Categories
2020_june

লেনার্ড কোহেনের কবিতা

অ নু বা দ  ক বি তা

শ্যা ম শ্রী   রা য়   ক র্ম কা র

shmyashree2

লেনার্ড কোহেনের কবিতা

অদৃশ্য হবার রাতে

আজ রাতে আমি অদৃশ্য হয়ে থাকবো

শুধু ক’জন ব্রীড়াবনতা দেখবে আমাকে

আমার দৃশ্যমানতার গোপন দিনগুলোতে

আমি তাদের স্মিত মুখের জন্য কাতর ছিলাম

এখন তারা তাদের সান্ধ্যকালীন ষড়যন্ত্র থেকে উঁকি মারে

যাতে আমরা পরস্পরকে অভিবাদন করতে পারি

আমার বোনেরা

আমার ভাঙাচোরা আপন মানুষেরা তৃতীয় প্রেমিকের পিছু নিতে নিতে

ওরা আমার দিকে তাকায়

ইশারায় বলে

যতদিন আমরা এই দুর্ভাগ্যের জীবন মেনে নেব, ততদিন

আমাদের দেখা হবে না।

 

কবিতারা আর আমাদের ভালোবাসে না

কবিতারা আর আমাদের ভালোবাসে না

ভালোবাসতে চাইছে না আমাদের কবিতা হতেও চাইছে না ওরা

বলছে, ডেকো না বন্ধু

আমরা এখন তোমাদের অকাজের।

 

উদার-হৃদয় নদীতেও

আর শিকার কোরো না প্রিয়

আমরা এবার নতুন জন্ম নেব

আমাদের তাই একলা থাকতে দিও

 

যারা শরীরের শ্রম দিয়ে যায় শুধু

বিশ্বকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই 

কোথাও কাউকে আনন্দ দিতে আসেনি এ পৃথিবীতে

কবিতারা গেছে তাদের সে জগতেই

 

আমি থাকি এক নদীর ওপর মায়ামি নামক শহরে

কীভাবে যে থাকি বলার যোগ্য নয়

ঝরে আসা দেহ, আধা জন্মানো মানুষগুলোর সাথে

কখনো কখনো আমাদেরও দেখা হয়।

ওদের পেশির চারদিক ঘিরে

গোটানো হাতার মতো

কবিতারা সব যেন থকথকে জেলি করাতের দাঁত এবং ধারালো যন্ত্রগুলোর সাথে

দিনভর ওরা করছে মানস-কেলি

 

এই পংক্তিতে তোমাকে স্বাগত

এই পংক্তিতে তোমাকে স্বাগত। যুদ্ধকালীন দিন আজ।

তবুও তোমাকে আমি আপ্যায়ন করে ডেকে নেবো।

আমার কথার দিকে দৃষ্টি দিও না।

এ শুধু স্নায়ুর চাপ।

তোমাকে কি আমি ভালোবাসিনি, বলো?

আমরা যখন পূর্বের দেশে ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম।

একথা ঠিক যে এই বাড়িটি আগের মত নয়।

গ্রামের দখল নিয়ে নেওয়া হবে, বেশি দেরি নেই।

শত্রুকে আপ্যায়ন করবে

এমন কিছু রাখিনি এখানে।

 

যতদিন না দিন বদলাবে

যখন আমরা হার স্বীকার করিনি যখন আমরা এই অন্ধকারকে

কবিতা বলে মেনে নিতে প্রত্যাখ্যান করেছি,

প্রতারিত মানুষেরা তীর্থযাত্রীর মতো

যতদিন না ফিরে আসে সেইসব সময়ের কাছে

ততদিন

আমরা এখানে একা।

লেনার্ড কোহেন (Leonard Cohen)

বিশ শতকের আমেরিকায় বব ডিলান যদি হন ফোক, ব্লুজ, রক, পপ ও গসপেলের বেতাজ বাদশা, লেনার্ড কোহেন তবে ফোক এবং বিশেষত সফট রক সংগীতের নিজস্ব ঘরানায় এক অলিখিত ঈশ্বর। এই কানাডিয়ান গায়ক, গীতিকার, কবি এবং ঔপন্যাসিক, যিনি ধর্ম, রাজনীতি, বিষাদ, যৌনতা, মৃত্যু এবং রোমান্স- সব প্রসঙ্গেই এমন অবাধ বিচরণ করেছেন যে মাত্র তিনটি কবিতার অনুবাদে তার সামান্যই ধরা পড়ে।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june goddyo

উজ্জ্বল পাঠ । পর্ব ২

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ২

সে লি ম   ম ণ্ড ল

অশুভ মোমবাতির ছায়ায় একা খেলা করেন কবি নিত্যব্রত দাস

২০১৫ সালের দিকে দাহপত্রের টেবিল থেকে একটি কবিতার বই ‘অশুভ মোমবাতি’ সংগ্রহ করেছিলাম। কয়েকপাতা পড়ে ভালো লাগেনি। এরপর আরও একটি বই ‘ইনস্টাগ্রামের বাড়ি’ সন্তুদার থেকে উপহার পাই। এই কবি সম্পর্কে আমার তেমন কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। কবি ‘দাহপত্র’ পত্রিকার ঘনিষ্ঠ। ওঁর সম্পর্কে জানতে পারি— ভীষণ খামখেয়ালি একজন মানুষ। কখনোই নিজের লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট হন না। সন্তুষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, বই ছাপানোর দু-দিন পর সেই বই তুলে নেন। বাইরের পাঠকের কাছে দু-এক কপি পৌঁছালে ফেরত দিতেও অনুরোধ করেন।

 

কবির নাম নিত্যব্রত দাস। পরিচিত লোকজন ‘পিকুদা’ বলে ডাকেন। আমার সঙ্গে কখনো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। আশির দশকের কবি। সন্তুদা বারবার বলত, পিকুদার লেখায় একটা নিজস্ব ভাবনা আর স্বর পাওয়া যায়। লেখাগুলো ভীষণ ভাবায়। সত্যি বলতে, আমরা যারা কবিতালেখক ভীষণ লোভী পাঠক। আমরা পাঠের মাধ্যমে বারবার খুঁজি এই লেখা থেকে কী ভাবনা পাব? কী স্বর পাব? কী শব্দ পাব? যা আমাদের লেখার ভাবনাকে উসকে দেবে। আমাদের চালিত করবে নিজস্ব ঘোরের  জোনাকিভর্তি একটা অন্ধকার কূপে। একজন কবিতা লেখকের কাছে বইপাঠ অবসর সময়ের বিনোদন নয়। লোভের নিভৃত আশ্রয়।

 

এবারের ২০২০ এর বইমেলায় কবির দুটো বই প্রকাশ পায়। একটি ‘অন্ধকারবয়সি’, আরেকটি ‘নানা রঙের কাঠের হাত’। কবি সম্পর্কে ততটা আগ্রহ না জন্মালেও দুটো বই-ই সংগ্রহ করি।

 

লকডাউনে ঘরবন্দি। নানা বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি। নিত্যব্রত দাসের ‘অন্ধকার বয়সি’ বইটা একদিন সামনে এল। পাঠ শুরু করলাম। বলা যায় আগে পড়া দুটো বই সম্পর্কে প্রায় ভুলে গেছি। নিত্যব্রত দাস সম্পর্কে আমার অন্ধকার দরজা খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করতে বুঝলাম, এই ঘর এতটাই রহস্যে ভরা এখানে প্রবেশ করতে হলে একটা প্রস্তুতি নিতে হয়। এতটা সময় পেরিয়ে, আবার নতুন করে পুরোনো বইগুলো নিয়ে বসলাম। আমার মাথার মধ্যে বসে গেল ক্ষুধার্ত এক কাঠঠোকরা।  ক্রমাগত সে ঠোঁট দিয়ে মাথা ঠোকরাচ্ছে। এই কবিকে নিয়ে কখনো লিখতে হবে। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, এই ধরণের লুকিয়ে থাকা বা হারিয়ে যাওয়া কবিদের সন্ধান করে কোনো কাজ করার। রাজদীপদার ‘Hello Testing বাংলা কবিতা’ ওয়েবজিনে কবিদের নিয়ে যখন ধারাবাহিক লেখার প্রস্তাব এল, ভাবলাম কাজটা শুরুই করে দিই। কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবে।

 

কবি, চারটে কাব্যগ্রন্থের কোনোটাতেই কোনো কবিতার নামকরণ করেননি। কবিতাগুলো সিরিয়াল নম্বরে রেখেছেন। কবিতার নামকরণ করা আমার নিজের কাছেও মনে হয় খুব কঠিন একটা কাজ। তবে গোটা কাব্যগ্রন্থে সিরিয়াল নম্বরে কবিতা রাখা আরও কঠিন। কাব্যগ্রন্থে, কবি শুধু তাঁর ভাবনা-চিন্তা সাজিয়ে রাখেন না, ধরে রাখেন তাঁর জার্নি। এই জার্নির সুরটা তখনই মসৃণ হবে যখন কবি দক্ষতার সঙ্গে সাজাতে পারবেন কবিতার মালা। নামকরণহীন কবিতা দিয়ে সাজানো কাব্যগ্রন্থ যেন একটিই দীর্ঘ কবিতা… দীর্ঘকবিতা, দীর্ঘ পথের মতো। গন্তব্যে পৌঁছানোই শুধু আমাদের লক্ষ্য নয়। গন্তব্যটা কতটা সুখকর হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।

‘নানা রঙের কাঠের হাত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রথমে কয়েকটি টুকরো টুকরো কবিতা প্রথমে পড়া যাক, বিক্ষিপ্তভাবেই—

 

এত ভারী শাড়ি দেখিনি মেলে দেবার পর ছাড়ার আগের মতোই হাওয়ায় এক ফোঁটা দোলে না, এক সন্ধ্যেয় রং ওঠা কাপড়ের বয়স বেড়ে যায় এত, কঠিন হয়, মুখের কথা জমে এত পুরাতন মন্দির হয়ে ঝড় ওঠার আশঙ্কায় বুক কাঁপায়।

 

একটাই চিনেমাটির বাসন। তাতে খাই, স্নান করি

মুখ দেখি, সময় দেখি, বয়স দেখি, গোল হয়ে সারারাত ঘুরি, দেখে ফেলবে ভয়ে

অন্ধকার লুকিয়ে রাখি অন্ধকারে, খারাপ সময় এলে উপুড় করে চাপা দিই একজোড়া

চিনে মাটির হাত দিয়ে।

 

আমি ভাড়া নিয়েছিলাম একটা জন্মদিন, একটা সময়কাল। আর, একটা চড়ুইয়ের পূর্ণ মালিকানা চেয়ে উচ্ছেদ হয়েছি সেই বিপাশায়, যে এসবের মালিক ছিল।

 

সকাল দশটার পর থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত যে লোকটা বাড়ি বাড়ি গ্রিলের গেট অব্দি গিয়ে দেখা করে আসে, সে-লোকটার নিজের বাড়ি নেই। একটা ঘানি আছে। একটা অল্প দামের সূর্য আছে।

 

উপরের কবিতাগুলো পড়লেই বোঝা যায় কবির স্বর কতটা স্বতন্ত্র। কবির দর্শন ও ভাবনার জগৎ কতটা আলাদা। কবির থেকে শেখা যায় কম কথায় কবিতাকে কতটা তীক্ষ্ম করা যায়। অণুকবিতার জোয়ারে একটা বড়ো বাক্যকে ভেঙে দু-তিন টুকরো করে যেভাবে কবিতা লেখার প্রয়াস দীর্ঘ দিন চলছে, তাতে বোধহয় বেশি করে এই কবিতাচর্চার প্রয়োজন। কবিতাগুলোয় দেখা যায়—আটপৌরে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা চিত্র। ক্লান্তিহীন ঘন বিষাদ। প্রথম কবিতাতে উঠে এসেছে ‘চিনেমাটির বাসন’। কবি বলেছেন, চিনেমাটির বাসনে ভাত খান, স্নান করেন, সময় দেখেন, বয়স দেখেন… চিনেমাটির বাসনে আলো পড়লে তার Reflection ঘটে। কবি সেই আলোতেই দেখেন মুখ। দেখেন জীবনের নানা প্রতিচ্ছবি। এমনকি অন্ধকারও লুকিয়ে রাখেন। কবিতাটি পড়তে পড়তে দেখা যাচ্ছিল নানা ছায়া-আবছায়া। শেষ লাইনে এসে কবিতাটি হয়ে  উঠল কোনো জাদুকরের মুগ্ধ করা রহস্যজাল। আমরা এই রহস্য দেখব বলেই তো কবিতার কাছে নতজানু হয়ে থাকি। লাইনের পর লাইন এগোতে থাকি। শেষ লাইনটা একবার ভাবুন, “খারাপ সময় এলে উপুড় করে চাপা দিই এক জোড়া চিনেমাটির হাত দিয়ে।”!!!

 

আরেকটি কবিতায় কবি বলেছেন— “ভাড়া নিয়েছিলাম একটা জন্মদিন” । পরের লাইনে বলছেন— একটা চড়ুইয়ের পূর্ণ মালিকানা চেয়ে উচ্ছেদ হয়েছি সেই বিপাশায়, যে এসবের মালিক ছিল।” খেয়াল করা যায় কবির কথন খুব সহজ সরল।   কিন্তু তাঁর ভাবনা ও দর্শন অনেক গভীরে। কবি কেন জন্মদিন ভাড়া নেওয়ার কথা বলছেন? জীবনের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। তার কতটুকুই বা আমরা পরিশোধ করতে পারি? চড়ুই পাখির মতো আমরা কি পারিনা ফুড়ুৎ করে এদিক-ওদিকে উড়ে যেতে? বিপাশার জলে ঝাঁপ দিয়ে শাপ মুক্তি হয়ে আবার জন্ম নিতে? নদী সবসময় আত্মসাৎ করে না,  অনেক সময় ভরিয়ে দেয়। পুরাণে কথিত বশিষ্ঠ মুনির সেই কাহিনির মতো। বিশ্বামিত্রের চক্রান্তে বশিষ্ঠের শত পুত্র নিহত হয়। তিনি ভেঙে পড়েন। বলা যায় শোকে উন্মাদ হয়ে যান। তিনি নিজের হাত পা বেঁধে ঠিক করেন নদীতে ঝাঁপ দেবেন। না, কিন্তু নদী তাকে মৃত্যুর পরিবর্তে দিল নতুন জীবন। কবি বোধহয়, এই ভাড়া করা জন্মদিন নিয়ে বিপাশায় ডুব দিতে চান।

 

‘অন্ধকার বয়সি’ কাব্য গ্রন্থ থেকে একটি কবিতা পড়া যাক—

 

ছোটো বেলার বাড়ি ছিল আমাদের অনেক দূরে। বিমলা

কখনো-সখনো আসত, আসত রঙিন কাগজের রিকশায়, কাচ ছেটানো

পুকুরে স্নান করত। বৃষ্টির ফোঁটা সেদিন করাঘাত ছিল।

শূন্য নারকেল মালায় টলটল করেছে সমুদ্র। সারারাত কারা মাছ ধরত,

মাটি আঁচড়াত কুকুর, শুয়ে শুয়ে শুনতাম।শোনা যেত মাটির বারান্দায়

খালি বিষের শিশিগড়ানোর শব্দ। এক শীতলা মূর্তি সেদিন কত

পরিচ্ছন্ন রেখেছে অন্ধকার বাঁশতলা।

 

উপরের কবিতার চিত্রকল্প আমাদের অচেনা নয়। আসলে আমাদের জীবন একই। সেই শৈশব, যৌবন, প্রেম, সংসার, ব্যাধি… কিন্তু প্রত্যেকের জীবনের আলাদা আলাদা বাঁক থাকে। জীবন সেখানেই বৈচিত্র্যময়। কবিতার ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার ঘটে। কবি, তাঁর নিজের দেখাকে শব্দ ও ভাবনার নিগূঢ়তায় কতটা গতিশীল ও প্রাণবন্ত করতে পারছেন, সেখানেই যেন কবিতার সারবত্তা। আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে অজস্র মৃত ঘাস পড়ে থাকে। একটু আলো পেলেই সে আবার জেগে উঠবে। কিন্তু সেই আলোর সন্ধান না করে আমরা নিজেদের পায়ে তা পিষে দিই। নিজেরাই ভুগি অস্তিত্ব-সংকটে। কবি লিখছেন, “বিমলা/ কখনো-সখনো আসত, আসত রঙিন কাগজের রিকশায়, কাচছেটানো/ পুকুরে স্নান করত।” কবিতাটি আমি হয়ত ভুলে যাব কোনোদিন, ভুলব না তাঁর এই শব্দদুটি ‘রঙিন কাগজের রিকশা’, ‘কাচ ছেটানো পুকুর’। এ-কবির একেবারেই নিজস্ব। ওই যে আগেই বলেছিলাম— কবিতা লেখক আমরা, লোভী পাঠক। এই লোভের বশেই নতুন নতুন কবিতার সন্ধান করে চলা…

 

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অশুভ মোমবাতি’ থেকে পড়া যাক একটি কবিতা—

 

যে মেয়ের নাক ছোটো চোখও তার

বনবেড়ালির মতো, নাকের ওপরেই থাকে তারা

শরীর ঝুঁকে থাকে শিকারে

কাপড়ের পুঁটুলিতে কাচটিপ, কেটলি,

জল গরম করার জ্বালানি, জামাকাপড়, সন্তানসন্ততি

মশারি উঠিয়ে সঙ্গে নামে আরও হাজার বেড়াল

অনেক স্বামীর একজন গাছতলা দিয়ে হাঁক দিতে দিতে ফেরে,

‘ফটো বাঁধানো হলনা’

কাপড়ের পুঁটুলি থেকে একের পর এক

শিকারি বেড়াল বাগানের আলোয় এসে

ছোটো ছোটো চোখ, তাদের ছোটো ছোটো নাক নিয়ে

মত্ত হয়ে ওঠে নতুন নতুন শিকারে

 

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। একজন আশির দশকের কবির কবিতা প্রকাশ হচ্ছে প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে। একজন কবির এই আত্মগোপন কতটা জরুরি তা কবিতাটি পাঠ করলে বোঝা যায়। একটি কবিতাকে কোনো পাঁচমাথার মোড়ে এসে ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। হয়ত সচেতন ভাবে কবি সবসময় পেরে ওঠেন না। পাঠক নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কবিতা নিজে কোনো মোড়ে না গিয়ে যদি পাঠকই নিয়ে যায় নিজ নিজ রাস্তা ধরে, তাহলেই তো কবিতার সার্থকতা। কবিতা যত বহুস্তরীয় হয়ে উঠবে এই রহস্য তত আলো ফেলবে। উপরের কবিতাটি পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে এই বহুস্তরীয় কবিতাটি নিয়ে নানা ভাবে ভাবতে। ওই যে প্রথমে বলেছিলাম— প্রথম পাঠে ভালো লাগেনি। আসলে এই বহুস্তরীয় কবিতার কাছে পৌঁছানর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা ছিল না। এখনও হয়ত ঠিকঠাক প্রস্তুতি হয়নি। কবিতাটির কোনো ব্যাখ্যাতে না গিয়ে শুধু বলতে পারি— ওই শিকারি বেড়ালের মতো আমিও ওত পেতে থাকি নিত্যব্রত দাসের কবিতার দিকে। ছোটো নাকের ফুটো দিয়ে নিই তার ঘ্রাণ।

 

‘ইন্সটাগ্রামের বাড়ি’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ার সময় মাথায় বারবার পাক খাচ্ছিল ‘গঙ্গা’ চরিত্রটি। গঙ্গা কে? রক্ত-মাংসের কোনো নারী না বয়ে যাওয়া বিপুল জল রাশি? কবি এক জায়গায় বলেছেন—  “বন্ধ্যা অপবাদ ভেঙে আদিগঙ্গার কোল জুড়ে খেয়ায় ভাঙবে/ নতুন গঙ্গার ঢেউ?” কবিতার শব্দ Duality কবিতাকে তাঁর নিজ অবস্থান সরিয়ে আরেক উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেন যদি কবি তাঁর মুন্সিয়ানায় ক্লান্তিহীন সিঁড়ি ভাঙতে পারেন।   অনেক কবিতায় দেখেছি— ফিকে শব্দ Duality কবিতাকে যতটা শরীর দিয়েছে ততটা প্রাণ দেয়নি। কবিতায় অলংকারের ব্যবহারের মতো।

এখন এই কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়া যাক কিছু কবিতা—

 


খবর এসেছে দ্বিধা এখানে আসেনি যেমন, কোথাও আসেনি।  

দ্বিধা কোথাও আসেনি। দ্বিধা গলায় সোনার হার পরে। দ্বিধাকে সহজে

চেনা যায় তাই। যখন লতার নিচে, বারান্দায়, হাইওয়ের চটিতে।   

তবু দ্বিধা যে আসেনি, তার কারক সম্ভবত দ্বিধা নিজে ছিল না।

তার মানে সে এসেছে, পৌঁছোয়নি। আফশোস করে ফিরে গেছে যে

গতকালটাই ঠিক খুঁতহীন ছিল, আজ নয়। তার আগের দিনগুলোও

খুঁতহীন ছিল না বিশেষ।  

এটা না হওয়াই খুব স্বাভাবিক যে, দ্বিধা এলো, সটান ঢুকে পড়ল ঘরে,

আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল সীতারা।  

 

শ্যামেদের পাড়ায় নতুন কল বসেছে। নতুন জল বসেনি।    

কল ঢাকা পড়ে গেছে পাতার অনন্তে। কথা ছিল কল বসবে,

জলের স্ফটিক দেখে মৃগেল বসবে। তার অন্য সহচর।   

পাতায় এখন ঢাকা পড়ে এই, তো হাওয়ায় উড়ে যায় সমান বেগে।   

একসময় পিছিয়ে যায় হাওয়ার বেগ। মৃত পাতার নতুন কল বসে।  

মুখ খোলে না শ্যাম। সারা গায়ে মাছি, মন্থরপায়ে অফিসে যায় শ্রাবণমাসে।

 

পাশের ফ্ল্যাটের গঙ্গা মারা গেল কয়েক বছর হলো।   

মেঝেতে অনেকদিন ছড়িয়ে রইল গঙ্গার ভিজে পা, জলের বালতি,

শায়ার লেস, কোলাপ‌‌সিব‌‌ল গেটে আটকে। আর তার আধখাওয়া

হাওয়াইয়ে পরপুরুষের পা গলিয়ে থাকার লোভ জানাজানি

হয়ে গেল চারমুখে।

ও বেঁচে থাকতে যে টুকটুক শব্দ বন্ধ দরজার পেছনে ঘুরত,

সে তবে ছিল দেশলাই ঠুকে প্রদীপ জ্বালাবার? মরে যাচ্ছে

পরপুরুষ যে, তাকে উল্টোচিতায় পুড়িয়ে জাগিয়ে রাখার মোমবাতি?

আসলে সে কি তবে নিরন্তর বৃষ্টি ছিল, আচার অনাচারের, কূল অকূলের

নিরন্তর যুদ্ধের অবৈধ স্মৃতি? এক শতাব্দী পরে ফাঁকা ঘরের

দরজা খোলার খাঁ খাঁ করা মোমবাতির আগুনের সূচনা?

 

আমার সঙ্গে হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে এল সত্যবতী। 

হাসি না থামিয়ে ঢুকে গেল উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে,

চটি ভেঙে রইল গোড়ালিতে।

ছাদের তারে কাপড় উল্টে সময় কাটিয়ে পা টিপে নামতে

গিয়ে দেখি চারতলায়, তিনতলায় ফ্ল্যাটের মুখে পা থেকে খুলছে

একটা একটা ফোস্কাপড়া চটি,

খালি পায়ে খ্যাপার মতো সত্যবতী ঘুরছে।

টোকা দিয়ে নামিয়ে আনছে সিঁড়ি,  এতলা ওতলার বাদুড়।

জঙ্গল হয়ে যাচ্ছে দুখানা চোখ, ভেঙে ফেলছে আগের হাসি হাসি ভাবখানা।

 

এই ধারাবাহিকের মূল উদ্দেশ্যই কবির কবিতার সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ ঘটানো। কোনো কবিতাবোদ্ধা বা আলোচক আমি নই। আমার পাঠানুভূতিকে পাঠকদের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে যদি কবিতার নানা টুকরো-টাকরা দিক পাঠককে ভাবাতে পারে বা কবিতা সম্পর্কে আগ্রহ যোগান দেয় তাহলেই সার্থক।

 

নিত্যব্রত দাসের কবিতা পড়লে বারবার আমার মাথায় আসে অমিতাভ মৈত্রের কথা। দুই কবির কোথাও যেন একটা মিল পাই। ভাবনার মিল। কিন্তু দু-জন দুই পথে হাঁটেন। স্বতন্ত্র ভাবেই হাঁটেন। অমিতাভ মৈত্র আটপৌরে জীবনের কথা লেখেন না। তিনি লেখেন বাংলায় দাঁড়িয়ে এমন কবিতা যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে মনে হয় সেই দেশের কবিতা। কিন্তু নিত্যব্রত দাস দেখেন আটপৌরে জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নানাদিক। ভীষণ সচেতন ভাবে। রহস্য রেখে। আড়াল রেখে। সহজ ভাবে। দর্শনে। অমিতাভ মৈত্রের কবিতায় আসে ম্যাডাম এম, খ্রিস্টোফার, হেনরি, মায়েস্ত্র। আর নিত্যব্রত দাসের কবিতায় আসে বিমলা, গঙ্গা, সত্যবতী। এরা বাংলার মেয়ে। পাশের পাড়ার,  পাশের বাড়ির মেয়ে। এই মেয়েগুলোকে কৈশোরে আড়চোখে দেখেছি। দেখেছি পরবর্তীতে ঝুলে যাওয়া স্তন নিয়ে স্বামীর সংসার করতে। দুরন্ত বাচ্চাকে উচ্চ স্বরে খ্যাঁকাতে। কখনো বা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে।

শূন্যতা আমাদের একা রেখে চলে যাচ্ছে। শূন্যতার সঙ্গে আমরা করতে চেয়েছি ঘর। এই ঘর, আমাদের চাঁদ না দিক, দিক জোছনার চঞ্চলতা অথবা মেঘের তীব্র গর্জন। ডানা ভেজা শালিখের মতো ঝাপটাতে ঝাপটাতে আমরা যেন শরীরের সমস্ত জল ঝেড়ে ফেলতে পারি। পারি— শরীরের উষ্ণতায় মনকে স্নান করাতে। আমাদের বালিশ ভিজে যাওয়ার আগেই ছিঁড়ে গেছে। এতে কার দোষ? মাথা না বালিশের? ওয়াড়ের নালে লাল জোনাকি রক্ত খেয়ে লাল আলোতে ভরিয়ে দেবে এই ভাবনার মৃত্যু নিয়ে যদি আবার গ্রহণ হয় তবে কাকে প্রথম পাশে পাব? কবিকে না কবিতাকে?  এই যে যত দিন যায় মনে হয়, কী লিখছি? বা কোনো বই পড়লে ধুস কেন সময় নষ্ট করে পড়লাম। আসলে কি অন্ধত্বের স্লোগানে মিছিলের প্রথম সারিতে উপনীত হয়েছি না আমার মিছিলে একাই একটা রাষ্ট্রের পতাকা বাহক হয়ে ভিতরে ভিতরে কবিতার দ্বন্দ্ব তৈরি করছি? এখুনি মিছিল শেষে যদি সন্ধ্যা নেমে আসে, আলো কোথায় পাব? আমরা আবার ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেব? না একটা ‘অন্ধকারবয়সি’ আমি ‘অশুভ মোমবাতি’ জ্বালিয়ে নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে দেব ‘নানা রঙের কাঠের হাত’ দিয়ে? না এই আমার ‘ইন্সটাগ্রামের বাড়ি’?

 

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ:

অশুভ মোমবাতি (২০১৫)

ইন্সটাগ্রামের বাড়ি (২০১৬)

নানা রঙের কাঠের হাত (২০১৯)

অন্ধকার বয়সি (২০১৯)

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june goddyo

স্মরণ | শম্ভু রক্ষিত

বি শে ষ  র চ না

হ্যালো টেস্টিং বাংলা কবিতা টিম

স্মরণ | শম্ভু রক্ষিত

box_pic_sambhu

‘হালকা অবিক্লিব স্বর্ণবর্ণ ঘোড়ায় চড়ে সূর্যকে দক্ষিণ দিকে দেখতে দেখতে’ আজীবন কোনো পুরস্কার বা প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করে, জীবনযাপনের সমস্ত বাহুল্যকে চরম বিদ্রূপ করে, প্রকৃত রাজার মতো মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলেন মহাপৃথিবীর বাসিন্দা, বিশিষ্ট কবি শম্ভু রক্ষিত। তিনি ‘কেরর না অসুর’ তা আমাদের জানা নেই, তবে তিনি যে একজন প্রকৃত মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবী নয়, ‘মহাপৃথিবী’— একটি পত্রিকার নাম নির্বাচনের প্রবণতাই ইঙ্গিত করে মানুষটির মনোজগতের ব্যাপ্তিকে।

কবি শম্ভু রক্ষিতের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট, স্বাধীনতার ১বছর ১দিন পর। বিপ্লবীযুগে জন্ম না হলেও বিপ্লব ছিল তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ১৯৭৫ সালের ২৬শে জুন ভারতে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি হলে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আরও অনেকের সঙ্গে কলম ধরেন তিনিও, এই সময় অনেক কবিতাও লেখেন।  কবি জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকা এরকম সময়ে প্রকাশ করে বিশেষ রাজনীতি সংখ্যা। শম্ভু রক্ষিত ছিলেন পত্রিকার বিশেষ সহযোগী সম্পাদক। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতেই প্রকাশ ঘটে সংখ্যাটির। ‘রাজনীতি’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয় তাঁর। ১৯৭৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। ১৯৭৭-এর ৮ই ফেব্রুয়ারি জরুরি অবস্থা শিথিল হলে তিনি মুক্তি পান। কাজী নজরুল ইসলামের পর তিনিই কোনো বাঙালি কবি যিনি জেল খাটেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

কবির জীবনের প্রথম পর্ব কাটে হাওড়ায় মামাবাড়িতে। পরবর্তী সময়ে তিনি পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন মেদিনীপুরে। মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়াই হয়ে ওঠে তাঁর ‘মহাপৃথিবী’ পরিচালনার ও যাবতীয় কাজকর্মের কন্ট্রোলরুম। কলেজস্ট্রিট থেকে মাথায় করে বয়ে নিয়ে আসতেন কাগজ। দারিদ্র ছিল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। কিন্তু কোনোদিন তিনি পাত্তা দেননি তাকে। বিশিষ্ট কবি সুজিত সরকারের একটি লেখা থেকে জানা যায়, তিনি একবার তাঁকে দেখেছিলেন একটি প্রেসে কমপোজিটারের কাজ করতে। সম্ভবত সেই মালিকও জানতেন না তাঁর কর্মচারীটির আসল পরিচয়। ধরাবাঁধা কোনো কাজের গণ্ডিতে কোনোদিন বেঁধে রাখেন নি নিজেকে। দারিদ্র, বোহেমিয়ান জীবনযাপন, ধোঁয়াশা ছিল তাঁর জীবনের অঙ্গ। কবি সুজিত সরকার একবার বাস থেকে তাঁকে দেখেছিলেন, তিনি রাস্তায় কাগজ কুড়োতে কুড়োতে হাঁটছেন। এমনই খামখেয়ালি ছিল তাঁর যাপন। সাহিত্যের আড্ডায়, বইপাড়ায় হঠাৎ হঠাৎ হাজির হতেন, আবার সেখান থেকে বেরিয়ে মিলিয়ে যেতেন অন্ধকারে।

 

সম্ভবত ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’ তাঁর প্রথম বই। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’। এই বইটিই তাঁকে বিশেষ পরিচিতি এনে দেয় কবিমহলে আর বাঙালি পাঠক পরিচিত হয় তাঁর ‘ঈশ্বরকন্যা’র সঙ্গে। ‘তুমি ঈশ্বরকন্যা, তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে…’ — কি আশ্চর্য পঙক্তি! ২০০৪-এ প্রকাশিত হয় তাঁর ‘‘আমি কেরর না অসুর’ কাব্যগ্রন্থটি। ২০০৫-এ পাঠক পায় তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। বইটি প্রকাশ করে ‘দি সী বুক এজেন্সি’ ২০১৫ তে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ।   

তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর কবিতাগুলির কোন চরিত্র বা বয়স নেই। প্রকৃতপক্ষে ধুতি-শার্ট, পায়ে কাবলি জুতো, কাঁধে ঝোলা, কথা বলার বিচিত্র ভঙ্গি আর হঠাৎ হঠাৎ খ্যা খ্যা শব্দে হেসে ওঠা নিয়ে ট্রেডমার্ক হয়ে থাকা কবি শম্ভু রক্ষিত নিজেও ছিলেন বোধহয় সমস্ত বয়স আর চরিত্রের উর্ধ্বে। কবি সুজিত সরকার তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, ‘আশ্চর্যের কথা, প্রথম যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যখন তাঁর কোনো কবিতাই আমি পড়িনি, আমার মনে হয়েছিল তাঁর কোনো বয়স নেই। তিনি আমার সমবয়সী হতে পারেন, কিংবা আমার বাবার সমবয়সীও হতে পারেন।’ একমাত্র প্রাজ্ঞই মানুষকে বয়সোত্তীর্ণ করতে পারে।

আচ্ছা এমন মানুষও কি প্রেমে পড়েন না? পড়েন। স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর টলে যান তো মানুষ কোন ছার! তারপর সেই মানুষ যদি কবি হন। সুজিত সরকারের লেখায় আমরা তারও উল্লেখ পাই— ‘সম্ভবত শ্রীরামপুর থেকে রমা ঘোষ ‘মহাপৃথিবী’-র জন্য কবিতা পাঠিয়েছিলেন। শম্ভু রক্ষিত সেই কবিতা ছেপে রমা ঘোষকে পৌঁছে দিতে যান হাওড়া থেকে শ্রীরামপুরে। সম্ভবত রমা ঘোষ তাঁকে চা মিষ্টি খাইয়েছিলেন। ব্যাস, শম্ভু রক্ষিতের ধারণা হ’ল রমা ঘোষের সঙ্গে তাঁর প্রেম জমে উঠেছে। তাঁর জীবনযাপন ও কবিতার মতোই অদ্ভুত এক চিঠি রমা ঘোষকে লিখে পাঠিয়েছিলেন পোস্টকার্ডে। রমা ঘোষের বাবা ছিলেন কলকাতা পোর্টট্রাস্টের ডক্টর। সম্ভবত পোস্টকার্ডটি তাঁর হাতেই পড়ে। এরপর শম্ভু রক্ষিত যখন শ্রীরামপুরে রমা ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে যান বাড়ি ঢোকবার মুখে রমা ঘোষের বাবা তাঁর নাম জিজ্ঞেস করেন এবং শোনার পর গম্ভীরভাবে তাঁর দিকে চেয়ে থাকেন। শম্ভু রক্ষিত সেখান থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন নাকি রমা ঘোষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তা অবশ্য আমার জানা হয়নি। তবে তাঁর কাছ থেকে এটুকুই জেনেছিলাম যে তিনি একটি সুদীর্ঘ দড়ির খোঁজে রয়েছেন। সেই দড়িতে রমা ঘোষকে বেঁধে তিনি হাওড়া থেকে রোজ একটু একটু ক’রে টান দেবেন। তাহলেই তাঁর রমা ঘোষকে পেতে আর কোনো অসুবিধা হবে না। একথা বলার সময় তাঁর কন্ঠস্বর প্রেমিকের মতো কোমল হয়ে আসতো।’

 

তিনি বিয়ে করেছিলেন। তবে রমা ঘোষকে নয়।  তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে বর্তমান। ছেলের নাম কীর্তিকর,  মেয়ের নাম দিওতিমা। কি অদ্ভুত নাম। অদ্ভুত শব্দের প্রতি কবি শম্ভু রক্ষিতের ঝোঁক ছিল বরাবরের। যেমন, ‘ঙাপি’, ‘ৎমীসিস’, ‘ছেরি’, ‘কেরর’, ‘হিমাধারা’ প্রভৃতি। এই সব অদ্ভুত শব্দদের দিয়ে তিনি রচনা করতেন তাঁর কবিতার চিত্রকল্প।  দেশি-বিদেশি, ইংরেজি, ফার্সি, হিন্দি, মাগধী, পালি-সহ বহু শব্দের ব্যবহার অলংকৃত করে ছিল তাঁর কবিতাকে। তাঁকে প্রণাম। বাংলা কবিতা মায়ের মতো বুকে জড়িয়ে রাখবে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে।

 

কবি সুজিত সরকার তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন একটি সুন্দর কবিতা—

শম্ভু রক্ষিতের লেখা কোনো পত্রিকাই ছাপতে চায় না, তাই তিনি নিজে নিজেই ছাপার উদ্যোগ নেন। শম্ভু রক্ষিতের লেখা কোনো কমপোজিটরই কমপোজ করতে চায় না, তাই, প্রেসমালিককে অনেক বুঝিয়ে, এখন নিজের লেখা তিনি নিজেই কমপোজ করেন। শম্ভু রক্ষিত যা লেখেন, তা কবিতা কিনা নিজেও জানেন না, কিন্তু তিনি না লিখেও থাকতে পারেন না।

 

তিনি প্রতিবারই আমাদের সাথে কফি খান, অসম্পূর্ণ বাক্যে কথা বলেন, হঠাৎ হঠাৎ খ্যা খ্যা শব্দে হেসে ওঠেন, প্রতিবারই কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গল্প করতে করতে কিছু দূর হেঁটে আসেন, তারপর প্রতিবারই হাওয়ায় মিলিয়ে যান। তিনি কোথায় থাকেন তা আজ আমরা কেউই জানি না। তিনি লেখেন: ‘আমি পৃথিবীর কত বাইরে, কত উপরে আছি।’

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
সুজিত সরকার, শুভদীপ সেনশর্মা

তথ্যসূত্র:
কবি শম্ভু রক্ষিত সম্পর্কে দু-চার কথা: সুজিত সরকার,
শম্ভু রক্ষিত স্মরণে: চন্দ্রদীপা সেনশর্মা (আলোপৃথিবী ত্রিকা)

চিত্র ঋণ:
লিটল প্রচার লিটল প্রসার ফেসবুক গ্রুপ, পৃথ্বী বসু, দীনেশ কর, শংকর রায়

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june path_protikriya

সায়ন

পা ঠ  প্র তি ক্রি য়া 

সা য় ন

মানবতার কোনও উপনিষদ হয় না,  কোরান হয় না

“আমি হলাম ককটেল ক্যাবিনেটের নীচে একটা ছোট্ট টিকটিকি, সভ্যতার সমকক্ষ।” হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম, সারা পৃথিবীতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ একদিন রাষ্ট্র জানাল, আপনাদের বন্দি হয়ে যেতে হবে ঘরে। বাইরে নাকি মৃত্যুমিছিল শুরু হয়ে গেছে। কাকদ্বীপ থেকে ক্যালিফোর্নিয়া সবাই আজ সন্ত্রস্ত, ভীত। প্রাত্যহিক জীবনে ঢুকে পড়ছে সংক্রমণ ও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। একে অপরের থেকে সর্বদা দূরে থাকুন কারণ মানুষ এখন এমন এক বাহক, যে অপরকে সংক্রমিত করে দেবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নয়, চিত্র এক, অনৈক্য বিরাট। আমরা জানতেও পারছি না কিছু- শুধু মৃত্যুর সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। শেষের দিনটা আমি কী শুধু একটা পরিসংখ্যান হয়ে বেঁচে থাকব মানুষের মনে! মাথার মধ্যে দুটো লাইন এসে গেল—

 

“আমেরিকা, মহাচীন এগিয়ে আসছে- গরীবের কী হবে?

 আমরা ডাক্তার নই, আমরা মানুষ- ইতি একজন ফুচকাওলা।”

 

সুবোধ সরকার! ২০০৬ সালের একটি কবিতার বই থেকে লাইন ক’টা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বইয়ের নামটা দেখছি- “যা উপনিষদ, তাই কোরান”। বইয়ের তাক থেকে চোদ্দ বছরের পুরনো একটা বন্দুক হাতে নিলাম, যার প্রতিটি পাতায় বুলেট ছাপানো আছে। এই কবিতাগুলোর সংক্রমণ থেকে তাহলে এখনও মুক্ত হতে পারি নি, আজও। 

সংক্রমণ- ১

২০১১ সাল, ২১শে ফেব্রুয়ারী। ভাষা দিবসে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে দুপুর ২টোয় কান পাতা দায়- মঞ্চে একজন কবি উঠছেন। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ার, মেয়েদের কলেজে গেছি কবিতা শুনতে। এটাও হয়! সুন্দরীরা একজন কবির জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে- তাঁর কবিতা শুনবে বলে। আমি কালো টি-শার্ট, জিনস, উনি কালো শার্ট, কটন ট্রাউজার্স। কবি বললেন “আমরা কেউ বাংলায় কবিতা পড়তে ভালবাসি না,” কন্ঠে তাঁর ‘মণিপুরের মা’। একজন তরুণ সংক্রমিত হল কবিকে দেখে, নাম সুবোধ সরকার। 

 

আমি ইনফেক্টেড হলাম কবিতা, প্রেম আর সাহসিকতায়। নিঃসঙ্গ সময়ে ঘরে বসে বসে অতীতের ছবিগুলো দেখছি। ছবি একটা সময়। কবির চোখ দিয়ে সময়কে দেখলে তার পরিসর অনেক বিস্তৃত হয়। ঠিক যেভাবে দান্তে হাত ধরেছিলেন ভার্জিলের, আমার হাত ধরে উনি নিয়ে এসেছিলেন ভাষার নগরে, ভাষানাগরিক হওয়ার আইডেন্টিটি কার্ড দিলেন, কানে কানে বলেছিলেন, “বিড়াল সাদা না কালো, কী দরকার, ইঁদুর ধরতে পারে কী?” (সাদা না কালো)

 

চারপাশটা যখন ক্লান্ত, অসহায়, অনিশ্চিত- তখন কবিতা কী করতে পারে এই সভ্যতার? পারে, অনেককিছু পারে। কবিতায় “সময়টা থাকেই। কারো লেখায় সময়টা একটু বেশি চেনা যায়, আবার কারো কারো কবিতায় এটা লুকিয়ে থাকে। একটু চিনে নিতে হয়।” (সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, সুবোধ সরকার)

সংক্রমণ- ২

এই ইউনিপোলার বিশ্বের টুঁটি টিপে ধরবার প্রতিযোগিতায় চীন একটা মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনই দাবি নিয়ে গোটা বিশ্বের গণমাধ্যম উত্তাল। ইতালি থেকে নিউইয়র্ক- গণকবরে তছনছ সর্বত্র। সারা বিশ্ব একটি দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে, তখন চীন একেবারে নিশ্চুপ। লা রেসফুকোর একটি ‘ম্যাক্সিম’-এর কথায় বলি- “স্বার্থান্বেষীরা সব ভাষায় কথা বলতে পারে, সব ধরণের লোকের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে, এমনকি উদাসীন লোকের ভূমিকায়। এই সময়ে “কী বললেন, বিশ্বায়ন?”—

 

“আমি আমেরিকায় গিয়ে শুনে এলাম

 লোকে ওখানেও বলছে

 দিনকাল যা পড়েছে 

 তুমি তোমার খাবারের কাছে ঠিক সময়ে

 পৌঁছতে না পারলে

 অন্য কেউ পৌঁছে যাবে।”

 

লকডাউনের ফলে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। অর্থ যার আছে তার থাকে প্রাণের ভয়, খিদের থেকে বড় সংক্রমণ আর কিছু আছে? 

সংক্রমণ- ৩

“যারা মঞ্চে ওঠেন না তাদের বলি, জল নয়

ওটা মদ

মন্ত্রী

কবি

আমলা

ভাইস- চ্যান্সেলর

      সবাই ওই মদ পান করেন।“  (মঞ্চ)

 

কোন সময়ে দাঁড়িয়ে কোন বইটা পড়ব- এই নির্বাচনকে বলে বোধ। অনর্গল টিভিতে আতঙ্কের প্রচার, সন্ধ্যা নামলেই আলো করে কবিদের খামখেয়ালী বিলাপ। কবিতা, গল্প- সৃষ্টির আপন আত্মপ্রচার একটি জাতির অলস কূপমণ্ডুকতার ছবির বাইরে বিরাট আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস, জাতীয়তাবাদী বিষ, উদারভাবনার ঐক্য থেকে সরিয়ে রাখা গণবিচ্ছিন্নতা নিয়ে আমরা কি সামান্য ভাবিত! নির্বোধ আত্মঅহংকার ও স্বল্পবিদ্যার অস্ত্র দিয়েই একটা দেশ কি সুন্দর আমাদের একে অপরের থেকে দুরে সরিয়ে দিল- এই বিষয়ে ভারতীয় কবিরা কতটা সজাগ! এই উত্তর অধরা। সুবোধ সরকারের কবিতা ঠিক এইখানেই বিশ্ববোধের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কবিতা তার সোনার কাঁকন খুলে রেখে – একটি আখ্যানের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে, এক হাতে রাইফেল, আরেক হাতে সংবিধান বই ধরে প্রশ্ন করে—

 

“কপালে আজ যা থাকে

মুণ্ডু যার উড়তে গেছে

 বন্ধ্ ডেকেছে আজকে যার ধড়…

 পুলিশ যদি কখনও মারে চড়

কে তাকে ভার দিয়েছে চড় মারার?

(মাফিয়া)

 

কবির মধ্যে যখন চলতে থাকে “গল্প না থাকলে আমি ভালো করে নিশ্বাস নিতে পারি না। উড়তে পারি না। বাস্তব আমাকে উড়তে বলে। যেভাবে মাটি থেকে একটা বিমান শুরু করে তার উড়ান। ন্যারেটিভ আমার কাছে একটা রানওয়ে।” তখনই সেই সাহিত্য মানুষের জন্য হয়ে যায়। “সে মানুষ যেরকমই হোক, সাহিত্য শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য। … সাহিত্য তা সে যত কম লোকই পড়ুক বা যত বেশী লোকই পড়ুক, আসলে শেষ পর্যন্ত সেটা মানুষের জন্য। ( “আমি বিশ্বাস করি রাজনীতি থাকুক, পলিটিক্স বন্ধ হোক।”

সংক্রমণ- ৪

“বাঙালী সমাজের এরকম হিপোক্রেসি আছে, যে তারা মুখে খুব সুশীল, বাইরের আচরণে খুবই ভদ্র। কিন্তু ভিতরে তারা একটু অন্যরকম। ভেতরে তাদের মধ্যে ভায়োলেন্স আছে, সেই ভায়োলেন্সটা  লুকানোর একটা কায়দা আছে।” (‘কথায় কথায়’) বাঙালির জীবনে এখন সবচেয়ে বড় মারণ ভাইরাসের নাম ফেসবুক। এই বন্দিদশায় শুধু তাদের টয়লেটের আপডেট বাদ দিয়ে সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। একটা দেশের কি বিপুল বৈচিত্র্য ভাবলে গা শিউরে ওঠে। যে মা ‘সন্তান প্রসব করে দু’ঘণ্টা পর হাঁটতে শুরু করে’ – সেই দৃশ্যের পরেই দেখতে পাওয়া যায় বাহারী খাদ্যসামগ্রী। পসরা সাজিয়ে আয়োজন দেখানোর আত্মপ্রচার। এর নামই বোধহয় ‘বিশ্ব’- “মাওবাদীদের সঙ্গে স্নান, আমেরিকায় বিয়ার খান।

গোটা বিশ্বজুড়ে মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে— তখন কী করে প্রাণের আরামে সেজে নিজেদের এত আত্মপ্রচার করতে পারে মানুষ! সামান্য ক’টা জিনিস গরিবের হাতে তুলে দিয়ে ৭০টা ছবি আপলোড হয়ে যায়- কেন? ফিরে দেখেছে কেউ, ক’জনের পেট আরও আছে খালি? কতজন গলায় দিল দড়ি, রেলে দিল মাথা, হাতে তুলে নিল বিষ- “বসে ভাগচাষি, হাতে ফলিডল / গণতন্ত্র মূষিকের স্বপ্নে পাওয়া ফল।” (সুজলাং সুফলাং একজিটপোল)

সংক্রমণ- ৫

“যাও ধর্ম, যাও রাজ, ভণ্ড আর.এস.এস.

দাও পুত্র, ঢালো বিষ, মধুপাত্র শেষ।

যাও ধর্ম, জাতে ওঠো, যাও জল অচল

চন্ডাল লিখুক কাব্য বিন্ধ্য হিমাচল

যাও থুতু, যাও বিষ্ঠা, যাও ক্যাবিনেট

ভুল অর্থনীতি যাও ঋণং দিবেত।” (সুজলাং সুফলাং একজিটপোল)

 

একটা ভয় আর হতাশা কত মানুষকে পিশাচ করে তুলেছে গোটা দেশ জুড়ে। কিন্তু গোটা দেশ বা বিশ্বের টুকরো টুকরো ছবি দেখতে দেখতে আর নিজের শহরের এক একটি অঞ্চলের ‘মুখোশ’ পরা মানুষগুলোর বাঁচার জন্য উগ্র চেহারা যেভাবে প্রকট করে তুলছে, আর সেই সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র একটি দানবে পরিণত আজ। একটা গেরিলা মন চিৎকার করে—

 

“রিভলবার যদি কখনও ছোটে

 ছুটবে গুলি এ-কান থেকে ও-কান

 দুপুরবেলা কলেজ ষ্ট্রীটে আমরা হব দুজনে খান খান।”

(রিভলবার)

 

ভাইরাস কোনও ধর্ম দেখে না, বিপদের কোনও জাত হয় না। ১৪ বছর আগের একটি বই খুলে বসে আছি। কবিতাগুলোর সামনে বসে ভাবছি- দেশ, বিশ্ব, মানবজাতির আপাত অবস্থা তাহলে একই জায়গায় রয়ে গেল। চেক রিপাবলিকের কম্যুনিস্ট সুন্দরী যেভাবে সব হারিয়েছিল, উহানের গ্রামের মানুষ সংক্রমণের মিথ্যা সন্দেহে একইভাবে দেশছাড়া হয়। শ্রমিক, চাষি, মজুরদের রাজনীতির শিকার বানানো হত, তাদের ঘাম রক্ত দিয়ে লেখা হত সরকারের নাম। না খেতে পেয়ে তখনও মারা যেত, এখনও মারা যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ তো আরও অন্ধকার। আমার সেকেণ্ড সেমেস্টারের ছাত্রী অয়ন্তিকার ঘর ঝড়ে সম্পূর্ণ ভেঙে গেলে ক্লাবের লোকেরা তাদের পরিবারকে সিঁড়ির নিচে স্থান দেয়, ক্লাবঘরটুকু পর্যন্ত দিতে পারে না- যদি তারা ভাইরাসের বাহক হয়! আমি আসলে সুবোধ সরকারের কবিতা পড়ছিলাম, না আলোচনা করছিলাম জানি না- তবে কবিতাগুলো একটা নতুন রক্তাক্ত জীবন দেখাচ্ছিল বার বার, যে ভণ্ডামি, হিংস্রতা “কত চালাকি ধরা পড়ে না/ যখন পড়ে, বামাল সহ পড়ে/ পড়েই উঠে দাঁড়ায়”

 

যা উপনিষদ, তাই কোরান  সুবোধ সরকার  |  আনন্দ পাবলিশার্স

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june goddyo

শংকর চক্রবর্তী

বি শে ষ  র চ না

শংকর চক্রবর্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি | পর্ব ১

বিদ্বিষ্ট কবি

সমস্যাটা ভবঘুরের মতো প্রান্ত বদল করে শুধু। গত জন্মের এক নিরীহ কচ্ছপের পিঠেও সে সমস্যার দাগ স্পষ্টই থেকে যায়। আমরা কী করি? যারা দু’চার লাইন কবিতা লিখে মনকে স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করি, তারা? অজান্তে নাকি সজ্ঞানে সমসাময়িক প্রকৃত ভালো কবিকে অবজ্ঞা বা অল্পবিস্তর হিংসা করতে শুরু করি। কেন করি? তার কারণ অন্য কিছু নয়, অনেকেই নিজেদের ওপর আর আস্থা টিঁকিয়ে রাখতে পারি না। যেন নিজেরই তৈরি করা এক অলংকৃত ভার্চুয়াল সিংহাসন হারানোর ভয়। আমার এই পঞ্চাশ বছরের নগণ্য কবি-জীবনের অভিজ্ঞতায় যাঁদের সঙ্গ বা সান্নিধ্য পেয়েছি, বিশেষ করে অগ্রজ যাঁরা- তাঁরা প্রত্যেকেই স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত তাতে কোনো দ্বিমত নেই। তাঁদের অবাক করা পঙক্তিগুলো আমাকে মানসিকভাবে পূর্ণতার দিকে এগোতে সাহায্য করেছে। অথচ ব্যতিক্রমী দু’তিন জন বাদে তাঁদের অধিকাংশই নিজেরই তৈরি করা সিংহাসনটি হারাবার আশঙ্কায় অন্যের প্রতি অবজ্ঞা কিংবা কখনো সখনো বিষোদগারও করতে দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথও নাকি এমন আক্রমণের আড়ালে নিজেকে রাখতে পারেননি। বারবার আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাতে অবশ্য তাঁর পাঠকের তৈরি সিংহাসনটি বিন্দুমাত্র টলে যায়নি। তবে ব্যতিক্রমী যে ক’জনের সঙ্গ পেয়েছিলাম, তাঁদের কখনোই কারও প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতে শুনিনি। এর বেশি আর কিছু নেই। পুরোটাই জটিল, বাসি মাঞ্জাসুতোর প্যাঁচ।

 

প্রথম প্রথম অবাক হতাম। রাগ হত খুব। বিশেষ কারোর ওপর রাগ নয়। অথচ প্রত্যেকের ওপরেই। চাকরিসূত্রে প্রায় ত্রিশটা বছর শিলং বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকতে হয়েছিল আমাকে। সত্তরের দশকের গোড়া থেকে। তখন সমসাময়িক কবিরা নতুন আন্দোলনের ঢেউ তুলছে বাংলা কবিতায়। আমি বহুদূর থেকে তার উত্তাপ টের পেতাম। আর চোখ বন্ধ করে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সমস্ত শ্রেণির কাগজেই লেখা পাঠাচ্ছি। অজানা কারণে সেসব ছাপাও হচ্ছে। ভেবেছিলাম বাংলা কবিতার সাম্রাজ্যটা সত্যিই শোভন-সুন্দর। সত্যিই কি তাই? শিলঙে পঞ্চাশের দশকের এক অবহেলিত, ব্যতিক্রমী শক্তিমান কবির সঙ্গ ছিল যেন আমার পূর্ব নির্ধারিত। তিনি একটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতার কাছেই তাঁর একটা বাড়ি আছে। প্রত্যেক শীতের সময় যখন স্কুল-কলেজ ছুটি থাকত, তিনি সপরিবারে শিলং থেকে চলে যেতেন সেখানে। তাঁকে তখন প্রায় সর্বক্ষণই ঘিরে থাকত তরুণ কবিরা। তাঁরা অধিকাংশই আমার সমসাময়িক বন্ধু-কবি। প্রায় দেড়-দু’মাস পর তিনি ফিরে আসতেন নতুন পত্র-পত্রিকা সমেত নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে। কোনো এক আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন আমাকে- ‘আপনার বন্ধুরা আপনাকে হিংসে বা অবজ্ঞা করে যে সে কথা বুঝতে পারি। এর কারণও আছে। ওরা প্রত্যেকেই আপনাকে ওদের একজন প্রতিযোগী ভাবে।’ একেবারে দূরদূরান্তের প্রবাসে পাহাড়ের কোল-সংলগ্ন থেকেও আমি যে কারও প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারি, এটা ভেবে পুলকিত হয়েছিলাম বলাবাহুল্য। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তবে পরবর্তী সময়ে সেসব চিত্র যে আরো ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করব, তা কল্পনাতেই ছিল না, যদি না বরাবরের জন্য কলকাতায় ফিরে আসতাম।

 

তবে আমার কলকাতা-পর্ব নিয়ে লেখার সময় আসেনি এখনও। কারণ এখনও নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে প্রতিদিন। কোনো পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তো অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও ভরপুর হওয়া স্বাভাবিক। এমনকি কোন কবিকে তরুণ কবিরা ফোনে অন্য একজনের থেকে বেশি যোগাযোগ করলেন তাও হিংসায় ঝিলমিল করা কোনো কবির জ্বলে ওঠার কারণ হয়ে ওঠে। সেসবই পরবর্তী কোনো সময়ের আলেখ্য হিসেবে বিবেচনার অধীনে থাকুক বরং।

 

অতি পুরনো একটা সামান্য ঘটনার উল্লেখ করেই আপাতত ইতি টানব এবার। একবার বইমেলায়, তা ১৯৮০-৮১ সাল হবে হয়তো, শিলং থেকে এসে শীতের পাখি হয়ে প্রতিদিন ‘কৌরব’-এর স্টলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম নিয়মিত। একদিন পঞ্চাশের দশকের প্রয়াত এক কবি-শিল্পী ‘কৌরব’-এর স্টল থেকে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁকে সঙ্গ দেবার জন্য। ‘পরিচয়’-এর স্টলের সামনে তখন অগ্রজ কবিদের জমজমাট আড্ডা। তিনি আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে স্টলের ভিতর ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বেরিয়ে আমাকে নিয়ে আবার এগোতে থাকলেন। তাঁর মুখটা তখন রাগে থমথম করছিল। কিছু হয়েছে কিনা আমি জানতে চাইলাম। তিনি ম্লান হেসে বললেন, ‘এবারের মেলায় একটা কবিতার বই বেরিয়েছে আমার। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সেটা ডিসপ্লে করে এলাম। আবার একটু পরে গিয়ে দেখব সেটা অন্য একটা বইয়ের পেছনে চলে গেছে।‘ তিনি তাঁরই সমসাময়িক এক কবির নাম উল্লেখ করছিলেন বারবার। প্রতিবারই নাকি ওই কবি নিজের প্রকাশিত বইটি দিয়ে এই কবির সদ্য প্রকাশিত বইটিকে আড়াল করে দিচ্ছিলেন। এ তো নেহাতই মিষ্টি-মধুর গল্প। তিক্ততার পর্যায়ে ওঠার কিছু কাহিনিও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে হাত ঢোকালেই উঠে আসবে সহজে। সেসব এখন নয়, বরং অন্য কোনো সময়ে।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june goddyo

অভিজিৎ দাশগুপ্ত

বি শে ষ  র চ না

অ ভি জি ৎ   দা শ গু প্ত

কবি নিশিকান্ত ও তাঁর ‘টুকরি’

আচ্ছা একবার ভাবুন তো; ফেসবুকের দৌলতে আমরা নিজেদের কবিতা পোস্ট করি, আবার কখনো প্রিয় কবির ভালোলাগা কবিতাও দু-একটি ছড়িয়ে দিই মাধ্যমটির সাহায্য নিয়ে, আর যদি এই দ্বিতীয় কাজটি স্বয়ং রবি ঠাকুর করতেন, তাহলে! হ্যাঁ, এমন কাজও তিনি একসময় করেছিলেন। তবে তখন তো ফেসবুক- টুইটারের জামানা নয়, তাই বিশ্বকবিকে উৎসব অনুষ্ঠানেই দেখা যেত তরুণ কবির ভালোলাগা কবিতা পাঠ করতে। তাঁদের মধ্যে একজন সৌভাগ্যবান হলেন নিশিকান্ত রায়চৌধুরী।

 

শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র জানাচ্ছেন, “নিশিকান্ত রায়চৌধুরী শান্তিনিকেতনে মানুষ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। কবিতা ও ছোট ছোট কবিতার পদ তিনি শান্তিনিকেতনেই লিখতেন; তার কিছু রবীন্দ্রনাথের আনুকূল্যে পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছিল। তাঁর স্বভাবে একটা কৌতুকের পরিমণ্ডল ছিল। পরিচিত এমনকি শ্রদ্ধেয় অনেকের সম্বন্ধে তিনি ছোট ছোট পদ্য লিখতেন; তাতে পরিহাসের ইঙ্গিত থাকলেও কেউ অসন্তুষ্ট হতেন না, কারণ মানুষটির মধ্যে সারল্য ছাড়া আর কোনও মনোভাব ছিল না।” (‘কবি নিশিকান্ত’ । ডালিয়া সরকার । ভূমিকা)। শুধু কবিতা লেখা নয়, চিত্রাঙ্কনেও তিনি পারদর্শী ছিলেন।

220651
WhatsApp Image 2020-06-07 at 9.25.07 AM

নিশিকান্তর সবথেকে বেশি খ্যাতি তাঁর ‘টুকরি’-র জন্য বোধ করি। বাংলা কবিতার অন্ত্যমিল ও ছন্দের বাঁধনকে আলগা করে এক নতুন পথে তাকে প্রবাহিত করে দেন কবি। অনুভূতির গাঢ়তা তাতে এতটুকু কম ছিল না। কালের বিচারে অভিনব চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন তিনি ‘টুকরি’গুলোতে। বাস্তবের চেনা জগৎ এই লেখাগুলিকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তারা যেন স্বপ্নলোকের কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন এক পথের সন্ধানে বার হয়ে পড়ে।

 

দেরী করে তুমি এসেছ এখন

যাও ভাই প্রজাপতি।

একটু আগেই মল্লিকা ছিল

ঝরে গেছে ঐ নদীপথে।

(মল্লিকা)

 

হায়রে অসাবধানী,

কালকে বিকেলে এখানে বেড়াতে এসে

পড়ে গেছে বুঝি তোমার কানের লাল পাথরের দুল।

বাদামি রঙের বালির উপরে সবুজ ঘাসের পাশে

ঐ রাঙা রঙ জ্বল জ্বল করে আজ!

যেই কাছে যাই— সব ভুল ভেঙ্গে যায়,

দেখি— পড়ে আছে লাল ‘ভেলবেট পোকা’।

(রক্ত কুন্তল)

 

যতদূর চাই

          সরস সবুজ মাঠ;

তারি মাঝে চরে অলস পাটল গরু,

দাঁড়কাক তার পিঠে বসে আছে

              চিকন কালো।

(তিন রঙা ছবি)

 

যখন যেমন ঘটনা তিনি দেখতেন তাকেই কলমের শক্তিতে স্থায়ী আসন দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন নিশিকান্ত। শ্রাবণ পূর্ণিমার চাঁদকে দেখে তাঁর আকুল প্রশ্ন— ‘আকাশ ভরে জমে আছে / শ্রাবণ মাসের কাজল-কালো জল; / সেই জলেতেই বারেক ডুবে, / বারেক ভেসে উঠে / কোন রূপসী পঞ্চদশী / সাঁতার কাটে আজ।’ ( শ্রাবণ পূর্ণিমা )।

 

শান্তিনিকেতনের প্রতিমুহূর্তের জীবনকে ধরে রাখতেই যেন তাঁর কলম ধরা। এই ‘টুকরি’-গুলোতে কীভাবে তারা ধরা পড়েছে, সেটি একবার দেখতে চাই বিভিন্ন কবিতার পঙক্তি ধরে। যেমন— ‘মেসের ছেলেরা সকলেই ওকে ঠাট্টা করে’, ‘কলেজের ক্লাসে হয়েছিল দুটো কথা, / সে কথার শেষ গাজনতলায় / এঁদো পুকুরের পাড়ে’ ইত্যাদি। শান্তিনিকেতনের জীবন যাত্রার সঙ্গে নিশিকান্তের এই সতত সঞ্চরমাণ জীবনকে মেলানো খুবই কঠিন। আমার কেন জানি না মনে হয়, সে-ই হয়তো কবির মানসপুত্র পঞ্চক। যার কণ্ঠ বাঁধ ভাঙার গান গাইবার জন্য সর্বদা তৈরি। একবার বন্ধুকে নিয়ে সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে ঘোর বিপদে পড়েন নিশিকান্ত। সর্দারের হুকুম তাদের একটি মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু ভয় পাওয়ার ছেলে নয় নিশিকান্ত। বাইরের কাজ সেরে এসে বিয়ে করবেন বলে তিনি নেশাগ্রস্ত সর্দারকে ফাঁকি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন। বিয়ে না করলেও সেই পাত্রীর কথা চিন্তা করে বেরিয়ে এল একটি টুকরি—

 

“পরনে রঙিন গামছার মতো কাপড়খানি,

কপালে উল্কী আঁকা; কালো সুতো

বাঁধা রূপোর হাঁসুলি গলায় দোলে;

এক হাতে ওঁর আঁচলে ঝোলানো

আলুর পুঁটুলি; আর এক হাতে

কাঁকুড় শশায় সাজানো মাটির হাঁড়ি।

তারই থেকে দুটো লকলকে কচি পাতা

গুঁজে নিল তার কালো খোঁপাটির চুলে।”

(সাঁওতালী)

 

বাংলা সাহিত্যে এই টুকরিগুলো উচ্চ আসন লাভ না করলেও এর নতুনত্ব কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। যদিও রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় ‘চাঁদকবি’-র এই টুকরিগুলোকে সংশোধন করার দায়িত্ব নেন, তবু এই বিষয়টি নিশিকান্তকে কতটা খুশি করেছিল তা বলতে পারা মুস্কিল। আসলে নিরাভরণ এই টুকরিগুলোর প্রাণশক্তি তার রচনাকর্তার মতোই ছিল উচ্ছল উদ্দাম। সৃষ্টির এই স্বকীয় সংকেত ধরতে তাই গুরুদেবের দেরি হয়নি। তবে টুকরি সংশোধন নিয়ে শেষ বয়সে কবি কিছুটা অপরাধে ভুগতেন হয়তো! তাই বুদ্ধদেব বসুকে একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন তাঁর মতামত— “নিশিকান্তের লেখাগুলো আমি নির্দয় ভাবে সংশোধন করেছিলুম— একেবারেই ভালো করিনি। সেগুলি তার মূলের বিশুদ্ধ মূল্যেই রক্ষনীয়।” (২৮।০৩।৪০)

 

বাংলা কবিতার ইতিহাসে নিশিকান্ত এক আলাদা পথের দিশারি। তিনি তাঁর বর্ণসম্পদ নিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক ছবি এঁকে চলেন নিরবধি কাল।

 

 

তথ্যসূত্র

 

১। দেশ, রবীন্দ্রজন্ম শতবর্ষ সংখ্যা

২। ‘কবি নিশিকান্ত’— ডালিয়া সরকার

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june golpo

মৃণালিনী

কবির কলমে  |  ছো ট  গ ল্প  ২

মৃ ণা লি নী

সিসিটিভির ফুটেজ

জানালার কাচে সাদা কুয়াশা ঢলে পড়েছে। বেড-এর পাশে পর্দা সরিয়ে অনিরুদ্ধ একবার বাইরে তাকিয়ে নিল। আকাশে থরে থরে মেঘ সাজানো। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে শীতের প্রকোপ অনেকটা থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু এসময়ে বৃষ্টি! বিছানা ছাড়বার আগেই শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সাদা কাচ বেয়ে নেমে এলো প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার। প্রকৃতির মেজাজ এখন বোঝা মুস্কিল। আবহাওয়া দপ্তরের প্রতিবেদনে হয়তো এই বৃষ্টিপাত বিনা নির্ঘন্টে ঢুকে পড়েছে।

 

চোখ কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুমের পরিবর্তে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল অনিরুদ্ধ। হালকা ঠান্ডা ওয়েদার, তার ওপরে অসময়ে এই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাট বেশ আরামদায়ক। হাওয়ার সঙ্গে জলের গুঁড়ো চোখেমুখে লেপ্টে থাকে। হয়তো এর জন্য অনিরুদ্ধর প্রিয় ঋতু বর্ষা। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সরু প্যাসেজের দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে অনিরুদ্ধর হঠাৎ চোখ পড়ল সিসিটিভির স্ক্রিনের দিকে। দুটো ছায়া ঝাপটে আছে না! না। ছায়া দুটো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। জীবন্ত মানুষ যেন! হ্যাঁ, মানুষই তো। অনিরুদ্ধর চোখ আটকে গেল সিসিটিভি স্ক্রিনে। বঁড়শিতে বাঁধা মাছের মতো ছায়া দুটো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। একবার দূরে সরে যাচ্ছে আবার হঠাৎ লজ্জাবতী পাতার মতো গুটিয়ে যাচ্ছে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে দেখতে অনিরুদ্ধর চোখের আধমোড়া ঘুম ও বৃষ্টি হাওয়ার যৌথ সঙ্গমের দৃশ্য দেখবার ইচ্ছেটা যেন মুহূর্তে হারিয়ে গেল।

 

সিসিটিভির স্ক্রিনে পরিষ্কার করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ছায়ার মালিকদেরও নয়। শুধু তাদের ছায়াটুকুই ধরা পড়েছে সিসিটিভির ফুটেজে। তবে ছায়ার মালিক যে দুজন যুবক যুবতীর সেটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে অনিরুদ্ধর কাছে। একবার তারা হাত ধরে একে অপরের থেকে একটু দূরে সরে যাচ্ছে আবার চিলের মতো ঝাপটা দিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। হয়তো চুমু খাচ্ছে। ছায়ায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ঝড়বৃষ্টির জন্য ল্যাম্পপোস্টের আলোও যেন নিজেকে অন্ধকারে ঢেকে নিয়েছে। এক পায়ে দাঁড়িয়ে, এক চোখে নির্লজ্জের মতো এসব দৃশ্য না দেখাই ভালো। বেশি উত্তেজিত হলে তার চোখের ফেটে পড়বার সম্ভাবনা আছে। এ ভয়েই হয়তো নিজেকে গুটিয়ে তির্যক চোখে মুখোমুখি দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। হলুদ দেওয়ালের নীচে রঙচটা কালো ছোপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে ওই দুই যুবক যুবতীর ছায়া।

 

কয়েক বছর আগে বাড়ির চারপাশে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। চওড়া রাস্তায় বিশাল বাড়ির মেইন গেট। এছাড়াও সরু গলিতে গেট রাখা হয়েছে। পাশেই গ্যারেজ। গ্যারেজের শেডের নীচে এক ধারে দাঁড়িয়েই দিব্যি গল্প করছে দুজন। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় গ্যারেজের সামনের চাতালে এসে পড়েছে তাদের নির্লজ্জ ছায়াছবি। হলরুমের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট ঘরে ঢুকতেই মা দৌড়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিতে দিতে বলল, ‘কি দেখছিস এত মনোযোগ দিয়ে? চা খাবি তো?’

 

 মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছে। আমাকে ডেকে দিলেই পারতে।’

 

মায়ের কানে অমনোযোগী অভিযোগ পৌঁছনোর আগেই মা ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রান্নাঘর থেকে বাসনের আওয়াজ ভেসে এলো। অনিরুদ্ধ সিসিটিভি থেকে চোখ সরিয়ে টিভি চালিয়ে শোফার ওপর বসে পড়ল। নিউজ চ্যানেল উল্টে পাল্টে একই খবর। তবে খবরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে লকডাউন শুরু হচ্ছে। ঘনজনবসতিপূর্ণ এই দেশে এই ভাইরাস কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি করবে, অদূর ভবিষ্যৎ কী এবং ব্যক্তিগত সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির কথা ভাবতে ভাবতে বিমর্ষ মনে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল অনিরুদ্ধ।

 

দুদিন না পেরোতেই শুরু হয়ে গেল লকডাউন পিরিয়ড। সারাদিন বাড়িতে বসে, অফিসের কাজ ছাড়াও নিজের লেখালেখিতে ডুবে গেল সে। রান্নার মাসি এমনকি অতিথি বলতে কেউ ইদানীং আর বাড়িতে আসছে না। নিজের কাজের সঙ্গে অতিরিক্ত যোগ হল বাড়ির নিত্য ঘরোয়া কাজ। সিসিটিভি ফুটেজেও সারাদিনে দু একটি গাড়ি অথবা দু’একটা মানুষের যাতায়াত ছাড়া আর কিছু লক্ষ্য করা গেল না। কিন্তু সন্ধের পরে গ্যারেজের সামনের ছায়াদৃশ্যের কোনো বদল ঘটল না। সারাদিনের পর সিসিটিভির ফুটেজও যেন অনিরুদ্ধর সঙ্গে হাঁপিয়ে অপেক্ষা করে থাকত এই দৃশ্যের জন্য। প্রথম দিন অনিরুদ্ধ এহেন বেহায়াপনায় বিরক্ত হলেও এখন তার বেশ ভালোই লাগে। যেহেতু ঝড়বৃষ্টি নেই তাই ছবিটাও প্রথমদিনের তুলনায় এখন অনেক পরিষ্কার। সন্ধের পর দুজন এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গল্প করে। কখনও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। স্যানিটাইজার, মাস্ক সব দূরে সরিয়ে রেখে গভীর চুম্বনে দুজন দুজনকে জড়িয়ে রাখে শীতকালীন উষ্ণতায়। অনিরুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে নিজেই নিজেকে বলল, প্রেম সব পারে। অন্তত ভালোবাসার ভাইরাস করোনা ভাইরাসের চেয়ে কম সংক্রমণাত্মক নয়।

 

মার্চ এপ্রিল পেরিয়ে মে মাস গড়িয়ে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীন বিষণ্ণতার দীর্ঘশ্বাস ইদানীং নিউজ চ্যানেল ছাপিয়ে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে। আমফান ঝড় বাংলার মাথার ওপর থেকে ছাদ কেড়ে নিয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা পশুর মতো খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পোকামাকড়ের মতো রাস্তায় শ্মশানভূমি তৈরি করে নিয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডব করোনাকে ধুয়ে মুছে শেষ করতে পারেনি। বরং নতুন নতুন জায়গায় এসে সে থাবা বসিয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে হিমশীতল করবার জন্য তার জিহ্বা যেন আরও লকলক করছে। কে জানে এই মৃত্যু মিছিলের শেষ কোথায়।

 

এত সব ঘটে যাবার পরেও সিসিটিভির স্ক্রিনে রোজ সন্ধের পর সেই একই ছায়াদৃশ্যের অবতারণা! অনিরুদ্ধ মনে মনে ঠিক করল একদিন ওদের সামনে থেকে দেখতেই হবে। ছায়া শরীরদের রক্ত মাংসের জীবন্ত রূপ না দেখলেই নয়। একটা অদম্য তাগিদ খেলা করে বেড়াতে লাগল অনিরুদ্ধর মনের ভেতর। তার দৃষ্টিতে কালো দুটো ছায়ার মধ্যে ফুটে উঠল আদম আর ইভের ছবি। চারপাশের এত ভয়াবহতার মধ্যে এই দুজন কীভাবে এতটা নিরুত্তাপ, এতটা উদাসীন? এরা যেন এক অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা অথবা অন্য এক পৃথিবী রচনার আনন্দে মশগুল। একদিকে ধ্বংস অন্যদিকে সৃষ্টি। একটা অদ্ভুত আতঙ্কে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। যদি ধ্বংসের কালো ছায়া ওদের পৃথিবীতেও এসে পড়ে। ল্যাম্প পোস্টের হলদে আলোয় কালো দুটো ছায়া নড়েচড়ে বেড়াতে থাকে। একবার নিজেদের ভেতর গুটিয়ে দলা পাকিয়ে যায় আবার আলাদা হয়ে যায়। গাছের সরু ডালের মতো এখন তারা একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনিরুদ্ধর মনে ভেতর একটা স্বস্তিবোধ কাজ করতে থাকে।

 

 লকডাউন কবে উঠবে ঠিক নেই। এভাবেই কাটতে থাকে অনিরুদ্ধর দিন। সারাদিন অফিসের কাজ, লেখালিখি আর সন্ধের চায়ের সঙ্গে একপাশে টিভির নিউজ আর অন্যপাশে সিসিটিভির ফুটেজে আবছা দুই যুবকযুবতী ছায়া। একদিকে আক্রান্ত, ধ্বংস ও মৃত্যু আরেকদিকে আগামীর পরিকল্পনায় প্রত্যেক মুহূর্ত একে অপরকে ছুঁয়ে উপলব্ধির পরম পবিত্র দৃশ্য। অনিরুদ্ধের মনে হল, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এরা যেন জেহাদ ঘোষণা করছে, ‘আমরা বেঁচে থাকব। পরস্পরকে জড়িয়ে বেঁচে থাকবো আবহমান।’ ‘লকডাউন ইভিনিং শো’ নামে একটা গল্প লেখাও শুরু করল সে। না, সামনে গিয়ে ছায়া শরীরদের রক্ত মাংসের শরীর আর দেখা হয়ে ওঠেনি তার।

 

রোজকার এক দৃশ্য কয়েক মাসে একরকম অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল অনিরুদ্ধর। কিন্তু দেখতে দেখতে রোজকার সেই দৃশ্যেও যে একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছিল তা পারিপার্শ্বিকতার চাপে অনিরুদ্ধের চোখে পড়েনি। তাই তো! আগে তো সেভাবে খেয়াল করিনি ব্যাপারটা। কোথায় সেই জড়াজড়ি করে থাকা কালো দুটো ছবি… কখনও কখনও দলা পাকিয়ে যাচ্ছে আবার কখনও একটু সরে যাচ্ছে একে অপরের থেকে। দেখে মনে হচ্ছে কেমন একটা ঢিলেঢালা সোয়েটারের ভেতর দুজন একসঙ্গে ঢুকে পড়েছে। কই সেই ছায়াদের ঘন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। একটু অপেক্ষা করেই দেখা যাক না। অনিরুদ্ধ উৎসুক ভাবে তাকিয়ে থাকে সিসিটিভির স্ক্রিনের দিকে।

 

কয়েকদিন পর দেখা গেল দুটো ছায়া মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ছায়া দুটোর মধ্যে হাতের সেই ঘন বন্ধন নেই। তার দু-তিন দিন পর ছবি দু’টোর মধ্যে অনেকটা দূরত্ব লক্ষ্য করে অনিরুদ্ধের মন ছটফট করে উঠল। ওদের মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়নি তো? আগামীকাল থেকে লকডাউন উঠে যাচ্ছে। হয়তো এবার দিনের আলোতে দুজন দু’জনকে মন ভরে দেখবে কোনো পার্কে বা শহরের অন্য কোনো নিরিবিলি জায়গায়, আবার আগের মতো জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে… নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আগামীকাল থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিল অনিরুদ্ধ।

 

রাস্তায় লোকজন বের হলেও একটা থমথমে পরিবেশ। এতদিন পর সবাই বাইরে বেরিয়েছে। দমবন্ধের ছটফটানি থেকে প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে চাইছে, মাস্কের গায়ে ঝরে পড়ছে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির দীর্ঘশ্বাস। আজ বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেল অনিরুদ্ধর। একেবারে ডিনার সেরে নিজের ঘরে এসে সিসিটিভিটাকে রিওয়াইন্ড করে সন্ধের দিক থেকে চালিয়ে দিল সে। কিন্তু দুটি ছায়ার জায়গায় একটি ছায়া কেন? অনিরুদ্ধর চিনতে ভুল হল না এটা ওই যুবতীটিরই ছায়া। ছেলেটি তবে কোথায় গেল? ধক করে উঠল অনিরুদ্ধর বুকের ভেতরটা। মেয়েটি অপেক্ষা করছে। অনিরুদ্ধও অপেক্ষা করছে। প্রায় এক ঘন্টা পেরিয়ে গেল। দৃশ্যের কোন পরিবর্তন হল না।

 

লক ডাউন উঠে গিয়েছে পনেরো দিনেরও বেশি হয়ে গেল। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে মেয়েটির নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষার ছবির কোন পরিবর্তন হল না। মেয়েটিকে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দেখে অনিরুদ্ধের মনও কেমন ছটফট করে উঠল। একবার তার মনে হল, একটু পিছিয়ে দিয়ে তাদের যুগ্ম ইভিনিং শো-টা দেখবে কিন্তু সময়ের সঙ্গে পুরনো ছবি মুছে গিয়েছে। মহাকালের সিসিটিভিতে তা সেভ করা থাকলেও, অনিরুদ্ধের সিসিটিভিতে তার কোনো রেকর্ড নেই। সুতরাং সেই পুরনো দৃশ্যের আশায় আর নারী মূর্তির অসম্পূর্ণতার দৃশ্য বদলের প্রতীক্ষায় নেশাগ্রস্তের মতো সে সিসিটিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল দিনের পর দিন । অথচ রোজই অনিরুদ্ধের চোখের সামনে ভেসে ওঠতে লাগল একই দৃশ্য। চারিদিকে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতাকে উপেক্ষা করে রোজই মেয়েটি এসে দাঁড়িয়ে থাকে গ্যারেজের ছাউনির নীচে। তার ছায়া কখনো একা একা নড়েচড়ে বেড়ায় গ্যারেজের চাতালে।

 

আজ সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অনিরুদ্ধের মনে পড়ল এমনই এক বৃষ্টির দিনে হঠাৎ করেই সে সিসিটিভি ফুটেজে চোখ রেখে আটকে গেছিল দুটি ছায়ার মায়াজালে। আজ সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে এল অনিরুদ্ধ। চারপাশে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ, ল্যাম্প পোস্টের হলুদ আলোয় বৃষ্টির গুঁড়ো ঝরে পড়ছে অনবরত। আজও কি মেয়েটি এসে একা একা অপেক্ষা করে ফিরে যাবে? এমন সুন্দর বৃষ্টির দিনেও অনিরুদ্ধর মনে হল, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সিসিটিভি থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল অনিরুদ্ধ। বিছানায় যাবে, এমন সময় হঠাৎ   মনে হল সিসিটিভির স্ক্রিনে কি যেন নড়েচড়ে উঠল। মনে হল দুটো ছায়া গ্যারেজের সামনেটায় যেন আগের মতো জড়িয়ে দলা পাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শোফায় বসে পড়ল। দু’হাতে ভালো করে চোখ কচলিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল স্ক্রিন জুড়ে অন্ধকার। কারেন্ট চলে গিয়েছে। প্রচন্ড বজ্রপাতের সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটানি আরও কিছুটা বেড়ে গেল।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june kobita

কমলেশ কুমার

ক বি তা

ক ম লে শ   কু মা র

গোধূলিকাল

তোমার ওষ্ঠের দিকে তাকিয়ে থাকি নির্নিমেষ,

লক্ষ দুঃস্বপ্নের ভিতরে 

শেষ আনন্দমুহূর্তের প্রতিচ্ছবি জেগে থাকে ওখানে,

আমি পেরিয়ে এসেছি কত শূন্যতার দরজা,

ঝলসে ওঠা ব্যর্থ কান্না, আর নক্ষত্রসম দগদগে ক্ষত,

 

আমার দুপাশে জেগে থাকা হলুদ ঘাস, সাপের খোলস,

জীর্ণ ঝরাপাতাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে আজ নির্ঘুম হেঁটে যাচ্ছি 

নির্জন বিকেলের ম্লান আলোয়,

 

তোমার চিবুকের উপর এসে পড়া 

অপরাহ্নের দ্যুতি নিয়ে 

নিঃসঙ্গ পুণ্যার্থীর মতো

                  আমি পেরিয়ে যাচ্ছি

                           ভালবাসার অন্তিম সূর্যাস্ত-সাঁকো

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june kobita

নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়

ক বি তা

নি র্মা ল্য   মু খো পা ধ্যা য়

ও কে, ও কে গো

কে?

এইভাবে একটি স্বপ্নের শুরু হতে পারে

তা আমি কখনো ভাবিনি।

মশারির এককোণে মধ্যরাতে বসে আছে ও।

ও কে?ওই নীলডোরা, গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট,

কপালে এসেছে চুল,হাঁটু মুড়ে,ও কে?

ভয় পাই আমি। জল খাই।

এভাবে মুহূর্ত অদৃশ্য হয়।

ফিরে আসে, আবার বাজারে!

মাছের গন্ধ থেকে সরে গুদামের পাশে

অন্ধকার,চোখ জ্বলা,হাঁটু অবিকল, দেখি

আঙুলগুলিও মুড়ে গেছে তবু

কুঠো হাতে কী শীতল!

গৃহে ফিরে বসি!

এখন বর্ষাকাল, তবু ঘাম দরদর করে।

পাখার তিনটি ব্লেড,বসে আছে

বালক না বৃহৎ ঊরগ

কিচ্ছু বুঝিনা

চেয়ে থাকে, কেন, কী চায়!

এক ফোঁটা রক্ত পড়ে মুখে।

যে সন্তান মরে গেছে পূর্ববিবাহে,

ভাবি,কোন লোক থেকে

এ দূরত্ব ভেঙে এলো,

কিছুতেই কাঁধ থেকে নামবে না ;

হাসবে না, নিশ্চল

কুঠো ঠুঁটো রস

আঠালো হওয়ার আগে

এই অবৈধ দেহ আমাকে

প্রেতার্থে পুত্রার্থে

বারবার বারবার বারবার

ঘন ও খনন করবে ও।

 

এই অ-সহন

এই জন্মে আর আমার সংসার হল না।

হয়তো পরেরবার দেখা হবে তোমার সঙ্গেই।

এক আঁধার জঙ্গলে, কোনো ভাঙা মন্দির

হলুদ লতাপাতা,হয়তো প্রদীপ

আমি জ্বলে থাকব শিবের মতন।

সে যেন ইতিহাস, সে যেন শুকনো নদী,

তোমার নতুন স্বামীর সূর্য, দেখো বেঁচে থাকব মন

এই জন্মে আর আমার হল না কিছুই,

এই অ-সহন, হয়ত পরেরবার

এই ক্ষয়! থাকবে না! থাকবে না।

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_june goddyo

ভিনদেশে । পর্ব ২

ভি ন দে শে । পর্ব ২

সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার  কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে  আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।

ঈ শি তা  ভা দু ড়ী

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা

আমরা যত্র তত্র এদেশ সেদেশ বেড়িয়ে বেড়াই, ভালই লাগে। লোকজন বলে, ‘একা একা বেড়াও, কোনো অসুবিধে হয় না?’ অসুবিধে আবার কি! দিব্যি তো বেড়াই! তবে স্বীকার না করে উপায় নেই, ক্রমশ স্মার্টনেসটা কমছে আমাদের। নানা রকম ওলট-পালট কাজ করে ফেলছি আমরা। যেমন বেজিং-এ গিয়ে প্রথমদিন সকালে ইয়ুথহস্টেল থেকে বেড়াতে বার হওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে আমরা নিজেকে বেজিং-এ বেড়ানোর উপযুক্ত করে নিতে ভুলে গেলাম। অর্থাৎ কাছের বাস-স্টপটির নাম বা হস্টেলের ঠিকানাটি চৈনিক হরফে লিখিয়ে সঙ্গে নিতে ভুলে গেলাম।

 

সারাদিন মনের আনন্দে বেড়িয়ে বেড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল। এবার ডেরায় ফিরতে হবে, আমরা একটা বাসে উঠলাম, বাস-নম্বরটি হস্টেলের স্টপেজ থেকে বুদ্ধি করে দেখে নিয়েছিল সোমা। তখন তো আর জানি না শুধু নম্বর দেখে বাসে উঠে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না বেজিং-এ। সেখানে রাস্তাগুলো রিং রোড কন্সেপ্টে, একই রাস্তা দিয়ে আপ এবং ডাউনের বাস যায় না। অতএব সঠিক নম্বরের বাসে উঠেও আমরা গোল গোল হয়ে ঘুরতে থাকলাম। যদিও বাসে উঠেই কন্ডাক্টরকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু সেই চৈনিক মহিলা কি বুঝে কি বলল আমাদের সেটা অবশ্য বুঝি নি আমরা। শেষমেষ আমাদের বারংবার প্রশ্নে আমাদেরকে কোনো একটি বিরাট চৌমাথায় নামিয়ে দিয়ে বাস উধাও।

সে রাস্তা কোন রাস্তা জানি না তখন আমরা, সেখান থেকে গন্তব্যস্থল কত দূরে তাও জানা নেই আমাদের। চোখ চেয়ে দেখি সিগারেট- কোল্ড ড্রিঙ্ক্‌সের একটি ছোট্ট দোকান আর বড় বড় দু-চারটে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই চারপাশে। সেই ছোট্ট দোকানের দোকানী কিছুই বলতে পারলো না, রাস্তার লোকজন তো প্রশ্নটাই বুঝতে পারলো না। চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একে ওকে প্রশ্ন করে সদুত্তর না পেয়ে অত্যন্ত হতাশ সোমা আমাকে বলল ‘ব্যাপারটা কিন্তু খুবই সিরিয়স’। আমি কি বুঝছি না সেটা! আমিও তো বুঝছি। কিন্তু উপায় কি!

 

হঠাৎ সাইকেল নিয়ে এক তরুণ ও তরুণী হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, মনে হল এরা কোনো সাহায্য করতে পারবে। ছুটে ছুটে তাদের গিয়ে ধরলাম। তারা কিন্তু যথার্থই চেষ্টা করল অনেক, ইয়ুথ হস্টেলে কথাও বলল নিজেদের মোবাইল থেকে। কিন্তু জানি না কেন তবুও কোনো সুরাহা হল না। নিজেদের ভাষায় তারা কি কথা বলল জানি না, কিন্তু তাদের চোখে-মুখে খুব সংশয়। ক্রমশ ভিড় জমে গেল। রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল, প্রকান্ড চওড়া রাস্তায় গুটি কয়েক মানুষ এবং তারা আমাদেরকে ঘিরেই, অথচ আমাদের উদ্ধার হওয়ার কোনোই লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ক্রমশ ভিড় বাড়তে থাকছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তারা কোনো সুরাহা না করতে পারায় শেষমেষ তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে তাদের থেকে বিদায় নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখলাম না। ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলাম, তারা হয়তো একটু অবাকই হল। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় থেকে আমার হাঁফ ধরে গিয়েছিল। সোমা তো অনেকক্ষণ থেকেই বলছিল, এখানে দাঁড়িয়ে কিস্‌সু হবে না। আমিই নেহাৎ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

 

আস্তে আস্তে ভিড়ের মানুষ চলে গেল, পুরো জনমানবশূন্য, গা ছমছম করতে লাগলো। হঠাৎ দেখি খুব আধুনিক পোশাক পরে একটি স্মার্ট তরুণী হেঁটে আসছে। তার কাছে আমাদের বিপদের গল্প বলায় সে খুবই চিন্তিত হল, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, সে জায়গাটি জানে না বলে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারছে না এবং সেজন্যে সে খুবই দুঃখিত, তবে আমরা চাইলে সে আমাদের একটা ট্যাক্সিতে চড়িয়ে দিতে পারে। আমরা খুবই আহ্লাদিত হলাম। এরকম চেষ্টা আগের মানুষজন যে করে নি তা নয়, আরেকবার দেখা যাক।

 

এবারেও ব্যাপারটি অত সহজ হল না, ট্যাক্সি-ড্রাইভার এসে পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন এমন সব প্রশ্ন করতে থাকলো যে আমরা আবার দিশেহারা হয়ে পড়লাম, ওই মেয়েটিও। শেষমেষ সম্বিত ফিরে পেলাম, বললাম যে কোনো একটি আন্ডারগ্রাউন্ড (ট্রেন) স্টেশনে আমাদেরকে নামিয়ে দিতে। ড্রাইভার রাজি হয়ে গেল, তার পক্ষে এটি অনেক সহজ কাজ, আমাদের পক্ষেও সুবিধে স্টেশনে গিয়ে বুঝে শুনে ট্রেন ধরে ইয়ুথ-হস্টেলে চলে যাওয়া। মেয়েটিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কেন যে এই বুদ্ধিটি এতক্ষণ আসে নি !

 

হস্টেলে ফিরে নাক-কান মললাম। এরপর চিনে যতদিন ছিলাম চৈনিক হরফে লেখা ঠিকানা না নিয়ে এক পা-ও বার হই নি আমরা ঘর থেকে।

আরও পড়ুন...