা যাই না, কাছে কাছেই আমরা একে ওপরকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছি। এই জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকার মধ্যেও এক লুকনো ‘রূপ’ আছে, আমরা তা বুঝতে পারি। এই একসঙ্গে– সুখ ও দুঃখের সাথী হয়ে আমরা আছি– কারণ এক রূপবান বা রূপবতী ‘অভিমান’ ও রূপবান বা রূপবতী ‘আনন্দ’– নদীর মতো ভিতরে ভিতরে বয়ে যায় আমাদের মধ্যে, আমাদের সংসারে। তোমার রূপের এক স্নিগ্ধ বাতাস বয় আমাদের মধ্যে, আমরা বুঝতে পারি, টের পাই।
ক্রোধের যেমন এক ‘রূপ’ আছে, জয়ের যেমন এক ‘রূপ’ আছে, তেমন পরাজয়ের মধ্যেও এক বিশাল রূপের ছটা আছে।
পরাজিতের যে ‘রূপ’ তা অনেকটা গানের মতো, যে গান শোনা যায় না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তা অনুভূত হয়। পরাজিতের রূপের আলো গোপনে পরাজিতকে বাজায়, আলোকিত করে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়– বিভূতিভূষণের ‘দৃষ্টি প্রদীপ’ উপন্যাসের কাছে।
‘রূপ’ আসলে, অরূপের মধ্যেই লুকোনো থাকে। অরূপের ভিতর থেকে রূপকে ভালোবেসে, স্নেহে, আন্তরিকতায় কাছে টেনে নিতে যে জানে, সে সুখী। সে অপ্রচারের আনন্দিত সাধক।
রূপের পিপাসা সকলের মধ্যেই আছে। যার মধ্যে রূপের তৃষ্ণা নেই, সে অভাগা। শিশুটি বিরাট বটগাছ দেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছে– বটের শাখাপ্রশাখায় কত সবুজ পাতা– কত অজানা পাখিরা সেখানে থাকে– শিশুটি অবাক– বটের এই নানান সুরের ‘রূপ’ দেখে। সে স্বপ্নে ডুবে যায়।
নদী বয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে তো কে জানে? তবু নদীর এই বয়ে যাওয়ার ‘রূপ’ দেখে এক অভিমানী তরুণী আনন্দে কেঁদে ফেলে, সেও নদীর এই বয়ে যাওয়ার– এই রূপের সঙ্গে যেতে চায় অজানায়, অচেনায়। সে নদীর রূপে ডুব দিয়ে ডুব দিয়ে নিজেকে খুঁজে পায়, সে নদীর ‘রূপ’ দিয়ে চোখের জল মোছে, চেয়ে থাকে পাড়ের দিকে, দিগন্তের দিকে।
দিগন্তের যে ‘রূপ’ তা বড় মন কেমনের। দিগন্তে তরুণীর বাল্যকালের হারিয়ে যাওয়া বালক বন্ধুটি আছে বোধহয়, সে কল্পনা করে। দিগন্তে নিশ্চয় দীর্ঘশ্বাসেরা থাকে না। সেখানে যারা থাকে তারা মেঘের রূপে মুগ্ধ। মেঘেরা ‘কে চলিতে পারে সহজ লোকের মতো!’ – সেইভাবে সহজ লোকের রূপের মতো মেঘেরা দিগন্তে হাঁটে পায়চারি করে, গান গায়, বালিকা মেঘের রঙিন ফ্রকের দিকে অবাক চেয়ে থাকে।
কুৎসিত, তার প্রবল ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে এসেছিল আমাদের বাল্যবিধবা বড় পিসিমার কাছে। আমাদের বড়পিসিমা কোনোদিনই রূপবতী ছিলেন না। কিন্তু তার আন্তরিক ব্যবহারের ‘রূপ’ ফুলে ফুলে ভরা এক করবী গাছের মতো।
কুৎসিত, বড় পিসিমার স্নেহভরা স্নিগ্ধতার ‘রূপ’-এর কাছে নতজানু যেন। তার ঘৃণা ক্রোধ হিংসা পরশ্রীকাতরতা কে যেন চোখের জল মোছার মতো মুছে দিল নিমেষে। কুৎসিত রূপবান হয়ে উঠল। কুৎসিতের ভিতর এক মহাজগতের বিরাট ‘রূপ’-এর আলো জ্বলে উঠল।
‘রূপ’ আসলে আমাদের মনেই থাকে। বিভিন্ন মন, ভিন্ন ভিন্ন ‘রূপ’-কে তৈরি করে। যে অভাবী, যে অনটনে অনটনে মনের দিকে থেকে দুর্বল, তার কাছে ‘রূপ’ বিলাসিতা। তবু সে কী হঠাৎ আকাশের চাঁদের ‘রূপ’ দেখে আনন্দ পায় না! তবু সে কী হঠাৎ আকাশের বিশাল ‘রূপ’ দেখে মনে মনে উঠে দাঁড়াবার সংকল্প করে না? করে হয়ত। নিশ্চয় করে।
আবার কারোর কাছে ‘রূপ’-এর কোনো মানেই নেই। তাদের কাছে ‘রূপ’ মানে আসবাব– তাদের কাছে ‘রূপ’ মানে ফার্নিচার। ‘রূপ’ এই জগতে– এই সংসারে থাকলেও চলে না থাকলেও চলে। এই ‘রূপ’-কে অস্বীকার করার মধ্যেও ‘রূপ’-এরই একপ্রকার সাধনা চলে মনে মনে।
‘রূপ’ সে তো দূরে থাকে, তাই তাকে কাছে টেনে নিতে বা নিজের করতে আর ইচ্ছে করে না অনেক সময়ে। তার ওপর একধরণের অভিমান করেই, ‘রূপ’কে আমি দূরে রাখি। আবার কাছে পেতেও তাকে ইচ্ছে করে, বা করেও না। এক দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলে নিজের ভিতরে। কিন্তু ‘রূপ’ সে তো অন্তর্যামী! তাই ‘রূপ’ নিজেই একদিন চলে আসে, আমার কাছে, আমাদের কাছে। যেন সে তো ছিলই আমার কাছে, আপনজন হয়ে। আমিই বরং ‘রূপ’কে উপেক্ষা করেছি। হতেও পারে তা।
মানুষ নিজেই জানে না, ‘রূপ’ কত কাছে আছে আমাদের। ‘রূপ’ আমাদের মধ্যেই আছে। কিন্তু আমরা তাকে দূরে দেখতে যাই। অনেক আয়োজন করে আমরা ‘রূপ’-এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। আসলে, ‘রূপ’ আয়োজনে নেই– সে খুব সাদামাটা হয়ে, আমার কাছেই লুকিয়ে আছে। তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে। ‘রূপ’-কে খুঁজে বের করা, তাঁকে কাছে ডেকে নেওয়া এক অভ্যাস, এক সাধনা যেন।
এই যে জল নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাছেই। পাগলের সংসারে কোনো কাজ নেই– তাই সে আপনমনে জলের নিরন্তর বয়ে যাওয়ার মধ্যে নিজের ‘রূপ’কে খুঁজছে। জলের ‘রূপ’-এর মধ্যে সে তার ছোটবেলার সুস্থ অবস্থাকে দেখতে পাচ্ছে। জল আর পাগলের মনের ‘রূপ’ আসলে এক কবির– এক শিল্পীর– নতুন পথের দিশা।
‘রূপ’ জ্যোৎস্না রাত্রির মতো চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন। আমরা তাঁর সেই জ্যোৎস্না ছড়ানো ‘রূপ’-এর সন্তান, আমরা তাঁর ‘রূপ’-এর রং-তুলির কারিগর। তিনি ‘রূপ’ দিয়ে আমাদের গড়েছেন, আমরাও সাধন দিয়ে তাঁর ‘রূপ’কে গড়েছি।
হে উদাসীন বাতাস আমরা তোমার রূপে মুগ্ধ, হে পাগল আমরা তোমার রূপে বিস্মিত!
হে রণে হেরে যাওয়া বীর, আমরাও তোমার চোখের জলের ‘রূপ’ দেখে– এই চুপের কাছে বসে আছি নিরন্তর। আমাদের এই ‘চুপ’ থাকা– হে বীর তোমার ‘রূপ’কে জয়ী করে তুলুক।
হে বালক, তোমার লাটাই ঘুড়ির ‘রূপ’ আমাদের আরো ব্যাপক ও উদাসীন করুক।
ক্রমশ