Categories
2020_july

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

বি শে ষ  র চ না

শু দ্ধে ন্দু   চ ক্র ব র্তী

কবিমনের ব্যবচ্ছেদ 

ঠিক যেন পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথনের নন্দিনীর মতো বলে ওঠা, “ভারি কথা শুনতে ভয় করে/অন্য কিছু বলো বা শোনাও/ইদানিং লেখা কবিতার/একটা দুটো,যা ইচ্ছা তোমার।” কবির মনের চলন আর তার গঠনের যোগসাজশে মানুষের মস্তিষ্কের যে ব্যবচ্ছেদ এখন আমরা করতে চলেছি, তার মধ্যে যে বেশ কিছু ভারি শব্দ এসে পড়বেই এতে আশ্চর্যের কী! সৃষ্টিশীল কবিমন সহজ প্রক্রিয়া নয়। যে মানুষ প্রকৃতই কবি, তার মস্তিষ্কের জটিল রসায়ন ভেদ করতে মনোবিজ্ঞানীরা পরিশ্রম করে চলেছেন বছরের পর বছর। তার মনকে ঘিরে ঘুরতে থাকা নানান বিতর্কের তালিকাও তো নেহাত কম নয়।

                ঠিক যেমন অনেকদিন অবধি মনোবৈজ্ঞানিকরা মনে করতেন মানুষের মস্তিষ্কের বামদিক হলো যুক্তির, আর ডানদিক সৃষ্টির। সেই ধারণা আধুনিক প্রযুক্তির নিরীক্ষণে অনেকটাই বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। বরং আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে মস্তিষ্কের দুই দিকের পারস্পরিক আদানপ্রদান। ঠিক তেমনই সৃষ্টিশীল মনকে ঘিরে ঘুরতে থাকা আরেকটি ধারণা হলো- যুক্তিপূর্ণ চিন্তা আদতে কবিত্বের বিরোধী। অথচ সমীক্ষা দেখাচ্ছে সৃষ্টিশীল মনের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মনের কোনও বিরোধ নেই। এর অর্থ একজন বিজ্ঞানের ছাত্র অনায়াসে হতে পারেন একজন কবি। আবার একজন কবি হতেই পারেন এক বিজ্ঞানী। এমনটি না হলে কী একজন গণিতজ্ঞ লিখে ফেলতে পারতেন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম মাইলফলক,যার নাম “ফিরে এসো চাকা”। কবিমনকে নিয়ে আরেকটি ভুল ধারণা হলো এই যে, মনোরোগ আর কবিত্ব পরস্পরের পরিপূরক। এই যুক্তির পক্ষে সমালোচকেরা তুলে আনবেন সিলভিয়া প্লাথ, জীবনানন্দ দাশ, রাইনে মারিয়া রিলকের মতো নাম। যাকে তাঁরা মনোরোগ পরিপন্থী বলবেন, আমি তাকে বলবো মনের অবস্থান। অবসাদ,উৎফুল্লতা,আবেগ,আগ্রাসন কবিতা লেখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মানেই কবিকে পাকাপাকিভাবে মনোরোগী হতে হবে, এ কথা মানতে আমি নারাজ। কবিতা সিংহ,বিষ্ণু দে,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,রবার্ট ফ্রস্ট যে মনোরোগী ছিলেন না একথা প্রমাণের দাবি রাখে না। এক কথায় অবচেতনেই কবিমনের ব্যবচ্ছেদ করতে থাকি আমরা। তাই এবার দেখা যাক কবির মনের গঠন বৈজ্ঞানিকভাবে কেমন হতে পারে।

                  আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে তার ব্যবহারিক যোগ সম্ভব করে তুলেছে। সেই গবেষণা থেকে উঠে আসছে যে জটিল মানচিত্র, তা প্রমাণ করে সৃষ্টিশীল কবিমনের মস্তিষ্কের ব্লুপ্রিন্ট মোটেই সহজ নয়। কবিতাসৃষ্টির বেশ কিছু ধাপ অবচেতনেই মেনে চলে মানুষের মন। কবিতা সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত হলো যোগ। একটি দৃশ্য থেকে একটি দর্শনের যোগ, একটি অভিজ্ঞতার থেকে অনুভূতি ও কল্পনার যোগ। মানুষের ঘিলুর যে অঞ্চল এটি সম্ভব করে তোলে, তার অবস্থান মাথার একদম ত্রিনয়নের জায়গায় লুকিয়ে থাকা ছোট একটি অঞ্চল, যার নাম ফ্রন্টাল করটেক্স। সেই সংশ্লেষের সেই প্রথম ধাপ প্রস্তুতির। এই প্রস্তুতিপর্বে কবি তাঁর কবিতার রূপরেখা,ভাবনাচয়ন,দৃশ্যকল্প  বেছে নেন তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির সঙ্গে নিজস্ব কল্পনার মেলবন্ধন ঘটিয়ে। এরপরের ধাপ অন্তরসংশ্লেষ বা ইনক্যুবেশন। এই সময়ে কবি কবিতা লেখেন। কিন্তু তা লেখা হয় তার মনে। এই সময় কারো ক্ষেত্রে এগারো দিন,কারো এগারো মাস,কারো বা এগারো বছর। রিলকে যেমন ড্যুইনো এলিজি লেখার আগে নিয়ে নিয়েছিলেন এগারো বছর। এই সময়ে কবির মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যামপাস কিন্তু প্রবল সক্রিয়তার সঙ্গে কাজ করতে থাকে। মস্তিষ্কের উপরিভাগের প্রিফ্রন্টাল করটেক্স, পাশের টেম্পোরাল করটেক্স থেকে আসতে থাকে তথ্য। কল্পনা আসে লিম্বিক প্রক্রিয়া থেকেও। লিম্বিক অঞ্চল হলো আবেগপ্রবণতার স্থান। কবি লিখে চলেন পাতার পর পাতা। কিন্তু কলম পড়ে থাকে একপাশে। সাদা হয়ে থাকে পাতা।যিনি কবিতা লেখেন,তিনি জানেন,প্রকৃত কবিতা নির্মাণ করা যায় না। তা হয় স্বতঃস্ফূর্ত। আরকিমিডিসের মতো হঠাৎই চলে আসে ‘ইউরেকা’ হয়ে!

                  এরপরের ধাপ আলোকপাতের। মস্তিষ্কের সেই সংশ্লেষ ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টা। সক্রিয় হয়ে ওঠে মস্তিষ্কের ভাষার কলকারখানা। কোন ছন্দ,কোন শব্দ,কোন গঠন ব্যবহৃত হবে কবিতায়, কবিমন ভাবতে থাকে। এই সময়ে সক্রিয় থাকা মস্তিষ্কাঞ্চল হলো বেসাল গ্যাঙলিয়া। তৈরি হয় চিরকুট। পছন্দ হয় না। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আবার নতুন কাগজ। আবার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। হঠাৎ ঘটে যায় আলোকপাত। ইউরেকা!

               শেষমেশ যাচাই করে নেওয়ার স্তর। যিনি প্রকৃত কবি,তিনি কখনোই এই স্তরে না পা রেখে কবিতাকে চুড়ান্ত করেন না। এই স্তর পর্যবেক্ষণের। নিজের কবিতাকে অপরিচিতের মতো করে পড়বার চেষ্টা করা। বিশ্লেষকের চোখে কাটাছেঁড়া করা। প্রয়োজনীয় শব্দ রেখে অপ্রয়োজনীয় শব্দ বাদ দিয়ে দেওয়া। এই প্রক্রিয়াতে শুধু কল্পনা বা আবেগ নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক যুক্তিগ্রাহ্যতার। কবিমনের এই প্রক্রিয়া সম্ভব করে তোলে মস্তিষ্কের সাদা অংশ বা হোয়াইট ম্যাটার। সেখানে যতো পারস্পরিক যোগাযোগ, কবিতা ততোটাই উৎকৃষ্ট।

             কবির কবিমন যে জটিল একথা অজানা নয়।কিন্তু তার যে পদক্ষেপ আছে,সংশ্লেষ আছে,বিন্যাস আছে,উত্তরণ আছে তার মস্তিষ্কের ভিতরেই,তা আধুনিক মনোবিজ্ঞান ক্রমশ প্রমাণ করছে। এই বিষয়ে আরও আলোকপাত করলে কে বলতে পারে একদিন সুপারকম্প্যুটার আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে যন্ত্রও লিখতে পারবে কবিতা। কিন্তু সত্যিই কী পারবে? “চিরসখা হে, ছেড়ো না মোরে” লিখতে পারবে কি? তাই সমাপ্তিতে ফিরে আসি আবার প্রবেশকেই। সহজ কথা যায় না বলা সহজে।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

পল্লবী মুখোপাধ্যায়

পা ঠ  প্র তি ক্রি য়া  ২

প ল্ল বী   মু খো পা ধ্যা য়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— স্বীকারোক্তিমূলক এক কবির জার্নি

কবিতার কথা ভাবতে বসে বুদ্ধদেব বসুর একটা কথা মনে হয়- “… আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যাবে।” আধুনিক কবিতায় প্রত‍্যেক কলমের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার চরিত্র বদল ঘটেছে। ৪০-৫০এর দশক হল উত্তেজনার দশক। বিশেষ করে ৫০-এর দশক।

 

এ সময় অনুভূতিকে পালিশ না করে সরাসরি কবিতায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গভীর যন্ত্রণা, হতাশা, রোমান্টিকতার সঙ্গে ব্ল‍্যাক রোমান্টিকতা, উত্তরনের কামনা, দেহ কামনার সঙ্গে অতীন্দ্রিয়বোধ, নাস্তিকের সঙ্গে ঈশ্বর, পাপ পুণ‍্য বিভিন্ন পক্ষপাতের মতো প্রচুর চিন্তা চেতনা নিয়ে কবিতার ভাঙা গড়া চলে।

 

৫০এর দশক লিরিকধর্মিতাকে প্রায় বিসর্জন দেয়। শীতলতাময় উচ্চারণের প্রবণতা উঠে আসে। সে সময়ের একজন শক্তিশালী কলমের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলম যেন আরও এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। ওঁর ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কাব‍্যগ্রন্থের নামকরণ থেকেই এই সময়ের কবিতার চরিত্র যে আরও একটা স্বাধীন আঙ্গিক খুঁজে পাচ্ছে তা বেশ ভালোই বোঝা যায় কবিতা পড়তে বসলে।

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘বন্দী জেগে আছো’, ‘মন ভালো নেই’, ‘সেই মুহূর্তে নীরা’ এইসব কাব‍্যগ্রন্থ থেকে সেই অনায়াস স্বাচ্ছন্দ‍্য দেখতে পেয়েছি।

 

প্রতিটা কবিতায় কোনোরকম আড়াল না রেখে সরাসরি কথা বলার কৌশল মুগ্ধ করেছে। অসংকোচ রীতিতে শব্দ সাজিয়েছেন।

 

আমার সামান্য জ্ঞানে মনে হয়েছে স্থিতাবস্থা ভাঙার জন্য এই প্রকরণের হয়তো প্রয়োজন ছিল। যেমন “সপ্তম গর্ভের কন‍্যা” কবিতায় বলেছেন—

 “সপ্তম গর্ভের কন‍্যা, কেন এলি যে বাড়িতে 

উনুন জ্বলে না?”  এইভাবে শব্দকে পালিশ না করে বাস্তবের ভ্রূণ থেকে জল ভেঙে শব্দ এনেছেন। 

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার কোনো এক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের মধ্যে কোনোরকম পরামর্শ না করেই যে নতুন রীতিতে কবিতা লিখতে শুরু করেছে, তাকে বলা যেতে পারে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা…”

 

বেশ কিছু কবিতায় এমন ধর্মও দেখেছি –

 

“আমার নাকি বয়েস বাড়ছে? হাসতে হাসতে এই কথাটা 

স্নানের আগে বাথরুমে যে ক’বার বললুম!”

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটা প্রায় ১৭টা কাব‍্যগ্রন্থ থেকে বেছে নেওয়া কবিতা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ফলে বিভিন্ন স্বাদ একসঙ্গে আস্বাদন করার সুযোগ হয়। শিল্পের শুদ্ধতার আধুনিকতাকে আরও কাছ থেকে দেখি।

 

আমার কাছে সুনীল-কবিতা একটা যুগও বটে— যেখানে রয়েছে এক বৃহৎ পাঠক গোষ্ঠী। আসলে অনুভবকে পুরো মূল্য না চুকিয়ে দিয়ে শুধু মেধা ও মননের চর্চা কিংবা রূপকলা তৈরিতে সচেতন হওয়া— কবির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলে, পাঠক হারাবার ভয় থেকেই যায়। যে ভয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনোদিনই ছিল না। যে কারোর মন পড়তে পারে ওঁর কবিতার শব্দরা—

 

“সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশী, আমায় ভুল বুঝবে?” (সখী আমার)

 

এক নিঃশ্বাসে কবিতা পড়ে শুধু উত্তাপকে অনায়াসে উপলব্ধি করেছি। ক্লান্তি দূর দূরান্তেও অনুভব করিনি। অনুবাদও তাঁর সাবলীল, নরম, মোলায়েম— “তখন তোমার বয়স আশি, দাঁড়াবে গিয়ে আয়নায় / নিজেই বিষম চমক যাবে, ভাববে এ কে? সামনে এ কোন্ ডাইনী?” ( ফরাসী কবিতার ভাব-অনুসরণে)। তাঁর কবিতায় রসবোধের তীক্ষ্মতাও অসাধারণ— “গাঁয়েতে এয়েছে এক কেরামতি সাহেব কোম্পানি/ কত তার ঢ‍্যাঁড়াকাড়া…” ( হাসান্ রাজার বাড়ি)

 

কি অদ্ভুতভাবে শরীরের উপর যৌবনের তৃষ্ণা এঁকেছেন। যেন এক ঘুমন্ত নারীর যৌবন স্পর্ধা হয়ে গ্রীবা তুলে শরীরী আকুলতাকে জানান দিচ্ছে। আজ ২০২০তেও আধুনিকতার পারদ, স্মার্টনেসের দিক দিয়ে ভীষণ প্রসঙ্গিক —

 

” ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি

উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু”

 

এমন কলমের সান্নিধ্য পেয়ে মনে সাহস পাই। সবাই নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে বাস্তব লিখলেও হাত খুলে লিখতে সঙ্কোচে পড়েন। শব্দ যে ব্রহ্ম সেটা প্রতিটা শব্দ প্রয়োগে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সমাজের যে চাপ আসতে পারে সেটা জেনে নিজেকে গুটিয়ে বুদ্ধি প্রয়োগ করেননি শব্দে–

 

“বাবরের সঙ্গে দেখা! তিনি হাঁটু গেড়ে 

সোনালি উষ্ণীষ খুলে নামাজ আদায়ে

বসেছেন। আমি কোনো ধর্মেরই প্রকাশ‍্য 

উদ্দীপনে অবিশ্বাসী।..”

 

বাস্তবের কথা ভাবতে গিয়ে কিন্তু রোমান্টিকতা বা প্রকৃতিকে বাদ দিয়েছেন তাও না। প্রকৃতিকে দৈনন্দিন বাস্তবের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। চলাফেরার পথে বা ভালো খারাপ অনুভূতি নিয়ে যাতে প্রকৃতির গায়ে ঠেস দিয়ে বসতে পারি সে ব‍্যবস্থা সজাগ হয়ে করেছেন।

 

“স্তব্ধ নীল আকাশের দৃশ্য অন্তহীন পটভূমি 

চক্ষুর সীমানা– প্রান্তে বেঁধে দিয়ে তুমি 

এঁকে দিলে মাঠ বন বৃষ্টি– মগ্ন নদী…”

 

কবিতায় শিশু সুলভ আবেগ থাকে– প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেমে মগ্ন এমন ছবি আধুনিক তো বটেই, যাঁরা কবিতাপ্রিয় নন এমন পাঠকবর্গকেও এই সাবলীলতা আকর্ষণ করে—

” নীরা, তোমার মনে পড়ে না স্বর্গ নদীর পারের দৃশ্য?

যুথীর মালা গলায় পরে বাতাস ওড়ে…”

 

বিদেশি দর্শনকে আপন করে বাংলা সাহিত্যকে আরও সাজিয়েছেন। গুরুপাক হয়ে হজমে, অর্থাৎ আত্মস্থ করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে এমন বিপদেও পড়তে দেননি।

” চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় 

আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে…”

 

অথবা,

 

” ফ্রয়েড ও মার্ক্স নামে দুই দাড়িওলা

বলে গেল, মানুষেরও রয়েছে সীমানা “

 

এককথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতার জন্য নতুন কাব‍্য আঙ্গিক তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর কবিতাকে বলেছেন স্বীকারোক্তি মূলক।

আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পর আধুনিকতার কান্ডারী জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের ঘরানাকে অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধু ঘরানা নন, তিনি স্বয়ং এক আধুনিক যুগ যার শতাব্দী কোনো দিনই শেষ হয় না।

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা
দেজ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ – মাঘ ১৩৮৪, জানুয়ারি ১৯৭৮

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

উজ্জ্বল পাঠ । পর্ব ৩

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ৩

সে লি ম   ম ণ্ড ল

হেমন্তের হৃদে ভেসে-যাওয়া পুরোনো এক পাতা: সমর চক্রবর্তী

আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস— কেউ মারা গেলে তাঁকে ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দেওয়া। প্রিয় কবি, পছন্দের কবি নিয়ে ফেসবুকে মাঝেমাঝে তর্ক-বিতর্ক দেখি। এ ধরনের তর্ক-বিতর্ক হাসির খোরাক ছাড়া কিছু না। ‘প্রিয়’ শব্দটা ভীষণ রাজনৈতিক ও সন্দেহজনক। তবু এ নিয়েই আমাদের চলতে হয়। লিখতে আসার শুরু থেকে আজ অবধি অজস্র কবি পছন্দের তালিকায় এসেছেন বা পছন্দ থেকে দূরে সরে গেছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক বা সন্দেহজনক কিছু থাকলেও থাকতে পারে। তবে প্রধান যে কারণ, তা হল— আমি লিখতে আসার শুরু থেকে আজ অবধি কীভাবে নিজের পাঠকসত্তাকে চালিত করছি। কোন পথে যেতে চাইছি। সেই পথে যেতে যেতে কোন গাছ, কোন পাহাড় দেখছি, সেগুলো আমার মনে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার ওপর নির্ভর করে অনেকটা। যাইহোক, আবার শুরুতে ফিরে আসি। মৃত্যুর পর এক ব্যক্তিকে আমি আনফ্রেন্ড করে দিই। জানতাম লেখালেখি করেন। লেখা সেভাবে পড়া হয়নি। কোনোদিন ইনবক্সেও কথা হয়নি। ফেসবুকে তিনি সম্ভবত কোনো লেখাও পোস্ট করতেন না। 

 

২০২০-তে আমাদের ফোরামের লিটল ম্যাগাজিন মেলায় ‘হাওয়াকল’ প্রকাশনীর টেবিলে চমৎকার একটা জেল জ্যাকেটের বই নজর কাড়ে। ছবি দেখেই মানুষটিকে চিনতে পারি। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই বইটির কয়েকপাতা পড়ে ফেলি। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করল। কেন এই মানুষটির কথা আগে জানতে পারিনি। বইটি কিনে নিই। কবি রিমি দে খুব গুছিয়ে বইটির সম্পাদনা করেছেন। এই কবির নাম সমর চক্রবর্তী। শিলিগুড়ি বাড়ি। শিলিগুড়ি কলেজেই অধ্যাপনা করতেন। ইংরাজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সুবীরদার (সরকার) সঙ্গে কথাসূত্রে মানুষটির সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। সত্তর দশকের এই কবি, শিক্ষক হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। সম্পাদিকা, ভূমিকাতে বলেছেন— “আমরা যারা খুব কাছ থেকে সমরদাকে দেখেছি, চিনেছি কিংবা পারিবারিকসূত্রে জেনেছি ওঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি, টের পেয়েছি যে শিশুর সারল্য বুকে রেখে গার্হস্থ্য প্রেম ও প্রবল ঔদাসীন্য লালন করতেন একইসঙ্গে। সংসারে থেকেও অসংসারী আবার বাউল হয়েও অসম্ভব গৃহী। এমন মানুষ খুব কম দেখা যায়”। 

   

২   

সুর সম্পর্কে একদম আনকোরা আমি। তবু অনেকসময় নানারকম গান শুনি। তার ভাষা বুঝি বা না-বুঝি। কান শান্তি পাচ্ছে। মনের ভিতর কোথাও যেন মৃদু বাতাস বইছে টের পাই। কিছু কিছু কবির ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর ভাষা বা ভাবনাকে ধরতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু কবিতার মধ্যে থাকা কোনো একটা সুর কবিতার প্রতি আসক্ত করে তুলছে। এই আসক্ত করে তোলার ক্ষমতা সব কবির থাকে না। কেউ কেউ পারেন। তবে কবিতার সুর অনেকসময় কবিতার ভাবনাকে নষ্ট করে। কবি সমর চক্রবর্তীর নির্বাচিত কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার ওঁর সুর আমাকে আবিষ্ট করেছে। বাংলাভাষায় ক’জন কবি কবিতার সুর নিয়ে ভাবেন জানি না। তবে কবি সমর চক্রবর্তীর কবিতার সুর যেন কোনো উচ্চাঙ্গ সংগীতের। হলভর্তি মানুষ গমগম করছে, কিন্তু কোনো হইহুল্লোড় নেই। শুধু হলের দেওয়ালে দেওয়ালে শিল্পীর গলার আওয়াজ ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে কানে। কান আরও প্রসারিত হচ্ছে ওই আওয়াজ সম্পূর্ণ ধারণ করতে। কবির কাব্যগ্রন্থগুলি পড়লে আমরা হয়ত সেটা টের পাব। ধীরে কবির নানা কবিতা পড়ব।

 

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শিলা কিংবা শৈলীবিষয়ক’। প্রকাশ হয় ১৯৯৭ সালে। ওই বইয়ের নাম কবিতাটা পড়া যাক—

 

পাথর এত তরল হতে জানে

শব্দবিহীন ছন্দোমহান মানের

টানে নেচে উঠল পাথর

 

হঠাৎ গূঢ় জন্ম রটে গেল

গুহার মধ্যে আকাশফাটা আলোর

ভালোবাসায় ভাসে পাথর

 

পাথর কুঁদে ঠিকরে নিলে ঝলস

তাকে তোমার খিদের কথা বলো

তাকে তোমার শীতের কথা বলো

মাঠের মাঘে ফুটিয়ে তোলা পলাশ

পাথর এখন উপুড়কলস 

গানে

 

এই কবিতার একটা অন্ধকার ও একটা আলোর দিক আছে। সেই অন্ধকার এত ঘন হয়েও তাৎক্ষণিক। বরং আলোটাই ছড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসায় যে পাথর ভাসে যেখানে আমাদের জমাট হতে বলে। আমাদের শীত, খিদেকে হয়ে উঠতে বলে মাঘের মাঠের পলাশ। মাঠের নীরবতা নয়, মাঠের প্রশস্ততায় যেন সমস্ত পাথর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। আমরা তরল হয়ে পাথরের সঙ্গে ভাসি। 

 

আমরা কবিতা লিখি না জীবন লিখি? কবিতা জীবনকে কোন আয়নার সামনে দাঁড় করাই? সেই আয়নায় কি আমরা নিজের মুখ দেখি? নাকি কেউ এসে সেই আয়নায় ভিড় জমাবে বলে সমস্ত ধুলোবালি সরিয়ে জমাট করি ধুলোবালি? ‘ভাষা দুই’ শিরোনামে তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতার মধ্যে একটি লাইন আছে— দ্রব মেদিনীর কষ্টে বর্ণবিভেদের আঁকাবাঁকা। লাইনটি নিয়ে ভাবছিলাম। কবি কেন এভাবে লিখলেন? লাইনটি কি কোথাও আমাদের আঘাত করছে না? পরের লাইনে লিখেছেন— শানে বাঁধা ঘাটের চকিত    শ্যাওলাশিথিল সীমারেখা। পরের লাইনে এসে বোঝা গেল কবিতায় তাঁর এই শব্দপ্রয়োগ জোরপূর্বক নয়। স্বভাবোচিত। আর এখানেই বোধহয় নিজস্ব মুন্সিয়ানা। ‘শ্যাওলাশিথিল সীমারেখা’ এই শব্দ আমি কোনোদিন ভুলব না। কবিতা লিখতে এসে মনে হয়— একটি পুকুরই যেন আমার অবস্থান। চারিপাশে শ্যাওলাঘেরা। আমি মাঝখানে সাঁতার কাটা, মাঝেমধ্যে ডুব দেওয়া কোনো হাঁস। নিজের ডানার জল ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিজেকে আবার করে তুলছি জলেরই কোনো আপনজন। কবিতাটা পড়া যাক—

 

একদিন কবিতা লিখেছি    এখন আমাকে লিখি     জলে

ধুয়ে যাই    ছুঁয়ে যাই     তারও

আগে কালো নীল ফিকে গাঢ়    কাদা

দ্রব মেদিনীর কষ্টে বর্ণবিভেদের আঁকাবাঁকা

শানে বাঁধা ঘাটের চকিত    শ্যাওলাশিথিল সীমারেখা

এতদিন কবিতা লিখছি    এখন জীবন লিখি    জলে 

 

চুপ! কোনো শব্দ নয় আমাদের পাপ ভেঙে যাবে।এক পংক্তির এই কবিতাটি প্রথম কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা। একটা লাইন কীভাবে একটা গোটা কবিতা হয়ে উঠতে পারে তা আমরা এই কবিতাটি পড়লেই বুঝতে পারি। কবিতা তো এমনই তীব্র হওয়া দরকার। যা আমাদের ফালা ফালা করবে। আমরা আমাদের ওই ফালা ফালা বুক নিয়ে বিনা ব্যান্ডেজে কোনো ভোরে উঠে দেখব আমাদের চেনা নতুন সূর্য। চুপ থাকতে থাকতে চুপকথার রাজ্যে আমাদের ধনসম্পদ, মনোসম্পদ, বাক্‌সম্পদ ক্রমশ লুঠ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এই দৃশ্য দেখতে দেখতে নতুন দৃশ্যে ঢুকছি। যেন আমাদেরই আঁকার খাতা। আমরা নিজেরাই আঁকছি। আঁকা শেষ হলে নিজেরাই ‘ভেরি গুড’ দিচ্ছি। তীব্র ব্যঞ্জনাময় এই একলাইন যেন আমদের চোখের সামনে আঙুল এনে বলে দেয়, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?”

 

কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাঠ ও পতনের কবিতা’ থেকে কয়েকটি কবিতা পড়া যাক—

 

দূরত্ব

 

তবু সব দেখতে পাচ্ছি    সামনে রাত্রিনগ্নিকার শব

তার কালো অনিশ্চিত ঢেউ

পেছনে রঙিন চরাচর

এই থীবস্   ওই চাঁপাগাছ    দূর সরযূর রেখা

দেখতে পাচ্ছি    আরও দূরে

শিল্প হয়ে ঝরে পড়ছে নিহত চোখের যত বালি

 

সন্ধিকালীন

 

একটা সরু সাঁকোর মতো বিপজ্জনক বিকেল

টলতে টলতে ঢলে পড়ল মিথ্যেসখীর দিকে

 

তখন থেকে শুরু হলাম    তখনই কল্পিত

জলের ওপর এঁকে দিলাম জীবন্ত জলপিপি

 

তার মানে তো অভিজ্ঞতা    সত্য এবং সরল

ঠিক জানি না    মিথ্যেসখী    এবার আমায় ধরো

 

আর যা বাকি    সন্ধিকালীন    হোক তা জনান্তিকে

 

আজ ঠিক রবিবার নয়

 

আজ ঠিক রবিবার নয়    আজ বিধিবহির্ভূত ছুটি

 

সূর্য আজ ভোরে উঠেছেন    তারও আগে ওঠা যায় না বলে

সমুদ্র আমাকে দেখতে নার্সিংহোমের কুণ্ঠিত বাগানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে

আমি তার পৃথুল হৃদয়ে নিজেকে প্রোথিত করে 

সূর্য স্পর্শ করি

 

আমার শরীর থেকে বাকলের ছায়া খসতে থাকে  

 

ন্যূনতম

 

একেকটি চুম্বন মানে একেকটা মৃত্যুর কথামুখ

তাই চুম্বনের আগে কিছুটা বয়ঃস্থ হয়ে নিতে হয়

তা না হলে মরতে চাওয়ার ন্যূনতম অধিকার জন্মাতে পারে না

 

দেখো সাবালক জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে জল ও বাতাস

তীব্রতর হয়ে উঠছে    জনদুপুরের আত্মগ্লানি

তোমার ঠোঁটের দিকে মুগ্ধ পিপাসায়

নেমে আসছে এই তুচ্ছ মননশীলতা

আমার প্রপন্ন প্রেম    আর্ত    আর্দ্র    মরণশীলতা

 

তুমি কি প্রস্তুত আছো    মুখমদে মিশিয়েছ বিষ 

 

প্রসঙ্গ

 

জনদুপুরের জন্য এতটাই তুলে রেখেছিলে!

 

রাস্তায় আত্মার গ্লানি গায়ে মেখে এঘরে এসেছি।

 

রিসিভার নামিয়ে রেখেছো,

 

অনুসঙ্গসূত্রগুলি বিচ্ছিন্ন করেছো একে একে

 

এবার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠো,

যেমন একান্ত জল

আত্মঘাতী সাবানের কাছে। 

 

আগের পর্বগুলিতে আমি বারবার বলেছি, আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি করছি। এই ধারাবাহিক কোনো গবেষক বা আলোচকের না। এই ধারাবাহিকটা শুরু করেছি— কবির কবিতার সঙ্গে পাঠকদের সংযোগ ঘটানোর উদ্দেশ্যে। চেষ্টা করছি যত বেশি সম্ভব সম্পূর্ণ কবিতা লেখাটির মধ্যে রাখতে। কবিতার ব্যাখা আমার কাছে মনে হয়ে সবুজ মাঠে পড়ে থাকা শুকনো ঘাসকে পিষে দেওয়া অবহেলার মতো। সবুজ মাঠে যখন বিচরণ করছি, তরতাজা ঘাস না ছুঁয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঘাস মাড়াব কেন? তাছাড়া বহুমুখী কবিতার ‘বহুমুখ’ থাকবে। প্রতিটি পাঠক নিজ নিজ পাঠে রহস্যসন্ধান করবেন। নিজের মতো করে খুঁজবেন আলো। তাই কোনো আলোচনায় না গিয়ে লেখাটির মাধ্যমে কবির গতিপথ বোঝার চেষ্টা করব। উপরের পাঁচটি কবিতা যদি আমরা গভীরভাবে পাঠ করি, কবি সম্পর্কে ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। ‘কবিতা বিষয়ক ভাবনা’ শীর্ষক একটি গদ্যে নবনীতা দেব সেন বলেছিলেন— “কবিতা আমার নাড়ির সঙ্গে জড়ানো কবচকুণ্ডল। কবিতা আমার অভিমান, আমার প্রার্থনা, আমার নিঃসঙ্গতা, আমার সঙ্গ, আমার পূর্ণতা, আমার অতৃপ্তি। চিরকালের পথে সে নুপূর হয়ে জড়িয়ে থাকে। যে কবিতা ফুরোয় না, আজ পর্যন্ত তেমন কবিতা কি লিখতে পেরেছি? জীবনের প্রত্যেকটি কবিতাই বোধহয় সেই কবিতাকে খোঁজার চেষ্টা। একটু পর্দা, একটু আব্রু, কিছুটা রহস্য থাকা চাই। এটা কবিতার অত্যাবশক ধর্ম। “দেখা না দেখায় মেশা” বধের অতীত এক বিদ্যুৎলতার উপস্থিতি চাই কবিতার “দ্য লা ম্যুজিক আভঁ ত্যুলে শোজ” সবার আগে সংগীত। তখন ভাষা তো সংকেত, ভাষা তো এক বুনো ঘোড়া। তাকে পোষ মানিয়ে জ্বলন্ত আগুনের রিঙের মধ্য দিয়ে তালে তালে লাফ দেওয়ানোর নাম কবিতা।” কবি সমর চক্রবর্তী সেই কবিতা সন্ধানেই ভাষাকে বুনো ঘোড়া করেছেন। তিনি অস্থির হয়ে কেমন যেন স্থির হয়ে থাকেন। তিনি দেখেন শিল্প হয়ে ঝরে পড়া নিহত চোখের বালি। দেখেন রাত্রিনগ্নিকার শব। অনিশ্চিত কালো ঢেউগুলো। তিনি সরু সাঁকোর মতো বিপজ্জনক বিকেলে টলতে টলতে ঢলে পড়েন মিথ্যেসখীর দিকে। নার্সিংহোমের কুণ্ঠিত বাগানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা সমুদ্রের পৃথুল হৃদয়ে প্রোথিত করেন নিজেকে। একি মৃত্যুচেতনা নয়? নাকি তাকে বশ করে তারই সঙ্গে করতে চাইছেন ঘর? সেজন্যই কি তিনি বলে ওঠেন— একেকটি চুম্বন মানে একেকটা মৃত্যুর কথামুখ/ তাই চুম্বনের আগে কিছুটা বয়ঃস্থ হয়ে নিতে হয়/ তা না হলে মরতে চাওয়ার ন্যূনতম অধিকার জন্মাতে পারে না।  কবি প্রেমিক মানুষ। প্রেম তাঁর কবিতায় এসেছে জোছনার মতো। আমরা সেই জোছনায় কনকনে ঠান্ডার দিনেও স্নান সেরে নিতে পারি। আমাদের রোমকূপের মধ্যে যে ভয় সংঘবদ্ধ হয়ে কালো হয়েছিল, তা এতটাই শাদা হয়ে ওঠে আমাদের মনে, শুভ্রতার সারি সারি বালি চিকচিক করে। জল হয়ে ওঠে সমস্ত ভয়। আত্মঘাতী হওয়া সাবান তার ফেনায় হাজার হাজার পৃথিবী তৈরী করে। আমরা নিজেরাই যে ঠিক করে নিই কোন পৃথিবী আমার? 

 

কবির তৃতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ অপড়া অবাক্‌প্রতিমারা’ থেকে একটি কবিতা পড়া যাক—

 

ডাক

 

আমাকে ভেতরে ডেকে নিও    যখন সময় হবে জল

যখন স্নানার্থী কোলাহল    থেমে যাবে

তখন একবার বোলো    বেলা হল    এখনও আসবে না

 

দুপুরের করুণ হলুদ    বাবলার আঁচড়ে চিরে গেছে

গভীর গাভীর কাছাকাছি কিছু কিছু চর ও অচর

আগেভাগে বিকেলে ঝুঁকেছে

একটু দূরে জারুলপুরের আকাশ ধুলোর মতো রঙ

ডাহুকের ডাক বেয়ে বেয়ে    এই মাঠে বড়ো হচ্ছে ছায়া

সরু হয়ে নিবে আসছে নদী

 

বেলা যায়    আমিও কি যাই

 

ভেতরে ভেতরে জড়ো হই    নদীর নিঃশ্বাস কেঁপে ওঠে 

 

কবির কবিতায় একাধিক বার জলের প্রসঙ্গ এসেছে। জলের প্রতি মোহ কেন? জল কি কেবলই বিষাদব্যঞ্জনা? আমি নিজেও জলের মোহে বারবার ছুটে যাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর পাড়ে বসি। দেখি কচুরিপানার আবদ্ধ ছোটো ছোটো ঢেউগুলো কীভাবে ধাক্কা মারছে একে অপরকে। ওদের কি টিকে থাকার লড়াই আছে? পাড়ে পৌঁছানোর তাড়া আছে? নিজেকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছি। নদীর কাছে কৈফিয়ৎ চাইনি। জলের শরীরে কখনো কখনো হাত বুলিয়ে দেখে নিতে চেয়েছি সে কতটা মাতৃত্বময়। সে আমাকে অদ্ভুত যৌনতা দিয়েছে। শরীরহীন আমি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন শরীরে শুধুই জলের নরম দাগ রেখেছি। আমার বিষাদ, আমার উচ্ছ্বাস সবুজ হয়ে উঠেছে। যেন মনে হয়েছে কোনো গাছ জন্ম নিয়েছে। কবি সমর চক্রবর্তীও কি তেমনটা অনুভব করতেন? কেন জানি না প্রথম লাইন পড়ার পর আমার আর এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় না।  মনে হয়েছে ওই লাইনটিকেই আঁকড়ে ধরে থাকি। আমি নিজেও এমনটা বলতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি কবির মতোই— আমাকে ভেতরে ডেকে নিও    যখন সময় হবে জল। 

 

এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই পাঠের জন্য রইল আরেকটি কবিতা—

 

বিন্দুবিসর্গ

 

বিসর্গ পর্যন্ত যাই

 

বিন্দু থেকে রিসর্ট বিষাদ

 

কার বালা    কার মালা    গলায় পরেছ

 

যেন তা জানার জন্য    যা-না-জানা    তার নীল

ডানায় ওড়াই

আমার ব্যাহত ইচ্ছে আমার    আমার আচ্ছন্দ    ছবিছেঁড়া চোখ

 

গানরেণু

 

৩ 

গান থামে না। তবুও গানকে থামিয়ে দিতে হয়। গলার স্বর মোটা হয়ে গেলে, আড়ষ্ট হয়ে গেলে গুনগুন করাই শ্রেয়। কিন্তু কবিতাকে আমরা কোথায় থামাব? কবিতার নিজের কি কোনো পথ আছে! এত বেড়া দিয়ে হইহুল্লোড় করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন যাঁরা, মাঝরাতে আমি কি তাঁদের ডেকে শোনাব এই কবিতা? চোখ নিভে যায় চোখের আড়ালে। জল দিয়ে কবিতার জোছনা বোনা ছাড়া কীই বা করার থাকে? তাই তো বোধহয় এই কবিকে এত দেরিতে পাঠ করতে এসে অপরাধবোধ কাজ করে। ‘প্রলয়পয়োধি’, ‘বাগর্থবৈভব’, ‘শ্যাওলানিথর’, ‘বায়সপ্রবর’, ‘শতশব্দক্রতু’, ‘ভাষাপারাবার’, ‘আনাভিপিচ্ছিল’, ‘মুখমদ’, ‘বননিশিপুর’, ‘পাখিচরণ’, ‘স্বপ্নবেণীসংহার’, ‘বিরহী ধূপ’ এমন অজস্র শব্দ তাঁর বাগান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। মনে হয় কখনো আমিও কোনো সুন্দর মালা গেঁথে তাঁকে জানাতে পারব আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য। 

 

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ:

 

১। শিলা কিংবা শৈলী বিষয়ক

২। পাঠ ও পতনের কবিতা

৩। অপড়া অবাক্ প্রতিমারা

৪। নির্বাচিত সমর চক্রবর্তী 

 

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:

 

কবি সুবীর সরকার

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

কস্তুরী সেন

বি শে ষ  র চ না

ক স্তু রী   সে ন

কবিতার সমসময় : কবিতায় সমসময়

(পঞ্চাশ থেকে শূন্য দশক)

সমসময়, আধুনিক এবং অবশ্যই উত্তর আধুনিক কবিতার শরীরে একটি এমন চিহ্ন, যাকে জন্মদাগ বলা চলে। উল্কি নয়। অন্তত পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে এযাবৎকালের বাংলা কবিতার পথরেখাটি বরাবর একটি সফরে নামলে দেখব, তা ‘চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট’…আক্ষরিক অর্থেই যে কোনও সিদ্ধান্ত, অনুসিদ্ধান্ত, preconceived notion এর ঘাড় ধরে আছাড় খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত। এর কারণ? এর প্রধান কারণ এই-ই যে, কবিতা আসলে কী, কী কী তার চিহ্ন ও চরিত্রলক্ষণ, সে বিষয়ে অগ্রিম হিসেব কষা চলে না কোনও। 

             পঞ্চাশের কবিতার মুখপত্র হিসেবে যদি কৃত্তিবাস ও শতভিষা, এই দুই পত্রিকাকে ধরি, তবে দেখব, প্রথমটির সম্পাদকীয়তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন- এ সময় আগের দশকগুলির কবিতাভাবনার বদলে ‘নিজেদের মধ্যে কোনরকম পরামর্শ না করেই’ নতুন কবিরা লিখছেন ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা’। আর শতভিষা বলল – ‘…তিরিশের দশকের কবিদের যৌনকাতরতা, মূল্যবোধে অনাস্থা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, অতিরিক্ত সমাজভাবনা, তরল কাব্যময়তা, ইত্যাদি আপাত লক্ষণগুলো যে আর ব্যবহৃত হবার নয় এ সত্য অভ্রান্ত জেনে, কবিতার মুক্তির জন্য শতভিষা প্রয়োজন অনুভব করেছে নতুন পথ সন্ধানের’ — ‘স্বীকারোক্তি’ ও ‘নতুন পথ’ এই দুটি চাবিশব্দ হাতে নিলে দেখছি,  পঞ্চাশ জোর দিচ্ছে ব্যক্তির কথনে এবং স্পষ্টই তার অনীহা ‘অতিরিক্ত সমাজভাবনা’র প্রতি। দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি, কবিতাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া, এই লক্ষণগুলি ধারণ করে মাঠে নেমে পঞ্চাশই সম্ভবত প্রথম তৈরি করতে পারল বাংলা কবিতার সব ধরনের পাঠক, কবিদের মধ্যে আশ্চর্য বিবিধতার সমাহার। এসময় স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের নতুন সম্ভাবনাময় আবহে বেরচ্ছে আলোক সরকারের ‘উতল নির্জন’, আবার তাঁর এই নির্জন বিশুদ্ধ আত্মমগ্নতার পাশাপাশিই সমসময়ের চিহ্ন ধারণ করছেন শঙ্খ ঘোষ, উদ্বাস্তু আগমনের ক্ষত বহন করে পঞ্চাশেই লিখছেন ‘কবর’ কবিতা – ‘নিবেই যখন গেলাম আমি নিবতে দিও হে পৃথিবী/আমার হাড়ে পাহাড় কোরো জমা/মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে অস্ত্র গোড়ো/আমায় কোরো ক্ষমা’। পঞ্চাশের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অথবা পঞ্চাশের শক্তি চট্টোপাধ্যায় সহ কোনও কবির কবিতাকেই ঠিক বেঁধে রাখা যাচ্ছে না একমুখী আত্মস্বীকারোক্তি কিংবা একমুখী সমকালনির্ভরতা, এ দুয়ের কোনটিরই বাঁধনে।

                এরই মধ্যে ৫৬ সালের খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দিয়ে সূচনা হচ্ছিল পরের দশকের বাংলা কবিতার। এই দশকে দু দু’টি সীমান্তযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল ভারত, ৬৬’র খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গ। কবিতায় ব্যক্তিচেতনার স্বতঃস্ফূর্ততার জায়গা আর থাকছে কোথায় যখন ফ্রান্স, আমেরিকা, চেকোশ্লোভাকিয়া সহ সারা বিশ্বে গড়ে উঠছে, ছড়িয়ে পড়ছে ছাত্র ও তরুণদের আন্দোলনগুলি? ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বলিভিয়ায় চে’র মৃত্যু, রবার্ট কেনেডি হত্যা, এসবের মধ্যেই বাংলা কবিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গের ভারতে আগমন। পাটনায় তরুণ কবি মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর আলাপের কিছু পর জন্ম নেবে এক ক্ষুধার্ত কবিতাপ্রজন্ম, যা পঞ্চাশের আত্মমগ্ন এবং সমসময়ের চিহ্ন ধারণ করেও, তুলনায় ব্যক্তিচেতনাকেন্দ্রিক কবিতার চেয়ে অনেকটাই দূরে গিয়ে হয়ে উঠবে এক নির্বেদ ও শূন্যতার কবিতা। এসময়ের কবিরা ঘোষণা করবেন – ‘কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্থ। সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়।’ (হাংরি জেনারেশন, বুলেটিন – ১)

        জীবন কি তবে খসে গেল কবিতার গা থেকে? সমকাল হয়ে উঠল প্রধান? ১৯৬৭কে সূচনাপর্ব ধরে ১৯৬৯-এ তুঙ্গে উঠল নকশাল আন্দোলন। আক্ষরিক অর্থেই এক অগ্নিসম্ভব সময়ের গর্ভ থেকে সমিধ জোগাড় করে জ্বলে উঠল সত্তরের কবিতার মশাল। যে মশালও কিন্তু বর্ণবান হয়ে উঠবে সমাজ ও সমসময়ের প্রবল আক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই, গূঢ় ও গহন ব্যক্তি এষণারও নানা রঙে।

             রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরে জন্ম নেওয়া সত্তর দশকের কবিতাও কিন্তু দ্বিধান্বিত মন নিয়েই, ভাষাশিল্পও নির্মাণ করতে চাইল। মধ্যবিত্তের একক নিজস্ব ঘৃণা এবং শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণিঘৃণা, তা যেমন এসময়ের কবিতায় এল, তেমনই তার পাশাপাশি ফুটে উঠল অনুচ্চস্বর নির্জনচারী ব্যক্তিভাবনার ফুলও। মগ্নতার অন্তর্বলয় এবং নকশালবাড়ি বা জরুরি সময়ের আগুন পরস্পর আত্মীকৃত হয়ে জন্ম দিল এই সময়ের কবিতার। মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতায় উঠল আরব গেরিলাদের সমর্থনের নির্ঘোষ, সৎকারগাথায় জয় গোস্বামী লিখলেন ‘যে দেশে এলাম, মরা গাছ চারিদিকে/ ডাল থেকে ঝোলে মৃত পশুদের ছাল/ পৃথিবীর শেষ নদীর কিনারে এসে/ নামিয়েছি আজ জননীর কঙ্কাল!’ — আবার তারই পাশাপাশি প্রমোদ বসু লিখলেন ‘পাখির পালকে ভালবাসাবাসি খেলা/ এসো খেলি আজ একেলা জগৎ ভুলে/ আমাদের কথা আগামি মানুষ এসে/ নেবে নাকি তার ওষ্ঠে আদরে তুলে?’– এই দ্বিধা, এই প্রশ্ন, এই আগুন এবং বিস্রস্তিরই আবর্তে ঘুরল সত্তর। সমকালকে কখনও ধারণ করে, কখনও অসহায়ভাবে অস্বীকার করে কবিরা লিখলেন- ‘উজ্জ্বল কবিতা কিছু লেখা যাবে শীতে/ উন্মাদ প্রমেহ মেহ ভালবাসা নিয়ে যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা যায়/ স্বপ্নে উড্ডয়নপটু ডানায় ভর করে আমি/ বেশ্যার বিছানা থেকে উড়ে যাব শৈশবের ডালে/ বাঁচার উৎকণ্ঠা থেকে দেখা দেবে মুক্তির মাদক’ (উজ্জ্বল কবিতা, তুষার চৌধুরী)

         আশির বাংলা কবিতাও কিন্তু মুক্তি পেল না সমসময় এবং ব্যক্তিভাষ্যকথনের এই দোলাচল থেকে৷ বস্তুত, আমরা দেখব, দশকনির্বিশেষেই তা হয়ে উঠছে অসম্ভব। আশিতে এসে ফুরিয়ে আসছে সত্তরের সংকট। এবং ফলত, সত্তরের কমিটমেন্টও। নির্বিকল্প প্রতিষ্ঠানঘৃণা এবং কবিদের ‘শতদল ঝর্ণার ধ্বনি’ চূর্ণ হচ্ছে, বুর্জোয়া বিশ্বায়ন আর তত্ত্ব নয়, বাস্তব। পুরনো কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতার বিপ্রতীপে তৈরি হচ্ছে নতুন পশ্চিমি এলিটিস্ট তত্ত্বকুহক। ইনস্যাট ওয়ান বি’র সাহায্যে ৮২ থেকে শুরু হল প্রথম জাতীয় দূরদর্শন সম্প্রচার। আশির কবিরাই প্রথম টেলিভিশন প্রজন্ম। একই সঙ্গে আশি চোখের সামনে দেখল ইন্দিরা গান্ধির হত্যা, ভেঙে যেতে দেখল পূর্ব ইওরোপের সমাজতন্ত্র, ছাত্র আন্দোলন দমনের নামে চীনের তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের ভয়ংকর গণহত্যা। জয়দেব বসুর ‘সৌতিকথন’এর মতো কবিতা জন্মাচ্ছে এসময়, জয়দেবই লিখছেন- ‘এখন বাংলাদেশ আহত শুয়োরের ঘাতক চিৎকার/ যে কোনওদিন গলবে আগুনসুখ/ করাল বিদ্বেষ শ্মশান করে দেবে বহুজাতিক!’… অথচ বহুজাতিক ও মৌষলপর্বের শ্মশান, এই দুই সময়চিহ্নই কিন্তু আর প্রধান হয়ে থাকছে না আশির দশকের বাংলা কবিতায়। বরং অসহ্য বাস্তব থেকে কবিতা পালাতে চাইছে স্যুরিয়ালিটি, ছন্দসতর্ক ও আঙ্গিকপ্রধান উপস্থাপনার দিকে। জহর সেনমজুমদার, রাহুল পুরকায়স্থদের সঙ্গে সঙ্গেই চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, সুতপা সেনগুপ্ত, মল্লিকা সেনগুপ্তদের কবিতায় ভর করে বরং উঠে আসছে আগের দশকগুলির তুলনায় অনেকটাই বেশি নারীবিশ্বের নিজস্ব কথন- ‘বাঁশির শব্দ যেমন বড়ায়ি অতীত শিলায় লিখে গিয়েছেন/ শ্রীমতীর কথা তেমনি আমার ইতিহাস লিখে নেবে’ (সুতপা সেনগুপ্ত, লুম্বিনি ১)

          নব্বই এল পণ্য সভ্যতার হাত ধরে। সমাজতন্ত্রের পতন, গণতন্ত্রের পদদলনের সাক্ষী হয়ে। অস্বীকার করার উপায় নেই নব্বইয়ের কবিতা অধিকাংশে সমাজ ও সমসময়েরই নিখুঁত রূপচিত্রণ। দগ্ধ পোখরান এবং শহিদের রক্ত নিয়ে শ্লোগান নব্বইয়ের কবিতাকে মুখর করেছে, তবুও নব্বইতেই প্রথম ব্যাপক রকমে এল কবিতায় গল্প বলার বৈশিষ্ট্য, এল ছন্দ-অন্ত্যমিল সহ কবিতার গঠনে অভূতপূর্ব সব নিরীক্ষা, নাটকের মতো ঘনবদ্ধ, তীব্র ঝকঝকে সংলাপভঙ্গিমা।  জয়-রণজিৎ-জয়দেব-মৃদুল-সুবোধ-মল্লিকাদের ইতোমধ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয় প্রকাশরীতিকে বাঁচিয়ে লিখতে চাইলেন শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, সাম্যব্রত জোয়ারদার, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভাস রায়চৌধুরী, হিন্দোল ভট্টাচার্যদের মতো তরুণরা। জেব্রাক্রসিং থেকে লালবাতি, নারীপুরুষের আনন্দযন্ত্রণা ও নগরবাউলের ভাষ্য নিয়ে, নিজের সময়কে জড়িয়ে এবং নিজের সময়কে অস্বীকার করেই জ্বলজ্বল করে উঠল নব্বই। প্রথমটির ক্ষেত্রে যদি শিবাশিস সমকালকে শুষে নিয়ে নীল অক্ষরে লিখলেন ‘কেরিয়ার গড়তে এসে আমরা যারা অপমান সই/ আমরা যারা কাপুরুষ আমরা যারা উনিশশো নব্বই/ যারা আজও মঞ্চে উঠে কৃষ্ণমালা ধুয়ে ধুয়ে খাই/ দুটো কল শো পাব বলে আজও যারা রং মেখে দাঁড়াই/ সেলিব্রিটিদের ভাইপো-ভাইঝি আমরা যারা, মিডিয়ার ভাই/ মনীষীর মৃত্যু হলে আমরা যারা ব্যান্ডপার্টি বাজাই/ আমরা যারা পার্টি করি কিংবা যারা আখের গোছাই/ তাদের হিমেল ব্যর্থ হাতে ডায়রি, বুকপকেটে পেন/ শম্ভু মিত্র আমাদের গালে একটা, থাপ্পড় মারলেন!’… তাহলে পিনাকী ঠাকুর এলেন নবীন বাতাসের মতো, যেন নতুন শতকের দোরগোড়ায়, আরও একবার অনুভূতিময় দর্শন, ছোট ছোট খণ্ডবাক্য আর মধুরতা নিয়ে পরিবর্তিত চেহারায় এসে দাঁড়ালেন অমিয় চক্রবর্তী — ‘সজনে পাতার অবাক ফড়িং লাল।/ খোড়ো মরা দিঘি। ভাঙা বাড়িঘর। শিবমন্দির/ রাস্তা হারিয়ে অন্ধকারে ভয়/ বারুণি পুকুরে লুকিয়ে সাঁতার/শরীরে জেগে…এবং/ জনস্থান মধ্যবর্তী শহরের ভিড়ে, তোমাকে প্রথম!’ (দুই দশক, পিনাকী ঠাকুর)। এসে দাঁড়ালেন পুরুষতন্ত্রের বয়ানে তৈরি ইতিহাসের বিপ্রতীপে একঝাঁক নতুন মেয়ে। শ্বেতা চক্রবর্তী লিখলেন ‘কাপুরুষই দেবদাস হয়’, লিখলেন ‘চলমান বুদ্ধ ভেবে সুজাতা দড়ির টানে জলগর্ভে মাটি খুঁজে পায়!’… পৌলোমী সেনগুপ্ত, যশোধরা রায়চৌধুরী, মন্দাক্রান্তা সেনদের কলমে ভর করে বাংলা কবিতা তার দায় আংশিক অস্বীকার করল সমাজের ইস্তেহার লেখার প্রতিও, নিজের কথা লিখতে চেয়ে বলে উঠল ‘হৃদয় অবাধ্য মেয়ে, তাকে কী শাস্তি দেবে দিও’।

              এই আলোচনায় শেষ দশক, নব্বই পরবর্তী শূন্য দশক। এক সম্পূর্ণ নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটের দশক৷ নব্বইয়ের সমসময়কেন্দ্রিকতা, ছন্দ, আঙ্গিক, প্রকরণপ্রধানতার বদলে দেখব এই সময়ের কবিরা যেতে চাইছেন ভাব ও ভাষার এক নিবিড় ব্যক্তিগত বিনির্মাণের দিকে। কখনও কখনও তাকে কেন্দ্রহীন লাগছে। গণমনোরঞ্জনকে গুরুত্ব না দিতে চাওয়া কখনও হয়ে উঠছে এতটাই প্রধান, যে সেই প্রবণতা কবিতাকে করে তুলছে জটিল, বহুস্তরীয় ও দুর্বোধ্য৷ আবার কখনও এই দশক চমকে দিচ্ছে বিমূর্ততা, open-endedness, এবং ভাবনাবীজ পুঁতে দেবার অসামান্য দক্ষতায়, যখন অরিত্র সান্যাল লিখছেন- ‘কে কবিকে মৃত ঘোষণা করবে, কে?/ কততম সংস্করণ?/ টেবিল বরাবর বয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ কৃষিপ্রধান মাঠের শ্বাস/ এক শান্ত দেহ ঘিরে আত্মীয়রা বিজন, আকুল’, অথবা যখন নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিমন্যু মাহাতো, রাকা দাশগুপ্তরা নির্মাণ করছেন নিজস্ব বিচিত্র কল্পবিশ্ব। সমসময়কে প্রাধান্য দিয়েই, অথবা না দিয়েও।

           সমসময়, আমরা শুরুতে যাকে বলেছিলাম কবিতার শরীরের জন্মদাগ, উল্কি নয়, সে বাক্যটির কাছে অতঃপর ফিরে এলে দেখব, অন্তত আমাদের আলোচ্য সময়পর্বের মধ্যে বাংলা কবিতা তার বিপুল বহুগা অববাহিকা বিস্তার করেছে কথাটিকে বারবার ঠিক প্রমাণ করেই। ক্রমাগত কবির অন্তর্বলয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সমসময়, কিন্তু চেতনে বা অচেতনে, তাকে প্রধান চরিত্র হিসেবে গ্রহণবর্জনের ক্ষমতা বিনা প্রশ্নে থেকেছে কবির হাতে। বা বলা ভাল, কবিতারই হাতে স্বয়ং। উদ্বেল ষাট-সত্তরের নিবিড় কবিতাগুলিই হোক বা ক্ষয়িষ্ণু আশি-নব্বইতে ভেসে আসা উজ্জ্বলতার কবিতাগুলি, বাংলা কবিতা আমাদের মানতে বাধ্য করেছে, যাবতীয় রামজন্মের সমসাময়িক ইতিহাসের চেয়ে কবির মনোভূমিই অধিকতর সত্য। দশকনির্বিশেষে এবং চিরদিনই।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

রিমি মুৎসুদ্দি

পা ঠ  প্র তি ক্রি য়া  ১

রি মি   মু ৎ সু দ্দি

মহাসময়ের সম্পাদ্যঃ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ- ‘ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা’, একটি আলোচনা অথবা আত্মবীক্ষণ

একটা লেখার প্রথম বাক্য আসলে একটা আস্ত গবেষণাগার। একশ’ বছরের নিঃসঙ্গতার কথক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একথা বলেছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সাংবাদিক বন্ধু প্লিনিও অ্যাপুলেইও মেন্দাসাকে। বহু আগে পড়া একটা কবিতার বই, যার বেশ কয়েকটা কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় পড়ে চমকে উঠেছিলাম বহুবছর আগে। কিন্তু কবির নাম নয়, কবিকে চেনার ইচ্ছে নয়, শুধু মাথার মধ্যে ঘুরত কয়েকটা লাইন-

 

‘ভিড়ের মধ্যে কে আমাকে বলল- ‘তোর পারগেশন নেই, তুই বাঁচবি না,’ আর আমি ডেরায় ফিরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম অভিধানের ওপর যেখানে অক্ষরবৃন্ত থেকে গড়াতে গড়াতে নামছে অর্থ- যেভাবে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নামে বরাদ্দ।’

 

আজ সেই কবিতার বইটা হয়ত দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার অথবা চতুর্থবার অথবা তারও বেশিবার পড়তে গিয়ে, পড়ার পরে সেই অক্ষরগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই কথাটাই মাথায় এল। কীভাবে পেলেন কবি এই কবিতার প্রথম লাইন? কীভাবে পেলেন এই ভাষ্য আর গান যা এক অজানা অচেনা পাঠকের চৈতন্যের স্পন্দন আর নৈঃস্পন্দ্যকে মিলিয়ে দেয়? অক্ষরের প্রশাসনে কীভাবে আঁকলেন তিনি এই সময়ের সম্পাদ্য? 

 

‘সময়ের সম্পাদ্য’ না বলে সময়কে একটা ব্যবধানহীন গ্রামে তাঁর অক্ষরে তুলে ধরলেন এও বলা যায়। কবি রচিত প্রতিটা চিত্রকল্প যেন আমাদের ইতিহাস, বেদনা, যন্ত্রণা ও হারাতে হারাতে মানুষের লাশ বয়ে আনা আস্ত একটা ট্রেন। যে ট্রেনের শাদা পোশাক পরা গার্ড তার স্থির দৃষ্টিতে দেখে ফেলছে সমস্ত ‘সময়-অসময়’-

 

‘দেখছি, সবজি খেতের পাশে টলটলে মুক্তাবৎ পুকুর

শুনছি, ভারী গলার আওয়াজ, ‘না, ওদিকে যায় না খুকু’

খুকুর মধ্যে দেখছি খুকুর অকালমৃতা পিসির চিহ্ন

একান্নবর্তিকায় জ্বলছি; মরে গিয়েও কেউ না ভিন্ন।

গল্পদাদুর আসর থেকে সুড়ুত করে বেরিয়ে এসে

খুঁজছি, তিনটে কুলি কখন রওনা দিল নিরুদ্দেশে।’ …

 

এ যেন পঙক্তি থেকে উঠে এল কান্না। যে কান্না নিজেই গিলে নিয়েছে কবিতা, রাজনীতি, সেকুলার, সিউডো সেকুলার আর সেই চিরপরিচিত সেলুলয়েডের টানটান উত্তেজনায় দেখা একটা শুয়ে পড়ার গল্প। যার সিংহভাগই সত্য নয় ভেবে আশ্বস্ত হওয়া। পুরোন সব স্লোগান, মন্ত্র তন্ত্র সব গিয়ে মিশেছে সেই এক ধ্বনিতে। যার সুর থেকে ভেসে আসে এক একটা ঘরের শব্দ। সেই শব্দে মিশে আছে কত মা-বোন, কাকা-জ্যাঠাদের লাশ ঘিরে অজস্র চিৎকার! পদ্মা মেঘনার জলে সেই কবেকার চিতাভস্ম থেকে লেখা হবে নতুন ইতিহাস? 

 

কে লিখবে এই আত্মঘাতী ইতিহাস? কোন কলম? যা কিনা পিতার মতো, গুরুর মতো সমস্ত নিয়ম অনিয়মের ব্যবধানে এক নির্মম অথচ নির্ভেজাল সত্যের সামনে এনে দাঁড় করাবে। কিন্তু কবি কি তাই করলেন? তিনি লিখলেন,

 

‘জ্বলন্ত প্রজাপতির ডানায় লিখলাম, ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’

নীচে সমুদ্র, ওপরে পাহাড়; না, আমি এখনও আদেশ পাইনি।’

 

‘মাটির মালসায়’ সমস্ত শহীদের রক্ত আর নিজের দীর্ঘশ্বাসকে ভরে রেখেও কবি বিশ্বাস হারাননি। কারণ,

 

‘মানচিত্রে মাথাই উধাও তবুও টিকি বাঁধা

গ্রাম- রাজাপুর, বাখরগঞ্জ থানা

ঘর বেঁধে দিই লক্ষ লোকের, না বাঁধি না ছাঁদা

বংশ পরম্পরায় ওইটে মানা

 

সাতমন তেল পুড়িয়ে যদি না-ই নাচলেন রাধা

বাজাই অশ্রু-সম্বরণের সানাই

 

দেয়াল ভাঙছে ‘ছত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ’ ধাঁধার

আমার কাজ তো ইট কুড়িয়ে আনা।’

 

ক্ষতর মধ্যেও জেগে আছে এক অনন্ত আশ্রয়। যে আশ্রয় কখনও ‘জীবনধারা’। আর এই ধারার সমস্ত জল বয়ে যায় ‘চণ্ডালের মেয়ের ঘটি থেকে সন্ন্যাসীর হাত অবধি’। আর কোনও এক অনামা অপরিচিত আলিম্মানের বুকে জেগে থাকে সেই স্বপ্নদৃশ্য। যেখানে এক যুবক পুত্রের বুকে তার বাবা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এত ক্ষত কেন? এত কষ্ট কেন?’ আর কবির সেই অমোঘ পঙক্তি উত্তর হয়ে সবহারাদের কন্ঠনালিতে মিশে যায়-

 

‘পথে যদি বিপদ বড়          বাবা আমার হাতটা ধরো

      নচিকেতার হাত ধরবেন মৈত্র মহাশয়।’      

 

সময়ের সম্পাদ্য আঁকতে আঁকতে কবি যেন কখন নিজেই ক্যালেণ্ডার হয়ে গেছেন। সাল তারিখের মতো সেখানে ‘নবান্নের স্বাদ’, ‘গোধুলির হারিয়ে যাওয়া সাইকেল’, পুকুরে ফলিডল দিয়ে মেরে ফেলা মাছের লাশ, বিশ্বায়নের সুখ, দখল আর পুনর্দখলের আখ্যান। প্রতিটা প্রহরের নগ্নতা আর অস্বস্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে কবি লেখেন,

 

‘অন্যের অস্বস্তিকে মাথায় ধারণ করে

অন্যের যন্ত্রণায় মিশে কদম কদম বাড়াতে বাড়াতে

নিজেকে ভালবেসে মারা গিয়ে অন্যের ভালবাসায় জন্মাতে জন্মাতে

ঘাসে লেগে থাকা অন্যের রক্তকে

নিজের বলে ভাবার মধ্যে

পাপ নেই, কোনও পাপ নেই।’

 

এই যে অখণ্ড একটা বোধ। যা কেবলমাত্র কবিকেই মানায়। তাই কোনও এক আদিকবির শ্লোকই হয়ে ওঠে কবিতা- ‘অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরচরম’।

কবিমাত্রেই এই অখণ্ডতার প্রতীক। যাঁর ব্যপ্তি সমস্ত চরাচর জুড়ে। একাল থেকে সেকাল, আদি থেকে অনন্ত এক সীমাহীন শেষহীন যাত্রা নিজের মধ্যে একমাত্র কবিই অনুভব করতে পারেন। কোলরিজ তাই বলেছেন,

 

‘The Primary Imagination I hold to be the living power and prime agent of all human perception and as a repetition in the finite mind of the eternal act of creation in the infinite I am.’ (Coleridge, Biographia Literaria. Ed. Shawcross, Oxford, vol.I, p. 202) 

 

বিনায়কের কবিতায় এই অখণ্ডতাকে বুঝতে হলে তাঁর ‘ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা’ কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তির কাছে ফিরে যেতে হবে-

 

‘পাথর মেলে ধরুক বিষদাঁত

তুলুক ফণা নিথর কালো জলও

বর্তমান তবু ঘটমান

আমাকে প্রভু শিকাগো যেতে বলো…’

 

অথবা,

 

‘মাটির নীচে প্রাচীন কোনও খনি

আকাশে লাঠি ঠকঠকায় শনি

ইতিহাসের দু’পায়ে অভিশাপ

কপালে তবু নাচতে থাকে মণি

 

সীমা থেকে সীমাহীন এই যাত্রা বুঝতে গেলে ভরসা তাঁর এই পঙক্তিগুলো-

 

‘ঘুমের কাছে চলে না অভিনয়

তাই তো জল মিশিয়ে খেতে হয়

লুপ্ত, অবলুপ্ত হতে হতে

জানাতে হয় নিজের পরিচয়

 

যখন নীচে পুড়তে থাকে স্টোভ

একলা কথা ছুঁড়তে থাকে ক্ষোভ

দ্রাঘিমা আর অক্ষরেখা নিয়ে

অন্ধকারে ঘুরতে থাকে গ্লোব।’ 

 

‘ঘটমান-বর্তমান’ যেভাবে তাঁর কবি মনে ব্যবচ্ছেদ হয়ে চলেছে ক্রমশ সেই বীক্ষণ ও ব্যবচ্ছেদের ভাষা তাঁর দীর্ঘকবিতায় কখনও ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’ কখনও ‘পৃথিবীর পথে’ ঘুরে ঘুরে পাঠককেও পরিক্রমণ করায় আর মনে করিয়ে দেয় অতীত আসলে বর্তমানের এক পণ্যমাত্র নয়। সে আসলে শুধু স্মৃতিও নয়। কবির উচ্চারণে, 

 

‘জড়ভরত করল বিধি

দোষ ধোরো না গুণনিধি

নিজের পথে পথে বিছোই নিজের মৃত্যুফাঁদ

 

আশমানে ওই যায় দেখা যায়- ঘর-সোহাগি চাঁদ।’

 

ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা | আনন্দ | প্রথম সংস্করণ ২০০৯

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

স্যামুয়েল ওয়াগন ওয়াটসনের কবিতা

অ নু বা দ

স্যামুয়েল ওয়াগন ওয়াটসন ( Samuel Wagan Watson) ১৯৭২ সালে ব্রিসবেনে জন্মান। জন্মসূত্রে তিনি আইরিশ, জার্মান এবং অস্ট্রেলীয় অ্যাবরিজিনাল। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘Of Muse, Meandering and Midnight’ ১৯৯৯ সালে বেরোয়। ২০০১ সালে বেরোয় ‘Itinerant Blues’ এবং ‘Hotel Bone’। ২০০৪ সালে বেরোয় ‘Smoke Encrypted Whispers’। সেই বছরই বইটি ‘Kenneth Slessor Prize for Poetry’ পুরস্কার পায়।

অ মি তা ভ মৈ ত্র

রক্ত জমাট রেডিও

 

আমি ঘরে বসে

আর কথা বলছে ওরা

রাষ্ট্রসঙ্ঘের দূতের আরো একটা দল ধরা পড়েছে

তাদের দেশ

যে জন্য আহত আরেক দেশের হাতে

আরেকটা দুর্ভোগ

 

ওদের কয়েকজনকে মারি আমরা

তাই ওরাও মারে আমাদের কয়েকজনকে

সারারাত বীয়ার ঢালা যাবে না

তবে পাঁচ ডলারেই আমাদের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলো

দেখতে পাবে এক ঝলক

চার্লি পার্কারের সুর শুনতে শুনতে

যার মধ্যেও ছিল একই রকম নরক

যা এখানে খুঁজছি আমরা 

 

কেউ একজন যখন চীনে গেল

কিছু লোক লেগে পড়ল চিলিকে বদলে দিতে

আর বীয়ার ফুরোতে শুরু করল দু’গুণ দ্রুত

কিন্তু বিমানবন্দরের গার্ডরা চোরাচালান আটকে দিল গোড়া থেকেই

আর আমাদের দিকের কেউ কেউ প্রশংসা করছে

বিষ দেওয়া খাবার আর রক্ত জমাট রেডিওর

আমি তখন এখানেই আছি

ষাঁড়ের লড়াইয়ের ভিড়ের মতো চ্যাপ্টা হয়ে

যেখানে ধীরগতি ভোরের মতো

তলানিটুকুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন হেমিংওয়ে

ধারণাতীত জলভরা চোখে

 

প্রিলুড

একজনের পায়ে ছুরি ফেলে দেওয়া

কোনোভাবেই

একজনের জিভে টাকিলা ঢেলে দেবার মতো নয়

 

মেয়েটির পোশাকের ফুলগুলো

তবু এটাই চেয়েছিল আমার কাছে

 

আর রাত্রি তখন,

হ্যাঁ

সরে দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে

 

সার্জারি মিউজিক 

সারাক্ষণ তারা বেকন রান্না করছে ক্যানসার ওয়ার্ডে

 

আজ মঙ্গলবার

আর মাথার ক্ষত থাকে সোমবার পর্যন্ত

কিন্তু ওরা রোগীদের বেডে

এখনও বেকন রান্না করে যাচ্ছে

ফোস্কা আর চর্বির একটা মুখ

ভয়ার্ত চিৎকারগুলোকে প্রশ্ন করার কেউ নেই

যতক্ষণ না সার্জারি মিউজিক

কয়েকজনকে বাদ দিয়ে

সামলে নেয় অন্যদের

 

মরে যাবার জন্য বেঁচে থাকার জন্য কেঁদে ওঠার জন্য

প্রায় কেউই নেই

অন্ধকার দেখাশোনা করছে বাকিদের

 

মৃত্যুর সঙ্গে এই বেকন ভোজ

চোখ থেকে

আর হাত গলা টিপে ধরছে চাদরের

যন্ত্রণাকে ধরার জন্য

যাকে একটা লাঠির মাথায় ভিজিয়ে

জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে

 

আর একটা কোণ যেখানে শ্বাস নেওয়া যায়

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

সায়ন

ক বি তা

সা য় ন

মৃত্তিকাগান

চাষির গোপন চাষ, রাতের জমি ক্ষত
বৃষ্টি, সে তো অবাধ্য মেঘমাঠ

 

খাল পেরিয়ে নদী
নদী পেরিয়ে দেশ
শেকল ভাঙা, অবাধ্য হাত পায়ে

 

গ্রামের বাড়ি শিশুর বুকে আলো
পুকুরজলে হলুদ মাখা গায়ে

 

খিদের লাইন

পা দিয়ে ঢেকেছ আর্তনাদ
মুছে দাও ছাল, রক্ত, শুকতলা

 

গ্রাম পেরিয়ে গুপ্তধনের গুহায়
এখন কটা থালা দরকার শুধু

 

ওদিকে পার্লামেন্টে – আজ রান্নার ঘোর আয়োজন
বিরোধীপক্ষ তাড়াতাড়ি কেটেকুটে নিচ্ছে মাছ সবজি

 

সরকার পক্ষ উনুনে
হাঁড়ি কড়াই চাপিয়ে দিয়েছে,
আর কিছুক্ষণ… থালাবাটি… আর কিছুক্ষণ

 

শুধু ঘন্টায় শুধু মিনিট শুধু সেকেন্ড
পেট বাড়ছে শুকনো জিভে অন্ধকারের মাস

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

সুজিত দাস

ক বি তা

সু জি ত   দা স

আনপ্লাগড/৯৯

ক্যাথারসিস।

 

যা হয়।

 

‘স্নানে যাচ্ছি’ বলে সেই যে নীহারিকা মন্ডলে গেলে, আর দেখা নেই।

ইতোমধ্যে আমি চেনাজানা সব মন্ডল সভাপতি, জোনাল সম্পাদকদের ফোন করলাম, তোমাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য। মনীষার অন্তর্ধান, রহস্যের চোরাবালি, বেদানার লাল এবং ব্যথার প্রজাপতি… সকলের জন্য মিসিং ডায়েরি। তবু স্নানের ঠিকানা লিখে রেখে কোন মিল্‌কি ওয়ে বরাবর হারিয়ে গেলে বলো তো! তোমার দিলকি দয়া হয় না?

 

যা যা হয়।

 

এই নিঝুম সন্ধ্যায়, পান্থ পাখিরা ঘরে ফিরছে। একলা ব্যালকনিতে নিঃসঙ্গ কাট্‌গ্লাস আর তার বরফসাদা ফুল। এই স্ফটিক আবহে তুমি কোথাও নেই। ল্যাপটপে একমনে গাইছেন পবন দাস বাউল। সাদা চুল, রিমলেস চশমা। আন্দাজমত বিড্‌সের মালা। উফার স্পিকার থেকে ভেসে আসছে হাস্কি আওয়াজ, ‘দিনদুনিয়ার মালিক খোদা…’

 

আরো যা যা হয়।

 

সম্পর্ক নামের এক অলৌকিক ট্র্যাপিজে এ ওকে লুফে নিয়েছি সন্ধের ‘শো’ বরাবর। এখন সার্কাস শেষ। বাঘ সিংহের খেলা বন্ধ, তাও অনেকদিন। খাঁচার বাঘ, আফিং-এর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা বাঘ, পটকা ফাটানো কাকাতুয়া, সৎ ও খেটে খাওয়া জোকারের লাফঝাঁপ…এসব দেখে কী হাততালিই না ফাটত গ্যালারি থেকে। পুরো মাখম।

 

তবু পৃথিবীর কোনও সার্কাস অনন্ত নয়।

প্রকাশ্য হাততালিরও একটা সেলফলাইফ আছে।

সিজন শেষে, সার্কাস এবং চেয়ার দুটোই অচল পয়সা।

স্নান, সম্পর্ক এবং সার্কাস, এসব রাজ-মৃগয়া দূরবীন দিয়ে দেখতে হয়। চেয়ারও।

 

স্নানে যাচ্ছি বলে ভর সন্ধেবেলায় সেই যে…

 

আনপ্লাগড/১০০

শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার কোনও একলা ফটো নেই।

 

একটা ম্যাজিক লন্ঠন বাদ দিলে আমার আর কিছু নেই।

 

প্রাইভেট বিচ নেই। বোধি, পিপল গাছ, পরমান্ন এবং সুজাতা কোনোটাই নেই। হাতে তাস নেই, ভাতে মাপ আছে। 

 

একটা ম্যাজিক লন্ঠন ছাড়া আমার আর সব কিছুই আছে।

 

গোটা করোনেশন ব্রিজ। ডিমা নদী, রাইখর মাছের ঝাঁক, তিতির বনক্ষেত্র। সব আছে। রঙের বিবি আছে, ঢঙের ছবিও।

 

এক একদিন মনখারাপ থাকে। 

ম্যাকউইলিয়াম হাই-এর শিরীষ পাতায় ভরে যায় ঘরদোর। সমীরবাবু স্যারের কবিতা ট্র্যাফিক সিগন্যালে বেজে ওঠে। বঞ্চুকুমারীর রাস্তায় দুলে ওঠে সরু বাঁশের সাঁকো। হ্যামিলটন ভাটিখানার বাইরে রঙিন ম্যাজিক লন্ঠন। দূরের আঁটিয়াবাড়ি বাগানে মাকনা হাতির তাণ্ডব।  ডিপ্রেশনের নিখুঁত কোলাজ।

 

এক একদিন দিলখুশ। 

ইনবক্সে মঞ্চসফল সিভিক কবি। মুড়ির বাটিতে মুখরোচক চানাচুর, অড়হর ডালে লাজুক কারিপাতা। ব্যারেজের জল থেকে মাছ মুখে নিয়ে উঠে আসা চতুর পানকৌড়ি। ওদিকে কুলিলাইনে ধামসা মাদল। ওরাওঁ বালিকার কপালে কাচপোকার টিপ। চার্চের মাথায় ম্যাজিক লন্ঠন!

 

তবু আমার কোনও জাদু লন্ঠন নেই।

হয়ত আমার একটা জাদু লন্ঠন আছে।

 

নেই নেই করে ক্রাই বেবির মতো কাঁদতে নেই। একটা গোটা রায়ডাক নদী, অর্ধেক ক্যাসলটন এবং কিছু লবণে মুখ রাখা হলুদ প্রজাপতি আমার ন্যাংটোবেলার বন্ধু। এদের নিয়েই বেশ আছি।

 

দুঃখ এই, শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার কোনও একলা ফটো নেই।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

পার্থজিৎ চন্দ

বি শে ষ  র চ না

পা র্থ জি ৎ   চ ন্দ

অন্ধময়ূরের নাচ

আষাঢ় যখন এসে মিশে যায় শ্রাবণে, তখন পুরুলিয়াই আমাদের শান্তিনিকেতন। কাঁসাইয়ের উপর থেকে আষাঢ়ের ভারী মেঘ ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়ে পুরুলিয়া শহরে… পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে। বাঁকজোড় নদীর ধারে একজন অচিন্ত্য মাজি… কিছুটা দূরের একজন সোমেন মুখোপাধ্যায় রাজীব ঘোষাল নিবিড় রায়ের সে সময় ময়ূর-জন্ম শুরু হয়। তারা ছটফট করে। তাদের কাছে বারবার ছুটে যাওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোনও পরিত্রাণ থাকে না। 

     বেশ কয়েক বছর আগের এক শ্রাবণ। সস্তা-ট্রেনের সস্তা কামরায় চেপে এক সন্ধ্যায় পৌঁছে গেছি পুরুলিয়ায়। হাসি মুখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কবি নির্মল হালদার… আমাদের নির্মলদা। বৃষ্টি নেই; কিন্তু আকাশে মেঘের আনাগোনা তুমুল। মেঘের কোলে চাঁদও আছে। কোদালে কোপানো মেঘের কথা পড়েছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়। পুরুলিয়ায় শ্রাবণমাসে একা ঘুরতে আসেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আমার বিশ্বাস। চাকা-নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। কালো পাথরে বসে পা ডুবিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে থাকেন পাগলের মতো। শাল আর পলাশের জঙ্গল কান পেতে শোনে সে গান। এই কারণেই পুরুলিয়ার শাল আর পলাশের এত রহস্যময় রূপ।

     শহরের মধ্যে সত্যি সত্যি ‘সন্দেশ গলি’ পেরিয়ে নির্মল হালদারের এক চিলতে ছাদে গোল হয়ে বসে আছি আমরা কয়েকজন। নির্মলদা স্বয়ং, সঙ্গে সুমিত পতি অচিন্ত্য মাজি সুপ্রিয় দেওঘরিয়া সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় নিবিড় রায়…

     মেঘের ফাঁক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে চাঁদ। মাথার উপর আয়ুর মতো ঝুঁকে থাকা একটা নিমডালের ফাঁক দিকে গুঁড়ি মেরে ঢুকে চাঁদের আলো ঘিরে ফেলছে আমাদের।

     স্তব্ধতার এক লাভার মধ্যে গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ছে গান। 

     অন্ধময়ূরের নাচ পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ও পবিত্র দৃশ্য। কারণ সেখানে দৃশ্য থেকে দৃশ্যের জন্ম হয় না; শ্রুতি থেকে জন্ম নেয় দৃশ্য। এমনকি এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে যে কোটি কোটি ‘চোখ’, অন্ধময়ূরের নাচ সেই দৃষ্টি-নিরপেক্ষ। দৃশ্যের মধ্যে যে temporality আছে তাকে অতিক্রম করে সে ধ্বনি ও সুরের কাছে ছুটে যায়। তার শিখীবিস্তার গূঢ়, রহস্যময়।

     হায়, তাঁরা কী দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছেন যাঁরা শুধু প্রমিত বাংলার কেতাবি সংজ্ঞার মতো সংজ্ঞায়িত এক ডায়ালেক্টে হুগলী-নদীর দু’পাড়ে (কলকাতা-নদিয়া-হাওড়ায়) গীত হওয়া রবীন্দ্রসংগীত শুনে গেলেন। উচ্চারণের শুদ্ধতা নিয়ে তারা হারমিট-ক্র্যাবের মতো এক খোলসে ঢুকে রইলেন চিরকাল। মহাকালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ব্রহ্মপুর-লোকাল ছেড়ে চলে গেল তাঁদের। দিকশূন্যপুর স্টেশনে নামা হল না তাঁদের। 

     যাঁরা উচ্চারণের শুদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন, তাঁদের কাছে একটি প্রশ্ন, ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে’ গানটি দু’জন প্রণম্য শিল্পীর কণ্ঠে বারবার শুনেছেন? একজন ‘বিজন’ শব্দটিকে প্রান্তে রুদ্ধদল হিসাবে গাইছেন। আরেকজন গাইছেন ‘বিজনওওওও…’। প্রমিত বাংলার নিরিখে একজনকে অতি অবশ্যই অস্বীকার করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত ভাবে হেমন্ত’র ‘বিজনওওওও…’ বেশি পছন্দের। কিন্তু অন্যজনকে অস্বীকার করবার মতো মতিভ্রম যেন জীবনে না-হয়। প্রমিত বাংলার এই ফারাকটুকুকে যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূম-দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতকেও আপনাকে মেনে নিতে হবে। ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার সঙ্গে অনেকে পৃথক ডায়ালেক্টে রবীন্দ্রসংগীত গাইবার প্রশ্নটিকে গুলিয়ে দিতে চান। বিষয়টি পুরোপুরি আলাদা।

     রাত বাড়ছে, এক সময়ে তরুণ কবি অচিন্ত্যর গলায় উঠে আসতে শুরু করেছে রবীন্দ্রনাথের গান। একের পর এক গান ঘুরে চলেছে গোল হয়ে। গান এসে বসছে আমাদের পাশে, অন্ধকারে। প্রায় মাঝরাত, অচিন্ত্য গাইছে, ‘তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ…’

     প্রমিত বাংলার থেকে অনেকটা দূরের এক বাংলা… বাঁকজোড়-হাড়াই নদীর ধারে পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা এক বাংলাকে আশ্রয় করে রবীন্দ্রনাথের গান উঠে আসছে অচিন্ত্যর গলায়। কী দুর্ভাগ্য তাঁদের, যাঁরা বাঁকজোড়-হাড়াই’এর কাছে লুকিয়ে থাকা বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনলেন না মাঝরাতে।

     এক সময় অচিন্ত্য ছেড়ে দেয় গানটিকে, লুফে নেন নির্মল হালদার। অকল্পিত ভাঙনের কিনারায় বসে নির্মলদা গাইছেন, ‘তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে…’

     ছায়াপথের এক কোণে ঝলমল করে উঠছে অন্ধ-ময়ূরের নাচ, অন্ধকারে একা।

 

বারো লাইনের এই গানটিতে একটি লাইনই চারবার ফিরে ফিরে এসেছে। 

     গানটি শুরু হয়েছে একটি assertion এর মধ্য দিয়ে, আমি তোমায় ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে ফেলছি, কিন্তু কোথাও কোনও সংশয় নেই তোমাকে ফিরে পাবার প্রশ্নে।  রবীন্দ্রনাথের গানের মহাজাগতিক ম্যাজিকের একটা বড় উপাদান তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা juxtaposition। নতুন করে পাবার আনন্দে এক হারবার বেদনাকে শিখীবর্ণ রহস্যে বন্দনা করছে অন্ধময়ূর।

     কিন্তু এ ‘নতুন’ কি পুরানোর বিপ্রতীপ ধারণা থেকে উঠে আসা? প্রেম-পর্যায়ের একটি গানের কথা বিদ্যুৎলতার মতো ঝলসে ওঠে মাথায়… স্নায়ু থেকে স্নায়ুতে ছুটে যায়, ‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে অলস অন্যমনে।’

     পৃথিবীর প্রখরতম শারীরিক বোধের মৃদুতম প্রকাশ সম্ভবত রয়ে গেছে এই গানটিতেই, ‘মোর দানে নেই দীনতার লেশ, যত নেবে তুমি না পাবে শেষ-’। যেন পবিত্রতম লুন্ঠনের অপেক্ষায় অবলুন্ঠিত হয়ে আছে কেউ। 

     রবীন্দ্রনাথের এক গান থেকে আরেক গানে ভেলা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক অপার্থিব অনুভূতি বয়ে আনে। সে রহস্যে না-ঢুকে আপাতত আবার সেই গানটির কাছে ফিরে যাই, দেখি ‘সে’ পুরানো নয়। সে নতুন এবং তাকে অধিকতর নতুনভাবে পাবার জন্য এই ‘সর্বনাশ’ ও ‘হারানোর’ আয়োজন। রবীন্দ্রনাথ এটিও বলে দিলেন, গানটির প্রথম লাইনে এ প্রসঙ্গে কিছু না-বলেও বলে দিলেন – আমি তোমাকে আগেই পেয়েছি। না-পেলে হারানোর অধিকার জন্মায় না। 

     এরপর গানটিতে এক ছায়া পড়ে। শেষ শ্রাবণের মাঝ-দুপুরে কাঁসাইয়ের উপর ভেসে থাকা এক-টুকরো মেঘকে আমি ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে যেতে দেখেছিলাম। থাকা না-থাকার মাঝখানে এক লীলা-চঞ্চলতা। মুহূর্ত ও মুহূর্তকে অতিক্রম করে অনাদি। শিকলের একটি বালার মতো মুহূর্ত পড়ে রয়েছে লীলা-চঞ্চলতার কাছে। 

     রবীন্দ্রনাথের গানের অধিকাংশ জুড়ে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ উচ্চারণ ছেয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে একই সঙ্গে পুরুষ-মনোজগত ও নারী-মনোজগত বহন করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রেমিকাকে (poet persona-র ধারণা অনুসারে প্রেমিকা বলা হল) ও নিভৃত-প্রাণের দেবতাকে একই রকমভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সম্বোধিত করলেন। ইংরেজির you ও বাংলার ‘তুমি’র মধ্যে এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে বারবার হারাচ্ছেন, তিনি যে আত্মার একটি টুকরো সেটি বোঝাতে ‘তুমি’ শব্দটির কোনও বিকল্প হয় না।

     অনেবার ভেবে দেখেছি এই গানটিতে একটি মাত্র অতি মৃদু অভিমানে ম্লান  লাইন আছে, ‘ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন।’ কোথাও যেন মনে হয় তাঁর ভালবাসার ধনের ‘অদর্শন’ মেনে নিতে পারছেন না রবীন্দ্রনাথ। বারবার তিনি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন, ‘তুমি আমার নও আড়ালের।’ ভালোবাসার ধর্মতো এই’ই। ক্ষণকালের ‘অদর্শন’ ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এখানেও একটি খেলা রয়ে গেল। গানটির চলন এমনই যে মনে হতে বাধ্য ক্ষণকালের লীলার স্রোতে আসলে তাকে হারিয়ে ফেলছেন কবি নিজেই। মুহূর্তের লীলা যতটা না তাঁর , তার থেকে অনেক বেশি ব্যক্তির। 

     এই গানটির প্রতিটি লাইনে অকল্পিত রুদ্ধশ্বাস এক সমর্পণ রয়ে গেছে। স্থির হ্রদের পৃষ্ঠতলের মতো শান্ত এক স্বরে প্রথমে তিনি বলছেন, ‘আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন-।’ কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।

     ঠিক তার পরেই লাইনেই যেন সে হ্রদে এসে পড়েছে এক কক্ষচ্যুত নীল তারা। ঝিরঝির করে কেঁপে উঠছে হ্রদের জল, ‘প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।’ এই ঢেউ গানটিতে আমাদের ভিস্যুয়ালাইজ করতে বাধ্য করালেন তিনি। গানটির প্রথম লাইনে যে assertion ছিল সেটি কিছুটা হলেও ভেঙে যায়, এক ‘প্রেমের কারণেই’ ভেঙে যায়। সম্ভাব্যতার সূত্র অনুসারে সব খোঁজের শেষে ব্যর্থতার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। 

     প্রেমে ঢেউ লাগার এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ মাইক্রোর পরিসর ছিন্ন করে ম্যাক্রোর দিকে ছুটে গেলেন। এই জায়গাটিতে এসে লালন শাহের একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়, ‘সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা। জীবের কি সাধ্য আছে তাই বলা।… কখন ধরে আকার কখন হয় নিরাকার কেউ বলে সাকার সাকার অপার’ ভেবে হই ঘোলা।’

     এবার গানটি শেষ হয়ে আসছে। এবং ঘনিয়ে আসছে গানটির সব থেকে ঘাতক লাইনটিও, ‘তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে-’। এই জায়গাটিতে এসে উপনিষদের সেই মহাশ্লোকটিও মনে পড়তে বাধ্য,

‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।’

(… সেই পূর্ণস্বভাব ব্রহ্ম হইতে পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলেও পূর্ণই অর্থাৎ পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন)

     শুধু তাই নয়, এই লাইনটির দিকে তাকালে এক ব্যাকওয়ার্ড টাইম-ট্রাভেল ঘটে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে বিগ-ব্যাং ঘটে যাওয়া মুহূর্তটিকে। যেন মহাকাল আর মহাকালী দু’জন দুজনের দিকে চেয়ে বসে রয়েছেন, চোখের পলক ফেলছেন না কেউ। এক পূর্ণ, এক অশেষ তার পূর্ণত্ব ও অসীমের অহংকারেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। কারণ তার কাছে পূর্ণ ও শূন্য বলে পৃথক কোনও অবস্থা নেই। সে নিজে পূর্ণের ভিতর অনন্ত শূন্য ও অনন্ত শূন্যের ভিতর মহা-পূর্ণ।

     ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বইটিতে শান্তিদেব ঘোষ লিখছেন, ‘সর্বত্রগামী এক প্রেমের বাঁধনে বাঁধা না পড়লে কি এ সবের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ দেখা দিত? একই প্রেমের আন্তরিক প্রকাশ নানাভাবে আমরা দেখি, তাঁর পূজা প্রেম প্রকৃতি সব পর্যায়ের গানে।’

     শান্তিদেব ঘোষ আরও বলছেন, ‘সেইরূপ গুরুদেবের পূজা পর্যায়ের গানেও তিনি যাকে উদ্দেশ করে প্রেম নিবেদন করে গেছেন, তার সঙ্গে মানবিক অর্থাৎ লৌকিক প্রেমের আবেগের রূপ ও রস যদি এক হয়, তবে তাতে বিরোধ কোথায়? গুরুদেবের পূজা পর্যায়ের গানের মধ্যে এমন সব প্রেমের কথা আছে, যাকে মানবিক প্রেমের গান হিসাবে ব্যবহার করতে কোনও বাধা দেখা দেয় না।’

     যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের পর্যায়গুলিকে অটল অনড় চিনের প্রাচীর মনে করেন তাঁদের উচিত শান্তিদেব ঘোষের আত্মাকে রবীন্দ্রবিরোধী বলে দেগে দেওয়া। 

     সে রাত্রিতে পুরুলিয়া শহরের একটি নির্জন ছাদে বসে মনে হচ্ছিল এই গানটিতে ‘ও মোর ভালোবাসার ধন’ লাইনটি চারবার ফিরে ফিরে এসেছে। 

     একজন্মে ঠিক কতবার কত হাজার লক্ষ বার আমাদের এই কথাটি বলতে বলতে ধুলোয় মিশে যাবার তীব্র ইচ্ছা বুকের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে! 

     উত্তর জানেন একমাত্র তিনি, একমাত্র রবীন্দ্রনাথ…

আরও পড়ুন...

Categories
2020_july

শংকর চক্রবর্তী

বি শে ষ  র চ না

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি | পর্ব ২

বিদ্বিষ্ট কবি

প্রতি রোববার সকালে আমি গড়িয়াহাট বাজারে যাই হাতে দুটো থলে নিয়ে। এবং জানি বাজারের দু’পাশে কয়েকটি বহুতল আবাসনে পঞ্চাশের দশকের অন্তত চার-পাঁচ জন কবি থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতেই আমাকে যেতে হত বিভিন্ন প্রয়োজনে। এমনকি রোববারের মাছের বাজারেও তাঁদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যেত কখনো-সখনো।

একদিন ব্যতিক্রমী ঘরোয়া পোশাক পরা পঞ্চাশের দশকের এক কবি, ওই মাছের বাজারে আমাকে দেখতে পেলেন। দেখে, দূর থেকেই উচ্চকন্ঠে আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। মাছ বাজারের ওই বিচিত্র হল্লার ফাঁকে যতটুকু শুনতে পেলাম, তাতে মনে হল তিনি কয়েক বছর আগে রবীন্দ্র পুরস্কার পাওয়া কোনো এক কবি সম্পর্কে তাঁর আপত্তির কথা জানাবার চেষ্টা করছেন, সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্যগুলিও সাজিয়ে দিচ্ছেন। তাও সেটা মাছের বাজারের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এবং মানুষের ধাক্কা সামলিয়েও। আমি সন্তর্পণে তাঁর হাত ধরে টেনে এনে ভিড় থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। সেদিন তিনি অনেক কথাই বলছিলেন প্রসঙ্গ পাল্টে পাল্টে। তাঁর পুরোনো অভিজ্ঞতার কথা। পরে কথা বলতে বলতে তাঁর আবাসনের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। এবং তাঁর বাড়ি গিয়ে বাকিটুকু শুনে আসার জন্য কথা দিতে হয়েছিল। হ্যাঁ, এরপরেও তাঁর বাড়ি যেতে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। বলতে দ্বিধা নেই, প্রায় প্রতিবারই দু’একটি কাজের কথার শেষে তিনি চলে যেতেন তাঁর নিজস্ব ভালো লাগার প্রসঙ্গে। তিনি কীভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, বা তাঁর সমসাময়িক কোন কোন কবি কীভাবেই বা প্রভাব বিস্তার করতেন সাহিত্যজগতে ইত্যাদি। যাঁদের সঙ্গে আমার ক্ষীণ যোগাযোগ ছিল বা যাঁদের সান্নিধ্য তেমনভাবে পাইনি কখনো- তাঁদের প্রসঙ্গ উঠলে আমি প্রত্যুত্তরের তথ্য না পেয়ে চুপচাপ সবটুকু শুনে ফিরে আসতাম। কিন্তু যখনই বাংলা সাহিত্যের দুই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাঁদের স্নেহ ও সান্নিধ্যে অনেকেই ধন্য হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলতে শুরু করলেই আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বিদায় নিতাম। মুচকি হেসে তিনি বলতেন, ‘শুনতে ভালো লাগছে না, না?’

আসলে ১৯৯৮ সালে শিলং-এর দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষ করে যখন বরাবরের জন্য কলকাতায় ফিরে আসি, আমার ভালোলাগা সমসাময়িক ও অনুজ কবিদের সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে- পরস্পরের প্রতি এক ধরণের গোপন ঈর্ষা ও দ্বেষের আবহ টের পাওয়ামাত্রই, অচিরেই একটা দূরত্ব তৈরি হতে থাকে কারো কারো সঙ্গে। ব্যাপারটা এতটাই সূক্ষ্ম যে স্বাভাবিক ব্যবহারে তার কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়ে না। অগোচরে স্থায়ী ব্যথা রেখে যায় অন্দরে। এ সব কিছুই অমরত্বের অলীক বাসনায় ওই চিরকালীন ভার্চুয়াল সিংহাসনটি অন্ধকারে খুঁজে না পাবার ভয়ে। তাঁদেরই মধ্যে কারো কারো অসাধারণ কবিতাগুলি পড়ার পর, বলাবাহুল্য ওই মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই তাঁদের কবিতার বাইরের মুখ ভিতরে ঢুকে তোলপাড় করে মনখারাপের রেশ রেখে যায়। মন থেকে কিছুতেই আলাদা করতে পারি না। এ বড়ো অসহায় অবস্থা, কষ্টেরও।

 

আরও পড়ুন...