Categories
2020_sep

উজ্জ্বল পাঠ । পর্ব ৫

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ৫

সে লি ম   ম ণ্ড ল

ভাতঘুমে জেগে থাকা কবি: কল্যাণ মিত্র

 

ডিসেম্বরের সন্ধে, পকেট থেকে হাত বের করার উপায় নেই। সোয়েটারের ওপর একটা চাদর পরেও আমরা ঠকঠক করে কাঁপছি। হরিসভা মন্দিরের ভিতর শীত গলে তরল হয়ে গেছে, চতুর্দিকে ফুটছে উষ্ণতার তরলবাষ্প। পুরুলিয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা চলছে। সমস্ত লিটলম্যাগকর্মীরা এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ভালোবাসা আর আন্তরিকতা এখানে হাড় কামড়ানো শীতকেও চাবুক মারে। মেলা ঘুরতে ঘুরতে ‘সর্বনাম’ পত্রিকার টেবিলে একটি ধূসর মলাটের কবিতার বই চোখে পড়ে। আশি পাতার বই। দাম মাত্র পঞ্চাশ টাকা। কোনোরকমে পকেট থেকে হাতটা বার করে কয়েকটা কবিতা পড়তে থাকলাম। পড়তে পড়তে অনুভব করলাম— আমার আঙুলে লেগে থাকা বরফ কখন কর্পূরের মতো উবে গেছে! পড়ব পড়ব করে বইটি দীর্ঘদিন আলমারিতে পড়েছিল। এরপর এক বর্ষার সন্ধেয় মোমবাতির আলোয় বইটি পড়া শুরু করলাম। সেদিন আমাদের ফ্লোরে কেউ নেই। বিকেল থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। কখন কারেন্ট আসবে ঠিক নেই! হঠাৎ দেখলাম— ঘরটা আলো হয়ে উঠছে । না কারেন্ট আসেনি। কবিতার বোধের আলো যেন প্রবাহিত হচ্ছে। সর্বনাম পত্রিকার সম্পাদক পঙ্কজদা (পঙ্কজ চক্রবর্তী)। পড়া শেষ করি। ওঁর সম্পর্কে খোঁজ নিই। জানতে পারি ওঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ আছে।

আশির দশকের এই কবি শ্যামনগরে থাকতেন। বর্তমানে থাকেন ব্যাঙ্গালুরু-তে। কবিতা-আক্রান্ত হয়ে একসময় একটি বেসরকারি কোম্পানির উচ্চপদস্থ চাকরিও ছেড়ে দেন। তবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন এই কবি। পেয়েছিলেন ‘তৃণাঙ্কুর পুরস্কার’। একসময় চিত্রক, বারোমাস পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। সম্পাদক গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী মারা যাওয়ার পর সামলেছেন পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব। এখনও অবধি দু’টি কাব্যগ্রন্থ। ‘ভাতঘুম, জেগে আছি’ ও ‘সেগুন কাঠের আঁশ’। 

 

 

প্রথমে পড়ে নেওয়া যাক, ‘ভাতঘুম, জেগে আছি’ কাব্যগ্রন্থের বিভাব কবিতা—

 

ভাতঘুম, জেগে আছি

 

মিটার বাক্সের মধ্যে বড়ো হচ্ছে 

ঘুঘুর ছানা

 

একটা বিড়াল

মাঝে মাঝে উচ্চতা জরিপ করে

 

বিকালের পায়ে 

সুতো সরছে সকালের

 

ঘুঘুর ডাকে

পেকে উঠছে দুপুর

ভাতঘুম, জেগে আছি।

 

বিভাব কবিতাটা পড়লেই আঁচ পাওয়া যায় কবির কবিতাবোধ সম্পর্কে। কবি যেন মাটির কোনো দালানে বসে দূরের কোনো দেশে হারিয়ে যেতে চাইছেন। যে দেশ কবি নিভৃত যাপনে এঁকেছেন বহুদিন। যে দেশের সুতো পায়ে জড়িয়ে তিনি হেঁটে যেতে চান। তাঁর ভিতরকার ঘুঘুটিকে তিনি জাগিয়ে রাখতে চান। আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই এমন ঘুঘু থাকে। তাকে আমরা শস্য দিই। কিন্তু সকাল-বিকাল-সন্ধে কি চেষ্টা করি তার ডাক শোনার? জেগে থাকতে থাকতে ঘুঘুটিই যেন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দেহরসে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো পড়ে নুইয়ে। তার ছায়ায় আমাদের কোনো প্রতিবিম্ব নেই। শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। কবি সেই অন্ধকার মাড়িয়েই নানা কবিতায় খুলে বসেছেন রোদের ড্রইং খাতা। কতরকম সিনারি!   

এই কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতা পাঠ করলে, কবির কবিতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। 

 

জন্মদিনের কবিতা

 

পেঁপেফুলের গর্ভে উঁকি দিচ্ছে জন্মদিন

আমার ভূমিকা ধুলোর

ঝটিকা সফরে একটা দেশলাই কাঠি আছে বটে

জানি না কোথায় কখন কীভাবে

 

শুকনো পাতার ঠোঁটে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ 

রুক্ষচুল এলো-করে ঘুরপাক খাচ্ছে মেঘ

ঈশানের গ্রামোফোনে পিনের খসখস

হাওয়ার শোঁ শোঁ

আর তীক্ষ্ম চিৎকারের মধ্যে

পেঁপেফুলের গর্ভে উঁকি দিচ্ছে জন্মদিন। 

 

তেপান্তর

 

একটা কোলকুঁজো গাছ

কোলে বসিয়ে আদর করছে

তার ছায়াকে

 

লম্বা রাস্তাটা

চওড়া হচ্ছে 

প্রতিদিন

 

কষ্টের বোঝা বইতে বইতে

মনে হচ্ছে

বোঝাটারও কষ্ট আছে। 

 

জলকাচে

 

এক একটা মাছ সকালবেলা নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ে

এক একটা মাছ বদ্ধজলে ভীষণ দ্রুত বাড়ে

এক একটা মাছ চারের মুখে লেজ ঝাপটায় জোরে

এক একটা মাছ বাচ্চা নিয়ে ঝাঁকের নীচে ঘোরে

এক একটা মাছ জল নাড়লে ঘাটের কাছে আসে

এক একটা মাছ এপারে ডুবে ওপারে গিয়ে ভাসে 

 

পাগল

 

মাথায় গণ্ডগোল থাকলে 

ছোঁড়া ঢিল গায়ে লাগে না।

 

সারাদিন চোখ মিটমিট

সাতসকালে হাতে বাজারের ব্যাগ নেই 

গিন্নির পাখিছুঁচ নেই

যতকথা শুধু নিজের সঙ্গে

সূর্যঘড়ির ঘণ্টা দুলছে তো দুলছেই…

 

পাগলের মনখারাপ নেই

মাঝরাত্তিরে শ্বাসকষ্ট নেই

থাকা বলতে একটা উলটে যাওয়া ভূগোল

আর বিগড়ে যাওয়া স্টিয়ারিং

 

রেল কাটা-পড়া, রাস্তায় চাপা-পড়া

মানুষজনের মধ্যে

একটাও পাগলের নাম নেই।  

 

বাড়ি

 

দীর্ঘশ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে

আমারই পায়ের চাপে মরে গেছে ঘাস

 

কোনদিকে ফিরে কাকে দেখি

 

বাড়িটা দু-ভাগ। দুদিকেই কাত হয়ে আছে। 

 

উপরের কবিতাগুলো পড়ে আমরা এটুকু বুঝতে পারি, কবির একটা নিজস্ব কবিতাগ্রাম আছে। সেই গ্রামেই কবি দেখেন সাদা পেঁপেফুলের গর্ভে জন্ম নিচ্ছে জন্মদিন। শুকনো পাতার ঠোঁটে কীভাবে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। শোনেন ঈশানের গ্রামোফোনের ফিসফিস। কখনো তিনি বসে যান— ছিপ হাতে পুকুরে। তিনি মাছ তোলা ভুলে গিয়ে দেখতে থাকেন জলে ওদের ওঠানামা। ভাবতে থাকেন একটা মাছ এপারে ডুবে কীভাবে ওপারে ভেসে ওঠে… তুমুল বর্ষাতেও কবির কাদামাটির গ্রামে পা হড়কে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। মনে হয়— এ আমাদের বাপ-ঠাকুদার গ্রাম, এই কাদামাটির ঘ্রাণ আমাদের ভিতর অনেকদিন আগে থেকে বসত গড়েছে। 

 

উপরের কবিতাগুলোর মধ্যে আলাদা করে ‘পাগল’ কবিতাটার কথা উল্লেখ করছি। এই জীবন-অনুভবের কাছে একজন কবিতা পাঠকের নতজানু হওয়া ছাড়া আর কী করার থাকে? জীবন-সংসারে আমরা সবাই পাগল। অথবা পাগল হয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু এই জগৎ আমাদের পাগল হতে দেয় না। নিয়মানুবর্তিতার ঘেরাটোপে আমরা সবাই কর্মপ্রবণ, দায়িত্বপ্রবণ মানুষ। আমাদের হাতে সকালের বাজারব্যাগ যেমন থাকে, তেমন থাকে কর্মব্যস্ততার সূর্যঘড়ি। থাকে নিজের ঘামের সাদা নুন, রোগের হাঁফানি, রক্ত কফ… একজন পাগলের মাঝরাত্তিরে থাকে না শ্বাসকষ্ট, থাকে না মনখারাপ। কবি ভিতর ভিতর এমনই পাগল হতে চেয়েছেন! এই কবিতার চারটে অমোঘ লাইন, আমার বহুদিন মনে থাকবে—

 

“পাগলের মনখারাপ নেই

মাঝরাত্তিরে শ্বাসকষ্ট নেই

থাকা বলতে একটা উলটে যাওয়া ভূগোল

আর বিগড়ে যাওয়া স্টিয়ারিং”

 

এই কবিতার শেষ লাইনে কবি আরও বিস্মৃত করলেন। লিখলেন, রেলে কাটা পড়া বা রাস্তায় চাপা পড়া মানুষজনের মধ্যে পাগলের কোনো নাম নেই। কবির বোধ কোন জায়গায় গেলে এইভাবে লেখা যায়! যদি কল্যাণ মিত্রের এই একটি কবিতাই ‘পাগল’ শুধু পড়তাম, তাঁকে আমার পছন্দের কবির তালিকায় রাখতাম। একজন কবিতা পাঠক একজন কবির কাছে কী চান? কিচ্ছু না, কিচ্ছু না… স্রেফ নিজের হাড়-মাংস ছুঁড়ে ফেলে একটা অশরীরী আত্মার মতো কবিতার আশেপাশে ঘুরে-ফিরে বেড়াতে চান। 

 

‘ভাতঘুম, জেগে আছি’ কাব্যগ্রন্থ এমনই এক আশ্চর্য গ্রন্থ। অনেক কথা বললে বলা যায়। ‘উজ্জ্বল পাঠ’ এই ধারাবাহিকটি লিখতে গিয়ে আমি বারবার বলেছি, এই লেখার মূল উদ্দেশ্য কবিতার সঙ্গে পাঠকের সংযোগ ঘটানো। আলোচনা এখানে মুখ্য নয়। তবুও এই সংযোগের সুতো ছাড়তে গিয়ে আমার লাটাই থেকে ক্রমশ সুতো ছড়িয়ে যায়। কবিতার এত বড়ো আকাশ! এ সুতো কিছুই নয়।

 

পড়ে নেওয়া যাক, আরও কয়েকটি কবিতা—

 

তুমি আর সেই তুমি নেই

 

ইচ্ছে ঠাকরুনের ইচ্ছেয় তোমার নবজন্ম হল।

 

তুমি এখন ছোট্ট শিশুটি

চিৎ হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ছ

আর খিলখিল করে হাসছ

 

হাসতে হাসতে তোমার চোয়াল গেল আটকে  

বেরিয়ে থাকল দুটো ফোকলা মাড়ি

আর মুখের সঙ্গে বেমানান

একটা বিরাট হাঁ—

 

শূন্যস্থান পূরণের জন্য 

 

সম্পর্ক

 

জল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বুঝে গেছি জলের ভাষা

এবং তার বিভ্রান্তি

 

কালো ঘোড়াটা জলের ধার থেকে যত সরে যাচ্ছে

তত কাছে আসছে আমার

 

আমি যেন রং-এর মিস্তিরি

প্রতিদিন চুনকাম করতে করতে ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলছি। 

 

পরিশিষ্ট 

 

আমার পৃথিবী বেশ ছোটো। আমি তাকে

টেনে বাড়াব না। মায়ের ছবিতে ফুল দেব।

বাবার ছবিতে ফুল দেব। ছায়াকে বলব,

ঘাড় সোজা রাখ্‌। একঘরে আমি বেশিদিন থাকব না।

 

এই নিচের কবিতাগুলো পড়লেও বোঝা যায়— তার কবিতার কী ভরকেন্দ্র। তিনি কোনো মাধ্যাকর্ষণ বলে কবিতাকে টেনে রাখেন। তিনি ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলা সেই রং-মিস্তিরি, যিনি শরীরে রামধনু এঁকে আকাশ থেকে খসিয়ে ফেলেন তারা? তাঁর জলের কী ভাষা? এ-ভাষা কি তাঁর কবিতারই ভাষা, না একজন শিশুর ফোকলা মাড়ির খিলখিল করে হেসে ওঠা? তাঁর হাঁ-এর শূন্যস্থান? তাঁর ছোটো পৃথিবীকে তিনি আসলে কোন ফুলে সাজাতে চেয়েছেন? একঘরে টিকবেন না বলে কবি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তা কি তাঁর সহজিয়া মনের অনুভূতিমালা? নানা প্রশ্ন ঘুরতে ঘুরতে কবিকে পড়ার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। 

 

আমার কাছে কবি কল্যাণ মিত্রের এই একটি কাব্যগ্রন্থই ছিল। আরেকটি কাব্যগ্রন্থ পঙ্কজদা বা সুপ্রসন্নদা (সুপ্রসন্ন কুণ্ডু) দিতে পারবে বলেছিল। সংগ্রহ করব করব বলেও সংগ্রহ করা হয়নি। এই লকডাউনে সংগ্রহ করার উপায় বলতে সফটকপি। পঙ্কজদাকে অনুরোধ করি বইটি যেন পিডিএফ করে আমায় একটু দেয়। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সেগুন কাঠের আঁশ’ পাঠ করতে গিয়ে দেখি— ওঁর সেই একই চোখ আরও ধারালো হয়ে ফুটে আছে। মৌচাকের অজস্র মৌমাছির মতো। একজন কবির হাত না-থাক, পা না-থাক, থাকা দরকার চোখ। এই চোখ সাদাকালোর কোনো ছোট্ট গোলক নয়। এই চোখ আমাদের ভিতর থাকা এক বোধিবীজ। যা অনেক সাধনার ফল। একজন কবিতালেখক হিসেবে ক’জন পারেন এই বোধিবীজ ভিতরে অঙ্কুরোদগম ঘটাতে?

 

‘সেগুন কাঠের আঁশ কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়া যাক কয়েকটি কবিতা—

 

ওই চোখ

 

ওই চোখ  তুমিই দিয়েছ

আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি

 

একটা কঞ্চি ধরে 

ছাদে উঠছে

একটা লাউগাছ

 

একটা কাটা ঘুড়িকে—

সুতোয় পেঁচিয়ে কাছে টেনে আনছে

আর একটা ঘুড়ি

 

ওই চোখ তুমিই দিয়েছ

আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি 

 

বারান্দা

 

বারান্দার সঙ্গে একটা সম্পর্ক  তৈরি হয়েছে আমার

যেরকম হয় পা এবং রাস্তার

 

ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই বারান্দার দরজা খুলি

বাইরে বেরোনোর সময় গেট থেকে

৯০ ডিগ্রী ঘাড়-ঘুরিয়ে বারান্দার দিকে তাকাই, দেখি

 

ঘর পিছন হাঁটছে

 

সাভানা হাওয়া

 

অভাব যাবে না। উপার্জন যত বাড়বে—

অভাব বাড়বে তার বেশি।

প্রিয় অক্ষরের গায়ে আ-কার, ই-কার

যুক্ত হতে হতে এসে যাবে য-ফলাও।

বিছানাটা ছোটো হবে, হাওয়া 

গরম হয়ে ঢুকবে জানলা দিয়ে।

পার্থ-র বাড়ি রোদ আসবে

ঘাস গজাবে তোমার বাড়ি,

সুলগ্নার বাড়ি ইনভার্টার আসবে

ঘাস গজাবে তোমার বাড়ি।

একটা নিড়েন হাতে নিয়ে ঘাসের পিছনে 

ছুটে বেড়াবে সারাক্ষণ—

 

পান খাবে, ঠোঁট লাল হবে না। 

 

শোক

 

মা, তোমার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারিনি বলে

মেদিনী গ্রাস করেছে আমার পা

 

ঘরে পোঁতা লোহার পেরেক

এখন বারোমাস আমাদের কুয়াশাবাস

 

তোমার হাতে লাগানো বেগুনগাছটা

নেই

 

যখন শীতের রোদে উথলে-পড়ে বেগুন পোড়ার গন্ধ

তোমার ছবির মুখ, রান্নাঘরের কোণে জবাফুলটির মতো

জিভ-বের-করে হাঁফায়…

 

‘উঠোনটা কা কা করে’

 

উপরের কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে প্রথম কাব্যগ্রন্থের মতো একই মুগ্ধতা অবশ করেছে। কিছু কিছু কবিতা পড়ার পর শুধু মনে হয়েছে চুপচাপ বসে থাকি। মনে হয়েছে কবির চোখখানি ধার করি। নগদে আমাদের চোখ রোজ যেভাবে ভুল পথে ফেরি করে তারচেয়ে বোধহয় এই ধার করা চোখ অনেক ভালো। তাঁর চোখ দিয়েই সম্পর্ক  তৈরি করি পা ও রাস্তার। ঘরকে পিছনে ফেলে আমরা হেঁটে যাব। আমাদের সংকীর্ণতার ভিতর যে শুকনো গোলাপ পড়ে থাকে, তার গায়ে ছিটিয়ে দেব কয়েক ফোঁটা জল। আমাদের না-পাওয়ার জার্নালে যে ঘাসগুলো মাড়াতে মাড়াতে ক্ষইয়ে ফেলি বুট, তা দিয়েই আমরা পালিশ করে নেব অভ্যন্তরীণ রোদ। 

 

‘শোক’ কবিতায় কবি বলেছেন— 

 

“যখন শীতের রোদে উথলে-পড়ে বেগুন পোড়ার গন্ধ

তোমার ছবির মুখ, রান্নাঘরের কোণে জবাফুলটির মতো

জিভ-বের-করে হাঁফায়…” 

 

কবির কল্পনাশক্তি কী তীব্র একবার ভাবুন! শীতের উথলে পড়া রোদে বেগুন পোড়ার গন্ধে মায়ের ছবি মুখ রান্নাঘরের কোণে জবাফুলটির মতো জিভ বের করে হাঁফায়। এই কবিতায় আর কিচ্ছু বলার দরকার ছিল না। তার আগের লাইনে বলেছেন ‘তোমার হাতে লাগানো বেগুন গাছটা নেই’। এই কবিতাটা যদি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া যায় দেখা যাবে টুকরো টুকরো ছবি নিয়ে কবি কোলাজ করেছেন। আর শোককে কোনো পার্থিব ব্যথা-বেদনার জায়গায় না রেখে নিয়ে গেছেন এক অতিচেতনার জগতে। এই জগৎ কি কবির একার? এই জগতে প্রবেশের জন্য কোনো টিকিট দরকার? নাকি তিনি উন্মুক্ত দরজা সামনে দাঁড়িয়ে আহ্বান করছেন সকলকে? 

  

চলুন, পড়ি আরও কিছু কবিতা—

 

সাতের নামতা

 

একটা কুকুরের চিৎকার ঘণ্টায় ক’মাইল ছুটে যায়

একজন মানুষের আর্তনাদই বা ঘণ্টায় ক’মাইল

 

বন্দুকের গুলি যত তাড়াতাড়ি ছুটে যায়

আলোর গতি কি তার চেয়ে দ্রুত নয়!

 

তবে কেন আলো হাতে নিয়ে তুমি

      ট্রিগার থেকে সরিয়ে নিতে পার না আঙুল

 

ভালোবাসা কেন সাতের নামতা মুখস্ত বলতে পারে না

 

জন্মকল

 

এই সেই ভরা ভাদ্র হৃদয় যেখানে এক অবুঝ গোলপাতার

এই সেই বিস্ময় বেড়াল, মুহূর্মুহু কেঁপে-ওঠে আমার পাঁচিল

এই সেই ইস্কাবনের বিবি, জ্বলা নেভা  জোনাকি পাঠিয়ে গলায় বরফ

বল্‌গাহীন রাস্তায় এদের সবাইকে নিয়ে আমি লাগাম ছাড়া

                                                 অদৃশ্য ঘোড়ার পিঠে… 

 

ভাগশেষ

 

উনুনটার জন্য সে গায়ে কাপড় রাখতে পারে না—

উঁচু নাকে রুক্ষ, অলজ্জ

বুকের দুদিকে দুটো পাখির বাসায়

জাগিয়ে রেখেছে

ঘুমপৃথিবীর ধূপকাঠি।

 

মাঝে মাঝে ছাইগাদার ওপাশে লাফিয়ে ওঠে অন্ধকার—

চকমকি ঠুকে সে ফুলকি ফেলে পোড়া শোলায়

আর ভাবে একটা অখণ্ড সংখ্যার কথা

যা-দিয়ে ভাগ করলে ভারতবর্ষ বানানে 

কোনো ভাগশেষ থাকে না। 

 

 

এই নিভৃতচারী কবি এখনো লিখছেন। সমস্ত কোলাহল দূরে রেখে নিজের আত্মযাপনের শব্দগুলি করছেন মগজাস্ত্র। নতুন বই নিয়ে আবার হয়ত সামনে আসবেন। কে পড়বে বা পড়বে না তা নিয়ে তাঁর কোনোকালেই মাথাব্যথা ছিল না। আসলে আমাদের মাথার ভিতর গেঁথে যাওয়া নাম টপকাতে পারি না বলে মাথা উঁচু করে আকাশ দেখতে গিয়ে করে ফেলি ঘাড় ব্যথা। এই ব্যথার ব্যারাম পেরিয়ে আমাদের বাংলা কবিতায় একদিন দিকে দিকে অস্ত্রোপচার হবে। ঘচাঘচ কাটা হবে কবিতার নিষ্ক্রিয় অঙ্গ। আমরা হাতে ব্যান্ডেজ ও ছুরি নিয়ে পড়তে বসব কবিতা। বাংলা কবিতা।

 

কবি কল্যাণ মিত্র

কৃতজ্ঞতা:

পঙ্কজ চক্রবর্তী

সুপ্রসন্ন কুণ্ডু

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

জেরোম রথেনবার্গের কবিতা

অ নু বা দ

অ মি তা ভ   মৈ ত্র

জেরোম রথেনবার্গের কবিতা

বানটু রাজাদের প্রশস্তি

১।

 

সঙ্গে যাই মৃতদের

আমি নিজের সঙ্গী হই না।

আমি বোকা এমন কেউ যে বুদ্ধিমান।

আমি সিংহ যে থাবা টানটান করেনি কখনও।

আমার বাবা নেই মা নেই।

আমি ছিলাম।

 

২।

 

বৃষ্টির সন্তান আমি যে বৃষ্টি পূর্ব থেকে আসে মৃদু জল দেয়।

আমি বৃষ্টি যে মৃদু জল দেয়।

টাকমাথা ক’জন বুড়োকে ভিজিয়েছি।

আমি বিছানা যেখানে শুয়ে পড়ে মৃতরা।

মাঝে মাঝে কাজ করি, একবার জায়গা খুঁজেছিলাম

                                     বেরিয়ে যাবার জন্য।

রেগে গেছিলাম।

পরে সিংহদের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই।

তোমাদের রাজা আমি।

 

৩।

 

আমি ছিলাম গাছ যার পাতা হারিয়ে গেছে।

শক্ত হয়ে গেছে চামড়া।

সরু কিছু ডালপালা পড়ে আছে জ্বালানির জন্য।

 

৪।

 

যা আমার নয় তাই আমি।

আমাকে কবর দিতে দেব না ওদের।

কাল দেখা করব আরেকজনের সাথে।

আমি মেরে ফেলেছি রাজাকে আর তার সন্তানদের।

এই দ্বীপ যার আমি মেরে ফেলেছি তাকে।

একসময় তার ভাইকেও মেরেছিলাম আমি।

 

৫।

 

আমি ভালবাসি।

আমি তন্নতন্ন করে বেড়িয়েছি এই দেশ।

আমাকে সম্মানিত করা হয়েছে জমি আর মানুষ দিয়ে।

যাদের ভেড়া আর ছাগল ঘৃণা করতাম আমি।

 

৬।

 

জঙ্গলের সিংহ আমি।

ভয় পাইনা ডাইনি বিদ্যায়।

শিকারকে মেরে আমি তার যৌনাঙ্গ খেয়ে ফেলি।

 

 ৭।

 

মাটিতে চোখ রেখে আমি খুঁজেছি

             চালুনি থেকে পড়ে যাওয়া শস্যদানা।

আমি ছিলাম ক্ষুধা এই পরাজয়ের দেশে।

 

৮।

 

আমি সুন্দর আর পাতলা আমার চামড়া।

মৃত বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার স্ট্রেচার আমি।

কবরখানার ভেতরে যাবার পথে আমাকে কেউ এড়াতে পারেনা।

মোষ আর আগন্তুকদের যুদ্ধে হারিয়েছি আমি।

 

৯।

 

দাগ দেওয়ার জন্য দক্ষতা আছে আমার।

আমার স্ত্রীর স্বামী। জামা গুঁজে পরিনা।

ছাগল-দাড়ির একজনের সঙ্গে ইয়ার্কি করেছি।

 

১০।

 

ঝুঁকে পড়া মানুষদের সাথে থাকতাম।

আমাকে শেখানো হয়েছিল।

খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

১৯৬০ সালে বেরিয়েছিল জেরোম রথেনবার্গের ( জন্ম-১৯৩১) প্রথম কবিতার বই ‘White Sun Black Sun’. সেই বইয়ের শুরুতেই টেলিগ্রামের মতো মিতকথনে তাঁর কবিতাভাবনা জোরালোভাবে জানিয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই তাঁর একা রাস্তার শুরু। আগের এবং সমসময়ের সমস্ত চিহ্ন ও লক্ষণ আত্মস্থ করেছেন তাঁর এই যাত্রাপথে। বিভিন্ন জনজাতির verbal এবং non-verbal poetics এর বিপুল বৈচিত্র্য, তার সঙ্গে উত্তর-মার্কিনি ভারতীয় সংস্কৃতি, জাপানি সাহিত্য, দাদাইজম, ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রত্নপরিচ­­­­­­­­­য়- সব মিলিয়ে ‘Ethnopoetics’ নামে একটি অখণ্ড ভাবনা তিনিই প্রথম এনেছিলেন, যার সাহায্যে সারা বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া লিখিত ও অলিখিত সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে তুলে এনে তাকে বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে বেরিয়েছিল ‘Technicians of the Sacred’ নামের একটি সংকলন যেখানে আফ্রিকান, আমেরিকান, এশিয়ান ও ওশিয়ানিক কাব্যতত্ত্ব ছাড়াও সেইসব দেশের ধর্মীয় আচার ও প্রথার মূল পাঠ, চিত্রনাট্য, দৃশ্য ও শ্রাব্য সাহিত্য তুলে এনেছিলেন তিনি। ‘Alcheringa’ নামের প্রথম Ethnopoetics পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাঁর আদর্শে উজ্জ্বীবিত হয়ে পরবর্তী সময়ে আরো পত্রিকা বেরোতে থাকে এবং Ethnopoetics নিয়ে চিন্তায় এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়।

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জার্মানিতে, একজন মার্কিন সৈনিক হিসেবে। নিউইয়র্কে ফিরে তিনি অনুবাদ করতে শুরু করলেন দু’হাতে। পাউল সেলান এবং গুণ্টার গ্রাসের প্রথম ইংরেজি অনুবাদক তিনিই।

লেখালেখির প্রথম দিকে তিনি এবং রবার্ট কেলি স্প্যানিশ শব্দ ‘Cante Todo’- এর ছায়ায় লোরকাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে সামনে রেখে শুরু করেছিলেন ‘Deep Image’ আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে ‘Sound Poetry’ বা ধ্বনি কবিতা তাঁর অন্বেষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অর্থহীন শব্দাংশ (syllable), ধ্বনি, সুর, বিকৃত উচ্চারণ সবকিছু নিয়ে এমন কবিতা তিনি ভেবেছিলেন যেখানে কবিতা, গান, অর্থহীন জড়ানো শব্দ সবকিছুই একসঙ্গে চলেছে। এই কবিতা কোনো নির্দিষ্ট ভাষার নয়। একে লিখে বোঝানো যায় না, লেখাও যায় না সেই অর্থে। অর্থ খুঁজে পাওয়ার কোনো দায়িত্ব নেই। অর্থের বেড়া ডিঙিয়েই এখানে পৌঁছানো যায়।

অমিতাভ মৈত্র

অনুবাদক

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

সুশোভন দত্ত

ক বি তা

সু শো ভ ন   দ ত্ত

অতল

সূর্য উঠবে, চারদিকে সাজো সাজো রব—

বর্ণে বর্ণে অপূর্ব ছটা
ছুঁয়ে যাবে সাগরের জল,
হে অতল, তোমার ওই হাত

 

আমার এই স্লেটে রাখো,
যদি রাত্রি ভাঙে …

 

রাতের ব্যথারা জেগে থাকে

সকালের পাতার ছায়ায়

 

স্পর্শ

সুর থেমে গেছে,
অন্ধের মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি অনন্ত—
যদি

একদিন

খুব ভোরে বেজে ওঠে

পুরোনো কলের গান…

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

বৈশাখী রায় চৌধুরী

ক বি তা

বৈ শা খী   রা য়   চৌ ধু রী

সমাপ্তিসূচক

চাঁদ সাজতে গিয়ে দেখি

ছদ্মবেশ কি মারাত্মক ভ্রম!

 

ছড়িয়ে আছে পালক

যতবার ময়ূর হবো ভেবেছি

মাথার ওপর তাচ্ছিল‍্য ডেকে গেছে পোড়ামুখো কাক

 

অক্ষত কাঁচের ভিড়ে নিজেকে দেখাতে ভয় করে

যদি নিভে যায় প্রিয় সর্বনাম

আগলে রেখেছি শিখা

 

অন্ধকারে কীভাবে পৌঁছোবো তুমি অবধি?

 

হাতড়ে হাতড়ে দেখেছি তোমার ভেতর

আমি একটা কাঠের চেয়ার

 

বিশ্বাস করো তারপর থেকে একটা রাতও ঘুমোইনি

 

সারারাত তোমার বুকে মাথা রেখে শুনেছি

ঘুণপোকার তীব্র আর্তনাদ।

 

পূর্ণচ্ছেদ

চলো মুখোমুখি বসে লিখি আত্মহত্যার চিঠি

 

মৃত্যুর কারণ লিখে ফেলা সহজ নয়, যতটা সহজে লেখা যায় খুনের পদ্ধতি

তবু লেখো।

 

চৌকাঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগোছালো জীবনকে যতটা গুছিয়ে লেখা যায় লেখো।

 

হাড়-হাভাতে ভিখিরি একটা জীবন ;

 

নিজের জীবনকে আদ‍্যোপান্ত লিখতে গিয়ে যদি দেখো

আজ পর্যন্ত একটাও বিরাম চিহ্ন আঁকতে পারোনি ঠিকঠাক

 

আফসোস কোরোনা।

 

তুমি তো  বাংলা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক

আজীবন কবিতা পড়ে এইটুকু বোঝোনি?

 

শুধুমাত্র একটা পূর্ণচ্ছেদের অভাব কবিদের কী সাংঘাতিকভাবে বাঁচিয়ে দেয় প্রতিবার…

 

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

হাবিব টেঙ্গুর

অ নু বা দ  ৪

রূ প ক   ব র্ধ ন   রা য়

হাবিব টেঙ্গুরের কবিতা

জগাখিচুড়ি (Hodgepodge)


প্রথম সাক্ষাতে ওগুলো শুধুই অসংলগ্ন খেলা। গর্ত বোজানোর বিদঘুটে উপকরণ। অজ্ঞানতা প্রদর্শন। সাধারণত্বের সশব্দ ঘুষি। অভিজাতদের আনন্দ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক বৈচিত্র্য। এক অমৃত! আজকের পাঠক এই কৌশলগত জটিলতার খেলায় বিরক্ত। ভাষা নিয়ে এই দুষ্টু-মিষ্টি পরীক্ষার সে কিছুই বোঝে না। সংবাদপাঠক তার সঙ্গে অন্যভাবে কথা বলে। প্রতিদিন এক নতুন বিপর্যয় তাকে যন্ত্রণায় গিলে নেয়। রক্তস্নাত সংবাদ। একটা অপ্রয়োজনীয় অলংকরণের বুনোট, যার আছে অবোধ্য সোনালী সুতোর কাজ।

 


চর্চিত সীমাবদ্ধতা শব্দবিন্যাসকে মিথ্যা করে। শব্দভাণ্ডারের বিকৃতির মাঝে অন্তরগুলো নিবদ্ধ কটাক্ষ। আখ্যান কারণ মানে না। ঘটনাপ্রবাহ পরিবর্তনহীন। কিছু স্টাইলিস্ট, যারা এর মাঝে লক্ষণীয় স্বাধীনতা খুঁজে পান তাদের আনন্দ দেয়। তবে এসব ভেলকি খালি পেটকে চুপ করাতে পারে না। সর্বত্র এক দ্বিধাগ্রস্ত মর্মার্থের ধাক্কা। কর্তৃত্বের চাহিদায় ধারালো শব্দের খোঁজ করছে সে। আসলে বিকল্পগুলি সীমিত। ক্রিয়া আর বিশেষণের উপর বিশেষ্য বিরাজমান। উত্কট শীর্ষ-শব্দ। কাঁচা গালাগালি। রোগগ্রস্ত নিন্দা। অস্বাস্থ্যকর অশ্লীলতা। পশু বা মানুষের আপত্তিকর নামেরা। কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামকরণ। এ সমস্তই তুচ্ছ যাপন যা এক সামান্য বিরক্তি উস্কে দেয়।

 

করাল বহুস্বরতার আশেপাশে তার ঘোরাফেরা। মূকনাট্যের মাঝে আর কেউ একে-অপরের কথা শোনে না। সে বলে, এর মাঝে সবার জন্যেই কিছু না কিছু আছে। তবে তাতে কোনো মাত্রা যোগ হয় না। এটা একটা সাধারণ কলম রেখার প্রশ্ন নয়। তুমি দেখো একটা সামান্যতম শব্দের ওজন কীভাবে ভাষার উপর চেপে বসে। এটা খুঁজে বের করা আতঙ্কের হয়নি। তুমি রাস্তা পাওয়ার চিরতর সামান্য প্রত্যাশায় শব্দকোষের সামনে দ্বন্দ্ব-ভোগান্তির মুখোমুখি হও। একটা অবাধ লক্ষণ থাকলেও ভাষার অভাব বা প্রাচুর্য কোনোটাই নেই। সে এক নিবৃত্তিহীন রক্তক্ষরণ। একটা স্থানীয় রঙ যার উপর সময়ের ছাপ নেই।

এর বাইরে একটা আপাত শূন্যতা এক বিপরীত বৈষম্য সৃষ্টি করে।

 

‘কাফে মেরিনস (চিঠি)’ থেকে (From ‘Café Marines (Letters)’)

পোষ মানানো ভোঁদড় চামড়ায় মোড়ানো রাস্তাটা

তোমায় ভালবাসি মেয়েটি বলেছিল

 

একটা প্রতিধ্বনি অবধি নয়

বীয়ার ভাল না লেগেও বোতলটা খালি

 

নিঃশব্দ দৃষ্টির সন্ধেগুলো

 

মেয়েটি কি জানতো সে কীভাবে তাকে ভালবেসেছে

 

কানায় কানায় ভরা ব্রেসারীতে সে তার নাম উচ্চারণ করেছিল

যেখানে কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি।

 

মেয়েটি কি তার জন্য অপেক্ষা করবে?

 

একটা কাঁপা হাত কামড়ে ধরেছিল     সে দেখেছিল

আবারও মেয়েটির ভেজা হাসি               এবং

 

‘তালপাতা, জলসিক্ত তৃণভূমি আর ধাতুর পাত’ থেকে (from ‘Thatch, Water-Meadow and Sheet Metal’)

আমায় ভালবেসো, হায়…

যন্ত্রণা, অনুশোচনার আপতনে মেহনতি শরীর

(তোমার শরীর-স্নাত আমার হৃদয় নিয়ে আমি না মরে থাকি কী করে)

সুপ্রতিষ্ঠিত ভয় থেকে ছিঁড়ে যাওয়া স্বপ্ন

 

হায়, ভালবাসো আমায়

একের পর এক চিহ্নগুলো বিলুপ্ত হয় আর নৈঃশব্দ্যে হারিয়ে যায়

 

আর তুমি, অস্থির, নৈঃশব্দ্যের থেকে কী আশা করো…

 

‘‘ট্রাভার্সার’ থেকে (from ‘Traverser’)

একটা বছর শেষ হয়

সেটা আবার শুরু হয়

ওখানের ছাই

অসম্পূর্ণ অভিলাষ শিকার করে

তুষার ধূসরতা সেই কুটিলতা

একটা বিভ্রান্তিকর যাপন

টেঙ্গুর সমসাময়িক মাগ্রেবীয় কবিদের অন্যতম। ওঁর লেখায় ধরা পড়ে ঔপনিবেশিকতা এবং আলজেরিয়ার মানুষদের যাযাবরস্থানীয় পরিস্থিতি। হাবিবের বাবা সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। পুলিশি অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে পাঁচ বছরের হাবিবকে নিয়ে তার পরিবার ফ্রান্সে পালিয়ে আসে। পড়াশোনা শেষ করে টেঙ্গুর আলজেরিয়ায় ফিরে যান বাধ্যতামূলক জাতীয় সেবার কাজে।  নৃতত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাবিব লিখেছেন পনেরোটিরও বেশি বই।

হাবিব  টেঙ্গুরের লেখায় বার বার উঠে এসেছে “আইডেন্টিটি ইস্যুজ” এবং প্রথাগত ফরাসি লিরিকাল ফর্মের বাইরে বেরিয়ে উদ্ভাবনী আখ্যান রচনার প্রচেষ্টা । ২০১৬ সালে পেয়েছেন “দান্তে ইউরোপিয়ান পোয়েট্রি প্রাইজ”।

সুপ্রসিদ্ধ কাজ- 

Tapapaktaques, la poésie-île, 1976;

La Nacre à l’âme, 1981;

Schistes et Tahmad II, 1983;

Sultan Galiev, ou la rupture de stocks, 1985;

L’Épreuve de l’Arc, 1990.

ইংরেজি-

“Exile is My Trade”: The Habib Tengour Reader (Black Widow, 2012), সম্পাদনা ও অনুবাদঃ Pierre Joris.

Crossings (The Post-Apollo Press, 2013), অনুবাদঃ Marilyn Hacker,

এছাড়াও হাবিব আলজায়ার্সে “এপিক” প্রকাশিত “পোয়েমস অফ দা ওয়ার্ল্ড” সিরিজটির নির্দেশনা করেন।

রূপক বর্ধন রায়

অনুবাদক

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

শংকর চক্রবর্তী

বি শে ষ  র চ না

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি   

পর্ব ৪

ঝাড়বাতি

কিছুদিন আগে জেলা শহরের এক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য কলকাতা থেকে বেশ কয়েকজন কবিকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই তরুণ কবি। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সীমিত সামর্থ্যে যতখানি সম্ভব আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেননি। আসলে এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলির বেশিরভাগই আবেগনির্ভর― প্রিয় কবিদের সান্নিধ্য, আদানপ্রদান ও আড্ডাই ভালোলাগায় কেন্দ্রীভূত। তাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এ পরম্পরা বহুদিনের। অন্তত আমার নজরে তো গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের চিত্রগুলি এরকম ভাবনাতেই ধরা আছে। সেদিনের জেলা-শহরের সেই অনুষ্ঠানেও এমনই ছবি আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমন ঘটেনি। দেখা গেল, রাত্তিরে থাকার ব্যাপারে আমন্ত্রিত কবিদের নানারকম বায়নাক্কা। কেউ হোটেলের একটা ঘরে একাই থাকতে চান। কারো টয়লেট পছন্দ না হওয়ায় উদ্যোক্তাদের অন্য হোটেলের সন্ধান করতে বলেন। কারো রাতের খাবারের সঙ্গে পানীয়সহ রুটি-মাংস চাই। কেউ আবার নিরামিষাশী! তো, আয়োজক তরুণ কবিদের দুর্ভোগ দেখতে দেখতে নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল সেদিন। আমন্ত্রিত কবিদের প্রত্যেকেই তেমন দাবি করেননি যদিও, তবে অনুজ কবিদের আব্দারের বহর দেখে তো আরো অবাক হতে হয়েছিল। একাধিকবার এরকম ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমি। আবার অন্য ছবি দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল আমার। সেরকমই একটা ছবির কথা এখানে উল্লেখ করে অন্তত প্রমাণ করার চেষ্টা থাকুক যে, সকলেই নন, কেউ কেউ।

এটিও সত্তরের দশকের ঘটনা। বলাবাহুল্য আমি তখন শিলঙেই। আমার সেজমামা রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে চাকরির সুবাদে গুয়াহাটির মালিগাঁও-এ কোয়ার্টারে থাকতেন। প্রচুর পড়াশোনা করতেন আর সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর পছন্দের অঙ্গন। ফলে গুয়াহাটির অনেক কবি-লেখক-অধ্যাপকই তাঁর বাড়ির আড্ডায় শামিল হতেন নিয়মিত। আমিও মাঝে মাঝে শিলং থেকে সেখানে গিয়ে সেইসব আড্ডায় যোগ দিয়েছি।

একবার ‘মল্লার’ নামের এক মিনিপত্রিকার আয়োজনে শিলঙে একটি সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হয়। আমার ওপর শুধু দায়িত্ব ছিল কলকাতা থেকে আয়োজকদের পছন্দের কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ গ্রহণে রাজি করানো এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার। এটুকুই। কলকাতা থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত আকাশপথ এবং বাকিটা সড়কপথে শিলং পর্যন্ত। মাত্র দু’দিনের ভ্রমণ। আয়োজকদের এই চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো এসে পৌঁছোলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং অমিতাভ চৌধুরী। অমিতাভদা তখনও আনন্দবাজারে, যুগান্তরে যাননি। এঁরা উদ্যোক্তাদের কাউকেই চেনেন না। এবং থাকা-খাওয়ার ব্যাপারেও কোনো অভিযোগ ছিল না ওঁদের। হল-ভর্তি দর্শক-শ্রোতা নিয়ে অনুষ্ঠানটিও জমজমাট ছিল।

তো, সমস্যা হল পরের দিন সকালে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর গাড়ি করে সোজা গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে গিয়ে সন্ধের ফ্লাইট ধরার কথা। কিন্তু উদ্যোক্তাদের পাত্তা নেই! ফেরার টিকিটও দিয়ে যাননি। আর যেহেতু আমিই আমন্ত্রিত চার অতিথির অবলম্বন, তাই দিশেহারার মতো ঘুরছি। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সুনীলদা শুধু একবার খুবই নিচু স্বরে জানালেন যে পরের দিন সকালে তাঁর একটা জরুরি কাজ আছে। হোটেলের ফোন থেকে আয়োজকদের একজনকে ফোন করে জানতে পারলাম যে, চারটে টিকিটের টাকা তখনও জোগাড় হয়নি। তবে খুব শিগগিরই টিকিট কেটে তাঁরা হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যাবেন বলেই তাঁদের বিশ্বাস। তবে সেক্ষেত্রে পরের দিন দুপুরের ফ্লাইট ধরতে হবে আমন্ত্রিতদের। অপরাধীর মতো এসে ওঁদের জানাই সে কথা। শুনে শক্তিদা হেসে বললেন, ‘আমাদের জন্য তুমি পড়েছ বিপদে।’ সুনীলদা শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরো একদিনের হোটেল-ভাড়া দিতে ওঁদের অসুবিধা হবে না তো?’ আমি তখন সাহস নিয়ে বলেছিলাম, ‘টিকিট হাতে পেয়েই যদি আজ আমরা গুয়াহাটি চলে যাই? আর রাতটুকু সেখানে আমার মামার বাড়ি থাকি, অসুবিধা হবে?’ শক্তিদা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে আমাকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। ওখানেই থাকব আমরা।’ আসলে শক্তিদা কলকাতা থেকে একদিন আগেই এসেছিলেন এবং আমি গুয়াহাটি গিয়ে তাঁকে আমার মামার বাড়িতেই রেখেছিলাম। যাই হোক, সেদিন বিকেলের মধ্যেই আয়োজকদের কয়েকজন টিকিট নিয়ে হাজির। এবং দেরির জন্য তাঁরা মার্জনা চেয়ে নিলেন। একটা লিটল ম্যাগাজিনের এইসব তরুণ কর্মীদের ভর্ৎসনা তো করেনইনি, উল্টে সুনীলদা ওঁদের আয়োজনের যথেষ্ট প্রশংসা করলেন।

সন্ধের সময় গুয়াহাটির মালিগাঁও-এ পৌঁছোলাম আমরা। রেল কলোনির অনেকেই ছুটে এসেছিলেন প্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ না করে সুনীল-শক্তি-শীর্ষেন্দু-অমিতাভ সবার সঙ্গেই সহযোগিতা করলেন। অমিতাভ চৌধুরীর এক আত্মীয় থাকতেন হাসপাতালের কাছেই। তো তিনি সেখানে চলে গেলেন। রাতে সেখানেই থাকবেন। সেবার শক্তিদা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন মীনাক্ষী বৌদি ও ছোট্ট তাতার-তিতিরকে। ফলে রাতের খাওয়া শেষে আমার মামী পাশের ঘরে বৌদি, তাতার, তিতির ও ছোট্ট মামাতো বোনকে নিয়ে ঘুমোতে গেলেন। আমি ও আমার মামা পাশের একটা ঘরে। আর সামনের ঘরের একটা খাটে ওঁরা তিনজন। মাঝখানে শীর্ষেন্দুদা আর তাঁর দু’পাশে শক্তিদা ও সুনীলদা। মনে আছে, এমন কিছু বড়ো খাট ছিল না সেটি। স্রেফ লিটল ম্যাগাজিনের কয়েকজন তরুণ কর্মীদের কথা ভেবে ওঁদের এই ত্যাগ স্বীকারের কথা আমি এখনও ভুলিনি। আমার মামা প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। মামীও সদ্য প্রয়াত। শুধু সেই ঐতিহাসিক খাটটি এখন স্মৃতি-ভারে নিঃসঙ্গ।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

ভিনদেশে । পর্ব ৫

ভি ন দে শে । পর্ব ৫

সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার  কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে  আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।

ঈ শি তা  ভা দু ড়ী

অ্যান্ডারনফ ও অন্যান্য

সালটা ১৯৯৪, আজ থেকে ২৬ বছর আগের কথা। আমার আর সোমার মাথায় পোকা নড়ে উঠল, আমরা ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। বাজেট ভ্রমণ করতে চাইলে অবশ্যই ইউরেল পাস কিনে নিয়ে ট্রেনে ট্রেনে বেড়ানো এবং ইয়ুথ-হস্টেলে থাকা সঠিক কাজের মধ্যে পড়ে। কিন্তু যেহেতু সেবার আমাদের প্রথম বিদেশ-ভ্রমণ এবং আমাদের বয়সও যথেষ্ট কম, তাই একা-একা বিদেশ বিভুঁইয়ে ঘুরে বেড়ানোর সাহস আমাদের ছিল না, যদিও দেশের চেয়ে বিদেশে একা একা ভ্রমণ অনেক নিরাপদ, একথা বুবুনদা আমাদেরকে বোঝালেও আমরা ১৯৯৪ তে  বুঝিনি, পরবর্তীতে অবশ্য আমাদের সমস্ত বিদেশ ভ্রমণই আমরা নিজেরা করেছিলাম। কিন্তু ১৯৯৪ তে আমরা লন্ডন থেকে  কসমস ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে ইউরোপ ট্যুর করেছিলাম।

আমস্টারডাম থেকে জার্মানির পথে। আমাদের দলে সাতচল্লিশ জন ছিল। আমস্টারডাম থেকে আরও তিনটি মেয়েকে পেলাম, শ্রীলঙ্কা থেকে বেড়াতে এসেছে, তারা অন্য দলে ছিল, কোনও কারণে বাস-ছুট হয়েছে তাদের। বিদেশ-বিভুঁইতে একদম পথে বসেছে যাকে বলে। অতএব, কার্লো, আমাদের গাইড ওই তিনজনকে আমাদের বাসে তুলে নিল। 

কোলোনে বিরতি। কোলোন রাইনল্যান্ডে ঢোকার মুখে প্রথম শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবর্ষণে আগাগোড়া ধ্বংস হয়েছে একসময়। কিন্তু বিখ্যাত ক্যাথিড্রালটি অবিচল দাঁড়িয়ে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ক্যাথিড্রাল গথিক আর্কিটেকচারে এমনই অনন্য, দেখে আশ্চর্য হতে হয়। ৫১৫ ফুট লম্বা দুটি টাওয়ার এই চার্চের মূল অংশ। আজ অবধি বিশ্বের সকল চার্চের মধ্যে এই দীর্ঘতম ক্যাথিড্রালের অর্ধেক অংশও আমার ক্যামেরায় আনা গেল না বলে খুবই কষ্ট পেলাম। চার্চের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রয়োদশ শতাব্দীর চিত্রিত জানলা, চতুর্দশ শতাব্দীর উঁচু বেদি, পঞ্চদশ শতাব্দীর চিত্র ইত্যাদি। গায়কদের জন্য নির্দিষ্ট আসন ১৩১০ সাল থেকে আজ অবধি রয়েছে, জার্মানিতে সবচেয়ে বড় সেটি, ১০৪ জন বসতে পারেন সেখানে। এছাড়াও আরও অনেক কিছুই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম তিন ডয়েস মার্কের (তখনও ইউরোর আমদানি হয়নি) বিনিময়ে। ক্যাথিড্রাল লাগোয়া Wallraf-Richartz মিউজিয়াম এবং মিউজিয়াম Ludwig চত্বর রাইনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়াম, ত্রয়োদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর সংগ্রহ রয়েছে। এখানে, রুবেন্স, রেমব্রান্ট, ভ্যান ডিক এবং ফ্রান্স হালস্ প্রমুখের শিল্প কীর্তি সযত্নে রক্ষিত, পিকাসোর সংগ্রহ অতুলনীয়। এখানে সঙ্গীতানুরাগীদের বিরাট কনসার্ট হল রয়েছে।  মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্য ৮ ডয়েস মার্ক ছিল তখন। আমরা গরিব মানুষ, বিদেশে খরচ করতে গেলেই মূল্যটা এসেই যায়।  

ক্যাথিড্রালের উল্টোদিকে Romisch-Germanisches মিউজিয়াম, ১৯৭০-১৯৭৪ সালে তৈরি। কাছেই অলটার মার্কেট এবং Altes Rathaus, জার্মানির সবচেয়ে পুরনো টাউন হল।

কোলোন চার্চ
রাইন নদীর ধারে ভিলেজ

কোলোন থেকে বন। ২০০০ বছরের পুরনো শহর। ১৭৭০ সালে বিথোভেন এখানে জন্মগ্রহণ করেন। সেই বাড়িটি নাকি এখন মিউজিয়াম। আমরা অবশ্য বন-এ কিছুই দেখিনি। শুধুমাত্র বন-এর নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে রাইন নদীর পাশে পাশে আমাদের বাস চলল। রাইন ইউরোপের একমাত্র নদী যার সঙ্গে ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। বর্বর জার্মান গোষ্ঠী এবং সভ্যতার সাক্ষী এই রাইন নদী। শুধুমাত্র জার্মানিতেই এই নদীর অস্তিত্ব তা নয়, ১৩১২ কিলোমিটার পথ পার হয়ে আল্পসের গভীর পথ ছাড়িয়ে সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানির পর নেদারল্যান্ডে ঢুকে নর্থ-সি-তে মিশেছে, তবে রাইনের সৌন্দর্য প্রবলভাবে মাইনজ আর কোলোনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিরাজমান। ছোট ছোট পাহাড়, বন, নদী, নদীর পাড়ে ছোট ছোট গ্রাম এবং সেইসঙ্গে একাধিক পুরনো ক্যাসেল।

সন্ধেবেলা ‘অ্যান্ডারনফ’-এ গিয়ে পৌঁছলাম। খুব ছোট্ট একটি জায়গা। যে হোটেলে ছিলাম সেটিও খুব ছোট। এমনই যে, আমি আর সোমা মাংস খাই না বলে আমাদেরকে আলুসেদ্ধ ও ভাত খেতে দিয়েছিল সেখানে, হোটেল কর্তৃপক্ষ অন্য দ্বিতীয় কোনও খাবার খুঁজে পাননি। জার্মানদের অবশ্য আলু খুব প্রিয় খাদ্য।

হোটেলে আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে সামনের রেলস্টেশনটিকে দেখে বেশ ছোটই মনে হল। কিন্তু সব মিলিয়ে জায়গাটিকে পছন্দ হল বেশ। যদি ইউরেল পাস নিয়ে ট্রেনে-ট্রেনে বেড়াতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমরা অ্যান্ডারনফ-এর মতো ছোট্ট জায়গায় যেতাম না, একটা সুন্দর জায়গা আমাদের দেখা হত না। এরকম লক্ষ লক্ষ ভাল জায়গা আমরা দেখিনি। আগেই লিখেছি, আঠারো বা কুড়ি দিনে পুরো দেশ দেখা সম্ভব না।

যেখানে মোসেল নদী রাইন নদীর সঙ্গে মিশেছে তার কিছু আগে কোব্লেজ শহর, খুবই ব্যস্ত এবং উল্লেখযোগ্য এই শহর মদ্যপানীয়র জন্য বিখ্যাত। দু’হাজার বছর আগে এই শহর রোমানদের অধীনে ছিল। এখনও বহু চার্চের সিন্দুক থেকে রোমান ঐতিহাসিক সামগ্রী পাওয়া যায়, বিশেষত সেন্ট ফ্লোরিন এবং সেন্ট ক্যাস্টর চার্চ থেকে। এই শহর জুড়ে বিভিন্ন ক্যাসেল ও প্যালেস, পায়ে হেঁটে বেড়ানোর জন্য খুবই আকর্ষণীয়। এখন অবশ্য বেশির ভাগ পুরনো বাড়ির নিচে বার বা নাইট ক্লাব হয়েছে। Ehrenbreitstein ক্যাসেলটি রাইনের পূর্ব পাড়ে খুবই মনোহর, বিশেষত কেবল কারে করে যাওয়ার পথটি। আমরা জুনের শেষে গিয়েছিলাম, শুনেছি আগস্ট মাসের তৃতীয় শনিবারে ভীষণ বাজি পোড়ানোর অনুষ্ঠান হয় এবং রাইন নদীকে আলো দিয়ে সাজানো হয়। ফোর্টের ভেতর মিউজিয়ামে রাইন উপত্যকার শিল্প ও প্রযুক্তিগত প্রগতির নিদর্শন রয়েছে।

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

ফ্রেডরিখ নীৎশে

অ নু বা দ  ৩

শ তা নী ক   রা য়

ফ্রেডরিখ নীৎশের কবিতা

‘রসিকতা, ধূর্ত, ও প্রতিশোধ’ (‘Joke, Cunning, and Revenge’)

 

আমন্ত্রণ (Invitation)

 

আহ্বান করছি আমার আহার গ্রহণে, প্রিয় রাত্রিভোজন!

আগামীকাল এসো এটা আরও সুস্বাদু লাগবে

আর পরশু আরও ভালো!

যদি তুমি এখনও আরও চাও— আমি তৈরি করব,

অতীত অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করো সেটা, 

খাদ্যকে ব্যবহার করো চিন্তাকে খাদ্যে বদলানোর জন্য।

 

আমার আনন্দ (My Happiness)

 

যেহেতু আমি খুঁজতে গিয়ে ভঙ্গুর হয়েছি

আমি অতঃপর নিজেকে খোঁজে রত থাকতে শিখিয়েছি।

যদিও এলোপাথাড়ি ঝড় আমার জাহাজকে মাতিয়েছে

আমি সামনে ভেসে গিয়েছি সব ঝড় সঙ্গে করে।

 

উচ্চতার মানুষেরা (Higher Men)

 

সে উচ্চতায় ওঠে— তাকে আমাদের প্রশংসা করা উচিত! 

কিন্তু সেটা সবসময় উচ্চতা থেকে আসে!

প্রশংসায় অভ্যস্ত হয়ে সে নিজের দিনযাপন করে,

সে আদপেই সূর্যরশ্মি!

 

Ecce Homo

 

হ্যাঁ! আমি এখন জানি কোথায় এসেছি!

আগুনের মতো অতৃপ্ত

আমার উজ্জ্বল শিখা আমাকে অপচয় করে।

সবাইকে আলোকিত করেই আমি থামি,

সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে আমি ছাড়ি:

আমি যথাসম্ভব একটি শিখা!   

           

আমার সঙ্গে চলো-নিজের সঙ্গে চলো (Vademecum-Vadetecum)

 

আমার ভঙ্গি আর ভাষা আলাপ করে তোমার সঙ্গে। 

তুমি অনুসরণ করো আমাকে, অনুধাবন পর্যন্তও করো?

তোমার আপন সত্তার তাগিদে আর সত্যি অর্থে:

অবশ্যই আমাকে অনুসরণ করো, কিন্তু অল্পবিস্তর!

 

 

[টীকা: Vademecum শব্দটি একটি লাতিন শব্দ যার অর্থ ‘আমার সঙ্গে চলো’, যেটা ইঙ্গিত করে সেই বইটার দিকে যেটা একজন মানুষ সবসময় বহন করে চলে। Vadetecum নীৎশে প্রদত্ত কনসেপ্ট যার অর্থ ‘নিজের সঙ্গে চলো’।]   

ফ্রেডরিখ নীৎশে ১৮৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন জার্মান দার্শনিক। ১৮৯০-এর সময়কালে তিনি খ্যাতিলাভ করেন একজন দার্শনিক হিসেবে, যিনি কবিতাও লিখতেন। অনেক ছোটোবেলায় তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন এবং সে-কবিতাগুলোকে দার্শনিক কবিতা হিসেবে মেনে নেওয়া যায়। তাঁর অধিকাংশ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন দর্শনের গ্রন্থে। তাঁর কবিতার সংকলন ‘ldyllen aus Messina’ ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় তৎকালীন কোনো পত্রিকায়। ‘Dionysos-Dithyramben’ তাঁর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কবিতার গ্রন্থ। ১৯৯৮ সালে বৃহৎ আকারে সর্বপ্রথম তাঁর কবিতার সংকলন ‘Gedichte und Spruche’ প্রকাশিত হয়। এখানে আমি তাঁর দর্শন গ্রন্থ ‘The Gay Science’-এর প্রথম ভাগে যে-কবিতাগুলো আছে সেখান থেকে কিছু কবিতার অনুবাদ করার প্রয়াস করেছি।

শতানীক রায়

অনুবাদক

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

নিজিম এজেকিয়েল

অ নু বা দ  ২

ঈ শা নী   ব সা ক

নিজিম এজেকিয়েল-এর কবিতা

সেই বিছের সঙ্গে কাটানো রাত

আমার সে রাতের কথা মনে পড়ে যে রাতে আমার মাকে বিছে কামড়েছিল। দশ ঘন্টা একটানা মুষলধারে বৃষ্টি ওকে চালের বস্তার নিচে লুকিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। নিজের বিষের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মুহূর্তে তার লেজের ঝাপট অদৃশ্য হয়ে গেছিল অন্ধকার ঘরে।

 

কৃষকরা দলে দলে মাছির মতো উড়ে এসে ভনভন করে ঈশ্বরের নাম করছিলো যাতে অপদেবতাকে পঙ্গু করে দিতে পারে।

 

মোমবাতি আর লন্ঠনের আলো জুড়ে সমস্ত দেওয়ালে দৈত্যসম ছায়া সেই বিছের। কাদামাটির দেওয়ালে ওই দীর্ঘ ছায়া অথচ তারা তাকে খুঁজে পায় না। ওরা বলছিলো যতবার সেই বিছেটি নড়েচড়ে আমার মায়ের রক্তে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নাকি তার বিষ।

 

তারা প্রার্থনা করে যাতে এ জন্মে আমার মায়ের এত কষ্ট তার পুনর্জন্ম হলে দুর্ভাগ্যের বোঝা কমিয়ে দেয়।

 

এই অনুপস্থিত বিশ্বে সমস্ত শয়তান যেন কমে আসে ভালোর তুলনায়। মায়ের ব্যথা যেন মেরে ফেলে সেই রক্তবীজকে।

 

মা যেন এই বিষের জ্বালায় মুক্তি পান উচ্চাশা, মোহমায়া থেকে। তারা ঘিরে বসেন মায়ের চারিদিকে। তাদের মুখে প্রগাঢ় শান্তি। আরো মোমবাতি, লন্ঠন, প্রতিবেশী, পোকা, একটানা বৃষ্টি। আমার মা ছটফট করতে থাকেন মাদুরে শুয়ে।

আমার বাবা একজন যুক্তিবাদী, বাস্তব অভিমুখী মানুষ। সমস্ত পুজো, ওষুধ, টোটকা, আয়ুর্বেদ ব্যবহার করেছেন তিনি। তিনি কিছুটা মোম ঢেলে দেশলাই জ্বালান যে পায়ে কামড়েছিল সেই হতভাগা সেখানে। আমি দেখতে থাকি এক ধর্মঅন্তঃপ্রাণ পুরুষ কীভাবে শেষকৃত্য করছে বিষ কে বশে আনার জন্য। কুড়ি ঘন্টা পর সেই বিষ নেতিয়ে পড়লো।

 

আমার মা খালি বলেছিলেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে নিলেন আমার সন্তানদের ছেড়ে…

 

বম্বেতে এক ইহুদি বিবাহে

তার মায়ের চোখ থেকে দু ফোঁটা জল পড়েছিল ঠিকই কিন্তু তিনি সত্যিকারের কাঁদছিলেন না। এই কান্নার সময়টুকু তাঁর কাছে আনন্দঘন ছিল। কনের দুঃখের সমব্যথী হতে চাইতেই সে হাসতে হাসতে বললো, বোকার মতো কোরো না।

 

তাঁর ভাইয়েরা আমার জুতো লুকিয়েছিল। সে জুতো ফেরত পেতে তাদের আমাকে টাকাও দিতে হয়েছে। এই খেলাটায় আশপাশের প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা মজা পেয়েছিল। এমন ব্যাজারমুখো জেদি বর তারা দেখেনি।

 

পণ নিইনি। ওরা জানে আমি খুব আধুনিক, পণপ্রথায় অবিশ্বাসী। তাঁর বাবা যখন জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েকে কতটা গয়না দেবেন, আমি জানিয়েছিলাম যে এ বিষয়ে আমি অজ্ঞ। ভদ্রলোক হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন।

 

বাইরে সিনাগগের কাছে কোনো ব্যান্ড পার্টি নেই। তবে কিছু নিয়ম পালন করে প্রার্থনামিছিল যাচ্ছিল। কত লোক টুপি, হ্যাট , রঙিন শাল পরে চলেছে। বরকনের জন্য একটিই আঙুরের সরবতের গ্লাস রাখা। বর ও কনের জন্য …

 

আমার এখনো মনে পড়ে গ্লাস ভাঙার মুহূর্ত । সমস্ত জমায়েত উল্লাসে ফেটে পড়ে। মোজেকের বিধান অনুযায়ী আমরা নাকি সুখী বিবাহিত অবশেষে।

 

ব্যস এটুকুই। আমার আর কিছুই সেরকম সুন্দর মনে হয়নি। আমরা আসলে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। কত কিছুই আমরা বিশ্বাস করি তাই না?

 

সবথেকে গোঁড়া লোকটিও গরু খেতেন কেন না তা খুবই সস্তা ছিল। তারা কখনো কখনো শুয়োর খাবার ঝুঁকিও নিতেন। সাবাথ শুধুই খানা পিনা, কথা দেবার খেলা।

 

সেরকম কিছু জাঁকজমক নেই, ছিমছাম অনুষ্ঠান । আমার বাবা বলতেন রক্ষণশীল মানুষজন জানেন কোথায় থামতে হয় নিজেদের কূটবুদ্ধি দিয়ে । বাবা নিজেই খুব লিবারেল ছিলেন যদিও যতক্ষণ না কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়। আমার মা যদিও গর্বিত ছিলেন মুক্তমনা বলে।

 

যাইহোক যেটা বলছিলাম, এইসব হাততালির পর আমরা লোবো আর ফার্নান্ডেজের ফোটোগ্রাফি স্টুডিওতে গেলাম। ওঁরা বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী। বিভিন্ন বিবাহের ছবি তুলতে সিদ্ধহস্ত । আমি আর আমার বউ এরপর রান্নাঘরে মাটিতে পাতা মাদুরে শুতাম ও মাঝেমাঝেই কাছে আসার জন্য জোর করতো তাই আমরা …

 

দশ বছর লেগেছিল আমার স্ত্রী’র আমাকে জানাতে যে তার একদম ভালো লাগেনি সেইসব কাছে আসার ক্ষণ।

আমি অকৃতকার্য …

এটুকুই কী আমার পক্ষে সম্ভব, তার প্রশ্ন। আঠারো মাস লন্ডনে থেকে আমি প্রায় পুরো প্রশিক্ষণ ভুলতে বসেছিলাম।

 

আমাদের প্রথম ঝামেলাতে বিয়ের পর ও জিজ্ঞাসা করেছিল , আমার কাছ থেকে কেন কেড়ে নিলে আমার পর্দা। আমি তো ফেরত দিয়ে দিতাম খুশি মনে। একটা বইয়েও লেখা নেই কীভাবে দিতে হয় ফেরত। জানলে হয়তো…

 

লিখিও উহা ফেরত চাও কিনা …

নিজিম এজেকিয়েল একজন ভারতীয় ইহুদি কবি এবং অভিনেতা, শিল্প-সমালোচক। তিনি এমন এক ভারতীয় কবি যাঁর ইংরেজি কবিতায় এক অসামান্য শৈল্পিক সত্তা লুকিয়ে আছে। ভারতীয় ঘরানার ইংরেজিতে লেখা তাঁর এই কবিতাগুলি চিরস্মরণীয়। তাঁর ‘ল্যাটার ডে সামস’ নামক কবিতাসমগ্রের জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন।

এজেকিয়েলের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম হল- দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া, দা আনফিনিশড ম্যান, হিমস ইন ডার্কনেস ইত্যাদি। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতার নাম নাইট অফ দা স্করপিয়ন, দ্য প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার ইত্যাদি। সরল ইংরেজি ভাষার ব্যবহার, অতি শ্রুতিমধুর কবিতা, অত্যন্ত ভাবে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে লেখা নিজিমের কবিতা সর্বদাই পাঠকের প্রিয়।

ঈশানী বসাক

অনুবাদক

আরও পড়ুন...

Categories
2020_sep

অক্তাভিও পাজ

অ নু বা দ  ১

রা জী ব   চ ক্র ব র্তী

অক্তাভিও পাজ-এর কবিতা

শেষ ঊষা

তোমার চুল হারিয়ে গিয়েছে এই বনে,

পায়ের শব্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে নিয়ত আমায়।

 

ঘুমন্ত তুমি রাত্রির চেয়েও বড়ো,

তবু স্বপ্নগুলো এই ঘরেই হেঁটে বেড়ায়।

 

আমরা কে কতো বড়ো কেই বা ক্ষুদ্র কতো!

 

প্রেতেদের নিয়ে

ট্যাক্সিটা চলে যায়।

 

বহতা নদীটি

পিছু হটে অবিরত।

 

আগামীকাল কি বদলাবে দিন, জানো?

 

সাবুদ

সূর্যালোকে পান করে কেশরী তরল

তার দু’টি চোখ যেন উড়ন্ত হরিণ।

 

নির্মম সে স্রষ্টা, তাকে হেলায় হারান,

বিস্ময় জাগে তবে, তিনি কি দৃষ্টিহীন?

 

এ বিস্ময় নেহাতই অন্ধত্বের নয়:

এই নারী বস্তুতই তরঙ্গবল্লরী।

 

বুদ্ধের নিদান তাই এখানে সাবুদ,

ব্রহ্মান্ড নিজেই সৃষ্ট, প্রকল্পবিহীন।

 

সেতু

এখনও এই মুহূর্তের মাঝে,

আমার ও তোমার মাঝে,

এক ঝুলন্ত শব্দের নাম হলো সেতু।

 

ওখানে দাঁড়াও,

তুমি ওখানে দাঁড়াও:

পৃথিবীর সাথে যুক্ত হও

বলয়ের মতো ঘোরা বন্ধ করো।

 

এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে

রামধনুর মতো টানটান ধরে রাখো তোমার শরীর,

যেন তার বিস্তীর্ণ বাঁকে

আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি নিরন্তর।

 

অস্বচ্ছতার বহির্গৃহ

ওগো লাস্যময়ী

পারিজাত গাছের মতো তুমি মেলে আছো মুখ ওই সূর্যের দিকে

 

আমার খোলা পাতার ওপর

                পড়েছে কি কোনোদিন

                           তোমার নজর?

 

তোমার অনন্তলাস্যে

           বশীকরণের অসীম ক্ষমতা

                                   মিশে আছে।

 

তবুও বিস্ময় জাগে, ক’টি কবিতাই বা 

তোমার জন্য লেখা হয়?

কতজন দান্তে-ই বা বলো তোমার জন্য

               কবিতা সাজায়, বিয়াত্রিস,

 

যেখানে তোমার যত দমিত বিভ্রম

কিম্বা রহস্যেরা খুঁজে পায়

                            স্বাধীন আশ্রয়।

 

একটি কবিতা

                                 হাওয়ার বাঁশি

ছাইয়ের গাছে

                                  আলোছায়ার

ঝর্না নাচে

                                    জলের কণ্ঠ

উচ্ছ্বাসহীন

                                     প্রতিধ্বনি

হাতের ভাঁজে

অক্তাভিও পাজ এর জন্ম ৩১ মার্চ, ১৯১৪ সালে মেক্সিকো শহরের  একটি রাজনৈতিক পরিবারে। মেক্সিকোর বিপ্লবের পর তাঁরা সপরিবারে লস এঞ্জেলিসে চলে আসেন। পরবর্তীতে অবশ্য আবার ফিরে যান স্বদেশে।

পাজ-এর কবিতাকে প্রভাবিত করেছিল মেক্সিকো, ইউরোপ ও স্পেনের কবিদের লেখনী।

১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সাংস্কৃতিক শাখার আমন্ত্রণে তিনি স্পেনে যান ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি প্রভাবিত হন সুররিয়াল কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে।

পাজ কর্মসূত্রে ফ্রান্স (১৯৬৯) ও ভারতে (১৯৬২) মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলে এখানকার হাংরি আন্দোলনের সঙ্গেও পরিচিত হন। উল্লেখ্য, প্রতিটি দেশ ও কাব্যধারাই পুষ্ট করেছে তাঁর কবিতাকে।

১৯৯৮ সালে মৃত্যুর কিছুকাল আগে (১৯৯০) তিনি সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর কয়েকটি কবিতার অনুবাদ এখানে করা হলো ইংরেজি অনুবাদ থেকে, যেগুলি তাঁর সুবিপুল রচনাসম্ভারের বিচ্ছিন্ন কিছু নমুনা স্বরূপ বলা যায়।

রাজীব  চক্রবর্তী

অনুবাদক

আরও পড়ুন...