Categories
2020_pujo goddyo

অমৃতা ভট্টাচার্য

আ মা র  পু জো

বাঙালির তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ দুর্গা পুজো। তো এই পুজো নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা? পুজো তাঁদের কাছে কীভাবে ধরা দেয় অথবা পুজোর ভেতর তাঁরা ধরা পড়েন কীভাবে... কলম ধরলেন

অ মৃ তা   ভ ট্টা চা র্য

নুনশিউলি

“নুনশিউলি… নুনশিউলি… পনের টাকায় একশো… আট টাকায় পঞ্চাশ…” আশ্বিনের সকালে ঘুম ভাঙত এই আওয়াজে। ঘুমের ঘোরেই জানতাম আরশাদ কাকুর গলা। নুনশিউলি আসলে অবিকল শিউলি ফুলের মতো দেখতে এক রকমের কুড়মুড়ে মুখরোচক খাবার। একটু নোনতা, আবার একটু মিষ্টি। ডাল দিয়ে বানানো খাবারটা বেশিদিন টাটকা রাখা যেত না। তাই দু-তিনদিন ছাড়াই আরশাদ কাকু বাড়ির গলি পেরিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে নুনশিউলি নিয়ে হেঁকে যেতেন। দু’চারজনের ভিড় জমলেই মাথা থেকে যত্নে বেতের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে দিতেন শিবমন্দিরের চাতালে। পলিথিন কাগজে মোড়া ছোট ছোট নুনশিউলি আর তার চারপাশে ঝুড়ির কানা ঘেঁষে গোল করে সাজানো টাটকা শিউলি ফুল। প্রতিবার আমার বরাদ্দ ছিল পঞ্চাশ গ্রাম। একটা খেলনা দাঁড়িপাল্লার মত ছোট পিতলের দাঁড়িপাল্লায় হিসেব করে ঠোঙায় ভরে তারপর আরও দু’চারটে ফাউ। শেষে উপরে দু’চারটে শিউলি ফুল ছড়িয়ে তবে ঠোঙাটা আমার হাতে দিতেন কাকু। দেবার সময় হেসে বলতেন, “এটা পুজোর প্রসাদ”। টাকা মেটানোর পর প্রতিবার মা আমার হাত থেকে ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে নিয়ম করে সব ফুলগুলো বেছে বেছে ফেলে দিতেন। আমি কিন্তু খাওয়ার সময় প্রতিবার ফুলের গন্ধ পেতাম। বেশ কয়েকবার কয়েকটা পাপড়ি চিবিয়েও ফেলেছিলাম। আলাদা কিছু মনে হয়নি। শুধু একটু কষা! আশ্বিনের সকালেই আরশাদ কাকু নুনশিউলি নিয়ে আসতেন নিয়ম করে। তাই নুনশিউলি মানেই তখন পুজো শুরু।

দুর্গাপুজো নিয়ে সবার উত্তেজনার কারণ আমার অল্প অল্প বোধগম্য হতে শুরু হয়েছে অনেক পরে। পুজো বলতে আমার কাছে একদিন বা বড়জোর দু’দিন নতুন জামাকাপড় পরে ভিড়ের মাঝে প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেলে ঘোরা। বাকি সব বাচ্চাদের কাছেও হয়ত পুজো একইরকম। মজার ব্যাপার হল পুজোর অনুভূতিটা আজও আমার কাছে খুব বেশি বদলায়নি। আমার কাছে ছোট থেকেই দেবী দুর্গা একটা বেশ সুন্দর দেখার জিনিস। সুন্দর মূর্তি, সুন্দর আলো… সব কিছুই সুন্দর সুন্দর। বড় বড় প্যান্ডেলের মধ্যে বড় বড় মূর্তি খুব সুন্দর করে সাজানো আর প্রচুর লোকের ভিড়। বাবা-মার হাত ধরে এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মূর্তিগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। প্যান্ডেলের মধ্যে অদ্ভুত নরম আলো আর অসংখ্য কারুকার্যে ঝলমল করা সন্ধেগুলো নেশার মত মনে হত প্রতিবার। ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফিরে কাদা হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। প্রায় প্রতি বছরই অষ্টমী কিংবা নবমীতে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। দশমী মানে বিসর্জন শুনে এসেছি বরাবর। আমার কাছে অবশ্য আবাহন বা বিসর্জন সবই ওই এক বা দু’দিনেই। যেদিন ঠাকুর দেখতে যাবো সেদিনই দুর্গাপুজো। সকাল থেকেই বেশ একটা অন্যরকম ব্যাপার। সুন্দর সুন্দর প্যান্ডেল, ঝলমলে সন্ধে, রাতে রাস্তায় ভিড়… কত মানুষ ! আলাদা করে ষষ্ঠীর বোধন বা দশমীর বিসর্জন কিছুই দাগ ফেলত না। আজও তাই।

ছোটবেলায় মনে হত ঠাকুর দু’রকমের হয়। একরকম ঠাকুরকে পুজো করা হয় আর একরকম ঠাকুরকে দেখতে হয়। পুজো করতে হয় যে ঠাকুরকে, সেই ঠাকুর আবার মূর্তি নয়। কারণ বাড়িতে মূর্তিপুজোর চল নেই। পূর্বপুরুষ নিষিদ্ধ করে গেছেন মূর্তিপুজো। ছোট থেকে দেখে আসছি বাড়ির তিনটে মন্দির। কালীমন্দিরে তামার ঘট। শিবমন্দিরে পাথরের শিবলিঙ্গ আর মহাপ্রভুর মন্দিরে তুলসীগাছ। যে ঠাকুরকে পুজো করতে হয় সেই ঠাকুরের আবার মানুষের মত চোখ, নাক, কান, হাত, পা থাকে, এটা কখনো মাথাতেই আসেনি। বন্ধুদের বাড়িতে সরস্বতী মূর্তি আসত। আমার বাড়িতে একটা তামার ঘটে আমশাখা। সুন্দর আলপনা এঁকে ঘট রাখা হতো। ঘটের সামনে বিস্তর বই, হারমোনিয়াম, গান-এর যাবতীয় সরঞ্জাম। সরস্বতী পুজোর সকাল থেকে তাই স্কুলে যাওয়ার তাগাদা বেশি ছিল। কি সুন্দর টানা টানা চোখ, সুন্দর শাড়ি পরা একটা ছোটখাটো মূর্তিকে পুজো করতো স্কুলে। আমিও বসতাম সবার সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দিতে। সেই আমার পুষ্পাঞ্জলির একমাত্র অভিজ্ঞতা। বাড়ির আশেপাশে দুর্গা ঠাকুর বলতে বেশ খানিক দূরে জমিদার বাড়ির পুজো আর রায় বাড়ির পুজো। কিংবা আরও খানিকটা দূরে বাসস্ট্যান্ডে বাজারের পুজো। কোনও পুজোর শব্দই আমার কানে এসে পৌঁছত না। ষষ্ঠীর দিনটা আমার কাছে বিশেষ ছিল কারণ প্রতিবছর মামাদাদু ষষ্ঠীতে আমাদের বাড়িতে আসতেন। হই হই ব্যাপার ! নতুন জামা, মিষ্টি। মাকে সারাদিনই দেখে মনে হত উৎসব লেগেছে। যে চারদিন দাদু আমাদের বাড়িতে থাকতেন মা’র মুখটা জ্বলজ্বল করত। আমারও তাই যাবতীয় দুষ্টুমির সাতখুন মাফ। আমার কাছে সেটাই পুজোর আনন্দ। দাদু মারা যাওয়ার পর ষষ্ঠীর দিন থেকে পুজো শুরু হয়না আর।  

আমার কাছে দেবী দুর্গা একটা অদ্ভুত ভাললাগার গল্প, এক পছন্দের প্রতীকী। প্যান্ডেলে ঢুকে আজও প্রণাম করতে পারিনা। কারণ কোনদিনই ওই প্যান্ডেলের দুর্গা আমার ঈশ্বর  হননি। যেমন ঈশ্বর হননি প্যান্ডেল বা মন্দিরের সরস্বতী, কালী, গণেশ, কার্তিক বা ফটোতে জটাধারী শিব। আমার কাছে ঈশ্বর কখনো মূর্তি হয়ে আসেননি। না, আমি নাস্তিক নই একেবারেই। শিবলিঙ্গের পুজো আমার বেশ পছন্দের। শিবের গল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা ধারণা বা দর্শন আমাকে বারবার টানে। যেমন টানে কালী বা দুর্গার সঙ্গে আটকে থাকা ধারণা আর দর্শন। কিন্তু আমার গল্প ওই ধারণাতেই শুরু আর শেষ। বড় হবার পর দেবীমূর্তি দেখে মনে হয়েছে মূর্তির গঠন এক অদ্ভুত ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু পুজো করার কথা মনে হয়নি তখনো। এখনও একবারও মনে হয় না যে আশ্বিনের কোন এক আগমনীতে সমস্ত অশুভ নাশ হবে। তেমনই কোন বিসর্জনের বাজনায় মন কাঁদেনা আমার। 

তবে দুর্গাপুজো আমার কাছে এরকমই কিছু কারণে বিশেষ হয়ে থেকেছে। পঞ্চমীর সকালে আমার হাত দিয়ে মা গরিব বাচ্চাদের নতুন জামা দিতেন। এখন নিজের হাতেই দেন। কারণ, পঞ্চমীতে আমি বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারিনা। বাকি তিনদিন আমার হাতে শুধু  বিভূতিভূষণ… জানিনা কেন পুজোর কয়েকটা দিন বিভূতিভূষণ ছাড়া আর কিছু মনে আসেনা আজও। আর অষ্টমীর দিনে বাবার আনা মাটির ভাঁড়ে ক্ষীর।

আরশাদ কাকু মুম্বাইতে ছেলের কাছে চলে গেছেন অনেক বছর হল। নুনশিউলির স্বাদটা এখন আর বর্ণনা করার মত করে মনে করতে পারিনা। তবে জিভে টাটকা স্মৃতি লেগে আছে। আশ্বিনের কোনও এক সকালে হঠাৎ ঘুম ভাঙে। মনে হয় কে যেন হেঁকে গেল “নুনশিউলি… নুনশিউলি… পনের টাকায় একশো…” কে জানে এতদিনে নিশ্চয়ই দামটা একটু বাড়াত আরশাদ কাকু! মুম্বাইতে কোন এক গলিতে এই আশ্বিনের সকালে কি কেউ অপেক্ষায় থাকে নুনশিউলির? মুম্বাইতে সেই গলিতে শিউলি ফোটে নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই তারা বোঝে আরশাদ কাকুর নুনশিউলি নামকরণের মাহাত্ম্য! হঠাৎ সকালে ঘুম ভাঙলে ওই রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়াই বারান্দায়। গলির রাস্তায় হাওয়ায় নাকে এসে লাগে শিউলির গন্ধ! ওপরের আকাশটাকেও কি নরম মনে হয় এই ক’দিন! আহা… বছর বছর দুগগা আসুক… বড় ভাল দুগগাঠাকুর…

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo goddyo

রবিউল ইসলাম

বি শে ষ  র চ না

র বি উ ল   ই স লা ম

বিষয়: শারদীয়া সংখ্যা

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর সবচেয়ে বড় পার্বণটি হল দুর্গোৎসব। দুর্গোৎসবকে ঘিরে বাঙালির উন্মাদনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছোয় যে সমাজের প্রতিটি স্তর এই উৎসবে প্রভাবিত হয়। সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। শারদীয়া সংখ্যার ব্যাপকতা দেখে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পূজা সংখ্যা’ প্রবন্ধে বলেছেন—

 “সাম্প্রতিককালে শারদীয়া পূজা উপলক্ষ্য করিয়া আমাদের মাসিক ও দৈনিক পত্রিকাগুলির সম্পাদকমণ্ডলী যে পূজা সংখ্যারূপে এক নূতন সংক্রামক প্রথার প্রবর্তন করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের মনন-জীবনে যে প্রতিক্রিয়া আসিয়াছে, তাহা মোটেই বহিরঙ্গ বলিয়া উপেক্ষিত নহে।”

(সন্দীপ কুমার দাঁ, ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’)

বাংলা সাহিত্যচর্চা সবচেয়ে বেশি হয় পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। সারাবছর পত্রপত্রিকাগুলি দৈনিক থেকে শুরু করে দ্বি-মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বাৎসরিক ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হলেও দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ পত্রপত্রিকা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে এবং এই সংখ্যাগুলি ঘিরে সাহিত্যপ্রেমীদের মনে যথেষ্ট উৎসাহ থাকে। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিশেষ সংখ্যা অর্থাৎ শারদীয়া সংখ্যা বা পুজো সংখ্যা প্রকাশিত হয় সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। 

শারদীয়া সংখ্যা  নিয়ে যে প্রশ্নটি সবার মনে প্রথমে আসে সেটি হল, শারদীয়া সংখ্যার সূত্রপাত কবে থেকে এবং কোন পত্রিকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। প্রাবন্ধিক ও গবেষকদের অনুমান অনুযায়ী ১২৮০ বঙ্গাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের ‘সুলভ সমাচার’-এর একটি সংখ্যাকে আমরা প্রথম শারদীয়া সংখ্যা বলতে পারি। এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১০ই আশ্বিন। এই বিশেষ সংস্করণটির দাম ছিল এক পয়সা। এ প্রসঙ্গে ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’ প্রবন্ধে সন্দীপ কুমার দাঁ জানিয়েছেন—

“…কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সংস্কার সভা’ তাদের তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার একটি সংস্করণ ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রকাশ করেছিল ১২৮০ বঙ্গাব্দের পুজোর সময়। অবশ্য পুজো সংখ্যা বলে এতে কোনও উল্লেখ ছিল না, কারণ সম্পাদক কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাহ্ম— স্বভাবতই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি।”

(সন্দীপ কুমার দাঁ, ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’)

‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার বিশেষ সংস্করণটি যেমন প্রথম শারদীয়া সংখ্যা, তেমনই এই বিশেষ সংখ্যার বিজ্ঞাপনটি হল প্রথম শারদীয়া সংখ্যার বিজ্ঞাপন—

“ছুটির সুলভ!!

আগামী ছুটি উপলক্ষে সুলভের বিশেষ একখণ্ড বাহির হইবে!

উত্তম কাগজ, উত্তম ছাপা। দাম কিন্তু এক পয়সা।

মজা করে পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও। একটা পয়সা দিয়ে সকলের কিনিতেই হইবে। দেখ 

যেন কেউ ফাঁকি পোড়ো না।”

(সন্দীপ কুমার দাঁ, ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’)

এরপর আমাদের বেশ কিছুটা সময় অর্থাৎ ১৩২০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় প্রথম পূর্ণাঙ্গ শারদীয়া সংখ্যা পেতে। ১৩২০ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা তাদের পুজো সংখ্যা প্রকাশ করে। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এই পুজো সংখ্যাটিতে তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা সাহিত্যিক সত্যেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বিপিনবিহারী দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, নিরূপমা দেবী প্রমুখ লিখেছেন। এখন প্রশ্ন হল, ১২৮০ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩২০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত কি দুর্গাপুজোকে নিয়ে কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি? ‘সুলভ সমাচারে’র পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ শারদীয়া সংখ্যা বাঙালির হাতে পেতে ৪০ বছর সময় লাগলেও, এই সময়ের মধ্যে বলা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশের পূর্ব প্রস্তুতি চলছিল। এই সময়পর্বে (১২৮০-১৩২০ বঙ্গাব্দ) কোনো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ না হলেও দেবী দুর্গাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, মনোমোহন বসু সম্পাদিত ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় ‘দুর্গাবন্দনা’ ও ‘দুর্গোৎসব’ নামক কবিতা প্রকাশিত হয়। এছাড়া ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকাতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে পুজোর পদ্য প্রকাশিত হত। এরপর ১৩২২ বঙ্গাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকার পুজো সংখ্যা ‘সচিত্র শারদীয় সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়। এই শারদীয়া সংখ্যাটিতে রঙিন ছবি, কবিতা আর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। আলোচ্য পত্রিকাটিতে দুর্গাপুজো সম্পর্কিত কবিতা— ললিতচন্দ্র মিত্রের ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’, বিপিনচন্দ্র পালের প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালীর প্রতিমা-পূজা ও দুর্গোৎসব’, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রীশ্রীদুর্গোৎসব’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধ ‘দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা’ ছাড়াও ভবানীচরণ লাহার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। 

 ১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটি প্রকাশিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ গল্পের মধ্যে পড়ে। এই কারণে ১৩২৯ সালের ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ।  ১৩৩২ সনে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের সম্পাদনায় ‘বসুমতী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ‘বসুমতী’র এই সংখ্যাতেই প্রথম শারদ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকার পুজো সংখ্যাতে রবীন্দ্রনাথের ‘পরিত্রাণ’ নাটকটিও প্রকাশিত হয়। এবার আসা যাক ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রসঙ্গে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতী’ পত্রিকার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শারদীয়া সংখ্যা ১৩৩৩ সনে প্রকাশিত হয়। ‘ভারতী’র পুজো সংখ্যার দাম ধার্য করা হয়েছিল এক টাকা। ‘ভারতী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘ষোড়শী’। এর নাট্যরূপ দেন শিবরাম চক্রবর্তী। এই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতী’ কবিতাটিও প্রকাশিত হয়। 

এবার আসা যাক বাণিজ্যিক পত্রিকা আনন্দবাজার প্রসঙ্গে। আনন্দবাজার পত্রিকা প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে ১৯২৬ সালে। আনন্দবাজার পত্রিকায় অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক লিখতেন। আনন্দবাজার পুজো সংখ্যায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, বিধুশেখর শাস্ত্রী, অন্নদাশঙ্কর রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সজনীকান্ত দাশ প্রমুখ লিখতেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম শারদীয়া উপন্যাস প্রকাশিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের এই সংখ্যাতেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রবিবার’ গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। আনন্দবাজার পুজো সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ (১৩৪৭) ও ‘প্রগতিসংহার’ (১৩৪৮) গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। আনন্দবাজার গ্রুপেরই পত্রিকা ‘দেশ’ তার প্রথম পুজো সংখ্যা প্রকাশ করে ১৩৪১ সনে। এই পত্রিকাতে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় আরো কয়েক বছর পরে অর্থাৎ ১৩৫৬ সনে। দেশ পত্রিকার প্রথম শারদীয়া উপন্যাস হল সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’। আনন্দবাজার গ্রুপের ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। ২০০৪ সালে আনন্দমেলা পত্রিকা দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি ‘আনন্দমেলা’ এবং অল্প বয়সি তরুণ-তরুণীদের জন্য প্রকাশিত হয় ‘উনিশ কুড়ি’। যদিও ‘উনিশ কুড়ি’র মুদ্রিত সংস্করণ এখন আর প্রকাশিত হয় না। বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকার সমস্ত পত্রিকাই শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে।

বাণিজ্যিক পত্রিকার মধ্যে বর্তমানে প্রতিটি সংবাদপত্র দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে গল্প-উপন্যাস ও কবিতার পসরা সাজিয়ে পাঠকের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। এই পত্রিকাগুলির মধ্যে আজকাল, স্টেটসম্যান, প্রতিদিন, বর্তমান, এই সময়, উৎসব, শুকতারা, নবকল্লোল, ফেস্টিভ্যাল টাইমস,  প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। 

বাণিজ্যিক পত্রিকার আলোচনা প্রসঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন এসেই যায়। বাণিজ্যিক পত্রিকার মতোই লিটল ম্যাগাজিনও দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে কতগুলি লিটল ম্যাগাজিন শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে সেই তথ্য আমাদের হাতে নেই। এ নিয়ে বিস্তারিত কাজ করার অবকাশ থেকে গেছে। তবুও আমরা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের নাম করতে পারি যারা খুব ভালো শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করত বা এখনও করে থাকে। যেমন নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘এক্ষণ’, আসানসোল থেকে প্রকাশিত ‘কোলফিল্ড টাইমস’, আন্দামান থেকে ‘দ্বীপবাণী’, ‘অনুষ্টুপ’ প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিন উল্লেখ করার মতো শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে।

শুধুমাত্র সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত পত্রপত্রিকাই শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আকাশবাণী’র ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা, সিনেমা সংক্রান্ত পত্রিকা ‘উলটোরথ’ ও ‘প্রসাদ’-এর নাম করা যায়। বলা বাহুল্য যে ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় মহাশ্বেতা দেবীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাজার চুরাশীর মা’ প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনও শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে। যেমন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পত্রিকা ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার শারদ সংখ্যা, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের ‘তত্ত্বমসি’ শারদ সংখ্যা, আদ্যাপীঠ মন্দির থেকে প্রকাশিত ‘মাতৃপূজা’ প্রভৃতি পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাগুলি উল্লেখযোগ্য।

পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে দুর্গোৎসবে পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা বাঙালির জীবনে কতখানি জুড়ে রয়েছে। তাই বর্তমানে প্রিন্ট থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাদের শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করছে। ব্লগজিন, ওয়েবজিন ও অনেক পত্রিকা তাদের ওয়েব সাইটে পুজো সংখ্যা এই মহামারীতেও পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে শারদীয়া সংখ্যার প্রকাশ মাধ্যমও পরিবর্তনের দিকে পা বাড়িয়েছে। মাধ্যম যাই হোক না কেন, লাভ বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যপ্রেমী পাঠকেরই।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo goddyo Uncategorized

সুদীপ্তা রায়চৌধুরী মুখার্জী

আ মা র  পু জো

বাঙালির তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ দুর্গা পুজো। তো এই পুজো নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা? পুজো তাঁদের কাছে কীভাবে ধরা দেয় অথবা পুজোর ভেতর তাঁরা ধরা পড়েন কীভাবে... কলম ধরলেন

সু দী প্তা   রা য় চৌ ধু রী   মু খা র্জী

দুর্গা পূজা: কার্নিভাল

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের ম‍ধ্যে দুর্গাপূজা শ্রেষ্ঠ পার্বণ। ঐতিহ্যে-অলঙ্কারে-সমারোহ-প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্যে যে অনুষ্ঠান আজ কার্নিভালের রূপ নিয়েছে। দর্শন-পৌরাণিক কাহিনি-আনুষ্ঠানিকতা এই তিনের মেলবন্ধনই ধর্ম । বাঙালি সেই সঙ্গে আন্তরিকতার মিশেলে ধর্মকে উৎসব থেকে ঐতিহ্যের কার্নিভালে পরিণত করেছে। যেখানে ধর্মীয় অনুশাসনের থেকেও সামাজিক, পারিবারিক, স্নেহবিধুর মরমী আবহের সার্বিক চিত্র পরিলক্ষিত হয় । উমা এখানে পূজিত হন কন‍্যা ভাবে। তাই তো বাংলার ঘরে ঘরে গান বাজে ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী উমা নাকি বড় কেঁদেছে’ – বাঙালি মায়ের চিরন্তন আকুতি ।

জগজ্জননীকে এইভাবে ঘরের কন্যা করে গড়ে তোলার রীতি ভারতের আর কোনো প্রদেশে বড় একটা দেখা যায় না । অধ‍্যাত্মবাদের সঙ্গে নিত্যযাপনের মিশেলের অন্য নাম বাঙালিয়ানা। 

আগমনী গানে বাংলার প্রকৃতি প্রতিফলিত হয় । কাশফুলের মায়া , শিউলির গন্ধ , প্রভাতী শিশির , নীলকন্ঠ পাখির ডাকে মুখরিত বাংলার গ্রামের শরৎ সজ্জা । সুজলাং-সুফলাং-শস‍্যশ‍্যামলাং ধরণী যেন তার সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ উজাড় করে অপেক্ষা করে দেবী আবাহনের । পূজার উপচারেও বাংলার প্রকৃতির উজ্বল উপস্থিতি । নবপত্রিকা অর্থাৎ বাংলার ফসল – ধান, যব, কচু , মানকচু, বেল, অশোক , হলুদ , কলা, ডালিম । যা কলা বউ নামে পরিচিত । এই কলা বউকে আবার গণেশের বউ ভাবা হয় । এও বাংলার সংস্কৃতি । একাত্ম হবার সংস্কৃতি ।

দেবী মন্ত্রে আছে ‘স বাহনায় স পরিবারায়’-এর উল্লেখ , যা কি না রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত ‘বাংলার ঘরে যত ভাইবোন’-এর মূর্ত প্রতীক । কার্তিক হচ্ছেন দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান , যিনি বৈদিক দেবতা নন , পৌরাণিক মতে ইনি দেব সেনাপতি । ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইনি পূজিত হন মুরুগান-স্কন্দ-সেন্থিল নামে । কিন্তু বাংলায় ইনি পুরুষের সৌন্দর্য পুত্র সন্তানের দ‍্যোতক । কার্তিক মাসে ইনি পূজিত হন আর কথিত আছে ছড়ার আকারে ‘কার্তিক ঠাকুর হ‍্যাংলা একবার আসে মায়ের সাথে একবার আসে একলা’। এরপর আসি গণেশের কথায়। ইনি সমৃদ্ধির প্রতিভূ । সর্বপ্রকার সাফল্য এঁর নখদর্পণে । ইনি গজানন, গণপতি প্রভৃতি নামে পরিচিত । বাংলায় তিনি Chubby শিশুর প্রতীক । ‘গনেশ দাদা পেটটি নাদা , লুচি খায় গাদাগাদা’ এই ছড়াতেই তিনি আবদ্ধ । আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও বাংলায় এঁর আলাদা পূজার প্রচলন ছিল না । ইনিও পৌরাণিক দেবতা । এঁর মূর্তি শুধু পূজা নয় , সৌন্দর্য্যায়নেও ব‍্যবহৃত হয় । দেবীর অপর পাশে থাকেন লক্ষ্মী । যিনি অর্থ-সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি-সৌন্দর্য‍ের প্রতীক । তিনি ধনলক্ষ্মী, তিনিই ধান‍্যলক্ষ্মী । কোজাগরী পূর্ণিমায় ইনি শুধু বাংলার ঘরে ঘরে পূজিতা হন । অথচ সারা ভারতে এঁর অসংখ্য মন্দির আছে । ধৃতি , কমলা , আরনা , নন্ধিকা নামে ইনি সমাদৃতা । দেবী সরস্বতী বিদ‍্যা-চারুকলা-সঙ্গীত-শিল্পকলার উপমা । তিনি বীণাবাদিনী । তিনি বসন্ত পঞ্চমীতে পূজিতা হন । ইনি বৈদিক দেবী । সরস্বতী নদীর ইনিই উৎস । বাংলায় ইনি সর্বগুণাসম্পন্নার উদাহরণ । বাংলার প্রতিটি বধূই রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী । আর দেবী সাক্ষাৎ জগজ্জননী মা । তিনি কখনো গিরিরাজের কন‍্যা , আবার কখনও শিবের ঘরণী । মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে তিনি আদ‍্যাশক্তি মহামায়া শ্রীশ্রীচণ্ডী । তিনি বাংলার নারীদের চেনা রূপ । দশপ্রহরণধারিণী দশ হাতে সংসারকেও ধারণ করেন । বাংলার পূজা ঘিরে পারিবারিক মিলনের যে চিত্র ফুটে উঠে তা বাঙালির একান্ত যাপনের এক পূর্ণ চিত্র ।

বাংলার খাদ‍্যাভাসের আভাসও পাওয়া যায় দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগে । শোভাবাজার রাজবাড়ি-সহ অনেক সাবেকি পূজায় আলুর ব‍্যবহার হয় না । কারণ তা বাংলায় উদ্ভূত নয় । কোথাও নিরামিষ , কোথাও চারদিনই আমিষ খাদ্য থাকে । লুচি , পরমান্ন , মোহনভোগ , নাড়ু থেকে শুরু করে ছোলার ডাল , বেগুন ভাজা , ইলিশ মাছ-সহ বিভিন্ন মাছের পদেই সেজে ওঠে ভোগ সামগ্রী । যেখানে বলির প্রচলন আছে সেখানে পাঁঠার মাংসও ভোগের উপচারে থাকে । কারণ বাঙালি মাত্রই ভোজনরসিক ।

মধুর সামাজিক বন্ধন, সাবেকি আবেশ , বারোয়ারি পূজার মণ্ডপ স্থাপত্যের মুন্সিয়ানা , থিমের দাপট , অষ্টমীর অঞ্জলি , আরতির নাচ, বোধন থেকে বিসর্জন প্রভৃতির অসাধারণত্ব এই পূজাকে বিশ্বজনীন করেছে । যার আবেদন ভারতে ‘বিবিধের মাঝে’ মহা মিলনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo kobita

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ক বি তা

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

ডাক

চলেছি জটিল অরণ্যে
তুমি সেবাদাসী ভূমিকা নেবে না?

 

কত অতল জল
কাঁচা মাটির উপর জ্বলে ওঠে ধূপ
একটি যুগের দিকে ঝাঁপ দেয় অন্ধকার মুখ

 

প্রসূতি সদন
হলুদ খাতায় লিখে রাখে সন্তানের মুখ, ভালোবাসা, নাভির কুণ্ডলী

 

জঙ্গলের পায়ে পায়ে, বিবাহযোগ্য, বলেছিলে সন্তর্পণে 
এ এক অসুখ

 

স্মৃতি

এবার জঙ্গল পেরোলে দেখা যাবে বাড়ি
সমস্ত দুপুর জুড়ে ফোড়নের ধোঁয়া
দুলছে ছেঁড়া নীল শাড়ি

 

কিছুদিনের জন্য খুলে দাও মধ্যাহ্নভোজনের পথ
বিছানায় মন্থর ঘুম

 

এসেছে সন্ধ্যার কুপি
তার অদৃশ্য চলে যাওয়া আছে

 

শুধু ছায়াটুকু উঠোনে অসম্ভব নৃত্যপরায়ণা

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo goddyo

অভিমন্যু মাহাত

আ মা র  পু জো

বাঙালির তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ দুর্গা পুজো। তো এই পুজো নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা? পুজো তাঁদের কাছে কীভাবে ধরা দেয় অথবা পুজোর ভেতর তাঁরা ধরা পড়েন কীভাবে... কলম ধরলেন

অ ভি ম ন্যু   মা হা ত

দুর্গা দেবী নন, তিনি হত্যাকারী

নাহ, আমাদের পুজো নেই। 

বলা ভালো, শারদ উৎসবের আবাহন বর্জিত এই দেশভূমি। মায়ের আগমন বা বিদায়ে আবেগহীন জনপদ। আমার যে গ্রাম, এখানে আদিকালে কোনো পুজো ছিল না। বৈদিক সংস্কৃতির আগ্রাসনের পরেও প্রান্তজনভূমিতে চরণ পড়ে না ‘দেবী’ দুর্গার। এই তল্লাট কার্যত উৎসবের আবহ থেকে শত যোজন বাইরে। পুজোয় আপামর বাঙালির মধ্যে ধুম পড়ে নতুন জামা, নতুন শাড়ি কেনার! আমাদের নতুন পরিধান বস্তু কেনার রীতিও নেই। সামর্থ্যও থাকে না।  ভাদ্র-আশ্বিন জুড়ে ঘরে ঘরে অনটন। কারণ মাঠ থেকে ফসল ওঠেনি যে! মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলি। পুজোর সময় আমরা কদ-গুন্দলু খেয়ে থাকতাম। কোনও দিন জনহার সিঝা (ভুট্টা সেদ্ধ)। রেডিওতে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে’… শুনে আলাদা কোনো অনুভূতি জাগত না। এখনো জাগে না!

নতুন জামা, নতুন শাড়ি কেনার রীতি আমাদের একমাত্র টুসু পরবে। তখন ঘরে ঘরে খামার ভর্তি ধান! ফসল বিক্রি করেই নতুন রঙিন জামা আসে ছানাপোনাদের গায়ে।

উপরে উল্লিখিত দুর্গা ‘দেবী’। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, আদিজাতিদের কাছে ‘দেবী’ নন তিনি। তিনি হত্যাকারী। অনার্য বীরকে তিনি ছলনা করে হত্যা করেছেন। তাই পুজোর দিনগুলিতে আমরা মেতে উঠি দাসাই পরবে।  মুখে মুখে প্রচলিত উপজাতিদের গানে বারবার ফিরে আসে জনগোষ্ঠীর পুরনো ইতিহাস৷ চাঁইচম্পা বা চম্পা ছিল তাদের বাসভূমি৷ সেই আদিম জীবনে মেঘ ঘনায় আর্যদের দখলদারি শুরু হলে৷ প্রচলিত বিশ্বাস, হুদুড় দুর্গার (অনার্য বীর) সঙ্গে বলে এঁটে উঠতে না পেরে কৌশল নেয় দখলদাররা৷ মহিলার সঙ্গে লড়াইয়ে নীতিগত আপত্তি ছিল হুদুড় দুর্গার৷ তাই ছলনা করে এক আর্য নারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাঁর৷ সেই নারীর হাতেই মৃত্যু হয় উপজাতি নেতার৷ হুদুড় দুর্গা বধ হওয়ার পর খেরোয়ালদের (উপজাতি) নেতৃত্ব দেওয়ার আর কেউ ছিল না৷ ধর্মগুরুদের পরামর্শে তারা সরস্বতী নদীতে স্নান করে মহিলাদের পোশাক পরে নাচতে নাচতে পূর্ব দিকে পালাতে থাকে৷ এই নাচই দাসাই নামে প্রচলিত৷ আশ্বিন মাসও এক অর্থে উপজাতিদের কাছে দাসাই৷ দাসাইয়ের অর্থ অসহায়৷ নেতাহীন খেরোয়ালরা সেই সময় যথার্থই অসহায় হয়েছিল৷  দাসাই নাচের গানেও সেই হা-হুতাশ আছে৷ তাতে বলা হয়, ‘দুর্গা অন্যায় সমরে মহিষাসুরকে বধ করেছেন৷ হে বীর, তোমার পরিণামে আমরা দুঃখিত৷ তুমি আমাদের পূর্বপুরুষ৷ প্রণাম নাও …৷’ নবমীর দিন রঙিন পোশাক পরে মাথায় ময়ূরের পালক গুঁজে বাজনার তালে তালে নাচ-গান করেন উপজাতিকুল। সেদিন স্মৃতিতর্পণের পর হুদুড় দুর্গা তথা মহিষাসুরের উদ্দেশে ছাতা উত্তোলনের অনুষ্ঠান চলে৷ যা পরিচিত ‘ছাতা ধরা’ উৎসব নামে৷ বীর বন্দনার এই পালা ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে আদিবাসী সমাজে৷ এই পুজোর ক্রমশ প্রসার ঘটছে৷ হুদুড় দুর্গা পুজোকে নিজেদের সমগ্র জাতিচেতনার অহংকার হিসেবে দেখেন জনজাতির অনেকেই।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo goddyo

পলাশ দে

আ মা র  পু জো

বাঙালির তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ দুর্গা পুজো। তো এই পুজো নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা? পুজো তাঁদের কাছে কীভাবে ধরা দেয় অথবা পুজোর ভেতর তাঁরা ধরা পড়েন কীভাবে... কলম ধরলেন

প লা শ   দে

কেউ আছেন নাকি ভেতরে?

শুরুয়াৎ

হাতে রোল ক্যাপ ভরা বন্দুক। হাফ প্যান্টের পকেটে উঁচু নিচু ক্যাপের ব্যাকআপ। সকাল ১১টা। স্পোর্টিং সেন্টারের সঙ্গে দাশ কলোনির লড়াই আজ। এই যুদ্ধের সকাল থেকে দুপুর চিরকালীন। বিকেলে নতুন গন্ধের পোশাক পরে বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। আজ প্রথম মোগলাই খাওয়া হবে তাও আবার সোদপুর ভগবতীতে বসে। টাকাপয়সার হিসেব কষা হয়ে গেছে। উফ্ কী যে উত্তেজনা। বাড়ির বাইরে থেকে অস্থির ডাক ইকো হচ্ছে- ‘কী রে আয়, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, আয় জলদি’…  

এমন সময় দম আচমকা ওঠানামা করছে কেন! কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে গোটা শরীর। আরে! কিছু বোঝার আগেই খলবল খলবল করে পাশের গঙ্গা নদীর এক চিকন ধারা বইতে লাগল চোখ থেকে। জামার বুক ভিজে যাচ্ছে। কী করা যায় কী করা যায়। কেন এমন হচ্ছে! কই কোথাও তো কোনো কারণ নেই। যদি মা দেখে ফ্যালে? বন্ধুরা? গৌতম বুগলাই দীপক যদি কিছু জিজ্ঞেস করে কী বলব!

বাথরুম, হ্যাঁ, চোখে মুখে জল দিতে গিয়ে জামায় লেগেছে। আর লাল হয়ে ওঠা চোখ? ওই তো চোখে একটা শ্যামাপোকা ঢুকে কী যে জ্বালা… 

ও হ্যাঁ, আজ ভোরবেলায় রাতের চোখ ডলতে ডলতে শিউলি ফুল তোলা হয়েছে–

 

নুন 

যত সমবেত তত একা নাকি কেউ কোথাও নেই এমন ভাবেই একা সম্ভব?

হাজার হাজার মানুষের মেলা। ফানুস, রঙিন বল, তালপাতার সেপাই… মাছভাজার গন্ধে ম ম চতুর্দিক। আলো সরিয়ে দেখি ফেনা গলে গলে পড়ছে পাথরে। তিন নম্বর ঢেউটা কি ভাঙবে আগেই? নাহ্, ওই যে আগেই কোলাকুলি করে নিল পাঁচ নম্বর ঢেউ সব। তার বেশি দ্যাখা যায় না। আন্ধার অ-নে-ক জল পেরিয়ে হ্যাজাকের আলো। পরপর, এখান থেকে সরলরেখা মনে হলেও নৌকা আগু পিছু জাল পেতে চলেছে।

সমুদ্রের জলে কিছু অভিশপ্ত মানুষের রস মিলেমিশে নুনের জন্ম। সেই স্বাদ গ্রহণ করতে গেলে সাধনার প্রয়োজন। সমুদ্র পরীক্ষা নেয়। 

ধুর, কীসব বলছ?

হুমমম, ওই যে জলে নামতে না নামতেই লাথি মারতে শুরু করল দ্যাখো -ওরা ফেল।  

পাশ করা মানুষ দায়িত্ব পায় নিম্নচাপ সরিয়ে সরিয়ে মেঘ রং করে সাদা আর আকাশি পৃথিবী প্রস্তুত করার, কী বুঝলে!

তোমার মাথামুণ্ডু। যত্তোসব…

 

উৎসব

উৎসব সারাক্ষণ একলা মানুষ খুঁজে যায়। সারাবছর অন্ধকার গলিতে যখন টুনি বাল্ব চকমকি করবে, অথচ কেউ সারাবছরের একই অভ্যাসে হেঁটে আসবে যাবে, তখন, ঠিক তখনই বশ করবে। সাইকেলের ক্রিং মুছে যাবে চটুল গানে। ছাদে সন্ধে জাপটে রাত্তির করতে থাকা মেয়েটাকে খুব আলগোছে যখন শহরের ঠাকুরের কথা বলবে আর সে সময় কীভাবে কোন মন্ত্রে যেন সে-ই দেবী!

রূপ রস ঘ্রাণ মিলেমিশে অসুর সন্ধান চলছে তখন।

অসুর কই? ওই যে এখন জীবনে প্রথম সিগারেটে টান দিয়ে কাশছে…

 

ম্যাজিক

যে কোনো দ্যাখা ছটফট করে ওঠে। শহরে নিয়ে যাওয়া বাস ট্রেন এক জাদুপৃথিবী। লোকাল সেন্টের গন্ধ, খাবারের দোকানের ডাকাডাকি, দূরে কাছে নকল আলোর মফস্‌সল। চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। সকলেই আইসক্রিম। ওই গলে গলে পড়া আরামে অনাথ মেয়েটা।

কি রে, কিছু খাবি?

ভাইয়ের জন্য দেবে তো!

উৎসব এইসব অভিশপ্তে প্রতীক্ষায় থাকে। তুমি পৌঁছনোর আগেই ভাইবোন হাপিস। তুমি কোথায় তাহলে। তুমি এখন কী ভূমিকায়?

গাছ থেকে পেরেক তোলা।

হার্টের রোগীর ঘরে জানলা বন্ধ করে দেওয়া।

বেলুনওয়ালার হাত দিয়ে ইয়া বড় গ্যাসবেলুন উড়িয়ে দেওয়া।

আতস কাচ দিয়ে একলা খুঁজে যাওয়া।

 

বাকল খুলে খুলে নতুন হচ্ছে। হাওয়ায় লাজুক লাজুক ভাব। সমুদ্র নীল আসমান। পাখি উড়তে পুড়তে দিশা ভুলে যাওয়া।

এসবের মানে কী?

উৎসব, তোমাকে খুঁজছে, একলা 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo kobita

তৃষ্ণা বসাক

ক বি তা

তৃ ষ্ণা   ব সা ক

রথযাত্রা

মেঘ ভোর থেকে এত গাঢ় গলায় কথা বলছে দেখে,

আমার সবুজ রথের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, রাসমাঠ,

সবুজ রথ, লাল নীল ছোট ছোট পতাকা আর বেলকুঁড়ির মালা,

জনতরঙ্গের মধ্যে সেই মালা ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে,

আর সেই মালার জন্যে লাফিয়ে উঠছে গোটা আশির দশক,

ভেঙে যাবে, তবু হাতে উঠে আসছে কাচের চুড়ি,

চারদিকে কাঁঠালের গন্ধ, আর্দ্র বাতাসের আঙুল ধরে হেঁটে আসা গ্রাম…

 

এখন সেই পা-গুলো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষে,

বসন্ত গেল, গ্রীষ্ম গেল, আষাঢ়ের প্রথম দিবসে আকাশ

কোনমতে একটা হাতখোঁপা, তাও ভেঙে পড়ছে,

থেবড়ে যাওয়া কাজল, একটা হাতপাখা, কোথায় রাখা,

পাওয়া যাচ্ছে না, বাইরের জুতো উঠোনে পড়ে,

বৃষ্টি আহা, বৃষ্টি এল,

তবু ওদের হাঁটা ফুরোল না…

 

আজ সকাল থেকে সেই পায়ের শব্দ মেঘে মেঘে বেজে উঠছে,

আর সেই শব্দগুলো রথের মেলার গমগমে ভিড়ের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে রাসমাঠ,

আমি আমার ছোট্ট রথটা নিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছি,

ছোট ছোট গলি থেকে মাঝারি রাস্তা,

কখনো মেঠো পথ বা রক্তাক্ত রেললাইন ধরে

আমি আসলে তোমার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি ভারতবর্ষ!

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo anubad

কুবলয় বসু

অ নু বা দ

কু ব ল য়   ব সু

আফ্রিকার কবিতা

বেলা সনি দীপোকো
(Mbella Sonne Dipoko)

ক্যামেরুনের কবি, ঔপন্যাসিক ও চিত্রকর বেলা সনি দীপোকো ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি প্যারিস চলে যান। সেখানে তিনি বেশ কিছু বছর নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ফ্রান্সের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে ফ্রান্সে পড়াশোনা শুরু করেও তা অসমাপ্ত রেখেই সাহিত্য চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর যাবতীয় লেখালেখি ইংরাজিতেই। তাঁর মৃত্যু ২০০৯ সালে। অনুবাদ করা কবিতা দু’টি যথাক্রমে ‘Transition’ (Vol. 4) এবং ‘Black and White in Love’ থেকে নেওয়া।

আমাদের জীবন

যন্ত্রণাকাতর পাখিটি মরুভূমিতে আরো কাতর হয়ে পড়ছিল

বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া একটি গান তার

মরূদ্যান যেমন

পানিবাহকেরা বলাবলি করছিল

পাখিটি ক্রমশ নিচে নেমে আসছে উড়তে উড়তে

আহা কী হৃদয়বিদারক তার এই গান

 

তার ডানায় ভর করা আশা শেষ অবধি স্বপ্নই

(আমাদের নিয়তি যেন কালো মুখোশে ঢাকা)

 

আগামীকাল বা পরবর্তী সময়ে যে সব দেশগুলি গড়ে উঠবে

সেই সমস্ত শহরে আমরা একই প্রার্থনা করেছিলাম

গ্রামে গ্রামে আমাদের পূর্বপুরুষের মিথগুলোকে উপস্থাপন করেছি

আমাদের হতাশা আমাদের জীবন আমাদের মৃত্যু প্রেরণ করেছি

কোনো এক রক্তদাতার ভালোবাসার দাক্ষিণ্যে আমরা আত্মতৃপ্ত হয়েছি

 

আমার প্যারিসের ডায়েরি থেকে

আমার কাছে শুধুমাত্র তিরিশ সেন্ট পড়ে আছে

কেন জানি না দুনিয়ার সব কিছুতেই আমার হাসি পায় বা

পঁয়তিরিশ বছরের শিশু আমি নিজেকে নিয়েও হাসি কিন্তু আমি আশাবাদী।

জীবন তখন থেকেই কঠিন হয়ে উঠেছে যখন আমি সব নিন্দার থেকে পালিয়ে এসেছি

পৃথিবীর যে কোনো সংবাদপত্রের থেকেই কমিশন পাবার মতো বিক্রিবাটা বন্ধ করে দিয়েছি

বামপন্থী পুস্তিকাগুলির বিষয়ে বিশেষভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে

আমি কিস্তিতে কিস্তিতে মৃত্যু গুণছি

অনাহারের খাদ্যতালিকা জেনে

এবং দীর্ঘদিনের ভাড়া বাকি রেখেছি।

নিশ্চিতভাবেই এটা জীবনধারণের কোনো উপায় নয়

নির্দয় দিনগুলিকে সামলানোর জন্য প্রস্তুত সেনাবাহিনির কাছে

আরো উন্নত যাপনের জন্য স্লোগান ফেরি করি

কিন্তু সংগ্রাম চলবেই

এবং আমরা স্বপ্নেও অজস্র নতুন রণাঙ্গন উন্মুক্ত করব

 

কোফি ওয়ানর (Kofi Awoonor)

ঘানার কবি-অধ্যাপক কোফি ওয়ানর ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ঘানা ছাড়াও তিনি তাঁর উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করেন লন্ডন ও আমেরিকাতে। লন্ডনে থাকাকালীন বিবিসি-র জন্য নাটক লেখার সময় তাঁর দীর্ঘ নামটিকে তিনি ছোট করে ব্যবহার করা শুরু করেন, এই নামেই তিনি খ্যাত। ঘানায় ফিরে এসে কেপ কোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরাজি ভাষার অধ্যাপক হিসেবেও পড়িয়েছেন অনেকদিন। ঘানার রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলার সময় তাঁকে বছরখানেক জেলে কাটাতে হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি ঘানার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ব্রাজিল এবং কিউবাতেও বেশ কিছুদিন নিযুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে নাইরোবিতে একটি শপিং মলে সাহিত্য উৎসবে যোগদান করতে গিয়ে এক হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়। অনুবাদ করা কবিতাগুলি তাঁর ‘The House by the Sea’ বইটি থেকে নেওয়া।

প্রথম বৃত্ত

১।

 

দুঃখ এখানে এসে শেষ হয়েছে

নতুন বছরের পার্টি শেষে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট নিয়ে লড়ে যাচ্ছে দুটো কাক

আমার কুঠুরি থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি

এক শীতল কঠিন পৃথিবীকে।

 

২।

 

এই তবে সেই স্ফোটক যা গোটা জাতির যন্ত্রণা-

বন্দিশালা, অত্যাচার, রক্ত আর ক্ষুধা।

একদিন বিস্ফোরণ হবেই;

হতেই হবে।

 

৩।

 

যখন আমি শুনলাম তোমাকে ওরা নিয়ে গেছে

আমরা অনেকেই অনুমান করতে চাইছিলাম

তুমি কোথায় থাকতে পারো

কোন দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকতে পারো?

সেই রাতে আমি চাপা গোঙানি শুনেছি

নিপীড়নের ঘেরাটোপে তুমি হারিয়ে গেছ

ভেবে অবাক হচ্ছিলাম

তারপর তুমি এলে, অসামান্য, রক্তাভ চোখে

 

সেই প্রথমবার আমি কেঁদেছিলাম

ক্রিস্টোফার ওকিবো
(Christopher Okigbo)

নাইজেরিয়ার কবি ক্রিস্টোফার ওকিবো জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ সালে। কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। প্রশাসনিক কাজ, শিক্ষকতা, প্রকাশনা, নাইজেরিয়া ইউনিভার্সিটিতে লাইব্রেরিয়ান ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি চিনুয়া আচেবের সঙ্গে ‘সিটাডেল প্রেস’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা শুরু করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে বিয়াফ্রার যুদ্ধে যোগদান করে তিনি নিহত হন। অনুবাদ করা কবিতাগুলি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘Heavensgate’ থেকে নেওয়া।

জলকন্যা

উজ্জ্বল

সিংহীর বাহুর মতো ঝলমলে,

সে সাড়া দিচ্ছিল,

সাদা আলোর পোশাকে

এবং ঢেউ তাকে আগলে রাখছিল

চন্দ্রালোকের মুকুটে জড়ানো আমার মৃগেন্দ্রাণী।

 

নিমেষের মতো তার উপস্থিতি-

বাতাসের শ্বাসে আগুন ঝলকানি-

যেন আয়নার মতো চারিদিকে তাকে দেখি।

 

আরো নিচে…

ঢেউগুলি তাকে পরিশুদ্ধ করে তুলছে:

যেন সোনার ফসল

নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে অনাহরিত

 

লবণের শূন্যতা-মাখা জলকন্যা,

গোপন শ্রবণে বেড়ে ওঠে।

 

সেতু

তোমাকে এবং জোয়ার ছাপিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি

দ্বিপ্রাহরিক জোয়ারেরও ঊর্ধে

জলস্রোতের হাস্যরোল শুনছি

কেন যে জানি না:

 

সেই উদ্দামতাকে শুনছি…

 

আমি দুপুরের জোয়ার ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছি

মাথা উঁচু করে,

আমার পায়ের নিচে তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে:

জোয়ার এসে ধাক্কা দিচ্ছে তারও তলদেশে।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo anubad

রূপক বর্ধন রায়

অ নু বা দ

রূ প ক   ব র্ধ ন   রা য়

Marie-Claire Bancquart

Marie-Claire Bancquart (জন্ম- ২১শে জুলাই,১৯৩২, মৃত্যু- ১৯শে ফেব্রুয়ারি,২০১৯) একজন কবি, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক এবং সাহিত্য সমালোচক ছিলেন। ফরাসি ভাষা এবং সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার Grand prix de la Critique littéraire of the Académie Française পেয়েছিলেন। মারীর কাজ প্রধানত "ভিসেরাল", যা মানুষের শারীরিক ও মননশীল অভ্যন্তরীন দিকগুলি আবিষ্কার করে। তিনি ফ্রেঞ্চ আর্ট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর কবিতাকে চার্লস বোদলেয়ারের সমতুল্য বলা হয়ে থাকে । তিনি French arts council La Maison de la Poésie-এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন। এ ছাড়াও ছিলেন Université Paris-Sorbonne এর এমিরেটাস প্রফেসার। অসংখ্য কাব্য সংকলন ছাড়াও প্রকাশ করেছেন একাধিক উপন্যাস, সুররিয়ালিজম ও ফরাসি কবি আনাতোল ফ্রান্সের উপর নানা প্রবন্ধের বই।

বইয়ের একাকিত্বে আমার চলাফেরা

আমি বইয়ের নির্জনতায় হাঁটাচলা করি; জমাট বাঁধা স্মৃতির সাথেই আমার মন জমাট বেঁধে যায়,

 

জানলার পাল্লায় ছিটকে পড়ে হাওয়া

 

নভেম্বর

 

একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা তৈরির জন্য কাঠে প্রয়োজনীয় ফাটল ধরাতে

একটা গোটা জীবন লেগে গেছে।

 

বাগান পেরিয়ে সময় পেরিয়ে আমাদের সামনে খসে পড়া চেস্টনাটের খোলস 

পাতার আগুন কুয়াশায় সেই বেগুনি জানলা।

 

ঠিক নভেম্বর।

 

সবই যে যার নিজের জায়গায়।

 

তবু একটা উদ্বিগ্ন পাখির মতো কেউ একজন আশেপাশে রয়েছে।


আমার জন্য, আমি এক বৃদ্ধকে ভালবাসি

আমার জন্য, আমি এক বৃদ্ধকে ভালবাসি

শাস্ত্র সম্পূর্ণ না করে

যে এক ছুতোরই রয়ে যেত।

 

একটা কাঠের টুকরো থেকে

সাদা চুলের যিশু

তার ভারী হাতে

একাধিক বাহুর ক্রুশ

খোদাই করা।

 

যে ভেড়া কখনই গসপেলের হবে না

জন্মদিনের ভোজের জন্য, মহিলারা

তাকে জলপাইয়ে ম্যারিনেট করছে।

 

তার বয়স ছেষট্টি বছর, সে হজরত নয়

কিন্তু সে তার নাতির হাত ধরেছে,

তার মৃত্যুর থেকেও দ্বিগুণ বয়সী,

ফিসফিস করে বলে,

এই বন থেকেই সে পায়রাদের জন্য বাসা বেঁধে দেবে।

 

প্রতিদিন ভোরে আমরা আবার বেরিয়ে পড়ি

প্রতিদিন ভোরে বহিষ্কৃত দেবতাদের মাঝে আমরা আবার বেরিয়ে পড়ি।

 

এ্যাঞ্জেলাস অথবা একজন নরম রুটির দেবতাকে

আমরা, সাজিয়ে গুছিয়ে নিই।

 

যে তুমি, তোমার রিফু করা জোব্বাকোট পরে আমাদের আমোদ দাও, তোমায় অভিনন্দন!

 

কাফন-আবৃত লাজারাসের যা আকাঙ্ক্ষিত তুমি তার দেখাশোনা কর;

একটা গৃহমধ্যস্থ পাম গাছ,

পরিপাটি ভাঁজ করা চাদরের অন্তঃস্থলে যেন ডিম,

রমণীদের গেয়ে চলা গান।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_pujo anubad

অরিন্দম রায়

অ নু বা দ

অ রি ন্দ ম   রা য়

রবার্ট ক্রিলি

বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি রবার্ট ক্রিলির জন্ম ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস-এ। অল্প বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। মায়ের কাছেই মানুষ। মাত্র চার বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় তাঁর একটি চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। লেখালেখির শুরুর দিকে ‘Black Mountain Poets’ নামে একটি কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্রিলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে কাব্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করার প্রচলিত ধারা থেকে সরে এসে ক্রিলি জোর দিয়েছিলেন ব্যক্তিমানুষের জীবনযাপনকে নিজের কবিতায় তুলে আনার দিকে। যে কারণে তাঁর কবিতায় বারবার ছায়া ফেলে তাঁর নিজের জীবন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল ___ ‘Hello: A Journal, February 29-May 3,1976’, Later, Mirrors, Memory Gardens, Windows, Echoes, Life & Death, ইত্যাদি। অ্যালেন গিন্সবার্গ রবার্ট ক্রিলিকে এজরা পাউন্ড, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস এর সার্থক উত্তরসূরি বলেছেন। ২০০৫ সালে,৭৮ বছর বয়সে আমেরিকার টেক্সাস শহরে ক্রিলি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিজের লেখা প্রসঙ্গে ক্রিলি বলেছিলেন --- “ I write to realize the world as one has come to live in it, thus to give testament. I write to move in worlds, a human delight. I write when no other act is possible.” ‘হ্যালো টেস্টিং বাংলা কবিতা’র পাঠকদের জন্য রইল রবার্ট ক্রিলির কয়েকটি কবিতার বাংলা অনুবাদ।

মহাকাব্য

কিছুটা জায়গা রেখো

আমার মহাকাব্যের জন্য

 

অনুপস্থিতি একটা

গর্ত তৈরি করে

 

যে কোনও গল্পই

কোথাও না কোথাও শুরু হয়

 

আর অন্য যে কোনও গল্প

শুরু হয় অন্য কোথাও

 

এখানে

যেহেতু আমি 

কাউকেই খুন করতে পারব না,

চুপচাপ বসে থাকাই ভালো

 

স্মৃতি

 

একঝলক 

টাটকা

সমুদ্রের বাতাস

 

রাত্রিকালীন 

যখন আলো চলে যায়

আর আকাশের রঙ কালো

তাকিয়ে দেখার জন্য 

কিছুই থাকে না

 

দিন শেষ

এটুকুই।

 

চড়াই 

ছোট্ট পাখিরা উড়ে এসে 

সিঁড়ির ধাপে বসে,

 

বসে, কিচিরমিচির করে

যখন সূর্য একেবারে মাঝ আকাশে।

 

শেষবারের মতো আমরা তাদের দেখব,

শেষবারের মতো আমরা শুনব 

 

দিনের প্রথম আলোর প্রতি

আসন্ন প্রত্যেক রাত্রির প্রতি

তাদের উচ্ছল সম্ভাষণ   

 

ইয়েটসকে ভেবে

ভাঙো 

‘সরলতা’

যা সত্যি তা-ই বলো

 

ছোট হও 

পৃথিবীর বিশাল মরুপ্রান্তরে  

 

প্রেম  

তুমি কি ধুলো হবে, 

এই কবিতা পড়ে?

 

তুমি কি বিষণ্ণ হবে

আমি আর থাকব না যখন।

 

ব্লু স্কাইজ মোটেল 

তাকিয়ে দ্যাখো

ওই মাদারচোদ চিমনির দিকে 

 

সোজা  

উপরের দিকে নির্দেশ করছে

 

দ্যাখো ওই মেঘগুলো,

পুরনো ফুলো বালিশ,

 

যেমনটা তারা বলে, সাদা আর ধূসর,

ভেসে যায়।

 

রাস্তায় তাদের গাড়িগুলো 

সামনের দিকে একটা সুইমিং পুল–

 

আর গাছেদের পাতাগুলো

ক্রমে হলুদ হয়ে যাচ্ছে

 

এখন 

শীতকাল 

 

সমুদ্র

কখনই ঘুমোয় না 

ফিরিয়ে দেয় জল।

খাড়াই পাহাড় 

চিন্তামগ্ন। 

 

একটি ছেলে আর একটি কুকুর

ধার ঘেঁষে হেঁটে চলেছে।

 

‘ফিরে এসো’, প্রথম ঢেউটিকে

আমি এইমাত্র দেখলাম।

 

জলের কিনারে একজন বয়স্ক মানুষ, বাদামি

প্যান্টটিকে গুটিয়ে রেখেছেন,

সাদা পা, সাদা পায়ের লোম।

 

পাতলা হালকা মেঘেরা 

সূর্যের পাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে 

চোখেই পড়ে না।

 

বালিতে আটকে আছে জুতো,

সোয়েটার, সিগারেট।

 

যাওয়ার মতো আর কোনো 

বাড়ি নেই।

 

কিন্তু সেই রেখা 

যেখানে আকাশ এসে সমুদ্রে মেশে

যেন অন্য কোনও কিছু।

 

বিদায়, জলরাশি–

দেখা হবে অন্য কোনোদিন ।

 

ভোর

বাঁধ ভেঙে গ্যাছে

মাথা একটি

জলপ্রপাত।

 

আত্মপ্রতিকৃতি  

তিনি একজন নৃশংস বুড়ো হতে চান,

একজন আক্রমণাত্মক বুড়ো হতে চান,

তাঁর চারপাশের শূন্যতার মতো 

নিষ্প্রভ, নৃশংস 

তিনি যেমন সমঝোতা চান না

তেমনই চান না কখনও কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে।

সমস্ত কিছুকে– চূড়ান্ত, সার্বিক-সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করার সময় 

তিনি কেবল ‘নিচ’ হতে চান।

 

তিনি চেষ্টা করেছিলেন মিষ্টি,

নরম গলায় বলার, ‘আহা,

এসো দু’জনে দু’জনার হাত ধরে থাকি’

আর সেটা ছিল ভয়াবহ,

বিবর্ণ, নৃশংসরকমের অবান্তর।

 

এখন তিনি তাঁর দুর্বল পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবেন।

তাঁর হাতদু’টি, তাঁর গায়ের চামড়া রোজ কুঁচকে যায়।

এবং, তিনি ভালোবাসেন আর ঘৃণা করেন সমানভাবে।

 

বাচ্চারা  

অবিশ্বাস্য বাচ্চাদের রাস্তা পার হতে দেখি, ট্রাফিকের ভিড় ঠেলে,

সাইকেল নিয়ে–

 

একটি ছোট মেয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে,

তার হাত সাইকেলের হ্যান্ডেলে–

পরিতৃপ্ত হৃদয়ে 

 

খুশি হওয়া,

আনন্দ পাওয়া,

যেমনটা তারা বলে,

 

খুবই সহজ হতে পারে

 

গল্প বলো 

সহজভাবে

গল্প বলো 

যেমনটি তুমি জানো 

কীভাবে বলতে হয়।

 

এই পথের সমাপ্তি,

হাত রেখে 

হাতে।

 

গিন্সবার্গের ‘কাদিশ’এর পঙক্তি নিয়ে লেখা 

“মেয়েরা সবাই বুড়ি হয়ে গেছে…”

ভগ্ন, ফুরিয়ে যাওয়া

 

পুরুষেরা, মৃত

বাড়িগুলি নেই, নৌকোগুলো ডুবে গেছে

 

কাজ চলে গেছে, অবসরপ্রাপ্ত 

পুরনো বন্ধুর বাড়িতে।

 

খানাপিনা করো,

আনন্দে থাকো, ওহে বিরক্তিকর লোক।

 

মার্কিনী প্রেম

এক গুরুনিতম্বিনী 

সুন্দরী! 


মহামারী  

পৃথিবী যখন এক মহামারীতে পরিণত হয়

এক অন্ধকারাচ্ছন্ন, অবর্ণনীয় সংক্রমণে,

 

যখন পুরুষ, নারী, শিশুরা

কিছু বুঝতে না বুঝতেই মারা যায়,

 

চোখের নিমেষে, শরীরের ভিতরে ঠেলা মারে

একটা যন্ত্রণাদায়ক স্রোত, বিচ্ছিন্ন–

 

আমার শৈশবে দ্যাখা 

নিঃসঙ্গ, একঘরে করে রাখা কুষ্ঠরোগীদের মতো–

 

রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে,

বন্ধ জানালা, বন্ধ জানালার পিছনে–

 

কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলত না, কেউ না

কেউ আর তাদের ছুঁয়ে দেখত না, কেউ আর অপেক্ষা করত না

 

পরবর্তী ঘটনা ঘটার জন্য– যেমনটা

আমরা এখন ভাবি , দিন শুরু হয়

 

আবার, আমরা ম্লান সূর্যকে খুঁজি,

যেন তারা এখনও সেখানে আছে , আমরা আশা করি 

আর আমরা আসছি

 

সালেহ-র সঙ্গে সফর

(সালেহ-র জন্য)     

 

ভি ডব্লিউ মোটরের গর্জন

পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষ, গাড়িদের–

 

কুয়ালালামপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে  

একটা গরম দিন, আর

 

চাইনিজ খাবার সহযোগে লাঞ্চ করার সময় হওয়া

কথাবার্তাগুলো এখনও মনে রয়ে গেছে,

 

“আমেরিকানরা কি এশীয়দের ঘৃণা করে?” পৃথিবীটা

গোল নাকি চ্যাপ্টা, পৃথিবী কি একটাই, নাকি দু’টো, নাকি তারও বেশি–

 

আর তোমার মতো একজন মুসলমান

এখানে কী করছে? 

 

যাইহোক, হাওয়া দিচ্ছে,

আকাশের কিনারে সূর্য ঝলমল করছে

 

গাছগুলো নুয়ে পড়েছে

হোটেলের উঁচু পাঁচিলের তলায়।

 

আফগানিস্তানে চলে যাও আর

সুফিদের মতো হও–

একসঙ্গে, মিলেমিশে, ভাই,

সর্বোপরি  

সেই প্রাচীন শিকড়ের মতো গভীরে প্রোথিত 

প্রজ্ঞার তালে তালে নাচো 

 

কুকুরেরা

আমি ওদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি 

আসতে,

 

আবার চলে যেতে,

বসতে, দাঁড়াতে,

 

অপেক্ষা করতে

আমার আদেশে,

 

অথবা আমি হতে চেয়েছি

সেই প্রভু 

 

যিনি

ওদের সেই কাজগুলোই করতে বলেন

যেগুলো তারা করতেই পারবে না।

 

ফ্লবেয়ারের প্রথমদিকের গদ্য 

“অবশেষে তিনি মারা গেলেন

বেঁচে থাকার ইচ্ছা চলে যাওয়ার কারণে,

নিছক ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার কারণে…”

 

আর তারপর কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময়

একটা লরি ধাক্কা মারল তাকে,

অথবা আজীবনের পারিবারিক বন্ধুরা 

একটা পাথরের গায়ে যন্ত্রণার ‘অবসান’ লিখে

গড়িয়ে দিল তাঁর দিকে–

 

অথবা তিনি কলেজ গেলেন,

বিয়ে করলেন,

এবং তারপর মারা গেলেন!

 

অথবা তিনি মারাই গেলেন না,

স্রেফ বেঁচে থাকলেন,

দিনের পর দিন, একইরকমভাবে… 

 

তিনি একজন খুবই চিত্তাকর্ষক মানুষ, 

প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন এক ব্যক্তি,

কিন্তু তাঁকে তো মরতেই হত কোনও না কোনওভাবে–

 

তাই তিনি একা একা চলে যান সমুদ্রতটে

জলের দিকে তাকিয়ে 

বসে থাকেন আর ভাবেন,

 

“কেন আমি জন্মেছিলাম?

কেন আমি বেঁচে আছি?”

–পুরনো একটা গানের মতো 

আর তারপর তিনি মারা যান।   

 

পঞ্চভূত 

আকাশ কান্নায় ভেঙে পড়ে

আর জল মুখ তুলে তাকায়।

 

বাতাস সর্বত্র অনুভব করে

হঠাৎ ধাক্কা আর অস্পষ্ট শূন্যতা।

 

আগুন জ্বলে, আবর্জনার মতো 

ফেলে রাখা মাটি, অমানবিক।   

আরও পড়ুন...