Categories
2020_aug

সায়ন

বি শে ষ  র চ না

সা য় ন

আমার নন্দিনী   পর্ব ১

( ‘রক্তকরবী’ একটি বিশ্বপ্রেমের পাঠ। )

“আন্দাজে বলতে পারি । তুমি ভিতরে ভিতরে ওর মনের তারে টান লাগিয়েছ;”… 

কে বলল কথাটা? এই মানুষটিকে চিনি মনে হয়? অধ্যাপক! না না … মনের কথাগুলো তিনি জানবেন কি করে! পাশে তাকাতেই —

চারপাশে অনেকদিন পর এমন একটা সবুজের পাশে বসে আছি। বাতাসের ছোঁয়ায় গাছের পাতারা আরও লাজুক হয়ে উঠছে। 

এখানে সভ্যতা – সোনা আর সফলতা, বাজার আর বিল গেটস নিয়ে মন কষাকষি করে না সকাল বিকেল রাত।

কাকে দেখে এমন মনে হল – কে ও? 

ওকে মনে হয় অনেকদিন ধরেই আমি চিনতে গিয়ে গভীর এক অজানা অতলের কাছে মন রেখেছি বার বার। দশ বছর ধরে তার মুখের প্রলেপ খুঁজেছি রঙ আর ভাষায় । চুপ করে বসে  ওর বুকের ভিতর দেখছি জলের ফেনারেখা, বাহুজোড়ায় লেগেছে পৌষের মায়াবী প্রলেপ, নীলকন্ঠ পাখির কোমলতায় গ্রীবাদেশ বেষ্টন করে আছে কোনো এক গোপন শিল্পীর হাতে গড়া কণ্ঠহার, দেহময় ছেয়ে আছে ধানী রঙের শাড়ি, হাঁটু ছোঁয়া চুলের সুগন্ধে মেলে রাখা শান্তির নিদ্রাহীন রাত…  তার আকাশগঙ্গা সিঁথির রেখা লেপে গেছে রক্তকরবীর আলোয়…

 

– তুমি কে গো নারী? 

কোনো দিন কোনো অন্ধকার তোমাকে স্পর্শ করেছে বলে তো মনে হয় না! 

দীর্ঘ পলকের বিদ্যুৎ আঁখি বলে – “আমি নন্দিনী ।

হ্যাঁ, তুমি আমাকেই খুঁজতে চেয়েছ বহুকাল! কিন্তু সাহস …….”

আমি ঘুরে যাই বিপরীত পথে – হাতটা নরম হাতে ধরা পড়ল – ” যেও না, পাশে বস”…

– তোমার সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলব গো নন্দিনী?

– তোমার ভাষায় বলবে গো শুধু! আমি তোমার ভাষা শুনব বলেই তো অপেক্ষা করে আছি। সবাই তো শুধু আমার কথা আমাকেই শুনিয়ে গেল! 

তাল তাল মাটির অন্তরে গাঁথা সোনা, অসহায় রাজা, ক্ষমতার উইপোকা সর্দার,খনি শ্রমিকদের কান্না আর রঞ্জনের আগামীর বার্তার মাঝে – এই আমি নন্দিনী, একলা নন্দিনী, নিঃসঙ্গ নন্দিনী – এই নন্দিনী কে কি শুধু দেখা যায় না গো?

তোমার যেমন একজন অধ্যাপক আছে, সর্ব সময়ের গ্রন্থ দংশনকারী , আমারও একজন অধ্যাপক আছে তিনি কিন্তু যৌবন বাউল, আমাদের ভিতর একটা দোতারা আছে, সেখানে সুর বাঁধেন সর্বক্ষণ । 

নন্দিনী অবাক হয়ে বলে – কে গো সেই যৌবন বাউল? 

– মলয় রক্ষিত। উনি তোমাকে নিয়ে একটা ভাবনার সুর বেঁধেছেন – ” যক্ষপুরীর রাজার জালের মুখোশের আড়ালে একটা খন্ডিত , সুপ্ত ব্যক্তিমানুষও ছিল। সেই ব্যক্তি মানুষটা মুক্তপ্রাণ নারী- নন্দিনীকে দেখে চঞ্চল হয়েছে; তাকে মুঠোর মধ্যে ধরতে চেযেছে। শুধু রাজা কেন,যক্ষপুরীর সর্দার-মোড়ল-অধ্যাপক-খোদাইকর সবাই যে যার নিজের মতো করে নন্দিনীকে পেতে চেয়েছে । কে এই নন্দিনী? যক্ষপুরীর মতো খনি-সভ্যতায় পুঁজিবাদী শাসন-ব্যবস্থার ঘটনাজালের মধ্যে তার এসে পড়াটা কি নিতান্তই কাকতালীয়? কাজকর্ম না করে ঘুরে-বেড়ানোর অবাধ স্বাধীনতাই বা নন্দিনী পায় কী করে?” 

এই কথাগুলো লেখা আছে মলয় রক্ষিতের একটি বইয়ে, ‘রক্তকরবী, পাঠ ও পাঠান্তরের ভাবনায়’ । নাও বইটা তোমাকে দিলাম পড়তে । 

বিকেলের শেষ সূর্যের আলো এসে মিশে যায় নন্দিনীর কাজল ঘন চোখে ভেসে ওঠা জলে। – সবার কাছে আমি শাসনের বিপরীতে এক প্রতীক মাত্রই রযে় গেলাম! 

তার উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে ভেঙে যায় আমার নির্বাক বোধের কাছে। নন্দিনী মাঠের ওপাশে কান পেতে শোনে বিশু ভাইয়ের কথা – “পাগলি, শুনতে পাচ্ছিস ওই ফসলকাটার গান?” 

নন্দিনী – শুনতে পাচ্ছি, প্রাণ কেঁদে উঠছে। 

জানো নন্দিনী ,আমার কবি শঙ্খ ঘোষ কি বলে – “মনে মনে বলি : অন্যের কাছে যে আচরণ আশা করো, তেমনিভাবে গড়ে তোলো নিজের চলাফেরা। তাই বলে এর উল্টোটা কিন্তু ঠিক নয় । যেমন আচরণ করতে চাও তুমি ঠিক সেইটেই যেন আর আশা কোরো না অন্যদেরও কাছে । তেমন আশা করলেই আহত আর আক্রান্ত হবে মন।

এই বিবেচনাটা হলো মন ভালো রাখবার উপায় । উপায়টা কতদিন ধরে শেখাচ্ছি নিজেকে; শিখছি না তবু! মন কি অত সহজ ব্যাপার!”

 লাইনগুলো পড়া হয়ে গেলে বইটা, শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’, ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলি। নন্দিনী আপন মনে গোধূলি আকাশের দিকে চেয়ে বলে, 

– সবাই শুধু বাস্তব বিপ্লব আর স্বাধীনতা দেখল গো, এই কান্নার পাশে কখনও কি একমুহূর্ত বসা যায় না, বলো?

চিত্র ঋণ: বিকাশ সরকার

(চলবে)

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

উজ্জ্বল পাঠ । পর্ব ৪

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ৪

সে লি ম   ম ণ্ড ল

একটি সম্পূর্ণ শোকগাথা: সুমিতেশ সরকার

নতুন লিখতে এসে আমাদের মধ্যে একটা স্পর্ধা কাজ করে। এই স্পর্ধা হল দ্রুত ‘rejection’-এর স্পর্ধা। কোনো কবির দু-চারটে কবিতা পড়ে ভালো না লাগলেই বাদ দাও। একজন পাঠক তখনই সৎ ও সাহসী হয়ে ওঠে যখন সে ‘Reject’ করতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল আমরা কোন লেখাকে ‘Reject’ করছি, কেন ‘Reject’ করছি তা নিজের কাছে স্পষ্ট থাকা ভীষণ জরুরী। সম্ভবত ২০১৫ বা ২০১৬ সাল হবে— চাপড়া বইমেলায় একটি হলুদ মলাটের কবিতার বই দেখে কিনি। কিন্তু মুশকিল হল— কিছুদিন পর বইটা খুলে পড়তে গিয়ে মনে হল টানছে না। বইটা আলমারিতে তুলে রাখলাম। সেই সময়টা এমন ছিল দ্রুত কাউকে গ্রহণ করছি বা দ্রুত কাউকে বর্জন করছি। কবিতাপাঠ ক্রমশ একমুখী হয়ে উঠছে। উৎপল, অমিতাভ, শ্যামল গ্রাস করছে।

 

মাঝে অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। নিজের কবিতাপাঠ বা ন্যূনতম বোধেরও পরিবর্তন হয়েছে। নিজের গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেও তৈরি হয়েছে অজস্র সরু সরু গলি। কবিতালেখক হিসেবে আমার নিজেরও যেমন কোথাও পৌঁছানোর আছে। আমি অন্যের কবিতা পড়ে আসলে নিজের পথ-ই খুঁজছি। সবসময় সদরপথ যে আমার গন্তব্যের রাস্তা তা তো নয়। সরু সরু গলির মধ্যে ঢুকেও পাওয়া যায় মানুষের সখ্য, বাড়ির ছায়া, কম পথকষ্ট… তা অনুধাবন করা দরকার।  

 

কবি সুমিতেশ সরকার রাণাঘাটে থাকতেন। ১৯৯২ সালের দিক থেকে এই কবি লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে ‘শুভেচ্ছা মমিঘর ছুঁয়ে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। নব্বইয়ের এই কবি একজন দিল-খোলা মানুষ ছিলেন। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, চোখে মোটা চশমা আর কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে মাঝেমাঝে রাণাঘাট স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বন্ধু গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ঝোলা থেকে বার করে কখনো নিচু স্বরে, কখনো উঁচু স্বরে শোনাতেন কবিতা। কবিতা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্কট রোগ কবির ওপর এমনভাবে থাবা বসায়… আর রক্ষা পাননি… অকালে চলে যান… তবে আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর কবিতা। কবিতা না বলে বলা যায় আত্মচিৎকার। যে চিৎকার কানের ভিতর কণ্ঠ রোধ করে। আমাদের অনুভবে প্রবাহিত করে তার অনুরণন।  

 

লকডাউনের শুরুর দিকে আলমারি থেকে পুরোনো কিছু কবিতার বই বার করে পড়ছিলাম। সুমিতেশ সরকারের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ও বার করি। শুরু থেকে পড়া শুরু করি। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘প্রাসঙ্গিক রূপকথার অপেক্ষায়’ কবিতাটি পড়তে গিয়ে আর স্কিপ করে বেরোতে পারি না। ওই পাতাতেই আটকে থাকি। আগে কবিতাটি পড়া যাক—

 

প্রাসঙ্গিক রূপকথার অপেক্ষায়

 

প্রকৃত রূপকথায় কোনও যতিচিহ্ন থাকে না…

অবসন্ন ইগলুর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ঘুমন্ত মেপলপাতার থেকে

ঝরে পড়া শুধু এই ক-টি কথাই আমি শুনতে পাই আজ।

যদিও স্বপ্নগত চকিত দৃশ্যটি মেনে নিলে—

এই রাত্রি, চরাচর নিরর্থক বাদামের মতো মনে হয়, তবু তার অন্ধকার পথে

ইশ্বরের অপেক্ষায় আমি কস্তুরীহরিণীর মতো বসে থাকি…

যতিচিহ্নহীন, নির্বাপিত, একা… তবু কোনও প্রাসঙ্গিক রূপকথার অপেক্ষায়।

 

সমগ্র কবিতা না, শুধু প্রথম লাইনটি ভাবুন ‘প্রকৃত রূপকথায় কোনও যতিচিহ্ন থাকে না’। কী অমোঘ লাইন! সত্যিই কি রূপকথার কোনো যতিচিহ্ন থাকে? আমরা বরাবর রূপকথার চওড়া কাঁধে ভর করে এগিয়ে যেতে চেয়েছি চেনা-অচেনা নানা পথ। কবি থাকতে চেয়েছেন যতিচিহ্নিহীন, নির্বাপিত, একা। তাই কি কবি শুনতে পান অবসন্ন ইগলুর ভিতর থেকে ঘুমন্ত মেপলপাতা ঝরার শব্দ? নিরর্থক বাদামের মতো থেকে কবি কি শুনতে চেয়েছেন বাদাম ভাঙারই শব্দ? মাথার মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। বইটা বন্ধ করে ভাবতে থাকি। আবার বইটা খুলে পড়তে থাকি। তাঁর কবিতার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গলিতে আমি আটকে পড়ে ভুলে যাই আমার ফেরার পথ। আমি কি সত্যিই ফিরতে চাই? নাকি তাঁরই ‘মাধবীলতা’কে সরিয়ে তাঁরই সুরে বলতে চাই— ‘আলো বলতে কবিতা/আর অন্ধকার বলতেও কবিতা ছাড়া কেউ নয়।’

 

একটি পিঁপড়ে

 

এত নির্জন তোমাকে বোঝান মুশকিল

এত নির্জন তোমাকে বোঝান যাবে না

ধু-ধু শূন্যতা চারিদিকে ঘিরে চুপচাপ

একটি পিঁপড়ে হেঁটে যায়… শুধু হেঁটে যায়

 

 

পাতা ঝরবার শব্দ

 

ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া একটা দিন…

ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া একটা রাত…

আর ছোটো-ছোটো পাতা ঝরবার শব্দ

 

ধূসর দেওয়ালঘড়ি থেকে নেমে আসা

অন্ধকার পাতা ঝরবার শব্দ

 

 

পুরোনো কথা

 

পুরোনো কথাগুলোই নতুন করে বললাম আবার

 

এবং তুমি হেসে উঠলে

 

আর সূর্যাস্তের দিকে গোধূলিরঙের কয়েকটি পাখি উড়ে গেল।

 

 

সূচনাপর্ব

 

অন্ধকার শব্দটিও কী সাবলীলভাবে উচ্চারণ করো তুমি

যেন কিছুই হয়নি, যেন এ-সমস্তই স্বাভাবিক—

একটা রোগা মোমবাতি একটা পরিত্যক্ত বাতিঘর আর

নিঃসঙ্গতার কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ…

 

কাহিনির সূচনাপর্বেই ফোঁটা-ফোঁটা অন্ধকার যাকে ঢেকে দিচ্ছে।

 

 

 পঁচিশে বৈশাখ

 

আজ পঁচিশে বৈশাখ

 

বহুদিন পর, তোমার অন্ধকার লেখার টেবিলে

একটুকরো আলো এসে পড়ছে।

 

 

 ছবি

 

ছবিগুলি পারিবারিক অ্যালবামে রাখা থাকবে

 

তারপর হারিয়ে যাবে, নষ্ট হয়ে যাব একদিন

 

কেননা— অমরত্ব বলে কিছু নেই, অমরত্ব বলে কিছু হয় না।

 

 

খাদক

 

ভালো কবিতা

পাঠককে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলে

 

যাকে খায়, সে বুঝতেও পারে না

 

যখন বুঝতে পারে—

তখন আর করার থাকে না কিছুই।

 

 

হননদৃশ্য

 

দুঃখের রঙ সবুজ, ভালোবাসার রঙ নীল

আর একটা স্ট্রবেরি রঙের একটি দুপুর

দূরের ব্যালকনি থেকে হাওয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

 

 

শিল্প

 

ইস্পাতের খাঁচার ভিতর একটি মানুষ—

 

ইস্পাতের খাঁচার ভিতর একটি বাঘ—

 

দুজন দুজনকে সন্দেহের চোখে দেখে

 

কিন্তু তাদের শিল্পিত আচার-আচরণে

                               এসবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না কখনও।

 

 

 বাকি জীবনটা

 

মহাকাব্য নয়,

একটা পাতলা মলাট-ছেঁড়া দশ পাতার বই—

 

যার সঙ্গে

তুমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে ভেবেছ।

 

 

১০টি ছোটো চেহারার কবিতা তুলে দিলাম। এত ছোটো পরিসরে কীভাবে বৃহৎ কবিতা লেখা যায় তার এক অনন্য উদাহরণ কবি সুমিতেশ সরকার। অঙ্কে, মাত্র দুটি বিন্দু দিয়ে আমরা সরলরেখা আঁকি। যতই দীর্ঘ বা ক্ষুদ্র সরলরেখা আঁকি না কেন দুটি বিন্দুরই প্রয়োজন। যার দৈর্ঘ্য ২ সেমি হোক বা ২০০০ সেমি। কবিতার ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। আকার না, ভাবনার বিশালতাই প্রধান। সুমিতেশ সরকার কখনো দীর্ঘ কবিতার দিকে হাঁটেননি। সচেতনভাবেই। তাঁর ভাবনার জগতে নিজেই মহারাজার মতো থেকে শাসন করেছেন প্রতিটা শব্দকে। শব্দের সঙ্গে প্রয়োজনে বন্ধুত্ব করেছেন, প্রয়োজন ছুঁড়ে ফেলেছেন তাকে।

 

আবার ফিরে আসি প্রথম দিকের কথায়। বইটি যখন আমাকে মোহগ্রস্ত করতে পারছিল না, সেই সময়ের কথায়। সময় আসলে আমাদের চালিত করে তারই শাসন বা অপশাসনে। তাই হয়তো আমরা বৃষ্টির মধ্যে শুনতে পাই না বৃষ্টি পড়ার শব্দ। রোদের ভিতর দেখতে পাই না রোদের চাঞ্চল্য। আমরা স্বপ্নসন্ধানী মানুষ। রূপকথার গল্পে ভেসে থাকা মানুষ। জলেভেজা, রোদেপোড়া জীবনকে কাছ থেকে দেখার আগেই তার জবজবে গা দেখে দূরে পালিয়ে যাই। জীবনটা আমাদের শিশুর মতোই সরল হবে বলে কবে যে হাড়ভাঙা কোনো বৃদ্ধের অসুখে পরিণত হয় টের পাই না।

 

সহজের একটা সৌন্দর্য আছে। ‘কথামৃত’ পড়ার সময় আমার বারবার মনে হয়েছে, কেন রামকৃষ্ণ কবি নয়। আমরা অক্ষরের ভিতর বোধের যে দাগ বসাই, রামকৃষ্ণ কথার মধ্যে বারবার বোধের দাগ বসিয়েছেন।

 

সুমিতেশের সহজ সরল ছোটো ছোটো কবিতাগুলোতে আমাদের সামনে খুলে যায় বিরাট কোনো স্পেস। যে স্পেস শূন্য অথবা ভরাট। যে স্পেসে আমরা পা ছড়িয়ে বসতে চাই। আমরা এলিয়ে দিতে চাই যাবতীয় জীবনের অনুৎপাদিত ফসল।

 

পড়া যাক সুমিতেশ সরকারের আরও কিছু কবিতা—

 

 

শাশ্বত

 

ডায়মন্ডহারবার রোডের কাছাকাছি যে একটি ধূসর রেস্তোরাঁ আছে

তা আমিও জানতাম।

 

কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, সেখানে যাওয়া হয়নি

কখনও।

 

তার রহস্যময় হাতছানি, আমি উপেক্ষা করেছি এতকাল।

 

আজ আপনার লেখালেখির ভিতর

এলোমেলো পায়চারি করতে করতে, শাশ্বত—

সেখানে যাবার ইচ্ছে আচমকাই প্রকট হয়ে উঠল।  

 

 

প্রতিভা

 

মস্তিষ্কের একটি প্রকোষ্ঠ বন্ধ করে দিয়ে

সাবলীল আর একটি প্রকোষ্ঠ খুলে ফেলবার যে কৌশল

 

কাউকে খুন করে এসে

ধীর লয়ে সেতার বাজাবার যে কৌশল

 

উজ্জ্বল আলোসুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে যেতে-যেতে

আচমকা অন্ধকার রচনার যে কৌশল

 

প্রকৃতার্থে, যে তাহাই প্রতিভা—

                        সে-বিষয়ে কোনও সংশয় নাই!

 

 

সুমিতেশের কবিতা পড়ে বোঝা যায়, তিনি নগরের এক বাউল কবি যিনি নিজের ভিতর গাছপালা লাগিয়ে সে গাছের ছায়াতেই চেয়েছেন সেতার বাজাতে। সেই সেতারের তারে কখনো কখনো কেটে ফেলেছেন নিজের হাত। আবার সাদা ব্যান্ডেজ পরে সেই হাতে বাজিয়ে চলেছেন সেতার। তিনি অন্ধকার রচনার মধ্যে ডুব দিয়ে সাঁতরাচ্ছেন। হয়ত নিজেই জানতেন না, তাঁর পাড় কোথায়। তবুও তিনি নিমগ্ন। অন্ধকারের শরীরকে ক্রমশ সাজিয়ে করে তুলছেন মোহময়ী। তিনি নিজে আচ্ছন্ন না বিচ্ছিন্ন তাও কি জানতেন? নিজের মধ্যে এভাবেই হয়ত পায়চারি করতে করতে খুঁজতেন একটা ‘destination’।

 

আরও কয়েকটি কবিতা—

 

 

শরৎ

 

পাখির ডাকগুলো মিহি  হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে

 

স্বপ্নের ভিতর

অস্ফুট বেজে উঠছে টেলিফোন

 

নীল আকাশের বুক চিরে

উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক তিতিরঙের মেঘ

 

বহুদিন পর, একটা চিঠি এল—

তুমি আমাকে  ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছ, শুরুতেই… 

 

 

 

একটি বেড়াল, রিংকুমাসি ও কিছু অনিশ্চয়তা

 

স্তব্ধতার ভিতর দিয়ে একটি বেড়াল চলে যায়

আর আচমকাই রিংকুমাসির কথা মনে পড়ে

 

ভাবি— তোমার সঙ্গে দেখা হলে এসমস্তই বলব

 

কিন্তু কবে-কীভাবে দেখা হবে, তার কিছুই জানি না

 

 

 

যেদিন কলকাতায় প্রথম বরফ পড়ল

 

যেদিন কলকাতায় প্রথম বরফ পড়ল

তোমার কথা মনে পড়ে গেল আমার—

 

মনে পড়ে গেল— দুটো বরফের পুতুল

একদিন কথা বলছিল এই ভাষায়

 

যদিও— ‘এই ভাষা’ মানে ঠিক কোন্‌ ভাষা

তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না আমি

 

আর বোঝাতে পারব না জেনেও

আজ আমার কোনও দুঃখবোধ নেই, অবসাদ নেই, ক্লান্তি নেই               

                                       মনস্তাপ নেই, পিছুটান নেই, খেদ নেই—

 

দেশপ্রিয় পার্কের একটা আবছা বেঞ্চিতে বসে

আমি এখন পা দোলাচ্ছি

আর গুঁড়ো-গুঁড়ো বরফে ঢেকে যেতে দেখছি

                                          প্রেম, প্রকৃতি, ভালোবাসা…

 

আর ভাবছি— মানুষ কেন মানুষকে ছেড়ে যায়

এটা সত্যিই ভাববার মতো একটা বিষয়।

 

 

তাঁকে পাঠের শুরু থেকেই আমার একটা খোঁজ ছিল নিজের কাছে। কোনোভাবে কি তিনি ভাস্কর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন? সুমিতেশের কাছের কয়েকজনের কাছেও আমার আত্মানুসন্ধান ছিল। সেদিন বাসবীদিকে (বাসবী চক্রবর্তী, ভাস্করপত্নী) জিজ্ঞাসা করেই ফেলি, সুমিতেশ সরকারের সঙ্গে ভাস্কর বাবুর কেমন সম্পর্ক ছিল, জানো? ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেও ছিলেন রাণাঘাটের জামাই। যাইহোক, একজন অগ্রজ কবির দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটা কোনো অপরাধ বলে মনে হয় না। তবে সুমিতেশের একটা নিজস্ব জগৎ ছিল। যে জগৎটাকে তৈরি করেছিলেন নিজেই। তাঁকে ‘detection’-এর জন্য আলাদা করে আতস কাচের প্রয়োজন পড়ে না।   

 

 

তখন তিনি কর্কটরোগে আক্রান্ত। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লিখছেন— “মুরশিদ জানেন— নাছোড় কর্কটরোগের মুখোমুখি— বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একজন মানুষের এ-নিজেকে একটু অন্যভাবে আবিষ্কারের এক সামান্য প্রয়াসমাত্র। মৃত্যুকে অপারেশন-থিয়েটারের দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে— গাঢ় অ্যানেস্থেশিয়ার গভীরে ডুবে যেতে যেতে, পেরিয়ে আসা সময়ের প্রেক্ষিতে এ-এক নির্জন অভিযাত্রা। নিজেকে ফিরে দেখবার এক ভিন্নমাত্রিক তাগিদ ছাড়া, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে এসবের অলক্ষ্যে নেই।”

 

মৃত্যুই কি আমাদের জীবনসার্কাসের সেরা খেলা? এই খেলার জন্যই কি আমরা অপেক্ষা করি? আমাদের ভিতর ক্রমাগত হাততালি পড়তে পড়তে যখন হাতগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় তখন আমরা কোন মঞ্চের জন্য অপেক্ষা করি? আলো নিভে যায়। আলো জ্বলে ওঠে দপ করে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় অঙ্গার আর অঙ্গার!

 

মৃত্যু খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল আমার—/ এত কাছে,/ যে তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ/ আমি নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারছিলাম” —  যখন মৃত্যু কারো দরজার সামনে এসে এভাবে কড়া নামে তখন দরজার ওপারের মানুষটি কীভাবে বলতে পারেন—

“বৃষ্টি হোক বা না হোক

ভালো থাকবেন

 

বিষাদ দূরে সরিয়ে, মনখারাপ দূরে সরিয়ে

ভালো থাকবেন”

 

এটাই বোধহয় সুমিতেশ ও সুমিতেশের কবিতার প্রাণশক্তি। যা বয়ে যেতে পারে যুগ যুগ বছর।

 

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:

গৌতম চট্টোপাধ্যায়

সঞ্জয় মৌলিক

রণজিৎ অধিকারী

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

র‍্যনে শ্যরের কবিতা

অ নু বা দ

অ মি তা ভ   মৈ ত্র

ফরাসি কবি র‍্যনে শ্যর

১৯০৭-এ জন্ম। ১১ বছর বয়সে পিতৃহীন হওয়ার পর খুব কষ্টে জীবনধারণ করতে হয় তাঁকে। মোটামুটি এই সময়েই তাঁর কবিতা লেখার শুরু। যখন তাঁর কুড়ি বছর, তাঁর কবিতা পড়ে মুগ্ধ পল এল্যুয়ার নিজেই এসেছিলেন তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। এই সময়েই এল্যুয়ার, ব্রঁতো আর আরাগঁ তাঁকে যুক্ত করে নিলেন স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে। “র‍্যাঁবোর পর র‍্যনে শ্যর-এর মতো ক্ষমতাসম্পন্ন কবি আর কেউ নেই।” – কাম্যু বিশ্বাস করতেন আর জোরের সঙ্গে ঘোষণা করতেন এই কথা।

ফ্রান্সের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন নিজের নাম গোপন করে। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতদিন না জার্মান বাহিনী পরাজিত হচ্ছে, ততোদিন কবিতা প্রকাশ করবেন না তিনি। এই সময় অসংখ্য চূর্ণ কবিতা টুকরো টুকরো কাগজে লিখে রাখতেন, বৃক্ষহীন কোনো দ্বীপে শব্দ-বীজ ছড়িয়ে দেবার মতো।

রাত্রির জন্য, অলংকারহীন

পিটিয়ে মেরে ফেলা রাত্রির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আস্তে আস্তে আমরা বদলে নিই আমাদের।

 

ঘটনা প্রকৃতি আর কবি মাঝরাতে জেগে উঠে খোঁজে

রাত্রি খাবার আনে তাদের জন্য আর সূর্য মার্জিত করে তাদের শরীর।

 

আমাদের অর্জন তুলে রাখা হয় তাদের জন্য পরে যারা অনুসরণ করবে আমাদের।

 

অসীমতা আক্রমণ করে, কিন্তু একটা মেঘ এসে বাঁচিয়ে দেয় শেষ পর্যন্ত।

 

সেই সব জীবনই শুধু রাত্রির বন্ধু যারা বসন্তে নিজেদের শেষ করে উড়ে যাবার   কথা ভাবছে।

 

তার বাগানের দরজা খুলে দিতে রাজি হবার আগে রাত্রি তার শরীরে মরচে  মেখে নেয়।

 

ভুতুড়ে কোনো ছত্রাক হয়ে ওঠে স্বপ্নরা, যখন জেগে উঠে রাত্রি তাদের দিকে তাকায়।

 

আলো জ্বেলোনা রাত্রির কেন্দ্রে। সেখানে অন্ধকারই একমাত্র শাসক, যেখানে সকালের শিশির লিখে রাখে নিজেকে।

 

শুধু রাত্রিই আসে রাত্রির পেছনে, স্বার্থপরের মতো যে সহ্য করে সূর্যের ঘন্টাঘর।

 

১০

রহস্যের সাথে রাত্রিই আমাদের আলাপ করিয়ে দেয়

এছাড়াও, আমাদের স্নানঘরের দেখভাল করে।

 

১১

আমাদের নিষ্পাপ আর অতীতকে নগ্ন করে দেয় রাত্রি,

চশমা কাত করে তাকায় বর্তমানের দিকে, আর চিন্তায় রাখে ভবিষ্যতকে।

 

১২

অপার্থিব পৃথিবী দিয়ে একদিন আমি ঠিক ভর্তি করে নেব নিজেকে।

 

১৩

যেখানে চোখ মিটমিট করেনা আদবকায়দা না জানা স্বপ্নদের,

সেই অফুরন্ত রাত্রিই বাঁচিয়ে রাখে আমার ভালবাসা।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

সুরাইয়া ইসলাম

বাং লা দে শে র  ক বি তা

সু রা ই য়া   ই স লা ম

সখ্য

তোমার আমার সম্পর্ক
ঠিক পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর মতো
সপ্তাহান্তে উপাদেয় কোনো রসনার যেন
আন্তরিক বিনম্র প্রিয়তা
আর
তোমার-আমার সখ্য
যেন ধোঁয়াটে, কাদাজল মাখা এক বাস্তুদেবতা।

 

সম্পর্ক ও বোধের জমিন

অথচ আমি পরিবারের বদলে শুধু
একটা বর্ষাকে বয়ে নিতে চাই,
যখন শীতে জমে যাওয়া সম্পর্কগুলো
গ্রীষ্মের তাপদাহে গলে আলাদা হতে থাকে,
কালবৈশাখী আছড়ে পড়ে
পৃথক, রুগ্ন আর একা অস্তিত্বের ওপর।

অন্যরা স্বার্থপর হতে হতে
জীব থেকে কেবলই জড়তে পরিণত হয়,
ভুলে যায় সেই হিমশীতল কষ্টে
একাত্ম হবার কথা,
ভীষণ জড়াজড়ি করে
একে অন্যের নিঃশ্বাস বোঝার কথা,
অসহ্য উষ্ণতায় আবেগ পোড়ানো কথা।

অযোগ্য আমি ভুলতে পারি না
এখনও কারও আর্তনাদের কথা ভেবে
দু’চোখে বৃষ্টি নামাই, আর ঈশ্বরকে বলি—
প্রভু আমার পরিবারে দ্রুত বর্ষা পাঠাও
ভুলের ধুলোমাখা আবছা সম্পর্কগুলো
ধুয়ে দাও শান্তির জলে;
বসন্তের ফুল থেকে তুলে রাখা বীজগুলো
পরম যত্নে বুনে দেবো আমাদের বোধের জমিনে
সবুজে সবুজে বেড়ে উঠবো আবার
আর নতুন প্রজন্মকে দেবো নবান্নের অধিকার।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

শাহজাদী আফরোজ ডেইজী

বাং লা দে শে র  ক বি তা

শা হ জা দী   আ ফ রো জ   ডে ই জী

নস্টালজিক

মৌনস্পর্শের মতো জাগ্রত অনুভূতিদের 

গায়ে সুগন্ধি সফেন,

শান্ত নদীর নিতলবুকে বাতাসের কানামাছি খেলা,

কুর্নিশে অবনত দেবদারু গাছটিও,

অথচ অন্তরালে এখনো চলছে 

শৈশব স্মৃতিদের নিমগ্ন খুনসুটি।

 

হিজলডালের শ্রান্ত পাখি হঠাৎ এসে বলল,

তোমার মনে আছে? 

হোঁচট খাওয়া অতীত সত্যিরা একদিন 

পাহাড়ের বুক-পাঁজরে

কেমন অবুঝের মতো কেঁদেছিল?

 

মনে আছে? 

সেদিন তোমার দীর্ঘশ্বাসের জলদীঘিটা

একটু-একটু করে কেমন নীলচে হয়ে গেল? 

আমি নভঃমণির ললাট ছুঁয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইলাম!

 

পায়ের কাছে শ্বেতপাথর, 

পাথরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে 

দুপুরের জ্বলজ্বলে রোদ;

অথচ মস্তিষ্কের নিউরনে এখনো লেগে আছে, 

সাতরঙা সত্যের আস্তিন পরা… সেই স্মৃতিকাঁটা প্রলেপ!

 

ভাঙা প্রাচীর

মৃত-আত্মায় উৎসাহী বলেই

শকুনের চোখ খোঁজে মাংসাশী শরীর, 

জ্বলন্ত বারুদের উৎকট গন্ধেও, 

ফেরারি পাখি খোঁজে ছোট্ট একটা নীড়;

 

অলীক জালের কৃত্রিম বন্ধনে আটকা পড়া 

চঞ্চলা হরিণী জানে; 

ক্ষুধার্ত বাঘের দৃষ্টি কত বীভৎস হয়!

 

সবকিছুই চলে নষ্টবিবেকের তর্জনীর ইশারায়, 

হয়তো এভাবেই চলবে 

অনন্তকালের হাত ধরে;

 

তবু ভাঙা প্রাচীরের ওপারে কাঁদে

উত্তর না পাওয়া কিছু নিশ্চল প্রশ্ন, 

কালরাত্রির ঔরসে জন্মানো কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন…

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

মোস্তফা হামেদী

বাং লা দে শে র  ক বি তা

মো স্ত ফা   হা মে দী

একা কোনো ফুল 

একান্নবর্তী বন থেকে সংকীর্ণ কোঠায়

এক উন্মূল গাছ 

ছেঁটে ফেলছে বন্যভাব;

 

কাঠের স্নিগ্ধতা ফুরিয়েছে 

আর পাতার ভেষজ প্রতিভা

ম্রিয়মাণ –

 

যেন বেজে যায় কোনো পুরানা সাইকেল 

শিথানের পাশ ঘেঁষে 

সরু রাস্তায় ;

 

একা কোনো ফুল নিজের গন্ধে নিজে ঝরে যায়

জোছনার অতল সায়র থেকে উঠে এসে 

যে পরিরা মিশে যেত আবডালে—ছায়ায় 

ঘননির্জন পথের উপর ঝুঁকে ঝুঁকে 

মেলে দিতো মায়া;

 

সেই মন্ত্রময় দেহভাষ্য থেকে 

মুছে যায় ছায়ালিপি—

 

কেবল রেখা অবলোপ কিছু শুকনা পাতা

আর স্মৃতিপথে বিরাজিত ঝিরিঝিরি ধ্বনি 

এই দেহবনের হাওয়ায় 

বাঁধাই হয়ে আছে!

 

শোঁল

আস্তে হাঁটো। বুনো পিঁপড়ের দল অন্তিম যাত্রায়—সার বেঁধে।

 

মেঘের সংবেদনা নিয়ে ঝরে পড়লো লটকন ফল।

কুড়াই বহুযুগ আগের শুকিয়ে যাওয়া হাড়।

কে যে কবে নীত হলো এই পুষ্পবনে,

তাকে ডাকবো কেমন করে?

 

মৃতদের ভাষা আজও শিখিনি।

 

ঐ ঝোপের ভিতরে সোঁ সোঁ আওয়াজ।

অবলোকনের চোখগুলি এখনো জ্বলজ্বল করে।

তেষ্টা পাওয়ার অনুভূতি নিয়ে ঝিম মেরে আছি।

ঠিকঠাক দেখানো সব গাছালির ভিতরে

শোঁল পড়ে গেছে,

 

সেই ফাঁপা এক জায়মানতায়

নড়বড়ে কোনো সাঁকোর মতো

দুলে উঠছি,

 

তোমার পদশব্দে—নূপুরের হীন আওয়াজে।

আস্তে হাঁটো।

 

গাঁথা

এই ঘুম মেলে দিয়েছি ধোয়া জামার মতো 

 

তারার আলোয় সে শুকায়

নরম শরীর 

 

কেউ কিছুই বলছে না

 

গেঁথে যায় পরস্পর

 

একাগ্রতায়—

 

কোনো নারী যেভাবে শিশুর বোতাম লাগিয়ে দেয়।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

এনামূল হক পলাশ

বাং লা দে শে র  ক বি তা

এ না মূ ল   হ ক   প লা শ

আঁকতে চাওয়া দৃশ্যের পাঠ

একটি দৃশ্য আঁকতে আঁকতে চলে যাচ্ছে সময়
যার ভেতর দিয়ে পুনরায় জন্ম হবে আমার।
এই দৃশ্যে আমি আর আঁকতে পারি না জীবন
বহমানতায় হারিয়ে যাচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ আক্ষেপ।
আমি যে দৃশ্য দেখি তা ফুল-পাখি, অন্তরাশ্রম,
প্রিয় সব মুখ, প্রিয় সব খুনসুটি সুখ।
স্থলপদ্মের ছবি আঁকতে আঁকতে অগোচরে
প্রিয় নারীর মুখ ভুলে গেছি বহুদিন।
বহুদিন ভোর দেখিনি বলে দৃশ্য ভুলে গেছি,
আমি নারীদের মুখ আঁকতে পারিনা।
আমি যে দৃশ্য আঁকি তা খণ্ডিত সময়,
আমি যে দৃশ্য আঁকতে চাই তা পূর্ণতা।

আঁকা মুখগুলিতে কারুকাজ করতে চাইলে
লেপ্টে যেতে থাকে তারা ভয়ানক কালিমায়।
আঁকা দৃশ্যে নদীর বুকে তুলি ছুঁয়ে দিলে
নদীরা খণ্ডিত হয়ে মরে যেতে থাকে।
বাতাসের ভেতর যে সীসা থাকে তার
ছবি আর বইতে পারছে না এইসব হৃদয়।
আমি যখন যে দৃশ্য আঁকতে চাই তা
বারবার খণ্ডিত হয়ে হারিয়ে যায় পেছনে।
আগামীকাল যে প্রেমিকার সাথে দেখা হবে
তার দৃশ্য ঠিকঠাক আঁকার চেষ্টা করবো অবশ্যই।
অথচ কোনো দৃশ্য ঠিকঠাক আঁকা হয়নি এমনকি
আঁকতে চাওয়া দৃশ্যের কোথাও কোনো ছায়া নেই।

পাটখড়ি জীবনের পাঠ

মাটিতেই জেগে উঠি বিন্দু কণা থেকে,
জলমগ্নতায় জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ি।

সময় হলেই আমাকে কেটে ফেলে দাও
পানিতে চুবিয়ে রাখো পচনের অপেক্ষায়।

তারপর তুলে আনো মাটির বিছানায়
বুড়ো আঙুলের খোঁচায় ছাল ছাড়িয়ে নিতে।

আমাকে আঁটি বেধে রৌদ্রে শুকাও
কারো কারো বেড়া হবো, কারো কারো আগুন।

আগুন? জল? নাকি মাটি? কোথায় ঠিকানা?
এইসব মিশে যাওয়ার খবর রাখে না কেউ।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

ভিনদেশে । পর্ব ৪

ভি ন দে শে । পর্ব ৪

সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার  কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে  আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।

ঈ শি তা  ভা দু ড়ী

খোলো খোলো দ্বার

প্রথমবার প্যারিসে যেমন নির্ঝঞ্ঝাটে পৌঁছোতে পেরেছিলাম, দ্বিতীয়বারে কিন্তু নানা বিপত্তি। লন্ডন থেকে ইউরোস্টার ট্রেনে করে প্যারিস নর্থ স্টেশনে নেমে, ইংরেজি প্রশ্নের ফরাসী উত্তরে স্তব্ধ-ভাব পার করে নিজেরা কিছুটা বুঝে কিছুটা আন্দাজেই দু’দিনের একটি কম্বাইন্‌ড্‌ টিকিট কেটে তাকিয়ে দেখি একদম ফাঁকা স্টেশন, চারপাশে আমরা ছাড়া আরো দু’চারজনই মাত্র।  

আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে যাওয়ার জন্যে মালপত্র নিয়ে বার হতে গিয়ে আর বার হতে পারি না, সে মহা বিপত্তি। গেটগুলি স্লাইডিং, টিকিট মেশিনে ঢোকালে দরজা খুলে যায় এবং তখন চট্‌জলদি বার হয়ে যেতে হয়। সে দরজা এতই অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় যে, মালপত্র বার করার কোনোই উপায় নেই। বুঝুন কাণ্ড! কী ভয়ানক বিপদ! এমনই অ্যাডভান্স্‌ড্‌ দেশ! এতই তাদের প্রগতি! এমনই তাদের ব্যবস্থাপনা!

paris_pic

সোমা বার হয়ে গেছে আর আমি কাঁড়ি কাঁড়ি মাল নিয়ে বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে। চারপাশে রেলের কোনো কাউন্টার অথবা কোনো মানুষই নেই যে বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার পথ বলে দেবে। রবীন্দ্রনাথ কী এই গেটের সামনে এসেই লিখেছিলেন “খোলো খোলো দ্বার, রাখিও না আর / বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে / দাও সাড়া দাও”!

আমাদের পাশে এশীয় দু’টি যুবক-যুবতীরও এই এক দশা  শেষমেষ সেই যুবক প্রবলতম শক্তিক্ষয়ে দরজা ঠেলে তার সঙ্গিনীকে বার করল এবং তারপর মালপত্র সহ আমাকে। নিশ্চয়ই সে খেলাধুলো করেছে অনেক, তাই না পারল! ভাগ্যিস সেই যুবক ছিল! ভাগ্যিস তার সঙ্গিনীও আটকে পড়েছিল!

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

ঈশানী বসাক

বি শে ষ  র চ না

ঈ শা নী   ব সা ক

কাব্যি টাব্যি

কবিতা নকশাকাঁটা সেলাই। যে যত যত্নে ফোঁড় তোলে ততো সুন্দর জেগে ওঠে টলটলে জল, পদ্মপাতা, মৌচাক,  অপরাজিতা, রুক্ষ চুলের মেয়েটা। আবহমান এই বেঁচে থাকার মধ্যেই থাকে সময়। তাকে ধরে রাখতে আঙুলের ডগায় ছুটছে সবাই। কেউ পিছিয়ে পড়ছে, কেউ দৌড়োচ্ছে। যারা পারছে না তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেউ বা ‘যাঃ  হলো না’ বলে পেন রেখে খেয়ে নিলো দু কাপ চা আর সিগারেট। আবার কে যেন কিছুই হয়নি,  বাকি আছে কতো ভেবে আবার ছুটলো। তা এই পিছিয়ে পড়া দলের লোকজন গভীরভাবে যখন জলের মধ্যে দেখে নেয় নির্মল রঙের সত্যি, তখনি পাড়ায় রে রে করে উঠে মা কাকিমারা চেঁচায়, কী রে শুনলাম নাকি তুই কবি হয়েছিস?  পাশের বাড়ির সমীরবাবু চশমা নামিয়ে বলেন, তা খোকা কবি হয়ে কি মালকড়ি পাচ্ছো? অথবা পিসিমা রান্নাঘরে শুকনো লঙ্কা, হিং ফোড়নে ডাল ঢালতে ঢালতে ফিক ফিক করে হেসে বলেন, ‘বলি অ খোকা… অমন হয়, এ বয়সে হয়!’ 

       আচ্ছা, কবিতা কত প্রকার বলুন তো? এক্ষুণি বলবেন অমন করে হিসেব খয়রাতি করে নাকি। এই তো করলুম… এক ধরনের কবিতা হলো ইনস্ট্যান্ট ম্যাগি নুডলস থুড়ি পুডল। ওই জমা জলে ঢোঁড়াসাপ। দেখলাম আর লিখলাম। আরেক ধরনের কবিতা একখানা ছন্নছাড়া লাইন দিয়ে পালাল। লে হালুয়া, দিন মাস বছর পেরোয়। তাকে কোথায় রাখি, কোথায় ফেলি। হঠাৎ কোনো এক বৃষ্টিমেদুর সন্ধ্যে, খসখস ছপছপ। একরাশ ব্যাঙ কোঁকরকো করে ডাকছে। লাইনটাও নিয়ম মেনে ঢুকে পড়লো। একে বলে আইনত অনুপ্রবেশ। এক্কেরে লুকিয়ে দেশে ঢুকে তারপর সবার অলক্ষ্যে ভোটার লিস্টে নাম তুলে আত্মপ্রকাশ। তা এই অপেক্ষাটুকু নিয়ে বাঁচা। তাহলে যারা বলে কবিতা লিখতে হলে কী করতে হবে। সাফ কথা, অন্য রাস্তা দেখুন মশাই। এখানে কোনো গ্যারান্টি নেই।

       কবিতা ছাড়া অন্য কিছু পারবো না এইটে কখনো বলবো না। অন্য কিছু হলেও এই বান্দা সহজে ধরা দেবে না। চাতক পাখির মতো বসে থাকো বছর ধরে। তারপর খানিক প্রতিক্রিয়া সবারই চাই বইকি। মুখে, হে হে, না না তেমন কিছু না। এ বলে কী আর পেট ভরে?

তার মধ্যে যদি কেউ আবার তোমার গোদা খাতা খুলে ধরিয়ে দিলো গুচ্ছখানেক ভুল। ভেবেছিলে যা লিখবে লোকে বাহ বলবে… কারা যেন আবার ধুয়ো তুললো কানে শোনো, মকশো করো, ছন্দে লেখো, অন্ত্যমিলে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। মালমশলা, পাঠক, রুচি, কারিগরীবিদ্যা সব ছেড়ে বেরিয়ে চলে আসতে ইচ্ছে করছে। থাক তবে, এতসবের কী বা প্রয়োজন।

       জীবনানন্দের একটি লাইন মনে পড়ছে: ‘কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে’। রে রে করে কারা যেন বলবেন সাধু চলিত, গুরুচন্ডালি। জীবনানন্দ বলবেন, নিকুচি করেছে। বাংলা ভাষা কানের ভাষা। এখানে শুনে শুনে কান তৈরী করতে হয়। হাঁটিতেছি আর হেঁটে চলেছি— পার্থক্য আছে বটে। হাঁটিতেছি হাজার বছরের সময় নিয়ে, এমন নদী সময়কে ধরে না। পিছু পিছু চলে। হেঁটে চলি ক্লান্ত হয়ে বসে মাঝে মাঝে। খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প যেন ঠিক। 

          অঙ্ক খাতার ফাঁকে চিঠি, উত্তর আসবে কি না ঠিক নেই। সাইকেলটা মাঠের ওপাশ দিয়ে ঘোরাতে হবে প্রতি বৃহস্পতিবার। যদি এক ঝলক, একবার… মাথার ভেতর ট্রালা…লালা…লা! মদ খেয়ে মাথা ফাটিয়ে লোকটা বসে আছে সিড়িতে। বউয়ের করুণ গলা, ‘কিয়ু পিতে হো রোজ?’ …‘বধুয়া! তু নেহি সমঝেগি।’

পুকুর থেকে চান করে উঠে পিছু ফিরে মায়ের অত সুন্দর চেহারা দেখে ফেলে দৌড়োনো, রাতে বিছানার চাদর কলের জলে ঘষে আনা। ছি ছি কেউ জেনে গেলে। সাবিনা, সাবিনা কহা গয়ি তু? আজ বড়া সা মেহফিল হ্যায়, চলে। হ্যাঁ হ্যাঁ সব কিছু লিখে ফেলেছে কেউ না কেউ। তাহলে আর কী লিখবে তুমি? কবিতা শেষ? স্টক আউট অফ অর্ডার? না না দেখো অন্যভাবে দেখো। দুঃখ পাও এখনো, কাঁদতে পারো? ছুঁতে পারো… যা কিছু অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে? বিস্মিত হয়ে দেখো। তোমার বিস্ময় শেষ হলে ছোটা শিখে যাবে। তখন কী করে লিখবে? 

       এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাবে সাঁকো পার করে। মাঝখানে আস্ত নদী। ভেসে গেলে ধাক্কা খাবে মরা গোরু, আধপোড়া কাঠ, না পোড়া নাভি আর পচা কচুরিপানার সাথে। বুক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভয় নিয়েও কেন লিখতে পারছো না? এখনো কি তুমি সেই হিসেবী পরিণত বুদ্ধির কাঠপুতুল? কারোর মৃত্যুতে এতটুকুও আশ্চর্য হও না। নাকি জানোই যে কবিতা আসলে ছেড়ে যাবেই। মাথায় উঠিয়ে তাকে প্রশ্রয় দিলেও প্রেমের মতোই হাত ফসকায় সে।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_aug

উমাপদ কর

বি শে ষ  র চ না

উ মা প দ   ক র

একপাক্ষিক ভালোবাসা

আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে, বুড়ো হতে চললাম। কিন্তু বয়স বাড়ল না তার। কবিতার। কচিটিই থেকে গেল। সেই যে সতের বছর বয়সে এক-আধটু দেখেছিলাম, এক ঝলক, তখন যেমনটি, এখন পঁয়ষট্টিতে এসেও যখন ঝলক কখনো-সখনো দেখতে পাই, তাতে একই রূপ আর রস যেন উথলে উঠছে। কৈশোরোত্তীর্ণ যন্ত্রণার মধ্যে তাকে দেখার ইচ্ছে হতো প্রেমিকা হিসেবে, হাতে মলম, লাগিয়ে দেবে ক্ষতগুলোতে। রহস্যময়ীর প্রেমিকা সাজার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। কল্পনাকে বাড়োয়া দিতে আলেয়া হতো। খোঁজো তারে খোঁজো। কচিৎ হয়তো কোনো বিদ্যুতচমকের সুযোগে তার চিকন চিবুক দেখে থাকব। সেটুকু দেখাতেই প্রেমিকা সাধা। মানেনি সে। কারণ, সে হয়তো টের পেয়েছিল, আমাতে প্রেম জাগেনি, তাকে ভালোবাসার মতো প্রেম। স্ব-আরোপিত একপাক্ষিক প্রেম থেকে কিছুদিন সরেই থাকলাম। ঠিক আছে, যদি প্রেম জেগে নাই থাকে, তাহলে প্রেম জাগানোর অনুশীলনে মত্ত হই। এইসময়টায় তাকে ঝলকের জন্যও দেখতে পাইনি। কেমন বদলেছে তার চোখ-কান-নাক-ওষ্ঠ-চিবুক, কোনো ধারণাই ছিল না। বয়স বাড়ল, কৈশোরোত্তীর্ণ যন্ত্রণা যৌবনের রোমান্টিসিজমে এসে মিশল। চব্বিশ-পঁচিশ। আবারও প্রেম জেগে উঠল, এবারে যেন পরীক্ষা দেওয়ার পালা ‘আমাতে প্রেম জেগেছে কিনা দ্যাখো গো’? তাকে ভালোবাসতে গেলে কী কী গুণাবলীর অধিকারী হতে হয়, কী ধরনের হিরোইজম দেখাতে হয়, তার চাহিদাই বা কী, আমিই বা তার কাছে কী চাই, চাইতে পারি, ধারণা স্পষ্ট নয়। শুধু প্রেম করব বললেই হয় না, তাকে একান্তে পেতে পটাতেও জানতে হবে। পটানোর কৌশলই বা কী? এতসব জানাজানির বাইরে থেকেই ভালোবাসার ফের শুরু। একপাক্ষিকই। ছাব্বিশে এসে এমনকি লিখেও ফেললাম— “কবিতা যে মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম, অনন্যা!” লাও ঠ্যালা। মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ ধর্ম কবিতা! যেন একটু বেশিই তোয়াজ করা হয়ে গেল, যৌবনের যা সিম্পটম। এবার বিষয়টা দাঁড়িয়ে গেল— ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না!’ যতটুকু যা দেখি তাতে একইরকম, তার ওপর বয়সের কোনো ছাপ নেই, নিত্য-নয়া। তার চিবুকের তিল-টা পর্যন্ত একই জায়গায়, এমনকি লিপস্টিকের রঙের ভিন্নতা থাকলেও লিপ-দুটো একই। আর সেই আলেয়া ভাব। থাকে তো, অলকগুচ্ছ দেখিয়ে কেটে পড়ে। প্রেমের বিনিময়ে প্রেম দেবার কোনো নামগন্ধই নেই। এভাবেই চলে, একপাক্ষিক। পঁচিশ বছর পর একবার দেখতে ইচ্ছে হল, আচ্ছা বহুদিন তো গেল, পঞ্চাশে পা, কল্পপ্রেমিকার অবস্থানটা একটু দেখাই যাক রূপ-রঙ-তামাশা-রসে এখন কেমন সে! ওয়াজেদ আলি-র মতো আবিষ্কার করলাম, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে’। না-পাওয়ার বেদনায় একটা ফাঁকাকে ভরতে হাজার হাজার ফাঁকা মুখিয়ে থাকে।

এখন পঁয়ষট্টি, যে কথায় শুরু করেছিলাম। ভাবি, কম দিন তো হল না। সেই দেমাক নিয়েই থেকে গেল আলেয়াশ্রী। এক রূপ এক লালিত্য। কেবল পোশাকে কিছু হেরফের দেখেছি। কখনো শাড়ি, ব্লাউজে ব্রোচ লাগানো, কখনো ঘাগরা-চোলি, কখনো প্লেন একটা সালোয়ার-কামিজ আর একটা উড়ু-উড়ু ওড়না। আবার কখনো জিনস্‌ আর টপ, একটু উঠে গেলেই তৃতীয়ার চাঁদের মতো নাভি দেখা যায়। কিন্তু বয়স বাড়েনি। আর আমাকে তার প্রেমিক হিসেবে মান্যতা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আমিও বহু আগেই বুঝে গেছি, তাকে ভালোবাসা শর্তহীন, দেওয়া-নেওয়া সূত্রে সে আবদ্ধ হওয়ার নয়, কোনোদিন কারও কাছে হয়ওনি। বুঝে গেছি, কবিতাকে আমার কিছু দেওয়ার থাকলেও থাকতে পারে, তার কাছে পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। আর পাওয়ার যদি কিছু নাই থাকে, তাহলে চাওয়ার কোনো মানেই হয় না। কাঙাল তবু চায়, হয়তো অর্থ, পুরস্কার, সম্মাননা, নাম-যশ-প্রতিষ্ঠা। কিন্তু অনেক ভেবে দেখেছি, সেই প্রায় তিরিশ বছর আগে থেকেই, প্রকৃত কাঙালের চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। সে মাধুকরী করে খায়, সঞ্চয় কিছু রাখে না। স্বাভাবিকভাবেই আমার মাধুকরী শুধুই পাঠকপ্রিয়তা। তার বেশি কিছু নয়। ভালোবাসলে নিঃশর্ত ভালোবাসাই শ্রেয়, এবং একমাত্র পন্থা। তাই কবিতার বয়স বাড়ে না, কবিতাকারীর বয়স বাড়তেই থাকে, পুরোনো হয়, জীর্ণ হয়। কিন্তু সে যাকে ভালোবাসে তার বয়স বাড়ে না, সে নিত্য নতুন, নতুনত্বের পূজারী হওয়ায় সে কচিটিই থেকে যায়, কোনোদিন সমস্ত রহস্যের বীজ উন্মোচন করে সে এসে দাঁড়ায় না জীর্ণতার রূপে-রঙে-রসে। তাতে, তার যে প্রেমিকসকল, তাকে ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে গেলেও তার কিছু করার থাকে না। 

আরও পড়ুন...