Categories
2021_april

উজ্জ্বল পাঠ । পর্ব ১০

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ১০

সে লি ম   ম ণ্ড ল

সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কমরেড: কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়

কথা দিয়েছিলাম— এই ধারাবাহিকে দশটি পর্ব লিখব। ন-টি পর্ব লেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, কাকে দিয়ে শেষ করব। দীর্ঘ লিস্ট বানিয়ে রেখেছি… বাংলায় এখন বিধানসভা নির্বাচন চলছে। নির্বাচন ঘিরে চারিপাশ উত্তপ্ত। এবারের ভোট ঘিরে মানুষের আগ্রহও অনেক। এইসময় আমার মনে পড়ছিল একটি নাম। কবি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়। যিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পেশাগতভাবে ছিলেন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার একজন শ্রমিক। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক কনভেনর।

 

কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় অদ্ভুতভাবে। সে-ও বছর চার-পাঁচ হবে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে দেখি— কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা সংগ্রহ’ পড়ে। কবির স্বাক্ষরসহ। দু-চার পাতা পড়ে বেশ ভালো লাগে। পুরোনো বইয়ের দাম হিসেবে অনেক বেশি দাম বলছিল। তখন হাতখরচ বাঁচিয়ে বই কিনতাম। সেদিন আর কেনা হয়নি… পরে যেদিন কলেজ স্ট্রিট যাই, দেখি— বইটি তেমনই পড়ে। কিনে নিই।

কবিতায় কোনো মৌলবাদে আমি বিশ্বাসে নই। সব ধরণের কবিতা পড়তে ভালোবাসি। তবে হ্যাঁ, লেখার ক্ষেত্রে তাঁকে গ্রহণ করব কিনা সেটা অন্য ব্যাপার। যদিও আমরা যাঁরা লিখিয়ে তাঁরা একটি লেখা পড়ি ‘gain’ করার জন্যই। সেটাও আবার নির্ভর করে কে কী ‘gain’ করতে চায়!

 

জীবন সবসময় সোজা লাইনে থাকে না। কখনো কখনো বেঁকে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও। সেখানে রণহুঙ্কারে প্রয়োজন। কবিতা কেন সবসময় নিশ্চুপ বা অবস্থানহীন অসাড় সম্ভাবনা হয়ে সাদা পাতায় গুমরে থাকবে! কখনো কখনো জাগিয়ে তুলতে হয়। কেষ্ট চট্টোপাধ্যায় রাজনীতি সচেতন কবি। রাজনীতির মানুষ। কারখানার ইউনিয়নের নেতা। তিনি অনুভব করেছিলেন— মানুষের জন্য, স্বৈরচারী শাসকের বিরুদ্ধে লিখতে হবে। তাঁর অধিকাংশ কবিতা মিছিলের কবিতা, আন্দোলনের কবিতা, মানুষের রুজির কবিতা, মানুষের রুটির কবিতা…

 

পড়া যাক তাঁর কিছু কবিতা—

 

শ্রমিক

 

এখনো হুইলখানা মেশিনের উপর চাপানোই আছে

কী সুন্দর উজ্জ্বলতা তার ধাঁধাচ্ছে চোখ

কারখানার শপে।

আমার মুখের ছবি তারই উপর পড়ে

খুলে যাচ্ছে পর্দার আড়াল।

 

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার নিখাদ প্রতিচ্ছবি—

দীনতার কী অস্থির ছিবড়ে কঙ্কাল।

 

দিল্লির মসনদ

 

এখন আমরা সকলে সাফ-সুফ বুঝে ফেলেছি

কারখানার কিছুই আমাদের হাতে দেয়নি মালিক সাহাব

হররোজ উৎপাদনের সব রেকর্ড নস্যাৎ করে

গোপন চক্রান্তে তসবিরে ঢালিস কালি

তবু     আমরা একরকম গায়ে পড়ে আলোচনায় গেছি

এবং বিক্ষোভ হরতাল করে সাফ-সুফ সমঝ গিয়া

এদের কাছে আমরা     বিদেশি।

 

অভি    কুছ-কুছ আমলা লোগ।

দ্বন্দ্বের ঘোলা জলের ডোবার মধ্যে পড়ে বুঝেছে

তারা কত মরদ

যারা খিলৌনা হতে চায়নি তাদের দু-একজনের বুকের পাটা ছিঁড়েছে সুতো

এর কিছু কথা শেডের নীচে ফাঁক বুঝে পালিয়ে এসেছে।

 

ভাই লোগ

কোথায় কি ফুল ফোটালে বাগানের শোভা বাড়ে

তা আমরা যতই জানি     দিল্লির মসনদ    বেহদ গুস্তাখী।

 

মুখোশ

 

ছোটবেলায় আমি যখন মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াতাম

খুব মজা লাগত।

বন্ধুদেরও বিভিন্ন রকমের ছিল;

দেখতাম পরস্পরের মুখ।

বড়ো হতে-হতে দেখছি তার সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে গেছে।

 

সেই— ছোটবেলার মুখোশটা যেমন থেকে গেছে আমার মুখের সাথে

তেমনি অন্যদের মুখেও আছে; রক্তে মিশে গেছে সে সব।

এখন আমার ছেলেকে আর মুখোশ কিনে দিতে হয় না

সে পেট থেকেই নেমে এসেছে খচ্চরের মতো

দ্বিতীয়টি প্রধান মন্ত্রীর মতো, তৃতীয়টি শিক্ষামন্ত্রী

একটাও মানুষের মতো হল না।

 

উপরের তিনটি কবিতা পড়ে আমরা বুঝতে পারি—  তিনি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত শূন্যতা বা অ্যামেচারের জন্য লেখেননি। কবিতা তাঁর কণ্ঠ। এই কণ্ঠকে যে অবরুদ্ধ করা যায় না, এর প্রমাণ, এই আজ আমি ভাবছি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা! শাসক আসে যায়, চেয়ার বদলায় না। সব চেয়ারের একই দৌরাত্ম্য!

 

যুগ যুগ ধরে সেই একই প্রতিচ্ছবি। দীনতার অস্থির ছিবড়ে কঙ্কাল। এ কি কখনো বদলাবে? “ভাই লোগ/ কোথায় কি ফুল ফোটালে বাগানের শোভা বাড়ে/ তা আমরা যতই জানি     দিল্লির মসনদ    বেহদ গুস্তাখী।” কিন্তু সাধারণ মানুষ কী করবে? কীভাবে ছিনিয়ে নেব তার অধিকার। সবই মুখ আর মুখোশ। মুখোশ কবিতাটিতে কবি যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা আঁতকে ওঠার! সদ্যজাত শিশু পেট থেকে নেমে আসছে খচ্চরের মতো! কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ শিক্ষামন্ত্রী! এই দেশে বিপ্লব ছাড়া কী আসতে পারে?

 

কবির আরও কিছু কবিতা পড়ব—

 

পয়লা ফাল্গুন

 

তোমার মুখের মতো সন্ধ্যা নেমেছিল হঠাৎ এখানে

মনের মতো কি অনির্বচনীয় ছায়া

মমতার স্নেহ-বৃক্ষে সারাদিন খেলে গেছে পাখি

দিনান্তের নির্ভরতায় আকাশ হয়েছিল অপরূপ

 সেদিন এখানে!

 

তথাপি নীরবে সে-বৃক্ষের পাখি উড়ে গেছে অজ্ঞাত কারণে

আর তো ফেরেনি।

 

এত আলো দিতে পারে

 

চলে গেছ আরও কোনো বড়োসড়ো সুখের আশায়

যাও—

যারা যায় তারা তো বোঝে না কিছু!

 

যন্ত্রণা যে এত আলো দিতে পারে—

সে যদি জানত!

 

উপরের দুটো কবিতা পড়লে বোঝা যায়, কবির আরও এক জগৎ আছে। যে জগতে তিনি অজ্ঞাত কারণে উড়ে যাওয়া পাখির সন্ধান করেন। খোঁজেন তার ছায়া। আবার এও অনুভব করেন যন্ত্রণার আলো কতটা ধারালো। 

 

প্রস্তুতি পর্ব

 

উষা লগ্ন। কালো আকাশের পরে তুলির সে লাল টান

মাটিতে পাখির ডাকে নেমে আসে সুপ্রভাত

দিনকালে অন্য কথা। সেফটি জুতোর শব্দে ভেঙে যায় সেসব নির্বাণ

যা আসে কোন গতি নেই তাতে। সুখ না ভিতরে। শুধু দুঃখের প্রপাত

তবুও থামে না কিছু। সূর্য ওঠে। পালিতে শ্রমিক যায়

দু-ধারে সবুজ মাঠ। মাঠে চাষি

ভোর থেকেই প্রস্তুতিপর্ব। বিষন্ন সন্ধ্যায় ভুখা দিন বলে— আসি

আমাদের ঘুরে ঘুরে আসা। যাওয়া নেই

যতই থাকুক দুঃখ তবু সেই অন্ধকারে কী এক রহস্য আছে

থাকে জীবনের গভীরেই চিরকাল নদীর স্পন্দন। চলমান প্রস্তুতির পর্বে

বিশ্বাসে অপার

তাকে সরাতে পারে না কেউ। সৃষ্টি করে ভেঙে-চুরে রক্তাক্ত অঙ্গার।

 

জ্বলছে

 

না, ও কিছু নয়

ওটা একজন শ্রমিকের বাড়ি

ঢুকে পড়েছে সল্টলেকে কখন

অবাক হচ্ছেন খুব, জ্বলছে

মর্যাদায় ঘা-লাগছে— ঘেমে যাচ্ছেন বুঝি

 

ঘেমে গেলে কী করে চলে বলুন— ছিঃ

 

বিকল্প নেই

 

ঘুরেই দাঁড়াতে হবে, বহুকাল সন্ত্রাসেই গেল

ঘর পোড়ে, লুঠ হয়, শিশু কাঁদে অসহায় কোলে

প্রাণ নিয়ে গ্রামছাড়া বসবাস ত্রাণের শিবিরে

ছয় ঋতু চলে যায় এই মন কখনো কি ভোলে?

 

ঘুরেই দাঁড়াতে হবে— মৃত্যুপুরী কতদিন থাকে

স্মৃতি-মধ্যে আছে সব ঘরপোড়া দাউ দাউ শিখা

 কে ওখানে আর্তনাদ করে ওঠে, অন্ধকার পথে

লাশ হয়ে গেল কেউ, খুনি সব গুম করে টীকা।

 

ঘুরেই দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ, প্রতিঘাতে আজ

মুখোশের অন্তরালে ঘাতকের বীভৎস চেহারা

খুলে দিতে হবে রোজ ক্লান্তিহীন উদাত্ত আজানে

ক্ষমা নেই, কাকে ক্ষমা জেগে থাকে সেই ধ্রুবতারা।

 

ক্ষমতার ক্রুর আশা স্পষ্ট করে দেওয়াল লিখন

স্বখাত সলিলে ডোবে, দেখে খুনি নিজস্ব পতন।

 

প্রভুত্বের স্বভাব

 

তোমার নীচে থাকলে ভালো বলো, কাছে ডাকো

প্রভুর মতো ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলো

তোমার পাশে বসলে তাকাও তির্যকভাবে

কখনো-কখনো ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দাও অবস্থানের কথা

এগিয়ে যেতে গেলে জাল বোনো মাকড়সার মতো।

 

আমাদের রাষ্ট্র এক মৃত্যুপুরী। কৃষক, শ্রমিক সবাই যেখানে অঙ্গার-শরীরে জ্বলছে। জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। অসহায় শিশু বা বৃদ্ধের আর্তনাদ পৌঁছাবে না। সব লাশ হয়ে যাবে গুম। ত্রাণের শিবিরে বসবে নেতাদের জুয়ার আড্ডা। কী করবে?

 

কবির কথায়, “এগিয়ে যেতে গেলে জাল বোনো মাকড়সার মতো”

মাঝেমাঝে ভাবি— এই কবিতা কী হবে? কেন আমরা লিখি? আমাদের চোখ এত dynamic! এরপরও কেন আমরা তুচ্ছতার সঙ্গে নিজের গণ্ডি এঁকে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধানোর চেষ্টা করি। চোখ যত বেশি যায়, ততই আলো আসে। কিন্তু আমরা কি সেই আলো সন্ধান করি? হতাশার অন্ধকার আমাদের ভিতর এত বেশি monopoly করে, দৃশ্যের খণ্ডচিত্র নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতি।

 

কবিতা মানে শুধু নন্দন চত্বর বা বাংলা আকাদেমি নয়… কেষ্ট চট্টোপাধ্যায় তা পদে পদে দেখিয়েছেন…

 

কবিতা পড়তে যাচ্ছি

 

প্রতিদিন এত দৃশ্য দেখি

প্রতিদিন এত দুঃখ, প্রতিদিন এত কষ্ট।

 

আজও বসে আছে সানকি পেতে সারাটা দিন

একটাও পয়সা পড়েনি

বাচ্চাছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে কখন।

 

আমরা পাশ কাটিয়ে, পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি

আকাদেমিতে কবিতা পড়তে।

কবি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়

kesto book

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

বই কথা

ব ই  ক থা

প্রি য়া ঙ্কা   চৌ ধু রী

যে দেশে ‘ঘাসও চেরি হয়ে ফোটে’

চেরিবসন্ত

রাকা দাশগুপ্ত

ধানসিড়ি

কোনও সিনেমা খুব পেলব, মসৃন হলে কিংবা বর্ণনাতীত হলে আমরা তাকে বলি, ‘কবিতার মতো’। কোনও গদ্য যখন শুধুমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ নয়, বরং আমাদের মনের তন্ত্রীগুলিকে স্পর্শ করতে পারে, আমরা বলি ‘এ তো পুরো কবিতা’! কবে, কী করে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছে গেছে এই ‘কবিতার মতো’ বিশেষণ, কবিতা নিজেও বোধহয় জানেনা।

রাকা দাশগুপ্তের ‘চেরি বসন্ত’ মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যক্তিগত আখ্যান, ভ্রমণকথা কিংবা দিনলিপি। কিন্তু পাতার পর পাতা যে বিস্ময়ের সামনে এনে দাঁড় করায়, সাবটাইটেলের মতো ভেতরে শুধু অনুরণন ঘটতে থাকে – এইসব কিছুই কবিতা… কবিতার মতো।

দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশের ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতি এবং লোককাহিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। আগ্রহ আরও ইন্ধন পায় যখন জানতে পারলাম এ’বই জন্মেছে দক্ষিণ কোরিয়ায় লেখিকার আড়াই বছরের একাকী বসবাসের দিনগুলিতে। পদার্থ বিজ্ঞানের পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার কাজে তাঁকে যখন থাকতে হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পোহাং শহরে, তখন। আর দেরি করিনি। তৎক্ষণাৎ কুক্ষিগত করেছিলাম। তদ্দিনে বেশ সাড়া ফেলেছে চেরিবসন্ত।

দক্ষ শিল্পী চিরঞ্জিৎ সামন্ত’র অসামান্য প্রচ্ছদ, অলংকরণ এবং লেখার পরিপূরক সাদা কালো কিংবা রঙিন ছবির প্যানেল বইটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রতিটি ইলাস্ট্রেশন এ’বইয়ের সম্পদ।

উজ্জ্বল প্রচ্ছদটিকে পার করে লেখিকার সেই সময়ের দিনলিপিতে যখন ঢুকে পড়লাম, মনে হলো, এ তো ঠিক পাঠ নয়, বরং মনোরম ভ্রমণ। প্লাম ফুলের রাজ্যে, চেরি ব্লসমের দেশে, বাঁশপাতার আঁকাবাঁকা পথে, পাইনের সারিতে, দুর্গম পর্বত শিখরে, প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরে। কখনও ইতিহাস স্পর্শ করে, কখনও ইতিহাসের মিসিং লিঙ্ক জোড়া লাগিয়ে। আবিষ্কারের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে যখন জানা যাচ্ছে ভারতীয় ইতিহাসের টুকরো ভৌগোলিক গণ্ডি পেরিয়ে সুদূর প্রাচ্যে রূপকথা হয়ে বেঁচে রয়েছে আজও।

যে চেরি ব্লসম নিয়ে সারা পৃথিবীর আগ্রহের শেষ নেই, জানা হয়ে যাচ্ছে স্বল্পায়ু সেই ফুলের নাকি ক্যালেন্ডার হয়! কিংবা আধিপত্য বিস্তারে চেরি এবং প্লাম ফুলের রাজনীতি জাপানের কোরিয়া দখলের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জানতাম দূরপ্রাচ্যে চায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জানা ছিল না কী অপরূপ ভাবে সেখানকার শিল্প সংস্কৃতি এমন কী সাহিত্যেও অনায়াসে মিশে আছে চায়ের উষ্ণতা। লেখিকার অনুবাদে কোরিয়ান চা বন্দনা দং-চা-সোং এর এক টুকরো পড়ানোর লোভ সামলাতে  পারছি না।

সবুজ ফুলের চা-টি যখনই  করেছি পান, দু’বাহুর নীচে বায়ু খরতেজ হয়

শরীর কী লঘু লাগে! ধীরে ধীরে উঠে যাই, পবিত্র দশায়

মোমবাতি হয়ে চাঁদ নেমে আসে, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাই

সাদা মেঘ উড়ে এসে বসার আসন দেয়, পর্দাও টানিয়ে দেয় দূরে।

  • চো-উই (জন্মসাল ১৭৮৬)

ভ্রমণ করতে করতে কখনও পৌঁছে গেছি পাহাড় চূড়ায় প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরে। যেখানে স্বেচ্ছায় দু’দিনের ভিক্ষুণী জীবন কাটাবেন লেখিকা। কিংবা বুদ্ধজয়ন্তীতে কোরিয়ান-দের আলোর উৎসব, লোটাস ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যালে, কিংবা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে। যে ঘুড়ি ওড়ানোয় কোনও প্রতিযোগিতা নেই। ঘুড়িতে মাঞ্জার কনসেপ্টই নেই। পাশের ঘুড়িকে না কেটেই নিজের ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দে তারা বিশ্বাসী। কখনও পৌঁছে গেছি চাঁদ ও চেরি ফুলের দুর্লভ মিলন দৃশ্যে, যেখানে চেরিফুল দেখার এই উৎসবকে আলাদা করে ‘হানামি’ নামে চিহ্নিত করা হয়। চেরি উৎসবে উল্লেখ পাওয়া যায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সাইগ্যো হোশির, যিনি সমাজ সংসার সব ত্যাগ করার পরেও চেরি ফুলের প্রতি তীব্র আকর্ষণ কাটাতে পারেননি এবং এ’নিয়ে আক্ষেপ করেছেন তাঁর লেখায়।

ইতিহাস, অপূর্ব সব লোককাহিনির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে হিরোশিমার ভ্রমণ বৃত্তান্তে এসে মন ভিজে যায়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণঘটিত প্রভাবে দুরারোগ্য অসুখ ‘হিবাকুশা’ য় আক্রান্ত ছোট্ট মেয়ে সাদাকো সাসাকির লড়াইয়ের গল্প। সে বিশ্বাস করে তাদের উপকথায়, হাজারটি কাগজের সারস বানাতে পারলে তার আরোগ্য হবে। কিন্তু মৃত্যু অব্দি সে ছশো চল্লিশ-টি সারস তৈরি করতে পেরেছিল। সাদাকো সাসাকি ইতিহাসের অংশ। যে ইতিহাস যতটা যন্ত্রণার, ততটাই লজ্জার।

কখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে অসাধারণ সব মৌলিক কবিতা কিংবা অনুবাদে ওয়োন চোন সোক, কোবায়াশি ইসা, কিম ইন হু’র অনবদ্য সব টুকরো কবিতা। কিংবা ছবির মতো উঠে আসছে জাপানের হাইকু, কোরিয়ার শিজো। সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধারালো কবিতার এই দু’টি প্রায় অনুরূপ প্রাচীন কবিতার ফর্ম আপাতদৃষ্টিতে সহজ কিন্তু সামান্য নয়। তেমনই রেসিপির মতো বুঝতে বুঝতে প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে অপূর্ব কিছু শিজো এবং হাইকুর অনুবাদ। যেমন –

দশটা বছর ব্যয় করে এই পর্ণ কুটির তৈরি করা

আধখানা তার বাতাস থাকে, আধখানা তার চাঁদের বাড়ি

তোমায় কোথায় বসতে দেব? বরং তুমি বাইরে এসো।

= সং-নুন (কোরিয়ান কবি)

বইয়ের শেষাংশে এসে থমকে যেতে হয়। মনে গেঁথে যাওয়া কিছু কিছু গান আমরা যেভাবে লুপে শুনি, চার ঋতুর অনুষঙ্গে লেখা আটখানা কবিতা আমি সেভাবে পড়েছি, আবার পড়েছি। আবারও  পড়েছি… সেইসব লেখা টাইম ট্র্যাভেল ঘটিয়েছে, সেইসব কবিতা এক একটা দিনের গতিপথ অনায়াসে বদলে দিয়েছে।

‘চার ঋতুর দিন’ শীর্ষক আটখানা কবিতার একটি পড়াই –

সামার – ১

সবুজ শিখেছি। এক ইস্পাতের নদী, তীক্ষ্ণধার

দৃশ্যের মোড়কে ছিঁড়ে পাকে পাকে নেমে আসছে, তার

দু-পাশে শ্যাওলার বন। পীচরং পেকেছে কোথাও।

ঘোড়ার আওয়াজ। যত আমাকে পেরিয়ে চলে যাও,

ড্রাগনফলের ত্বক ফেটে পড়ে। লাল এত লাল

ধুলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে দিকচক্রবাল

এতটা দহন আমি কাউকে বলিনি, শুধু এই

কাগজপাখার ভাঁজে নিঃশব্দ বীজন ফেলে গেছি।

গোটা চেরিবসন্ত জুড়ে যে নিঃশব্দ জীবন দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়, খালি চোখে যা দেখা যায় না, অন্তর্দৃষ্টির লেন্সের প্রয়োজন পড়ে, রাকা দাশগুপ্ত সেই লেন্স উজাড় করে বিলিয়েছেন। সঞ্চয়ে রাখা পাঠকের কাজ।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

ড্রাফট অফ দা শ্যাডোস

বি শে ষ  র চ না

রা জী ব   চ ক্র ব র্তী

rajib2

'ড্রাফট অফ দা শ্যাডোস': একটি ভিন্নমাত্রার স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাব্য-চলচ্চিত্র

কবি অমিতাভ মৈত্র লিখেছিলেন- ‘তেতো মন্তব্যের মতো এই জানালা তুমি এড়াতে পারবে না মায়েস্ত্রো/ এক ধাপ নেমে দাঁড়ালেই দেখবে ব্লেড তোমার বোতামের দিকে এগোচ্ছে…’। ভাষার ইন্দ্রজাল যা নিছক স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের সম্মিলিত দার্ঢ্য থেকে তিলে তিলে তৈরি হওয়া তিলোত্তমা মায়া, কিম্বা ক্রোধের ধারাপাত। এই শাব্দিক বোধ কবিতার ন্যারেটিভকে পাঠকের স্থানিক ও কালগত অবস্থান ভেদে এক পরম  আশ্রয় দান করে… যাকে তার্কোভস্কি বলেন ভাষার বর্ম;  তা বাস্তব অথবা সেলুলয়েডের মৌলিক মাধ্যমে, যেখানেই হোক না কেন। সেই কাব্যচলৎযানচিত্রকেই নির্মম ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ড্রাফট অফ দা শ্যাডোস’ নাতিদীর্ঘ সিনেমাটিতে। মৌসুমী চ্যাটার্জী পরিচালিত কবি অগ্নি রায়ের কবিতা নির্ভর এই কাব্য–চলচ্চিত্রটিতে আবহ রচনা করেছেন অনুপম রায়। অনুপম রায়ের আবহ রচনা এক অন্য মাত্রা সংযোগ করেছে ছবিটিতে। আমরা একবার পড়ে নি কবি অগ্নি রায়ের যে কবিতাটি ভিত্তি করে নির্মাণ হয়েছে এই ছবিটি—

“কারশেডের ছায়াকে পিঠে নিয়ে বসে থাকা ঘাট, বহু হত্যার অমনিবাস উল্টে দেখে ভাসিয়ে দিয়েছে পরীদের কাছে। তামাদি সাক্ষ্য প্রমাণ আর ঘেঁটে যাওয়া কাজলের ব্যবহার তাদের পাতায় কয়লার মত নির্ঘাৎ। জলজ তদন্তের শব্দ আছড়ে এসে পড়ে শৈশব দূরত্বে। আততায়ী দূরের ব্রিজে হেলান দিয়ে বাতাস খতিয়ে দেখে। আলগোছে ধরিয়ে নেয় পরবর্তী সিগারের বিশ্বস্ত আগুন। এবার সে মুছে দেবে হত্যার চিহ্ন ও বিভা। খবর জানাজানি হওয়ার আগে খাপে রাখা পেন্সিল খুলে শেষ নৌকাটা অন্তত এঁকে ফেলতে হবে তাকে”

‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়’– এই শব্দগুলিই যেন আছড়ে পড়ছে এখানে মুহুর্মুহু। ঋত্বিকের ভাষায় “random triggering”। ইতিহাস থেকে সমকাল জুড়ে মহাকালের রাজপথে যে ছায়া তা বঞ্চনার, ক্ষয়ের, লোহিতাশ্রুর, হত্যার, মৃত্যুর, ক্ষোভের। এক অদ্ভুত আঁধারের নির্দেশক এই ছবি যার স্তরে স্তরে যে যন্ত্রণার চিহ্ন আঁকা হয়েছে তা দেখে কেউ বলতেই পারেন “এখনও পৃথিবীর শিকারপর্ব চলছে।” মহাকাল উল্টে চলেছেন এক ‘হত্যার অমনিবাস’।

হ্যাঁ, এই হত্যার রেশ বয়ে চলেছে আমাদের পার্শস্থ মানুষজনের হত্যায়– প্রতিবাদের গলা টিপে শেষ করে ফেলার দর্পিত হুঙ্কারে, যেখানে আমাদের পৈশাচিক আহ্লাদ মুখ বেঁধে দেয় — নিয়ে যায়  আনন্দসাগরে। সেইসব স্বর এই বায়বীয় পৃথিবীর নেশার জাল ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলে, যখন আমরা দেখি লক্ষ্য চেষ্টা সত্ত্বেও মৃত্যুর হাতছানি আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় — বিচ্ছিন্ন করে, আর সেই ভয়কেই ফুটিয়ে তুলেছে সাদা ক্যানভাসে সোজা নেমে আসা রক্তের দাগ। ধর্ষণের জন্য উদ্ধতলিঙ্গ নিছকই একটা কায়েমি ক্ষমতার আনুগত্যকামী হুঙ্কার, “All dark fibres of power  and hatred from time immemorial blended with each other and smuggled like charcoal in the eyes of the rape survivor.”

ক্ষমতার শান্ত চোখ বাস্তবেই এক বিকৃতির ইঙ্গিত। তার প্রকাশ ঘটে মুহুর্মুহু। ঘটে জলে -স্থলে- অন্তরীক্ষে -নাগরিক ‘সুসভ্যতায়’। ঘটনার কোলাজে, প্রযুক্তির আধুনিকতম প্রস্বরেও সেই সুসভ্য-বর্বরতাকে, হিমশীতল হত্যার হুমকিকে এড়ানো যায় না — তবে এখানেও কি  সেই যক্ষপুরী — সেই রাজকীয় দম্ভের পানসে হুঙ্কার! বর্তমান চলচ্চিত্র সেই ‘বিশ্বস্ত আগুন’, সেই ‘smell of ashes’-ই আমাদের উপহার দেয়।

সব গল্পেরই একটা শেষ থাকে…. সেই শেষ যেন এক অনন্তযাত্রার ইঙ্গিতবাহী। জীর্ণতাকে ছাপিয়ে সেই যাত্রা এক শূন্যতা থেকে আর এক অসীমের পথে প্রবহমান। তাই গল্পের শেষে এক নির্মল শৈশব তার কাগজের পানসি নৌকা বানিয়ে ফেলে, যাতে রঙ কেবল দুটি। আর মাথার ভিতরে বেজে ওঠে “…. only two colours are enough to express the whole story”।

কবিতায় ভেসে থাকা এই কাব্য – চলচ্চিত্র যে শূন্যতাকে আমাদের উপহার দিয়েছে তা কি তবে সত্যিই শূন্য, নাকি এক দৃঢ় মৃত্যুঞ্জয়ী উচ্চারণ “Death is finished. It is no more”-এর নিশান! হয়তো এই আপ্তবাক্যই আমাদের আশ্রয় দিয়েছে মৌসুমী চ্যাটার্জী পরিচালিত এই কাব্য-চলচ্চিত্রটি ‘ড্রাফট অফ দা শ্যাডোস’…. যেখানে কবিতা বিমূর্ত নয় আর বরং তা আমাদের প্রতিবেশী দুর্দশার এক মৌলিক সাক্ষ্য হয়ে উঠেছে। মৌসুমী চ্যাটার্জীকে অসংখ্য ধন্যবাদ সারা পৃথিবীর কাব্যপ্রেমীদের এমন একটি অসাধারণ কাজ উপহার দেওয়ার জন্যে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তাঁর পরবর্তী কাজগুলির দিকে। কবিতা নিয়ে তাঁর এমন পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

index

ছবিটি দেখতে ক্লিক করুন নিচের আইকন-এ…

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

শংকর চক্রবর্তী

বি শে ষ  র চ না  | পর্ব ৯

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি 

ঝাড়বাতি

কবিকে কি উদাসী হতে হবে? কিংবা ভুলোমন? এই ভুলে থাকার স্বতঃস্ফূর্ততায় নিশ্চয়ই কেউ কেউ কখনো কখনো মহান হয়ে ওঠেন। আবার সবকিছু ভুলে থাকতে পারাটাও একধরনের শৈল্পিক পর্যায়ে উন্নত করে তুলতে পারে যে কোনো ঘটনা প্রবাহকে। এ এক মজার স্মৃতি-বিভ্রমের খেলা চলে প্রতিনিয়ত। যদিও কারো কারো ক্ষেত্রে সবরকম অতীত বিমুখিতাই যেন তাঁদের জীবন নিঃশব্দে আলোকিত রাখে। বলাবাহুল্য, তাঁরা স্বেচ্ছায় ভুলতে চান সবকিছু। দ্রুত আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পিছন ফিরতে প্রত্যেকেরই ভয়।  অর্থাৎ আবেগবিহ্বলতা আর কোনোভাবেই সযত্নে থাকার মতন নয়। তবুও স্মৃতির তলানিতে কিছু নুড়ি পাথর তো জমে থাকেই। যা কখনো হয়ত প্রাক-মৃত্যু পর্বে হঠাৎই ফের একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তবে এটা স্বীকৃত সত্য যে, অজান্তে বিস্মৃত হওয়াটাই চরিত্রের শুভ লক্ষণ। আর যেসব কবিরা জাগতিক ব্যাপারস্যাপার ভুলে থাকতে পারেন, তাঁদের চরিত্রের মানবিক দিকগুলিও নিঃসন্দেহে স্পর্শযোগ্য। বহু কবি-চরিত্রের সঙ্গে আত্মস্থ থেকেই আমি এই ধারণায় পৌঁছেছি। এবং একথা নিগূঢ় সত্য যে, তাঁরা প্রকৃত সুখের সন্ধানই পেয়ে যান। আসলে এই অনিচ্ছাকৃত ভুলে থাকাটাই প্রকৃত অর্থে একজন কবির নিষ্পাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

বহু বছর আগে, পঞ্চাশের দশকের এক প্রধান কবির সঙ্গে তাঁর বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাঁর স্ত্রী আমার দেখা অন্যতম সেরা মানবিক ও বুদ্ধিদীপ্ত মহিলা। তো আড্ডার মাঝপথে তাঁর কাছে এক গ্লাস জল চেয়েছিলাম। তিনি জল আনতে উঠে গেলেন। আর আমরা ফের সাহিত্য আলোচনায় মশগুল। বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম তিনি হাতে একটি রঙিন তোয়ালে নিয়ে আমার পাশে সোফায় বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “তুমি এটা চেয়েছিলে না?” আমাকে অপ্রস্তুত করে প্রাণ-খোলা হাসিতে ফেটে পড়লেন আমার প্রিয় সেই অগ্রজ কবি। বললেন, “তোমার কাছে এসব নতুন লাগছে আমার কাছে নয়।”

যে সময়ের কথা বলছি, আমাকে তখন আমার শিলং অফিস থেকে বছর দুয়েকের জন্য গুয়াহাটির অফিসে কাজ করতে হয়েছিল। সেখানে প্রায়ই আড্ডা হতো আমার অসমীয়া কবিবন্ধু ও সেখানকার অগ্রজ কবিদের সঙ্গে। সেখানেই ষাটের দশকের একজন অগ্রজ কবির ভুলে-যাওয়ার গল্প শুনেছিলাম আমারই এক বন্ধুর কাছে। সেই অগ্রজ কবি একদিন নাকি তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়ে কাজে বসার পর খেয়াল করলেন যে চশমটাই সঙ্গে আনা হয়নি। অথচ চশমা ছাড়া কোনো কাজই তাঁর করা সম্ভব নয়। ফলে, একটা ট্যাক্সি করে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী তখন মেয়েকে আসন্ন পরীক্ষার জন্য  অঙ্ক বোঝাচ্ছিলেন। তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে একটি জটিল অঙ্ক বুঝতে না পেরে অঙ্কটি তাঁর দিকে এগিয়ে দেন। তিনি নিবিষ্ট মনে অঙ্কটি সমাধান করে আবার চশমা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মেয়ে সেদিন বাবার চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলেছিলেন, “খুঁজে দেখো তো পাও কিনা”! শুনেছিলাম, সেই সম্মাননীয় কবির এমন অনেক কাহিনিই নাকি উপন্যাসের আকার নিতে পারার মতন।

আমি কিন্তু নিজে মনে করি যে, একান্ত নিজস্বভাবে ভোলার মতন আমার কিছুই নেই। সবই যেন স্মৃতির কোটরে রাখা এক একটি উজ্জ্বল মুক্তো। এই প্রচণ্ড আত্মাভিমান নিয়েই আমি ভালো ছিলাম। কিন্তু অজান্তেই সে অহংকার চূর্ণ হল একদিন। আপাতত তাই, নিজেকেও এর বাইরে না রাখতে পেরে একটা মাত্র ছোটো ঘটনার উল্লেখ করে পর্বটি শেষ করছি। পরবর্তী সময়ে কখনো আমার সমসাময়িক কবি বন্ধুদের কিছু ভুলোমনের ছবি তুলে ধরার ইচ্ছে রইল।

প্রায় ৩৫বছর আগের কথা। আমি তখন শিলঙে। একদিন অফিস যাইনি। বাড়িতে বসে কিছু কাজ করছিলাম। ছেলে স্কুলে ও স্ত্রী অফিসে। একাই ছিলাম। তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। বাড়িতে শুধু অফিসের দেওয়া কালো ধুমসো ফোন। প্রেস থেকে ফোন করে জানিয়েছিল পত্রিকার গ্যালিপ্রুফ তৈরি আছে। আমি যেন গিয়ে নিয়ে আসি। তো আমি ভাবলাম প্রুফটা নিয়ে এসেই দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নেব। এই ভেবে দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরোই। ঘন্টা খানেক পরে বাড়ি ফিরে দরজার কাছে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি চাবি নেই। তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও চাবিটি পেলাম না। আমার তখন মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। ক্লান্ত হয়ে বাইরের বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম। আমি জানি বাড়ির অন্য দুজনের যে কোনো একজন ফিরলেই আমি ঘরে ঢুকতে পারব। কেননা প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা চাবি আছে। ঘন্টা চারেক পরে আমার ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলে স্কুলবাস থেকে নেমেই গটগট করে দরজার হুড়কো টেনে খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। আমি অবাক হলাম। আমার বাইরে বসে থাকার কারণ ছেলে বুঝতে না পারায় তাকে কিছুই জানালাম না। আর নিজে চুপিচুপি ঘরে ঢুকে দেখি, নিঃসঙ্গ তালা আর চাবিটি তাঁর নিজস্ব জায়গায় তখনও হাসি মুখে ঝুলছে। 

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

নারী শহরের সম্পদ । পর্ব ৪

বি শে ষ  র চ না । পর্ব ৪

নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় থেকে তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের ফরাসী ও মার্কিনি বিশিষ্ট মহিলা কবিদের এক গুচ্ছ জানা অজানা কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছেন বর্তমানে কর্মসূত্রে ফ্রান্স নিবাসী ম্যাডিকেল আল্ট্রাসাউণ্ডের তরুণ বিজ্ঞানী…

রূ প ক  ব র্ধ ন   রা য়

নারী শহরের সম্পদ

“এম-এল-এফ” আন্দোলন, “লূ টর্চোঁ ব্রুল” পত্রিকা এবং তার কবিতা—

১৯৭০-১৯৭৫ খৃষ্টাব্দ ফরাসী নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৬৮ সালে ঘটে যাওয়া ফরাসি ইতিহাসের বৃহত্তম ছাত্র ও কর্মী হরতালের ঘটনা ও প্রায় একই সময়ে গড়ে ওঠা মার্কিন নারীবাদী আন্দোলনের উত্তরসূরি এই সময় একাধিক নারীবাদী মতাদর্শের আঁতুড় ঘর। 

১

MLF (এম-এল-এফ) বা “Mouvement de libération des femmes” এমনই এক নাম। 

২৬ আগস্ট, ১৯৭০ সালে ক্যাথি বার্ণহাইম, খ্রিস্টিন ডেলফিন, মনিক উইট্টিজ, খ্রিস্টিয়েন রশফোর্ট এবং নমস্কার শক্তিনি-র নেতৃত্বে প্রায় বারোজন মহিলা রাজনৈতিক কর্মী কিছু ব্যানার হাতে প্যারিসে “প্লাস দূ ল’এটয়েল”-এ এক নারীবাদী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। ব্যানারগুলোর কিছু কথা যেমন  “That one man out of two is a woman” কিম্বা “There is even more unknown than the unknown soldier, his wife” ফরাসী নারীবাদের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। সমস্ত বিক্ষোভকারীকেই সেদিনই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন, সংবাদ মাধ্যম এই আন্দোলনের সমর্থনে বিবৃতি দেয় এবং নারীবাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সুত্রপাত ঘটে। তারই নামকরণ হয় ‘এম-এল-এফ’। এম-এল-এফ কর্মপদ্ধতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা আদর্শের থেকে বিচ্ছিন্নতা । দলের কর্মীরা ছোটো ছোটো স্বাধীন দলে ভাগ হয়ে শহর জুড়ে কাজ করতেন। “দা প্রাইভেট ইজ পলিটিকাল” বা “যা ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক” এই উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের শুরুর দিকে মূল শক্তি ছিলেন ১৩-১৭ বছরের অন্তঃসত্ত্বা যুবতীরা। পরবর্তী সময়ে যৌন-স্বাধীনতা-আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার কারণে এম-এল-এফ মুভমেন্টের প্রধান কার্যাবলীর বিষয় তালিকার মধ্যে :

  • গৃহস্থালির কাজে পুরুষের দায়িত্ব।
  • নার্সারির প্রয়োজনীয়তা।
  • ধর্ষণ।
  • যৌন নিগ্রহ।
  • গর্ভপাতের অধিকার (১৯৭৫ সালে আইনত বৈধতা পায়) ইত্যাদি প্রায় সমস্ত দিককেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২

এম-এল-এফের কাজের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হওয়ার পর সিমন দ্য বাভোয়া নিজে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ১৯৭২ সালে সিমন “Manifeste de 343” নথিতে সর্বসম্মুখে তাঁর স্বেচ্ছাকৃত গর্ভপাতের কথা উন্মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেন। এমনও বলা হয়ে থাকে যে হালফিলের #metoo আন্দোলন এম-এল-এফ মুভমেন্টেরই উত্তরসূরি।

এম-এল-এফ এর এক সাধারণ অধিবেশনে জন্ম নেয় সে সময়ের এক বিখ্যাত নারীবাদী ছোটো পত্রিকা, যার নাম “লূ টর্চঁ ব্রূল (Le Torchon Brule)” [অর্থঃ ন্যাকড়াটা জ্বলছে]। এই পত্রিকার কার্যকরী কমিটির প্রধান সদস্যা ছিলেন  মারি দেদিউ (আলোকচিত্রী), জুলিয়েট কাহান, মারিয়েল বুর্কহাল্টার, নাদিয়া রিঙ্গার্ট, এবংসিল্ভিনা বয়েসসোন্নাস-এর মতো বিশিষ্ট এম-এল-এফ কর্মীরা।

book

১৯৭0 সালে প্রকাশিত কাগজেরশূন্যসংখ্যার প্রচ্ছদ। ( https://www.franceculture.fr/ )

এই পত্রিকার “শূন্য”তম সংখ্যা “L’Idiot Liberté” খবরের কাগজের সম্পূরক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়। প্রত্যেকটি লেখার নীচে “—” আকারের একটি লাইন দেওয়া হয়েছিল যাতে যে কেউ চাইলেই কোনো একটি লেখাকে নিজের মত করে কেটে নিজের ব্যক্তিগত পুস্তিকার অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারেন। Le Torchon Brule-এর প্রথম স্বতন্ত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের বসন্তে। দাম ছিল ১ ফ্র্যাংক। ১৬ পাতার এই কাগজের ৩৫০০০ কপি বিক্রি হয়। এই কাগজ প্রকাশের কোনো নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক বাধ্যবাধকতা না থাকায় সম্পাদকমণ্ডলী এই কাগজকে “মেন্সট্রুয়াল” বলেই প্রচার করতেন। তাদের নিজেদেরই কথায় এই কাগজ ছিল “menstrual, not monthly journal”। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে Le Torchon Brule পত্রিকার ৬ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ পঞ্চম সংখ্যা (প্রথমটি “শূন্য” সংখ্যা) এবং সম্পূরক কাগজ হিসাবে প্রকাশিত বিশেষ “মাতৃ দিবস” সংখ্যার সাথে “Le Torchon Brule”-এর উজ্জ্বল যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে।

৫

কবিতা, প্রবন্ধ, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, কার্টুন, ছবি, চিত্রকল্প ইত্যাদি সবকিছুই এই কাগজে জায়গা করে নেয়। এই পত্রিকায় যেমন ফরাসী নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বটবৃক্ষের মত নামেরা নিয়মিত লিখতেন, ঠিক তেমনই নিজের মতো করেই জায়গা করে নেন ফ্রান্সের প্রত্যন্ত গ্রামের অজানা অচেনা অনামী-রাও । যার লেখাই ছাপা হয়ে থাকুক, বেশিরভাগ প্রকাশিত লেখাগুলির ক্ষেত্রেই লেখিকা/লেখকদের নাম থাকতো না। 

“নারী শহরের সম্পদ” ধারাবাহিকের বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত হল “Le Torchon Brule” পত্রিকায় প্রকাশিত “শূন্য”, প্রথম ও শেষ তথা পঞ্চম সংখ্যায় প্রকাশিত এমনই অনামী জনের তিনটি কবিতা। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে এই ধরণের কাজ সম্ভবত এই প্রথম। যেমন বলা হল, এই কবিতাগুলি কাদের লেখা তা আমরা জানি না, জানার উপায়ও বোধহয় এখন আর নেই।

কবিতা নির্বাচন, মূল কবিতাগুলির ফরাসী থেকে বাংলায় অনুবাদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনুবাদক, তাঁর দুই সহযোগী, ব্রিটেনবাসী অধ্যাপক নিনা পারিশ (Nina Parish, Professor of Literature and Languages, University of Stirling) ও অধ্যাপক সান্ড্রা ডারোকজি (Sandra Daroczi, Lecturer of Politics, Languages & International Studies, University of Bath) এর থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নারী-স্বাধীনতার এই ইতিহাসের মূল্য অপরিসীম।

নঃ ০, পৃঃ ১৮

আমি মোটেই এক নারী হতে চাই না, আমি থাকতে চাই

শ্রেণী নিরেটদের সাথে

আর গেছো মহিলাদের সাথে

আর ছোট্ট মেয়েদের সাথে যারা ভীষণ ভাল

আর মোমের পুতুলদের 

আর নারীসুলভ নারী ও শিশুসুলভ মেয়েদের সাথে

আর আমাজন ও নারী-যোদ্ধাদের

আর অযোগ্য মায়েদের ও সর্বনেশে মেয়েদের

আর জাদুকরী ও মডেলদের সাথে

 

এই ধুলিধূসরিত নাট্যশালায়

যেখানে আমি আহ্বান জানাই তুমি নিজেকে চেনো

তুমি

আমি তোমার সাথে থাকতে চাই

ব্যস ওটুকুই

আর যথেষ্ট হয়েছে

আর-যথেষ্ট-বলা-হয়েছে যে জুলি সেই তিমিকে ব্যভিচারী মনে করে

ঈশ্বরের দিব্যি যথেষ্ট হয়েছে আমায় নিঃশ্বাস নিতে দাও

গানটায় যেমন বলা আছে

আমার সম্মুখে আমারই অচেনা প্রতিবিম্বের দিকে 

তাকিয়ে দেখতে দাও, আমায় কেমন তোমার মতো দেখায়!

নঃ ১, পৃঃ ১২

poem2header

আমি আমার মাষ্টারমশাইকে হত্যা করতে চলেছি

নীল রাতে গোলাপী টুপি

আমি আমার মাষ্টারমশাইয়ের দিকে হেঁটে যাই

হাতের ডগায় স্কুলের ঝোলা

ভারী

শেখার মতো জ্ঞান

আমার মাষ্টারমশাইয়ের কাছে আমার আঙুলের ডগাগুলোর দিয়ে

পড়া উগরে দেব বলে

 

নীল রাতে গোলাপী জামা

আমি আমার মাষ্টারমশাইয়ের দিকে হেঁটে যাই

ওর হাতের

 

দিকে এগোনো নরম রেশম

ভারী

শেখার মতো জ্ঞান

আমার মাষ্টারমশাইয়ের কাছে আমার আঙুলের ডগাগুলোর দিয়ে

পড়া উগরে দেব বলে

 

কালো রাতে লাল হৃদয়

আমি আমার স্কুলমাষ্টারের দিকে হেঁটে যাই

তার অসংখ্য তুচ্ছ অস্ত্রের

বিরুদ্ধে

আমার নগ্ন হাত এবং আমার বোনেদের রক্ষা করতে

আমি আমার মাষ্টারমশাইকে হত্যা করতে চলেছি

নঃ ৫, পৃঃ ২১

poem3header

‘আমি সবজি, তুমি সবজি’

একজন নারী, তার তো সবজি হওয়ার কথা!

একজন নারী চটকদার, চকমকে, জমাট,

উদীয়মান নারী, পুঞ্জীভূত নারী, আবদ্ধ নারী;

ওরা আছেন যাদের আমরা মজুত করে রাখি

তারা যারা আমাদের হাতে স্তুপাকৃত

তারা যাদের আমরা কবর দিয়ে রাখি

একজন নারী, তার তো সবজি হওয়ার কথা!

দুর্গন্ধী ধনী তাকে একটা চারাঘরে রাখে, দালালটা ওকে একটা ভস্মাধারের মত ব্যবহার করে।

নবমুকুল পেড়ে ফেলা হয়, ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যায়,

আমরা ওকে তাজা রাখি, রক্তটা বিযুক্ত…

নিস্তব্ধতার জন্য কেউ আছেনঃ একজন নারীকে স্থির থাকতেই হবে।

দুঃখের জন্য আছেন কেউ কেউঃ বৈধ ধ্বংসাবসশেষে এক নারী।

কেউ আছেন আরামের উদ্দেশ্যেঃ বিনামূল্য উপহারের মত এক ত্রুটিহীন নারী।

একজন নারী, তার তো সবজি হওয়ার কথা!

আরোগ্যের জন্য প্রণীত তাবিজের মতো নারী,

আবরিত নারী, প্রতারিত নারী, ধর্ষিতা নারী, নারীর অনুপস্থিতি।

একত্রিতের জমি থেকে অলৌকিকভাবে নিষ্কাশিত নারী,

নারী উপহ্রদ, নারী জলাভূমি, নারী পাঁক,

নারী গাছ, ঝুলে পড়া মৌসুমী নারী, ব্যয়িত অলংকৃত নারী, নিমজ্জিত নারী

রূপক বর্ধন রায়

অনুবাদক

GE Heathcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত, ফ্রান্স-এর নীস শহরে থাকেন। টার্কি-র সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্ত্রাস্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভারসিটি ও পি এইচ ডির পর বছর খানেক জার্মানির ফ্রনহফার সোসাইটিতে সায়েনটিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। লেখালেখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ট্রাভেলগ, সাহিত্য মনন নিয়েই। কলেজজীবনে বন্ধুরা মিলে “দেওয়াল” নামক কবিতা পত্রিকা চালিয়েছেন কয়েক বছর। এছাড়াও কবিতা, গদ্য প্রকাশ পেয়েছে একাধিক বাঙলা অনলাইন পত্র পত্রিকায়। লেখা লেখি ছাড়াও গান বাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে রূপকের সমান আগ্রহ রয়েছে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

শুভ চক্রবর্তী

অ নু বা দ | পাবলো নেরুদার একটি সাক্ষাৎকার

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

suva

একজন কবির কবিতায় তো তাঁর জীবন প্রতিবিম্বিত হবে, এটাই হওয়া উচিত। এটাই হচ্ছে শিল্প ও জীবনের নিয়ম...

neruda2

(গত সংখ্যার পর)

আপনার রচনাগুলো আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তো জড়িয়েই আছে?

এটাই তো স্বাভাবিক। একজন কবির কবিতায় তো তাঁর জীবন প্রতিবিম্বিত হবে, এটাই হওয়া উচিত। এটাই হচ্ছে শিল্প ও জীবনের নিয়ম।

আমার মনে হয় আপনার রচনাবলীকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়, তাই তো?

এ বিষয়ে আমি মনে করি আমার চিন্তা বেশ গোলমেলে । আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টিকে কোনো পর্যায়ে ভাগ করি না , কিন্তু যাঁরা সমালোচনা করেন তাঁরা বিষয়টিকে আবিষ্কার করেছেন । সত্যি যদি কিছু বলতে হয় তাহলে বিষয়টিকে বলা যেতে পারে যে আমার কবিতার একটি অবয়বগত একটা সামঞ্জস্য আছে , তা এই যে আমি যখন খুব কম বয়সের, বা আমি যখন কিশোর বা তরুণ , আর নিরানন্দময় যখন আমি কষ্ট পাচ্ছি , এবং যখন সংগ্রামশীল আমাকে সামাজিক সংঘাতে প্রবেশ করতে হয়েছে , এইরকম সব কিছুই মেশানো আছে আমার সাম্প্রতিক কবিতায়। ভেতরের তাগিদ থেকে আমি সবসময়ই লিখি আর কল্পনা করি যে সত্যি যদি এমন ঘটনা ঘটে সমস্ত লেখকের ক্ষেত্রে, তাঁদের জীবনে বা বিশেষত কবিদের জীবনে।

আপনার লেখার সময় কখন?

সেভাবে আমার লেখার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, কিন্তু যদি বেছে নিতে বলা হয় তাহলে বলব লিখি সকালেই, বলতে গেলে এই যে আপনি আমার সময় নষ্ট না করতেন (আর আপনারও সময় নষ্ট হচ্ছে) তাহলে হয়ত লিখতাম । বিশেষত দিনের বেলায় আমি পড়ি না। বরং সারাটা দিন আমি লিখি, কিন্তু অনেকসময়ই একটা চিন্তার পূর্ণতা , একটা প্রকাশের,  এমন একটা কিছু যা আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রবল উচ্ছ্বসিত স্পন্দনে —- একে বলা যেতে পারে ‘অনুপ্রেরণা’। কিন্তু আমি লিখে যাই অতল আহ্বানে যখনই লিখি, আর যেখানেই লিখি, আমার চারপাশে যদি প্রচুর লোকজন থাকেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। 

আপনার লেখা নিয়ে আলোচকরা কি সবচেয়ে ভালো বুঝেছেন ?

ওঃ, আমার আলোচকগণ! আমার আলোচকরা আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন তাঁদের ভালোবাসা অথবা ঘৃণা মিশিয়ে । জীবনে , শিল্পেও , মানুষ তো সবাইকে খুশি করতে পারেন না , আর এটা একটা পরিস্থিতি যা আমাদের মধ্যে সবসময়ই আছে।

একটা মানুষ সবসময়ই চুমু অথবা থাপ্পড় পাচ্ছে , আদর কিংবা লাথি পাচ্ছে , আর এটাই একজন কবির জীবন । আমাকে যেটা সবথেকে বেশি বিব্রত করে সেটা কবির জীবন ও কবিতাকে ব্যাখ্যা করা । যেমন ধরুন বহুলোক একত্রিত হন নিউইয়র্কে পি. ই. এন ক্লাব কংগ্রেসের সময় , আমি আমার কবিতা পড়ি , সামাজিক কবিতা, অনেক লোক বিভিন্ন জায়গা থেকে এক জায়গায় জড়ো হন। আমি আমার সামাজিক কবিতা পড়ি, হয়তো এটা বেশি মাত্রায় ক্যালিফোর্নিয়ায় …কিউবায় বিপ্লবকে উৎসর্গ করা সব কবিতা। তবুও কিউবার লেখকরা একটি চিঠিতে সবাই স্বাক্ষর করে লক্ষ লক্ষ কপি বিতরণ করলেন যাতে আমার মতামত সন্দেহের বিষয় বলা হলো , আর ওই চিঠিতে আমাকে এমন এক প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত করা হল যে উত্তর আমেরিকার দ্বারা আশ্রিত ও রক্ষিত তাঁরা এটাই ইশারা করলেন যে যুক্তরাজ্যে আমার প্রবেশই হচ্ছে পুরস্কারের মতো। এটা একটা সম্পূর্ণ বোকামির বিষয় । যদি কাদা ছোঁড়া না হয় , কারণ ওই রকম একটা অনুষ্ঠানে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর থেকেও অনেক লেখক এসেছিলেন , এমনকি কিউবান লেখকদের আসাও প্রত্যাশিত ছিল। নিউইয়র্কে গিয়ে আমরা আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রটি হারিয়ে ফেলিনি। তবুও এমন একটি ইশারা করা হয়েছিল , কিউবান লেখকদের তাড়নায় কিংবা অন্ধবিশ্বাসের মোহে । এই মুহুর্তে ঘটনাটা হচ্ছে এইরকম যে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আমি পার্টির ক্যান্ডিডেট , এটাই প্রমাণ করে যে আমার একটা সত্যিকারের বিপ্লবী ইতিহাসের ঐতিহ্য আছে।

আপনি অনেক গ্রন্থাগারে দান করেছেন । এখন কি ইসলো নেগ্রায় লেখকদের এক উপনিবেশ গড়ে তোলার কাজে আপনি যুক্ত নন?

 আমি একটা সম্পূর্ণ গ্রন্থগার দান করে দিয়েছি আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বইয়ের উপার্জনে আমার চলে যায়। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। বিলিয়ে দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই আর , শুধু আমার কিছু বই থেকে যেটুকু আমাকে দেওয়া হয় সেটুকুই ।

ওই আয় থেকে আমি উপকূলে একটা বড়ো জমি কিনেছি যাতে ভবিষ্যতে লেখকরা সেখানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে পারেন আর তাঁদের সৃজনশীল কাজ করে যেতে পারেন এমন একটা অসাধারণ সুন্দর পরিবেশ সেটা। এটা হবে কান্তলাও ফাউন্ডেশন—যার পরিচালকরা থাকবেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় , চিলি বিশ্ববিদ্যালয় এবং লেখক সমাজ থেকে।

কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান, আপনার প্রথম দিকের একটি বই , ধারাবাহিকভাবে হাজার হাজার ভক্ত সে লেখা পড়ে চলেছেন।

 ওই বইটার এক মিলিয়ন কপির প্রকাশ উপলক্ষে… খুব তাড়াতাড়ি এটা দু’মিলিয়ন হবে—যে সংস্করণ তার ভূমিকায় বলেছি —আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারি না কেন এমন হয়—কেন এই বইটা, যে বই প্রেম-বিষাদের, প্রেম-যাতনার , এত লোক পড়েই চলে , এত তরুণ পড়েই চলে। সত্যি এটা আমি বুঝতেই পারি না । হয়তো এই বইটা ভিন্ন ভিন্ন তারুণ্যময় প্রহেলিকার  ভঙ্গিমার ধারক। হয়তো এটা সেই সব প্রহেলিকার উত্তর দিয়ে যায়। এটা শোকভরা বই, যদিও এর আকর্ষণ এখনও কমে নি। 

আপনি এমন একজন কবি যাঁর কবিতা বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে প্রায় কুড়িটি ভাষায়। খুব বেশি অনুবাদ হয়েছে কোন ভাষায়?

 আমি বলতে চাই ইটালিয়ান… কারণ এই দুটি ভাষার খুবই সাদৃশ্য। ইংরেজি ও ফরাসি যে দুটি ভাষা ইটালিয়ান ছাড়া আমি জানি, সে দুটি স্প্যানিশের সঙ্গে মেলে না। স্বপ্নেও না, বিন্যাস কি বর্ণে ও শব্দের ভারেও নয় । এটা ব্যাখ্যামুলক সমার্থক নয় , বুঝলেন না , মানেটা ঠিক হল, অর্থাৎ অনুবাদের গ্রহণ বর্জন , কবিতা ধ্বংস করে দিতে পারে। আমার কবিতার অনেক ফরাসি অনুবাদে—-আমি এটা বলছি না যে সবক্ষত্রেই ….আমার কবিতা পালিয়ে যায় …কিছুই থাকে না,কেউ প্রতিবাদ করতে পারবে না কারণ সেখানে যা বলা হচ্ছে তাই তো লেখা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট এটা আমি যদি একজন ফরাসি কবি হতাম , আমি কবিতায় যা করেছি আমি বলতাম না, কারণ শব্দের মূল্য সম্পূর্ণ আলাদা । আমি হয়তো লিখে ফেলতাম ভিন্ন কিছু।

আর ইংরেজিতে?

আমি দেখি যে ইংরেজি ভাষা স্প্যানিশ থেকে এত ভিন্ন —তার থেকে এত বেশি সরাসরি… যে অনেকসময়ই তা আমার কবিতার অর্থ প্রকাশ করে ফেলে কিন্তু আমার কবিতার আবহ প্রকাশ করতে পারে না। আবার এমনটাও হয়তো হতে পারে যখন একজন ইংরেজ কবি স্প্যানিশে অনূদিত হন ।

কোন ধরনের বই পড়েন আপনি?

আমি ইতিহাসের পাঠক , বিশেষত আমার দেশের প্রাচীনতম ইতিবৃত্তের । চিলির এক অনন্য ইতিহাস আছে । এটা শুধু মিনার বা প্রাচীন স্থাপত্যের জন্য নয়, সে সব নেইও এখানে , বরং আগ্রহ এ কারণে যে চিলি আবিষ্কার হয়েছিল একজন কবির দ্বারা …

দোন আলোনসো দে এরসিইয়া ই জুনিগার দ্বারা —-যিনি ছিলেন কার্লোস পঞ্চমের  চাকর । এবং উনি ছিলেন এক বাস্ক অভিজাত , যিনি কানকুইস্তাদোরদের সঙ্গে এসেছিলেন …বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক কারণ চিলিতে পাঠানো বেশিরভাগ মানুষই তো আসতো অন্ধকার কারারক্ষ থেকে । বসবাসের পক্ষে জায়গাটা খুবই দুর্ভাগ্যের । আরাউকানিয়ান ও স্পেনীয়দের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, যা মানবতার ইতিহাসে  দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ। আরাউ কানিয়া-র অর্ধ-বন্য উপজাতিরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়েছেন  তিনশ বছর ধরে স্পেনীয় আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে । দোন আলোনসো দে এরসিইয়াই জুনিগা , তরুণ এক মানবতাবাদী , এসেছিলেন  দাসসৃষ্টিকারীদের সঙ্গে , যাঁরা  সমগ্র আমেরিকাকে পায়ে পিষে দিতে চেয়েছিলন  এবং পিষেও ছিলেন , তবে ব্যতিক্রমী ছিল এই বন্য অঞ্চল যাকে আমরা বলে থাকি  চিলি। দোন আলেনসো লেখেন ‘ দ্য আরাউকানা ‘ , কান্তিলীয়  সাহিত্যে যা দীর্ঘতম , যাতে বীরের দল যাদের তিনিই প্রথম নাম নথিভুক্ত করলেন , তার সঙ্গীরা  , সেই কান্তিলীয় সৈনিকরা যতটা আগ্রহী এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন তাদের থেকেও বহুগুণ  বেশি আগ্রহী । ‘দ্য আরাউকানা ‘, প্রকাশিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে , অনূদিত হয় এবং  ঘুরতে থাকে নানা ধাঁচে সমগ্র ইউরোপে। এটি ছিল এক মহান কবির মহান কবিতা। চিলির ইতিহাসে এভাবে পেয়েছিল মহাকাব্যিক মহত্ব এবং  বীরত্বময় জন্মলগ্ন থেকেই। অবশ্য আমরা চিলিবাসীরা , স্পেনীয় ও ইন্ডিয়ান আমেরিকা সংমিশনে দোআঁশলা মানুষের মতো ছিলাম না। আমরা স্পেনীয় সৈনিক ও তাদের ধর্ষণ অথবা রক্ষিতাজাত  নই , বরং এটা আরাউকানিয়ান ও স্পেনীয় মহিলাদের স্বেচ্ছা বা বাধ্যতামূলক বিবাহের ফসল , যে মহিলাদের বন্দী রাখা হয়েছিল দীর্ঘ যুদ্ধকালীন বছরগুলোতে। আমরা নিশ্চিতই ব্যাতিক্রমী । অবশ্য তারপরেই আসে ১৮১০ -এর পর আমাদের স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস, যে ইতিহাস ট্র্যাজিডিতে বিবাদে এবং সংঘাতে পরিপূর্ণ যাতে সান মার্তিন ও বোলিভার , হোসে মিগুয়েল কারবেরা ও ও’হিগিনস  -এর নাম প্রবাহিত হয় অশেষ পৃষ্ঠা জুড়ে সাফল্য ও দুর্ভাগ্যের আভায় । এসবই তো আমাকে বইয়ের পাঠক করেছিল যেসব বই মাটি খুঁড়ে ধুলো ঝেড়ে বার করেছি আর যেসব বই আমাকে উপভোগ দিয়েছে বিপুলভাবে , যখন আমি খুঁজতে চেয়েছি আমার দেশের তাৎপর্য …আর সব দেশের থেকে এত দূর , অক্ষাংশ হিসেবে এত ঠান্ডা , এত পরিত্যক্ত প্রান্তর , এর বিপুল প্যাতাগনিয়া , আন্ডিজ -এ এত বরফ , সমুদ্র এত পরিপূর্ণ । আর এই হল আমার দেশ চিলি। আমি তো সেই পূর্ণতায়  থাকা একজন চিলিবাসী , এমন একজন , অন্যজায়গায় মানুষ কিভাবে আমার সঙ্গে আচরণ করে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না, অবশ্যই ফিরে ফিরে আসি আমার স্বদেশে । আমি পছন্দ করি ইউরোপের বড়ো বড়ো শহর । আমি ভালোবাসি অর্নো উপত্যকা , কোপেন হাগেন …এবং স্টকহোম -এর কোনো সড়ক আর স্বাভাবিকভাবেই প্যারী, আর তবু আমাকে ফিরতেই হয় চিলিতে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

কার্ল স্যান্ডবার্গ-এর কবিতা

অ নু বা দ

অ মি তা ভ   মৈ ত্র

কার্ল স্যান্ডবার্গ-এর কবিতা

“Poetry is an echo, asking a shadow to dance” বলেছিলেন স্যান্ডবার্গ (১৮৭৮-১৯৬৯)। জন্ম ইলিনয়ে। বাবা-মা অগাস্ট জনসন আর ক্লারা জনসন। সুইডেন থেকে আমেরিকায় বসবাস করতে এসে বেশ কিছু অগাস্ট জনসন নামের মানুষ দেখে জনসন থেকে স্যান্ডবার্গ করে নিলেন নিজেদের নাম। গরিব পরিবার। রুটিরুজির জন্য তেরো বছর বয়সে স্কুল জীবন ছেড়ে কখনো দুধের গাড়ি চালানো কখনো হোটেলের কুলির কাজ, আবার কখনো ইটের ভাটায় কাজ করার পর Spanish- America War-এর সময় যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “Reckless Ecstasy” বের হয় ১৯০৪ সালে। এরপর শিকাগোতে এসে “Daily News” পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে যোগ দিলেন। প্রতিবছর ব্যাঞ্জো আর গিটার নিয়ে সারা দেশে লোকসংগীত গেয়ে আর কবিতা পড়ে বেড়াতেন কার্ল স্যান্ডবার্গ।

Carl-Sandburg

বাতাসের খেলনা বিষয়ে চারটি প্রস্তাবনা

 

আগামীকাল নামের মেয়েটি

দাঁতের ফাঁকে চুলের কাঁটা নিয়ে

ধীরে সুস্থে বসে

নিজের ইচ্ছে মতো চুল বাঁধছে

তারপর শেষ গুছিটুকু বিনুনি বেঁধে খোঁপা করে

চুলের কাঁটা বসিয়ে যেখানে দরকার

তারপর মুখ ফিরিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করছে

ঠিক আছে, কী আসে যায়?

আমার গতকাল নামের দিদিমাটি মারা গেছে।

কী আসে যায়? যারা মৃত শান্তিতে কবরে থাকুক তারা।

 

 

সেডার কাঠের দরজায়

সোনার নকশায় কিছু লেখা

আর মেয়েরাও খাঁটি সোনার।

সোনার নকশা পড়ছিল তারা মন্ত্রের মতো—

আমরাই শ্রেষ্ঠ শহর

মহত্তম জাতি আমরাই

আমাদের মতো আর কিছু থাকতে পারে না।

 

এখন ভাঙা কবজার দরজার পাল্লাগুলো বেকেচুরে ঝুলছে

আর শোঁ শোঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘন বৃষ্টির ঝাপটা

যেখান থেকে চলে গেছে সোনার মেয়েরা।

দরজার সোনার নকশায় তখনো লেখা—

আমরাই শেষ্ঠ শহর

মহত্তম জাতি আমরাই

আমাদের মতো আর কিছু থাকতে পারে না।

 

 

আগেও এমন হয়েছে

শক্তিমান মানুষেরা বড়ো বড়ো শহর বানাল

একত্রিত করল একটা জাতিকে

আর গায়িকা এবং মহিলাদের পয়সাকড়ি দিল যাতে তারা গায়—

আমরাই শ্রেষ্ঠ শহর

মহত্তম জাতি আমরাই

আমাদের মতো আর কিছু থাকতে পারে না।

যখন গাওয়া হলো

শক্তিমান মানুষেরা শুনল সেই গান

আর ভালমতো পয়সাকড়ি দিল গাইবার জন্য।

শ্রোতাদের মধ্যে ছিল ইঁদুর আর টিকটিকিরাও

 

সেই গান শুনতে এখন শুধু আছে

ইদুর, টিকটিকি আর কালো কাক যারা কা কা করছে

শুকনো কাঠগি আর কাদা দিয়ে বাসা বাঁধছে

শক্ত হয়ে যাওয়া শব্দগুলোর ওপর

যেখানে সেডার কাঠের দরজায়

সোনার নকশায় লেখা ছিল

আর সোনার মেয়েরা গেয়েছিল আদরের গান—

আমরাই শ্রেষ্ঠ শহর

মহত্তম জাতি আমরাই

আমাদের মতো আর কিছু থাকতে পারে না।

 

গান বলতে শুধু কাকেদের কা কা চিৎকার

ঘন বৃষ্টির ঝাপটা গুমরে উঠছে বাতাসে, ভাঙা দরজায়

যেখানে শ্রোতা শুধু ইঁদুর, টিকটিকি।

 

 

চৌকাঠে ইঁদুরের পায়ের হিজিবিজি দাগ

সেই দাগের হিয়েরোগ্লিফ এখন বকবক করছে

ইঁদুরদের বংশ পরিচয় নিয়ে

আর তাদের বাপ ঠাকুরদার শুদ্ধ রক্ত আর মহান জীবন নিয়ে।

আর সরে যাচ্ছে বাতাস

চৌকাঠের জমাট ধুলো দ্রে যাচ্ছে নিঃশব্দে

এমনকি ইঁদুরদের পায়ের দাগও একেবারে কিছুই বলছে না

আমাদের শ্রেষ্ঠ শহর আমাদের মহত্তম জাতির বিষয়ে

যেখানে শক্তিমান মানুষেরা শুনতো মেয়েদের গান—

আমাদের মতো আ কিছু থাকতে পারে না।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

ভিনদেশে । পর্ব ১০

ভি ন দে শে । পর্ব ১০

ঈ শি তা  ভা দু ড়ী

হোয়াইট লেডি

বার্গেন হল ফিওরডের প্রবেশপথ। পশ্চিম নরওয়ের ফিওরড-ই যে স্ক্যান্ডিনিভিয়া-ভ্ৰমণার্থীদের সবচেয়ে বড়াে আকর্ষণ এ-কথা অনস্বীকার্য।
 
বার্গেন শহরের প্রাণকেন্দ্র হার্বার-অঞ্চল থেকে ফিওরড ট্যুর করা যায়, আমরা সেই ইচ্ছেতেই গুটিগুটি এগােলাম। কাউন্টারের মহিলা টিকিট দেওয়ার সময় আঙুল তুলে একটি লঞ্চ দেখিয়ে বললেন, চারটের সময় ছাড়বে। তখন ঘড়িতে তিনটে পনেরাে, পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাতে সময়। আমরা বাজারে, রাস্তায় এলােমেলাে ঘুরে বেড়িয়ে পৌনে চারটের সময় এসে দরজার সামনে দু-চারটে মানুষের পেছনে লাইনে দাঁড়ালাম। এবং দাঁড়িয়েই রইলাম, ঘড়িতে এদিকে চারটে বেজে গেল। ব্যাপারটা কী! দরজা খােলার কোনাে চেষ্টাই নেই কেন! ইউরােপীয় মানুষেরা তাে খুবই সময়নিষ্ঠ, তবে এমন অঘটন কেন? অতঃপর প্রশ্ন করে জানতে পারলাম সেটি আদপে আমাদের লঞ্চ নয়। কী কাণ্ড! আমাদের লঞ্চ গেল কোথায় ? কাউন্টারের মহিলা তো হাত দিয়ে এই লঞ্চটিকেই দেখিয়েছিলেন! আমাদেরকে তখন সবাই দেখাল, ওই দেখ তােমাদের লঞ্চ ঘাট ছেড়ে চলে গেল। তাকিয়ে দেখি, দূরে একটি লঞ্চ যাচ্ছে, অনেক দূরে। হায় রে আমাদের এতগুলাে ক্রোনার পুরােটাই জলে গেল! ছুট ছুট ছুট, কাউন্টারে পৌঁছালাম।
 
কাউন্টারের মহিলা বললেন- ‘লঞ্চ তা তােমাদের ছেড়ে গেছে বাপু, টিকিটটা কালকের জন্য করে দিচ্ছি, তােমরা কাল যেও বরং।’
 
‘আরে না না কাল আমরা সকালের ট্রেনেই অসলাে ফিরে যাব, দেখ আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, বার্গেন থেকে ফিরড় না দেখে ফিরে যাব?’
ভদ্রমহিলা তৎক্ষণাৎ কাউকে ফোন করলেন, তারপর কোনাে বাক্যব্যয় না করে অফিসঘর থেকে বার হয়ে আমাদের দুজনকে দুহাতে নিয়ে একটি বাতানুকুল ট্যাক্সিতে ওঠালেন। ট্যাক্সিতে কেন উঠব! বিপদের ওপর বিপদ! মহিলার কাছে এসে তাে আরও মুশকিলে পড়লাম। আমাদের অবস্থা না বুঝেই ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিচ্ছে, কতগুলাে নরউইজিয়ান ক্রোনার আরও খরচ হয়ে যাবে কে জানে! নাহয় ফিওরড় ট্যুরটা নাই করলাম! কিন্তু ভদ্রমহিলা আমাদেরকে কোনােই অবকাশ দিচ্ছেন না কিছু বলার। ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে নিজস্ব ভাষায় অনেক অনেক কথা বলে ভদ্রমহিলার সময় হল আমাদের দিকে ফিরে তাকানাের, বললেন — “ড্রাইভার তােমাদেরকে একটি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে, সেইখানে ‘হােয়াইট লেডি’ নামের লঞ্চ এসে তােমাদেরকে তুলে নেবে, তােমাদের কোনাে খরচ নেই, ‘হােয়াইট লেডি’ এই খরচ বহন করবে”। তখন জানতে পারলাম লঞ্চটির নাম ‘হোয়াইট লেডি’।
 
যাইহােক, ট্যাক্সি জোর কদমে বেশ অনেকক্ষণ ধরে চলল প্রায় তিরিশ মিনিট, জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে। আমাদের কিন্তু বেশ ভয় হতে থাকল, এমন জনমানবইীন রাস্তায় দুজন তরুণীকে মেরে পাসপাের্ট, ডলার লুট হয়ে যাওয়া আমাদের দেশে এমন বিরাট কোনাে ব্যাপার নয়। কিন্তু তারা যতই রুক্ষ হােক, লােক কিন্তু সজ্জন। তাই ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।
 
এমন ফাঁকা জায়গায় আমরা দুটি মহিলাই শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে, কখন লঞ্চ এসে আমাদেরকে তুলে নেবে এই অপেক্ষায়। লঞ্চ যদি না আসে তাে হয়ে গেল! ফিরব যে তার কোনাে ব্যবস্থাই নেই, কোনাে যানবাহনের চিহ্ন নেই, কোনাে ফোন বুথও আশেপাশে নেই, বুথ থাকলে কী হত তা অবশ্য জানি না।
 
আমরা শুধু শুধুই দুশ্চিন্তা করছিলাম, দু-চার মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ এল, শুধুমাত্র আমাদের দুজনের জন্যই ওই ঘাটে লঞ্চ ভিড়ল এবং আমাদেরকে তুলে নিল। আমাদের ফিওরড় ভ্রমণ অবশ্য কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হল, কিন্তু পুরাে ঘটনাটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায়?
 
এই ঘটনার অনেকদিন পর, বারো কিংবা চোদ্দ বছর আগের একটি ঘটনার কথা না উল্লেখ করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট আয়ােজিত কলকাতার সাবেক পুজাগুলি দেখার জন্যে বাসে উঠবার আগে তাদের অফিসে বসে আছি, সেই সময় এক যুবক কাউন্টারে এলেন। কাউন্টারের মানুষ এবং সেই যুবকের কথােপকথনে বােঝা গেল, সেই যুবক ত্রিপুরা থেকে এসেছে, কলকাতা শহর দেখার নির্দিষ্ট ট্যুরটি নেওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু সে আসতে কিছু দেরি করেছে, বাস ছেড়ে চলে গেছে – হুবহু আমাদের পঁচিশ বছর আগের বার্গেনের হােয়াইট লেডি উপাখ্যান। কিন্তু পরবর্তী ছবি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। ত্রিপুরা-বাসী যুবক সকালে ত্রিপুরা ফিরে যাচ্ছে শুনেও কাউন্টারের ওপারের মানুষ কিছুই করতে পারল না, নিদেনপক্ষে টাকাটাও ফেরত দিতে পারল না। এহেন অবস্থায় বড়াে বেদনা, বড়াে আক্ষেপ, আমরা কেন তাদের মতাে হতে পারি না!

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

বনশ্রী বড়ুয়া

বাং লা দে শে র  ক বি তা

ব ন শ্রী   ব ড়ু য়া

রক্ত চুষে খায় দাঁড়কাক

কুকুরটা পোয়াতি ছিল,
পেটটা কেমন মোটা আর নাদুসনুদুস ছিল,
জরায়ুর ভেতর লেপ্টে শুয়ে ছিল চার, ছয় কিংবা আটটা বাচ্চা।

গতকালও এমন নড়াচড়া করছিল ওরা পেটের ভেতর
মাদি কুকুরটা অদ্ভুত এক প্রশান্তি নিয়ে অনুভূতিটুকু উপভোগ করছিল;

বাচ্চাগুলো পেছন পেছন তিড়িংতিড়িং লাফাবে এমন দৃশ্য স্বপ্নে দেখেছে অসংখ্য রাত।
আর দু’এক সপ্তাহ মাত্র;
আর ক’টা দিন পরই চোখ না ফোটা বাচ্চাগুলো অন্ধকারেই খুঁজে নিতো মাতৃস্তন;
আহা! কি তৃপ্তি…

স্তন!
ভয়েই শিহরে উঠে জ্ঞানহারা মৃতপ্রায় মাদি কুকুরটা!
রক্তস্রোত এখনও সারা রাস্তায় …
ওরা এত বীভৎস কেন?
স্তন কিংবা শরীর এসবের বাইরের সে ছিল মা,
যোনী কিংবা মাদি এর বাইরেও সে ছিল পোয়াতি।
প্রতিটি আঘাতে শুধু সন্তান বা শরীরের মৃত্যু হয়নি হয়েছে মা শব্দটার মৃত্যু।

মা, পোয়াতি কিংবা জন্ম,
কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়া এই শব্দগুলো আজ আর তেমন ভাবায় না;
উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিমে স্তন-শরীর মানে মাংস;
স্তন শরীর মানে উল্লাস,
আর মাংস মানেই হায়েনার থাবা।

 

মৃন্ময়ী স্নান 

মৃন্ময় লতায় কচিপাতা সাজ,
দেখেছিস আঙুল ছুঁইয়ে?
কতটা রক্তে নিস্তব্ধতা আসে?
ঘেমে উঠে শিশির নিষিক্ত মাটির ফাঁকে,
পোড়া ধূপের গন্ধে বিষাক্ত ছোবলে
কৃষ্ণচূড়ায় ভাসে কায়া;
ফাগুন ছোঁয়া জলরঙে আঁকে ক্যানভাস,
ঘুমন্ত প্রজাপতি গুমরে কাঁদে;
কুমোর গড়ে দেবীমূর্তি কামাসক্ত হাতে!
ভালবাসার উষ্ণতায় দেব-নটরাজ!
কলাপাতায় মোড়ানো আবেগ,

কিছুটা ভুলে বরফ গলে হয়ে উঠে নিশ্চুপ নদী;
কাগজের পোঁটলায় আড়াল খোঁজে মন খারাপের শহর।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_april

আবু তাহের মুহাম্মদ

বাং লা দে শে র  ক বি তা

আ বু   তা হে র   মু হা ম্ম দ

মনে পড়ে যায়

রেল ক্রসিং, সেই আমবাগান
অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা
দিনগুলি স্বপ্ন মায়া ঘেরা
প্রতিমাসের রোববার রোববার
একই পথে ঘুরে ফিরে বারবার
উদ্দেশ্যহীন শুধু রিক্সায় ঘুরবার
ধুলোবালির চট্টগ্রাম
সন্ধ্যার সলতে আলোটুকু জ্বালিয়ে
তোমাকে দেখে নবীন পিউ পাখিরা
পৌঁছে যাই মামা ভাগ্নের দরগাহে
রোজ রোজ পথে আমার দেরি হে।

পশ্চিমাকাশ রং বদলিয়ে বদলিয়ে
সন্ধ্যা নামায় শব্দহীন
শাড়ির আঁচলে আঙুল পেঁচিয়ে
সুখস্ফুরণ আঁকে কাব্যকার
এই নির্জনে
আসলে আমরা কে  কার?

আমার শার্টের কালো বোতাম
সবুজ শাড়ির সঘন আম্বর
মস্তিষ্কে জ্বর নদী-নির্ঝর
ইস যদি সন্ধ্যার পথ হারানো গাংচিল হতাম।

মনে কি পড়ে

প্রতিদিন তোমার অসুখ হতো
রোববার ছাড়া
অপেক্ষায় অপেক্ষায় হাসনুহানা ফুটতো সেদিন
জানিনা এখন কে কার অপেক্ষায় প্রহর গোনে।

পড়তি সূর্য পাহাড়ে লুটোপুটি খেয়ে
শেষমেষ সন্ধেকে স্বাগত জানায়
আনত নয়নে ধোঁয়াশায় যতো স্বপ্ন
এবার রাঙিয়ে দিয়ে যাও।

আরও পড়ুন...