Categories
2021_mar

উজ্জ্বল পাঠ । পর্ব ৯

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ৯

সে লি ম   ম ণ্ড ল

একটি নিঃসঙ্গ প্রজাপতি: স্বপনবরণ আচার্য

বছর চার-পাঁচ আগে, কথাসাহিত্যিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পোস্টে দেখি— স্বপনবরণ আচার্যের কবিতা। ওই আমার প্রথম স্বপনবরণ পড়া। এরপর পর  পর বেশ কয়েকজন স্বপ্ননবরণ আচার্যের কবিতা পোস্ট করতে থাকেন। সত্তরের এই কবি একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। প্রথম সারির সমস্ত বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখতেন। বড়ো অভিমানী। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবে তাঁর সাহিত্য সাধনা থেমে থাকেনি। 

   

যাঁর কবিতা আমায় টানে, আমি তাঁর সমস্ত লেখা পড়ার চেষ্টা করি। সেইসময় স্বপনবরণ আচার্যের কোনো কাব্যগ্রন্থ পাচ্ছিলাম না। ফেসবুকের সমস্ত লেখা সেভ করে একটা ফোল্ডার করে রাখি। স্বস্তি পাই না। ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে এই পাঠ আমার কবিতাক্রান্ত মনকে আরও উদ্রেক করে তোলে। তমালদার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, তাঁর একটি গ্রন্থ (বাছাই কবিতার সংকলন) পাওয়া যাবে। জেরক্স করে নিতে হবে। একটি বইয়ের মলাটের স্পর্শানুভব যে বই পাঠকে যতটা আন্দোলিত করে তা বোঝানো সম্ভব নয়। ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ উলটে পালটে পড়তে পড়তে স্বপনবরণের কবিতার মেঘ কখন নিজের দুয়ারে এসেছে ছাঁট দিয়েছে টের পাইনি…

 

সাতের দশকের এই কবি ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৫, কৃষ্ণনগর জন্মগ্রহণ করেন। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ট্রান্সক্রিয়েশন, নাটক, টেলিফিল্ম, থিয়েটার-ফিল্ম একাধিক ক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করেছেন। 

 

জানুয়ারি ২০১৯-এ ‘মুদ্রা’ প্রকাশনী থেকে ‘পঞ্চাশপেরিয়ে’ নামে একটি তাঁর কাব্যসংকলন প্রকাশ পায়। তৃপ্তির খিদে নিজের ভিতর আবার জেগে ওঠে। এই বইয়ের মুখবন্ধে তিনি বলেছেন— “২০০৭-এ প্রকাশিত ‘কুড়ি বছরের কবিতা’-র কয়েকটি বাদ দিয়ে বাকীগুলো এখানে রইলো। সঙ্গে এলো নতুন তেইশটি দীর্ঘ কবিতা, ড্রামাটিক মনোলগ। মোট ১২৮টা লেখা। কবিতা লেখা নিয়ে আমার আর কোনো আফশোষ নেই। চিন্তা ও অনুভব করার যেটুকু ক্ষমতা প্রকৃতি আমাকে দিয়েছেন, এই বইটি তার পরিপুর্ণ প্রকাশ।”

 

প্রথমে পড়া যাক এই কবির কিছু কবিতা—

 

একই অঙ্গে

 

মা আমায় চিনিয়ে দেবে? কোন চুমুটা

শব্দ শুধু!

যে-মেয়েটা শরীর চেনায়, হয়-মা নয়-সে

পুত্রবধূ।

 

মনে আছে? সেই সেবারে পুজোর ছুটির

নদীর ধারে—

আমি আর সাঁওতালনী! শালবাগানের

অন্ধকারে,

 

বুকে পিঠে গুঁড়িয়েছিলাম শুকনো পাতার

ভঙ্গুরতা!

সস্নেহে হিংসে করে বললে তুমি

অসভ্যতা!

 

মা জানো, সেই চুমুটাই তোমার মতো

আসল ছিল!

 

মেয়েটা-না, তোমার মতোই জড়িয়ে ধরে

কী হাসছিল!

 

 

আত্মহত্যাকলা

 

ঘুমের বড়ি, ট্রেনের নীচে গলা

গলায় দড়ি, গাড়ির নীচে চিত

এদের চেয়েও আত্মহত্যাকলা

সফল করার গুপ্ত ও নিশ্চিত

 

উপায় হলো শব্দ নিয়ে ভাবা।

জলের অনেক নীচের জলকে চিনে

বর্ণগন্ধহীনের মূর্তি গড়া

আত্মঘাতী আত্মনিমজ্জনে।

 

প্রশ্ন উঠবে, আত্মহত্যা করার

পথটা ভালোই। কিন্তু অন্যগুলো…

গলায় দড়ি, ট্রেনের নীচে গলা

ঘুমের বড়ি… কী দোষ করেছিল?

 

কারণ হলো, মরতে তো ভয় নেই

না-বাঁচতে খুব খারাপ লাগে! তাই

ক্রমান্বয়ে আত্মহত্যা করি

ক্রমান্বয়ে নতুন জীবন পাই।

 

সাপের শব্দ

 

হঠাৎ তাসের অগ্রালিকার একটা দেওয়াল নড়ে

শব্দ এলে, মাথার ভিতর তাস ছড়িয়ে পড়ে…

 

…যেমন একটি পরিতান্ত বাড়ীর উঠোনভরা

দুবেবাঘাসের ভিতর মগ্ন স্বেচ্ছাচারী ছাগল

মুখভরা ঘাস হঠাৎ ঘাসের অন্তরালে শোনে

সাপের খোসার অগ্রগমন। আতঙ্কে কান খাড়া,

…আনমনা দাঁত। দাঁতের মুঠোর ঘাস ছড়িয়ে পড়ে,

শব্দ আসছে। মাথার ভিতর তাস ছড়িয়ে পড়ে।

শোবো

 

লোহার বাক্সে ঢুকছি, শোবো

যে করে হোক শোবো।

পা গুটিয়ে রাখব। চিবুক

গিঁথিয়ে নেব বুকে…

 

জ্বর

 

জ্বর কি কখনো আসে? জুর থাকে। জুর ফিন্‌কি দেয়।

যেমন সাপের জিভ চিকণ চিবুক থেকে ঘাসের ভিতরে!

মানুষ কিছুটা জর সমস্ত জীবন ধরে বয়ে নিয়ে চলে

এবং সমস্ত জবর কিছুটা জীবন ধরে উপভোগ করে!

 

খনিজ শরীরে তার উত্তাপের প্রাণ আসে, কেউ তাকে ছুঁলে

সজীব দংশন করে। প্রতিটি ইলেকট্রন তপ্ত প্রাণ পায়,

জরাক্রান্ত মানুষের হৃৎপিন্ড প্রতি রোমে ভাগ হয়ে যায়

 

তাপমাননিরপেক্ষ, তর্কাতীত, এ পবিত্র জ্বর

সমস্ত জীবন থাকে। কিছুটা জীবন তার সাধুসঙ্গ পায়!

 

 

স্বপনবরণের কবিতায় এক আশ্চর্য জগৎ আছে। এই জগৎটা আবিষ্কার করতে সময় লাগে। মেধা ও মনন তাঁর কবিতার প্রাণবিন্দু। কিন্তু যে প্রাণের সন্ধান কবিতার রক্তমাংসে স্থূল হবে তার হদিশ দেবার জন্য একাধিক রেখা টেনেছেন। যা ওই প্রাণবিন্দু থেকেই আলোকরশ্মির মতো আগত।

 

সম্ভবত ‘একই অঙ্গে’ এই কবিতাটির মাধ্যমে স্বপনবরণের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়। কবিতাটি প্রথম পাঠেই এত আকর্ষণ করে… এত সহজভাবে কী মারাত্মক কবিতা তিনি লিখেছেন ভাবা যায় না! তীব্র শ্লেষ যখন প্রেমকে ছাড়িয়ে কোথাও তখন মায়ের আঁচল আর প্রেমিকার কপালের টিপ জ্বল জ্বল করে তখন চুমুর স্নিগ্ধতা আরও জড়িয়ে ধরে। এমনই যেন জীবনের তাস… আত্মহত্যাকলা শিখে নিলেও আত্মহত্যা করা যায় না। জলের অনেক নীচের জলকে চিনে নেওয়ার জন্য গলায় দড়ি বা গাড়ির তলায় চিত হওয়ার দরকার পড়ে না। ঘাসের অন্তরালে সাপের ফিসফিস ধ্বনির মতো শব্দ জেগে ওঠে বুকে। কবি ঘুমোতে চান। লোহার বাক্সে পা গুটিয়ে, বুকে চিবুক গিঁথিয়ে শুতে চান… কিন্তু কীভাবে ঘুমোবেন? জ্বর যখন ফিনকি জীবনের সমস্তটা উপভোগ করতে চান তখন খনিজ শরীরে উত্তাপ আসে… জল দিয়ে তিনি জল মুছতে চাননি… বরং জলের সঞ্চয়ে একটা জাহাজ কিনে তিনি নিজেই পাড়ি দিয়েছেন বৃহৎ কোনো সমুদ্রে…

 

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কি কোনো সাধনার? সম্পর্কের ভিতর এত দড়ি, পাক বাঁধতে বাঁধতে অনেকসময় যেভাবে জটলা হয়ে যায়, তাতে সমস্ত সরলরেখা একসময় বক্র হয়ে যায়। কিন্তু কবি এই সম্পর্কের মধ্যে যে লাইন এঁকেছেন তা চিরকাল সোজা অর্থ্যাৎ দুটো মানুষের মধ্যে কোনো লাইন-ই থাকে না। দুটো মানুষের মধ্যে সব নিয়ম অতি নিরাপদ। দুটো মানুষের মধ্যে পথের বাঁক নিলে জানতে হবে একটি মানুষ অন্যদিকে পা ফেলেছে। এই জীবনদর্শন কেবলই একজন কবির।

 

 

একজন মানুষের

 

দুইজন মানুষের মধ্যে থেকে, লাইন বাঁকে না

প্রথমজনের পরে দ্বিতীয়জনের পরে পরপর মানুষ দাঁড়ালে

লাইন তৈরি হয়। সে লাইন জীবনে কখনো

দু’জনের মধ্যে থেকে বেঁকে যায় না অন্য অভিমুখে।

দুটো মানুষের মধ্যে থেকে কোন লাইন বাঁকে না!

 

দুটো মানুষের মধ্যে সব লাইন চিরকাল সোজা

দুটো মানুষের মধ্যে সব নিয়ম অতি নিরাপদ:

দুটো মানুষের মধ্যে মানুষ থাকে না বলে লাইন বাঁকে না!

 

লাইন যখনই বাঁকে বুঝতে হবে একটা মানুষ

লাইন যেখানে বাঁকে বুঝতে হবে একটা মানুষ

অন্যদিকে তাকিয়েছে, পা বাড়ালো অন্য অভিমুখে…

দু’জনের মধ্যে থেকে নয়, সব মানুষের সমস্ত লাইন

একজনই মানুষের মধ্যে থেকে বাক নেয়… অন্য কোনো দিকে!

 

মানুষের মধ্যে থেকে একজনই বাক নেয় অন্য অভিমুখে…

 

 

কবিতার টান এক অদ্ভুত টান। জীবন, জীবিকা, আহার— এসব অন্বেষণের পথ, কবি নিজেই হারিয়ে ফেলতে চান। অথবা হারিয়ে ফেলেন। বুকের ভিতর জাগিয়ে রাখেন নদী। যেন নেকড়ের পানীয়। একটা বর্ষাকাল। উচপে ওঠা নদীতে তিনি শিখতে চান জলজ কৌশল। কীভাবে শিখবেন? তিনি স্মৃতিচারণরত… হাজার বছর ধরে যে বৃষ্টি পড়ছে ভারতবর্ষে, সেখান কী সান্নিধ্য চান তিনি? এই সমাজ কি সত্যিই তিনি চান? উঁচু ছাতা আর নীচু মাথার মধ্যে আমাদের সমাজ গলে যায়… চুঁইয়ে পড়ে তার বদ রক্ত… সেখানে আমরাই পা পিছলে পড়ে যাই…

 

পানীয়

 

নেকড়ের পানীয় জল যে পুকুরে থাকে তার পাড়ে

কয়েকটি অদম্য ঘাস হরিণ-করোটি গহুরে

নিশ্চিন্তে বৃদ্ধি পায়। হাওয়া, বৃষ্টিজল পায়। আলো

চোখের কোটরপথে ঘাসগুলি স্পর্শ করেছিল।

তোমার মাথার মধ্যে যদি সেই ঘাস বেড়ে ওঠে

যদি দু’টো ঘাসফুল দু’চোখের মণিমধ্যে ফোটে…

 

বুকের ভিতর ছলছল করবে নেকড়ের পানীয়।

 

স্মৃতিচারণরত 

 

আমরা     তথাপি অক্ষত

আমরা    স্মৃতিচারণরত

আমরা    ফুলে পাতায় নশ্বরতা, মূলত শাশ্বত!

আমরা    স্মৃতিচারণরত।

এখন     কেন্দ্রবিন্দু ক্ষয়িষ্ণু, তাই পরিধি বিস্তৃত।

এখন     স্মৃতিচারণরত!

 

প্রাচীন    কুয়োর নীচে জল

ডুবতে    ডুবতে নেমে চল

বৃদ্ধ       হাওয়ার মুখে ভলিরেখার সরনী চঞ্চল।

জলে     পায়ের পাতা রাখি

জলে     দন্ডায়মান থাকি

পায়ের   ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে ওঠে জলজ কৌশল

মাথায়    স্মৃতিচারণরত

এখন    পরিধি শাশ্বত

এখন    কেন্দ্রবিন্দু ক্ষয়িষ্ণু, তাই

          স্মৃতিচারণরত…

 

বর্ষাকালে

 

আপনি একটু উঁচু করলেন ছাতাটা,

আমি একটু নীচু করলাম মাথাটা ।

 

সমাজ!

একেই সমাজ বলে

বর্ষাকালে!

 

ওমনি একটু আবীর

মেঘে ছড়িয়ে গেল।

দ্রাবিড় রঙের মেঘে

আমার দ্রাবিড় রঙের ত্বকে

তোমার আর্যমুখর ঝলক

আগুন ধরিয়ে গেল!

বৃষ্টি এলে,

পরস্পরকে বিরুদ্ধবেগ পেরিয়ে গেলেই, সমাজ!

তাকে সমাজ বলে!

আড়াই হাজার বছর ধরে বৃষ্টি পড়ছে ভারতবর্ষে,

আড়াই হাজার বছর ধরে

 

আর্যরঙ ও দ্রাবিড় মেঘে হঠাৎ তীব সন্নিকর্ষে

প্রেম ছড়াচ্ছে! বর্ষাকালে

সমাজ!

একেই সমাজ বলে!

 

‘পঞ্চাশ পেরিয়ে’-এর মুখবন্ধে কবি বলেছেন—

“পেশার স্থিরতা নেই, আয়ের নিশ্চয়তা নেই, পরিবারের কারো প্রতি কর্তব্য করতে পারি না, অথচ বাড়ি আমাকে অনন্ত প্রশয় ও সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ছাড়া, এই সময় আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তিনটে অবলম্বন। লালমাটি আর জঙ্গলের দেশ, উইওলিয়ম শেক্সপিয়র আর ইংরেজি ভাষা। প্রথমটা মনের, দ্বিতীয়টা মগজের আর তৃতীয়টা পেটের।”  শেক্সপিয়র যে তাঁর মগজের অস্ত্র তা নিজেই বলেছেন। শেক্সপিয়রের নাটকের পাশাপাশি তিনি অনুবাদ করেছেন সনেট। এই সনেট পড়ে বোঝা যায়, কেন তিনি এ কথা বলেছেন…

 

সনেট ২৭

 

দিন ক্লান্ত করে। ক্লান্তি বিশ্রামে সজীব হতে চেয়ে,

দ্রুত শয্যা খুঁজে নেয়; ঘুমে ডোবে নৌকার শরীর;

কাঠ স্থির হয়ে আছে; মন ছুটছে মন ছুঁইয়ে ছুঁয়ে

আপাত অস্থির শান্ত হয়, বইছে আপাত সুস্থির।

মনের সে তীর্থযাত্রা। গন্তব্য তুমি, চিন্তা তুমি,

হে বন্ধু; শরীর নেই, অনর্গল দু’চোখে তাকিয়ে

দেখি অন্ধকার, অন্ধকার দেখা। তীর্থভূমি,

অসীম, নিশ্চুপ, স্থির। সহসা সে আকাশ ঝাঁকিয়ে

একটি জ্যোতিষ্ক জাগে। আঁধারের রূপ খুলে যায়,

ঘুমের শরীর ভেঙে জেগে ওঠে মনের জীবন;

হে বন্ধু একটি তারা তোমার রূপের ছোঁওয়া পায়,

ভয়াল রাত্রির মুখে সুন্দরের শান্ত হাসি চোঁয়ায় যখন।

                     অশান্ত দিনের দেহ; রাত্রি কাঁপে তীব্র মনে মনে

                     ঘুমে ডুবে আছে নৌকা। চিন্তা, চেতনায় দাঁড় টানে।     

 

অনেকেই মনে করেন— কবি স্বপ্ননবরণের চিন্তা জগতের প্রবেশদ্বার খুব ঘোরালো। কোন পথ দিয়ে ঢুকবেন তা অনুধাবন করার আগে পথ নিজেই ঘুরে যায়। আমার সামান্য পাঠে কবি স্বপ্ননবরণকে মনে হয়েছে, একটা উন্মুক্ত আকাশ। এখানে আলাদা করে কিচ্ছু সাজানো নেই। সবটাই প্রকৃতস্থ। জোছনার জন্য আমাদেরকে আলাদা করে ছুটে যেতে হয় না। আমাদের মাথার উপর তার আভা নিজের মতো করেই আমাদের ঋণী করে তোলে।

কবি স্বপনবরণ আচার্য

ponchash periye

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

এ. ডি. হোপের কবিতা

অ নু বা দ

অ মি তা ভ   মৈ ত্র

এ. ডি. হোপের কবিতা

এ. ডি. হোপ (১৯০৭-২০০০) নিউ সাউথ ওয়েলসের কুমায় জন্মেছিলেন। জন্মভূমি আর তাসমানিয়া গ্রামে তাঁর শৈশব কেটেছিল। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (১৯২৮) হওয়ার পর তিনি ছাত্রবৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডে যান। ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটি কলেজে ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করার সময় তিনি অস্ট্রেলীয় শাহীটয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ পাঠ্য বিষয় হিসাবে এনেছিলেন।

আটবছর বয়সে মায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবিতায় তাঁর হাতেখড়ি। ১৯৫৫ সালে বেরোল তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘The Wandering Islands’। ১৫টি কাব্যগ্রন্থের সাথে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বই রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।  

4449576-1x1-700x700

তোরণ

হৃদয় এখন হাজার গলায় গাইছে, শরীর

তোমার কোষের জেগে ওঠা গান শোনাও আমাকে

শক্ত মাটিকে সবলে ফাটিয়ে শিকড় এবার

মৃদু করাঘাতে কাঁপিয়ে তুলেছে বসন্ত; দেহ।

 

তিরতির করে উপরে উঠেছে জলকণা আর

ছড়িয়ে পড়ছে আনাচে কানাচে সবুজ বাড়ির

বুকে সুডোল মহিমা ধরেছে লাবণি পুঞ্জ

ওষ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছে তৃপ্তি প্রগাঢ় চাপের।

 

আমিও ফিরছি। এদেশে আমাকে অনেকেই চায়

ওরা নাম জানে আমার এবং ডাকে আনন্দে।

স্বপন আমিই আর তুমি তার প্রবেশ তোরণ

তোমার ভেতরে আমি জেগে উঠে আলো হয়ে যাই।

 

নৈশ স্কুল

তোমার নৈশ স্কুলে আমি যা শিখেছি আজ বলি:

যখন তোমার মুখ প্রথম অপরিমেয় সম্মতি দিয়েছে

অদ্ভুত গ্রন্থের মতো তোমার শরীর এই চোখের সামনে মেলে দিতে

আমার উত্তর লেখা পাতাগুলো পরপর যেখানে সাজানো।

যদিও ঘটনা এই: অনেক খুঁজেও আমি হদিশ পাইনি

কী তকে জাগায় ঠিক, আর সেই প্রশ্নপত্র কোঠায় লুকানো।

 

আর, তোমার ঘুমের যারা অন্যতম প্রতিবেশী— সেই

ফিসফিস, ঘুমে-হেঁটে-চলা সেই গম্ভীর মুখেরা

যাদের দু-চোখ শুধু খুঁজে ফেরে কোঙ্খানে রক্ত, ক্ষতমুখ

সেই দৈত্য, যে দুঃস্বপ্নে জেগে উঠে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়

আর সেই মেয়েটি এ কেঁপে ওঠে, শক্ত করে চেপে ধরা হাত—

যেন শিশু ভ্যাম্পায়ার তাঁর আঙুল কামড়ে ধরে আছে।

 

শিখেছি এদেরই কাছে। ছাত্র, কলমখানি তুলে ধরে

দেখে তার রক্ত ঝরছে ঘন হয়ে পৃষ্ঠায় ওপর

এবং নতুন ভাষ্য তৈরি হচ্ছে অনেকের চেনা মুখ নিয়ে

আমার বিশ্লেষণ তাদেরকে বারবার বলে দিতে থাকে,

যখন শব্দের সারি রেখা টানে আর অস্পষ্ট খাঁচা তৈরি হয়

আমাকে বন্দি করতে তাঁর জাদুকরী উজ্জীবনে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

শুভ চক্রবর্তী

অ নু বা দ | পাবলো নেরুদার একটি সাক্ষাৎকার

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

পুরস্কার যোগ্য মানুষের হাতে গেল কি না সেটা নিয়ে তর্ক করার মানসিকতায় আমি বিশ্বাস করি না: পাবলো নেরুদা

রিকার্দো নেফতালি রেইয়েস বাসোআলতো-  তাঁর এই আসল নামে কেউই কিন্তু চেনেন না পাবলো নেরুদা-কে। বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকান কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি পাবলো নেরুদা । তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০৪ সালের ১২ই জুলাই ।

স্কুল শিক্ষিকা মা যক্ষ্ণায় মারা যান পাবলো নেরুদার জন্মের এক মাসের মধ্যে। নেরুদার বাবা সেইসময় আবার বিয়ে করেন এবং পরিবারটিকে নিয়ে উঠে আসেন দক্ষিণ চিলির পাররাল নামের একটি ছোট শহর থেকে সীমান্ত শহর তেমুকোয়। খুব কম বয়স থেকেই নেরুদার কবিতা লেখার দিকে ঝোঁক লক্ষ্য করা গেছে , এই নিয়ে তাঁর বাবা উদ্বেগের মধ্যে থাকতেন। কেননা  তিনি  লেখার পক্ষে কোনও দিনই সায় দিতেন না। সেই কারণে নেরুদার মাধ্যমিক পর্ব শেষ হলে ১৯২১ সালে নেরুদাকে নিয়ে তাঁর বাবা  চলে আসেন সান্তিয়াগোয়।

কুড়ি বছর বয়সে নেরুদার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও হতাশার গান’ ১৯২৪ সালে। 

এই সাক্ষাৎকারটি যখন নেওয়া, ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে, তার ঠিক একবছরের মধ্যে ১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন রিটা গুইব্রেট এবং এটি প্যারিস রিভিউ-এর জন্য অনুবাদ করেন রোনাল্ড  ক্রিস্ট। এই অনুবাদটি করতে গিয়ে  বিভিন্ন মতামত ও পরামর্শ দিয়ে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন শিবাদিত্য সেন, কবিরুল ইসলাম, অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত, কৃষ্ণ গোপাল মল্লিক ।

neruda2

কেন আপনি আপনার নামটা বদলে দিলেন, কী কারণে ‘পাবলো নেরুদা’ নামটা আপনি বেছে নিয়েছিলেন?

আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তখন আমার বয়স তের বা চোদ্দ হবে। মনে পড়ছে যে আমি লিখতে চাই এটা আমার বাবাকে অসম্ভব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তিনি সেইসময় একটা চূড়ান্ত মানসিকতার দিক থেকে মনে করেছিলেন যে হয়ত আমার লেখালেখি আমার ও আমার পরিবারের উপর ধ্বংস করে দেবে। এবং বিশেষ করে এটা আমাকে আমার জীবনকে শেষ করে দেবে । এরকমটা ভাবার হয়ত কারণ ছিল, কিন্তু সেসব কারণ আমাকে প্রভাবিত করতে পারে নি। আর নিজেকে রক্ষা করবার কৌশল হিসেবে প্রথম যে পদক্ষেপটি আমি নিয়েছিলাম তা হলো আমার নামটা বদলে ফেলা ।

তাহলে জাঁ নেরুদা‘-র কথা মনে করেই কি আপনি নেরুদানামটা পছন্দ করলেন?

আমি তাঁর একটি ছোটোগল্প পড়েছিলাম। কিন্তু তাঁর কবিতা কখনও পড়িনি, তাঁর একটা বই ছিল ‘মালা স্ট্রনার গল্প’ এরকম একটা নামের, সেখানে প্রাগের নম্র মানুষদের কথা লেখা ছিল। এটা এমনও হতে পারে আমার নতুন নামটা এখান থেকেই আসতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু অনেকদিন আগের, আমার সেভাবে ঠিক মনে নেই। আমি মনে করতে পারছি না। অবশ্য চেকরা মনে করে আমি তাঁদেরই দেশের একজন, আর আমার সঙ্গে ওদের বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ আছে।

আপনি যদি চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাহলেও কি আপনি আপনার লেখা আগের মতোই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চালিয়ে যাবেন?

আমার কাছে লেখাটা হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না, লেখা ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারবো না।

সেইসব কবি কাদের বলতে পারি যাঁরা রাজনৈতিক ভাবে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন? 

বলা যায় আমাদের সময়টা শাসক কবির যুগ । মাও সে তুঙ আর হো চি মিন। হো চি মিন ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন গুণের অধিকারী, আপনি জানেন যে তিনি কত বড়ো মাপের সাঁতারু ছিলেন, এই ব্যাপারটা আবার আমি পারি না। অন্য একজন বড়ো কবি আছেন লেওপোল্ড সেঙ্গর, যিনি আবার সেনেগালের প্রেসিডেন্ট। আর একজন আইমে সেজেয়ার, তিনি পরাবাস্তবতাবাদী কবি, তিনি মার্টিনিকের অন্তর্গত ফোর্ট দ্য ফ্রান্সের মেয়র হয়েছেন। আমার দেশে কবিরা সবসময়ই রাজনীতির  বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন, অবশ্য প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কখনোই কোনো কবিকে আমরা পাইনি। আর অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার কোনো কোনো লেখক আছেন যাঁরা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, যেমন রোমুলো গ্যালগোস ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট।

আপনি প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনী প্রচার কেমন চালাচ্ছেন?

একটা উঠোন করা আছে। প্রথমে লোকসঙ্গীত এবং তারপর কেউ নির্বাচনী প্রচারে রাজনৈতিক সুবিধা বিষয়ে আলোচনা করেন, যাঁরা এর দায়িত্বে আছেন। এরপর আমি যেটা বলি জনগনের সামনে সেটা খুবই খোলামেলা ব্যাপার, কিছুটা অগোছালো কিন্তু অনেকটাই কাব্যময়। আর শেষ করি সবসময় কবিতা পাঠ করে। কেননা কয়েকটা কবিতা আমি যদি না পড়ি তাহলে লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু তাঁরা আমার রাজনৈতিক ভাবনার কথাও শুনতে চায়, আমি কিন্তু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ে খুব বেশি কিছু তৈরি করি না, কারণ জনগন ভিন্ন ভাষা শুনতে চায়।

আপনি কবিতা পড়েন যখন তাঁরা তখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেন?

তারা আমাকে ভালোবাসে, অনেকটা আবেগময়তা জড়িয়ে থাকে, যে কারণে আমি আমার ইচ্ছামতো কোথাও ঢুকে যেতে বা বেরিয়ে আসতে পারি না। আমি যখন যাই ওদের মধ্যে, তখন কিছু মানুষ আমাকে সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ে যায়, কারণ তারা আমাকে জনতার থেকে রক্ষা করে। লোকজন আমার চারপাশে চাপ সৃষ্টি করে এবং করতেই থাকে, এটা প্রায় সব জায়গায় একইরকম ঘটে।

যদি এটা হয় যে চিলির প্রেসিডেন্ট পদ ও নোবেল পুরস্কার  (যে পুরস্কারের জন্য আপনার নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়) -এর মধ্যে থেকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আপনি কোনটা বেছে নেবেন?

 এই ধরণের উদ্ভট কল্পনার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবার কোনো অর্থই হয় না।

কিন্তু এই টেবিলের ওপর যদি ওঁরা প্রেসিডেন্ট পদ ও নোবেল পুরস্কার এই মুহূর্তে রাখেন তাহলে ?

 সত্যিই যদি ওঁরা ওই দুটোকে এই টেবিলের ওপর রাখেন তাহলে আমি উঠে দাঁড়াবো এবং পাশের টেবিলে গিয়ে বসব।

আপনি কি এটা মনে করেন যে স্যামুয়েল বেকেটকে নোবেল পুরস্কার দেওয়াটা সঙ্গত হয়েছে?

হ্যাঁ, ঠিক সিদ্ধান্ত বলেই আমার বিশ্বাস। বেকেট লেখেন কম কিন্তু অসম্ভব লেখেন। নোবেল পুরস্কার যাঁর হাতেই দেওয়া হোক না কেন তা সবসময়ই সাহিত্যের সম্মান । পুরস্কার যোগ্য মানুষের হাতে গেল কি না সেটা নিয়ে তর্ক করার মানসিকতায় আমি বিশ্বাস করি না। এই পুরস্কার বিষয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, যদি এর কোনো গুরুত্ব থাকে তা হচ্ছে তা লেখকের সেই কাজের প্রতি একটা সম্মান জানানো। এটাই স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার কোনও জোরালো স্মৃতি আছে যেটা এখনও আপনি মনে করতে চান?

আমি ঠিক জানি না। খুব জোরালো স্মৃতি, এটা হয়তো স্পেনে যখন আমি দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম…. কবিবন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ দিনগুলোর স্মৃতি। আমাদের আমেরিকানদের মধ্যে এইরকম বন্ধুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীর বিষয়ে কখনো শুনিনি…. ওই রকম বুয়েনোস ইরিসে যেমন সেইরকম আলাস্ক্রানেত্তস বা প্রচারিত গালগল্প আছে এইটুকুই। তারপর তো ওই বন্ধুদের প্রজাতন্ত্র গৃহযুদ্ধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, সেটাও ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের ভয়ংকর বাস্তবতা। তখন আমার বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, কাউকে তো ওখানেই শেষ করে দেওয়া হলো…. যেমন গার্সিয়া লোরকা আর মিগুয়েল এরনানদেজ, এবং অন্যরা মারা গেলেন নির্বাসিত হয়ে। আমার জীবনের ওই সময়টা ঘটনাবহুল, গভীর আবেগময় সমৃদ্ধ, এটাই আমার জীবনের বিবর্তনকে সম্পূর্নভাবে বদলে দিয়েছে।

এই মুহূর্তে কি আপনাকে ওঁরা আপনাকে স্পেনে ঢোকার অনুমতি দেবে?

সরকারীভাবে আমার ওখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। একবার তো চিলির দূতাবাস থেকে কিছু পাঠ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। হয়ত এটা সম্ভব যে ওঁরা আমাকে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। কিন্তু আমি এটা চাই না, এটাই সুযোগ, কারণ সেটা স্প্যানিশ সরকারের পক্ষে অনুকূল। কেননা যে মানুষটা তাঁদেরই বিরুদ্ধে এমন সব জোরালো দাবি তুলছে, লড়ে যাচ্ছে তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলে অন্তত গণতান্ত্রিক অনুভূতির বিষয়টি প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে যাওয়া।

অবশ্য এমন অনেক দেশ আছে যেখান থেকে আমাকে সত্যি বার করে দেওয়া হয়েছে, এটা এখন আমার খুবই বিব্রতকর বলে  মনে হয়।

এটা ঠিক যে কোনো একটা দিক দিয়ে গার্সিয়া লোরকার বিষয়ে আপনার শোকগাথাটি যা আপনি লোরকার মৃত্যুর পূর্বেই রচনা করেছিলেন, তাঁর ট্র্যাজিক পরিসমাপ্তিকেই আপনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।

 হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কবিতাটি বিস্ময়কর। এটা বিস্ময়কর এই কারণে যে তিনি ছিলেন একজন সুখী মানুষ, কী যে উৎফুল্ল, ফুর্তিবাজ একজন মানুষ! সত্যি তাঁর মতো মানুষ আমি খুব কম জনকেই জানি। এবং তিনি ছিলেন একজন মূর্ত বিগ্রহ। হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি তাঁর জীবনের প্রতি ভালোবাসা, সেখানে সাফল্যের কথা নেই। এটা ঠিক যে তিনি তাঁর জীবনের অস্তিত্বের প্রতিটি মিনিট উপভোগ করতেন… তিনি ছিলেন সুখের প্রাচুর্যে থাকা একজন। যেটা আমি বলতে চাই যে তাঁকে হত্যা করার অপরাধ ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমার অযোগ্যের মতো একটি অপরাধ।

আপনি মিগুয়েল এরনানদেজের কথা উল্লেখ করেছেন আপনার নানা কবিতায়।

এরনানদেজ ছিল আমার সন্তানের মতো। কবি হিসেবে সে আমার ঘরের ছেলে এইরকম একটা সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে। সে জেলে গেলো আর মারা গেল সেখানেই, কারণ সে গার্সিয়ার লোরকার মৃত্যুর সরকারী ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেনি। যদি এমনটা হত যে তাঁদের ব্যাখ্যা ঠিক, তাহলে কেন ফ্যাসিস্ট সরকার মিগুয়েল এরনানদেজের মৃত্যু পর্যন্ত তাকে রেখে দিল কারাগারে? কেন তাঁরা চিলির দূতাবাস প্রস্তাব করা সত্ত্বেও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো না! তারা কেন এটা অস্বীকার করল? এটা সত্যি যে মিগুয়েলের মৃত্যু একটা হত্যাই।

ভারতবর্ষে কয়েক বছর থাকার মধ্যে কোন বিষয়টি আপনার সবসময় মনে থেকে গেছে?

ওখানকার ঘটনার বিষয়ে আমি কখনওই প্রস্তুত ছিলাম না। একটা অপরিচিত মহাদেশের বিস্ময়কর সবকিছু আমাকে অভিভূত করেছিল, এবং আমি প্রায় মরিয়া বোধ করছিলাম কারণ আমার জীবন এবং নির্জনতা সেখানে দীর্ঘ ছিল। কখনও কখনও আমি আকর্ষিত হতাম বর্ণময় সিনেমায়, অসম্ভব , দারুণ সব চলচ্চিত্র, কিন্তু আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম না, অনুমতি পেতাম না। আমার এমন কখনও হয়নি যা ভারতবর্ষের মতো একটা দেশে  দক্ষিণ আমেরিকান বা অন্যান্য বিদেশিরা মিস্টিসিজম নিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করত। তাঁরা তাঁদের চিন্তাধারার জন্য এক ধর্মীয় উত্তরের সন্ধানে বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করত। অন্তত আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল সেটা হল, সমাজতাত্ত্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে আমার মধ্যে একটা গভীর বিচলিত বোধ জন্ম নিয়েছিল। ওইরকম একটা নিরস্ত্র দেশ, এত আরক্ষণহীন, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে আবদ্ধ। এমনকি ইংরেজি সংস্কৃতি, যার প্রতি আমার অসম্ভব পক্ষপাত, মনে হয়েছিল ঘৃণ্য কারণে সেইসময় অনেক হিন্দু বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে এই সংস্কৃতিতে নিজেদের সঁপে  দিয়েছেন। ওখানকার বিদ্রোহী তরুণদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল, মিশতাম তাঁদের সঙ্গে, আমার রাষ্ট্রদূত থাকা সত্ত্বেও আমি ওদের জানতে চাইতাম ওইসব বিপ্লবীদের কথা যাঁরা স্বাধীনতার আন্দোলনের অংশ ।

ভারতবর্ষে থাকার সময়েই কি আপনি রেসিডেন্স অন আর্থলিখেছিলেন ?

 হ্যাঁ, এটা ঠিকই। তবে ভারতবর্ষ আমার কবিতায় খুবই সামান্য প্রভাব ফেলেছে।

এই ভারতবর্ষ থেকেই তো আপনি সেই অস্থিরময় চিঠিগুলো লিখেছিলেন আর্জেন্টিনার হিক্টর এয়ানিসকে ?

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ওই চিঠিগুলো আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওঁর মতো একজন লেখককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না, তিনি নিজেই একজন উদার মানুষের মতো, দায়িত্বশীল মানুষের মতো আমাকে সংবাদ ও পত্র-পত্রিকা পাঠাতেন, ওঁর মধ্যে এটাই বড়ো একটা দিক যে তিনি আমাকে নির্জনতার মধ্যেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আমার নিজের ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে যাবার ভয় হচ্ছিল বছরের পর বছর। আমার এমন কারও সঙ্গে দেখা হয়নি যাঁর সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা যেতে পারত।

আলবর্তিকে আমি একটা চিঠিতে স্প্যানিশ অভিধান চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। আমাকে তখন রাষ্ট্রদূত পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল নিম্নমানের পদ আর এ পদে কোনো বৃত্তি ছিল না। আমি সময়টা কাটাতাম সর্বোচ্চ দারিদ্র্য আর সর্বোচ্চ নির্জনতায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাউকে দেখা যেত না ।

সেখানেই আপনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল জোসি ব্লিসের সঙ্গে , এবং তাঁর কথা প্রায় নানা কবিতায় আপনি উল্লেখ করেছেন।

 হ্যাঁ, জোসি ব্লিস ছিলেন এমন একজন নারী যাঁর প্রভাব আমার কবিতায় বেশ গভীর।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

ভিনদেশে । পর্ব ৯

ভি ন দে শে । পর্ব ৯

সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার  কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে  আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।

ঈ শি তা  ভা দু ড়ী

মাইন নদীর ধারে | শেষ পর্ব

আমরা পরদিন সকালবেলায় Alte Oper-এ গেলাম। এটি পুরনাে অপেরা হাউস। আমরা এমন সময়ে গিয়েছিলাম যে তখন বাড়িটিতে মেরামতির কাজ চলছে। শুধু ওই বাড়িটিতে নয়, ফ্রাঙ্কফুর্টের অধিকাংশ বাড়িতে, শুধু ফ্রাঙ্কফুর্টে নয় প্যারিসে লন্ডনে যেখানে-যেখানে গিয়েছি সব জায়গাতেই মেরামতির কাজ লক্ষ করলাম; ফলে চিন্তা এসে যায়; এই বছরটি মেরামতি বর্ষ নাকি, যেমন নারী-বর্ষ, শিশু-বর্ষ হয়! তা যাই হােক, মূল অপেরা হাউসটি এতই সুন্দর যে এটি ড্রেসডেন বা প্যারিসের অপেরা হাউসের হিংসার কারণ হতে পারে। ১৮৮০-র ২০ অক্টোবর এই অপেরা হাউসের উদ্বোধন এতই জাঁকজমক করে হয় যে অতীতের রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠানও হার মেনে গিয়েছিল। ১৯৪৪-এর বােমাবর্ষণে এটি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮১-তে পুনরায় চালু হয়। ১৯৮৭-তে একটি উন্মাদ এতে আগুন লাগায় এবং পুনর্নির্মাণ করতে তিন বছর সময় লেগেছিল। এখানে জ্যাজ ও নানারকম সঙ্গীত-অনুষ্ঠান হয়। বেসমেন্টে রেস্টুরেন্ট এবং গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। Alte Oper-এর সামনে একটি সুন্দর পার্ক রয়েছে, সেখানে সারাদিন বাচ্চা-বুড়াে সকলের ভিড় হয়, মানুষজন রােদ পােহায়।
 
এই Alte Oper থেকে দূরে টেলি কমিউনিকেশনের মিনার দেখা যায়, সুচের মতাে সরু মাথাটিই সেখান থেকে দেখা যায়। পরে ব্যাড হ্যামবার্গ নামে একটি মফস্বল অঞ্চল থেকে ফেরার পথে ট্রেনের জানলা দিয়ে ওই মিনারের মাথা ছাড়া অন্যান্য অংশও দেখতে পেয়েছিলাম। ৩৩০ মিটার উঁচু এই টাওয়ারটি নাকি পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে উঁচু।
 
ফ্রাঙ্কফুর্টে বিরাট-বিরাট দোকান। একটি দোকানের চারদিকে প্রবেশপথ। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে একটি দরজা। দোকানটিতে অ আ ক খ সবই পাওয়া বায়। আমরা জিনিস দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ আমরা দেখলাম, একজন মধ্যবয়সি খুবই ভদ্রজনােচিত মানুষ, ভাল জামা-কাপড়-টাই পরে মন দিয়ে সিডি ক্যাসেট দেখছিল, হঠাৎ একটি ক্যাসেট নিয়ে দরজা দিয়ে দ্রুতগতিতে হেঁটে বার হয়ে গেল সাবওয়ে স্টেশনের দিকে। আমি আর সােমা দুজনেই দেখলাম, আরও কেউ কেউ হয়তাে দেখেছিল; দোকানিরা নিশ্চয় কেউ দেখেনি, যদিও চারদিকেই ক্লোজ সার্কিট টিভি র ক্যামেরা। আমি সােমা আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ, ইউরােপীয় মানুষের এরকম আচরণে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা, না, আনন্দিত হওয়ার কথা?
 
সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের সামনে থেকে ১৯ নম্বর ট্রামে করে Messe-তে যাওয়ার পথে ট্রামে হঠাৎ শুদ্ধবাংলা কথা কানে এল, ‘আপনারা ভারতীয়?’ হঠাৎ অনেকদিন পর নিজের ভাষা শুনলে কার না ভাল লাগে! পরিচয়ে জানা গেল, তিনি বাংলাদেশি, বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত। আমরা দুটি না-বৃদ্ধা মহিলা বিদেশে না-জানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় থেকে আলাপে যেতে চাইনি।
 
অতএব ট্রাম থেকে নেমে আমরা আমাদের গন্তব্যে, বিরাট মেলা প্রাঙ্গণ, এখানে বিশ্ব বাণিজ্য মেলাটি হয়, এলাহি ব্যাপার, যদিও আমরা মেলার সময় যাইনি। দুপুরবেলার খা-খা রােদে মাইল-মাইল হেঁটে দেখি Messe-র এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত। Festhalle-এর যে ছবিটি আমরা দেখেছিলাম ফ্রাঙ্কফার্টে রওনা হওয়ার আগে সেটি ১৯৮৮ কি ১৯৮৯-এর—ছবির সেই বাড়িটির সঙ্গে আমাদের চোখে দেখা বাড়িটির অনেক তফাত, যদিও তখনও বাড়িটি গােল এবং যথেষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এখানে সপ্তাহে দুদিন কনসার্ট ইত্যাদি হয়। এই হলটিতে নাকি বারাে হাজার মানুষ একসঙ্গে জমায়েত হতে পারে। ফ্রাঙ্কফুর্টে যাওয়ার আগে পড়েছিলাম ২৪ তলা Torhaus বাড়িটি Messe তে জাতীয় সুবর্ণ পদক পেয়েছে স্থাপত্যের জন্য। সেই বাড়িটিকে দেখার জন্যে হেঁটে হেঁটে আর কুল পাই না, শেষে বাড়িটিকে পাওয়া গেল যদিও চেহারায় আমূল বদল। সেই বাড়িটি দেখে এমনই বিভাের যে ভুল রাস্তায় হাঁটা লাগিয়েছি। ওইসব দেশে একবার ভুল রাস্তায় গেলে আর রক্ষে নেই, বিশাল নাকানি চোবানি খেয়ে তবেই ঠিক রাস্তায় ফেরা যায়। সােমা আমাকে সমানে বোঝানোর চেষ্টা করছে এটা শহরের রাস্তা নয়, ডানদিকে গেলে শহরে যাওয়া যাবে, আমরা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তাে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বােদ্ধা, অতএব আমি কিছুতেই বুঝবো না। আমার বক্তব্য ছিল এই রাস্তা শুধু বাঁদিকেই যাবে কে বলল, ডাননিকেও নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু না, সত্যিই ওই রাস্তাটি শুধু বাঁদিকেই গিয়েছিল। সোমার কথা না শুনে ওই রাস্তা ধরে হাঁটলে সম্ভবত আমরা Bockenheim অঞ্চলে চলে যেতাম।
 
আমাদের বছর দুয়েক আগে জার্মানিতে গিয়ে রাইন নদীর বুকে বেড়ানাের স্মৃতি এমনই মধুর যে এবারে দুদিন ধরে জার্মানিতে এসেও সেই নদীর দেখা না মেলায় মনটা হু হু করে উঠল। তৃতীয় দিনেই সম্ভবত রাইনের টানে এয়ারপাের্ট ছাড়িয়ে চলে গেলাম উইসবাডেনে S৪ লাইনের ট্রেনে করে। Maing Sind স্টেশনের গায়েই আমরা রাইন আর মাইন এই দুই নদীর সংযােগ দেখতে পেলাম। উইসবাডেন থেকে ফেরার পথে অন্য লাইনের ট্রেন ধরে অন্যদিকে দিয়ে ফিরেছিলাম—সে ট্রেন যায় আমাদের জনতা এক্সপ্রেসের চেয়েও খারাপ এবং সে ট্রেনে লােক নেই বললেই চলে। পুরাে ট্রেনে সম্ভবত ১০ থেকে ১৫ জন লােক। আমাদের কম্পার্টমেন্টে আমরা দুজন, ভয়ে গা ছমছম করার অবস্থা। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরকে দুদিন ধরে যতটুকু দেখেছি তাতে খুব একটা নির্ভেজাল মনে হয়নি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সন্দেহজনক মানুষকে বেশ ভালই দেখা যায়। সাবওয়েতে বা স্টেশনের চারপাশে বা খুব ব্যস্ত এলাকায়ও যখন ভিড় কমে যায় তখন নেশাগ্রস্ত সন্দেহজনক মানুষজন দেখা যায়। তাদেরকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
 
আমরা শুক্রবারে একটি এলাকায় গিয়েছিলাম, Hauptwache র কাছাকাছি Fressgass-এর দিকে, সেখানে প্রতি শুক্রবারে হাট বসে। বই থেকে আরম্ভ করে ছুরি কাঁচি, জামাকাপড়, খাদ্যবস্তু সবই পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখি একটি স্টলের সামনে খুব ভিড়, বিক্রেতা গরম-গরম কী যেন ভাজছে! সােমা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিয়েছে বস্তুটি আলু। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম জার্মানদের সঙ্গে—নির্ভেজাল আলুর বড়া। খুবই বড়-বড়, সঙ্গে আবার আপেলের সস, জার্মান মানুষেরা দেখলাম খুবই খাদ্যরসিক!
দেখতে দেখতে আমাদের ভারতে ফেরার দিন এসে গেল, শনিবারে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে রওনা হলাম। ইয়ুথ হস্টেলের সামনেই বাসস্টপ। নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম, ক্রমে-ক্রমে একজন দুজন করে আরও চার-পাঁচজন এসে গেল বাসস্টপে। আমাদের ঘরের দুটি মেয়ে কোরিয়া থেকে এসেছিল, ফ্রাঙ্কফুর্টে দুদিন ছিল, তারা শহরটাকে দেখেনি, মফস্বলে ঘুরে বেড়িয়েছে, প্রচুর কেনাকাটা করেছে আর ক্যাসিনোর আড্ডায় গিয়েছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট রেল স্টেশনের বাইরে থেকে নিয়মিত বাস ছাড়ে ক্যাসিনাের আড্ডায় যাওয়ার জন্য, দুপুর থেকে মধ্যরাত অবধি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাসিনাের জায়গা মন্টি কার্লোতে গিয়েই আমরা ক্যাসিনােতে যাইনি, অতএব ফ্রাঙ্কফুর্টেও যে যাব না এ আর নতুন কথা কী! আমরা নিতান্তই বেরসিক।
 
ওই কোরিয়ার মেয়ে দুটিরও ওইদিন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে চলে যাওয়ার কথা, তারা হস্টেল থেকে বার হয়ে বাসস্টপে না দাঁড়িয়ে সােজা বিপরীতদিকে হেঁটে চলে গেল। খুবই বিস্মিত হলাম, তারা স্টেশনে যাবে অথচ বাসস্টপে দাঁড়াল না, তার ওপর আবার উলটো পথে হাঁটে কেন, বিষয়টা কিরে বাবা! সে যাক গে, তাদের নিয়ে ভেবে কাজ নেই, নিজেদের বাসটা এলে হয়! আধঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি, বাস আর আসে না! ওসব দেশে তাে সবই ঘড়ির কাঁটা পারে। তবে? সােমা খুবই চিন্তিত। আনাদের পাশেই একটি ছেলে, ওই স্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে এমন জমিয়ে গল্প আরম্ভ করেছে, যে তার তো কোনও হুঁশই নেই। সােমা তাদের গল্প না থামিয়ে পারল না। ছেলেটির তখন হুঁশ হল, আরে ওর ট্রেনই তাে ছেড়ে গেছে। এহ বাহ্য! অতএব ট্রেন যখন ছেড়ে চলেই গেল তখন আর গল্প করতে বাধা কোথায়! সে ততোধিক উৎসাহ নিয়ে পুনরায় গল্প করতে আরম্ভ করল। দশ মিনিট পরে সে-ই আবিষ্কার করল একটি নােটিশ, সেদিন ৪৬ নম্বর বাস বন্ধ। যদিও নােটিশটি জার্মান ভাষায় লেখা এবং ওই স্টপে দাঁড়ানাে ছেলে-মেয়েরা সবাই অন্যভাষী, তবু আমরা সবাই বুঝতে পারলাম ওই নােটিশটি। আমরা, আমি বা সােমা কেউই ওই ছেলেটির মতাে দুঃসাহসী নই, আমাদের প্লেন ছেড়ে চলে গেলে আমাদের চিন্তাহীনভাবে গল্প করার সাহস নেই, অতএব আমাদের তখন মারাত্মক অবস্থা, সােমার তো উন্মাদ হওয়ার উপক্রম।
 
ততক্ষণে বুঝলাম কোরিয়ার মেয়েগুলি দোকান-ক্যাসিনাে যা-ই করুক আসলে বুদ্ধিমতী। ম্যাপ দেখে তখন আবিষ্কার করলাম আমরা উল্টোদিকে কিছুটা হাঁটলে ১৫ আর ১৬ নম্বর ট্রাম পাওয়া যাবে, সেই ট্রামে করে Muhlberg স্টেশনে গিয়ে S8 লাইনের ট্রেন ধরে এয়ারপাের্ট যাওয়া যাবে। তাে, এবার সেই ট্রামের খোঁজে রওনা হলাম। সােমা তখন এতই অস্থির যে কী করে তাকে উত্তেজনামুক্ত করব ভেবে ঠিক করতে পারছি না। একে তাে জিনিসের বােঝা, তায় পথ চিনি না। পথে এক মহিলার কাছে সােমা ট্রামের খোঁজ করল। সােমার ইংরেজি প্রশ্নের জবাবে ওই মহিলা যথারীতি জার্মান ভাষায় কথা বলে গেলেন। ভদ্রমহিলা অবশ্য আকারে-ইঙ্গিতেও বােঝানাের চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত ট্রাম পাওয়া গেল। এবং নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌছে সােমার তখন একগাল হাসি। এয়ারপাের্টে যথা সময়েই পৌঁছেছিলাম আমরা সেদিন।
 
সমাপ্ত 

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

নারী শহরের সম্পদ । পর্ব ৩

বি শে ষ  র চ না । পর্ব ৩

নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় থেকে তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের ফরাসী ও মার্কিনি বিশিষ্ট মহিলা কবিদের এক গুচ্ছ জানা অজানা কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছেন বর্তমানে কর্মসূত্রে ফ্রান্স নিবাসী ম্যাডিকেল আল্ট্রাসাউণ্ডের তরুণ গবেষক…

রূ প ক  ব র্ধ ন   রা য়

নারী শহরের সম্পদ

ক্লেয়ার মালরুর জন্ম ১৯২৫ সালে, দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের আলবি শহরে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। মালরুর বাবা নাজিদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘ফ্রেঞ্চ রিজিসস্ট্যান্স’-এর সদস্য ছিলেন। কাজেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাবার মৃত্যু এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তাঁর শুরুর দিকের লেখার একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে। ১৯৩৬ সালে বাবার হাত ধরে দক্ষিণ ফ্রান্স ছেড়ে প্যারিসে চলে যান মালরু। সেখানেই বিখ্যাত École Normale Supérieure-এ পড়াশোনা শেষ করেন। তার পর অবশ্য জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন প্যারিসে।

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অবশ্য অল্প কিছু সময় ইংল্যাণ্ডে ছিলেন। সেখানেই ইংরেজি ভাষার প্রেমে পড়েন এবং পরবর্তী সময়ে একটানা বহু সমসাময়িক ইংরেজি ভাষার কবিকে ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন এলিজাবেথ বিশপ, ডেরেক ওয়ালকট, সি কে উইলিয়ামস, অ্যান কারসন, ওয়ালেস স্টেভেন্স, চার্লস সিমিক প্রমুখ। এছাড়া এমিলি ডিকিনসনের অনুবাদ মালরুকে এনে দিয়েছে Grand Prix National de la Traduction পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে Chevalier de la Légion d’honneur খেতাব।

গদ্য ও কবিতা মিলিয়ে মালরুর নিজস্ব বইয়ের সংখ্যা মোট ১১। তার মধ্যে সাতটিই প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালের পর। তাঁর লেখার তিনটি দ্বিভাষী এ্যান্থলজি-ও প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রে।

মালরুর লেখার ভাব, ভাষা এবং গঠন মূলত ফরাসীতে হলেও ডিকিনসন সহ ইংরেজি ভাষার বহু কবি লেখকের প্রভাব তাঁর কাজে স্পষ্ট। মালরু এমন একজন অপ্রথাসিদ্ধ সাহিত্যিক, যাঁর লেখায় ইংরেজি ও ফরাসী এই দুই ভাষার বুননের প্রভাবই সমান। ফরাসী কবিদের মধ্যে জঁ ফোলাঁ, ইভস বোনেফয়, এবং মালার্মের প্রতি মালরু অগাধ সম্ভ্রম প্রকাশ করে থাকেন। তাছাড়া ডিকিনসনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে নিজেই একাধিকবার বলেছেনঃ

“an encounter with the uncanny,” এবং “the awakening of a “personal affinity.”

FRANCE - FEBRUARY 20:  Translator Claire Malroux in France on February 20, 1998.  (Photo by Louis MONIER/Gamma-Rapho via Getty Images)

ক্লেয়ার মালরু (Claire Malroux)

শব্দ মর্মভেদী…

শব্দ মর্মভেদী

            বৃষ্টি

যা প্রবাহিনী ও

আলসে গুঞ্জনকে গর্ভাধান করে

                 ওরা ওড়ে

ঈগলের থেকে উঁচুতে

এবং ওরা ফেরেশতা

               ওরা খসে পড়ে

এবং ওরা নুড়ি

স্মৃতিতে লালাভ বৃত্তের

পদাঙ্ক অনুসরণকারী

                বীর্য

দিনের চাদরগুলোর ফাঁকে

মৃত্যুহীনতার অক্ষিবিভ্রম

             উপভোগ করে

 

পবিত্রতম লালা…

অট্টহাস্য, একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস, দিগন্তে আঘাত হানে

কিছু একটা অভিমুখে ছুটে যায়, পাতলা হওয়া রামধনু

ছিটিয়ে দেওয়া ধুলো, উলের জড়ানো

সুতো পুরনো বাসার রঙ

কিংবা ইউইয়ের দল যা কারো চোখে পড়তো

রাজধানীর মিনারগুলোর অদূরেই, তড়পানো

একটা দ্বীপে উঁচু পীচ গাছটার ছায়ায়

যেখানে জংলী আপেল গাছগুলো ওদের হাত মুচড়ে দেয়

কিন্তু মানুষের কাছে এমন এক বাগিচার আর চাহিদা ছিল না

মাটিতে নিজেদের মুকুট খুঁজতে খুঁজতে

পাখিরা হিরের মত ঝরে পড়েছিল

সমুদ্রের পোশাকের তলায় গুনগুন করেছিল বাতাস, পাতলা

উপড়ে নেওয়া, সাদাগুচ্ছ; চুল

এক থোকা কম্পমান পালক

একে একে ছিঁড়তে ছিঁড়তে, ও আমায় ভালবাসে, ও ভালবাসে না আমায়

 

এভাবেই সমস্ত কিছু তাকে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় হাড় দীনতায়

চামড়া খসে নির্গত হয়, শ্লেষ্মা বা মেডুসা

বালির উপর কর্দমাক্ত জলের ছায়া

 

ব্যারক

বিদ্যুৎ ও বাতাসের সঙ্গীত, তারাদের বিশৃঙ্খলা

ভাসমান অপেরাদের টুকিটাকি থেকে বহুদূরে

সমতলের গোলমাল ঘিরেই আমার চলাফেরা

বাকলের আঁশ, আঁকিবুঁকি কাটা কোটি কোটি পাতা

সাপের চেরা জিভ

যেন কালো আঙুরের রস দিয়ে এমন এক ক্ষার সম্পাদন করতে পারি

যা দিয়ে সমস্ত কিছুকে মুছে সাফ করে ফেলা যায়

প্রত্যেকটি পরমাণুতে এক কদাকার উজ্জ্বল দেবদূত উন্মুক্ত করতে পারি

যা মূর্তির সোনায় পেরেক মারা প্রজাপতি হবে না

অথবা হবে না কয়্যার দলের পিছনের ব্যারক চন্দ্রমল্লিকা

প্লাস্টার কাজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া

কালো ভেড়ার পালকে পথ দেখান রাখালের চুল

 

আমার দেবদূত শ্বাশত নন, আমি তাঁর হাত ছুঁয়েছি

এবং কিছুটা চোখের জল ঝরিয়েছি তাঁর পায়ের উপর

রামধনুতে পুনর্জন্ম পাওয়া কালপুরুষ

ফুলেদের বরফ, বৃষ্টিধারার জন্মস্রোত

ভোরের মার্বেল পাথরের পাদদেশে উষ্ণ হওয়া

আলোকিত বনবীথির ছায়া

সমুদ্রের স্তন নীলাভ করা, দুই জলভূমির মাঝে

সাঁতরানো, দুই বাতাসের মাঝে বহমান

নিঃসাড়, দু’টি শব্দের মাঝে ভাসমান, আমার গলা,

আমার ঠোঁট ছুঁয়ে যাওয়া, অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলা

 

নেকড়ের মত সন্ধ্যায় ঘনতর

নৈঃশব্দে সে নির্লিপ্ত হয়ে যায়

আমার আর কখনই ওর মুখ ওর পাখি-গ্রীবা জানা হবে না

দুটো খাদের মত ওর চোখ

 

সমুদ্র খেলাগুলো…

সমুদ্র খেলাগুলো

এই নদীগুলোর ধার ঘেঁষে লেখার সর্পিলতা

সৈকতের ঢাল

ছাড়িয়ে যাবে না

 

প্রকৃত পাঠ্য সুদূরে নির্ঘোষিত

নিজের শরীরে চেপে ধরা

দুর্ভেদ্য

ঘূর্ণি

 

শব্দ চলাফেরা করে অগ্রসর-সূত্রে

জীবন-পদচিহ্নের সাথে

ছড়ানো ব্যথা ও

দূরগত অন্তঃসারের মাঝে

অজ্ঞানান্ধ

বাদাম শাঁসের হৃদয়

 

কখনও হাতটা যখন

শক্ত কিছু ছুঁয়ে ফেলে

বিচরণ নিজের আবরণ সরায়

আর তার উদ্ভাসকতায় ভাষা

ছলনাময়কে একত্রিত করে

গুরুত্বপূর্ণ কাজ-

Traces, furrows , José Corti, 2009 

The Woman Without Words , The Astral Beaver, 2006 

Neither so distant , the Astral Beaver, 2004 

Suspense , the Astral Beaver, 2001 

Reverdir , Rougerie, 2000 

Old Sun , Astral Beaver, 1998 

রূপক বর্ধন রায়

অনুবাদক

GE Heathcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত, ফ্রান্স-এর নীস শহরে থাকেন। টার্কি-র সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্ত্রাস্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভারসিটি ও পি এইচ ডির পর বছর খানেক জার্মানির ফ্রনহফার সোসাইটিতে সায়েনটিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। লেখালেখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ট্রাভেলগ, সাহিত্য মনন নিয়েই। কলেজজীবনে বন্ধুরা মিলে “দেওয়াল” নামক কবিতা পত্রিকা চালিয়েছেন কয়েক বছর। এছাড়াও কবিতা, গদ্য প্রকাশ পেয়েছে একাধিক বাঙলা অনলাইন পত্র পত্রিকায়। লেখা লেখি ছাড়াও গান বাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে রূপকের সমান আগ্রহ রয়েছে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

রীনা তালুকদার

বাং লা দে শে র  ক বি তা

রী না   তা লু ক দা র

দেবদারুর পাতা ঝরার দিন

তখন দুপুর রাস্তার ইলেকট্রিক কেবলে হেলান দিয়েছে

ধ্যান ধরেছে মোবাইল ফোন

ওদিকে ঠোঁটের পাটে চুমুর খই ফোটে 

তরুণ তাজা ঘাসগুলি মাঠের দিকে কানাকানি জুড়েছে

সূর্যতাপে শরীরের আড়মোড়া ভাঙা মুথাঘাস অলস এখন

রোদ আড়ালে পাতার ফাঁকে হেসে কুটি কুটি ডালিম গাছের ময়না

গাদা ফুলেরা মুণ্ডু উঁচু করে ডেটিং করছে

আড়াই প্যাঁচ পর্দার নীচে চোখ মাঘের শীতের

শিমুল গাছে রক্তিম বসন্ত ঝুলেই আছে

তার এখন আত্মহত্যার কাল

একজন বলেছে ‘চোখ তুলে হেরিবনা’ কোনোদিন সাদা কাপড়ের দাগ

হোলি খেলার ছলে হাতের মুঠোয় রাখা বিশ্বাস সর্বদাই উজ্জ্বল

হৃদয় ধুয়ে সাফ করে দেয় যাবতীয় ডিটারজেন্ট 

সর্পমণি যক্ষের ধনে হাওয়া তার পাহারাদার

জলবন্দী জীবন বানবাসি জীবনযাপন

অব্যবহৃত জলের কী দাম বন্দী জীবনে? 

মজ্জাগত নালা খলবলিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে আশীবিষের ছোবলে

শাপলার বিলে সর্পের মণিমানিক্য রক্ষা 

দিন দিন রোদের সন্ন্যাসী সাধনা

দেবদারুর পাতা ঝরার দিন ঘনিয়ে আসছে ক্রমশ…

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

রওশন রুবী

বাং লা দে শে র  ক বি তা

র ও শ ন   রু বী

যখন কবিতা হয়ে যাই

মাননীয়,

রোজ আপনি শুনতে চেয়েছেন 

পদ্যের প্রথম পাঠ এবং 

বিমর্ষ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন,

প্রতিশোধে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন 

ভূমধ্যসাগরের ঢেউ,

আমি হেসেই গোপন করেছি তীব্রতা

আর মগ্ন বটের এলোচুলে 

বাতাসের গান শুনবার ইচ্ছে গেঁথেছি প্রতিবার

জেনে রাখুন,

সবাই এগিয়ে গেলে আমি ঠিক সরে থাকি

অন্যকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় বলে

মাছেরা মৃত হলেও কেন চোখ খুলে রাখে

এ সত্য আমি আজ জানি, জানি কেন

আপনি বিন্দু বলে উপহাস করেন আপন সত্তাকে

 

মাননীয়,

এই যান্ত্রিক যুগে গোপন আর্তনাদের দাম নেই ,

সবাই নগদে ঝুলি ভরে, ফিরে দেখে না,

লালন করে না, আমি বড্ড সেকেলে, শুধু ফিরে দেখি

লালন করি, আগুনের জন্ম দেই,

আবার আগ্নেয়গিরির প্রতিপক্ষ হয়ে মানুষ বাঁচাই

আমার পোড়া কয়লার টুকরো খুঁটে

অবলা বাতাস বলে ভালোবাসি,

কেন ভালোবেসেও বলতে পারি না আজও ভালোবাসি

 

আপনি কি জানেন

ঘুম কেন স্বপ্ন বুঝে, আগুন বুঝেনা?

কেন আমি লিখতে গিয়ে শিউরে উঠি?

চোখের জলের তীক্ষ্ণ ধারার নদীটাকে 

কবে, কখন, কোথায় হারালাম,

ট্রেনের মধ্যেও যাত্রীবিহীন একা হলাম,

কোন পাষাণের জন্য পাঁজর ঠেলে বর্ষা নামালাম?

 

মাননীয়,

আপনি আমাকে জানতে চেয়েছেন,

কিন্তু কত কথা থাকে জানা যায় না,

জানতেও হয় না

শুধু এটুকু বলি পরিশেষে আমাকে চিনে নেবেন 

যখন কবিতা হয়ে যাই

 

তুই কবে গণতান্ত্রিক হবি

জানিস কাল যখন আমি মরতে গিয়েছিলাম,

তুই এসে সামনে দাঁড়ালি, ঘোলা চোখ না ঘুরিয়ে বললি- 

দৃশ্যত মৃত্যু একা হলেও একা নয়, অন্য সত্তাকে মেরে ফেলে,

কেউ সেই আপন মৃত্যুর খবর জানে না

 

তুই কেমন বদলে গেছিস, আমি তোকে দেখে হতবাক

 

তোর জলের টিসু ডাস্টবিনে ঘুমোচ্ছিল,

তাদের শরীরে সংসারের উচ্ছিষ্ট আর 

পতঙ্গের বিষ্ঠা দখল করে নিল, জামায় শুকিয়ে ছিল যেটুকু- 

তার যত্ন করি আজও যে কথা জানিসনি তুই; 

সে কথা জানবি না মিলা জানবি না কোনদিন 

 

একটা হাত এসে কপাল ছুঁতেই উপলব্ধি হলো- 

নিঃসঙ্গতার চেয়ে সঙ্গ জরুরি 

ঠোঁট কপালে নেমে এলে বুঝলাম – 

কেন মানুষ ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করে 

নিস্তরঙ্গ শরীর বেয়ে তরঙ্গ উঠেছিল যেদিন- 

সেদিন প্রথম খুন হয়ে ঘরে ফিরে ছুঁইনি রাত  

অথচ পুরোটা রাত আমার পাশেই ছিল, 

ধ্যানে ও ধৈর্যে আড়ষ্ট অনড়

 

একথা বলতে আজ দ্বিধা নেই –

তেল, নুন, উনুনে, 

আড্ডায় আমাদের থাকা ভীষণ জরুরি জেনেও- 

থাকা হয়নি যখন; আমি ভেঙেছি;

খুব ভেঙেছি

তোর পাশে দাঁড়িয়েছেন কল্যাণদা 

বৃষ্টি কোলে ভাঙনের শব্দ

লালন করতে করতে সেই প্রথম খুন হয়েছি

এক জীবনে কতবার খুন হলে জীবন আর চায় না জীবন? 

তখন শুধু ওপারের টান; জানিস?

 

জানি, তোর ভেতর সিগারেটের ইচ্ছেটা মরে গেছে,

কামে, ক্রোধে তুই ভীষণ শান্ত এখন,

বসন্তে হলুদ আর লাল রঙে রঙিন হবার ইচ্ছেও নেই,

মানিয়ে নেয়া স্বাধীনতাকে হত্যা করে, 

এটুকু উপলব্ধি করা আর হবে না তোর 

রমণী হয়ে ওঠার আগে- এঁকে ছিলি একটা গণ্ডি 

যেখানে গণতন্ত্র ছিল না তুই কবে গণতান্ত্রিক হবি?

কবে হবি রমণী থেকে রণবীর? কবে হবি? 

 

ভালোবাসা রূপে অরূপে এই ফড়িংজীবনে 

এতো বার বদলে যায় কেন রে ? 

কেন বারংবার খুন হতে হয়; বলতে পারিস?

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

শংকর চক্রবর্তী

বি শে ষ  র চ না  | পর্ব ৮

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি 

বিদ্বিষ্ট কবি

আমার লেখালেখির প্রথম দিকে, ৪০-৫০ বছর আগের কথা। পঞ্চাশের এক প্রয়াত কবি-সম্পাদকের চিঠি পেতাম প্রায়ই। প্রবাস– জীবনে সেইসব চিঠি বিদ্যুৎচমকের মতো এক ঝলক উন্মুক্ত বাতাস বয়ে নিয়ে আসত যেন। চিঠিগুলো পড়তে পড়তে শেষ লাইনের অমোঘ বাক্যটির জন্য অপেক্ষায় থাকতাম তখন। তাতে সাধারণত লেখা থাকত, ‘অনেকদিন লেখা পাঠাওনি। ৩-৪টি কবিতা পাঠিয়ে দিও দ্রুত।’ হ্যাঁ, যথেষ্ট আন্তরিকভাবেই লেখা সেইসব বাক্য। এত ব্যস্ততার মধ্যেও কীভাবে যে মনে রাখতেন এসব- এখনও ভেবে অবাক হই। আমার মতন যাঁরা কলকাতা থেকে বহু দূরে অভিমান জমিয়ে পর্বত বানাতেন- তাঁদের কাছে এরকম চিঠির মূল্য অপরিসীম। আবার এও জানি, অনেক কবিই এরকম সুখের ভাগীদার হতে পারেননি। বঞ্চিত হতেন। তাঁদের সেই তরুণ বয়সের দুঃখ, মান-অভিমানকেও ছুঁতে পারতাম তখন। এখনও পারি। তবে কি এখনও সেই ধারা অব্যাহত?

যাঁরা কোনো সম্মেলন বা উৎসবের আয়োজক বা পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কাছে এইসব দায়িত্ব যেন যুগপৎ আনন্দ ও শোকের কারণ হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের কাজ সার্বিকভাবে কাউকেই খুশি করতে পারে না। না করার কারণও যথেষ্ট। যেমন মনে আছে, একবার দুই গুরুত্বপূর্ণ কবিবন্ধুর মধ্যে একজন কোনো এক কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত হওয়ার পর, অন্যজন সে সুযোগ না পেয়ে তাঁর কাছে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গমের সহায়ক হল না। ন্যায্য কারণেই তিনি দুঃখিত। এবং পরে তিনি জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হন যে, আমন্ত্রণ পাওয়া তাঁর বন্ধুটি ওই উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ফলে এই ধরনের সম্মেলন দুই বন্ধুকে একইসঙ্গে খুশি করতে পারল না। আর যাঁরা শহরাঞ্চল থেকে বেশ দূরে, আলোকিত মহল্লার ছায়ায় নিশ্চুপে একান্তে লিখে যাচ্ছেন– তাঁদেরও ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। আশেপাশে ছড়ানো গ্ল্যামারের বর্ণচ্ছটায় ওঁরা বরাবরই আড়ালে থাকেন। তবে হ্যাঁ, ইদানীং দূরের কিছু মধ্যমেধার সাধারণ কবিও কীভাবে যেন ওইসব গ্ল্যামারদের তালিকায় নিজেদের নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারছেন। কীভাবে তা সত্যিই জানা নেই। হয়তো কোনো প্রভাবশালী কবি-সম্পাদক তাঁর স্নেহসিক্ত হাতটি সজ্ঞানে রেখেছেন ওই হঠাৎ-ই উত্থান হওয়া কবির মাথায়। আসলে, বহুযুগ থেকেই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ব্যতিক্রমও আছে। কেউ কেউ নিজের যোগ্যতায় নিজেকে ওই স্তরে উত্তীর্ণ করতে পারেন। তবে নিছক এইসব কারণে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কবি বঞ্চিত হলে মনখারাপ হয়ে যায়। যদিও এটা এমন কিছু নতুন ব্যাপারও না। প্রতিটি উৎসবেই বঞ্চিতের সংখ্যা নেহাত নগণ্য থাকে না। তবে শুধুমাত্র উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার দরুন যদি আমন্ত্রিতদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়– তাহলে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তা খুব একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে না। 

একজন পত্রিকা-সম্পাদকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের যৌবনে তুখোড় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্পাদক হিসেবে সাগরময় ঘোষেকে জানতাম। বাংলা সাহিত্যে বহু সুযোগ্য কবি-লেখকের উত্থান আমরা দেখেছিলাম সেই সময়। এমন ধীর-স্থির ব্যক্তিত্বের অধিকারী সম্পাদককে ফোন তো দূরের কথা, কাছাকাছি যেতেই বুক কাঁপত। আর তাছাড়া সেই সময় কোনো সম্পাদকের সঙ্গে ফোনে কথা বলার রেওয়াজই ছিল না। বরং ওই সম্পাদক প্রকৃত মেধাবী লেখককে খুঁজে নিজেই ফোন করতেন। লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। সময় পাল্টেছে। এখন আর সেভাবে হয় না। অনেক নবীন লেখকই ভাবেন যে একবার অন্তত সম্পাদক বা কোনো উৎসবের উদ্যোক্তাদের ফোন না করলে হয়তো আড়ালে চলে যেতে হবে। অথচ আমি বিশ্বাস করি, একজন কবির উদাসীন থাকাটাই নিশ্চিতভাবে কবি হয়ে ওঠার প্রাথমিক যোগ্যতা। আবার এখনকার বহু সম্পাদকের হৃদয়ও বড্ড নড়বড়ে। ফলে, বারবার ফোনাঘাতে অনেক অযোগ্য লেখকও প্রচারের আলোয় চলে আসতে পারেন সহজেই।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, যাঁরা বঞ্চিত তাঁদের অভিমানী বরফ-পাহাড়কে গলানো সহজসাধ্য নয়। তাঁরা শুধু নিভৃতেই লিখে যান। আর, কোনো পত্রিকা-সম্পাদক বা উদ্যোক্তাদের ওইসব যোগ্য লেখকের দিকে তাঁদের বিশ্বস্ত হাত এগিয়ে দেওয়াটাই কর্তব্য হোক এখন।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

দেবাশিস ঘোষ

ক বি তা

দে বা শি স   ঘো ষ

আমার দুঃখগুলো

আমার প্রজাপতি দিন দুঃখ ঢালে শাদা পাতায়

আমি ব্লটিং পেপারে তার কিছুটা শুষে নিই

বাকিটুকু দগদগে কালি-দাগ সময় পোড়াতে থাকে রোজ

সময়ের পিঠে সময় যেন লম্বা ফিল্মের রোল 

মাঝে মাঝে জ্বলে যাওয়া দাগ।

আমার দুঃখগুলো রোদে পুড়ে নেতিয়ে পড়ে ক্রমশ

তাদের গায়ে ফের জলের ঝাপটা দিয়ে বলি ওঠো জাগো প্রাপ্য বরান নিবোধত

তারা উঠে বসতে গিয়ে ফের এলিয়ে পড়ে, 

ভোরের কোমল রে ধা রক্তাভ আকাশে তাদের প্রার্থনায়

দেখি আমার সেইসব দুঃখগুলো ফুটে উঠেছে পলাশের রঙে

দূর থেকে আমি তাদের পতাকায় স্বাগত জানাই

ডালে ডালে হাওয়ায় হাওয়ায় ওরা দুলতে থাকে সারাদিন

জ্যোৎস্না

জ্যোৎস্না আমার কাছে গান হয়ে ভেসে ভেসে আসে,

গোলাপ মাসির ঘরে রেডিওতে যেভাবে ঝরত কত চমৎকার গান।

এতদিনে জেনে গেছি পৃথিবীর থেকে চাঁদ তিন লক্ষ

চুরাশি হাজার কিমি দূরে। কলকাতা, দিল্লি থেকে 

রেডিওতে ফ্রিকোয়েন্সি আসে।

কে কীভাবে চাঁদের দূরত্ব  মেপেছিল এখনো জানি না।

শুধু তার জ্যোৎস্নাটুকু এখনো রক্তিম কৃষ্ণচূড়া

হারানো গানেরা ফিরে আসে, লতায় পাতায় স্নায়ু বেয়ে,

সেখানে পাহাড় আছে, বড় বড় ক্রেটার রয়েছে

এ-খবরে জ্যোৎস্নার বিরাম ঘটেনি কক্ষনো

সে আমায় গানে জলে এখনো আগের মতো শিশু করে রাখে

নদী বেয়ে রাত্রি আর জ্যোৎস্না ভেসে যায়

সবুজ পাতায় উপচে পড়ে চুম্বনের ছোপ

ঝড় বৃষ্টি রোদ চাঁদ সব কিছু নিয়ে পৃথিবীর অভিনয়

আমি এক জ্যোৎস্নাভরা কলম খুঁজেছি

আরও পড়ুন...

Categories
2021_mar

সুদীপ ঘোষাল

ক বি তা

সু দী প   ঘো ষা ল

সাফল্য

দুঃখগুলো মাটির ভাঁড়ে জমিয়ে রাখি

কষ্টগুলো একটা একটা করে ঝরে পড়ে শরীরের সৈকতে

ভালবেসে তুলে রাখি তাকে অনিশ্চিত দুপুরে

জমানো কষ্ট আর দুঃখ বেচে তৈরি করি ভাড়াটে সকাল

কিছুদিন পরে হৃদয় ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিই দু’মুঠো শান্তি

তৈরি হয় প্রেমের জাহাজবাড়ি

রুটি তরকারি  খাই ভালবাসা ও কষ্টের সাজানো থালায় 

 

নিরাশার আকাশে জেগে ওঠে ধীরে সোনার ফসল

সাফল্যের  চাঁদ হাসে কুটিরে দীর্ঘ অমাবস্যার অবসানে 

মাটির ভাঁড়ের সুখ এবার উপচে পড়ে আষাঢ় মাটিতে

 

জলজীবন

জলের ট্যাঙ্কি জুড়ে জীবনের মোট আয়ু 

পাইপলাইন আর কল শিরা আর গোপন অঙ্গের মতো কামুক মন বেয়ে নামে প্রবাহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিস্তৃত শরীরবাড়ি জুড়ে… নিচের কলটা প্যাঁচকাটা ঢিলে অসংযমের অন্ধকারে ট্যাপ বেয়ে জীবন পড়ে টুপটাপ ফোঁটায় ফোঁটায়

কেউ খেয়াল করি না বিশৃঙ্খল গার্হস্থ্য লোভে

মোট আয়ু থেকে জলজীবন বিয়োগের খাতায়

বিন্দুতে সিন্ধু গড়ে অজ্ঞানতায় ক্ষয়ে যায় জীবন, যৌবন জীবনের ট্যাঙ্কি খালি হয় হেমন্ত আকাশে…

হিসেব জানি না কেউ

জেনেশুনে জল মাপে আয়ুর সীমানা…

আরও পড়ুন...