Categories
2021_pujo

শংকর চক্রবর্তী

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  আমার পুজো

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

sankar

এক ভবঘুরের উৎসব-কাহিনি

সে তখন ক্লাস থ্রি। সি আর জেড্ মিশনারি স্কুল। তখনও রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে ভর্তি হয়নি। উদ্বাস্তু হয়ে এসে ভাড়া-বাড়ির ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দেখে, সামনে অরোরা স্টুডিয়োর পাঁচিল। আর বাঁ দিকে, বড়ো রাস্তার ওপারে ফ্রেন্ডস ইউনিয়ান ক্লাবের পুজো-প্যান্ডেল। পঞ্চমীর মণ্ডপে তখন ডেকোরেটার্স-এর কর্মীরা খুব ব্যস্ত। ক্লাবের দাদারা ছুটোছুটি করছেন। বিকেল শেষ হয়ে এসেছে। রাস্তার রঙিন আলোগুলো জ্বালাবার প্রাকমুহূর্তে সে দেখল, নীচে, বাড়ির সর্বক্ষণের সহযোগী হারুদা তার থেকে দেড় বছরের ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে মণ্ডপের দিকে যাচ্ছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে না যাওয়ার অধিকার কে দিল হারুদাকে? সে দ্রুত একতলায় নেমে হারুদাকে লক্ষ্য করে রাস্তার দিয়ে প্রাণপণ ছুট লাগালো। আর উল্টোদিক থেকে দুরন্ত বেগে ধেয়ে আসা একটা সাইকেল সরাসরি তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে চোখের সামনে সামনে বিদ্যুৎ ঝলকের আলোটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। রক্তে ভিজে গিয়েছিল সৎচাষী পাড়ার পিচের রাস্তা। তার জ্ঞান ফিরল নর্থ সুবারবন হাসপাতালের বিছানায়। অনেকটা জায়গা জুড়ে সেলাই করতে হয়েছিল বাঁ দিকের ঠোঁটের নীচে। দাঁতগুলো লন্ডভন্ড। বাবা অফিস থেকে খবর পেয়ে সোজা হাসপাতালে। তার মা সমস্ত আড়াল সরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায়। ত্রাতা হিসাবে পুজো মণ্ডপ থেকে ছুটে আসে ক্লাবের দাদারা। দু’জন তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান আর বাকিরা ওই সাইকেল আরোহীর উপর মারমুখী হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত তার মাই তাঁদের কাছে আকুতিমিনতি করে ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে মুক্ত করেন। অনেক রাতে সে অবশ্য তার বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে এবং পুজোর পাঁচটা দিন বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকাটাই তার ভবিতব্য ছিল সে বছর। একধরনের লজেন্স ও তরল খাবার খেয়েই কাটে তার পুজোর দিনগুলি। ১৯৫৩ সালের সেই ক্ষতচিহ্ন এখনও সে তার বাঁ দিকের ঠোঁটের নীচ থেকে মুছে ফেলতে পারেনি।

                         সে ছিল তার ছোটবেলার দিন। এবার আসি মাঝবেলার দিনগুলিতে। ১৯৬৯ সাল থেকেই সে বাড়ির বাইরে, প্রায় অর্ধেক জীবন কেটেছে তার শিলং পাহাড়ে। সেই পাহাড়ি আকাশে শরতের মেঘ এসে জমতো না কখনো। তবুও শরৎ আসতো। নিয়মিত। পাহাড়ের আনাচে কানাচে প্রায় হাজার খানেক পুজো হত। এখনও হয় নিশ্চয়ই। মণ্ডপের চারপাশে মেলা জমে মেলা বসে যেত। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকিরা এসে পৌঁছাত কয়েকদিন আগেই। ঢাকের শব্দ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে তার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকত সকালে। সারাদিন সে কলকাতার কথা, বাড়ির কথা ভুলে থাকতে পারত। সত্তরের শেষভাগে একবার ভাসানের সময় আগুন জ্বলল। সেই আগুন শান্ত পাহাড়কে খুব দ্রুত অশান্ত করে তুলল। সেসবও দেখল সে। তারপর থেকেই প্রতি পুজো মরশুমের আগে শহরবাসীদের মধ্যে শুরু হত অজানা আশঙ্কার দিন। সমস্ত পুজো কমিটিগুলোকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘সেন্ট্রাল পুজো কমিটি’। সেই কমিটি শারদীয় উৎসব ও উৎসবের সময় সম্প্রীতি রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিত খুব। সে নিজেও এই দুরূহ কাজে শামিল হতে পেরে দারুণ খুশি হল। কমিটি থেকে পুজোর মণ্ডপ, মূর্তি-প্রতিমা, আলোকসজ্জা ও বিভিন্নজাতির পুজো মণ্ডপের শৃঙ্খলিত পরিবেশের ওপর পুরস্কার ঘোষণা করা হল।  সেই শহরের শিল্পী, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে নিজেও একজন বিচারক হয়ে পুজোর ক’টা দিন কাটাত মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে। কখনো একশো সাতাশটি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামার পর দেখা গেল খুবই সাধারণ এক শামিয়ানার নীচে-রাখা প্রতিমা মূর্তির বাঁ দিকে ভাঙা সিঁড়ির ওপর বসে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক, গায়ে শতচ্ছিন্ন গরম কোট, মাথায় কাউ-বয়ের মতো হ্যাট, গিটার বাজিয়ে ইংরেজি গান গাইতে গাইতে ভিক্ষা করছেন। কখনো আবার অনেকটা ওপরে উঠে দেখা গেল, কোনো এক বাজারের পাশে কপালে তিলক-কাটা নেপালি আয়োজকরা পুজোয় বলির হাড়িকাঠ সাজিয়ে রাখছে। বা কখনো অসমীয়া নামঘরের পুজোয় অন্য ধরনের বাদ্যযন্ত্রের গম্ভীর আওয়াজে সে পরিবেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে।

                         এই রঙিন ছবিগুলো তার স্মৃতির মণিকোটায় সযত্নে সাজিয়ে রাখতে রাখতেই পুজো কেটে যেত। কোন পুজো মণ্ডপ বা প্রতিমা মূর্তি প্রথম-দ্বিতীয় বা বাতিল হল তা কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তার কাছে। বরং ওই ভিন্ন ভিন্ন রঙিন ছবিগুলোই মুক্ত ভাবনায় ডুবিয়ে রাখতে এখনও সাহায্য করছে তাকে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

মৃণালিনী

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  কবিতা

মৃ ণা লি নী

একটি কবিতা

একটি কবিতার জন্যে মেসেজ করতে পারি সারাদিন

একটি কবিতার জন্যে জেগে থাকি টানা তিন রাত

একটি কবিতার জন্যে ভাবতে পারি কয়েকশ’ বছর

একটি কবিতার জন্যে মাথা পেতে নিতে পারি বিরক্তি অপবাদ অপমান।

অথচ আমি কবিতাকে ভালোবাসি না

সে বলে, আমি তার শরীর নিয়ে আলোচনা করি রাস্তাঘাটে

চার লাইনের অণু বা বাইশ লাইনের হনু

তার সন্তানদের নামিয়ে এনেছি রকের মোড়ে

ভাব বিষয় শব্দ ছন্দ অতি ভদ্র ছিল অভিধানে

তাদের টেনে এনেছি কল্পনার বাড়ি থেকে বাস্তবের পোড়া রোদে

খেলাচ্ছি অশ্লীলতার মাঠে

যেখানে রাতে খেলে অন্তর্জগৎ, দিনে মুখোশের আড়ালে।

একটি কবিতার জন্যে সব অভিযোগ শুনে যাই দিনের পর দিন

অথচ আমি কবিতাকে ভালোবাসি না

আজ জিজ্ঞেস করলে বলব, চিনি না জানি না বুঝিও না

রাস্তায় পরিচয় সে কথা অনেকদিনের হলদে ইতিহাস।

 

আমি

আমার ভেতর আছে অসংখ্য আমি

আমার মতো শত শত মানুষেরা

জানি না তারা কারা, কী ভাবছে, কী অনুভব করছে?

অনুভবে আমি তাদের আধার

যেখানে তাদের অনুভব, ভাবনা, অবাস্তব চিন্তার দোল যেন আমার মনের দোলনায়।

আমার মধ্যেই অনুভব করি অনেক মন, শরীর ও আত্মা

মাঝে মধ্যে তারা মাথাচাড়া দিলেই সবার প্রতি আসক্তিহীন

ঘুমিয়ে থাকি দিনের পর দিন

এভাবেই বেঁচে আছি আবহমান আর জেগে থাকলে তারাও নির্বাক

নিজের ঘোরে কথা বলে যাই, ওরা তখন চুপ করে ঘুমোয় ।

নিস্তব্ধতায় ওরা কথা বললে মানচিত্র আঁকি

তার কিছুটা বুঝি কিছুটা বোধের ওপারে ভাসে

বোঝা আর না-বোঝায় তারা প্রশ্ন করে, তর্ক করে জুড়ে বসে

শিরায় ছাইচাপা আগুনের ধাক্কায় প্রতিবাদের ভূমিকম্প

আন্দোলন সজাগ হতে চায় আমার ভেতর কোন এক সচেতন মন ।

রাতদুপুরে আমায় ছিড়েখুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে রাজপথে

তাকিয়ে দেখি মানচিত্রের দিকে,

বিধ্বস্ত ভারতবর্ষ রক্ত আগুন চোখে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

রেহান কৌশিক

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  গুচ্ছ কবিতা 

রে হা ন   কৌ শি ক

এই আয়ু, এই অন্ধকার

এক

 

যে হাতে মেহেন্দি-রেখা নুয়ে পড়ত ভোরের মতন 

সেই হাত নিষিদ্ধ এখন।

 

রহমত বাড়ি ফিরে কার হাত ছোঁবে?

কার ঠোঁটে এঁকে দেবে শতক ডিঙিয়ে যাওয়া পিতার-চুম্বন?

 

দিকে দিকে মৃত্যু চিহ্ন। দিকে দিকে ভাঙনের গান। 

দিকে দিকে মধ্যযুগ, জমা করে অন্ধ-জন্মস্থান!

 

দুই

 

যেখানে বিতর্ক নেই কোনো

যেখানে সমস্ত কথা শর্তহীন হয় 

 

সেখানেই অন্ধকার মুছে দেয় আলোর মহিমা।

 

ধর্ম কখনো চায়না তর্কের আভাস 

চায় শুধু মুগ্ধ-দৃষ্টি, অনুগত চোখ

 

দশক-শতককাল ধর্ম শুধু ভেঙে চলে সভ্যতার সীমা।

 

তিন

 

ভালোবাসা ছাড়া

কে আছে অন্ধকারের প্রতিপক্ষ, বলো? 

 

চাঁদ এলে কৃষ্ণপক্ষ সরে যায় দূরে 

যেরকম প্রিয়মুখ হঠাৎ দাঁড়ালে দরজায় 

       চকিতে বসন্ত এসে ঘাই দেয় বুকের ভিতর 

       সমস্ত অসুখ যায় সেরে…

 

চার

 

এ-সময় দখলে বিশ্বাসী। ভিন্ন যেন ধর্ম নেই আর।

 

এই যে জগৎজোড়া সুরের আবহ

শুদ্ধতায় ক্রমাগত মিশে যাচ্ছে নম্র আরোহণ— 

কে আর তাকায় সেদিকে? 

কে তার কোমল দ্যুতি বুকে নিয়ে হেঁটে যাবে আজ?

 

 আসলে যা-সত্য নয়, তা-ই দিয়ে গড়া হয় সব বিজ্ঞাপন।

 

পাঁচ

 

ক্রমাগত অন্তরাল থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়ে আসছে শর।

 

ঘাতক শরের মুখে প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে জনতাশরীর

ভেঙে যাচ্ছে স্বপ্ন-শ্রম-সরলসাহস।

 

আলিশায় রক্ত লেগে থাকে

মেঘের আড়াল থেকে শাসক এবং বিরোধীরা

                          মঞ্চ জুড়ে হাসে। 

 

ছয়

 

পাতা ঝরে? নাকি স্মৃতিও এমন

         ক্রমাগত ঝ’রে পড়ে, আর

         বৃক্ষের মতন কিছু মানুষেরা ফাঁকা হয়, একা হয় ধীরে?

 

ফাঁকা পেলে অন্ধকার বসতি বানায়

আলোরা কি থাকে না সেখানে?

 

চিঠিতে জানিয়ো— কেন প্রিয়মুখও ইদানীং স্পষ্টতা হারায়।

 

সাত

 

ধরো, যদি দাঁড় হয় অমোঘ সময়?

জল হয় ইচ্ছে আমাদের?

ধরো, যদি ডিঙি ভাবি মাটিকে এখন?

 

শঙ্খবাবুর মতন ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ নিয়ে

      পারি না কি পুনরায় মুখোমুখি বসি

      আমরা দুজন?

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  কবিতা

দী প ক   ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

নগ্ন সভ্যতার সংজ্ঞা

একজন নগ্ন মানুষ
সভ্যতার পতাকা হাতে
শহরের মাঝখানে রাজ মূর্তির কাঁধে চরে বসলো
তারপর যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শূন্যতা
সেদিকেই হাসছে নগ্নতার সাম্রাজ্য
সেদিকেই জ্বলছে নগ্নতার চিতাকাঠ
চারিদিকে ভিড় জমে গেল
ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষগুলো লজ্জায় চিৎকার করে উঠলো
নিচে নামো – নিচে নামো
রাজা জানলে গর্দান যাবে
কিন্তু উত্তরহীন সময়
নগ্নতার পতাকা আরও উপরে তুলে ধরলো
এতদিন পাখিরা রাজার কাঁধে বসতো
এতদিন পাখিরাই রাজাকে গান শোনাত
এতদিন রাজার হাতেই ছিল রাজধর্ম
এখন এই হঠাৎ একটা সকালে
সব কিছুই পাল্টে গেল
রাজার কাঁধে বসেই মানুষটা সবাইকে শেখাতে লাগলো
নগ্ন সভ্যতার সংজ্ঞা
বেঁচে থাকার ছুমন্তর
নিচে ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকলো
সর্বনাশের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে
সবাই যখন এটাকেই ভবিতব্য ভাবছে
তখনই অনেকে লোকটাকে চিনে ফেললো
ভয়ে নিষ্পাপ চোখগুলো বিস্ফোরিত
ফিস ফিস শব্দটাও নিস্তেজ হয়ে পড়লো
সাহস করে এগিয়ে এসে কেউই বললো না
নগ্ন মানুষটাই দেশের রাজা

 

হাওয়া বইছে

এপারে সমুদ্র- ওপারে সমুদ্র
মাঝখানে শূন্যতার গৃহস্থালী
দুঃখের জলীয় বাস্প নীল থেকে আবছা ঘোলাটে
যারা ভালোবাসার খোঁজে এসেছিল
তারাও পাথরের বুকে পা ডুবিয়ে বসে
গান গাইছে শোকের!
সমুদ্রের জল নোনতা – চোখের জল ও নোনতা
কে জানে কার শোক কার সাথে মেশে!
দিকে দিকে বিপদ সংকেত
হাওয়া বইছে
নিম্নচাপ বাসা বাঁধছে চেতনায়
স্বপ্নের রং ফিকে হতে হতে ‘পাণ্ডুর’
দুঃখের নোনতা ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে
ভোরের সূর্যদ্বয়!

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

সাম্যব্রত জোয়ারদার

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  কবিতা

সা ম্য ব্র ত   জো য়া র দা র

মিশন টিউবরকুলোসিস

 

রুগ্ন শালিখেরা বুনেছে বসতি বিবর্ণ হলুদ মৃত ঘাস

 

মিশন টিউবরকুলোসিস আহত সে রক্ত-ফুলের নিশ্বাস —

 

পেঁজা-তুলা নাকি এই রোদ্দুরেই উড়ে দূর দেশে ফিরে যাবে

 

ধুনকারির সাইকেল পাখি-ধরা ফাঁদ যন্ত্রপাতি ছিঁড়ে খাবে

 

শীতের দুপুর মাঠে নিকটের কাছে শালিখেরা নেমে আসে

 

ঘরের দুয়ার পড়ে বরাবর অবহেলায় ট্রমা ফুটে আছে

 

 

 

বিকেলের জংশন গেট সিগন্যাল খুলে ছিঁড়ে গেল রোদের রেলিং

 

ধুলোমাখা মানুষেরা হাঁটে, কথা বলে, অভিমানে ভাত খায় না অর্থহীন

 

 

 

দরদাম করে সে কিনেছে হাট থেকে দুই খানি

 

স্ত্রীকুক্কুট— ডিম দেয় দু’দিন অন্তর ডাক্তার লিখেছে পথ্য —

 

মিশন টিউবরকুলোসিস উল্টোপাল্টা হাওয়া দিচ্ছে

 

ভোর থেকে ওষুধের দোকান গুলোতে শ্যাওলামাখা

ছত্রাকের ভিড়, কুয়াশাবুড়িরা আনারস-বন

 

পার করে ডুয়ার্স পাহাড়ে ঝুপি গাছে মেঘে

আস্তানা ফেলেছে— আজকাল ভাল ঘুম

হয় না কিছুতে— খড়িওঠা সব চায়ের দোকান

 

বেশি রাত পর্যন্ত একটানা হাতরুটি বেলে গেছে আর

 

লম্বাটে করেছে ছায়া আগুনের আঁচ— হাই ওঠে

 

বিড়াল কেটেছে গায়ে আঁচড়ের দাগ, চক্ষু লাল

 

আর একরকম ঘুসঘুসে জ্বর-সর্দি-কাশি-হাঁচি

 

লেগেই রয়েছে, বুড়া ধনিরাম টোটো ঘুম থেকে উঠে

ভীত হতবাক— নাসারন্ধ্র দিয়ে রক্ত তালুতে গড়াচ্ছে

 

ওষুধের কতো দাম— প্রেসক্রিপশনে লিখে দিও

 

কখন কোনটা খেতে হবে, আজকাল চোখেও তো কম দেখি— ছাই

 

 

 

শূন্য টিলা পড়ে আছে জ্বলে ওঠে মিনে করা চাঁদ

 

মানসিক হাসপাতালের বারান্দারা আর্তনাদ

 

করে ওঠে— বন্যফুল নেশাগন্ধ দূরে কুয়াশায়

 

রেললাইন পার হয় সেতু— ভবে কীসের আশায়

 

নখের দাগের নীচে পরিত্যক্ত মরে গেছে কবে

 

পুরোনো টিকিট-ঘর— লোকালয় মৃতের স্বভাবে,

 

ভাঙা বোতামের ঘর ফুটো-করা কেউ নেই আজ

 

বাংলোর লাল রাস্তায় শ্বাস ফেলে ডুবন্ত জাহাজ

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

মাসুদ পথিক

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  বাংলাদেশের কবিতা

মা সু দ   প থি ক

নিউজ 

নদী যে বিছানায় ঘুমায়, তার বালিশের নিচে 

খুলে রেখেছে সমুদ্র তার দু’টি চোখ

 

জাগলি ধানের ফাঁসির দিন আত্মহত্যা করলো লক্ষীপ্যাঁচা

গোলাঘরে ঝুলছে এখন বাবুইপাখির শূন্য খাঁচা

 

মুখে পুরবার পূর্বে মুখস্থ করে নিই ভাতের কান্না

তবে প্রেমে পড়বার পূর্বে পড়িনি ‘ব্যথার জীবনী’

 

মৃত্যু’র ছোট মেয়েটা কলেজ থেকে ফেরার পথে 

বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ভাইরাল হয়ে গেছে

 

কাশফুলের কোমল ছোঁয়া

কী দারুন! ‘বিশেষণ’ পড়ে আছে ভোরের দরজায়

সম্পর্কের মধ্যে কাশফুল দুলে, আর বিশেষ্যের দ্বিতীয় লিঙ্গ 

 

দূরে, উপন্যাসের গ্রামগুলো দারিদ্র পীড়িত 

বাক্যের সাপ বাড়ির পেছনের ডোবা জঙ্গলে

অতীতের কাহিনি আলোকোজ্জ্বল 

ভবিষ্যতের আকাশ মেঘ মেঘ

 

মাঝে মাঝে তোমার কানে দুলে উঠে বিকালের আকাশ

স্তনচূড়ায় আটকে যায় পাড়ার বখাটে বাতাস

বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়া যুবকটির মাস্টারবেশন

 

মাঝে মাঝে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় জীবন

যখন পাড়াগাঁ আক্রান্ত  হয় ক্রিয়া ও অব্যয়ে

 

তোমার আমার অতীতের নাভিতে জমেছে যে ময়লা

তার রূপতত্ত্ব পড়া হয় এখন ভাষাবিজ্ঞানের ক্লাসে

ধ্বনি অন্ধ দুপুরের ক্লাসে ডাকে জাতীয় পাখি দোয়েল

 

আমাদের প্রেম জাতীয় ছিলো না, ছিলো খুবই লোকাল

তবুও হাইপ উঠেছিলো জাতীয় পত্রিকায়

কিছু উপন্যাস ভরে উঠেছিল কল্পনায়

 

ভোর হয়েছে আজও, ডাকছে হকার

হয়তো আজও কোথাও, ছেড়ে আসা অজপাড়াগাঁ’য়

পেকে উঠেছে কারো প্রেম, কী দারুণ, কী দারুণ 

কতো কোমল এইসব মুখরা শব্দ, ও ধ্বনি এবং কাহিনি

 

কী আনন্দ হয়! আহা! মৈথুনের পর ক্লান্ত দেহখানিতে

কেবল তোমরা, এই নিন্দুকেরা বলছো, ভেসে যাচ্ছে 

এই শহর ভেসে যাচ্ছে কাশফুলের নরম ছোঁয়ায়

আর অবৈধ সঙ্গমের গ্লানিতে

 

অবৈধ বলে কিছু নেই ভোরের ভাষায়, প্রেম ও পিপুলের বাণীতে

ভাষিক নদীতে, এমনতরো ভোরে ভাসছে গান

ভাসছে মূর্ছিত সুর, বিসর্গের, রাজহাঁসের!

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

ধ্রুব এষ

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  বাংলাদেশের গল্প

ধ্রু ব   এ ষ

মুরিদ

pic4

‘রঙে মানুষ প্রকাশিত হয়।’

শীতকালের এক সন্ধ্যায় সে বলল।

কেন বলল?

আমি সেই সুলুক সন্ধানে কংক্রিট, পিচ কি জলকাদায় নামলাম না। তার কথার অর্থ ধরার কোনো অপচেষ্টার দিকেও গেলাম না। সে বলেছে রঙে মানুষ প্রকাশিত হয়, আচ্ছা, রঙে মানুষ প্রকাশিত হয়। যে কেউ একজন এখানে বলে দিক, ‘তথাস্তু।’

বলল না কেউ। যে কেউ একজন বলল, ‘জটিলতা পরিহার করে বলা হোক।’

‘তথাস্তু।’

আমি যার কথা বলছি, সে এমন একজন মানুষ যাকে বলা যেতে পারে মিতবাক। তবে বাকসংযমী বলা যাবে না। সে যা বলে সবসময়ই এমন ছাড়া ছাড়া যে, বাকসংযম বিবেচনা করা যায় না সেটাকে।

সে একা। একা থাকে। একা ঘুমায়। মানুষজন পছন্দ করে না বিলকুল। মনে করে উৎপাত। তবে আমি কেন তার কাছে আসি? আমাকে কি মানুষ মনে করে সে? না মনে হয়। উৎপাত মনে করে? না মনে হয়। আমি শুধু তার কাছে আসি। তার কথা শুনি। বসে থাকি। কেন?

আমি তার মুরিদ।

পীর না সে, তাও আমি তার মুরিদ।

একমাত্র মুরিদ।

বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত

সংস্করণ, পৌষ ১৪০৭ বঙ্গাব্দের, ৯৯৩ পৃষ্ঠায় আছে শব্দটা। মুরিদ। গ্রহণযোগ্য অর্থটা হচ্ছে পীরের শিষ্য।

আমি তার শিষ্য।

সে আমার পীর।

শীতকালের আরেক সন্ধ্যায় কিছু হলুদ পাতার কথা সে বলল। হলুদ সেইকিছু পাতা উড়ে দূরের হরিৎ তৃণভূমিতে যায়। সে বলল, আমি শুনলাম আর সেই হলুদ পাতাদের দেখলাম। সেই হরিৎ তৃণভূমি দেখলাম। সে যা বলে আমি দেখি। দেখতে পাই। সংশয় যদিও যায় না। যা দেখলাম ঠিক কি দেখলাম? ভুল দেখলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, তেমন কিছু সে কখনোই বলে না। তবে যেসব হলুদ পাতা দূরের হরিৎ তৃণভূমিতে যায়, তারা ধূসর ট্রাংক বন্দি পান্ডুলিপির কাটাকুটি করা পাতাও হতে পারে। তর্ক সাপেক্ষ হলেও গ্রাহ্য কথাটা।

শীতকালের আরেক সন্ধ্যায় সে বলল, ‘আমি কিছু মুরিদ কিনব।’

‘দরপত্র দিব?’ আমি বললাম।

‘দরপত্র?’

‘মুরিদ সাপ্লাইয়ের। টেন্ডারবাজি ছাড়া আর কিছু হয় না।’

‘বার টেন্ডারবাজি।’

বলে সে হাসল। হা হা হা হা করে হাসল। তার হাসি ইকো হলো দূর নক্ষত্রমালার পাহাড়ে। হলুদ কিছু পাতা যেখানে যায়, সেই হরিৎ তৃণভূমিতে, ঘুণাক্ষর সমেত। শীতকালের আরেক সন্ধ্যায় সে বলল, জরায়ুর গহীন অন্ধকারের স্তোত্র। সৃষ্টির পবিত্রতম অন্ধকারে।

‘যত অন্ধকার তত আলো।’

সে বলল।

আমি বললাম, ‘আলোকিত না?’

সে বলল, ‘বিউপনিবেশায়ন।’

আর হাসল। হা হা হা হা।

আমার পীর। বাস্তবতা থেকে বহু দূরের সে একজন। আমি তার একমাত্র মুরিদ। ছাড়া ছাড়া ভাবে বলা তার যত কথা আমি শুনি। প্যানডোরার বাক্সের কথা বলে সে কখনো। বোকার স্বর্গ কী বলে কখনো। কখনো সাড়ে তিন হাত ভূমির কথা শুধু। কখনো সোনার পাথরবাটির। আমি তার কথা শুনে যাই কেবল। অ-মনোযোগী এক কাকপক্ষীর মনোযোগ দিয়ে, যে কাকপক্ষী মাত্র সনাক্ত করেছে এবং উৎখাত করেছে তার সংসারের অনুপ্রবেশকারী আরেক কালো পক্ষীসন্তানকে। রঙে কি পাখিও প্রকাশিত হয়?

বর্ণবাদ নিপাত যাক।

সব শ্লোগান কবে নিপাত গেছে।

তবুও ফিরি সেই শীতকালের সন্ধ্যায়।

তবুও আমার পীর এতদিনে রঙের কথা বলল।

রং।

আমি ওত পেতে থাকলাম, আমার পীর কী বলে আর। শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। হাওয়া এবং সন্ধ্যাজাত পাঁশুটে অন্ধকার জানান দিচ্ছে। আমার পীরের ঘরের বারান্দায় এক বটগাছ শিশু আছে। বার-তেরটা পাতা হবে। কিয়দংশ হলুদ কিছু পাতার। বারান্দা থেকে রোদ চলে গিয়েছিল রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীয়মান আলোয় তাদের রাজনীতিরুগ্ন দেখাচ্ছে। অন্য দৃশ্য ছিল সামান্য আগেও। রোদ ছিল। তবে আমার পীরের ঘরের বারান্দায় ছিল না, চলে গেছে উত্তরের কিছু বারান্দায়। বহুতল মানুষের গুহা উত্তরে। বারান্দার গ্রিলে তারা শীতের কাপড় চোপড় শুকাতে দিয়েছে। বড়দের, বাচ্চাদের। রোদ পড়েছিল সেই সব কাপড় চোপড়ে।

আকাশের রং ইন্ডিগো বস্নু। রাজনীতিরুগ্ন।

‘এত কাপড় শুকাতে দিয়েছে বারান্দায়। লাল সাদা ছাড়া কাপড় কেউ পরে না। শুধু লাল রং। শুধু সাদা রং।’

বলেছিল সে।

আফসোসহীন পর্যবেক্ষণ।

আর কিছু?

‘কেউ রঙিন কাপড় পরে না। হিমালয়ের বরফে যেমন দেখা যায়, নিশানের রং, মানুষের রং।’

এতক্ষণ পর, সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে সে বলল।

হিমালয়ের বরফে কী রঙের নিশান, কী রঙের মানুষ দেখা যায়?

না শুধু নিশান, না শুধু মানুষ দেখা যায়?

না নিশানরা মানুষ এবং মানুষরা নিশান হয়ে যায়?

কী রঙের?

ফয়সালা দিল না সে। কখনো দেয় না। না দিল। আমার পীর সে। তবে আরো শীতকাল এবং আরো এমন সন্ধ্যা মজুদ আছে হয়ত, রং-ফং বাদ দিয়ে সে কথা বলবে জন্মনিরোধক নিয়ে।

রঙে জন্মনিরোধক প্রকাশিত হয়।

‘অপ্রকাশিত থাক রংহীন অনাগতরা এই পৃথিবীতে।’

আরেক শীতকালের সন্ধ্যায় সে হয়ত বলবে।

আমার পীর সে।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

মাহমুদ নোমান

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  বাংলাদেশের গল্প

মা হ মু দ   নো মা ন

রেডিও মায়মুনা

pic3

পৌরসভা অফিসের শিরদাঁড়া সোজা গলির ডানদিকে এগিয়ে, হাতের বামে গেলেই পাড়াটা। হেঁটে না গিয়ে রিক্সা দিয়ে যায় অনেকে। ভাড়া দশ টাকা। পাঁচ টাকায় খালি এক কাপ চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না এ যখন অবস্থা; আলিশান বিল্ডিংগুলোর দেয়ালঘেঁষা রাস্তার নালা ফেঁপে উচ্ছিষ্ট আবর্জনায়, পাতি ও ডুলকাকের অজিরানি কা- কা। নাক দুই আঙুলে, ওড়নাতে চেপে রমণীরা হাঁটে, কালো রোদচশমায় কেউ কেউ ভাব মাড়িয়ে। প্রযুক্তির দিলখোলা আশীর্বাদে প্রাইমারী স্কুলে ঝরে পড়া ছেলেগুলোও ক্রিকইনফো, ক্রিকবাজে নেট গুঁতিয়ে প্রতি বলে ধরছে বাজি। সেখানে কলেজ ডিঙানো মুক্তার আঙুলের ডগায় পুরো পৃথিবী সহজেই অনুমেয়।

ইন্টার পরীক্ষার মাসখানিক আগে বিয়ে হয়েছিল প্রবাসী হান্নানের সঙ্গে! বলা যায়, প্রবাসীরা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে। পরীক্ষার সময় একটা মেয়েকে বিয়ে করা, বিছানায় কলবলে রাত কাটানো সব সম্ভব, তদুপরি উপায় ছিলো না। তিনমাসের ছুটি নিয়ে বিয়ে করতে এসেছিল। ছুটির প্রতিটা সেকেণ্ড বউ ছাড়া কাটানো কষ্টকর যেন; পুরো পরিবার গলদঘর্ম হয়ে ওঠে পাত্রীর খোঁজাখুঁজিতে।

বিদেশ থেকে আসার রাতটা কেবল গেছে বিছানায় গড়গড়াতে। পরের দিনের আলো ছড়িয়ে পড়তেই পাত্রী দেখার তোড়জোড়। কখনো ছোট ভাইয়ের, কখনো খালা – ফুপির, কখনো বন্ধুদের এ আত্মীয় সে আত্মীয়ের মেয়ে। এই সেই করতে করতে হান্নান হাঁফিয়ে উঠেছিল। বিয়ের উকিলগুলোর প্যানপ্যানানিতে সপ্তাহ যেতেই আবেগ প্রায় ভোঁতা ! 

এমন সময়ে ছোট ভাইয়ের বন্ধুর বোন মুক্তাকে প্রথম দিন দেখতে গিয়ে হান্নানের পছন্দের মাত্রা এমন যে, হাতে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন নগদে ধার্যও করেছিল। বেশরম বলা যায় না, জঞ্জালি টেনশন থেকে রেহাই পাবার উপস্থিত বুদ্ধি মাত্র। সবাইকে বুঝাতে চেয়েছে – বিয়ে যখন করতেই হবে, ছাড়-টাড় দিয়ে করে নিলেই হয়। মুক্তাকে এতো ভালোলাগা বুঝতেও দিলো না কাউকে। দারুণ হজমী শক্তি বটে; মুরব্বিদের কথা বলার অতটুক সময়ক্ষেপণও করেনি…! মুরব্বিদের এটা-ওটার দাবি হান্নানের কাছে গরুর হাটে দর কষাকষির মতো ঠেকে। এ প্যাঁচে মুক্তাকে যদি বউ করা হয়ে না ওঠে!

হান্নান প্রথম দৃষ্টিতে মুক্তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসা এমন করেও হয়। ভালোবাসা বড়ই বিচিত্র, ভালোবাসা বুঝি এক ধাঁধাঁ। কেননা ভালোবাসাবাসি করবে সেই সময়ে হান্নানকে বিদেশে চলে যেতে হয়। পরিবারের হাল ধরে। ভালোবাসাবাসির ক্ষোভ তো আছেই। ভালোবাসার ক্ষোভ আগুনের চেয়ে বেশি পোড়ায় সবার অলক্ষ্যে;

বৈঠকে থাকা মুরব্বিদের হান্নান সাহসী স্বরে বলেই দিলো চাচাতো দুলাভাইকে চোখ টিপ্পনী দিয়ে –  বউ তো আমার হবে, নাকি ? আমার পছন্দ না হলে ! ঘুমাতে তো আর কেউ যাবে না… সবাইতো থ’। মুরব্বিরা না শোনার ভান ধরলো। কেউ কেউ তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো। হতে পারে হাসির কারণটাও না জেনে; বিয়ের পরবর্তী তিনমাস পেরুতেই যথারীতি হান্নান বিদেশ চলে যায়। অথচ কেমন জানি দূরে থাকা নয়। হৃদয় সংযোগ তো আছে, তদুপরি দিনের প্রায় সময়টা মোবাইলের চওড়া স্ক্রিনে তাকিয়ে আনমনা ও একগুঁয়েমির মুহূর্ত কলবলিয়ে কাটে। দুপুরবেলার খাবারের পর পাকঘরটা গুছিয়ে শোবার ঘরে আসতে আসতে বিকেলের উদ্দামতা ফুরোয়। বিদেশে তখন হান্নানের লাঞ্চ ব্রেক। প্রায় চার ঘন্টার মতো সময়ের ব্যবধান।

সেদিন শোবার ঘরে শিমুল তুলোর বালিশে উপুড় হয়ে, জোড়া পায়ের গোড়ালি দোলাতে দোলাতে শূন্যে, ভিডিও কলে পরস্পরের মুখ চেয়ে কথা হচ্ছিলো…

এই বুঝি সেই এশকের ঠেলা। অজিরানি রিংটোন বেজেই যাচ্ছে। কল রিসিভ করার জন্য পাকঘর থেকে একরকম দৌড়ে, শাড়ির আঁচলায় তুলতুলা হাত মোছতে মোছতে ; সাদা হেডফোনটি কানে লাগিয়ে যে কথা বলা শুরু, রুমের দরোজাটা আটকাবে সেটার হুঁশও থাকলো না। তবে, ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে একমাত্র দেবরটিও পড়াশোনার জন্য বাইরে। জরুরি সত্য কথা এই, হেডফোন কানে লাগালে বাইরের দুনিয়াটার খবর কি আর থাকে! কথার টানে কথায় এশকের লা-মক্বামে গলার স্বরটা এমনি এমনি পৌঁছে, ভলিউম বাড়ে নিজেদের অজান্তে। মুক্তাও জানে না তার শাশুড়ি মায়মুনা দরোজার আড়ালে এসে পা টিপে দাঁড়িয়েছে… !

মায়মুনা মানে মুক্তার শাশুড়ি। এখনও বয়স তেমন হয়নি। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের বছরটাও না যেতে কোলজুড়ে হান্নানের হাত-পায়ের ছোঁড়াছুঁড়ি। এখন চলতি বয়স বললে বিয়াল্লিশটা বসন্ত পেরোলো মাত্র…!

এই পড়ন্ত বিকেলে মোবাইলে উচ্চস্বরে কথা বলায় মনে আসা কৌতূহলে, আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে এসে মায়মুনা নিজের শরীরে খুব চেনা চেনা অতীতের টান অনুভূত হলো; ঐদিকে মুক্তা মোবাইলের স্ক্রিনে চুমুর পর চুমুর বন্যা বয়েই দিচ্ছে। যেন জল ঠুস্ ঠুস্ শব্দ করে পড়ছে জলে, জলের গায়ে। মুক্তা ঝলমলে চোখেমুখে বলছে – হলো?  সোনা, হলো…এবার তুমি শান্ত হলে?

শান্তদিঘির কালো জলের মতো চোখের মণি দুটো মোবাইলের স্ক্রিনে নিবিড়তায় ঝলমলাচ্ছে। মন আর শরীরের দ্বৈত তৃষ্ণায় দেদারসে চুমু দেওয়ার পর মুক্তা হাঁ-মুখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলছে – অ্যাঁ….. দাও, গরাস খাওয়ায়ে দাও…

হান্নান হয়তো খাবারের প্লেট থেকে গরাস তুলে দিচ্ছে। কী অত্যাধুনিক জলজ্যান্ত আধ্যাত্মিক কাজ কারবার!
মুক্তা হাঁ বন্ধ করে বললো – হুম, খেলাম। আচ্ছা, আজ শুধু ডাল ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছো কেন! 

মুক্তা কিছুক্ষণ চুপ করে হান্নানের কথা শুনে বলে — ওহ্ হো সোনা, কী কষ্ট না? জানো সোনা, রান্না শেষ করে খাবারগুলো মুখেই যায় না। প্লেটের ভাতগুলোতে তোমার মুখ ভাসে। গরুর গোশতের ভুনা রান্না করলে তো, সেদিন খেতেই পারি না চোখের জলে…

দরোজার আড়ালেই মায়মুনার হঠাৎ মনে পড়ে গেল গর্ভছেঁড়া হান্নানকে। ছোটোকালে ভাত খাওয়ায়ে দেওয়ার সে ঝলমলে সাদাকালোর দৃশ্য। এই তো, হান্নান হাই স্কুলে উঠেও ভুগিয়েছে। শত কাজে ঢলে পড়া দেহই হোক, গরাস খাওয়ায়ে না দিলেই খেতো না। এসব ভাবতে নিজের অজান্তে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। গাল বেয়ে পড়তে থাকা অশ্রু মুছে যে তাকালো, মুক্তা মোবাইলটি কমলার কোয়ার ঠোঁট ছুঁয়ায়ে বুক থেকে, ঘামে নেয়ে ওঠা আপেলের মতো গর্তের নাভি থেকে আরো নিচে, আরো নিচে…ধীরে ধীরে এলোমেলো শাড়ির কুঁচি গলিয়ে জ্বরমাপক স্টেথোস্কোপ যেন হাতড়াচ্ছে সব উষ্ণতা ; মুক্তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো জানালার পর্দা মৃদু বাতাসে তিরতিরে উল্টে-পাল্টে, বিড়বিড়ে আলোর ছটকে স্বর্ণালী হয়ে চকমকাচ্ছে। জানালার কাছে কামিনী গাছে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুলের ম-ম গন্ধে ঘুচঘুচে কালো ভিমরুলের দৌড়াদৌড়ি ঘরের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ। মুক্তার সারা শরীর ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। হোমিওপ্যাথির শিশি’র মতো এক পায়ের নূপুর ঝনঝনায়ে, সাপের তলপেটের মতো বেঁকে, অতঃপর ঘামের বিন্দু দরদরিয়ে ঝরে পড়লো বালিশে, বিছানার চাদরে…
নিঃশ্বাসের বাড়াবাড়িতে বুকটার ঘন ঘন উঠা-নামা। ঘামে ভরা গাল ও কপালে মোবাইলটি ঠেকিয়ে হিসহিস শব্দে বলতে লাগলো — ইস্ সোনা, আমাকে শেষ করলে তুমি, আমি আর পারছি না…

এতক্ষণে মায়মুনার শরীরে আচমকা কে যেন বৈদ্যুতিক হিটার বসাল। বুকটা ভারী হয়ে এলো হঠাৎ, সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার মতো। সে হাতড়াতে থাকলো নিজেকে আর নিজের জীবনের সে দিনগুলি… 

তখন হেমন্তের পাকা ধানের মওসুম। পুরাতন বাড়ির ঘরে – বাইরে ধানের ফুঁঝা। গলাকাটা ধানের গোড়া বাইরে আর ধানেরচড়া ভেতরে এভাবে উঠোনের পুরোটাতে ফুঁঝাগুলো টিলার ন্যায় ‘তারা’য় সাজানো। মাগরিবের আজানের পর থেকে শীতের ধোঁয়াশা ভেদ করে চাঁদের আলোকে মজজুবি চিকমিকি। 
সন্ধ্যা পর্যন্তই ফুঁঝাগুলোর উপর লাফিয়ে লাফিয়ে খেলেছে হান্নান ও তার বন্ধুরা। ধানপাতার আঁলে কচি গায়ের অনেক জায়গায় কেটেছে মালুমও নেই। সন্ধ্যার পরে হাত মুখ ধুতে যখন কাটা স্থানে পানি লাগছে, শূলিয়ে ওঠছে বিষম। অথচ মায়ের সামনে ‘অহু’ শব্দ করলেই ঝাড়ি – বকাবকি, চোখরাঙানি। তাই ভেতরে দাঁত খিচে চুপচাপ…

মায়মুনার স্বামী সবেমাত্র বিদেশে গিয়েছে। চাষের জমিগুলোতে চাষবাস দেবর দুটোই করে। ট্র্যাক্টর দিয়ে, কখনো ঘরের মেয়েমানুষরা মিলে কোমরে আঁচলা গুজিয়ে টুলে – টেবিলে, কেউ কেউ মরিচের পাঁডায় ধোপার কাপড় আছাড় মারার মতো ধানগাছ থেকে ছড়ানো ধানগুলোর ঘরময় স্তূপ। শীত তেমন নেই বললেই চলে স্তূপাকার ধানের ভাপসা গরমে। দলিফড়িং, ছোট ছোট কালো – সোনালি পোকাগুলি আঁধারে মায়মুনার রুমেও ঢুকে যাচ্ছে। রাতের খাবার খাওয়ার আগ পর্যন্ত এই খাটুনির পরেও মায়মুনার অবসর নেই। কেননা স্বামীকে ক্যাসেট পাঠাতে হবে। আরেক গ্রামের একজন বিদেশ যাচ্ছে আগামীকাল…

রেডিও-র সামনে বসলো। ঠিক রেডিও জকির মতো। জোরে কাশি দিয়ে গলা ঝাড়ল কয়েকবার। থু থু গিলল পরপর। রেডিও-র রেকর্ডের ঘরটি চাপতে প্লে এর ঘরটি চেপে যায়। মানে দুটো ঘর চাপে আর ঘুটঘুটে লাল মরিচরঙা ছোট একটা বাতি জ্বলতে থাকে। ‘আসসালামু আলায়কুম, আসসালামু আলায়কুম’ বলে বলে রেকর্ড করছে। তারপর রেকর্ড পিছনে টেনে শুনছে। এমন কয়েকবার টেস্টিং করে গলার স্বরটা ভালো বোঝাচ্ছে কিনা পরখ করে। 

আহা, ক্যাসেটটি অনেক আগেকার জারি গানের। মায়মুনা এটি প্রায়ই শুনে। সুখে – দুঃখে আর অবসরের একমাত্র সাথী। মা ফাতেমা – কুলসুমার জারি। কাজ-টাজ থেকে একটু রেহাই পেলেই শুনতে শুনতে, নাক টেনে টেনে চোখের জল ঝরায়। একমাত্র মরা বোনটির কথাও খুব মনে পড়ে। আর কোনো ক্যাসেট নেই বলে রোদে দিনভর শুকালো, যেন ফিতে ফুলিতে না আটকায়। এতো শখের জারির ক্যাসেটটির জন্য রেকর্ড করতে বসার আগে মৃদু আফসোসও করল।

ঠিক নিশুতি রাত। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ বা মাঝে মধ্যে কেবল খেঁকশিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে। চূড়ান্তভাবে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েও দরোজাটা খুলে অন্য রুমগুলো দেখে। দেবর দুটোই পাশের বাড়ির ছেমা মাহফিলে গেছে। ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত জোড়খাই – তবলা, হারমোনিয়াম ও জুঁরির ঝুমঝাম ঝংকারে ভাণ্ডারী আর কাওয়ালি গানের জিকির আসকার চলবে। খুব দূর থেকে এ গভীর রাতে মাইকের আওয়াজ আসছে একটু একটু — 

তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার কালাসোনা আসিতে পারে
মনে চায়, দিলে চাঁই যারে…

মায়মুনা বুক ধড়পড় ধড়পড় করা রাতে কানখাড়া করে গানটি বুঝতে ও শুনতে চেষ্টা করে। মনের পশম ধরে টানাটানিতে, গুনগুনিয়ে গলাও মেলায় মাইকে শুনা গানের তালে তালে। 

হঠাৎ গানের ঝোঁকটা বাদ দিয়ে রেডিও-র সামনে চূড়ান্তভাবে গলা ঝাড়ল। টিনের চালে পাকনা বরই পড়ার শব্দে শিশির ঝরছে। এমন সময় বৃদ্ধা শাশুড়ি বিছানায় পড়লে দুনিয়ার খবরও থাকে না, তবুও মনে খটকা। দরোজা আবারও খুলে আর বন্ধ করে। এমনকি জানালাটিও খুলে দেখে ফকফকা জোছনায়, বেঁড়ার ফাঁকে কেউ তাকিয়ে বা শুনে আছে কিনা। অতঃপর রেডিও-র সামনে বসে। গলা ঝাড়ে, থু থু  গিলে। মাথার ঘনকালো লম্বা চুলের বেণী কোমলতায় মোচড়ে মোচড়ে কথা বলা শুরু করে –

আসসালামু আলায়কুম, আশা গঁরি অঁনে ভালা আঁছন। আঁইয়্যও আল্লাহর রহমতত্ আর অঁনর দোআঁয় হঁনো রহঁম আঁছি। আঁই ন জানি রফিক ভাই হাঁলিয়ে যেবো গোঁয় বিদেশত্। আঁজিয়ে হইয়্যিঁদে তোঁয়ার ভাই। অঁনে জানোন ঘরে বাইরে এঁহন ধান। এতল্লাই রেতঁর নিশিত হঁতা হদ্দি। অঁনেত্যে পেট ন পুড়ের না শাঁমী…? আঁই নিজও ন জানি, কেঁনে রেঁত হাঁডায়। বালিশে জানে আঁর দো নয়নঁর জঁলে জানে। দোচোঁখোর ভূঁর পুঁচি যাবু এগদিন। অঁনে হাঁছা গঁরি হঁনতো হত্তে দেশত্ আঁইবেন…? আঁই পতিবার আলমারি খুঁলিলি অঁনর শাটর্ত্তুন অঁনর গন্ধ লঁই আর হাঁদি…

দপ্ করে রেডিও-র পজ ঘরটি চাপ দিয়ে রেকর্ড বন্ধ করে। ইচ্ছেমতোন কাঁদে মায়মুনা। বুকের পাঁজরের হাড়গুলো কাঁচি দিয়ে কাটছে যেন কেউ। হান্নানকে ঘুম থেকে তুলে প্রস্রাব করায়। সে সবে দশ বছরের বালক। হান্নানের চোখে পানি ছিটিয়ে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে। রেডিও-র সামনে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দিয়ে বলে – হঁ না হঁতা ওপুত্ তুঁর বাপঁল্লেই, হাঁলিয়ে ক্যাসেট দিঁইয়্যুমদে…

হান্নান ঘুমের ঘোরে সালাম দিয়ে বলতে থাকে – আব্বু ভালা আঁছন্না…? আঁই এঁহন স্কুলুত্ যাঁই। আঁল্লেই গাড়ি এন্নোন, আঁর জ্যাম্পার ছিঁড়ি গিঁইয়্যিঁ…

মায়মুনা হান্নানের গালটা টেনে দেয় এমন পাকনা কথাবার্তার জন্য। হান্নানের ছোট মন্নান এক বছরের। ঘুমের মধ্যে নেড়েচেড়ে কান্না করায় উচ্চস্বরে। এ কান্নাও রেকর্ড করে। এ যেন কান্না নয় শুধু, অনেক বড় পাওনা মায়মুনার স্বামীর কাছে… বুকের ঢেউ, আকুতি….

এ ক্যাসেটটি মায়মুনার স্বামীর প্রবাসে পৌঁছলেও, হয়তো শুনতে পারেনি। রফিক যাওয়ার ঠিক দু’দিন পর খবর এলো স্বামী আরবের রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। লাশও দেখা হয়নি শেষবারের মতো। অনেকে ফতোয়া দিলো – আরবের মাটিতে দাফন হওয়া পরম সৌভাগ্যের…

হঠাৎ এসব ভাবতে ভাবতে মায়মুনার দু’টি চোখ চাপিয়ে অশ্রুতে অশ্রুজলসা। রুমের আড়াল থেকে নিজের রুমে দৌড়ে গেল আঁচলা মুখে চেপে আর পাওয়ারি চশমার সম্মুখে জমে উঠেছে হেমন্তের আবছা কুয়াশা…

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

রণবীর পুরকায়স্থ

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  গল্প

র ণ বী র   পু র কা য় স্থ

পাণ্ডুলিপি

pic4

রাত খুব একটা নয়, ন’টায় শুরু হয় সাহিত্যপাঠ। দেবেশচন্দ্রের ঘরে উজ্জীবিত মৃণ্ময়  গ্লাসটাস সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেয় যথাযথ, চড়চড়াৎ করে বাদাম চিপসের প্যাকেট খোলা হয়। সবাই উল্লাসে হাঁক দেয় চিয়ার্স। এক চুমুকেই শুরু হয় পাঠ। শুরুতেই গল্প পড়ে নন্দিনী,  অসমিয়া বাঙালির মিশ্র সংস্কৃতির জনপদ রিহাবাড়ির ভাড়াবাড়িতে বেড়ে ওঠা দেব পরিবারের সদস্য নন্দিনী। গুয়াহাটিতে প্রেম ও বিবাহ অসমিয়া প্রযুক্তিবিদ উদ্ধব কাকতির সঙ্গে। উদ্ধব থাকে ইউএস, নন্দিনী কোচবিহারে মাস্টারির চাকরি নিয়ে একা থাকে, স্ট্যাটাস বিবাহিত।

বাসবীর বরও থাকে দূরে, প্রোষিতভর্তৃকা। বরের কাছে রাঁচি গেলে তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যায় শীতঘুমে। বাসবীর চাকরি বাকরি করতে হয় না, বরের অনেক টাকা। বরের নাম মিঠু। মিঠুর কথায় মনে পড়ে যায় দেবেশচন্দ্রের বাসবীর শেষ না হওয়া কথাটা। বাসবীকে বলেন,

— মিঠু কী বলছিল রে?

— না, ও কিছু না।

— বল না।

— ওটা একটা ফেসবুক রসিকতা।

— ইন্টারেস্টিং নিশ্চয়?  বল না।

— বলব? আপনিও পড়েছেন নিশ্চয় দেবেশদা,  আম কাঁঠালের ছুটিতে দশ-বারোজন নাতি-নাতনি ব্যাঙ্গালোর পুনে চেন্নাই থেকে এসেছে গ্রামের বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে সময় কাটাবে বলে, গর্বিত ঠাকুমাও আড্ডার মেজাজে মধ্যমণি হয়ে বসেছেন কিন্তু কেউ যে কোনও কথা বলছে না, সব চুপচাপ, পিনড্রপ সাইলেন্স। অবস্থা বেগতিক দেখে ঠাকুমাও উঠে গেলেন কিছু একটা আনতে। এখন বলুন তো দাদা, ঠাকুমা কী নিয়ে ফিরলেন?  

কেউ ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে না। কেউ বলে চশমা, কেউ বলে দোক্তা, কেউ বলে গানের খাতা। না। বাসবী সবটাতেই বলে, গলত জবাব। শেষ পর্যন্ত মৃন্ময়ের স্ত্রী বলে,

— ঠাকুমাও তার মোবাইল আনতে গেছেন।

— ঠিক।

যথেষ্ট হাসির পর দেবেশচন্দ্র ফরমান জারি করেন সাহিত্যবাসরে কোনো মোবাইল নয়, সুইচ অফ করে দাও সবাই। নন্দিনী শোনায় পুরুষের বয়ানে বহুগামী কামুক পুরুষের গল্প। অনেকটা যেন তার জীবনের কথা। গল্প শেষ করে সবার মতামতের জন্য অপেক্ষা করে।  কেউ কিছু বলছে না দেখে দেবেশচন্দ্রকে বলে,

— সবাই চুপ কেন? এরকম গল্প কি হয় না?

— হবে না কেন?

— গল্পে হয় না জানি, পরম্পরা মিলিয়ে লিখতে হয়, কিন্তু জীবন তো এত মাপজোক লিখে রাখে না। আপনারা বলেন যৌনতা জীবনের অঙ্গ, আমি বলি বিকৃতি।  

বলেই ঝরঝর করে এক পশলা কেঁদে নেয় নন্দিনী। কিছু আবেগ আর কিছুটা ভদকার প্রতিক্রিয়া হতে পারে। দেবেশচন্দ্র যে আজ ঢালাও পানের সম্মতি দিয়ে রেখেছেন সবাইকে। তাই নন্দিনীর গল্পের একটা সদর্থক আলোচনা শেষে বলেন- খুব ভালো হয়েছে গল্প। এবার বাসবী বলল মোবাইল দেখে পড়বে। দেবেশ চন্দ্র বললেন,

— না, আইন আইনের পথে চলবে। কাগজে লেখা পাণ্ডুলিপি পড়তে হবে। আর জমা দিতে হবে, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার লেখা স্থির হবে আজ।

বাসবী মেনে নেয়, ব্যাগ থেকে বের করে কাগজের তাড়া। দেবেশচন্দ্র  বাসবীকে পড়া শুরুর আগে আবার সাবধান করে দেন,

— সাদামাটা পড়বে, তোমার বাচিক শিল্পী সত্তা যেন গল্পকে প্রভাবিত না করে।

এটা ঠিকই বাসবীর কণ্ঠস্বরে এমন একটা জাদু আছে যা ঢাকাই রাঁধুনিকেও হার মানায়। দুব্বো ঘাস কাঁঠাল পাতা ফুলকপির ডাঁটা আলুর খোসা সব কিছুই রান্নার জাদুতে অমৃত পদ হয়ে ওঠে। বাসবী মৃদু হাসিতে সম্মত হয়। বাসবীর গল্পটা সবাইকে নাড়িয়ে দেয়।  একেবারে ভিন্ন ধরণের গল্প, এক প্রতিবাদী মানুষের জন্য খোঁড়া হয়েছে কবর, কিন্তু তাঁর দেহ পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। খুনি কিংবা গুণ্ডা একটি লোক প্রতিদিন দেখে যায় খোঁড়া কবর, আর প্রতিদিন সে বদলে যেতে থাকে। একদিন সে নিজেই সেই পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কবরে ঢুকে যায়, কি জানি কী খোঁজে, সব শেষে ধুলিধূসরিত যখন বেরিয়ে আসে, তখন তাকে দেখে আর চেনাই যায় না। মানুষ বদলে যাওয়ার গল্প শুনে নন্দিনীই প্রথম বলে- অসাধারণ। নলিনী বলে,

— কী করে লিখলে দিদি। এখন তো কেউ প্রতিবাদী থাকতে পারে না। প্রতিবাদী মানে এখন দেশদ্রোহী হওয়া। আর দেশদ্রোহের শাস্তি মৃত্যু নয় জেল।  তবে দি বিশ্বাস হারানোও যে পাপ, ওকে কেন আবার কবরে পাঠিয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে এলে।  আরও বেশি প্রতিবাদী করে নিয়ে আসা যায় না ? তবে লিখেছ দারুণ, মুন্সিয়ানা আছে।

এর পর, কেউ খেয়াল করেনি কখন এসে হোটেল রুমের এক কোণে বসে পড়েছে নলিনী। কারও কোনও অনুমতি না নিয়েই এক তাড়া কাগজ নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে তার গল্প।


প্রথম পরিচ্ছেদ


— দুঃখিত দেবেশ দা, আজ সারাদিন অনুপস্থিত ছিলাম, দুঃখিত সুমিতাদি, আমার বন্ধু মৃন্ময়ের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করছি। চোখ ঢুলুঢুলু জুরি বোন স্যরি, বাসবীদি নন্দিনীদি দুঃখিত, দেবেশদা আর সুমিতাদিকে কষ্ট দেওয়াই তো আমার কাজ তাই ওসব বলে লজ্জা পাব না।  স্যরি গঙ্গাধর স্যরি গোলকগঞ্জ।  

দেবেশচন্দ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নলিনীকে থামিয়ে দেন। বলেন,

— সময় কম সরাসরি গল্পে চলে যাও।

— গল্পেই তো আছি দেবেশদা, আপনাদের নাম আছে গোলকগঞ্জ আছে দেখে ভাববেন না বক্তৃতা দিচ্ছি, গল্পই পড়ছি। আপনাদের নাম মানে পাত্র ও স্থান কাল মিলে যাওয়ায় বিভ্রান্তি হতে পারে, আপনার আপত্তি থাকলে নাম পালটে দেব, দেবেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় সাধন চট্টোপাধ্যায় করতে পারি স্বপ্নময় চক্রবর্তী হতে পারে, অমর মিত্র কিন্নর রায় নলিনী বেরা কিংবা ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ও হতে পারে। না, তাই বা কেন,  মিত্র রায় বেরা চলবে না। গল্পটা বলা হবে একজন ব্রাহ্মণ সাহিত্যিককে, আর কোচবিহারে আপনার থেকে যোগ্য ব্রাহ্মণ লেখক কে আছে বলুন?  যাক পড়ি আবার, হ্যাঁ গঙ্গাধর নদী আর গোলকগঞ্জ ছাড়া কুলেশ্বরী মন্দিরেরও একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে কাল সকাল পর্যন্ত। আজ সারাদিন অনুপস্থিত ছিলাম। আপনাদের এই ছোটো শহরে নিয়ে আসার পিছনে যার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি সে মানুষটাও এখন অনুপস্থিত। তাতে কী হয়েছে, অদম্য নেই তো কী হয়েছে, আমি তো আছি।  কাল সকাল নাগাদ সব শেষ হয়ে গেলে, গোলকগঞ্জ দেখাতে নিয়ে যাব আপনাদের । অদম্য বলেছিল তার ছোটো শহরের ছোটো নদীটা দেখাবে আপনাদের, গঙ্গাধরকে কেউ পুংনামে ডাকে না, গঙ্গা নামেই পরিচিত। বলেছিল লখিমারি সীমান্ত দেখাবে, সীমান্তে আছে বর্ডার ট্রেড সেন্টার, এদেশে ওদেশের শাক সব্জি মাছ বিক্রি হয়, এদেশের গ্রামীণ আনাজপাতি কেনে ওদেশের সাধারণ মানুষ।  মূলত এই সময় ইলিশ আসে খুব, শুঁটকিমাছও বিক্রি হয় । অদম্য বলেছিল একটা কাজ সেরে আসবে সিঙ্গিমারি থেকে, আমি যেন আপনাদের সঙ্গে থাকি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারব কি না জানি না।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ  


অদম্যকে আমি একা যেতে দিই নি। আসামের অবস্থা তো এখন ভালো নয়। আপনি জানেন আমি আসামের বানপানির কথা বলছি না, বন্যা আসে বন্যা যায় আসামে, এসব নিয়ে কেউ ভাবে না, কিন্তু এই বন্যা পরিস্থিতি সামলে প্রতিবছর আসামের ক্ষেত জমি যাদের ঘাম পরিশ্রমে উর্বর হয়ে ওঠে, তাদের কথা বলছি। যাদের কায়িক পরিশ্রমে আসামের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় চাউল শাক সবজি গাখির। গাখির মানে দুধ। তারা যখন রংপুর জেলা থেকে ব্রহ্মপুত্রের পারে এসেছিল তখন আসামের বুদ্ধিজীবীরা ওদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। তখন কুশল চাষী ছিল না আসামে। রংপুরের কৃষকরা গড়ে তুলেছিল ‘চিকুনি দেশ, শুওলা, সুফলা মরমর দেশ’।  সোনার ফসল ফলানো সেই কারিগরেরা এখন হয়ে গেল বিদেশি, ১৯৮৫র এক উদ্ভট চুক্তির ফলে। দেবেশদা, আপনি একজন সংবেদনশীল লেখক, আর লেখক হলে তো কত কিছুর খবর রাখতে হয়। ভিয়েতনাম আন্দোলন থেকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ পর্যন্ত। হয়তো কিছুটা জানেন আসামের এনআরসি নিয়েও। হয়তো মিটিং মিছিলও করেছেন বা করবেন আরও। তবু এত কাছাকাছির প্রতিবেশি আমরা, আমিও তো কোচবিহারেই থাকি। আমিই বা কতটুকু বুঝতাম, অদম্য কামতাপুরী আন্দোলন করত বলে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কলেজে বিপরীত রাজনীতি করেছি তখন, উস্কানিও ছিল। তারপর কী জানি কী হল অদম্য ছেড়ে দিল দলীয় রাজনীতি। আসামে তখন বিদেশি খেদা আন্দোলন চলছে, তার অনেক আগে, আমাদের জন্মও হয়নি, আসাম চুক্তি হয়ে গেছে, এক আগ্নেয়গিরির জন্ম হয়েছে, আমাদের দেশ ভাবনার উপর কুঠারের প্রথম আঘাত। এদিকে আমরা ৩৭০ উঠিয়ে দিয়ে একাকার করে দিয়েছি কাশ্মীরে ভারতে, ওদিকে আসামে জারি রয়েছে ভাগের ভোট খেলা। ভাগের এই দেশটা সত্যিই এক প্রমোদ তরণী, হা হা! সকাল থেকে রাত অব্দি এই শহরে থেকে একটা কথা নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন যে, আসামের এই শহরের সত্তর ভাগ মানুষই বাঙালি। ভেবেছেন অদম্য তো ভালোই আছে তাহলে কেন উস্কানি। আপনারা ভাবছেন সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় কেন, বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের মতোই তো এরা। এখানকার গাছগাছালি ফলমূল শাকসবজি আর গঙ্গাধরের মাছ নিশ্চয় খাইয়েছে লীলাধর চক্রবর্তী,  বড়িয়ালির তো তুলনা নেই। লীলার উপাধি চক্রবর্তী হলেও কিন্তু সে বাঙালি নয়, অন্তত আসামে সে গোয়ালপাড়িয়া ভাষাভাষী হিসেবে পরিচিত। অদম্যের মামাতো ভাইটি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলবে তখন কিন্তু সে খাঁটি বাঙালি আবার কাগজপত্রে সে নির্ভেজাল অসমিয়া। ভেজাল কিছু থাকলে সে ব্রিটিশরা করে গেছে কোনকালে। আপনার জানার কথা নয়, ১৮২৬ এর ইয়াণ্ডাবু সন্ধির পর আসামের ব্রিটিশ অধিকার কায়েম হওয়ার পর এদিক ওদিক বাংলার অনেক ভূখণ্ড আসামের হয়ে গেছে।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ  


রাজ্য পুনর্গঠনের সময় দক্ষিণবঙ্গের মানভূম সিংভূমও চলে যায় তৎকালীন বিহার রাজ্যে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর পুরুলিয়া ফিরে আসে। উড়িষ্যায়ও চলে যায় বাংলার অংশ। আপনারা বলবেন যাক না, থেকে তো গেল ভারতবর্ষে, চলে তো যায়নি পাকিস্তানে বাংলাদেশে। হয়ে যায়নি বিদেশ। আসলে বিদেশ থেকে কিছু কম নয় দেবেশদা। ঘাটশিলায় গেলে এখন বাংলায় কথা বলতে পারবেন? কিংবা ধানবাদে? ধুবড়ির সবক’টা স্কুলে বাংলা পড়ানো  হতো, আর এখন? গঙ্গাধরপারে এই ছোটো শহরে চোখে পড়ল একটা বাংলায় লেখা সাইন বোর্ড? সব পেট কাটা ‘র’ আর ওয়াব্ব মানে ‘ব’য়ের নিচে টান।

বর্ধমান গেছেন তো, কল্যাণেশ্বরী মন্দির পেরিয়ে মাইথন ড্যাম, উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ অন্যপারে ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের দিকে অনেক দোকানপাট স্থায়ী অস্থায়ী, কিছু বাংলা বেশির ভাগ হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ড। বাঙালি নিজেকে ভাগ করে দিয়ে গেছে হিন্দি হিন্দুস্থানকে, সম্পূর্ণ সমর্পণ এই ভাগের দেশে। এবার ওপারের দৃশ্যটাও দেখেছেন? সব হিন্দি। নিজেকে ছিন্ন শূন্য করে দিয়েও কী সুখে থাকল বাঙালি, আমরা যেমন আছি কোচবিহারে আলিপুরদুয়ারে দার্জিলিংয়ে। তবু আমরা চাইলেই কলকাতা চলে যেতে পারি, পাঁচতলা তেত্রিশতলার একটি খুপরিতে মাথা গুঁজতে পারি নিশ্চিন্তে। তা কলকাতাও তো কলকাতা নয়, কলকাত্তা মে বাংলা চলে না, হিন্দি উর্দুর দাপট। তাও তো পশ্চিম বাংলার রাজধানী, ফ্ল্যাট কিনে থাকতে পারেন আপনি। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র চরের দরিদ্র কৃষিজীবী যে ভয় পেয়ে নাম লিখিয়েছিল অসমিয়া বলে, এখন তো তাদেরও পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ডিএনএ, যার নাম এনআরসি, ডি ভোটার, লিগ্যাসি ডেটা, দিতে হবে বন্যাপ্রবণ  ব্রহ্মপুত্র আর বরাক পারের বাঙালিকে।

এক দেশে কত আইন, অসমিয়াদের পরীক্ষা দিতে হয় না, ওরা খিলঞ্জিয়া, মানে আদি বাসিন্দা। পরীক্ষা দিতে হবে শুধু বাঙালিকে। কাশ্মীরে পাঞ্জাবে কি তেমন পরীক্ষার চল আছে? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যখন তখন মানতেই হবে আসামের খিলঞ্জিয়া ভূমিপুত্র তখন প্রধান বিচারপতি।



চতুর্থ পরিচ্ছেদ


এই নন্দিনীদি তোমার কাছে ভিক্স আছে গো? দাওনা একটু, আজ সারাদিন ভিজেছি বৃষ্টিতে। জুরি বারবার তাকাচ্ছে দেখুন আমার কাঁধের দিকে। না না, গোলাগুলির মুখে পড়িনি কিংবা কোন সন্ত্রাসী হামলা করেনি কোথাও। হাইওয়ের পাশে নয়ানজুলিতে বাস উল্টে যায়। মরেনি কেউ, তবে আহত হয়েছে সবাই কিছু না কিছু। অদম্য ছাড়া কেউই হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় নি। তাই আমরা বিভিন্ন বাহনে হিচহাইক করে ফিরেছি। কিছু রয়েছে গোলকগঞ্জ স্টেশনে কিছু অন্য এক জায়গায়। সব সন্দেহজনক বিদেশি। ভাগ্য ভালো থাকলে কালকেই পৌঁছে যাবে নিরাপদ স্থানে রাজ্যান্তরে। ভয় পাবেন না, অদম্যর নেটওয়ার্ক নিশ্ছিদ্র, কেউ ধরতে পারেনি, ধরলেও আর রক্ষে ছিল না। লীলাময় থেকে আপনাদের নিয়েও টানাটানি হতো। বাইরে শুনেছেন কেমন মেঘের ডাকাডাকি, বৃষ্টিও হচ্ছে লাগাতার। এই মাঝারাতে একটা গান গাই দেবেশদা? শুনবেন?  

‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান
বানের জলে ভাসল পুকুর ভাসল আমার গান
বন্ধু আইসোরে… কোলেতে বসতে দেব, মুখে দেব পান
ইস্টিকুটুম বৃষ্টি এলো সৃষ্টি হল সুর।’
                     

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সিঙ্গিমারি গ্রামে আজ সারাদিন বৃষ্টি, দু’দিন ধরেই চলছে লাগাতার। কী সুন্দর এই গ্রাম সিঙ্গিমারি, গ্রামের সবাই আজ কর্মহীন, নির্বাক, শুধু হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক ধ্বনি পথে ঘাটে। ওদের মহোৎসব আজ সর্বত্র। বিলাসীপাড়ার পথের উপর দেড়শ গ্রাম ওজনের কইমাছ উজানে চলেছে কানে হেঁটে, বাঁচার তাগিদে উজানে যাচ্ছে, বোকারা ভাবতেও পারছে না কোন পথে বিপদ আর কোন পথে নিরাপদ। পথ মাছের জন্য যে নিরাপদ নয় সে তাদের বোঝাবে কে? কিন্তু আজ কোনও বিপদ হল না তাদের,  নিরাপদ উজানের পুকুরে চলে গেল নির্বিবাদে। বেঁচে গেল, বাঁচ গিয়া শালা।

তরণী মালাকারের বাড়িতে তখন অন্য আতঙ্ক। জড়ো হয়েছে জনা তিরিশেক মানুষ উজানে যাওয়ার জন্য, সন্দেহের হাত থেকে বাঁচতে বিদেশি তকমা পরে যাতে বন্দীশিবিরে জীবন কাটাতে না হয়। ওরা সবাই শুধুমাত্র একটি পুঁটলি সঙ্গে নিয়ে এসেছে, থাকল পড়ে শন বাঁশ বেতের তৈরি বাড়ি ঘর। ওরা যাবে আসাম সীমান্ত পেরিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায়। কী ভাবছেন আপনারা, ওরা যাবে গঙ্গাধর পেরিয়ে বাংলাদেশে? লখিমারির ওপারে? বাংলাদেশে কে নেবে ওদের, সীমান্তের আশেপাশে থাকলে বিএসএফ করবে গুলি, ওপারে চলে গেলে বিডিআরের গুলি খেয়ে মরতে হবে। ওই বিদেশকে চেনে না ওরা, জন্ম থেকে আছে এদেশে। পঞ্চাশ ষাটের ভিতর বয়স তাদের। একজন পদ্মবিবির বয়স শুধু সত্তরের দু’তিন বছর বেশি হবে, মানে দেশ ভাগের বয়সী। ওরা এপারের বিদেশি। কয়েকজনের আদিবাড়ি গোলকগঞ্জে, ওরা কেউ ধানের, সবজির চাষি,  কেউ মাছচাষি। কারোরই কাছে কোনো কাগজপত্র নেই, এককালে হয়তো ছিল, বানপানি খেয়ে ফেলেছে। বানপানি মানে বন্যা।  তবু এনআরসি পাশ করে গেছে ত্রিশজনের ত্রিশজনই। ভাবছেন এনআরসি পাশটা আবার কী, আসলে এটা একটা কথার কথা। মানে এদের নাম নথিভুক্ত হয়ে গেছে আসামবাসী ভারতীয় হিসেবে। এনআরসি নিয়ে কি কিছু বলেছি আপনাকে? এনআরসি মানে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স বা সোনার পাথরবাটি। জাতীয় কোনও ব্যাপারই নয়, পুরোটাই উগ্র জাতীয়তাবাদ। ভারতে কোথাও নেই, আসামে থাকতে হলে ওটা চাই।

সিঙ্গিমারি গ্রামের একটা এনজিওর সঙ্গে আমি যুক্ত, শুধু মেয়েদের নিয়ে সংগঠন, অসমীয়া মেয়েরা আছে, বাঙালিও আছে, মেয়েরা কাপড় বোনে, নিজেরাই বিপণন করে, অদম্যর কাণ্ড আর কি। দেবেশদা আপনি তো অনেক জানেন, হয়তো ভাবছেন সিঙ্গিমারি তো বরপেটা জেলায় আর আমি নিয়ে এসেছি ধুবড়িতে, নিশ্চয়ই কিছু লুকোতে চাইছি। না দেবেশদা ন্যাংটোর নেই বাটপাড়ের ভয়। আসামে এখন যে কত কিছু হচ্ছে, এক এক সময় মনে হয় সুপ্রিম কোর্টও কি চাইছে যেন তেন প্রকারেন নাম কাটা পড়ুক বাঙালির, তাই আর একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে, যারা নাগরিক পঞ্জিতে নথিভুক্ত হয়ে গেছে তাদের দেশি হওয়ার বিপক্ষে যে কেউ আপত্তি জানাতে পারে, আপত্তিকারীর কোনও দায় নেই প্রমাণ করার, যার বিরুদ্ধে করা হয়েছে তাকেই নিতে হবে প্রমাণের দায়। মানে পাশ করিয়ে আবার ফেল করানোর কল। শাসকের তৎপরতায় আসাম রাজনীতির শিশুনায়ক ছাত্র সংগঠন এখন আপত্তি জানানোর বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছে। এমতাবস্থায় অনেক ঘোষিত নাগরিককে আবার অগ্নিপরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। গ্রামের মানুষের পক্ষে দূরদূরান্তের এনআরসি সেবা কেন্দ্রে যাওয়াও কষ্টকর। কেউ কেউ গেছে কষ্ট করে, হয়নি প্রমাণ। গেছে বিদেশি ট্রাইব্যুন্যালেও, সেখানেও ফেল হওয়ায় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বন্দী শিবিরে। কেউ কেউ হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
                                          

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ


হারান মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে ছিল গতকাল, মেয়েটি আমার এনজিওর সভ্য। বিয়ের দিনই হারান আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকে আমি কাপুরুষতা মনে করতাম, পালিয়ে যাওয়া ভাবতাম। কোনও দয়ামায়া ছিল না। হারানের আত্মহত্যায় আমার আজন্মলালিত বিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝে গেছি, হারান হাজার চেষ্টা করলেও অসম লড়াই জিততে পারত না, বাঁচতে পারত না। অজগরের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হওয়া তার একার পক্ষে সম্ভব নয়, বাইরের সব শক্তি দূর থেকে তার তিলে তিলে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে পারে, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারে না তার নাগরিক অধিকার।

তবু দেবেশদা এটাও সত্যি,  হারানের মৃত্যু আরো অনেক সম্ভাব্য মৃত্যুর বিরুদ্ধে যে এক প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াবে তারও কোনও আভাস নেই কোথাও। শোষকের বধির কর্ণে এসব মৃত্যু মিছিলের কোনও মূল্য নেই, তবু প্রতিবাদ তো জানাতেই হবে। হারানের হবু মেয়েজামাই বিল্বমঙ্গল আমার চোখ খুলে দিয়েছে দেবেশদা। সে বলেছে দায়িত্ব নিয়ে সে শ্বশুরের দাহকার্য করতে চায়, বলেছে ওকে যেন সেই সামাজিক অধিকার দেওয়া হয়। তাই আজ সকালে গোলকগঞ্জ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত করে শবদেহ দেওয়া হবে। আপনি বলবেন বেশ তো সৎকার করে নাও গঙ্গাধরের পারে। তারামনি মুখাগ্নি করে নিক। না, দেবেশদা তারামনি বলেছে ওর বাবা হারান মণ্ডল বিল্বকে তার মুখাগ্নি শ্রাদ্ধশান্তির অধিকার দিয়ে গেছে। বিল্বমঙ্গল বলেছে কোন অধিকারে? আমি অসহায় হয়ে সামাজিক সমাধান বের করার উপায় পাইনি। বলেছি,

— তারামনি দাহসংস্কার করুক না, তুমি সঙ্গে থেকো।

তার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু তারামনির যে এক গোঁ, পিতৃবাক্য রক্ষা করবে। তারামনিই বলল,

— দিদি তুমি আমাদের বিয়ে  দিয়ে দাও।

— সে হয় নাকি? বাবার মৃতদেহের সামনে এসব হয় না। পিতৃদশা চলবে এক বছর, এক বছরে কোনও শুভকার্য হয় না।

— সব কাজই শুভকাজ দিদি। তুমি পারবে। চেষ্টা করলেই পারবে।

— কোনো ব্রাহ্মণই রাজি হবে না। তবে রেজিস্ট্রি একটা করিয়ে দিতে পারি সুমিতাদিকে বলে।

— তাই করো দিদি।

— না রে, হবে না, সুমিতাদি অন্য রাজ্যের রেজিস্ট্রার, যদি না হয়, তার উপর নোটিশ টোটিস দেওয়ার ব্যাপার আছে।

আমি জানি সুমিতাদি খুব রাগ করবে,  তুমি তো এসেছিলে দিদি আমাদের বিয়ে দিতে। জানি না, এ আবদার রাখার কোনও আইন আছে কিনা। না থাকুক। দেবেশদা আপনি তো পারেন।  মৃণ্ময়ের বিয়েতে দেখেছি বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছেন শাস্ত্রমতে। কবিতার মতো করে সাহিত্য বাসরেও শুনিয়েছেন বাংলায়। কুলেশ্বরী মন্দিরে ওদের বিবাহমন্ত্র পাঠ করিয়ে দিন না। মন্দিরের যদি বাধা থাকে অশৌচকালীন বিবাহে, তাহলে গঙ্গাধর নদীকে সাক্ষী করে ওদের বিয়ে দিন। তারপর দেহ আসবে, দাহ হবে। আমি না হয় ওদের নিয়ে চলে যাব রাজ্য ছেড়ে। আপনারাও অদম্যকে টাটা করে চলে আসবেন কাল বাদ পরশু। এক ফাঁকে লখিমারি সীমান্ত  বাজারও ঘুরে আসুন। আমাদের তো  আর বিয়ে হল না এ জীবনে।

উর্দ্ধশ্বাসে পড়ে কিংবা বলে থামে নলিনী। কাগজের তাড়াও রাখে চেয়ারে। দেবেশচন্দ্র অবাক হয়ে দেখেন নলিনীকে। দেখেন তার শাড়ি ব্লাউজের ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এ তো এক বেলার ঘটনা, নলিনী লিখল কবে। অবাক বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন মূর্তিমতী প্রতিবাদকে। বলেন,

— কী নাম দেবে গল্পের?

নলিনী বলে,

— আপনি দিয়ে দিন কিছু।

— ‘উজানের কই’ নামটা কেমন?

 সবাই বলে একবাক্যে,

— ঠিক।

কিন্তু দেবেশচন্দ্র লিখবেন কোথায়! সবই তো  সাদা কাগজের তাড়া। নীরবে অন্য দু’টি গল্পের নিচে রেখে দেন শূন্য পত্রাবলী।

আরও পড়ুন...

Categories
2021_pujo

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  গল্প

বি না য় ক   ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

যেদিন ব্রিজ ভাঙল

pic7

বৃহস্পতিবার ক্লাস একটু কম থাকে সোমঋতার। কিন্তু এই বৃহস্পতিবারটা আলাদা। আজ ওদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের তিনজন সদস্য দিল্লি থেকে আসছেন আর তাদের খাতিরদারির জন্য যে কমিটি করা হয়েছে সোমঋতা তার সেক্রেটারি। সেক্রেটারি বলে ওকে যে সব কাজ করতে হচ্ছে তা অবশ্য নয়, ওর থেকে অনেক বেশি কাজ করছে সুহেনা, অপালা, অময়ও। কিন্তু তবু, কে সেক্রেটারি হবে, আলোচনার সময় যখন আরও কয়েকটা নামের সঙ্গে সোমঋতার নামটাও উঠেছিল তখন ওরাই এমন হইহই শুরু করে দিয়েছিল যে মুহূর্তেই ওর নামটায় সিলমোহর দিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল।

– মনে মনে উনিও চাইছিলেন তোকেই সেক্রেটারি করতে। সেদিন রাতে ওকে ফোন করে

বলল সুহেনা।

– কেন? সোমঋতা জানতে চাইল।

– কারণ সবচেয়ে সুন্দর মুখটাকেই সবার সামনে এগিয়ে দিতে হয়। যে-কোনও প্রোডাক্টের

বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেই এই নিয়মটা খাটে।

– আমি তোদের আ্যাড এজেন্সির মডেল, তাই না? দাঁড়া কাল দেখা হোক, তারপর

দেখাচ্ছি। সোমঋতা নকল রাগের গলায় বলে উঠল।

– কী দেখাবি বল তো? তোকে দেখলে যে আর অন্য কিছু চোখে পড়ে না। এমন রূপ তোর, মনে হয় তাকিয়েই থাকি।

এত আন্তরিকতার সঙ্গে কথাটা বলল সুহেনা যে খানিকক্ষণ উত্তর খুঁজে পেল না সোমঋতা। তারপর বলল, আমি খুব লাকি রে। তোর মতো কলিগ পেয়েছি, বন্ধু পেয়েছি।

– আমার একারই যে এমন হয় তা কিন্ত না। কৃষ্ণকলি, সাহানা, অপালা সবারই এক মত। আর আমাদের মেয়েদেরই যদি এরকম হয়, ছেলেদের কী হয় বল তো, তোকে দেখলে? আমি ভেবেছি একদিন চুপিচুপি একটা সার্ভে করব, আমাদের কলিগদের মধ্যেই। দারুণ হবে না?

– আমার একটা ফোন আসছে রে। বোধহয় বাড়ি থেকেই। ফোনটা ছেড়ে দেবার তাড়ায় বলে উঠল সোমঋতা। আর ফোনটা ছেড়েই বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল বেশ কয়েকবার। ছেলেদের ওকে দেখলে কী হয়, ও জানতে চায় না। আর জানতে চায় না।

– আপনাদের নিশ্চয়ই অনেক পাস্ট অ্যাচিভমেন্টস আছে, আগে যে যেখানে ছিলেন অনেক

ভাল কাজ করেছেন, উই আর শিওর। বাট আমরা একটা রিকোয়েস্ট করব এখানে

একদম ক্লিন স্লেটে শুরু করুন। একেবারে নতুনভাবে।

ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হওয়ার পর, কথাগুলো বলা হয়েছিল, ওদের চার-পাঁচজনকে। শুনে কারও-কারও মুখ একটু গোমড়া হয়ে গিয়েছিল কিন্ত খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিল, সোমঋতা। ও তো ঠিক এটাই চাইছিল। পুরোনো সবকিছুকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে। যাতে দুঃস্বপ্নেও আর মনে না পড়ে কোনওদিন। শৌভিককে তো নয়ই, সিদ্ধেশকেও নয়। ও মন দিতে চাইছিল, ওর কাজে। এই যে কলকাতার উপকন্ঠে গড়ে ওঠা ব্র্যান্ড নিউ একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে ও চাকরি পেয়েছে, সে তো দিল্লির জার্নালে প্রকাশিত ওর পেপারটার জন্যই। ওরকম আরও অনেক পেপার লিখতে হবে ওকে। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে নিজের পিএইচডি। তারপর পোস্ট-ডক্টরাল কাজের জন্য প্রস্তুত হতে হবে৷ নিজের পোটেনশিয়ালকে গুরুত্ব না দিয়ে যে ভুল করেছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে, যে ভুল করতে যাচ্ছিল আবার, রিসেন্টলি, সেরকম ভুল আর অ্যাফোর্ড করতে পারে না সোমঋতা। ব্যক্তিগত কিংবা অ্যাকাডেমিক কোনও জীবনেই আর নতুন করে ঝুঁকি নেওয়ার জায়গায় নেই ও। বরং যে আলো-ঝিকমিক ভবিষ্যৎটাকে এই এতদিন পর খানিকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, তার কাছে পৌঁছতেই হবে ওকে। না পারলে পরে, মরেও শান্তি পাবে না।

-কী রে, কলকাতা কেমন লাগছে? অনেক নতুন ছেলের সঙ্গে ফুর্তি করছিস নাকি?

ফোনের ওপাশে শৌভিকের গলা।

সোমঋতা এত চমকে গিয়েছিল যে কথা বলতে পারল না প্রথমটা। তারপর গলাটাকে কঠিন করে জিজ্ঞেস করল, ফোন করেছ কেন?

-বা রে! ফোন করতে ইচ্ছে হয় তো মাঝেমধ্যে! আগে তবু দুর্গাপুরে থাকতি, ইচ্ছে হলে বাইকে চেপেও চলে যেতে পারতাম তোর কাছে। কিন্ত এখন কত দূরে তুই…

-আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে আজ তিন বছরের ওপর। দেখা করার বা কথা বলার তো কিছু নেই।

-স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি কাগজে সই করে দিলেই ঘুচে যায় নাকি? একটা টান থাকেই।

-না, থাকে না। আমার নেই। তুমি আর কোনওদিন ডিস্টার্ব করবে না আমায়।

-আমি ফোন করলে ডিস্টার্বড হোস। খুশি হোস কার ফোনে?

-কারও ফোনে না। আর যদি হইও সেটা জানার কোনও দরকার তোমার নেই।

-আছে রে আছে। আমি যে আবার বিয়ে করব তোকে। উইল রি-ম্যারি ইউ। বুঝলি? জোরে হেসে উঠল শৌভিক।

ওর সেই হাসিটা, বিস্ফোরণের মতো বাজতে লাগল সোমঋতার কানে। বিয়ে? ফের বিয়ে? তাও আবার শৌভিককেই?

সোমঋতার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।

পরিচয়ের পরপরই শৌভিক ক্ষেপে উঠেছিল সোমঋতাকে বিয়ে করার জন্য। প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা যে খুব খারাপ লাগত সোমঋতার তা নয়, কিন্ত যেদিন ওর জ্যাঠতুতো দাদার বাইকের পিছনে ওকে দেখতে পেয়ে হুলস্থুল বাধিয়ে দিল শৌভিক, সেদিন থেকে কীরকম যেন ভয় করতে লাগল সোমঋতার। মনে হতে লাগল, এই ছেলেটার সঙ্গে ও থাকতে পারবে না। কিন্ত ততদিনে ছিনে জোঁকের মতো শৌভিক এ্রঁটে বসেছে ওর গায়ে। তাও একদিন বিদ্রোহ করে উঠেছিল সোমঋতা। নিজের বাড়িতে আর শৌভিকের বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে এই বিয়েটা ও করতে পারবে না। আর বন্ধ করে দিয়েছিল শৌভিকের ফোন ধরা। কিন্ত দু’দিন না যেতেই শৌভিকের বাবা ফোন করে ওকে জানালেন যে, ছেলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে, এখন আইসিইউ-তে আছে। সোমঋতা আর স্থির থাকতে পারেনি, ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। সরে এসেছিল নিজের জেদ থেকে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ঠিক করেছিল, শৌভিককেই বিয়ে করবে।

সেই সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল ছিল তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। ছোটমামা যে আমেরিকায় থাকা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে সম্বন্ধ এনেছিল ওর সম্পর্ক ভেঙে গেছে শুনে, তার ছবিটা পর্যন্ত দেখেনি সোমঋতা, শৌভিক আইসিইউ’তে আছে খবর পেয়ে। কিন্তু যখন সেই শৌভিককেই পাড়ার এক বিধবা বউদির সঙ্গে নিজের বেডরুমে আবিষ্কার করল ও, আর আবিষ্কার করল এমন অবস্থায় যখন দু’জনের কারও গায়েই একটা সুতো নেই, তখন শুধু ঘুমের ওষুধ খেয়ে নয়, গায়ে কেরোসিন ঢেলে, গলায় দড়ি দিয়ে, ড্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করার হচ্ছে হল সোমঋতার।

সেই ইচ্ছেটাই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল ওকে, যতক্ষণ না শোভিকের বাবার মুখ থেকে শুনল যে শৌভিকের ওই আত্মহত্যার চেষ্টা, পুরোটাই নাটক। চেনা ডাক্তারকে ম্যানেজ করে নার্সিংহোমে তিনদিন ভর্তি হয়ে থাকা শুধু।

– কেন আমাকে এভাবে ঠকালে তোমরা? চিৎকার করে উঠেছিল সোমঋতা।

– তুই বা ওরকম ফুঁসে উঠেছিলি কেন? জানিস না, তেজি ঘোড়াকে বশ করতেই আমার

বেশি আনন্দ। সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল শৌভিক।

আর কাঁদতে থাকা সোমঋতাকে ব্যঙ্গ করে ওর শ্বশুর বলেছিলেন- তুই কেমন সুন্দরী,

নিজের শরীর দিয়ে বরকে বেঁধে রাখতে পারছিস না ?

একটা শরীরেই রূপান্তরিত হয়েছিল সোমঋতা। আর ওই বিধবা বউদিকেও ওর স্রেফ একটা শরীর বলেই মনে হত, কারণ দুটোকেই তো ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার করত শৌভিক। তবু একদিন রাতের অন্ধকারে শৌভিকের প্রবল চাহিদার মুখে পিষে যেতে যেতে সোমঋতা বলে উঠল- আগে যা করেছ, করেছ। এখন আর কোরো না। আমায় সব ভুলে বাঁচতে দাও।

পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে যেভাবে ‘তুই-তোকারি’ করত সেই একই গলায় শৌভিক বলে উঠল- তোর তো গর্ব হওয়া উচিত যে তোর বর একসঙ্গে দু’জনকে স্যাটিসফাই করতে পারছে। তাতে তোর কী অসুবিধে হচ্ছে, বল না? কোথায় কম পড়ছে তোর?

কোথায় কম পড়ছে সেটা বোঝা শৌভিকের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ ওর তো ‘মন’ বলে

পদার্থটাই ছিল না। কিন্তু যাদের আছে বলে ভেবেছিল তারাও কি তাদের মনের পরিচয় দিতে পারল?

ওর প্রাণের বন্ধু শেলি দুর্গাপুজোর অঞ্জলি দেবার সময় সোমঋতার হাত থেকে ফুল নিয়ে আবার ওকেই ফিরিয়ে দিয়েছিল। আর অবাক সোমঋতাকে হাসিমুখে বলেছিল, ঠাকুরমশাই-এর হাত থেকে ডাইরেক্ট ফুল নেওয়াই ভাল, বুঝলি? তোর হাত থেকে ফুল নিলে যদি তোর মতো ডিভোর্সি হয়ে যাই?

সোমঋতার হাতের ফুলগুলো পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। অঞ্জলি না দিয়েই ও ফিরে এসেছিল বাড়িতে। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। মা জড়িয়ে ধরে বসেছিল ওকে। বাবা উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করছিল। তখনই ছোটমামার ফোন এল। আর ফোনে সোমঋতার ঘটনাটা শুনে, মামা একটাই কথা বলল, তোর কাছে ব্যাপারটা যত সাঙ্ঘাতিকই হোক না কেন, অন্যের কাছে এটা একটা গল্প মাত্র। আর গল্প থেকে লোকে মজা নেবে না?

মামার ওই একটা কথা সোমঋতাকে ফিরিয়ে এনেছিল ট্র্যাকে। ওর নিজের দুর্ঘটনাটাকে ও কারও গল্প হতে দেয়নি। দেবে না বলেই, দুর্গাপুরের প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ানোর সময় শৌভিক ওর সঙ্গে রাস্তায় কথা বলতে এগিয়ে এলে একটা-দুটো কথা বলেছে যাতে লোকাল ছেলে হবার সুবাদে সিন-ক্রিয়েট করতে না পারে শয়তানটা।

কিন্ত কলকাতায় আসার পরও শৌভিকের নম্বরটা ব্লক করে দেয়নি কেন? ব্লক করলে ও অন্য নম্বর থেকে ফোন করে জ্বালাবে তাই? নাকি সোমঋতার মাথার মধ্যে সিদ্ধেশ এতটা জায়গা নিয়ে ফেলেছে যে শৌভিকের কথা আর মনেই পড়েনি তেমন করে?

কিন্ত আজকে শৌভিকের ফোনটা আসার সঙ্গে সঙ্গে ও ঠিক করে নিল যে এনাফ ইজ এনাফ। আর তখনই অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন এল ওর মোবাইলে। ভারী মিষ্টি গলার একটা মেয়ে বলল- নমস্কার, আমি অজপা, সিদ্ধেশদার কাছ থেকে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি। একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

– আমি আজকে ভীষণ ব্যস্ত আছি, এখন কথা বলাও সম্ভব নয়। সোমঋতা একটু কড়া গলায় বলল।

– সরি, আপনাকে ডিসটার্ব করলাম। আপনি কাইণ্ডলি পরে একটু জানাবেন, কবে যেতে পারি। অজপা বলল।

সোমঋতা রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না, এমন নরম গলা মেয়েটির। শুধু জিজ্ঞেস করল- কোনও বিশেষ প্রয়োজন আছে আমার সঙ্গে?

– একটা পোর্ট্রেট দেবার ছিল আপনাকে । অজপা বলল।

– সরি, আমি কোনও ছবি নিতে পারব না। বলেই ফোনটা কেটে দিল সোমঋতা। কিন্ত কাটার পরই মনে হতে লাগল মেয়েটাকে ডেকে এনে যদি সিদ্ধেশের আঁকা ওর ছবিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়তে পারত তাহলে কেমন হত? ওর ভাবনাটা দানা বাঁধার আগেই প্রায় ছুটতে ছুটতে ওর সামনে এসে হাঁপাতে লাগল সুহেনা।

কী হল রে? সোমঋতা জিজ্ঞেস করল।

দিল্লির বস-রা আসছে না। সুহেনা বলল।

– মানে? ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?

– তুই খবর জানিস না? পোস্তায় একটা বিরাট ব্রিজ, আই মিন ফ্লাইওভার, ভেঙে পড়েছে। প্রচুর লোক মারা গেছে। খবরটা পেয়েই ওরা আজকের ভিজিটটা ক্যানসেল করেছে। সুহেনা একটু দম নিল।

সোমঋতার মনে হল, ও অনেক দূর থেকে কথাগুলো শুনছে। ব্রিজ ভেঙেছে, মানুষ মারা গেছে, কী সাত্ঘাতিক ব্যাপার! কিন্ত যত সাঙ্ঘাতিকই হোক, সোমঋতার কাছে তো এই দুর্ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত একটা গল্পই। শেলির কাছে ওরটা যেমন ছিল। তাহলে আজকের এই পড়ে পাওয়া সময়টাকে ও কাজে লাগাবে নাই বা কেন?

ভাবতে ভাবতে অজপার নম্বরে রিংব্যাক করল সোমঋতা।

আর ওপাশ থেকে গলার আওয়াজ পেতেই জিজ্ঞেস করল- পোর্ট্রেটটা নিয়ে আপনি কখন আসতে পারবেন?

সিদ্ধেশের সঙ্গে সোমঋতার আলাপ হয়েছিল বইমেলায়। শ্রাবন্তীদি, ওর দুর্গাপুরের কলেজের কলিগ, সিদ্ধেশের ব্যাচমেট ছিল কলেজে। বইমেলায় আলাপ করিয়ে দেবার সময় শ্রাবন্তীদি বলেছিল- এই যে দেখে নিলো তোকে, এরপর বাড়ি ফিরেই সিদ্ধেশ তোর দুর্দান্ত একটা ছবি এঁকে দেবে।

– শ্রাবন্তীদি যতটা বলল, আপনি কি ততটাই ডেঞ্জারাস? সোমঋতা জিজ্ঞেস করেছিল মেলার মাঠেই।

সিদ্ধেশ তখনই কোনও জবাব দেয়নি। রাতে ফেসবুকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। তাতে লিখেছিল, আমি পোর্ট্রেট আঁকতে পারি না। সচরাচর পারি না।

‘সচরাচর’ শব্দটা কৌতূহল জাগিয়ে ছিল সোমঋতার। ও পালটা জানতে চেয়েছিল, কখন পারেন?

– যখন কাউকে খুব ভালবেসে ফেলি। জবাব দিয়েছিল সিদ্ধেশ।

– কতজনকে ভালবেসেছেন এতাবৎ? আই মিন ক’জনের পোর্ট্রেট এঁকেছেন?

– একশো জনের হবে।

– বাপ রে! মেলার মাঠে তার মানে একশো এক নম্বরের খোঁজে গিয়েছিলেন?

– খোঁজে গিয়েছিলাম বললে পুরোটা বলা হয় না। আমি বোধহয় পেয়েও গেছি।

– মানে?

উত্তরে আর কিছু লিখল না সিদ্ধেশ। একটা স্মাইলি পাঠাল শুধু।

ব্যাপারটা স্মাইলিতেই শেষ হয়ে যাওয়ার ছিল না বলেই হয়তো হাসি, কান্না, তর্ক, ঝগড়া সবকিছুই জন্ম নিতে থাকল আর সোমঋতা একসময় টের পেল যে নিজের অজান্তে ও সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সিদ্ধেশকে মিস করতে আরম্ভ  করেছে। নিজের একটা কথার উত্তরে সিদ্ধেশের তিন-চারটে লম্বা মেসেজ না পেলে ওর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। যা নয় তাই বলে দিচ্ছে । সেসব শুনে সিদ্ধেশ চুপ করে গেলে আবার অস্থির হয়ে নিজেই মেসেজ করছে ওকে। মেসেজ করছে টিফিন খেতে-খেতে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, এমনকি বাথরুমে গিয়েও। আর তারপরও উত্তর না এলে হোস্টেলে ওর ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে থাকছে রাত আড়াইটে-তিনটে পর্যন্ত। দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে, হাই তুলছে তবু ঘুমোতে পারছে না কিছুতেই। আর ঘুমোতে না পেরে শেষমেশ লিখে পাঠাচ্ছে, “তুমি মিথ্যুক! তুমি মোটেও তোমার একশো এক নম্বরকে খুঁজে পাওনি মেলার মাঠে। পেলে পরে আমাকে একবার আই লাভ ইউ না বলে চলে যেতে পারতে না।”

সিদ্ধেশ কোথাও চলে যায়নি, তাই ওই মেসেজটা যাওয়ার দু’মিনিটের মাথায় ফোন আসছে সোমঋতার কাছে আর ভোর তিনটে থেকে শুরু হয়ে সকাল ছ’টা অবধি কথা চলছে দু’জনের। কিন্ত সেই কথায় যত না বসন্তের পলাশ, তার চেয়ে বেশি শ্রাবণের মেঘ। দুর্গাপুরে সিদ্ধেশকে আসতে বারণ করেছিল সোমঋতা, শৌভিক বা ওর কোনও স্যাঙাত দেখে ফেলবে সেই আতঙ্কে, কিন্তু বর্ধমানে, ব্যান্ডেল বা কলকাতায় দেখা করতে এলেও নিজের অতীতটাকে সঙ্গে করেই নিয়ে আসত সোমঋতা। আর সেটা সিদ্ধেশের সঙ্গে শেয়ার করার সময় মুখ-চোখ লাল হয়ে যেত ওর।

-কুল ডাউন সোনা। তুমি এখন দুর্গাপুরে নেই। কলকাতায় আছ। সিদ্ধেশ ওকে বলল একদিন।

কিন্ত সোমঋতা কিছুতেই ভুলতে পারত না, বর্ধমানের গ্রামে ওদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই তন্ময়দের বাড়িতে, তন্ময়ের বন্ধু শৌভিকের বেড়াতে আসার কথা আর চলে যাওয়ার আগে কলেজ ফেরতা সোমঋতার ব্যাগের মধ্যে একটা চিঠি ভরে দেওয়ার ঘটনাটা। তার আগে একবারই ক্যাজুয়ালি কথা হয়েছিল শৌভিকের সঙ্গে, তন্ময়দের বাড়ি সত্যনারায়ণের পুজোয় গিয়ে।

শৌভিক যে ওকে লাইক করে সেটা তন্ময়ের মুখ থেকে জেনেও কোনও হেলদোল দেখায়নি সোমঋতা। কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরে ব্যাগ খুলেই চমকে ওঠে ও। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ ব্যাগের ভিতরে, বইখাতাতেও। মুহূর্তের মধ্যে সোমঋতা আবিষ্কার করে যে রক্ত দিয়ে ওকে চিঠি লিখেছে শৌভিক। তিন-চার লাইনেরই চিঠি, বানান ভুলও আছে। কিন্তু সবটাই রক্তে। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘তোমাকেই বিয়ে করব’ ইত্যাদি কথাগুলো কোনও রেখাপাত না করলেও ওই রক্তের ছোপগুলো মাথা ঘুরিয়ে দিল সোমঋতার। ও রাজি হয়ে গেল শৌভিকের প্রস্তাবে।

তোমার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো একই কাজ করতাম। কথাগুলো শুনে সিদ্ধেশ বলেছিল।

তোমার আগে আর কাউকে বলিনি জানো তো এই কথাটা। আমার মা-বাবা আজও অবাক হয়ে যায়, আমি আদৌ শৌভিকের মতো একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালাম কেন, ভেবে। আমি ওদের বলতে পারিনি। আর ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগের দিন ও আমার নাকে ঘুসি মেরেছিল। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল আমার। সেটা দেখে শৌভিক হাসতে হাসতে বলেছিল যে, ওই চিঠি লেখার রক্তের শোধ ও নিয়ে নিয়েছে। সোমঋতা কেঁদে ফেলল।

-এগুলো ভোলার চেষ্টা করো, প্লিজ। নইলে বাঁচতে পারবে না।

-বেঁচে তো আছি। চালিয়ে তো নিচ্ছি।

-এটাকে বেঁচে থাকা বলে না।

-কী বলে সেটা তোমার থেকে জানতে চাই না। রেগে গেল সোমঋতা।

-চলো বিয়ে করে নিই। সিদ্ধেশ বলল।

-আমি পারব না।

-কেন?

-জানি না। কিন্ত পারব না।

সেদিন ওকে দুর্গাপুরের ট্রেনে তুলে দেওয়ার আগে, অনেক আদর করল সিদ্ধেশ। ব্যাপারটা আকস্মিকভাবেই শুরু হল যখন ট্যাক্সির ভিতরে সিদ্ধেশের ডান হাতটা টেনে নিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখল সোমঋতা। ঘটনাটার প্রতিক্রিয়ায় সিদ্ধেশ বাঁ হাতটা সোমঋতার খোঁপায় রাখতেই ওর মুখটা চলে এল সিদ্ধেশের মুখের কাছে। তারপর চারটে ঠোঁট মিলেমিশে একটাই সত্তা হয়ে গেল; পৃথিবীর সব নদীকে শুষে নিল নিজের ভিতরে।

স্টেশনে ঢোকার মুখে সিদ্ধেশ জড়িয়ে ধরল সোমঋতাকে, বলল- আমরা নতুন করে শুরু করি চলো। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না আর। একটা মিনিটও না।

ছাড়ো, লোকজন দেখছে- বলে স্টেশনে ঢুকে গেল সোমঋতা আর রাতে সিদ্ধেশকে ফোন করে বলল, তুমি আসলে স্বার্থপর একটা লোক।

-কী বলছ?

-ঠিকই বলছি। তোমার জন্য নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে আমি টের পেয়েছি, তুমি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতেই পারো না। তাই আমার কথা উঠলেই খালি থামিয়ে দিতে চাও।

-ফর গডস সেক, আমায় এতটা ভুল বুঝো না প্লিজ। আমি শুধু চাই তুমি ওই বিষাক্ত দিনরাত্রিগুলো থেকে বেরিয়ে এসো। বাস্তবে তো বেরিয়েই এসেছ, এবার মন থেকেও ঝেড়ে ফেলো ওগুলোকে।

-তাহলেই তুমি বেশ একটা সুন্দরী, ফ্রেশ বউ পেয়ে যাও তাই না? কিন্ত শোনো, আমি যতদিন বাঁচব, ওই রক্ত আমার মাথার মধ্যে থাকবে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠবে।

-কিন্ত কেন?

-কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না। শুধু বলব, খেতে না পেয়ে তো কেউ পাগল হয় না। মানুষ পাগল হয় একটা অবসেসিভ ডিসঅর্ডার থেকে। এবার যার সেই ডিসঅর্ডারটা আছে তার কাছে তো সেটা তুচ্ছ নয়। সে ওটা নিয়েই বাঁচে কিংবা মরে। আমার ওটা আছে জেনেও আমায় ভালবাসতে পারবে ? আমি পাগল হয়ে গেলেও আমার সঙ্গেই থাকতে পারবে শেষদিন পর্যন্ত?

সিদ্ধেশ যে চেষ্টা করেছিল নিজের সর্বস্ব দিয়ে তা নিয়ে সোমঋতারও কোনও সংশয় নেই। ও নিজেও ভেবেছিল যে সিদ্ধেশের চেষ্টার সঙ্গে ওর মনের ইচ্ছা মিলে যাবে। বিশেষ করে যখন কলকাতার কাছাকাছি এই ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পেয়ে গেল। শৌভিক তো কনট্রাকটরি করত দুর্গাপুরে, সিদ্ধেশ সেখানে একটা সরকারি চাকরি করে, প্লাস অত ভাল ছবি আঁকে। সোমঋতার বাবা-মাও ওর মুখ থেকে শুনে, সিদ্ধেশকে দেখতে চাইলেন একবার।

– আসবে আমাদের গ্রামে? তোমাকে খেজুর রস খাওয়াব? সোমঋতা একদিন দেখা করতে এসে জানতে চাইল।

-যাব। কিন্ত যাওয়ার আগে ছোট্ট একটা কাজ সেরে যাব। বলে সিদ্ধেশ সেদিনই একরকম জোর করে সোমঋতাকে নিয়ে গেল এক ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে। সেখানে বসে সিদ্ধেশ যখন নোটিসের ফর্ম ফিল-আপ করছে, রেজিস্ট্রার ভদ্রলোক সোমঋতাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, আপনার আগের বিয়ের ডিভোর্সের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক আছে তো? সোমঋতা ওঁকে কোনও উত্তর না দিয়ে সিদ্ধেশকে জিজ্ঞেস করল, আমি যে ডিভোর্সি সেটা এই লোকটাকে জানানোর কোনও দরকার ছিল কি?

– যাতে কোনও লিগাল প্রবলেম না হয় তাই…

সোমঋতা সিদ্ধেশকে থামিয়ে দিল- মিথ্যে কথা। তুমি আসলে কখনই ভুলতে পারো না যে আমার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। আমি ভার্জিন নই।

– বিশ্বাস করো, এরকম কিছু নয়।

– এরকমই। তুমি শয়তান একটা, তুমি পিশাচ। বলতে বলতে বিয়ের নোটিসের ফর্মটা সিদ্ধেশের হাত থেকে টেনে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল সোমঋতা। ছিঁড়ে ফেলে যখন ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে দরজা দিয়ে, ওর কানে এল, ম্যারেজ রেজিস্ট্রার সিদ্ধেশকে জিজ্ঞেস করছেন- পাগল নাকি মেয়েটা? না আপনি ভাগিয়ে আনছিলেন ?

অজপার হাত থেকে পোর্ট্রেটটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলার আগের মুহূর্তে সেদিনের সব দৃশ্যগুলো ভেসে উঠল সোমঋতার চোখের সামনে। সিদ্ধেশ তারপরও ফোন করে গেছে, যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে গেছে, কিন্তু সোমঋতা নিজেকে ঘিরে যে দেয়ালটা তুলে দিয়েছে সেটা ভাঙতে পারেনি। সোমঋতা খুশিই হয়েছে তাতে। ও তো টের পেয়ে গিয়েছিল যে ওর মনের কয়েকটা জায়গা ভয়াবহভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, ও আর সাড়া দিতে পারবে না কারওর ডাকেই, তাহলে সিদ্ধেশকেই বা কেন শুধু শুধু আটকে রাখবে ও?

সিদ্ধেশ সরে যাক, কেবল যাওয়ার আগে সোমঋতার একটা পোর্ট্রেট এঁকে দিয়ে যাক। জীবনে সব হারিয়ে ফেলা সোমঋতা ওই ছবিটা হারাবে না। কিছুতেই না। অসতর্কভাবে সিদ্ধেশের কাছে এই একটা জিনিসই চেয়ে বসেছিল সোমঋতা। সিদ্ধেশের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পর।

সিদ্ধেশ সেটা শোনার পর থেকে আর ফোন করেনি।

আর আজ অন্য একটা মেয়েকে দিয়ে ফোন করিয়েছে ওকে, তারপর তার হাত দিয়েই পাঠিয়েছে ক্যানভাসে আঁকা, ‘সোমঋতা’কে। কী জানাতে চাইছে সিদ্ধেশ ওকে, আগের প্রেম ভুলে গিয়ে এই মেয়েটাকে নিয়ে ও সুখে আছে? এতে সোমঋতার কতটা অপমান হতে পারে, ভাবল না একবার? তাহলে সোমঋতাই বা ছবি ছিঁড়ে ফেলবে না কেন?

-আপনি প্লিজ আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর ছবিটা ছিঁড়বেন। অজপা অনুরোধ করল সোমঋতাকে।

– না। আমি এক্ষুনি ছবিটা ছিঁড়ব যাতে তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিদ্ধেশকে ছবির টুকরোগুলো নিয়ে গিয়ে দিতে পারো। ওর চালাকি আমি বুঝি না ভেবেছ?

– আপনি সত্যিই কিছু বোঝেননি। বাইরে গাড়িতে আমার হাজব্যান্ড ওয়েট করছে।

– তাহলে সিদ্ধেশ কোথায়?

– আধ ঘন্টা আগে লাস্ট ফোন করেছিলাম, আপনার কাছে আসছি জানিয়ে, তখন বলল যে মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে যাচ্ছে, রক্ত দিতে।

– রক্ত দেবে কেন?

– কত মানুষ আহত, এখনও কে জানে আরও কতজন চাপা পড়ে আছে ব্রিজের নীচে, তাদের বাঁচাবার জন্য রক্ত লাগবে না? অজপা বেরিয়ে যেতে যেতে বলল।

– রক্ত, রক্ত, সিদ্ধেশ রক্ত দিচ্ছে… স্বগতোক্তি করল সোমঋতা।

ততক্ষণে অজপা বেরিয়ে গেছে আর সোমঋতার হাতের টানে পোর্ট্রেটটাও ছিঁড়ে গেছে অনেকটা।

-কী ভাল এঁকেছে ছেলেটা। তুই ছিঁড়ে ফেললি? আমাকে দিয়ে দিতে পারতি, আমার ঘরে রাখতাম। রেগে গেল সুহেনা। সোমঋতা এই এতক্ষণে কাঁদতে পারল। সুহেনার কিউবিকলে বসে বলে উঠল- আমি ছিঁড়তে চাইনি, বিশ্বাস কর।

– ছিঁড়ে ফেলে বলছিস, ছিঁড়তে চাইনি। সুহেনা সোমঋতার হাত থেকে পোর্ট্রেটটা নিয়ে জোড়ার ব্যর্থ চেষ্টা শুরু করল।

– আমি তো ওরকমই। যা চাই না, ঠিক তাই করে ফেলি। কিন্তু সিদ্ধেশ কেন রক্ত দিতে গেল? অন্যের দুর্ঘটনা তাহলে ওর কাছে গল্প নয়? নিজেরও অ্যাক্সিডেন্ট?

– কী বকছিস বল তো তুই, পাগলের মতো?

সুহেনার কথার উত্তর না দিয়ে সোমঋতা বলল, আমায় একবার মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে যেতে হবে রে এক্ষুনি।

-কেন, তুইও রক্ত দিবি?

– দিতে পারি। রক্ত ব্যাপারটার সঙ্গে যে ভয় জড়িয়ে ছিল আমার মধ্যে, সিদ্ধেশ সেটা ভেঙে দিয়েছে আজ। কিন্ত আমি রক্ত দেবার জন্য নয়, ওর সঙ্গে একবার দেখা করবার জন্য মানিকতলা যেতে চাইছিলাম। হয়তো এখনও ওখানে আছে।

– গিয়ে কী বলবি ওকে? পোর্ট্রেটটা তো ছিঁড়ে ফেলেছিস? সুহেনা বলল।

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাথার চুলটা একটু ঠিক করে নিল সোমঋতা। তারপর ব্যাগ থেকে নিজের ছোট আয়নাটা বের করে মুখের সামনে ধরে বলল- একটা কথা জিজ্ঞেস করব সিদ্ধেশকে। আমাকে খুব ভালবেসে ও যে ছবিটা এ্রঁকেছিল, আমি ওকে খুব ভালবাসলে সেই ছবিটা আরও একবার ও আঁকতে পারবে?

আরও পড়ুন...