Categories
2022-sep kobita

সুরভী চট্টোপাধ্যায়

ক বি তা

সু র ভী  চ ট্টো পা ধ্যা য়

প্রকান্ড নিস্তব্ধতায়

নোনা জলে চাঁদ ভেসে ওঠে মৃতদেহের মতো

আমি বাঁচিয়ে রেখেছি কয়েকটি শব্দ দেউলের নৈবেদ্যে

মহাশূন্যের একটি কোটরে জীবন যোগাযোগহীন

প্রকান্ড নিস্তব্ধতায়

রাস্তা ছিনিয়ে নিয়েছে হাওয়ার কীট।

 

কল্পনার জঙ্গলে বৃষ্টি অভিশাপের মতো

আর লাল অঙ্গারে ভুলের মাশুল

শহুরে আস্তিনে কোবরার বেড়ে ওঠা ইটের পোশাকি আড্ডায়

আর চুপসে যায় ফানুস, টান ধরে ফুটপাতের মতো।

 

রাস্তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে গোটা দশেক অকেজ শব্দ

জীবাণুর মতো সাজিয়ে নিচ্ছে আমাদের হৃদয়।

 

একটি বারুদ জাহাজ

ভেতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটি বারুদ জাহাজ

মৌন আবহাওয়া

বীতশ্রদ্ধার ভরসায় স্পন্দিত হচ্ছে তাবৎ মূর্তিমান উপসর্গ

চোখের আগুন ছুঁড়বে এবার তন্থিচিতা।

 

পাট ধোয়া জলে দারিদ্র ভিজিয়ে নিয়েছে

আমাদের জন্ম

ভয় আর সংশয়— বেড়ে উঠছে একটি সভ্যতার গাছ

স্নেহের বইপত্র হারিয়ে গেছে আকালের ঝড়ে

ভাতের পাত্রে উজ্জীবিত হচ্ছে শূন্যতা

আর নরকের দেহে পুষ্টি।

 

মেঘের অচলায়তনে বৃষ্টিও দেউলিয়া

বিপর্যস্ত চরাচরে আর একটিও নৌকো নেই।

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep kobita

মীরা মুখোপাধ্যায়

ক বি তা

মী রা   মু খো পা ধ্যা য়

টয়লেট ফর আ ট্রান্সজেন্ডর

আমি দীপক,  সুইট সিক্সটিন   

নিজের সাথে কথা বলার সময় আমি নিজেকে 

দীপিকা বলে থাকি, সময় পেলেই আমি 

লুকিয়ে নিজেকে দেখি গোপন আয়নায়।

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি মেয়ে…

কেন কেউ বুঝতে চাইছো না, কেন বিরক্ত করছো!

 

কিন্তু  না… বাবা বলেছেন না, লোকে থুতু  দেবে

দিদি বলেছে একদম না

দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে…

মা কিছু বলে না, শুধু কাঁদে

 

তিনটে টয়লেট সামনে 

আমি চোখ কান বন্ধ করে

‘ফর মেল’ লেখা টয়লেটে ঢুকে পড়ি

 

শীতলপাটি

কি ভীষণ দুর্বহ এই বৈশাখের অপরাহ্নগুলো !

আগুন ঢালতে ঢালতে তেতে উঠেছে সৌর উনুন,

উনুনের নিচে বসে আধপোড়া মাদুরবিক্রেতা

অপার মমতা নিয়ে চেয়ে আছে তার

অবিক্রীত শীতলপাটিটার দিকে, ঘামভেজা

গামছায় মুছে নিচ্ছে  মিহি ধুলোবালি 

 

যারা এই পাটি বোনে আর যারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে

এ পাটি বিক্রি করে তারা কেউ কোনদিন 

শুয়েও দেখেনি এ পাটিতে

অথচ দিব্যি বলছে ‘ এ পাটিতে শুলে এ ছি

লাগবেনা বৌদি ‘

 

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep kobita

তথাগত দত্ত

ক বি তা

ত থা গ ত   দ ত্ত

খই

ফুটপাতে ল্যাপটা খেয়ে বসে আছে লোকটি 

রোদ এসে পড়েছে তার চুলে

এই সব কত দিনের স্নান না করা চুল, মাথা ভর্তি জটা, জটায় উকুন তার 

গায়ে নোংরা ছেঁড়া একটা জামা, লুঙ্গিটাও ছিঁড়ে গেছে;

                                                 কোনও রকমে পরে থাকা শুধু।

মুখ ভর্তি ময়লা দাড়ি গোঁফে মুখ তার দেখা যায় না আর!

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর ঝাঁকুনি দিয়ে সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল রোদ

তারপর সদ্য তৈরি হওয়া ছায়া খোদাই করে

সে বানাতে লাগল হারিয়ে যাওয়া তার সন্তানের মুখ।

বউটা তার মরেছে কবেই!

একটা মেয়েকে ভালোবেসে কুড়ি বাইশ বছরের তরুণ ছেলেটি

                                                    কোথায় হারাতে পারে?

লোকটি সূর্যের আলোতে খুঁজেছে তার হারানো সন্তানের মুখ

লোকটি চাঁদের অন্ধকারে খুঁজেছে তার হারানো সন্তানের মুখ।

কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে সে এসে দাঁড়াল বাস স্টপে

এখন অফিস যাওয়ার সময়, চারদিকে শুধু ভীষণ ব্যস্ততা

বাস স্টপে যাত্রী অনেক, লোকটি খাবার চায় যাত্রীদের কাছে—

মা, একটু খই কিনে দেবে, মা? তিনদিন কিছু খাইনি! বাবা, একটু খই কিনে দেবে?

এই ব্যস্ত সময়ে এসবে লোকে বিরক্ত হয় ; মহিলারা ভয় পায় খুব,

কামড়ে দেবে না তো!

তিন চার দিন কোথাও দেখা যায় না লোকটিকে

আজ দেখলাম রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে খই।

 

পাগল 

লোকটি রাতে শ্মশানে ঘুমোয়

আর দুপুর বেলাটা সে কাটিয়ে আসে কবরখানায়, গাছের ছায়ায়।

তার বাড়ি নেই, ঘর নেই, খাবারও জোটে না দুই বেলা।

তবে এ অঞ্চলে সে পরিচিত 

সবাই তাকে পাগল বলে জানে।

পাগলামি সে সত্যিই করে

জিভে আঙুল ঠেকিয়ে সেই আঙুল নিজের কপালে মুছে রাখে

নিজের ভাগ্যকে সে থুতু দেয় রোজ।

তখন বিকেল হতে যায়, কবরখানার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সে দেখল

অন্যদিনের মতো ফুল ফোটেনি আজ 

আজ গোরস্থানে ফুটেছে শুধু একটাই ফুল – একটাই শ্মশান চাঁপা!

সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ফুলটার দিকে, মুখে তার ফুটে উঠল হাসি

তারপর সে আনন্দে দু’হাত তুলে ছুটতে থাকল এদিক ওদিক 

যেন ধর্মান্ধ মানুষদেরকে সে করুণা করতে চায়।

একটু পরে স্বাভাবিক হয়ে সে আবার এসে দাঁড়াল ফুলটার সামনে।

তারপর সে ভেবে দেখল কিছুক্ষণ…

হয়তো সে সত্যিই পাগল কিন্তু ধর্মান্ধ নয়

এও তো অনেক কৃপা অদৃষ্টের!

এই প্রথম নিজেকে তার ভাগ্যবান মনে হল।

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep kobita

প্রদীপ চক্রবর্তী

ক বি তা

প্র দী প   চ ক্র ব র্তী

অন্ধ এমন কৃষ্ণচূড়া…  

এক

 

ম-ম ফুল কী দিশায় মাথা নাড়ে এমন অপলক

রিরংসাপৃথুল  ভারতের বুকে। দু’হাত চিৎশক্তি আমার সময় খোঁজে হালকা মধু যৌনতায় 

 

গাং জলে দ্যাখেন বাবুসকল। ত্রিনয়নে দেখতে পান,  অলক্ত-ভবার্ণবে রক্তের মশকে ভরা ফুলের প্রাণবায়ু কতখানি কম! 

 

সেই সূত্রে মনুষ্যবিহীন দেশে নির্বাসনে দেবে ধূসর হরপ্পার ছায়া। পরধর্মসেবীকে আরশিনগরে তুমি শয্যাসঙ্গী করে নেবে জানি 

 

তোমার চিত্রপ্রকরণ অধুনা বাজার তত্ত্বে অন্ধকারে পা বাড়ালে কলকল করে স্কুল, সবুজ চাঁদের দু-এক কুচি সাইকেলবিধি 

 

ধর্মঠাকুরের ধবল ঘোড়াটি সারল্যবর্জিত গ্রীবার অতিব্যবহারে শীর্ণ অবয়বসহ লাফায় না, নাচে না, ভয়ে পিছিয়ে আসে না। কেউ যদি অকিঞ্চিৎকর গোষ্ঠীকোন্দলে হয় দলছুট, প্রতিসাম্যে কষ্টার্জিত পরিহাসছলে যদি অনুভূতি হয় ফুলের ভ্রুণসম, 

 

অপূর্ণ-অভিমুখী…

 

রক্ত গোপন করে উচ্চাভিলাষী ব্যাধ। বাজারে কাঁচা মাংস বেচার ছলে কালকেতু ফুলের মুখমণ্ডলব্যাপী ছড়ায় ব্রণ…

 

 

দুই

 

কতদিন পর মায়াবী নাগকেশরের ক্লোনিং-এ ডানা মেলে দোল খাচ্ছে খ্যাপা ভূতেদের প্রতিরোধচক্র। মনুষ্য-ভূত নাকি সরীসৃপসম বেশুমার তৈলচিত্রে অবোধ বরাহ নন্দন! তুষারকুচি না কি  কুর্চিফুল ঝরছে তাদের মাথায় 

 

ফুলের কী যায় আসে গণ অভিধানে! 

 

এ জায়গা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বৌদ্ধ লামাদের গান 

 

অমানুষেরা মানুষের কথা ভাবছে রৌদ্রনিবিড় তালবনে 

 

যাদের কান্না পায় মৃদু যুক্তাক্ষরে, তরল  মহুয়ায়

 

সুতার লতালী ফাঁদে বছিরদ্দি কাকভোরে মাছ ধরিতে যায় 

 

এই বাংলার শহরতলীর মধ্যে তারও একটি শিশ্ন আছে, 

 

সেই তো আলো…  

 

 

তিন

 

সেই ফুলে ছায়া হয়, হতে পারে ফুলের তমসা। যার দু’দিকে দেবী ও ভাস্কর। এ পথ সরলরেখায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। কাজ সারা হাতের ধুলোয় বীতকাম গঠনশৈলী জানা যাবে, সেই পুরনো দিনের আশ্রমে কোন গুপ্তঘড়া তুমি পাতালে নামাও, মেঘের কাঞ্চন ফুঁড়ে। জল-বিভাজিকায় জলের ব্যাঙ, ঘাসের ফড়িং, ঝোপের  ঝিঁঝিঁ ফিরে আসছে কালচক্রে 

 

জলের কুহকে বুক থেকে ক্রমশ উপরে ওঠা আঁশবটির গন্ধ। দু’দিকে সরলরেখা মাঝখানে হাজামজা নদী সেঁচে কিছু মাছ লোহিত কণিকা।

 

জীবিকা নিশ্চিত নয় প্রত্যুষে জিজীবিষা। ভ্রূ-মধ্যস্থ গুপ্ত আঘাতেরা বড়ো পুচ্ছ নাড়িয়ে ময়ূর সাজে। নিম্ন যোনি বিশ্বরূপ। দাস-প্রণয়িনী অতঃপর বিক্রি হয়, স্বপ্ন বিজ্ঞাপন থেকে মুখ ফেরালো কে? 

 

শুধু বল্গা হাতে তুমি থাকো, আঁধার মিশকালো। অশ্ব পৃষ্ঠে  মিরপুরের দিকে। বিকেলের কলে জল পড়ে যাক, সারা পৃথিবীর শববাহকেরা নিঃসঙ্গ ট্রেনের হুইসল বাজাক  দূরে। আকাশের লাল উল্কি বাড়ি গাঁথছে। তোমার হিরণ্ময়, যার ডাকনাম হিংসুটে- হীরু, তার জন্য ঝুমুরে লতা ঘুরিয়ে শাড়ি পরেছ, কপালে কালো বনমরিচের টিপ…

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep goddyo

প্রচ্ছদ কাহিনী | সেপ্টেম্বর সংখ্যা

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

ত ন্ম য়  ভ ট্টা চা র্য

tanamy

বলিউড ও বাংলা কবিতা

‘পর্দার তারকাদের মুঠোয় পেয়ে এ কী করলেন কবিরা!’ কিংবা ‘বলিউডের সঙ্গে বাঙালি কবিদের গোপন আঁতাত, ফাঁস হল কুকীর্তি’— এ-জাতীয় হেডলাইন দিতে হাত নিশপিশ করছিল। বদলে দিয়ে বসলাম নিরামিষ্যি এক শিরোনাম। আর, লেখার উত্তেজনা অর্ধেক হয়ে গেল নিমেষেই। গোমড়ামুখো এক প্রবন্ধের দিকে এগিয়ে চলেছি আমি— না-আছে নিষিদ্ধ ইঙ্গিত, না-আছে গসিপের সুযোগ। কোথায় সেই স্ক্রিন-ঝলমলে হিন্দি সিনেমার তারকা-সমাবেশ, আর কোথায় আমাদের ‘দীন-দুঃখী ‘বাংলা কবিতা! এ-দুয়ের মধ্যে সিনেমার প্রোমোশন ছাড়া মোলাকাত হতে পারে, ভাবা শিবেরও অসাধ্য। কিন্তু, ঘটনাচক্রে, হয়েছে। আর সেইসব লুকিয়ে-থাকা তুরুপ চোখে যখন পড়েই গেছে, লেখার সুযোগ ছাড়ি কেন!

বলিউডের সঙ্গে বাংলা কবিতার সম্পর্ক! প্রথমেই ঠেক খেতে হয় এমন কথা ভেবে। কোনো হিন্দি সিনেমায় বাংলা কবিতার প্রয়োগ বা উল্লেখ আমার অন্তত চোখে পড়েনি। কিন্তু উল্টোদিকে উদাহরণের কমতি নেই। অর্থাৎ, বাংলা কবিতায় বারবার বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়েছে বলিউড। কখনও সিনেমা, কখনও গান। অবশ্য নায়ক-নায়িকাদের প্রসঙ্গই বেশি। এ-লেখাও সেই নায়ক-নায়িকাদের ঝলমলে হাজিরা নিয়েই। তবে একটা খামতি স্বীকার করে নেওয়া ভালো। বুক ফুলিয়ে ‘বাংলা কবিতা’ বললেও, শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কবিতাই উদাহরণ হিসেবে এসেছে এখানে। আসাম, ত্রিপুরা ধরা পড়েনি। নেই বাংলাদেশও। অবশ্য বাংলাদেশের কিছু কবিতায় বলিউডি নায়কদের উল্লেখ উঁকি দিচ্ছে স্মৃতিতে। সে-যাইহোক। এই লেখার ডেটাবেসও যে আহামরি, তা নয়। আমার সংগ্রহে থাকা কবিতাবইয়ের একটা অংশ একবেলায় নেড়েঘেঁটে যা-যা খুঁজে পেয়েছি, তা-ই সম্বল। এর বাইরেও নির্ঘাত রয়ে গেছে প্রচুর। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে বাংলা কবিতার সম্পর্কচরিত্র বুঝতে, এই লেখা-মানচিত্র নেহাত ফেলনা হবে না আশা করি।

শিল্পমাধ্যমগুলির পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদান কোনো নতুন কথা নয়। সিনেমা, নাটক, থিয়েটার বারবার পুষ্ট হয়েছে সাহিত্য থেকে। আবার, সাহিত্যও বিভিন্ন সময়ে উপাদান নিয়েছে অন্য মাধ্যমগুলো থেকে। আজও, কোনো সুন্দর সিনেমা-থিয়েটার-ছবি-ফটোগ্রাফি দেখে উচ্চারিত হয়— ‘কবিতার মতো!’ কী সেই ‘কবিতার মতো’-র ধর্ম? যাকে গদ্যে বা সহজবোধ্যতায় ব্যাখ্যা করা যায় না, গতানুগতিকের বাইরে রহস্যের আলোছায়া খেলে-যাওয়ার মুহূর্তগুলোই কি কবিতার মতো হয়ে ওঠে? মনে পড়ছে ‘হারানো সুর’-এর শেষ দৃশ্য। উত্তমকুমার কুয়াশাঘেরা পথ দিয়ে চিৎকার করে ছুটে চলেছেন— ‘রমা! রমা!’, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই ডাক, বিষণ্ন সুচিত্রা ঘাড় ফেরালেন একবার— ওই দৃশ্যসমষ্টি কি কবিতার মতো নয়? দেশ-বিদেশের সিনেমায় দৃশ্যায়নে কাব্যিক সৌন্দর্যের কমতি নেই। এ-আলোচনাও তা নিয়ে নয়। বরং মূল বিষয়ে ঢুকি।

বাংলা কবিতায় সিনেমার উপস্থিতি কীরকম? নেহাত নগণ্য নয়, বলাই বাহুল্য। শুধু সিনেমা নয়, যাত্রা, নাটক থিয়েটার ইত্যাদি প্রসঙ্গ, অভিনেতাদের নাম বারবার ফিরে-ফিরে এসেছে। গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনীর ‘থ্যাটার’ থেকে শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র পর্যন্ত উঁকি দিয়ে গেছেন বাংলা কবিতায়। মঞ্চ, মঞ্চায়ন, মঞ্চের আলো— সবই বিষয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কবির লেখায়। আর সিনেমার ক্ষেত্রে? পর্দা, সিনেমা হল, হলের ভেতরের অভিজ্ঞতা, নায়ক-নায়িকা, গান— সর্বোপরি, নস্টালজিয়া। বাংলা কবিতা সিনেমা দেখার স্মৃতিকে ধারণ করেছে সযত্নে। কত কবিতা গড়ে উঠেছে সিনেমাঋণ স্বীকার করেই। সিনেমার কোনো দৃশ্য বা ভাব কবির মনে অনুরণন তৈরি করেছে, সেই আবহ ঠেলে দিয়েছে কবিতা লেখার দিকে। হয়তো কোনো সিনেমার নামোল্লেখই নেই, অথচ কবিতার সর্বাঙ্গে গমগম করছে সিনেমা-অনুভূতি— এমন কবিতা চোখে পড়েছে প্রচুর। সিনেমা প্রচ্ছন্নে আরও কী কী কারুকার্য ঘটিয়েছে, তা বিস্তর গবেষণার বিষয়। আপাতত প্রত্যক্ষ উদাহরণগুলো দিয়েই শো শুরু করা যাক।

তবে, হিন্দি সিনেমায় যাওয়ার আগে, বঙ্গীয় সিনেমাজলে আচমন সারা কর্তব্য। আর, এ-কথা বলে না দিলেও চলে, বাংলা কবিতাতেও সিনেজগতের ‘গুরু’ একজনই— উত্তমকুমার। নায়ক-নায়িকাদের নামতালিকা করতে বসলে, সবচেয়ে বেশিবার উঠে আসবেন উত্তমই। মনে করুন অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য একফর্মাটির কথা— ‘ছায়াপুরুষের রক্তমাংস’— যে-বইয়ের প্রত্যেকটি কবিতাই গড়ে উঠেছে উত্তম-আবহে। নায়ক উত্তম ও সিনেমার প্রেক্ষিত বারবার অঙ্গাঙ্গী হয়ে যায় কবিতার সঙ্গে। ‘ল্যান্ডমার্ক গম্বুজকল, সামনে সুচিত্রা সেলুন/—এখানে উত্তমরূপে চুল কাটা হয়’, ‘টেবিল চাপড়ে লোকটা বলছিল/টু দা টপ… টপ… টপ…,/অথচ আমরা শুধু টপ-টপ-টপ করে/কী যেন পতনের শব্দ শুনলাম সারাজীবন?’, ‘আমাদের সপ্তপদী ছিল,/আমাদের জতুগৃহ নেই’— উত্তমে জারিত এইসব কবিতা আমাদের ভাষার সম্পদ। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী দেবী, সুপ্রিয়া চৌধুরী প্রমুখের নামও। উঠে এসেছে কলকাতার সিনেমা হলগুলি। বাংলা কবিতার সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ক নিয়ে বলতে গেলে, আমি সবার প্রথমে রাখব এই ক্ষীণতনু পুস্তিকাটিকেই।

আর দ্বিতীয়ে? সে-ও এক আস্ত কবিতার বই, তবে শুধু উত্তমকে নিয়ে নয়। কৌশিক বাজারীর ‘ম্যাটিনিতে, রূপকথা টকীজে’। ‘পথের পাঁচালী’-র অপু-দুর্গার প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সপ্তপদী’র কৃষ্ণেন্দু-রীনা ব্রাউন, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, সন্ধ্যা রায়, অপর্ণা সেন, কঙ্কনা সেনশর্মা— একের পর এক কবিতায় ঢুকে পড়েছে এই নামগুলো। সিনেমার ডায়লগও হয়ে উঠেছে কবিতাপঙক্তি। ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’, ‘একবার বলো, উত্তমকুমার!’, ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’— কিংবদন্তি হয়ে-যাওয়া ডায়লগ ঠাঁই পাচ্ছে কবিতায়। কৌশিক লিখছেন, ‘প্রজাপতি চোর সেই পাহাড়ী সান্যালের গল্প মনে পড়ে?’ লিখছেন, ‘সন্ধ্যা রায়ের মতো চোখ তুলে কেঁদে ফেলচ বিরতির আগে’। তবে গুরু সেই একজনই, উত্তমকুমার। গোটা বইয়েই ফিরে-ফিরে এসেছেন বারবার।

উত্তম-সৌমিত্রের আবহমান তর্ক ধরা পড়ে সম্বিত বসুর এই ছোট্ট কবিতায়— ‘একরকমভাবে সিগারেট না খেয়ে/নানারকমভাবে খেলে বোঝা যায়/উত্তমকুমার আর সৌমিত্র/দুজনের মধ্যে তুলনা চলে না’। শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘এন্টনী ফিরিঙ্গি-তে আমি উত্তমকুমার’-এর তিনটে টুকরোতেই মহানায়কের সগৌরব উপস্থিতি। শিবাশিস লিখেছেন— ‘আমি উত্তমকুমার আর পাশের মেয়েটি তনুজা,/তারপর শেষদিকে এসে যখন চোখে জল এসে গেছে আমাদের/তখন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মনে হয়েছিল/আমি এন্টনী আর মেয়েটি বুঝি নিরুপমা।’ অন্যদিকে, পিনাকী ঠাকুর লেখেন— ‘বেকারের ভালোবাসা উত্তম সুচিত্রা শেষে/ফিরিবার গাড়িভাড়া চায়!’ পিনাকীরই আরেকটি কবিতার লাইন— ‘চুরুট টানেন নাকি? কমল মিত্রের মতো ড্রেসিং গাউনও…?/—মানে সিনেমার মতো? বেশ লাগে সুচিত্রা-উত্তম!’ রণজিৎ দাশের কলমেও বাদ পড়েননি তাঁরা। ‘শুধু আকাশের দুটি দীপ-জ্বলা তারা/উত্তম যুবকটিকে নীরবে পাহারা দেয়/সুচিত্রা সেনের দুটি চোখের মায়ায়!’ অন্য একটি বইয়ে, অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় লিখছেন— ‘সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে এল/উত্তমকুমারের মতো একফালি চাঁদ।’ সেই কবিতার শেষে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন জীবেন বসুও।

উত্তম-ঘোর থেকে বেরোই। বাংলা কবিতা ও বাংলা সিনেমার বন্ধুত্বে উঁকি মারলে, পথের পাঁচালী ফিরে-ফিরে আসবে বারবার। আসবেন ঋত্বিক ঘটকও। এই দুয়েরই উদাহরণ রয়েছে কৌশিক বাজারীর পূর্বোল্লেখিত বইটিতে। এছাড়াও, দেশভাগের ইঙ্গিতবাহী কবিতায় ঋত্বিক-প্রসঙ্গ ও তাঁর সিনেমায় অভিনীত চরিত্রদের নাম দেখা যায়। রাণা রায়চৌধুরী লিখছেন— ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর চরাচর দেখে যখন বেরলাম/তখন আমার গা ভর্তি পাখি’। সুজিত দাসের কবিতায় দেখি “মৃণাল সেনের কোরাস সিনেমা থেকে উঠে আসবে জনগণ, খিদেপেটে চিৎকার করবে ‘তিরিশ হাজার’, ‘তিরিশ হাজার’।” আঙ্গিক পত্রিকার ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ সংখ্যা’য় ঋতুপর্ণকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন কবিতার উপস্থিতি। এইসব ক্ষেত্রে সিনেমা বা নায়ক নয়, পরিচালকই হয়ে উঠেছেন কবিতার মুখ্য চরিত্র।

তবে, হেঁহেঁ, অন্যান্য উদাহরণ যতই উঠে আসুক, বাংলা কবিতা ও বাংলা সিনেজগতের সম্পর্ক প্রবলভাবে উত্তম-নিয়ন্ত্রিত। বাকিরাও আছেন, কিন্তু গুরুর সামনে ফিকে সকলেই।

বলিউডে ঢোকার আগে, বিদেশের সিনেমায় একবার উঁকি দেব নাকি? সংখ্যায় কম হলেও, কিছু চিহ্ন খুঁজে তো পেয়েইছি! এই যেমন কৌশিক বাজারীর বইতেই, ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’, ‘দ্য টিনড্রাম’, ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ শীর্ষক কবিতা দেখতে পাচ্ছি। সিনেমা দেখার পরের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে লেখা কবিতাগুলো। আরেক কবিতায় দেখা যায় ইরানিয়ান পরিচালক মজিদ মজিদির নাম। তবে, এই জাতীয় কবিতার শিকড় সিনেমায় প্রোথিত হলেও, নিজস্ব গুণ নিয়েই বেড়ে উঠেছে কবিতাগুলি। যেমন অরিত্র চ্যাটার্জির বই ‘সার্কিস পারজানিয়ার ডাইরি’। সার্কিস পারজানিয়া একজন রাশিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক। অরিত্র-র কবিতার প্রচ্ছন্নে বারবার ছায়া ফেলেছে সার্কিসের সিনেমার প্রভাব। বইয়ের নামকরণেও সেহেতু ঠাঁই পেয়েছেন পরিচালক।

অন্যদিকে হলিউডের সিনেমার নায়িকারা রীতিমতো রাজত্ব করেছেন কবিমনে। রণজিৎ দাশ লেখেন— ‘মেরিলিন মনরো-র উড়ন্ত স্কার্টের মতো জ্যোৎস্না ছড়ায়/নির্জন চৌরঙ্গি জুড়ে, মধ্যরাতে, গঙ্গার ঘূর্ণি হাওয়ায়’। সুদীপ চক্রবর্তীর ‘সোফিয়া লরেনের আয়না’ শীর্ষক কবিতায় দেখতে পাই— ‘পর্দায় ভাসছে জেমস বন্ড, এই বন্দুক ছুঁড়ছে/পরক্ষণেই নায়িকা-কে নিয়ে শুচ্ছে’। শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় ঢুকে পড়ছে জুরাসিক পার্ক— ‘ডায়নোসরের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল সিনেমার হলে।’ ‘বেসিক ইনস্টিংক্ট’ শীর্ষক কবিতায় শিবাশিস লেখেন— ‘শ্যারন স্টোন যখন ঝরিয়ে ফেললেন তাঁর মেঘমালা তখন তাঁর শরীর একটা ঝকঝকে আকাশ।’ আবার অন্য একটি কবিতায় শিবাশিসই লিখছেন— ‘রঙবেরঙের স্টিমার বলল যাত্রী হোন/নীল যমুনায় ঝাঁপ দিয়েছেন শ্যারন স্টোন!’ সুজিত সরকারের কবিতায় পাই “স্টিভ ম্যাকুইনস আর ডাস্টিন হফম্যানের ‘প্যাপিলন’-এর কথা।” অংশুমান করের একটি কবিতার নাম ‘জেনিফার লোপেজ’— ‘আমি জানি, জেনিফার, আপনিই শ্বাসকষ্ট—/মধ্যরাত, পাহাড়ের খাত।’ জুলিয়া রবার্টস অংশুমানের কবিতায় ধরা দেন এভাবে— ‘স্বপ্নে আজ জুলিয়া রবার্টস্‌/বহুদিন পড়ে তাই প্রেম হল ভীষণ শরীরী।’ দীপংকর দাশগুপ্তের কাছে অবশ্য হলিউডের নায়িকাদের চেয়ে প্রাধান্য পান নিজের ঘরের মানুষটিই। ‘বোকা বলেই অসংকোচে বলতে পারি/মনরো কিংবা টেইলরের চেয়ে/ঘরের গিন্নি সহজপাচ্য/এবং ভারি উপকারী।’

বিদেশি সিনেমার প্রসঙ্গে যখন কথা হচ্ছেই, অন্য ‘সিনেমা’র দিকে কি একবার উঁকিও দেব না? ব্লু ফিল্ম? তার নায়িকাদের উল্লেখও বাংলা কবিতায় বিরল নয়। মেসবাড়ির অভিজ্ঞতা-প্রসঙ্গে মনোজ দে— ‘সেসব অদ্ভুত দিন/ওহ্‌ ইয়েস লবি, পাওলি দাম, সানি লিওন কলোনি ইত্যাদি ইত্যাদি।’ প্রসঙ্গত, পাওলি দামের যে-ক্লিপিংসের প্রেক্ষিত এই কবিতায়, তা কিন্তু মোটেই নীলছবি নয়, একটি সিনেমারই দৃশ্য। মনোজ যেখানে পর্নস্টার হিসেবে সানি লিওনের পক্ষে, সেখানে সুস্নাত চৌধুরী আবার ঝুঁকছেন মিয়া খলিফার দিকে। ‘মিয়া খলিফা ও একটি আনফিট বালক’ শীর্ষক কবিতা তিনি শুরু করছেন এভাবে— ‘একটি পাতলা, আনফিট বালক আর কীই-বা করতে পারে,/যদি ভারাক্রান্ত স্তন দুলিয়ে তুমি রবীন্দ্রসংগীত শুরু কর!’

দীর্ঘ অপেক্ষা ও ভণিতার পর, এবার বলিউডে প্রবেশের পালা। মুম্বাইয়ের ঝাঁ-চকচকে সিনেমা ও নায়ক-নায়িকাদের লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজ বাঙালি কবিদের টেনেছে বারবার। কখনও নিজের কথা প্রসঙ্গে, কখনো-বা চরিত্রের মুখ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সেসব। শুধু নায়ক-নায়িকাই কেন! সিনেমার গায়করাও উঁকি দিয়েছেন বারবার। বাংলার ক্ষেত্রে যেমন পাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে-র নাম, বলিউডে তেমনই কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, শচীন দেববর্মণ, আরডি বর্মণের নাম ধরা পড়েছে বাংলা কবিতায়। কখনও আবার গানের লাইনও উঠে এসেছে পঙক্তি হয়ে। ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা’, ‘সাথী রে তেরে বিনা ভি কেয়া জিনা’, ‘মেরা গীত অমর কর্‌ দো’— এইসব গানের লাইন আশ্রয় পেয়েছে বাংলা কবিতায়। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ঘোরতামস দৃশ্যের প্রেক্ষিতে নিয়ে আসেন জনপ্রিয় হিন্দি গানের লাইন— ‘বাচ্চার চিতার কাছে/রুপোর খাঁড়ারা ওঠে, গর্ভগর্ত, নড়ে জিহ্মজিভ,/উরুব্যাদানের পল্লী, কঁহি ধুঁয়া য়ঁহা নাচেনাচে//আউয়া আউয়া।” আবার, দুজন কবির কবিতায় একই লাইন দুভাবে ধরা পড়েছে— উদাহরণ আছে এমনও। শ্রীজাত যেখানে সরাসরি গানের লাইনই উদ্ধৃত করেছেন— ‘এক অকেলি ছত্রি মেঁ যব আধে-আধে ভিগ রহে থে’, কস্তুরী সেন সেখানে এই লাইনই হাজির করেছেন কিঞ্চিৎ অন্যভাবে— ‘এক আকেলি ছতরি মেঁ/সব আধে আধে ভেজাই গোড়ার কথা!’ কবিতার ভেতরেই শুধু নয়, কবিতার শিরোনাম হিসেবেও উঠে এসেছে গানের লাইন বা সিনেমার নাম— বাংলা বা হিন্দি সব ক্ষেত্রেই।

কবিতাগুলো পড়তে-পড়তে ভাবছিলাম, বাংলা কবিতায় হিন্দি চলচ্চিত্রজগতের এত রমরমা কেন। সামাজিক ইতিহাসই দিয়ে দিল উত্তর। মোটামুটি সাতের দশক থেকেই পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে হিন্দি সিনেমার প্রভাব বাড়তে শুরু করে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিন্দি ভাষার। কবিতাতেও দেখতে পাব, যে-যে নায়ক-নায়িকার নাম উঠে আসছে, তাঁদের অনেকেরই উত্থান সাতের দশকে। মোটামুটি সাত থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত হিন্দি সিনেমা দাপিয়ে রাজত্ব করেছে বাংলা কবিতাজগতে। নয়ের দশকের বিশ্বায়ন ও সেইসঙ্গে ঘরে-ঘরে টেলিভিশনের ঢুকে-পড়ার প্রভাব এক্ষেত্রে অসীম। একদিকে যেমন সিনেমাহলে গিয়ে নায়ক-নায়িকাদের রংচঙে জীবনের স্বাদ নেওয়া, অন্যদিকে ঘরে টিভির সামনে আরও নিবিড়ভাবে পাওয়া তাঁদের। আর, কে না জানে, বিনোদনমাধ্যম হিসেবে বাণিজ্যিক সিনেমার গুরুত্ব কতটা! দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা থেকে পালিয়ে সিনেমার রানিং টাইম দর্শকদের সামনে হাজির করে এক মায়াজগত। দর্শকরা তাতে হাসেন, কাঁদেন, হল থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরেন নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে নিয়েই। রাতে ঘুমের মধ্যে পান সেলিব্রিটি-স্পর্শ। এই দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন কবিরাও। ফলে, তাঁদের লেখাতেও যে সেই স্বপ্নপুরীর বাসিন্দারা হানা দেবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! কখনও আবার অবদমিত যৌনতাও প্রকাশ পেয়েছে বইকি! পর্দার নায়ক-নায়িকাদের মনে-মনে কামনা করেন অনেকেই। ‘বামন হয়ে চাঁদ ধরা’র চেষ্টা স্বপ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করে মনে। প্রকাশ পায় কবিতা হিসেবে। বাস্তবের না-মেটা যৌন খিদে সিনেমার অভিনেতাদের দিয়ে যদি তৃপ্ত হয়, তাতেই শান্তি। অন্তত মন ভুলিয়ে রাখা তো যায়!

আমার পড়া কবিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র নায়ক দিলীপকুমার। অন্যদিকে, কবি যিনি, আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, দিলীপকুমারের রাজপাটের অনেক পরের সময়ের। তারপরও আকাশের কবিতায় মুদির দোকানে সেঁটে থাকে দিলীপসাবের পোস্টার, বা হয়তো টিভিতে চলতে থাকে সিনেমা। আকাশ লেখেন— ‘মুদির দোকান থেকে উঁকি মারে দিলীপকুমার’। পাণ্ডুলিপি পড়ার সুবাদে ব্যক্তিগতভাবে জানি, দিলীপসাবের জায়গায় আগে ওই পঙক্তিতে ছিলেন ‘বুড়ো দেবানন্দ’। প্রোডিউসাররা যেমন এক নায়ককে কাঁচি করে অন্য নায়ককে সিনেমায় নিয়ে আসে, আকাশও তেমনি দেবানন্দকে সরিয়ে দিলীপকুমারকে এনেছেন কবিতায়। কেন, কে জানে!

হিন্দি সিনেমার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত কিছু প্রেক্ষিতও চোখ এড়ায় না। পিনাকী ঠাকুর লিখছেন— “আড়াই ঘণ্টায় রঙিন মিথ্যের/’বলাকা’ গরিবের সস্তা বোম্বাই!” ‘বলাকা’ একটি সিনেমাহলের নাম। রণজিৎ দাশের একটি কবিতা, নাম ‘প্রথম ম্যাটিনি শো’, ধরে রেখেছে দুই যুবক-যুবতীর সিনেমাহলের অন্ধকারে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি। সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় দেখা দেয় সিনেমাকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও পরাবাস্তবের সেই যাতায়াতই— ‘আমরা মেলায় যাব, আমরা দেখব সব লালনীল হিন্দি সিনেমা/আমাদের জারজ মহব্বত পথে পথে সাদা খইয়ের মতো ওড়ে’। ‘মহব্বত’ কি এখানে শুধুই ভালোবাসার হিন্দি অনুবাদ? অমিতাভ-শাহরুখ অভিনীত সিনেমাটিও কি উঁকি দিচ্ছে না?

এরপর যে কবিতাগুলোয় আসব, সেগুলো পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, কবিরা বুঝি কাস্টিং ডিরেক্টর। কাকে কোন কবিতায় পার্ট দেবেন, তা একান্ত তাঁদেরই সিদ্ধান্ত। আগে থেকে অনুমান করা মুশকিল। এই যেমন যশোধরা রায়চৌধুরী লিখছেন— ‘দিদি আর আমি চুপি চুপি স্কুল পালিয়ে/নুন-শো মেরেছি সিনেমা পাড়ায়: দুজনেই/নানা পাটেকারে মজেছি একটা সময়ে/একটা সময়ে সানি দেওলেও মজেছি’। এখানে নানা পাটেকর আর সানি দেওলের জায়গায় অন্য-কেউও হতে পারতেন। কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে রোল পেয়ে গেলেন এই দুজন। শিবাশিস মুখোপাধ্যায় আবার সলমন খান ও মাধুরী দীক্ষিতের পক্ষপাতী। ‘ছেলেটি অ-মাধ্যমিক, কয়লা দেয়, মেয়েটির ইংরেজি অনার্স,/হয়তো তারা প্রেমই করে কিংবা স্রেফ সলমন-মাধুরী’। এই অসম প্রেমের প্লট কতশত সিনেমার ভিত্তি, তার ইয়ত্তা নেই। এবার ভিত্তি হয়ে উঠল বাংলা কবিতারও। মহরতে সলমন-মাধুরী।

সুজিত সরকারের কবিতায় দেখতে পাই জেনারেশন গ্যাপের চিহ্ন। মেয়ে যখন হাল আমলের নায়ক-নায়িকাদের কথা বলছে, কবি ফিরে যাচ্ছেন ছয়-সাতের দশকে। “বাড়ি ফিরে রাত্তিরে/মেয়ের সঙ্গে গল্প করি।/ও আমাকে বলে/হৃত্বিক রোশনের নতুন ছবির কথা,/ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের নতুন ছবির কথা,/টিভি সিরিয়ালের কথা।/আমি ওকে বলি/ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে/বাড়িতে কাউকে না বলে/বন্ধুদের সঙ্গে/উত্তম-অপর্ণার ‘এখানে পিঞ্জর’ দেখার কথা”।

যশোধরা রায়চৌধুরীর সানি দেওল খানিক অন্যভাবে উঠে আসছেন অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়। ‘তার বৃদ্ধা মা-কে বলে গেছ/জরুর আসবে ফির্‌, আগলে টাইম/সানি দেওলের মত… মেঘমুক্ত, পরিবারসহ’। এক লরিচালকের কথা বোঝাতে, তার ফিরে আসা বোঝাতে ব্যবহৃত হল সানি দেওলের ‘পৌরুষ’-এর ইমেজারি। ফেরা যদি হয়ই, সানি দেওলের মতো হোক! এদিকে, সঞ্জয় মৌলিক জীবনের নায়ক-নায়িকাদের কথা বলতে গিয়ে নস্যাৎ করছেন বড়োপর্দার জাদুকরদের— ‘না, মাধুরী দীক্ষিত আমার কাছে সত্যিকারের নায়িকা নন।/কেট উইন্সলেট কিংবা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি আরও আরও নন।’ একই ফর্মুলায় তাঁর কাছে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছেন প্রসেনজিৎ, শাহরুখ খান।

সেলিম মণ্ডল বাবার মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন সলমন খান-কে। কেন-না, চোখের সমস্যায় বাবা কালো চশমা পরেছেন চোখে। সেলিম লিখছেন— “সানগ্লাস পরে বাবাকে মনে হচ্ছে সালমান খান/ছোটবেলায় নিজেকে বহুবার সালমান খান করে তোলার চেষ্টা করেছি…/খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে আজ সল্লুভাই বলে ডাকতে/কিন্তু বাবাকে কি ‘ভাই’ ডাকা যায়?” কবিতার নাম ‘সল্লুভাই’। এই সলমনের কিন্তু বয়স নেই। তিনি নয়ের দশকের হতে পারেন, আবার এখনকারও। সানগ্লাস পরে নিজেদের নায়ক ভাবার হাস্যকর দিন কাটিয়েছি কমবেশি আমরা সবাই। কেউ সলমন খান, কেউ শাহরুখ। পর্দার নায়কদের কেন্দ্র করে সেই ছোটো-ছোটো অনুভূতিগুলোই ধরা পড়ছে বাংলা কবিতায়।

আর-সব নায়িকাকে ছেড়ে, প্রশান্ত মল্ল বেছে নিচ্ছেন বঙ্গতনয়া বিপাশা বসুকে। ‘হাঁস যেমন হাঁসির গলা চুলকে প্রস্তাব দেয়/ঠিক সেইভাবে বিপাশা বসুকে প্রস্তাব দিলাম/এক দাম্পত্য বছর সাঁতার কেটে/তুমি আমি সুখঃসুখের ভারতবর্ষ দেখব।’ ওঁদের নিভৃতে ছেড়ে আমরা বরং আরেক নায়িকার প্রতি নজর দিই। সুস্মিতা সেন। বাঙালি কবিদের এত কেন প্রিয় তিনি? আভিজাত্যের জন্য, চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য নাকি বাঙালি হওয়ার জন্য? তিন-চারজনের কবিতায় ঘুরে-ফিরে আসতে দেখেছি সুস্মিতাকে। গদ্যকার স্মরণজিৎ চক্রবর্তী অনিয়মিত হলেও কবিতা লেখেন। তাঁর একটি কবিতাতেই দেখি— ‘ভেজা পোস্টারে সুস্মিতা সেন অফিসের থেকে দিদি ফিরছেন’। একটি দৃশ্য। একটিই দৃশ্য। আর তাতেই সুস্মিতা কেমন ঘরের মেয়ে হয়ে গেলেন। আর এ-জন্যেই বুঝি আপন মনে করে অভাব-অভিযোগ-নালিশও সুস্মিতার কাছেই জানাচ্ছেন কবিরা। সোহেল ইসলামের বক্তব্য— ‘সুস্মিতা সেন আমি কখনও কোনো ন্যাংটো শ্বেতাঙ্গ দেখিনি’। এরপরে অভিযোগ ও যৌন-অবদমনের আলোছায়া খেলা করছে কবিতায়। ‘শুনেছি আপনার নাভিতে অনেক বকুল, বকুলের গন্ধ/ওখানে একটা জায়গা করে দেবেন? ভালোবাসার নামে ব্যবহার করব না’। সুবোধ সরকারের কণ্ঠে আবার সুস্মিতার প্রতি অভিমান— ‘যে দিন ম্যানিলায় সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স হল/সুস্মিতা, অভিনন্দন আপনাকে/আপনার পরিবারের সবার জন্য শুভেচ্ছা/এত নিষ্পাপ আপনার হাসি, এই দুঃখের/এত নিষ্পাপ হল কী করে?/কিন্তু আপনি এ কী বললেন?/একটা মেয়ের পূর্ণতা মাতৃত্বে? সে তার সন্তানকে অন্যদের ভালোবাসতে শেখায়।’ ঘরোয়া দৃশ্য হোক, কামনা বা নালিশ— সুস্মিতা সেন সবদিক দিয়েই আশ্রয় হয়ে উঠেছেন বাঙালি কবিদের।

কৌশিক বাজারী আবার স্মিতা পাতিলের মধ্যে আবহমানের আশ্রয় খোঁজেন। ‘স্মিতা পাতিলের ভূমিকায় বৌটির মুখ/জলজ আঁধারের দিকে ডুবে যায়’ কিংবা ‘স্মিতা পাতিলের মুখ জেগে ওঠে গ্রামীণভারতে’ তারই প্রমাণ। শ্রীজাত জুটি হিসেবে উল্লেখ করেন জিতেন্দ্র-রিনা রায় আর নাসির-শাবানার। এদিকে স্মরণজিৎ টুইঙ্কল খান্নার অনুরাগী। ‘টুইঙ্কেল খান্নাকে দেখতে খুব ভালো লাগত আমার।/তবু দেখতাম রাস্তায় পোস্টারে/কে জানে তার ঠোঁটের কাছের কাগজ ছিঁড়ে নিয়েছে/কালো কালি দিয়ে এঁকে রেখেছে গোঁফ’। ঠোঁটের কাছের কাগজ ছেঁড়া কেন? হতে পারে কোনো বিকৃতকাম মানুষের কীর্তি। আর ছবিতে কালি দিয়ে গোঁফ আঁকা— নায়িকাদের পুরুষালি করে মনে-মনে হাসা— ছেলেবেলায় এমন কে না করেছে! তবে স্মরণজিতের আফশোস কবিতা বেয়ে শেষ হয় এখানে— ‘অক্ষয়কুমারকে বিয়ে করে টুইঙ্কেল খান্না সিনেমা করাই ছেড়ে দিল।’ স্মরণজিৎ যা-ই বলুন, এক সাক্ষাৎকারে টুইঙ্কল নিজেই পরবর্তীকালে বলেছেন, অভিনয় করতে পারেন না তিনি। সিনেমা ছেড়ে বেঁচেছেন। স্মরণজিতের আফশোস, না আমাদের স্বস্তি— কাকে প্রাধান্য দেব!

ওয়েব সিরিজের বয়স এক দশকও পেরোয়নি। ফলে, কবিতায় তার হাজিরা খুঁজতে যাওয়া খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতোই। তবে, ইতিমধ্যেই জনমানসে ওয়েব সিরিজ যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ওয়েব সিরিজ বাংলা কবিতায় ঠাঁই পেলে আশ্চর্য হব না। এই তো, অলৌকিকভাবেই, সম্প্রতি-প্রকাশিত এক পত্রিকায় পেয়ে গেলাম ‘মির্জাপুর’-এর একটি চরিত্র নিয়ে কবিতাপঙক্তি। কবি সুজিত দাস। তিনি লিখছেন— ‘এখনও পঙ্কজ ত্রিপাঠির ভালো দাঁড়ায় না বলে মির্জাপুরে কাট্টার রমরমা। পাইপগান, পাইপগান।’ বাংলা কবিতায় ওয়েব সিরিজের অনুপ্রবেশ বোধহয় এই প্রথম।

আবার বড়োপর্দায় ফিরি। হিন্দি সিনেমার কথা চলছে, আর বিগ-বি আসবেন না, তা কি হয়! বাংলা কবিতাতেও পড়েছে তাঁর দীর্ঘ ছায়া। ‘জামাই আদর’ বলা যেতে পারে কি? জয় গোস্বামী তাঁর ছোটোদের জন্য লেখা একটি কবিতায় লিখেছেন— ‘ইতিমধ্যেই দরজায় বেল/খুলতেই দেখি, কী কাণ্ড! আরে!/মুম্বই থেকে আমারই জন্য/বিগ-বি স্বয়ং এসেছেন দ্বারে!/কাবেরী বলল, কী সৌভাগ্য/আমি আপনার নিদারুণ ফ্যান!/বিগ-বি বলেন, আমাকে দেখিয়ে—/এঁর সামনে যে কী লজ্জা দেন!’ তবে জয়ের কবিতা ছোটোদের জন্যে হলেও, অন্যদের প্রেমের কবিতাতেও শাহেনশার উদার সহাবস্থান। মিলন চট্টোপাধ্যায় লেখেন— ‘নই রাজ-নার্গিস, হলাম না অমিতাভ-রেখা/তবু এই প্রেমটুকু/সিলসিলা থেকে টুকে শেখা’। সিনেমার পর্দা কীভাবে ব্যক্তিগত প্রেমসম্পর্কেও ছাপ ফেলছে, এর উদাহরণ আমরা দেখেছি আগেও। মিলনের কবিতা সেই ধারারই সংযোজন। এবং অবশ্যই জুটি হিসেবে রাজ কাপুরের সঙ্গে নার্গিস ও অমিতাভের সঙ্গে রেখার উপস্থিতি। জুটি ছাড়া কি প্রেম জমে! সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তম-প্রেমই বা কই!

শ্রীজাত-র কবিতাতেও উঠে এসেছে ‘সিলসিলা’ সিনেমার প্রসঙ্গ। ‘নিজেকে যে আজ বড় সিলসিলার অমিতাভ লাগে/তোমার হাতযশ চোপড়া চলেছে সবার আগে আগে/কে রেখা কে জয়া তাও বুঝতে পারছি না…’। এই কবিতাতেই উল্লেখ পাই সঞ্জীবকুমারেরও। তবে, অমিতাভ বচ্চন কি এখানেই ফুরিয়ে যাবেন? তাহলে কীসের শাহেনশা তিনি! এই তো, কৌশিক বাজারী এক পথশিশুর কথা লিখছেন— ‘দুরন্ত পোস্টার দেখে নিজেকে বচ্চনের ছোটোবেলা ভাবে’, ‘পোস্টারে দুঃখী দুঃখী বচ্চনের মুখ/সেলিমের সংলাপ বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে—/মেরে পাশ মা হ্যায়— মেরে পাশ মা হ্যায়’। সিনেমাকে কেন্দ্র করে আসমুদ্রহিমাচলের এক অলঙ্ঘ্যনীয় ঘটনা উঠে এসেছে কৌশিকের এই কবিতায়, তা হল— অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিশমা। তিনি যেন কলিযুগে ঈশ্বরের প্রতিভূ, সমস্ত দুরাত্মাকে খতম করে, অভাবের সঙ্গে লড়াই করে, প্রেমে বিজয়ী হয়ে, নীতির সঙ্গে আপোস না করে সদাবিরাজমান। বচ্চনের ক্ষয় নেই, বচ্চন অবিনাশী। বড়োপর্দার সম্মোহনের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ অমিতাভ বচ্চন। দশকের পর দশক ধরে কত লোক যে শুধুমাত্র তাঁকে দেখবে বলে মুম্বইয়ে ভিড় করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। সর্বস্তরের মানুষের কাছে যে একজন মানুষ আশাবাদের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, অমিতাভ বচ্চন প্রমাণ করে দিয়েছেন তা।

সর্বস্তরের এবং সব বয়সের। নইলে দু-হাজার সালের জাতক, অতিতরুণ কবি পল্লবের কবিতাতেও বচ্চন-ক্যারিশমা এমন উজ্জ্বল থাকত না। পল্লব লেখেন— ‘তুমি দোমড়ানো এক কিতাব/আমি মৃত্যুপথেই যুদ্ধরত, শোলের অমিতাভ।’ বাংলা কবিতা অমিতাভ বচ্চনকে যেভাবে জায়গা দিয়েছে, তাতে তাঁর জনপ্রিয়তাই প্রমাণিত হয় আবারও। কবিরাও এড়িয়ে যেতে পারেননি তাঁকে।

তবে হ্যাঁ, বচ্চন একা নন। আরেকজন আছেন, যিনি বাংলা কবিতার আঙিনায় তাঁকে টক্কর দিতে পারেন। অবশ্য অমিতাভের মতো ‘ত্রাতা’র ইমেজ তাঁর নেই। তবে যা আছে, তা হয়তো অমিতাভ বচ্চনও তৈরি করতে পারেননি। ‘প্রেমিক’। কে এই মানুষটি?

শাহরুখ খান। তিনিও হাসান, তিনিও কাঁদান। সেইসঙ্গে, ভালোবাসায় ভাসান। যে-কারণে ‘প্রেম শিখতে হলে শাহরুখ খানের কাছ থেকে’— এমন একটা মিথও ঘুরে বেড়ায় চারপাশে। তাঁর সেই সম্মোহনী শক্তিকে এড়াতে পারেনি বাংলা কবিতাও। নব্বইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত তিনি হাসি দিয়ে মাত করে চলেছেন দর্শকদের, কবিদেরও। আর, ঘরের লোক ভেবে কবিরাও দিল-উজাড় ভালোবেসেছে তাঁকে। যে-কারণে মিতুল দত্ত লিখে ফেলেন— ‘শারুখখানের সঙ্গে বোঝাপড়া বাকি আছে/ও কেন আমার মুখে মুতে দিয়ে আনবাড়ি গেল!’ মনে পড়ে যায় রাধার অভিমান— ‘আমার বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়া’। শাহরুখ কি ‘কলির কেষ্ট’? পর্দার নায়কের ওপর এমন মান করতে পারে কেউ? নিজের মান ভাঙতে উদ্যোগী হয় নিজেই? এই তো, মিতুল লিখছেন, ওই কবিতাতেই— ‘শারুখের সঙ্গে আমি পাবলিক টয়লেটে ঢুকে পড়ি/রাগটাগ জল হয়ে যায়’। যেখানেই তুমি যাও হে সখা, আমি যাব পিছে-পিছে। ভালো যখন বাসিয়েছ, ছাড়ান নেই আর।

এই শাহরুখ-সম্মোহনের আরেক নজির পাই রূপক চক্রবর্তীর ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ শীর্ষক কবিতায়। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ইভিনিং শো-এ তিন বোন হলে গেছে সিনেমা দেখতে। ব্ল্যাকে কেটেছে টিকিট। দেখতে দেখতে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় দমবন্ধ হয়ে আসছে তিনজনেরই। কেন? ‘কখন কাজলকে ছেড়ে আমাদের দিকে হাত বাড়াবে শাহরুখ খান।’ পর্দার নায়ককে নিজের সঙ্গী হিসেবে কল্পনা করা, কিংবা নিজেকেই পর্দার নায়িকা ভাবা— সিনেমা যুগে-যুগে এ-কাজ করেই চলেছে। কিন্তু ঘোর ও ঈর্ষা কোন পর্যায়ে গেলে কাজলকে ছেড়ে দর্শক নিজের দিকে হাত বাড়ানোর কথা বলে? আমি নিশ্চিত, ওই তিন বোন বাড়ি ফিরে রাতে নিজের-নিজের মতো করে শাহরুখকে পেয়েছিলেন। পরদিন সকালে চুলোচুলি হয়নি তাঁদের?

আবার, কখনও কবিতায় নামোল্লেখ না-হলেও, ঘোরতর উপস্থিত শাহরুখ। কেন-না কবিতার নাম, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’। কবি জয়াশিস ঘোষ। “পৃথিবীর শেষ স্টেশনে বসে আছে মেয়েটা/ট্রেনের প্রতীক্ষায়/বাবা মুঠো খুলে দিয়েছে/’যা, জি লে আপনি জিন্দেগি’।” পাঠক, এই কবিতার ভেতরে কি কিংবদন্তি-হয়ে-যাওয়া ম্যান্ডোলিনের সুর শুনতে পাচ্ছেন? সর্ষেক্ষেত? ছেড়ে-যাওয়া ট্রেন ও ছুটন্ত নায়িকার দিকে নায়কের হাত বাড়িয়ে দেওয়া? ওই বাড়িয়ে-দেওয়া হাত ধরেছে বাংলা কবিতাও। উঠে পড়েছে ট্রেনে। কেন-না, ‘কিং খান’কে ফেরানো যায় না।

জয় গোস্বামীর কবিতায়, এক যুবক, পরিচিত একটি মেয়েকে বলছে— ‘চল নবীনা হলে/সন্দেবেলা শারুক খানের বই দেখতে যাই!’ কবিতার নাম ‘বাজিগর’। মেয়েটি নিম্নমধ্যবিত্ত, রিফিউজি পরিবারের। বাড়ি-বাড়ি কর্মসহায়িকার কাজ করে উপার্জন। সেদিন বিকেলে কাজ নেই। অতএব প্রস্তাব, দেখতে চল্‌ শাহরুখের সিনেমা। প্রচ্ছন্নে প্রেম ঘনীভূত হওয়ার দুরুদুরু-আকাঙ্ক্ষা। কেন-না পর্দায় যিনি থাকবেন, তিনি পাষাণেরও মন গলিয়ে দেন। মেয়েটির মন গলবে না! আবার, এর ঠিক বিপরীতে, পৌরুষের প্রতীক হয়ে আসছেন শাহরুখ। অবদমিত যৌনতার প্রতীক। প্রিয় মানুষটি যেন শাহরুখের মতো হয়। পঙ্কজ চক্রবর্তীর কবিতায় সেই আভাস। ‘হলুদ বই পড়ে না দাঁড়ালে তুমি বল শাহরুখ হতে। হবে না থ্রি-এক্স, হার্ডকোর চাই।’

গত পাঁচ দশকের হিন্দি সিনেমার দুই স্তম্ভ অমিতাভ বচ্চন ও শাহরুখ খান। বাংলা কবিতায় দুজনেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। নিজের-নিজের মতো করে প্রভাব ফেলেছেন কবিদের মনে। কবিরা, সেই প্রভাব সঞ্চালিত করে দিয়েছেন পাঠকের মনে। এই বাস্তুতন্ত্রের মূলে কী?

বিনোদন, বিনোদন আর বিনোদন। সুপারহিট সিনেমার প্রভাব কখন চুঁইয়ে-চুঁইয়ে এসে পড়েছে বাংলা কবিতাতেও। আর আমি ভাবছি, সিনেমার মতো কবিতাও তো এক শিল্পমাধ্যম, এর গতি তাহলে এত শ্লথ কেন! উত্তরও সেই একই— ‘বিনোদন’। কবিতা অন্যকে বিনোদন দেওয়ার জন্য জন্ম নেয় না। এই সততাই কবিতার পুঁজি। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাব, যে-সব কবিতায় বলিউডি প্রসঙ্গ এসেছে, সেগুলির অধিকাংশই উঁচু-তারে বাঁধা। সিনেমার লাউডনেস খানিক ছাপ ফেলেছে কবিতাতেও। তা অবশ্য হতেই হত, কেন-না অন্তর্মুখী বা সংকেত-নির্ভর কবিতায় নায়ক-নায়িকাদের নাম খাপ খাওয়ানো খানিক কঠিনই। যা লার্জার দ্যান লাইফ, তা ধরার জন্য কবিতাকেও লার্জ না-হোক, কয়েক চুমুক অন্তত দিতেই হত।

এসব তত্ত্বকথা অবশ্য লিখতে হয় বলে লেখা। আমি আসলে মনে-মনে ভাবছি, ঐশ্বর্য রাই-এর নাম খুঁজে পেলাম না একবারও! গুরু দত্ত কিংবা রাজেশ খান্নার না-থাকা তাও আমসি-মুখে মেনে নিতে রাজি, কিন্তু ঐশ্বর্য রাই! এ-ব্যথা কারেই-বা বোঝাব আর! (দীর্ঘশ্বাস)

গ্রন্থঋণ

আবার প্রথম থেকে পড়ো – যশোধরা রায়চৌধুরী, প্রেমের সাইজ বত্রিশ – সুদীপ চক্রবর্তী, বিয়োগ শেখার স্কুল – সম্বিত বসু, ধুলোয় ঢাকা প্রচ্ছদ – সঞ্জয় মৌলিক, এখানে নিয়ম তৈরি করে প্রলেতারিয়েত – মনোজ দে, ন্যুড স্টাডি – পিনাকী ঠাকুর, ধানখেতে বৃষ্টির কবিতা – রণজিৎ দাশ, শ্রেষ্ঠ কবিতা – শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, শ্রেষ্ঠ কবিতা – পিনাকী ঠাকুর, অজানায় শুরু, না-জানায় শেষ – সুজিত সরকার, একটি অল্পবয়সী ঘুম – রাণা রায়চচৌধুরী, জিনসেং অরণ্যের গাথা – অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়, গুজবে কান দেবেন – সুজিত দাস, আহারলিপি – সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, সরে দাঁড়ালেন লেন্ডল – অংশুমান কর, ধীরে, বলো অকস্মাৎ – কস্তুরী সেন, তথ্যচিত্র – কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, ছোটোগল্প – সুস্নাত চৌধুরী, রাত্রি চতুর্দশী – পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, শীত তারা বিভূষিতা – দীপ্তপ্রকাশ চক্রবর্তী, বাচস্পতিপাড়া রোড – অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, মায়াজন্ম – সেলিম মণ্ডল, মাকাল ঠাকুর – প্রশান্ত মল্ল, রাজনীতি করবেন না – সুবোধ সরকার, আব্বাচরিত – সোহেল ইসলাম, পরিগন্ধের শহর – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, হুলোরা টুলের পাশে – জয় গোস্বামী, দোয়াতে যুবতী চাঁদ – মিলন চট্টোপাধ্যায়, সেই কালো ছেলেটা – দীপংকর দাশগুপ্ত, ছোটদের চিড়িয়াখানা – শ্রীজাত, কবিতা ও একটি মেয়ে – পল্লব, অকালবৈশাখী – শ্রীজাত, ম্যাটিনিতে রূপকথা টকীজে – কৌশিক বাজারী, পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, ছায়াপুরুষের রক্তমাংস – অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, আমাদের কালোসাম্যগান – মিতুল দত্ত, যখন মহাভারত লিখছিলাম – রূপক চক্রবর্তী, নির্বাচিত কবিতা – জয়াশিস ঘোষ, জগৎবাড়ি – জয় গোস্বামী, লালার বিগ্রহ – পঙ্কজ চক্রবর্তী, ‘হ্যালো টেস্টিং বাংলা কবিতা’ শারদ সংখ্যা ১৪২৯

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep uponyas

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা । পর্ব ৪

উ প ন্যা স । পর্ব ৪

ম ল য়   রা য় চৌ ধু রী র

জাদুবাস্তব উপন্যাস

malay_roy_choudhury

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা

(গত সংখ্যার পর)

জগদীশ আর অমরিন্দর প্রথমে গররাজি থাকলেও, নেতি, তোকে ওনারা ডানার আড়ালে নিয়েছিলেন, তা তুই স্বীকার করিস  কিনা জানি না।

    আমি ব্যানার্জির বলে-দেয়া অ্যাকাউন্টে প্রতিবছরের শুরুতে টাকা জমে করে দিয়েছি, আজও করি। ওরা যে অ্যামাউন্ট বলে, জমা করে দিই। বারবার নতুন অ্যাকাউন্ট খোলে, বড্ড মনে রাখার ঝামেলা। তুই অ্যাডাল্ট হলে তোর নামে খুলবে হয়ত, কিন্তু তখন তো তুই স্বাবলম্বী। আমাকে কি বিদায় করে দিবি স্বাবলম্বী হলে?

    এনজিওকে সাহায্যের রিবেট পায় আয়করে, তাই ব্যানার্জিও মেনে নিয়েছিল বন্দোবস্তটা।

    ব্যানার্জিকে স্হানীয় অভিভাবকই শুধু নয়, ওদের পদবীটাও আমি তোর নামে জুড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি তো ব্রাহ্মণ নই, জানি অব্রাহ্মণদের নিয়ে কেমন ঠেলাঠেলি চলে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে।

    আমার পদবি তো প্রধান, প্রভঞ্জন প্রধান। গুজরাতি, কর্নাটকি, মারাঠিদের মধ্যেও প্রধান পদবি আছে।

    আমি তোকে বাঙালি করে তুলতে চেয়েছি; তাতেও তোর চাপা অস্বস্তির কথা অমরিন্দর জানিয়েছিলেন একবার। তখনও পর্যন্ত তুই জানতিস না যে তোকে কলকাতা শহরের এক আঁস্তাকুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিল তোর মা। যখন জানলি তখন তোর গোঁসা গিয়ে পড়ল পশ্চিমবাংলার ওপর।

     বৈদেহী আর আরিয়ানের চরিত্রে, শুনেছি, বাঙালি হয়ে ওঠার গোঁ, সব দ্রুত সেরে ফেলতে হবে, শিখে ফেলতে হবে, ক্লাস ফাইভ থেকে, গান, নাচ, বইপড়া, শাড়ি, নলেন গুড়, ছানার মুড়কি, পলাশ ফুল, মাছরাঙা, শুঁটকি মাছ, রাধাবল্লভি, পান্তুয়া-লুচি, ভাপা ইলিশ, সরস্বতী পুজো, বলেছিল অমরিন্দর।

     পদবি ব্যাপারটা কত গুরুত্বপূর্ণ তা তোকে স্পনসর করতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম।

     আঁস্তাকুড় তো পদবি দিতে পারে না, নাম দিতে পারে না, জন্মদিনও দিতে পারে না।

 

                ব্যানার্জি, বন্দ্যোপাধ্যায়, চ্যাটার্জি, চট্টোপাধ্যায়, মুখার্জি, মুখোপাধ্যায়, গাঙ্গুলি, গঙ্গোপাধ্যায়।

                কারা তুলে নিয়ে যাবে পথপার্শে পড়ে থাকা কয়েকদিনের বাসি লাশ?

                মৃতদেহে পোকা? মৃতের দেহ থেকে তাহলে প্রাণও জন্মায়, অবাক অবাক হও।

                শ্মশানে কাদের হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে চলে যেতে চাও!

                শকুন, পদবি বলো, কাদের মাংসপিণ্ড অসীম আকাশে গিয়ে খাও।

 

       তুই বেশ পরে সুস্পষ্টভাবে জানতে পেরেছিলি, যে তোকে ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছিল কলকাতার যাদবপুর থানার পুলিশ, ভোররাত থেকে যারা বাঁশদ্রোণী বাজারের সামনে বাঁধাকপির সবুজ পাহাড় গড়ে তোলে, একের পর এক দূরপাল্লার ট্রাক থেকে, তখনই ওরা তোর কান্না শুনতে পেয়েছিল।

      এত জায়গা থাকতে ডাস্টবিনেই কেন? তুই বার বার নিজেকে আর তোর অভিভাবকদের প্রশ্ন করেছিস, শুনেছি। তারাই বা এর উত্তর কী করে দেবে। হয়ত তোর মা চেয়েছিলেন যে তুই বেঁচে থাক, বাজারের সামনে ভোর রাত থেকেই সবজির ট্রাক আসে একের পর এক।

       তোর মায়ের হয়তো আশা ছিল যে ট্রাকচালদের কেউ যদি সন্তানহীন হয়, সে তোকে কোলে তুলে নেবে। নেয়নি রে, নেয়নি। ওরা কাছের ক্লাবের ছেলেদের খবর দিলে, তারা থানায়, আর থানা তুলে নিয়ে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে, নয়তো তুই সত্যিই মরে যেতিস।

       হাসপাতাল থেকে সমাজসেবীদের চ্যানেল হয়ে এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড এনজিওতে পৌঁছোলি ; আরও বহু পরিত্যক্ত শিশুদের একজন।

       সংবাদপত্রে তোর ওই সময়ের যে ফোটো বেরিয়েছিল, তা আমার সংগ্রহে আছে ; হলুদ হয়ে গেছে, ভাঁজে-ভাঁজে ছিঁড়ে গেছে, কতোবার যে দেখেছি। তোর এখনকার মুখের সঙ্গে একেবারে মেলে না, ভাগ্যিস মেলে না।

       তোর চোখমুখ, এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড দপতরে, ওই বয়সেই এমন আকর্ষক মনে হয়েছিল যে চব্বিশটা শিশুর মধ্যে থেকে তোকেই স্পনসর করার জন্য বেছে নিয়েছিলাম আমি।

 

        বাঁশদ্রোণী বাজার  যে  কোথায় স্পষ্ট করে বলতে পারেনি পরিচিত বাঙালি অফিসাররা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা যেতে পড়ে, বলেছিল কেউ। কলকাতায় গিয়ে, জিপিএস নিয়ে, পৌঁছেছিলাম। আঁস্তাকুড় বা ডাস্টবিন বলা উচিত হবে না; জায়গাটা আসলে ভ্যাট, সারাদিনের বাতিল পচাগলা শাক-সবজি আর মাছের আঁশ-পোঁটা ওখানে ফেলা হয়, হয়তো সবজির নরম সবুজ পাতার ওপরে শুয়েছিলি, হেমন্তের রাতে।

       বাজারের ভেতরে গিয়ে দীর্ঘদেহী কোনো বিক্রেতাকে দেখিনি, সবজিঅলারা অধিকাংশই মুসলমান,  চাষি পরিবারের।

       অন্য কোনো এলাকা থেকে তোকে এনে ওখানে ফেলে গিয়ে থাকবে তোর মা কিংবা বাবা, যাতে সহজে তাদের  খুঁজে পাওয়া না যায়।

       আঁস্তাকুড়ের প্রসঙ্গ উঠলেই তুই বিব্রত হতিস, তোর মনে হতো সারা গায়ে নোংরা, কখনও উৎসাহ প্রকাশ করিসনি জায়গাটা দেখে আসার, শুনেছি। বরং বিরক্ত হতিস প্রসঙ্গটা উঠলে।

       জগদীশ বলেছিল আমাকে, ক্লাস সেভেন থেকে পড়াশুনার শেষ ধাপ পর্যন্ত তুই প্রতিবছরের ডায়রিতে একটা বাক্য অবশ্যই লিখেছিস, “আই নো সামবডি ওনস মি, বাট হি ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” তোর সেই সব ডায়রির ওই পাতাটা ছিঁড়ে আমাকে দিয়েছে অমরিন্দর।  

       শেষে, বাঁশদ্রোণী বাজার তুই গেলি দেখতে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে।  যৌবনের শীর্ষে তখন তুই, আঁস্তাকুড়ের কথা শুনলেই যার সারা গায়ে র‌্যাশ বেরোতো ? শুনেছি,  অমরিন্দরের মুখে।

  

দুই

    ইলেকট্রিক ? এরকম নাম হয় নাকি !

    তাই তো বললেন।

     অনুমান করিনি তুই কখনও আমার শান্তি ইনভেড করবি, এইভাবে, হাতে লাল সুটকেস, কাঁধে হলুদ ব্যাগ, ফেডেড জিন্স, লাল ঢিলেঢালা টপ কিংবা জার্সি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি মনে হল, তার ওপর শাদা ব্লেজার, পায়ে সাতরঙা ফ্ল্যাপার, ডান হাতে গোটা পাঁচেক স্লোগানচুড়ি, কানে চুড়ির মাপের লাল রঙের মাকড়ি, হাতের আর পায়ের নখে ব্রাউন-লাল নখপালিশ, হাতের নখ ততো বড়ো নয়, পোশাক অত্যন্ত দামি, আঁচ করতে পেরেছিলাম, ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া চুল। অথই আলগা চটক, অথই।

     দেখছি দেখছি দেখছি দেখছি দেখছি দেখছি ; সন্মোহনকে অনুবাদ করা নির্বাক দৃষ্টি; আজ দশটা বেজে তিন মিনিটে সময় কিছুক্ষণের জন্য স্হির, অবিচল, পৃথিবী শুরু হল, রাতে  ঘুমিয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না, ধুনুরিরা কি আমাকে পিটিয়ে মেঘ করে উড়িয়ে দিয়েছে !

      তুই ছাড়া আর কে-ই বা এভাবে শান্তিভঙ্গ করতে চলে আসবে নিজের বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ?

      দুই হাতে মেহেন্দির নকশা !

      মেহেন্দি ? কেন ? প্রশ্নের উদ্বেগে আক্রান্ত হল মস্তিষ্ক ; মরুভূমির বালিতে মাকড়সাপায়ে আঁকা মানচিত্র।

      তুই তো চাকরি নিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলি, নিঃশব্দে নিজেকে বললাম, নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম শুনে, যাক, সেটল হলি, আমার মিশন সাকসেসফুল, ভাবছিলাম, ভাবছিলাম, ভাবছিলাম, তোকে দেখতে দেখতে, তোকে দেখে যে চিনতে পারিনি তা বলব না, চিনতে পারার আক্রমণে বিপর্যস্ত, সেই ক্লাস টুয়েলভের পর তোর ফোটো দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ঝলকানি, ঝলকানি, ঝলকানি।

       কেবল স্বপ্নে যেটুকু আবছা ঢেউ।

       আমার সমান ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছিস।

       আমি স্তব্ধ হতবাক থ দেখে তুই বলে উঠলি, ঠিকই বলেছে তোমার পিওন না অর্ডারলি, হোয়াটএভার, আমি এলেকট্রা, মহাকাব্যের নায়িকা, কবিকল্পনার মেয়ে।

       মগজের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটল, এলেকট্রা, কবিকল্পনার নায়িকা, অপার্থিব, রহস্যময় ?

       একটা শব্দের ভেতরে কতটা বারুদ যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা আমিই জানি। নিজেকে বললাম, হ্যাঁ, স্বপ্নের ভেতরে তোকে, যার পালক পিতা আমি, যাকে তুই বলেছিস ফাউনডিং ফাদার, পেয়েছি, এলকট্রার মতনই নিষিদ্ধ সম্পর্ক পাতিয়েছি।

               সেই সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা দিতে এলি নাকি, মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না, গলা শুকিয়ে গেছে।

 

      আমার চাঞ্চল্য গোপন করতে গিয়ে প্রবল আবেগে আপ্লুত হলাম, টের পাচ্ছিলাম যে প্রতিক্রয়ার বিস্ফোরণ ঘটছে নিঃশব্দে, তোকে ঘিরে তেজোময়তার দুর্নিবার জ্যোতি, তুই এই মুহূর্তে যদি না আসতিস তাহলে আমি পচনে ধ্বসে পড়তাম – এরকম মনে হল, বাসনার , চকিত দ্যুতি দিয়ে আমাকে নতুন দৃষ্টি দিলি তুই, এতদিন পর্যন্ত আমি বন্দি ছিলাম ফালতু জাগতিক জীবনে, তুই মুক্ত করে ছড়িয়ে দিলি মঙ্গলময় লিবিডোর গোপন রঙ্গ। উচ্ছ্বাস।

      এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

      যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

       ইতি, তুমি, আমার মুখ দিয়ে এইটুকই বিস্ময় ক্ষরিত হয়েছিল, সন্তর্পনে, নিয়ন্ত্রিত শ্বাসে।

       কান থেকে ইয়ার-প্লাগ বের করে বললি, ইতি, এখন ইতি, নেতি নাম রেখেছিলে তো ! নেটি, বাঃ, কি একখানা নাম রেখেছিলে ! আশ্চর্য লাগছে না? কী করে তোমায় খুঁজে বের করলুম ? এনিওয়ে, আজ তো রবিবার, তোমার কর্মীদের দিয়ে আজও খাটাচ্ছো? ওদের তো পরিবার পরিজন আছে। টেল দেম টু গো হোম।

      বোধহয় বাবলগাম খাচ্ছিস, কথাগুলো চিবিয়ে বললি, চিবিয়ে বলা সংলাপে থাকে বেপরোয়াভাব, জানি। ইয়ার-প্লাগ  জিন্সের সামনের পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে-রাখতে বললি, তোমাদের ঈশ্বরগুলো সব কালা হয়ে গেছে, কেউ তাকে ছাদে দাঁড়িয়ে লাউডস্পিকারে ডাকছে, কেউ আবার দল বেঁধে জগঝম্প বাজিয়ে ডাকছে, ডিসগাস্টিং টোটালিটেরিয়ানিজম। ঈশ্বরগুলোও আমার মতো সকাল থেকে বিরক্ত হয়ে গিয়ে থাকবে জগঝম্পের ঝালাপালায়।

      অ্যাটিট্যুড, অ্যাটিট্যুড, আই অ্যাম কুল, আই অ্যাম গার্লি, আই অ্যাম ফেমিনিন, অ্যাটিট্যুড। তোর দিকে, চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এক পলক তাকিয়ে, নিজেকে নিঃশব্দে বললাম আমি।

      আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে, স্লোগানচুড়ির ঝিনঝিন বাজিয়ে, নিজেই হুকুম দিলি, আপ লোগ ঘর যাইয়ে, আজ কিঁউ কাম কর রহেঁ হ্যাঁয়? ছুট্টি হ্যায় না আজ।

      সেকশান অফিসার পেনডিং ফাইলগুলো দিতে, আর রাতে যেগুলো ক্লিয়ার করে দিয়েছি সেগুলো নিতে এসেছিল। পিওন রবিন্দর সিং ওর সঙ্গে। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে নির্দেশের অপেক্ষা করছে দেখে তুই বললি, হাঁ, হাঁ, যাইয়ে, ঘর যাইয়ে, ম্যাঁয় ইনকি রিশতেদার হুঁ, বিদেশ সে আয়া হুঁ বহুত দিনোঁ বাদ।

     আমি তো জাস্ট বোবা, মাথা নাড়িয়ে, ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে, বললুম, করিম সাহব, যাইয়ে, ফাইলোঁ কো লে যাইয়ে, কল অফিস যাকর হি দেখুংগা।

      হুকুম করার কন্ঠস্বরে তুই বললি, চাপরাশি কুক আর কে কে আছে, সবাইকে যেতে বলো, আমি রাঁধতে পারি, ইনডিয়ান, ওয়েস্টার্ন, চাইনিজ, থাই, মেক্সিকান, টার্কিশ, যা খেতে চাও। টেল অল অফ দেম টু গো ; আমি চাই না যে তোমার কোনো কর্মচারী আজ বাড়িতে থাকে।

      চাপরাশি নানকু প্রসাদ তোর সুটকেসটা তুলে আমাকে জিগ্যেস করল, গেস্ট রুমমেঁ রখ দুঁ ?

        তুই তাকে বললি, আপকো কুছ করনে কি জরুরত নহিঁ হ্যায়, আপ ভি ঘর যাইয়ে, রসোই বনানেওয়ালে অওর মালি কো ভি বোলিয়ে আজ সবকি ছুট্টি।

        তোর হুকুমে সন্মতি দিলাম, চলে গেল ওরা।

        ফেনিল কথার ঢেউ, আলোকোজ্জ্বল চাউনি, উসকে-দেয়া রক্তসঞ্চালন।

        চৌম্বকীয় আঠা, আকস্মিকতার টান, অমেয় চিরন্তন।

       ইলেকট্রিসিটি নয়, আমি এলেকট্রা। জানো তো এপিকের নায়িকা এলেকট্রা ? গ্রিক মহাকাব্যের এলেকট্রা ? এলেকট্রা কমপ্লেক্সের এলেকট্রা। আমি সেই এলেকট্রা কমপ্লেক্সের এলেকট্রা, মহাকবির কল্পনা দিয়ে গড়া। তুমি তো ইংরেজি সাহিত্যে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলে !

      আমি চুপ করে আছি, দেখছি তোকে, অবাক, কুয়াশা, অঝোর বৃষ্টি, বাতাসে শিউলিফুলের গন্ধ বলে চলেছে উৎকীর্ণ করো, শিহরিত করো, উষ্ণ করো।

       ভাবছি, তুই কি করে এলেকট্রার গল্প জানলি, তুই তো ম্যাথামেটিক্স, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির বইপোকা ছিলিস, ইলেকট্রনিক্স পড়েছিস। আমি যেসব বইপত্র তোর নামে জগদীশের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম, তাতে কি এলেকট্রা প্রসঙ্গ ছিল, মনে পড়ছে না, উঁহু, মনে পড়ছে না। থেকে থাকবে, বইগুলো বাছাই করত পড়ুয়া জুনিয়ার অফিসাররা, আমি পেমেন্ট করে দিতাম।

       ভাবছ কী করে তোমাকে লোকেট করলুম, তাই না? না, বাপি, আই মিন আঙ্কলবাপি, বা আন্টিমা বলেননি, ওনাদের কাছে জানতে চাইনি কখনও; জানতে চাইলে ওনারা তোমাকে নোটিফাই করে দিতেন, আর তুমি তোমার পায়ের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা করতে।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep goddyo

কারাবাসের কবিতা । পর্ব ৬

বি শে ষ  র চ না । পর্ব ৬

ডঃ রূপক বর্ধন রায়

rupak2

কারাবাসের কবিতা: বাংলা অনুবাদে ব্রায়টেন ব্রায়টেনবাখ

( গত সংখ্যার পর )

‘এক্লিপ্স’  বই থেকে ( ১৯৭৭-এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৯-এর মাঝামাঝি সময়ে লেখা কবিতা)

 

 

একটা বেবুনের মত সন্ধে নাগাদ আমিও ধূসর হয়ে

যাই, শান্ত, পতনের ভয়ে পরিপূর্ণ যখন এই পৃথিবী সূর্যের 

থেকে দূরে সরতে থাকে এবং খসে পড়ে, সেই ধাবনের অন্তহীন

তল-দরজা দিয়ে ক্রমাগত খসে পড়েঃ- মৃত্যু

এক ধাবন-ও-পতন। কি আশ্চর্য যে ফলন্ত ও জরাগ্রস্ত 

মিত্রাক্ষর যাতে মৃত্যু এক সংজ্ঞাহীনতা হয়ে যায়, নিজেকে জীবনের

আশ্বাস দিতে চাওয়া হাওয়া-মোজাটার একটা গোড়ালি,

আর এই যে এটা যার এখন পৌরাণিক সকালের সাথে 

পিত্তের সবুজ স্বাদ রয়েছে আবারও একবার গোড়ালিটাকে আর ঈলমাছটাকে সারিয়ে তোলে

যদি ততক্ষণে শব্দগুলো ধাবনের মাঝেই পুড়ে শেষ হয়।

হৃদপিণ্ডকে ক্ষরণের জন্য আর জিভগুলোকে ঘষার জন্য ছেড়ে দাও-

ইতিমধ্যে আমি হাঁটু অবধি কবিতায় লুকিয়ে থাকি

কারণ তুমি আমায় জানো, জানো আমি কেঃ-

সেই অন্ধরাতের খুনি, শালা সেই উগ্রপন্থী!


১৭

 

সবুজ বাড়ন্তের সেই ক্ষুদ্র ছোপগুলো ঠাণ্ডায় ধূসর হয়েছে

শহর ও দেশের প্রত্যেকটি ভিত্তিপ্রস্তর ও ভাঁজে সর্বত্র

শুকনো পোকামাকড়     বিদ্বজ্জনের বউয়েরা

নিজেদের পুষ্ট পাছা দেখিয়েছে মা’কে কারণ

দৃশ্যত তার উচ্চারণে বাঁশিধ্বনি নেই এবং জাতীয় ও

নারীমূর্তির সাথে যথেষ্ট সদৃশ্য নয় আর বাবা বারান্দার শূন্য

চারাগাছটার পাশে বসে ছিলেন যখন দুটো যুদ্ধবিমান সান্ধ্য আকাশ চিরে

 ছুটে যায়

প্রত্যেকটির পতাকা ‘আর যুদ্ধ নয়’ এবং এছাড়াও ‘শান্তি’র দুর্বল

শব্দে ভরা আর যখন উল্লেখিত শেষেরটি ফেটে পড়ে একখানা

হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে, এখানে

এই শুকনো বাগানে কালো পেগাসাসঃ- এক ভোঁতা অশ্বখুর; কিন্তু আমার কবিতা সুদীর্ঘ 

প্রতিশ্রুতি তখন অতীত আর আমি সন্ত্রস্ত পাছার ধুকপুকুনি মাসোনিক হোটেল 

যেখানে নেশাতুর রেনেসীঁয় অনুকৃতি সর্বোচ্চ গোপনীয় 

শারীরিক অলিগলিতে

খোঁজার অপেক্ষায় ঝুলে থাকে তার পাশ দিয়ে ততক্ষণে 

ফিরতি পথে

এবং লোহার গরাদে বন্দীঃ- জেলে

 

‘YK’ বই থেকে (অক্টোবর ১৯৭৯ থেকে নভেম্বর ১৯৮২-র মধ্যে রচিত কবিতা)

 

কেউ কেউ দুঃখজনকভাবে জীভ দিয়ে টিক-টিক(*) আওয়াজ করে

আর এই জায়গাটাকে বলে Eziqwaqweni

সেই বাড়ি যেখানে ডাকাতেরা থাকে;

অন্যরা বলে না এটা আরো অনেক বেশি করে

একটা কবরখানার মত যেখানে একজন ধ্যান করতে পারে

আর তাই একে Dlinza বলেই ডাকা উচিত;

কিন্তু আমি এতক্ষণে জানি যে তুমি তোমার 

পন্টিয়াস থেকে ছোট্টো পিটার থেকে ভুমেরু অবধি মুক্তির

গোলকধাঁধাবত খোঁজে এখানে হারিয়ে যাবেঃ-

এখানে তোমার সৎভাইয়েরা তোমার উলঙ্গ পাছা-ছিদ্র

এক পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে গর্তে গুঁজে দেয়- সততই kwaDukuza

অবিকল হারিয়ে যাওয়া মানুষের জায়গা-

 

(*) নানান দক্ষিণ আফ্রিকীয় ভাষায়, মূলত বান্টু ভাষায় এমন ‘ক্লিক’ আওয়াজের ব্যবহার আছে। বান্টু পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষার একটি।

সমাপ্ত

লেখক পরিচিতি :  GE Heathcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত, ফ্রান্স-এর নীস শহরে থাকেন। টার্কি-র সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্ত্রাস্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভারসিটি ও পি এইচ ডির পর বছর খানেক জার্মানির ফ্রনহফার সোসাইটিতে সায়েনটিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। লেখালেখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ট্রাভেলগ, সাহিত্য মনন নিয়েই। কলেজজীবনে বন্ধুরা মিলে “দেওয়াল” নামক কবিতা পত্রিকা চালিয়েছেন কয়েক বছর। এছাড়াও কবিতা, গদ্য প্রকাশ পেয়েছে একাধিক বাঙলা অনলাইন পত্র পত্রিকায়। লেখা লেখি ছাড়াও গান বাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে রূপকের সমান আগ্রহ রয়েছে।

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep goddyo

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি । পর্ব ৪

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৪

স ব্য সা চী   স র কা র

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি

sabyasachi

সঙ্কোচে জানাই আজ…

‘রুকুদা, জোরে আরো জোরে…।’

এক তলার রক থেকে ভেসে আসছে গোলাপি ফ্রকের গলা। আর সে দিকে তাকিয়ে মাথার ফেট্টি ঠিক করে নিচ্ছে রুকুদা, মানে সোমক বিশ্বাস। 

একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ফর্সা, লম্বা পেটানো চেহারা। গলি ক্রিকেটে সেভেন আ সাইড ম্যাচের সেমিফাইনাল, ক্যাম্বিস বলে। খেলা ১২ ওভারের। আমরা মানে সিক্স ফ্রেন্ডস আগের ম্যাচগুলোয় হারতে হারতে কোনোরকমে জিতে সেমিফাইনালে উঠেছি। কিন্তু উঠেই শুনলাম, এ বারের প্রতিপক্ষ নেতাজি স্পোর্টিং। শুনলাম, গত বছরে টুনার্মেন্টের সেরা প্লেয়ার সোমক বিশ্বাস ওদের হয়ে খেলে। যখন তখন যেমন ছক্কা মারতে পারে, ঠিক তেমনই প্রতি ম্যাচে তিন-চারটে উইকেট পায়। সঙ্গে ভয়ঙ্কর পেস। বল নাকি দেখা যায় না। 

গড়িয়াহাট বাজারের একটু আগে এখন যেখানে ট্রাইব রেস্তোরাঁ, তার ডান দিকের রাস্তার নাম বালিগঞ্জ গার্ডেন্স। কাঁকুলিয়া রোডের দিকে যেতে যে চার মাথার মোড়, সেই রাস্তাটাকে আমরা বলতাম ফর্টি ফিট। চল্লিশ ফুট, কারণ চওড়া রাস্তা, অনেক চওড়া ফুটপাথ। সেখানেই পরপর ইঁট পেতে উইকেট, রাস্তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য এক দিকে ব্যাটিং। কারণ অফসাইড আর লেগসাইড খোলা।  ফুটপাথের উঁচু রকগুলোতে ছোট ছোট জটলা। তার একটায় আমাদের সিক্স ফ্রেন্ডসের প্লেয়াররা বসেছে। বাকিগুলোতেও উৎসাহী জনতা। মাসটা ডিসেম্বর, রবিবারের অলস দুপুর। আটের দশকের সেসব দুপুরে এই সব গলি-ক্রিকেটের ম্যাচ আমাদের কাছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে কিছু কম উত্তেজক ছিল না। 

টস জিতে আমরা ব্যাটিং করছি। আমি আর টুবলু ওপেন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম ওভারের তিন নম্বর বলে টুবলু সিলি মিড অফে ঠেলেই রানের জন্য দৌড়ল। বলটা একটা রকের দেওয়ালে লেগে ফিল্ডারের হাতেই গেল। ততক্ষণে টুবলু অনেকটা চলে এসেছে। আমি ‘নো নো’ বলতে না বলতে ফিল্ডারের থ্রো ইঁটের উইকেটে ধাক্কা খেল। ০ রানে এক উইকেট। টুবলু আমাকে গালাগাল করতে করতে আমাদের সিক্স ফ্রেন্ডসের রকে গিয়ে বসল। এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি খুন করেছি। রান আউট হলে ব্যাটার যেমন ভাবে তাকায় আর কী!

তিন নম্বরে ব্যাট করতে আসছে সুজন। স্টান্স নেওয়ার আগে আমি মাঝ পিচে এগিয়ে এলাম। বললাম, ‘টুবলু আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করছে। তুই প্লিজ রান নেওয়ার আগে ইয়েস বা নো বলবি। না হলে গণ্ডগোল হবেই।’

সুজনের ব্যাটিংয়ে আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বলল, ‘নামটা দিতি। আমি জেনে নিয়েছি।’

‘কে দিতি?’

‘ওই যে রক থেকে চেচাঁচ্ছে! ওই মেয়েটা!’

আমি রক্তচক্ষু হেনে বললাম, ‘ও দিকে তাকাস না। সোমক বিশ্বাস তোর মাথা ভেঙে দেবে!’ 

সুজনের মাথায় ঢুকল বলে মনে হল না। কোনোরকমে সেই ওভারের বাকি দুটো বল খেলে দিল। এর পরেই বল করতে এল সোমক। প্রথম বলটাই অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে বুলেটের মতো আমার অফ স্টাম্প ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। কী পেস! চারধারে প্রশংসাসূচক দৃষ্টি, বড়দের গলা আসছে, ‘ওয়েল বোল্ড সোমক। ভেরি গুড।’ আর দ্বিতীয় বলটা করার আগে গোলাপি ফ্রকের গলা, ‘রুকুদা, জোরে আরো জোরে…।’

এ বার বলটা একটু ঠুকে দিয়েছে সোমক। কাঁধের বাড়তি জোর প্রয়োগ। বল শর্ট পিচ হয়ে আমার প্রায় নাক ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল কিপারের হাতে। রক থেকে আওয়াজ আসছে, ‘এ তো বল দেখতেই পাচ্ছে না রে। স্টাম্পে কর সোমক। করলেই বোল্ড!’

বাঁ হাতি ব্যাট আমি। পুলটা ভালোই করতে পারি। কিন্তু পুল মারার মতো বল তো পেতে হবে। এ তো সত্যি বল দেখতে পাচ্ছি না। এতোটাই পেস। তার উপর এটা নেতাজি স্পোর্টিংয়ের নিজেদের পাড়া। পাড়ার রকগুলো চনমন করছে আর চিয়ার লিডার ওই গোলাপি ফ্রক। মাখনের মতো রঙ, একমাথা চুল, গোলাপি পদ্মের মতো ফুটে আছে পিচ রাস্তার ধারে। 

আমার হাতে কিছু নেই। শুধু একটা ব্যাট। এইটুকু সম্বল। শুধু এটা নিয়েই লড়ে যেতে হবে। ১২ ওভারের খেলা। কোনো বোলার তিন ওভারের বেশি করতে পারবে না, নিয়মে আছে। অন্য বোলারটাকে তেমন জুতসই মনে হচ্ছে না। সোমকের তিনটে ওভার খেলে দিতে পারলে…।

মনে মনে বললাম, গোলাপি ফ্রক, তুমি আমার চোখ টেনে নিচ্ছ। যখন নিচ্ছ, তোমার প্রেমিককে আমি উইকেট দেব না। কিছুতেই না। 

‘কোত্থেকে হাওয়া ছুটে এসে কী জানি করল কী কৌশল

দু-চক্ষু তার ভাসিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে

ছুটিতে চলল ঝর্ণাদল!’   

(উন্মাদের পাঠক্রম, জয় গোস্বামী)

সোমকের ওভারের শেষ বলটা লেগে পড়ল। ওই যে কবিতায় আছে—

‘কোত্থেকে হাওয়া ছুটে এসে কী জানি করল কী কৌশল..।’ বলটা লেগে পড়তেই নিখুঁত ফুটওয়ার্কে শর্ট আর্ম পুল। গলির মুখে স্কোয়ার লেগে দাঁড়ানো ফিল্ডারের পাশ দিয়ে চার। 

সেই শুরু। পরের ওভারে লেগস্পিনার। ফ্লাইট করাচ্ছে। কিন্তু আমি বাঁ হাতি বলে মিডলে পড়ে লেগের দিকে পড়ছে। দুটো বল অনায়াসে তুলে দিয়ে ছক্কা পেলাম। উল্টোদিকে সুজনও মাঝে মাঝেই চালাচ্ছে।

একটু একটু করে রান বাড়ছে। সাত ওভারে আমরা ৫২-১। লং অফে ফিল্ডিং করছে সোমক। মাঝে মাঝেই পাশের রকে গোলাপি ফ্রকের সঙ্গে কথা বলছে। মাথা নেডে় কলকল করছে গোলাপি ফ্রকও। সুজন সেটা দেখিয়ে বলল, ‘আমি শালা আজ আউট হব না। দেখি ওর বয়ফ্রেণ্ড কীভাবে ওদের জেতায়!’

‘মারের চোটে শুইয়ে দাও, শুয়ে আদর করো

গলায় যেই পরাও হাত— প্রেমিক জড়োসড়ো

 

মাটিতে দাও ঘষটে মুখ, মুখে লাগাও দড়ি

আঘাতে যেই নামাও মুখ—প্রেমিক যায়-যায়’

                           (বাঁকা, ভুতুম ভগবান, জয় গোস্বামী)

এগারো নম্বর ওভারে আবার সোমক এল বল করতে। প্রথমটা হাফভলি। একটু এগিয়ে নিখুঁত ফুটওয়ার্কে লংয়ের উপর দিয়ে তুলে দিল সুজন। দুরন্ত টাইমিং। ছক্কা। ওই ওভারে এলো ১৪। শেষ পর্যন্ত আমরা ১১৩-২। শেষ ওভারে চালাতে গিয়ে বোল্ড হল সুজন। কিন্তু করেছে ৫৩ রান। আমি ৫৯ নট আউট। 

এর পরে ওদের ৮১ রানে অলআউটে খুব একটা বিস্ময়ের কিছু নেই। টোটনের স্টাম্প টু স্টাম্প বোলিংয়ে এলো তিন উইকেট। আর বিস্ময়করভাবে শুরুতেই চালাতে গিয়ে ৪ রানে বোল্ড হয়ে গেল সেই সোমক বিশ্বাস। নিস্তব্ধ পাড়া। রকগুলো ফাঁকা হচ্ছিল। কিন্তু সেই গোলাপি ফ্রক বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল রকে। শুধু আর চেচাঁচ্ছিল না। 

আর কোনোদিন পাড়া ক্রিকেটে আমি ৫৯ নট আউট করিনি। সুজনও করেছে কি? জানি না। ম্যাচ শেষে মেয়েটির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাটা মনে আছে। সিনিয়র দাদাদের পাশাপাশি সেখানে ছিল সোমক তথা রুকুদা। রুকুদার কাঁধে প্রকাশ্যে মাথা রাখেনি মেয়েটি। কিন্তু সজোরে হাতটা খিমচে দিয়ে বলেছিল, ‘কেন পারলে না? কেন হেরে গেলে?’

বিধ্বস্ত প্রেমিকের মতো দাঁড়িয়েছিল সোমক বিশ্বাস। শীতের দুপুর দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আমরা ফিরছিলাম। সোমক বিশ্বাসের প্রেমটা টিকেছিল? ও কি এখন দিতির সঙ্গে থাকে? কে জানে। সেদিন সত্যিই আমরা একটু কড়কে দিয়েছিলাম আর কি! হিংসেয়, মুগ্ধতায়। ভালোবাসায়!

‘সংকোচে জানাই আজ; একবার মুগ্ধ হতে চাই।

তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।

এতদিন সাহস ছিল না কোনও ঝর্ণাজলে লুন্ঠিত হবার—

আজ দেখি, অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে—’

                           (স্নান, ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা, জয় গোস্বামী)   

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep goddyo

আবার রাণার কথা । পর্ব ৮

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৮

রা ণা   রা য় চৌ ধু রী

আবার রাণার কথা

rana2

একদিন আনন্দ পেয়েছিলাম

একা একটা ঘরে শুয়ে আছি। একা থাকতেই ভালো লাগে আজকাল। পাহাড় থেকে দীর্ঘ বাতাস আমার জন্য মায়ের স্নেহ ভালোবাসা বয়ে নিয়ে আসছে।

কারোর জন্য কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব আনন্দের। আমার এক ছাত্রের বাবা, মাঝবয়সী দেখেছিলাম। সেদিন আমিও সাইকেলে বাজার করে ফিরছি, দেখি উনি কবে কীভাবে যেন বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। বাজার আর টানতে পারছেন না, আমাকে বললেন, ‘এগুলো বাড়ি পৌঁছে দেবে?’ আমি দিলাম। বয়ে দিলাম। এর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, কিন্তু একটা অল্প স্রোতের মতো আনন্দ আমি পাচ্ছিলাম।

আনন্দ সংগ্রহ করতে হয়। আমি আনন্দ সংগ্রহে সাইকেলে ঘুরি। ট্রেনেও। এই আনন্দ সংগ্রহে এসেছি, এখানে। এই পান্থশালায়।

আনন্দ কাছেই আছে। আমার দ্বিতীয় আমির নাম আনন্দ।

পুরো যৌবনকাল কেটে যাওয়ার পর,  জিনেদিন জিদান রিটায়ার করার পর,
শেষমেশ আমার একটা নরম তুলতুলে পাশবালিশ জোটে,
ধীরে ক্রমে আস্তে আস্তে
লক্ষ্য করি সেটি গাছের গুঁড়িতে পরিণত হয়েছে

কবি তো! তাই এতো ঘ্যাম।
আমি দূর হতে দেখি তারে।
দূর হতে
হঠাৎ খেয়াল হয়
আমার প্যান্টের চেন খোলা!

দুটো পা, হাত, কান, চোখ (টিউবলাইটের মতো) কুড়িটি আঙুল, একটি টানটান গোপন কঞ্চি  এতো জিনিসপত্র কেন দিলেন ভগবান!
অবাক লাগে!
আমি ধনী।
আমার ধ্বনি বাজে ভিতরের ঘর

আমি সাইকেলে বেল খুব দরকার ছাড়া দিই না। কাউকে বিরক্ত না করে এগোতে চাই, মৃদু।
বেল না বাজিয়ে, ঠিক কাটিয়ে কাটিয়ে, কাউকে বিন্দুমাত্র ধাক্কা বা টাচ না করে বেরিয়ে যাই।
তবু থামব না, সাইকেল চালাবোই, এগোবোই। এখন অবশ্য স্পিড কমে গেছে। তবু টুকটুক করে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি জানিনা, কিন্তু যাচ্ছি।
যতদিন রাস্তা থাকবে আমি যাবো। সাইকেল চালাবো, বিনা বেলে, বিনা ক্রিংক্রিঙে, নিঃশব্দে।
ভাবি, যদি কোনোদিন রাস্তাই না থাকে, তবে?
আমি তো মুণিঋষি নই যে জলের ওপর সাইকেল চালিয়ে ওপারে চলে যাবো?
আমার বিশ্বাস রাস্তা থাকবে। গলি রাজপথ থাকবে। ভাঙাচোরা হলেও থাকবে, আর আমি বা আমরা চুপে সাইকেলে, হেঁটে, টোটোতে, অটোতে ঠিক একটু একটু করে এগোতে পারবো

ডায়রি আমার দ্বারা লেখা হল না। লিখতে ইচ্ছে করে, আবার ভাবি সেখানে মিথ্যে তো লিখতে পারবো না! সত্যিটাই লিখবো। আর সে সত্যি হয়তো অন্যকে দোষারোপই হবে শুধু। নিজের দোষ অন্যায় নিজের ভুল ত্রুটি, নিজের ক্রুরতা কি লিখবো সেখানে? সেটা লিখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সবক্ষেত্রে তো আমি দোষী নাও হতে পারি। বুঝতে পারি না। জীবনের যা যা শিক্ষা পেলাম তা আমার অন্তরেই থাক, আবার ডায়রিতে লেখালেখি, সে এক ঝামেলার। যা কিছু গোপন দুঃখ যন্ত্রণা আশা লোভ অবৈধ প্রেমের ইচ্ছা ডুব সাঁতার চিৎ সাঁতারের ইচ্ছা সব একদিন আগুনকে দিয়ে যাবো। আগুনকে দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না, যেহেতু দাহ হবো, সেহেতু আগুনকে। কিন্তু জলকে আগুনের চে বেশি ভালো লাগে আমার। মনে হয় আমার সব সফলতা ব্যর্থতাকে জল গিলে নিক। জল তার পিপাসা মেটাক আমাকে দিয়ে।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022-sep goddyo

উদাসীন তাঁতঘর | পর্ব ১১

ধা রা বা হি ক পর্ব ১১

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

একটি সাংস্কৃতিক চরিত্রের সন্ধানে

এই মানুষটির সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে। বাজারের মোড়ে অথবা নির্দিষ্ট কিছু চায়ের দোকানে। সবসময় ব্যস্ত। জীবনে এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশ্নাতুর। সাম্প্রতিক ছেলে মেয়েদের চলাফেরাকে সে সন্দেহের চোখে দেখে। আর প্রতিমুহূর্তে ভাবে সংস্কৃতি গোল্লায় যাচ্ছে। তার হাতে কিছু নেই। তবুও সে লুকিয়ে রেখেছে দুরারোগ্য কিছু রঙিন প্রস্তাব। যেন গর্ভের অন্ধকার থেকেই সে সাংস্কৃতিক এবং বাঙ্ময়। যেন বিংশ শতাব্দীর সকল মনীষী মৃত্যুর আগে তাঁকে খুঁজে ছিল। এমনই এক উত্তরসাধক বসে আছে আপনার পাশে । শুধু মাত্র কথার বিনিময়ে বিনা পয়সায় চাইছে চা এবং সিগারেটের অধিকার। আমরা সামান্য শিক্ষিত এবং কিছুটা সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ দায় নিয়েছি এদের আর আড়ালে হাসাহাসি করেছি।

কিছুদিন আগেও,নব্বই দশকে স্পষ্ট দেখা যেত তাঁদের। কোনো সাংসারিক বা পারিবারিক কাজের জন্য জন্ম হয়নি যাদের। এদের সব কাজ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য। গভীর রাতে বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কোনো সামাজিক কর্তব্য নেই। সারাদিন মনীষীদের বাণী বয়ে বেড়ানো ছাড়া অন্য কোনো সংবেদনা নেই। তাঁরা উদ্যোগী এবং উদ্যমী পুরুষ। প্রতিদিন কোন কবি বা মনীষীর জন্মদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নিতে হয় তাঁকে। যেকোনো ছুতোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং তার মুরুব্বী হয়ে ওঠাই তাঁর একমাত্র ভবিষ্যৎ। কোন কুক্ষনে সামান্য কিছু সাহিত্যের বুলি সে আত্মস্থ করেছিল ভেবে অবাক হই। দু-একটি কবিতা শিরোধার্য করে হয় সে আবৃত্তির মাস্টারমশাই অথবা মঞ্চের ঘোষক। কোনো অনুষ্ঠানে দুই শিল্পীর মাঝের ফাঁকটুকু সে ভরিয়ে রাখতে চায় স্বরোচিত কবিতায়। তথ্য যাচাই না করেই নানা সাহিত্য গুজবকে সারাজীবন বয়ে চলে। পড়াশোনা নেই। সেই প্রয়োজনও নেই। শুধু সংস্কৃতির অবনতি দেখলে তাঁর মাথার পোকা নড়ে ওঠে। সেই সংস্কৃতি যার কোনো উত্তরণ নেই শুধু প্রাচীন এক পন্থায় প্রথাগত আত্মসমর্পণ ছাড়া।

কৈশোরে অভিভাবকের হাত ধরে সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক পুরস্কার জিতে নিয়েছে। আবৃত্তি,ক্যুইজ, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। পড়া নয় বলার কৌশলে সে হয়েছে সংস্কৃতিমনস্ক। তারপর একদিন নিজেকে করে তুলেছে উদ্যোক্তা। এদেরই গোপন দালালিতে সেজে উঠেছে মফস্বলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একদিন এরাই আদায় করে নিয়েছেন অভিভাবকের সমীহ, নানা কালচারাল কমিটির সম্মান। পড়াশোনা চেনা ছকে বাঁধা। নতুন যা কিছু সবই চলার পথে কোনো না কোনো ব্যক্তির সভাসমিতির কথা সূত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ বা ‘প্রশ্ন'(ভগবান তুমি যুগে যুগে…) নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ বা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ এইরকম দু- একটি কবিতা গলা কাঁপিয়ে নাটকীয়ভাবে পরিবেশন করতে করতে তাঁর দিন ফুরোয়। কিছুটা এগিয়ে আছেন যিনি তাঁর অস্ত্র নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (উলঙ্গরাজা), শঙ্খ ঘোষ (যমুনাবতী), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( রাজা আসে রাজা যায়), পূর্ণেন্দু পত্রীর (কথোপকথন) কিছু জনপ্রিয় কবিতা। এইটুকু সম্পদ আর কণ্ঠের নানা মুদ্রাদোষ নিয়ে সে হয়ে ওঠে মফস্বলের অনিবার্য সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। এদেরই ঘোষণায় মফস্বলের রবীন্দ্র -নজরুল সন্ধ্যা,বিচিত্রানুষ্ঠান, রক্তদান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদেরই কণ্ঠ আমাদের ছোটবেলার ঘুমজাগানিয়া স্বপ্ন, হয়তো বা সংস্কৃতির প্রথম প্রেরণা। আজ নব্বইয়ের সেই দিন গিয়াছে। চাকরির স্বপ্ন ছেড়ে শুধু এক সাংস্কৃতিক যাযাবর জীবন নিয়ে আজ আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ কেউ তাড়ায় না। সাংস্কৃতিক দাদার পদটি মফস্বলে বহুদিন ফাঁকা পড়ে আছে।

আজ কোথায় কীভাবে আছেন তাঁরা? সম্প্রতি তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন আর রবীন্দ্র -নজরুল সন্ধ্যা পাড়ায় পাড়ায় হয় না। এখন মফস্বলের অলিতে গলিতে শোনা যায় না কিশোরী কণ্ঠের ‘ বসন্তে ফুল গাঁথল’ বা’ ম্লান আলোকে ফুটলি কেন ‘ এইসব গান। আমরা পাড়া বেপাড়া ঘুরে সংগ্রহ করতাম শিল্পীদের নাম। অনুষ্ঠান সাজানো হত গান, আবৃত্তি,নৃত্যের এমন এক সমন্বয়ে যাতে দর্শকাসন খালি হয়ে না যায়। সভাপতির দীর্ঘ বক্তৃতার মাঝে চিরকূট পাঠাতে হত থামার জন্য। আর প্রতিমুহূর্তে তাকাতে হত আকাশের দিকে কারণ কোনো এক অবশ্যম্ভাবী কারণে সেইদিন বৃষ্টি হত। আমাদের ঘোষক বা সভাপতির তেমন পড়াশোনা নেই সেসব যখন বুঝলাম তখন বড়ো হয়ে গেছি। তবুও এসব নিয়েই দিব্যি চলছিল দিন।

আজ সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দখল করে নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল। এমনকী ধর্মীয় অনুষ্ঠানও স্থানীয় বিধায়কের উপস্থিতি ছাড়া অসম্ভব। রক্তদানের অরাজনৈতিক উদ্দেশ্যর ভিতরে বসে আছেন লোকাল কমিটির সদস্য, কাউন্সিলর,বিধায়ক এবং উঠতি মস্তান ঘোষক যাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘বিশিষ্ট সমাজসেবী’ বলে। এখন শিল্পী খোঁজার অবসর বা পরিশ্রম করার লোক নেই। তার বদলে একটি নাচের স্কুলকে দায়িত্ব দিলে তিন ঘন্টার ধামাকা মজুত। দর্শক খুশি। দল খুশি। ক্যাডার খুশি। পারিশ্রমিক পেয়ে নাচের দলও খুশি। এভাবেই চলবে রক্তদান, স্বাধীনতা দিবস সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। আর নাচের দলও সাপ্লাই দেবে উদ্দেশ্য বুঝে। লতা মঙ্গেশকরের চটজলদি দেশাত্মবোধক গানের নিচে ঢাকা পড়ে যাবে সবিতাব্রত দত্তর গান। ফলত আজ আর ঘোষকের অবশ্যম্ভাবী চাকরি নেই।

এমনই এক সাংস্কৃতিক দাদার সঙ্গে দেখা হল চায়ের দোকানে। তিনি একাধারে ঘোষক-কবি-বাচিকশিল্পী। তাঁর দাপট দেখেছি একদিন। আজ আবৃত্তি ক্লাসের হাঁটুর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা এগোয় সাংস্কৃতিক দুঃসময় নিয়ে। উঠে আসে শিক্ষা ও রাজনৈতিক নানা প্রসঙ্গ। চা সিগারেট খেতে খেতে আজও দেখছি তিনি অপ্রয়োজনে কবিতা গুঁজে দিচ্ছেন স্বকণ্ঠে। অভ্যাসের অভাবে ভুলে যাচ্ছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। তাঁর গলায় আক্ষেপ। অথচ এখনও তিনি স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় একজন বড়ো সাহিত্যিকের জন্মভিটে সংস্কারের। প্রয়োজনে স্মৃতিরক্ষা কমিটি তৈরির। এখন তার দিন যায় বিধায়ক আর রাজনৈতিক দালালদের পিছনে পিছনে। একদিন অনেক রাতে মঞ্চ থেকে নামলে জুটত মিষ্টির প্যাকেট, বড়জোর রিক্সাভাড়া। আর আজ পাওয়া যায় বিরিয়ানির প্যাকেট এবং কিছুটাকা। অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় কোনো নেতা বাইকে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। প্রায় প্রতিদিনই চার পাঁচটা অনুষ্ঠান। সংস্কৃতির ছলে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে রোজগার মন্দ হয় না। তাই ছদ্মবেশী শোকের ভিতরে দেখছি তার চোখ ম্রিয়মান লোভে চকচক করছে। এই তো সেদিনও তাঁকে দেখলাম চায়ের দোকানে বসে শঙ্খ ঘোষের কবিতার উচ্চারণরীতি শেখাচ্ছেন অকারণে। আবার সন্ধ্যায় লোকাল কেবল চ্যানেলে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রার সরাসরি সম্প্রচারে ব্যস্ত।কণ্ঠে কখনও ঝড় কখনও বিষাদ। অনেক রাতে আজ লম্বা একটা সিগারেট ধরিয়ে বাড়ি ফিরবেন তিনি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার চেয়েও লম্বা।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...