Categories
2022_april golpo

শ্রীজিৎ দাস

গ ল্প

শ্রী জি ৎ  দা স

golpo2

গল্পবুড়োর গল্প

এক 

অলস দিনগুলোর ঘুম শান্তির হয় না। দীর্ঘ হয় কিন্তু গাঢ় হয় না। ঘুম গাঢ় হলে ভালো স্বপ্ন আসে। দীর্ঘ হলেও স্বপ্ন আসে। কিন্তু কিছু দুশ্চিন্তা তার মধ্যে মিশে যায়। স্বপ্ন সে যেমনটাই হোক, দেখতে মন্দ লাগে না। অবচেতনে অনুভূতির যে সূক্ষ্ম দড়ি বাঁধা থাকে তাতে একটু টান পড়লেই আবার সব ঠিকঠাক। সপ্তাহে দু’একদিন রাতে তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বিছানায় যাওয়া নিয়ম করে নিয়েছি। শহরে থাকলেও এমনটা করতাম। শহরে তাড়াতাড়ি মানে এই রাত এগারোটা। গ্রামের কিছুটা মন্থর জীবন গতিতে সেটা ন’টা কিংবা সাড়ে ন’টা। বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে এসে আছি। ডাক্তারবাবু বলেছেন, এখন আমার এক মাস বিশ্রামের প্রয়োজন।  চার হপ্তা হতে আর দুদিন বাকি। শহুরে জীবনটাকে এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়। সেই আটটায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে, দু’টি গরম ভাত মুখে দিয়ে ভিড় বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস দৌড়নো। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করা। বড়বাবুর বকুনি, সহকর্মীদের খেলো হাসিঠাট্টা, যানজট, গাড়ির ধোঁয়া, আবার সন্ধে ছ’টা নাগাদ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা।

এখন বিকেল বেলা ছাদে উঠি কিংবা বুড়ি নদীর ধারটায় গিয়ে বসি। মাঝেমাঝে মনে হয় চুয়াল্লিশ নম্বর বাস, মারগারেট বিল্ডিং, বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদার কিংবা গোটা শহরটাই এই পৃথিবীর মধ্যে নয়। হতেই পারে না এই পৃথিবীর। বুড়ি নদীর বয়ে যাওয়া জলে বিকেলের শেষ রোদটা এসে লাফায়। এই সময়টা নদীর ধারে খুব শীতল অথচ মৃদু একটা হাওয়া দেয়। আগেও যে ক’বার এসেছি, দেখেছি দুটো শামখোল নদীর তীরে কাঁটা ঝোপের পাশে বালিয়াড়িতে লড়াই করে। আমার মতো একটা কুকুরও তাদের দাঁড়িয়ে দেখে মাঝে মাঝে। আজ দেখি ওরা একটা গুগলি নিয়ে টানাটানি করছে। কিন্তু শামখোল এ অঞ্চলে আগে পাওয়া যেতো না, ইদানিং বোধহয় আসছে। আচ্ছা শামখোলে কি গুগলি খায়?

-“হ্যাঁ খায় তো।” পাশ থেকে একটা বুড়োর গলার আওয়াজ আসে। কখন আমার অজান্তেই একটা থুত্থুড়ে লোক আমার পাশে ঘাসের ওপর এসে বসেছে। পরনে এক অদ্ভুত জোব্বা, অনেকটা জাদুকরদের মতো। গায়ের রং ফর্সা, গালের চামড়া ঝুলে পড়েছে। ছোটো ছোটো চোখের দুটো পাতার মাঝে অনেকটা ফাঁক। এ দেশীয় লোকের মুখের গড়ন এমনটা হয় না। লোকটাকে দেখে তবু মনে হলো আগে কোথাও যেন দেখেছি। কিন্তু আমি তো কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলাম! লোকটা বুঝলো কীভাবে? তাছাড়া বলা নেই কওয়া নেই এমন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবার দরকারটাই বা কী! বুড়ো লোকটাকে বললাম, “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”

-“চিনবেই বা কেমন করে? আমার বাড়ি তো এ দেশে নয়। টরেগারমা বলে কোনো জায়গার নাম শুনেছো কখনো? সেখানেই আমার আসল ঘর ছিলো। আমার ছোট্ট খড়ের ঘরের সামনে ছিলো নীল সমুদ্র। বালুচরে ছোটো ছোটো শিশুরা সকাল বিকাল খেলা করতো। ভোরবেলা ডিঙি নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম আমি। সেই মাছ গ্রামের বাজারে বিক্রি করে আমার একার সংসার ভালোভাবেই কেটে যেতো। বিকেলে সমুদ্র তীরে খেলতে আসা বাচ্চারা সন্ধেয় গিয়ে জুটতো আমার ঘরে, গল্প শুনবে বলে। ল্যাম্পের আলোয় বসে দেশ বিদেশের রূপকথা কিংবা সমুদ্রের অদ্ভুত সব প্রাণীর গল্প শোনাতাম তাদের। তাই তারা আদর করে আমায় ডাকতো ‘গল্প বুড়ো’।”

কাল অফিসে যোগ দিতে হবে। ভোরেই বেরবো। এক মাসের লম্বা একটা ছুটি একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছিল। শরীরটা মোটেও ভালো যাচ্ছিল না। কাজে কিছুতেই মন বসতো না। এখনো যে বিশেষ ভালো আছি তা নয়। নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক মাস পর আমাকে দেখে, বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদার দশটা মোটা ফাইল দিয়ে হয়তো চোখ পাকিয়ে বলবেন, “অ্যাদ্দিন খুব ফাঁকি মেরেছো। আজকের মধ্যেই এগুলো শেষ করো।” এসব কাজ কারই বা ভাল্লাগে! তার ওপর আবার এই বুড়োটা কীসব ভুলভাল গল্প শোনাচ্ছে। বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “সবই তো বুঝলাম! কিন্তু আপনি এদেশে এলেন কেমন করে? আপনার নামটাই বা কী? সেসব কিছুই তো বললেন না।”

-“আমার নাম তিইমা ল্য মাতসু। অতো বড় নামে কাজ নেই। তুমি আমায় গল্পবুড়ো বলেই ডাকবে। সবাই তাই ডাকে। এবার আমার এখানে এসে পৌঁছনোর ব্যাপারটা বলি। সেদিন ছিলো ঝড়ের রাত। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে একখানা গল্পের বই হাতে বিছানায় ঢুকেছি, এমন সময় দরজার কড়াটা কেউ সজোরে নাড়তে লাগলো। দরজা খুলতে দেখি একটা কমবয়েসি ছেলে দাঁড়িয়ে। পিঠে তার একটা ঢাউস বোঝা, বড় বড় বাবরি ছাঁট চুলগুলো ঝড়ের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে। সে আমায় জানালো আজ রাতটুকুর জন্য সে আমার আশ্রয়প্রার্থী। খাবারদাবার কিছুই লাগবে না, কেবল একটু শোবার জায়গা দিলেই হবে। চাইলে এর জন্য উপযুক্ত মূল্য দিতেও সে রাজি। একেই অতিথি দেবতার সমান, তার ওপর ঝড়ের রাতে এই অবস্থায় শত্রুকেও ফিরিয়ে দেওয়া চলে না। আমি তাকে সানন্দে আমার ঘরের ভিতরে ডাকলাম। বিনামূল্যেই তার রাত্রিবাসের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলাম আমার ছোট্ট ঘরে। ছোকরার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম সে পেশায় জাদুকর। দেশবিদেশে জাদু দেখিয়ে মানুষজনের মনোরঞ্জন করে। পাশের গলদের গ্রামে যে মেলা বসেছে সেখানেই আজ তামাশা দেখানোর কথা ছিলো তার। কিন্ত হঠাৎ ঝড় আসায় সে মেলা ভেস্তে যায়। কাল সকালেই এখান থেকে সে আপন দেশে রওনা দেবে। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে জাদুকর ছোকরাটি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ছিলো। পরনের জোব্বাটা খুলে সে খুব তাড়াতাড়ি বিছানা ধরলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমের মাঝে নাক ডাকতে আরম্ভ করলো। রূপকথা পড়ে আর রূপকথার গল্প শুনিয়ে আমার মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল জাদুকর হওয়ার। সে শখ পূর্ণ যদিও হয়নি। কিন্তু চোখের সামনে জাদুকর ছোকরার খুলে রাখা জোব্বাটা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ওটা গায়ে দিয়ে নিজেকে কেমন লাগে দেখবার ভারী শখ হলো। জোব্বাটা গায়ে দিয়ে জাদুকরের পোঁটলা হাতড়ে একখানা আয়না বের করলাম। সেটা নিয়ে মুখ দেখতে গিয়েই তো যতো বিপত্তি। সোজা একেবারে এ দেশে এসে উঠলাম। এই দেখো আমার গায়ের পোশাক, এটা ওই জাদুকরেরই জোব্বাটা।” বলে কী লোকটা! পাগল-টাগলের পাল্লায় পড়লাম বোধহয়। এমনটা আবার হয় নাকি!

-“জানি হয়তো আমায় পাগল ভাবছো তুমি। ভাববারই কথা। কিন্তু কী জানো, এ বিশ্বের অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা নেই। এই পৃথিবীতে দু’চোখ দিয়ে তোমরা যা দেখো তার সবটার পিছনে কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করো। কিন্তু দু’চোখ খোলা রেখে ততোটুকুই দেখা যায় যতোটুকু আমাদের দেখতে দেওয়া হয়। সব জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। ঘুমের মাঝে চোখ বন্ধ করেও তো কতো জিনিস দেখা যায়। ইচ্ছেমতো ছোটোবড় জগৎ বানানো যায়। ঘুম ভাঙলেই সে জগৎ ভেঙে গেলো তেমনটা নয়। স্বপ্নের চরিত্রগুলোরও একটা জীবন আছে। তা বাস্তবের অত্যন্ত সমান্তরাল। তাছাড়া কোনটা বাস্তব কোনটা স্বপ্ন তা বলার আমরাই বা কে! যাই হোক, আমার মনে হয় তোমার আরো ক’দিন বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। কাল অফিস থেকে একবার ঘুরে আসতে পারো। সবার সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগবে। আজ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিও। আমার বাড়ি ফিরতে সুবিধে হবে। এখান থেকে টরেগারমা কম পথ নয় তো!”

ঝুপ করে কখন সন্ধে নেমে গেছে। নদীর ওপারটা আর দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটার চোখ দুটো জ্বলছে। আমি মুখ ঘোরাতে না ঘোরাতে বুড়ো লোকটা হাওয়া!

 

দুই

শৌর্য আজ অফিস এলো দীর্ঘ এক মাস পর। বাড়ি থেকে নিজের গাড়িতেই এসেছে আজ। সঙ্গে স্ত্রী অথৈ-ও আছে। হাফ-ডে অফিস করে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। শৌর্যকে এতোদিন পর দেখতে পেয়ে সহকর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। গোমড়ামুখো পুলকবাবু পর্যন্ত এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “ওয়েলকাম ব্যাক।” বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদারের ঘরে ঢুকতে তিনি ফাইল ছেড়ে শৌর্যের দিকে মন দিলেন। শরীরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, রাজনীতি-খেলা নিয়ে গল্প জুড়ে বসলেন শৌর্যের সঙ্গে। কথার ফাঁকে বড়বাবু শৌর্যের দিকে এগিয়ে দিলেন একটা কাগজ। সরকারি স্ট্যাম্প দেওয়া কাগজটা দেখিয়ে তিনি বললেন, “আরো দশদিন বিশ্রাম নাও। আমি হাই অথরিটির অনুমতি জোগাড় করে এনেছি।” কিন্ত বিশ্রাম আর ভালো লাগছে না শৌর্যের। এবার ও কাজে ফিরতে চায়। তবু বড়বাবুর মুখের ওপর কিছু বলতে পারলো না সে। লোকটাকে যতোটা খারাপ ভাবতো শৌর্য, অতোটাও খারাপ নয়। বেরনোর সময় দারোয়ানটাও শরীরের খবর নিলো। শৌর্য গাড়িতে উঠে বসতে অথৈ-এর ইশারায় ড্রাইভার ফ্লাইওভার ধরলো।

মারগারেট বিল্ডিং-এর সামনে এসে থামলো গাড়িটা। শহরের বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ সুতমাল্য মাইতির বাড়ি। শৌর্য বাড়িতে লাগানো সাইন বোর্ডের লেখাগুলো উল্টো করে পড়ার চেষ্টা করে। শব্দগুলো ওর চেনা চেনা লাগছিল। অশীতিপর বৃদ্ধ সুতমাল্য বাবু বাড়ির সামনের বাঁধানো পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিলেন। অথৈ একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে গাড়ি থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে চললো। চোখে তার জল টলটল করছে। এ অশ্রু কৃতজ্ঞতার। 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april golpo

তথাগত দত্ত

গ ল্প

ত থা গ ত  দ ত্ত

tatha

ফ্যান

রুদ্র এক কাপ কফি নিয়ে বসল, ধোঁয়া উঠছে কফি থেকে। গরম কফি। তবে বেশিক্ষণ গরম থাকবে না। ঠাণ্ডাটা ভালই পড়েছে কলকাতায়। রুদ্র একটা সিগারেট ধরাল। পরপর দু’টো রিং ছাড়ল। ঘরের জানলা দরজা বন্ধ। আস্তে আস্তে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকল উপরের দিকে। রুদ্র’র আবার আহেলির কথা মনে পড়ে গেল। 

 চার বছরের সম্পর্কটা হঠাৎ এভাবে শেষ হয়ে যাবে, রুদ্র কোনোদিনও তা ভাবেনি। রামশঙ্করবাবুর বেশ চালু ব্যবসা। শিলিগুড়িতে বড় শাড়ির দোকান। দু’জন কর্মচারী আর সঙ্গে রামশঙ্করবাবু নিজে।  রুদ্রও বিগত কিছু মাস ধরে দোকানে বসা শুরু করে দিয়েছিল। অবশ্য, দোকানে বসার পিছনে আহেলির ভূমিকা রয়েছে। রামশঙ্করবাবু, তাঁর স্ত্রী মিতাদেবী অনেক বলেও রুদ্রকে ব্যবসামুখী করতে পারছিলেন না। কিন্তু আহেলির সঙ্গে পরিচয়, তারও কিছুদিন পর ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি মিলে একটা তাগিদ তৈরি হয়েছিল রুদ্র’র মধ্যে। যার ফলে সে উপার্জনের দিকে এগোতে বাধ্য হয়েছিল। তার মানে এই নয় যে রুদ্র কর্মবিমুখ। রুদ্র আসলে শিল্পী। সে খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে। তাই ধরাবাঁধা কাজের প্রতি তার একটা ভীষণ অনীহা ছিল প্রথম থেকেই।    

কফিটা শেষ করে রুদ্র একটা অর্ধসমাপ্ত ছবি নিয়ে বসল। রুদ্র আহেলির একটা ন্যুড করা শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন আগে। তারপর পরিস্থিতির চাপে ছবি আঁকার মানসিকতা তার সম্পূর্ণভাবেই নষ্ট হয়ে গেছিল। আহেলির দু’টি স্তনের মাঝখানে হালকা একটা আলোছায়া দিতে দিতে রুদ্র’র মনে হল আহেলির কাছ থেকে দূরে থাকার জন্যই তো এরকম সামান্য একটা চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসা। তাহলে নতুন করে আবার সেই আহেলির কাছে এভাবে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণই হয় না। বুকের কাজটুকু করে নিয়ে রুদ্র মুখমণ্ডলে রঙের আস্তরণ ফেলতে শুরু করল নতুন করে। রাত বাড়তে থাকল, আর পাল্টাতে থাকল মেয়েটির মুখ। 

মুখ থেকে রুদ্র আবার বুকে চলে এলো। একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো তার মনে পড়তে থাকল। কয়েকবার মাত্র প্রদর্শিত হয়েছে তার ছবি, আপাতত। ছবি দেখে আহেলি মুগ্ধ হয়েছিল। পরিচয় আর তারপর সম্পর্ক শুরু হয়েছিল আস্তে আস্তে। আহেলি ভীষণভাবে উৎসাহ দিয়ে গেছে তাকে। বারবার বলেছে, ‘এখানে থেকে হবে না, রুদ্র। কলকাতা তোমাকে যেতেই হবে।’ এমনকী ব্যবসায় ঢোকার পর আহেলি বলেছে, ‘ব্যবসা যেন তোমার শিল্পসত্ত্বা গ্রাস করতে না পারে। একটা ছবির জন্য তোমার যা করার দরকার, তাই করবে রুদ্র।’  আর সেটাই যেন কাল হল শেষে। দিন পনেরো আগের কথা, রুদ্র একজন মহিলা মডেলকে নিয়ে কাজ করা শুরু করল। বেশ কিছু দিন সে আহেলির শরীর পায়নি, অথচ তার মনে হচ্ছিল একটা মৈথুন ভীষণ দরকার তা না হলে ছবিটা যেন ফুটছে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে কোনো ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট না করেই আহেলি এলো এবং রুদ্রকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় নিজের চোখে দেখে গেলো। রুদ্র কিন্তু নিজেকে দোষী ভাবতে রাজি নয়। আহেলি তো নিজেই বলেছে যে একটা ছবিকে বুকের গভীর থেকে তুলে আনার জন্য যা দরকার, সেটাই করবে! রুদ্র তো তাই করেছে! তাহলে ওসব কথা কি আহেলির মনের কথা ছিল না? অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও রুদ্র ব্যর্থ হয়। শেষে দু’তিন দিন আগে যখন রুদ্র খবর পেলো আহেলি বিয়ের রেজিস্ট্রি করেছে, একটি ছেলের সঙ্গে, তার আর ভালো লাগল না। ওই শহর ছেড়ে সোজা কলকাতা। চেনা শহর, স্মৃতি সবই যেন তার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছিল। 

কিছুটা মদ রুদ্র গলায় ঢেলে দিল। আজই দুপুর নাগাদ সে কলকাতায় পৌঁছেছে। জিনিসপত্র বেশি কিছু আনেনি। বাড়িওয়ালার কিছু জিনিস রয়েছে, এ দিয়েই তার কাজ চলে যাবে। তাছাড়া রান্নার তো কোনো ব্যাপার নেই। বাইরে থেকে কিনে এনে খাবে। 

রুদ্র  সিগারেট ধরাল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল ছবিটার মুখের দিকে। সে যেন চমকে উঠল। অথচ চমকে ওঠার তো কিছু নেই। একটি নারীর মুখ। যাকে সে কোনোদিনও দেখেনি। অথচ তার চোখে এমন কিছু আছে, যার ফলে তার চোখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না।

রুদ্রর কাজ বিকেল তিনটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তবে অফিসে অনেক সকালে যেতে হয়। মিন্টোপার্ক থেকে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র রবীন্দ্র সদনের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতায় আসার পর থেকে রুদ্র এমনই করে থাকে। টালিগঞ্জ থেকে মেট্রো করে রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে অফিসে চলে যায় আর ছুটির পর মেট্রো ধরার আগে রবীন্দ্র সদন চত্বরে কিছুক্ষণ সময় কাটায়, চা খায়, ফাইন আর্টসে গিয়ে প্রত্যেকটা গ্যালারি রোজ দেখে অনেকক্ষণ সময় ধরে। 

একটা ছবি, চারকোলের অসাধারণ কাজ। নিমগ্ন হয়ে রুদ্র সেটাই দেখে চলেছিল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পাশে। বুদ্ধের একটা আবক্ষ তৈলচিত্রের সামনে এক মহিলা। কালো শাড়ি, কালো স্লিভলেস  ব্লাউজ। শৌখিনতায় একটা হলদে সানগ্লাস কপালের উপর তোলা রয়েছে তাঁর। মহিলার শরীরে এমন একটা ভাষা আছে, যা যে কোনো পুরুষকেই একবার হলেও তাঁর দিকে তাকাতে বাধ্য করবে। রুদ্র তাকিয়ে রয়েছে মহিলার দিকে। তবে শুধুমাত্র এই একটা কারণেই যে সে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেটা নয়। আসল কারণটা হলো, তার আঁকা সেই ছবিটার সঙ্গে এই মহিলার ভীষণ রকমের মিল। একজন অচেনা, না দেখা মানুষকে সে যেন এঁকে ফেলেছে নিখুঁত দক্ষতায়। রুদ্র এগিয়ে গেল মহিলার দিকে।

হোয়াটসঅ্যাপে ছবিটা দেখে নন্দিতা তাঁর সমস্ত ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ তো তাঁরই ছবি। রুদ্রর কিছুটা সংকোচ ছিল, যতোই হোক নগ্ন চিত্র, নন্দিতা কীভাবে দেখবেন ব্যাপারটা! তবে সে নিয়ে অবশ্য রুদ্রকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। 

আজকাল রুদ্রর মনে হয় আহেলির সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে ভালোই হয়েছে যেন।  ও জীবনে থাকলে নন্দিতার সঙ্গে হয়তো তার দেখাই হতো না। রুদ্র বুঝতে পারছে নন্দিতাকে তার কী ভীষণভাবে দরকার। একটু বয়সে বড় সুন্দরী মহিলাদের প্রতি রুদ্র’র বরাবরই আকর্ষণ ছিল খুব। নন্দিতা তার জীবনে প্রথম মহিলা যিনি বলেছেন, ‘রুদ্র, আমি তোমার ফ্যান হয়ে গেছি।’ 

নন্দিতার স্বামী জয়দীপবাবু কলেজে পড়ান। বছর তিনেক হল তাঁদের বিয়ে হয়েছে। এখনও সন্তান হয়নি। নন্দিতা এবং জয়দীপের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সেই ছবিটা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দোতলার কোণের ঘরে টাঙানোর পর থেকে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে কি একটু হলেও চিড় ধরল! নন্দিতা অবশ্য সম্পর্কে চিড় ধরার মতো কোনো সুযোগই দিতে চান না জয়দীপকে। জয়দীপকে তিনি সোজা কথাটা সোজা ভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন, ‘জয়, আমি কিন্তু রুদ্রর সামনে কাপড় খুলিনি। দেখতেই তো পাচ্ছো, মুখ বাদে ছবিটার সঙ্গে কোনো মিলই নেই আমার। আমার বুকে তো তিল আছে, কোথায় তিল ছবিটায়? তাছাড়া আমার নাভি অনেক গভীর। ছবির মতো নয় মোটেও। আমি ওকে ভালোবাসি না জয়, ভালো তোমাকেই বাসি। আমি জাস্ট ওর ফ্যান, ব্যস এটুকুই, ওর ছবির গুণমুগ্ধ ভক্ত।’ 

নন্দিতা কিন্তু জয়দীপকে ঠকাতে চান না। কারণ জয়দীপের মতো ভালো মানুষ তেমন হয় না আজকাল। তাছাড়া জয়দীপের মতো ভালবাসা দেওয়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু রুদ্র’র প্রতি তাঁর কী যে এক আকর্ষণ, নন্দিতা এর কারণ কিছুই ভেবে বের করতে পারলেন না।

আজকাল নন্দিতার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে কিছুটা। বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়েন। বিয়ের ঠিক পর পরই জয়দীপ টালিগঞ্জে ছোট দোতলা এই বাড়িটা কিনেছেন। যাদবপুরের বাড়িটা একতলা, মাত্র দুটো ঘর সেখানে। ও বাড়ি এখন ফাঁকা পড়ে থাকে। টালিগঞ্জ থেকে মেট্রো ধরে নন্দিতা রুদ্র’র মতোই চলে আসেন রবীন্দ্র সদন। বসে অপেক্ষা করেন রুদ্র’র জন্য। অফিস শেষ করে রুদ্র চলে আসে। তারপর দু’জনের  মনের মতো করে কিছুটা সময় কাটানো। পুড়তে থাকা সিগারেটে ভাগাভাগি করে চুম্বন, আড্ডা, একসঙ্গে সিনেমা দেখা। নন্দনের নান্দনিক অন্ধকারে হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট। 

রামশঙ্করবাবু রুদ্র’র এই কলকাতায় পড়ে থাকা নিয়ে ভীষণ রুষ্ট। এর আগে দু’বার টাকা পাঠালেও আর তিনি টাকা পাঠাবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। এসব সমস্যার কথা রুদ্র বলে চলেছিল। নন্দিতা বেশ কয়েকদিন ধরেই রুদ্রকে অফিস ছুটি নিয়ে ওঁর বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলেন। সারাটা দুপুর নিভৃতে কাটালে দুজনেরই মন ভাল হবে। ‘কাল এসো রুদ্র, আমি অপেক্ষা করব’, বলে নন্দিতা এগোতে থাকলেন দ্রুত পায়ে। রুদ্র আর এগোল না। সিগারেট ধরাল। দু’জনেরই গন্তব্য টালিগঞ্জ, তাই রুদ্র আর নন্দিতার সন্ধ্যাগুলো একসঙ্গে মেট্রো সফরের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় রোজ।

দেখতে দেখতে বসন্ত এসে গেল। দোলটা জয়দীপ আর নন্দিতা শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে এলেন দিন কয়েকের জন্য। এই সময়টা রুদ্র বেশ একাকিত্বে কাটিয়েছে। বেশ কয়েকদিন রুদ্র অফিসে যাওয়া বন্ধ করায় তার চাকরিটা গেছে। অফিসে না গিয়ে সে নন্দিতার বাড়িতে যায় দুপুরবেলা। নন্দিতা খুব অবাক হন জয়দীপের ব্যাপারে। জয়দীপ কি তাঁর চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারেন না যে তিনি কী গভীরভাবে ডুবে আছেন অন্য এক পুরুষের প্রেমে!  অবশ্য চোখে চোখ রেখে রুদ্র’র প্রতি তাঁর ভালবাসা বোঝার দরকার হয় না, কারণ ওঁরা দু’জনে গল্প করতে বসলে আজকাল নন্দিতা বেশিটা সময় রুদ্র’র কথাই বলেন জয়দীপকে। কী অদ্ভুত মানুষ এই জয়দীপ। নন্দিতাকে নিজের বুক দিয়ে আগলে রাখেন। রুদ্রর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র রাগ নেই! 

রুদ্র এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি এঁকেছে। নন্দিতার মতো মেয়ে জীবনে থাকলে সৃষ্টির একটা আলাদা উৎসাহ পাওয়া যায়। নন্দিতা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলেছেন, ‘রুদ্র, এখন আমার একটাই পরিচয়, আমি তোমার ফ্যান।’ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট দেখে এক ভদ্রলোকের কয়েকটা ছবি বেশ পছন্দ হয়েছিল। তিনি আজ কিনে নিয়ে গেলেন। অবশ্য তরুণ শিল্পীর আঁকা ছবি তো, কেউ তেমন দাম দিতে চায় না। রুদ্র’র এই টাকাটা ভীষণ দরকার ছিল। হাতের লক্ষ্মীকে সে পায়ে ঠেলতে পারেনি। 

ফাল্গুনের মাঝামাঝি গরম পড়তে শুরু করেছে। একটা পাখার দরকার হয়ে পড়ল। যদিও রুদ্র’র এখন ফ্যান কিনে পয়সা নষ্ট করার ইচ্ছে নেই মোটেও। কিন্তু কিছু করারও নেই। সন্ধ্যার দিকে রুদ্র পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ানের দোকানে গেলো। কখন যে কার হাতে কী চলে আসে, তা কেই বা বলতে পারে! আজ সকালেই নাকি এক ভদ্রলোক পুরনো একটা সিলিং ফ্যান বিক্রি করে গেছিলেন। অজিতবাবু সেটা রুদ্রকে ভাড়ায় দিতে রাজি হয়ে গেলেন। তখনই একটি ছেলেকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন রুদ্র’র সঙ্গে। পাখা লাগানো হয়ে গেলো। দু’দিন আগে ভাড়া করা পাখা নিয়ে রুদ্র’র কথা হচ্ছিল নন্দিতার সঙ্গে। নন্দিতা অবশ্য বলেছিলেন, ‘রুদ্র, দিনকাল পাল্টে গেছে, কলকাতায় আজকাল ভাড়ায় আর পাখা পাওয়া যায় না। পাখা তো দূরের কথা, দেখছোই তো এখন ঘরে ঘরে এসি।’ তারপর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একটা হাইস্পিড ফ্যান কিনে দিই তোমাকে, রুদ্র?’ রুদ্র অবশ্য সেই প্রস্তাব তখনই নাকচ করে দিয়েছিল। 

এইসব ছোটখাটো প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তিতে খুশি হওয়ার নামই জীবন। পাখার হাওয়া লেগে তার মনটা যেন ফুরফুর করে উড়ছে। নন্দিতাকে খবরটা জানানোর সে জন্য পকেট থেকে ফোন বের করল। কিন্তু খবরটা তাকে আর জানানো হল না। হোয়াটসঅ্যাপে নন্দিতার টেক্সট মেসেজ জমে আছে- ‘রুদ্র, পিরিয়ড মিস করেছিলাম। সন্দেহ হল, প্রেগা টেস্ট করে দেখছি আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট। রুদ্র, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। কী করবে এখন তুমি?’

রুদ্র কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। তার মনে হল পৃথিবীর সমস্ত ভার যেন তারই মাথায় চেপে বসেছে। সে ফোন করল নন্দিতাকে বেশ কয়েকবার। রিং হয়ে থেমে গেল। বাধ্য হয়ে টেক্সট করল তারপর। সীন হয়ে পড়ে রইল তার সমস্ত মেসেজ। কোনও রিপ্লাই এলো না।

রাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল রুদ্র’র। সে চোখ খুলে তাকাল আর নাইট ল্যাম্পের অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোয় সে দেখল মাথার উপর পাখাটা ঘুরছে বনবন করে। মৃদু আলো ফ্যানের ব্লেডে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কী এক রহস্যময় দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রুদ্র’র মনে হল সে যদি গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে পড়ে তাহলে তার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হবে মুহূর্তে। তার পরেই রুদ্র’র মনে হলো কী সব ভয়ংকর কথা সে ভাবছে! তার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? সে কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছে? এক লাফে সে বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। দরজা খুলে এসে দাঁড়াল এক চিলতে ব্যালকনিটায়। একটা সিগারেট ধরাল। সারা রাত তার আর ঘুম এলো না। 

সারা রাতের দুশ্চিন্তা আর রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে সে পরের দিন দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। হোটেলের ঘরে এক ব্যক্তি নাকি গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল, তারপর থেকে ওই পাখা চালিয়ে যে-ই শুয়েছে তারই নাকি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে— এমন একটা ঘটনার কথা রুদ্র শুনেছিল। ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষণ। তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। 

কলকাতায় আসার পর প্রায় আড়াই মাস কেটে গেছে। একবারও সে বাড়ি ফেরেনি। প্রথম প্রথম মা ফোন করে খুব ডাকাডাকি করতেন, আজকাল তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কলকাতার পরিবেশ কেমন একটা দমবন্ধকর হয়ে ওঠায় রুদ্র বাড়ি ফিরেছে আজ। মা ভীষণ খুশি, ‘বাবা, তুই জানিয়ে এলে কতো কিছু রান্না করে রাখতাম, এখন আমার হুটোপাটি লেগে যাচ্ছে।’ রামশঙ্করবাবুও খুশি হয়েছেন যথেষ্ট, কিন্তু মুখে তেমন কিছু প্রকাশ করলেন না। 

রুদ্র’র এখন বাড়ি ফেরার আরেকটি কারণ হল টাকা। সে ঠিক করেই এসেছে বাবার কাছে টাকা চাইবে এগজিবিশনের কথা বলে। না পেলে সে বাবার সিন্দুক থেকে চুরি করতেও পিছপা হবে না। কারণ টাকাটা তার চাই-ই চাই। ব্যবসার কারণে রামশঙ্করবাবুকে ভালো অ্যামাউন্টের ক্যাশ রাখতে হয় নিজের কাছে। রুদ্র আসলে নন্দিতার গর্ভপাত করাতে চায়। আর এই সব ইললিগ্যাল অ্যাবরশান করাতে টাকা কেমন জলের মতো বেরিয়ে যায়, সে তো সকলেরই জানা। 

শিলিগুড়িতে গরম নেই। পাখা চালানোর দরকার ছিল না, তবুও একটা উদ্দেশ্য নিয়েই রুদ্র গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে পাখা চালিয়ে শুলো। সারারাত ধরে সে ঘুমাল, অনেকদিন পর খুব সুন্দর একটা ঘুম হল তার। 

পরের দিন সকালবেলাটা তার আশ্চর্যজনকভাবে শুরু হল। হোয়াটসঅ্যাপে নন্দিতার টেক্সট- ‘আমি দেখছিলাম তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি কিনা। নাহ্, পারলাম না। বিয়ে করবে আমাকে? মানছি জয়দীপের মতো মানুষ হয় না। কিন্তু আমাকে তো একজনকে বেছে নিতে হবে। আমি না হয় তোমাকেই বেছে নিলাম রুদ্র। তুমি নেবে না আমাকে?’

এরপরে আর কোনো কথা থাকতে পারে না। ব্রেকফাস্ট করেই রুদ্র কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। অনেকদিন পর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। তাছাড়া বাপের টাকা চুরি করেও তাকে পাপের বোঝা বাড়াতে হলো না। 

ক্লান্ত ছিলো, তবু রুদ্র’র ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে সে উঠে বসল বিছানায়। তার সারা শরীরে ঘাম। পাখাটা দ্রুত ঘুরে চলেছে। সে পাখার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। পাখার স্যুইচ অফ করল। তার মনে হলো সত্যিই যেন কিছু রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই ফ্যানের মধ্যে। সে একটা চেয়ার নিয়ে খাটের উপর রাখল। তারপর চেয়ারের উপর উঠে ভালো করে দেখতে থাকল পাখাটাকে। অনেকক্ষণ চলায় বেশ গরম হয়ে রয়েছে পাখাটা। 

পরের দিন পুলিশ দরজা ভেঙে রুদ্র’র ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে নিয়ে গেল পোস্টমর্টেমের জন্য। নন্দিতা এই খবরটা কয়েকদিন পর পেলেন। তারপর থেকে তাঁর শরীর এবং মন দুটোই খারাপ হতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। নন্দিতার আজকাল মনে হয় খুব ভুল করেছেন তিনি। জয়দীপই তাঁর প্রকৃত বন্ধু, প্রকৃত ভালবাসা। এখন তিনি তীব্রভাবে ফিরে আসতে চাইছেন জয়দীপের কাছে কিন্তু পারছেন না। কিন্তু এই সন্তানের পিতৃপরিচয় কীভাবে জানাবেন তিনি জয়দীপকে? 

জয়দীপ এখন রাতে পাশের ঘরে শোন। তার কারণ, তিনি আজকাল সিগারেট খাওয়া ধরেছেন। ধোঁয়ায় নন্দিতার অসুবিধে হোক তা তিনি চান না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে নন্দিতাকে, ওষুধ চলছে।

পুলিশের তদন্ত মিটে গেল খুব দ্রুত। এটা যে আত্মহত্যা, সে বিষয়ে কারোরই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যে ভদ্রলোক ওই পাখাটা অজিতবাবুকে বিক্রি করে গেছিলেন, তিনিই আবার সেই পাখাটাই কিনবেন বলে দোকানে এসে হাজির। অজিতবাবু একটু অবাকই হলেন তারপর ভাবলেন, ভালই হল। ‘আপনার বাড়িটা বলে যান, আমার কাজের ছেলেটাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠাচ্ছি।’

রবিবারের দুপুর।  ভদ্রলোকটি ভাত বসিয়েছেন তখন। ইলেকট্রিশিয়ান ছেলেটি কাজ শেষ করে বেরিয়ে যেতে যেতে এমনিই জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, রান্নার কতদূর?’ 

হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। মুখটাকে কিছুটা চেপে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে জয়দীপ উত্তর দিলেন, ‘এখন শুধু ফ্যান গালা বাকি।’ 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april goddyo

উদাসীন তাঁতঘর | পর্ব ৭

উ দা সী ন  তাঁ ত ঘ র পর্ব ৭

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

pankaj

অপ্রস্তুত এই তরবারি

এই তো এক দশকেরও বেশ কিছু আগে একটি ছোটো পত্রিকার ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল ‘ অন্য ধারার বাংলা উপন্যাস।’ সেখানে প্রধানত উল্লেখ্য ছিলেন সত্তরের এক ঝাঁক লেখক। তাঁরা ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এমনকী পাঠকপ্রিয়। স্থানীয় গ্রন্থাগারেও তাঁদের বই পাওয়া যায়। অর্থাৎ শহর- মফস্সলে পাঠকের চাহিদা আছে। তবুও সম্পাদক তাদের ‘অন্যধারা’ বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন। কেন? তাহলে কি মূলধারার বাইরে এই অক্ষরযাপন? মেইনস্ট্রিম বলে কথা সাহিত্যের স্বতন্ত্র এক মান্যধারা আছে তা কি প্রতিষ্ঠান আর মিডিয়া গেঁথে দিয়েছে আমাদের মগজে? আমরা কি সহজেই মেনে নিয়েছি শীর্ষেন্দু- সুনীল- সমরেশ মেইনস্ট্রিম আর কিন্নর- অমর-সৈকত-রামকুমার বিকল্প বা অন্যধারা? সত্যজিৎ- ঋত্বিক প্যারালাল আর অঞ্জন চৌধুরী- স্বপন সাহা মেইনস্ট্রিম? এতদিন পর এসব প্রশ্নে মিথ্যে এক গোলোকধাঁধা সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে। পাঠকের অধিকার সংকুচিত করে এই বিভাজনের রাজনীতি কয়েক দশক ধরে চলছে। রুচির প্রশ্নটি অতিনিরূপিত। রুচির সমগ্রতা কেবলই সন্দেহপ্রবণ এক নিরপেক্ষতা।

পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে এই সংকট ছিল পাঠকের দিক থেকে কিন্তু বিভাজনের জল অচল স্পষ্ট করে দেননি কোনো সম্পাদক বা প্রকাশক। তাই জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা রতন ভট্টাচার্যের মতো সৎ লেখকের লেখায় পুষ্ট হত বিগ হাউস। বনফুল বা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস , বুদ্ধদেব গুহ বা মতি নন্দীর ছোটগল্প পাশাপাশিই ছিল। এর পাশাপাশি বিপুল পাঠক ছিল শক্তিপদ রাজগুরু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, প্রফুল্ল রায়ের। বরেন গঙ্গোপাধ্যায়,দেবেশ রায়ের পাঠক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ পড়েছেন স্বচ্ছন্দে। অমিয়ভূষণ বা কমলকুমার দুই মজুমদারের পাঠক তাঁদের ভালোবেসেছেন ভিন্নপথকে গুরুত্ব না দিয়েই। বাংলাদেশ সীমান্তের এক গ্রাম্য পাঠাগারে এই তো সেদিন একজন গবেষক খুঁজে পেলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস । তখনও তাঁর উপন্যাসসমগ্র ছিল দুরাশা মাত্র। আবার মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামীণ লাইব্রেরীতে দশ বছর আগে কবিতা সিংহর অনেক দুর্লভ উপন্যাসের দেখা মিলল যার হদিশ দিতে পারেনি অনেক জেলা গ্রন্থাগার। সর্বত্র পাঠকই শেষ কথা।

সত্তরের সূচনায় দৃশ্যটি আমূল বদলে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যর চেহারা নগ্ন হয়ে গেল অনেকখানি। সমরেশ বসু কে কিনে নিলেন আনন্দ বাজার। তাদের হাউসের বাইরে অন্যত্র লেখা নিষিদ্ধ হল। সুনীল- শীর্ষেন্দু-সমরেশ আরও অনেক প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত মেনে নিলেন। যেকোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চিহ্নিত হল ‘ অন্য ধারা’ বলে। বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সুবিমল মিশ্রর সৎ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক চেহারায় সেইদিন পাঠক ছিলেন অপ্রস্তুত। রমানাথ রায়- বলরাম বসাক- শেখর বসুর ছোটগল্পের আরেকরকম চেহারা দেখলেন পাঠক। সেদিনের সব পুরস্কার জিতে নিচ্ছেন মিডিয়াধন্য লেখকেরা। তাঁরাই কমিটি, তাঁরাই পুরস্কার। তাঁরাই শেষকথা। তাঁরাই চুল্লির কিছুটা আগে অভিশপ্ত শেষ কিংবদন্তি। শুধু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়,বিমল মিত্র, নারায়ণ সান্যালের জনপ্রিয়তায় তাঁরা শোচনীয় পরাজিত। পাঠকের ‘ দুপুরের ঘুম’ কে অভিশাপ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।

কথা সাহিত্যের যখন এই অবস্থা তখন কবিতা র ক্ষেত্রটি কেমন? জীবনানন্দকে মেইনস্ট্রিম না বলে আমাদের উপায় ছিল না। বিষ্ণু দে থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে আমরা প্রধান কবির মর্যাদা দিয়েছি। পঞ্চাশের কবিরা মিডিয়ার দৌলতে ধুম মাচিয়েছে কয়েক দশক। বলতে চেয়েছে জীবনানন্দ পরবর্তী আমরাই প্রধান কবি। শক্তি- সুনীল – শঙ্খ ছিলেন প্রধান উপাস্য। তরুণ কবিদের কাছ থেকে আদায় করেছেন বিগ্রহের যাবতীয় উপাচার। এই আবহাওয়ায় বানিজ্য বিস্তার সুবোধ সরকার বা জয় গোস্বামীর। কিংবদন্তির ছায়া গিলে নিচ্ছে শহর- মফস্সল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর মুখ থুবড়ে পড়ল যাবতীয় কিংবদন্তি। গত কুড়ি বছরে পাঠকের তালিকায় প্রধান কবি হিসেবে উঠে এসেছেন উৎপলকুমার বসু, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়,প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মনীন্দ্র গুপ্ত,দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কবি। অনেক কিংবদন্তি কবির যজমানি বন্ধ। বাংলা কবিতার পাঠককে ধন্যবাদ শত প্রলোভন সত্ত্বেও তারা কবিতায় মেইনস্ট্রিম বা অন্যধারার কবিতার বিভাজনে আস্থা রাখেন নি। আবহমানকালের বাংলা কবিতায় আস্থা রেখেছেন।

বাংলা কথাসাহিত্যের সমস্যা অবশ্য অন্য এবং অন্যত্র। কথাসাহিত্য কে আজও লড়তে হয় গল্পপিপাসু পাঠকের বিরুদ্ধে। আজও ‘ একটু পাহাড়,একটু প্রেম, একটু ভ্রমণ আছে’ এমন দাবি মেনে উপন্যাসের নাম সাজেস্ট করতে হয় বিভিন্ন গ্রুপে। আশুতোষের পাঠকের জ্যোতিরিন্দ্র পড়ার হৃদয় ছিল একদিন। আজকের পাঠকের সেটুকুও অবশিষ্ট নেই। তবুও ভাঙছে প্রবণতা। কিন্নর থেকে রবিশঙ্কর বল বা মানিক চক্রবর্তী থেকে কনিষ্ক ভট্টাচার্য-শাক্যজিৎ- অনির্বাণ বসু কে আজ আর অন্যধারা বলে ভাবতে রাজি নই আমরা। আবহমানকলের সাহিত্যে কোনো প্রধান ধারা নেই ।পাঠক প্রস্তুত। অপ্রস্তুত মিডিয়ার জন্য আমাদের সান্ত্বনা পুরস্কারও নেই।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april goddyo

প্রচ্ছদ কাহিনী | এপ্রিল সংখ্যা

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

বা প্পা দি ত্য   রা য়   বি শ্বা স

bappa2

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমকাহিনীগুলো প্রেম ছাড়াও আরো অনেককিছুকে আঁকড়ে রাখে। আসলে তারা প্রত্যেকেই অপ্রেমকে দূরে রাখার এক একটি দুরন্ত ম্যানুয়াল। না, এই কথাগুলো বিখ্যাত কেউ বলেননি। অ্যান্টিপ্রেম শব্দটা সাদা কাগজের উপর লিখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারই হঠাৎ মনে এল…

“যুবতী কিছু জানেনা, শুধু

 প্রেমের কথা ব’লে 

 দেহ আমার সাজিয়েছিল

 প্রাচীন বল্কলে

 আমিও পরিবর্তে তার

 রেখেছি সব কথা:

 শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি

 আগুন, প্রবণতা”        

(শঙ্খ ঘোষ, কবিতা: প্রতিহিংসা, কাব্যগ্রন্থ: নিহিত পাতালছায়া)

 কী জানে না যুবতী? কী তার জানা শ্রেয় ছিল?না জেনে কী করেছে? তার কি আর একটু দায়িত্বশীল হওয়ার কথা ছিল?তা না হয়ে নিছক প্রেমের কথা বলাটা তার উচিত হয়নি? তার ফলে কী হয়েছে? তার প্রেমিকের দেহ প্রাচীন বল্কলে সেজে উঠেছে৷ প্রাচীন বল্কলটি কীসের পরিচায়ক?বন্ধনের, বাধ্যবাধকতার, একমুখীনতার– প্রেমের পরিণতি হিসেবে যে সমস্ত সংস্কার সময়লালিত? পরিবর্তে প্রেমিকটি কী করেছে? নিছক প্রেমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বল্কলে বেঁধে ফেলার খেসারত দিতে বাধ্য করেছে যুবতীটিকে। অগ্নিস্নাত হয়ে তাকে শিকার হতে হয়েছে দহনপ্রবণতার।

 প্রশ্ন হল– আমরা এই উচ্চারণ কোন ঘরে রাখব? বিরহের মেদুরতা বা মেলানকলি তো এর নেই, নেই তথাকথিত প্রেমের সমর্পণ বা আকুলতাও। প্রেমের খানিক বিপ্রতীপে এর অবস্থান, যদিও বিরহের পথ ধরে নিষ্ক্রমণের অভীপ্সার  কোনো পরিচয়ও তেমনভাবে মেলে না। যেটা মেলে তা এক অভিযোগপ্রবণতা; অন্তর্লীন ক্ষোভ — মানুষটাকে পেয়েও না পাওয়ার, পুরোটা না পাওয়ার, পুরোটা পেয়েও ধরে রাখতে না পারার, বা যেমন করে যেমন রূপে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল তেমন করে না পাওয়ার। ঘর্ষণে ঘর্ষণে সংঘাতের অনিবার্য ফুলকিরা উড়তে থাকে, যে কাঠের টুকরো দুটো ভেবেছিল ‘নাই, রস নাই’ তারাই পরিণত হয় দারুন চকমকি দুটো পাথরে, আবিষ্কৃত হয় আগুন আর এই আগুনেই হয়তো উজ্জ্বল স্নানে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে তাদের প্রেম। আরো একবার কালের কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে। এই দ্রোহ, এই তর্জনী উত্তোলনকারী আপাত সন্ত্রাসের নামই  অ্যান্টিপ্রেম, অ্যান্টিহিরোর মতোই যার অভাবে প্রেম তার ভাস্বর রূপটার সঙ্গে আলাপে অক্ষম রয়ে যায়।

 “চাব না তোমার চোখে আঁখিজল পাবো আশা করি

 রাখিবারে চিরদিন স্মৃতিরে করুণারসে ভরি।……

 ভুলে যাওয়া কথাগুলি কানে কানে করায়ে স্মরণ

 দিব না মন্থর করি ওই তব চঞ্চল চরণ

 তারপরে যেয়ো তুমি চলে

 ঝরাপাতা দ্রুতপদে দ’লে

 নীড়ে ফেরা পাখি যবে অস্ফুট কাকলিরবে

 দিনান্তেরে ক্ষুব্ধ করি তোলে।”

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতা: শেষ বসন্ত, কাব্যগ্রন্থ: পূরবী)

কবিতাটির রচনাকাল ২১শে নভেম্বর ১৯২৪। কবি তখন ‘বিজয়া’ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায়, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ারিসে সফররত। নিমগ্ন পাঠকের মনে এই কবিতা যেন ছায়া ফেলে এক বিদায়লগ্নের — এক প্রিয় মানুষের সঙ্গে অনিবার্য বিচ্ছেদের। বিচ্ছেদের ক্ষণ যত ঘনিয়ে আসে অবচেতনের অভিযোগের তির ছুটে যায় অভিযুক্তের দিকে, নালিশ ওঠে তার “চঞ্চল চরণ”-এর প্রতি, ” “আঁখিজল” মোচনের অনীহার প্রতি। কবিমানসে অ্যান্টিপ্রেমের এই অস্থিরতা আমাদের শুধু সচকিত নয়, মুগ্ধও করে।

 বিরহ নয়, ঝটিতে অ্যান্টিপ্রেমের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন জীবনানন্দ দাশ:

“অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল, / অনেক কমলা রঙের রোদ; / আর তুমি ছিলে; / তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না, / খুঁজি না।” 

(কবিতা: নগ্ন নির্জন হাত, কাব্যগ্রন্থ: বনলতা সেন )

‘দেখি না’ অবধি যা ছিল বিরহের উচ্চারণ, ইচ্ছাকৃত ‘খুঁজি না’-য় কবিমানসের অভিমানহত মুখটা সটান সামনে চলে এল, প্রাধান্য পেল অ্যান্টিপ্রেম। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুদর্শনা’ কবিতায় রূঢ়তা অন্য মাত্রা পায়:

“এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন / তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো; / সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে / সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।”

 এই রূঢ়তাও যেন কবি অতিক্রম করে যান একই কাব্যগ্রন্থের ‘ইহাদেরই কানে’ কবিতায় — শামিল হন অ্যান্টিপ্রেমিক যুবকদের অন্তর্লীন বেদনায়:

“একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে — একবার বেদনার পানে / অনেক কবিতা লিখে চলে গেল যুবকের দল; / পৃথিবীর পথে পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে / শুনিল আধেক কথা; — এইসব বধির নিশ্চল / সোনার পিত্তলমূর্তি: তবু আহা ইহাদেরি কানে / অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল, / একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে, একবার বেদনার পানে।”

 কবির নির্জন শ্লেষে ‘মূর্খ সসম্মানে’ শব্দবন্ধের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

 অ্যান্টিপ্রেমসঞ্জাত অনুযোগ প্রায়শই পুঞ্জীভূত হয় প্রিয় মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশের অনীহার কারণে — নিরর্থক আত্মাভিমানের পরতে পরতে। অমিয় চক্রবর্তীর কথায়: 

“গতিময় ফুলবৃন্ত, চলন্ত বকুল / এনেছিলে স্তব্ধতার ভুল — / সুরভি কোরক ওগো, অনিন্দ্য প্রেমের পুষ্পভার / — কোথাও চিহ্নই নেই আর।।”

(কবিতা: স্রোতস্বিনী, কাব্যগ্রন্থ: পুষ্পিত ইমেজ)

সত্যিই কি চিহ্ন থাকে না? তবে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর আইকনিক ‘শাশ্বতী’-তে কেন বলেন:

“স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি সম / সে রোমরাজির কোমলতা ঘাসে ঘাসে; / পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম; / কিন্তু সে আজ আর কারে ভালবাসে। / স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে / আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা…”

(কাব্যগ্রন্থ: অর্কেস্ট্রা)

 নিসর্গের বর্ণ ও অনুভবের মধ্যে প্রেমিক খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে। সমস্যা হল “সে আজ আর কারে ভালবাসে”। অভিমান আসলে অজান্তেই কখনো কখনো সূক্ষ্ম গণ্ডিটুকু পেরিয়ে পৌঁছে যায় অধিকারে, মালিকানায়, দাবি রাখে একনিষ্ঠ মনোযোগের। আমাকে আর ভালবাসে কিনা তার থেকে প্রধানতর হয়ে ওঠে “আর কারে ভালবাসে”র যন্ত্রণা! মন খাড়া করে ফেলে এক বাইনারি তত্ত্বের — “আর কারে ভালোবাসে” মানে আমায় আর বাসে না। ইগো নিজের ভালোবাসাটাকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পরিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করে self gratifying অঙ্গীকার — পরবর্তী পংক্তিতে :

“সে ভোলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে / আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।।”

 এই অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থেরই আরেকটি কবিতা ‘মার্জনা’র দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব:

” ক্ষমা? ক্ষমা?কেন চাও ক্ষমা? / নিরুপমা / আমি তো তোমার ‘পরে করিনি নির্মাণ / অভ্রভেদী স্বর্গের সোপান; / স্থাপিনি অটল আস্থা বিদায়ের দিব্য অঙ্গীকারে; / ভাবিনি তোমারে নিষ্ঠার প্রস্তরমূর্তি, অমানুষ, স্থবির, নিষ্প্রাণ; / ভুলিনি তো তুমি মুগ্ধ নিমেষের দান।।”

 প্রেমিকসত্তা স্থির জানে যে উল্লেখিত ‘ভুল’গুলোই  সে করেছে। অথচ তার দয়িতা যখন ফিরে আসার লক্ষণ দেখায়, কতটা ক্ষিপ্রতায় সে তিরের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেয় অন্যদিকে! আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির সামনে নিজের উজ্জ্বলতম রূপটির উপস্থাপনের প্রয়োজন আছে বৈকি! একইসঙ্গে প্রয়োজন আছে নিজের অহং রক্ষার। তাই সে স্মরণ নেয় অ্যান্টিপ্রেমের। কল্যাণী প্রেম — আজ কটাই বা পড়ে আছে পৃথিবীতে?

 অনুযোগ কখনও এতটাই পরিব্যাপ্ত হয়ে ওঠে যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলম থেকে বেরিয়ে আসে বিতৃষ্ণা সুলভ উচ্চারণ :

“ফুলকে দিয়ে / মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই / ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই। / তার চেয়ে আমার পছন্দ / আগুনের ফুলকি — / যা দিয়ে কোনোদিন কারও মুখোশ হয় না।”

(কবিতা: পাথরের ফুল, কাব্যগ্রন্থ: যত দূরেই যাই )

 একই কবিতায় অনতিবিলম্বেই তিনি বলে ওঠেন:

“কাঁধ বদল করো / এবার / স্তূপাকার কাঠ আমাকে নিক। / আগুনের একটি রমণীয় ফুলকি / আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা / ভুলিয়ে দিক।”

 মিথ্যেবাদী ফুলসাজ আমাদের কাছে কখনও এতটাই অসহ্য হয়ে ওঠে যে অগ্নিদাহের যন্ত্রণাও তুলনায় শুশ্রূষা প্রদানকারী বলে গণ্য হয়। ‘ চিরকুট’ কাব্যগ্রন্থের ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ কবিতায় কবি প্রণয়পিপাসু দিগভ্রান্তের ক্ষতে প্রলেপ দেন:

“হে দিগভ্রান্ত, আমি তো বুঝি — / তোমার জটিল হারানো পথে / বাতি যে ধরব, সেটুকু পুঁজি / আলেয়ার নেই। আমার মতে, / এসো আজ এই জটিল পথে / ঠিকানা বদলে প্রণয় খুঁজি।”

 আধুনিক বাংলা কবিতায় পরিবর্তনের প্রথম কাণ্ডারী বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় বিক্ষত মনকে নারীর দিক থেকে ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় রেখেছেন:

“এ জীর্ণ পাতার স্পর্শ নারীমাংস চেয়ে সুখকর, / মলাটে ধূলির গন্ধ — মুখমদ্য তার তুল্য নয়, / গ্রন্থের অক্ষয় গ্রন্থি — পরিপূর্ণ, প্রবল প্রণয়, / এই প্রেমে সমাসীন স্বপ্নলব্ধ পরম সুন্দর। / হেরিতেছে একসঙ্গে শত শিল্প, সংগীত, কবিতা, / কারুকার্য, চারুকলা, মাধুর্যের নাহি পরিসীমা।”

(কাব্যগ্রন্থ: বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা)

 কবি বলে ফেলেন যে তাঁর কাব্যরচনায় পদার্পণ incidental, দ্রোহজাত:

“আমি যে রচিব কাব্য, এ উদ্দেশ্য ছিল না স্রষ্টার। / তবু কাব্য রচিলাম। এ গর্ব বিদ্রোহ আমার।”

একই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রেমিক’ কবিতায় সম্মুখীন হই অ্যান্টিপ্রেমের ভলকে বেরোনো ক্যাথার্সিসের:

“মোরে প্রেম দিতে চাও? প্রেমে মোর ভুলাইবে মন?/ তুমি নারী কঙ্কাবতী, প্রেম কোথা পাবে? / আমারে কোরো না দান, তোমার নিজের যাহা নয়। / ধার করা বিত্তে মোর লোভ নাই; সে ঋণের বোঝা / বাড়িয়া চলিবে প্রতিদিন — যতক্ষণ সেই ভার সর্বনাশ না করে তোমার।”

 অ্যান্টিপ্রেমের উৎসার প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে কটুভাষণের গণ্ডি। এই তিক্ততাই পরিশীলিত অথচ রক্তক্ষরণে লা জবাব হয়ে ওঠে একই কবিতার পরবর্তী কয়েকটি পংক্তিতে:

“সুন্দর না হলে যদি জীবনের পাত্র হ’তে কোনো ক্ষতি, ক্ষয় নাহি হয়, / সুন্দর হবার গূঢ়, দুরূহ সাধনা– / ক্লেশকর তপশ্চর্যা / কে আর করিতে যায় তবে?

 সব আমি জানি, তবু — তাই ভালবাসি, / জানি বলে আরও বেশি ভালবাসি। / জানি শুধু ততদিন তুমি রবে তুমি, / যতদিন রবে মোর প্রিয়া।”

 ত্রুটিগুলো চোখে পড়ছে, প্রকট হয়ে উঠছে। যেমন ভাবা গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি তো নয়। তবু পাত্র যে প্রায় উপুড় করে সবটুকু দেওয়া হয়ে গেছে, নিতান্ত ফিরিয়ে না দিলে আর তো ফেরার উপায় নেই! অতএব অ্যান্টিপ্রেমের এই উৎসারেই যেটুকু নিরাময়।

 নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শালপ্রাংশু উচ্চারণে অনুরণিত হয় বিক্ষুব্ধ নির্দেশ:

“আংটিটা ফিরিয়ে দিয়ো ভানুমতী, সমস্ত সকাল / দুপুর বিকেল তুমি হাতে পেয়েছিলে। / যদি মনে হয়ে থাকে, আকাশের বৃষ্টিধোয়া নীলে দুঃখের শুশ্রূষা নেই, যদি / উন্মত্ত হাওয়ার মাঠে কিংশুকের লাল পাপড়িও / না পেরে থাকে রুগণ বুকে সাহস জাগাতে। / অথবা সান্ত্বনা দিতে বৈকালের নদী, — / আংটিটা ফিরিয়ে দিয়ো সন্ধ্যার সহিষ্ণু শান্ত হাতে।

 আংটিটা ফিরিয়ে দিয়ো, এ আংটি যেহেতু তারই হাতে / মানায়, যে পায় খুঁজে পত্রালির ভিড়ে / ফুলের সুন্দর মুখ, ঘনকৃষ্ণ মেঘের শরীরে রৌদ্রের আলপনা।“

(কবিতা: আংটিটা, কাব্যগ্রন্থ: অন্ধকার বারান্দা )

 সম্বোধিত সত্তার নাম নির্বাচনটি সচেতন পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। ভানুমতী তো তিনিই যিনি ‘খেল’ প্রদর্শনে পারদর্শী!

 এই অ্যান্টিপ্রেমই এক অমোঘ ভাস্বরতা পায় নীরেন্দ্রনাথের ভিন্ন এক উচ্চারণে। প্রেম, অস্থিরতা, দ্রোহ পার হয়ে এক চিরন্তন সত্যের শিহরণ তোলে শরীর ছাড়িয়ে মননে:

“বরং দ্বিমত হও আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়। / বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। / বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। / অন্তত আর যা-ই করো, সমস্ত কথায় / অনায়াসে সম্মতি দিও না। / কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, / তারা আর কিছুই করে না, / তারা আত্মহননের পথ পরিষ্কার করে।………./ ওই দেখো কয়েকটি অবিবাদী স্থির / অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়। / পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি। / ওরা আর তাকাবে না ফিরে! / ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা একমত হতে হতে কুতুবের সিঁড়ি বেয়ে / ঊর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।”

(কবিতা: মিলিত মৃত্যু, কাব্যগ্রন্থ: নিরক্ত করবী)

 প্রেমের সিরাপে আশিরনখ ভিজে বিচার-বিবেচনাহীন হয়ে নিজস্বতা বিসর্জন দেওয়ার মেষপ্রবণতাকে কবি বিদ্ধ করেছেন তাঁর অ্যান্টিপ্রেমের প্রখর শরে। অথচ আজও সেরকম গভীরতায় সমৃদ্ধ মনের মানুষ বিরল যাঁর চোখে জ্বলে উঠবে লক্ষ ওয়াটের আলো যদি তাঁর গাঢ়  চেনা মানুষটি তাঁকে বলেন ‘আমি তোমায় মধু নয়, প্রাত্যহিকতার লবণের মতই ভালবাসি’। রাজা লিয়ারের মতোই আমাদের প্রত্যেকের ভেতরের তোয়াজপ্রিয়, প্রশ্নাতীত আনুগত্যে অভ্যস্ত মানুষটি এক হতদরিদ্র অসহায়তায় দিন কাটাতে বাধ্য হন, এগিয়ে যান কবি’র নির্দিষ্ট এক অনিবার্য আত্মহননের দিকে। অ্যান্টিপ্রেমের তীক্ষ্ণতা আরো প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে একই কাব্যগ্রন্থের ‘একটাই মোমবাতি’ কবিতায়:

“নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর / অনায়াসে কাটাতে পারতে, কিন্তু কাটালে না; / এখনই দপ ক’রে তুমি জ্বলে উঠলে ব্লাউজের হলুদে। / খুব অহংকারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়। / তুমি এত অহংকারী কেন? / একটাই মোমবাতি তবু অহংকারে তাকে তুমি দুদিকে জ্বেলেছ।”

 যাঁর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা তিনি হয়তো প্রগলভতার উদযাপনে নিমগ্নতার হোমাগ্নিতে জল ঢেলে দিয়েছেন। এ দোষে আমরা অনেকেই দুষ্ট; এটুকুও অনেকসময় খেয়াল থাকে না যে দুদিক থেকে জ্বলতে জ্বলতে অনেকটাই ছোট হয়ে গেলে, নিভে যাওয়া ছাড়া আর প্রদর্শনযোগ্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

 ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে কোনো হার-জিতের প্রশ্ন ওঠে না, কোনো প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গ সেখানে অবান্তর। অথচ অ্যান্টিপ্রেম সমুদ্র থেকে ঢুকে পড়া গুমোট লোনা বাতাসের মতো কখন যেন বয়ে আনে সে বীজাণু। প্রেমেন্দ্র মিত্র লেখেন:

“সব কথা হেরে গেলে / তাই এক দীর্ঘশ্বাস বয়, / বুঝি ভুলে কেঁপে ওঠে / একবার নির্লিপ্ত সময়। / তারপর জীবনের ফাটলে ফাটলে / কুয়াশা জড়ায়, / কুয়াশার মতো কথা হৃদয়ের দিগন্তে ছড়ায়।”

(কবিতা: কথা, কাব্যগ্রন্থ: ফেরারী ফৌজ)

 এ কুয়াশা কি কেটে যাওয়া সম্ভব?সে প্রসঙ্গে আর নয় একটু পরে আসি?

 কবি বিষ্ণু দে-র অ্যান্টিপ্রেমের স্বর ব্যর্থ  হয় প্রকৃতিজোড়া উৎসব উদযাপনের আয়োজনে নিজেকে শামিল করতে। দীর্ণ হয় বিধুর স্মৃতির রোমন্থনে:

“শরতের সাদা খামকাখুশির মেঘ — / পৃথিবী  পাঠায় কাশের নিমন্ত্রণ — / নির্বোধ, নির্বোধ। /পদ্ম দীঘির পাড়ে / আশ্বিনে গাঁথা গান যে আমার কুচিকুচি করে ছিঁড়ে / ভাসালে নিথর জলে। / আমারই হৃদয় নিথর গভীর নীল সে পদ্মদীঘি।”                                           

( কবিতা: ওফেলিয়া, কাব্যগ্রন্থ: চোরাবালি )

 মনের ক্যানোপিতে এতটাই বুনো মেঘের আনাগোনা, শরতের স্বাভাবিক সাদা মেঘের খুশির অনুষঙ্গতেও ‘খামকা’ বিশেষণ জুড়ে যায়! জলের নিথরতা যেন সাড়া না দেওয়া হৃদয়ের নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতার ইঙ্গিতবাহী। আহত অ্যান্টিপ্রেম কখনও বা নিষ্কৃতি খোঁজে লঘু মস্করায়, the lips curl up in a wry grin:

“সভ্য তো বটে, শরীরধর্ম লোপাট আজ / আদিম স্নায়ুর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তি নেই। / তবুও তোমাকে খুঁজে ফিরি দেখো কলকাতায়! / রিজার্ভ ব্যাঙ্কে কেন  যে তোমার চুক্তি নেই!”

(কবিতা: নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, কাব্যগ্রন্থ: চোরাবালি)

 তাঁর অমর কবিতা “ক্রেসিডা”-য় অ্যান্টিপ্রেমটুকু সম্বল করে গুঁড়ো করে দেন প্রেমজনিত সন্ত্রাস:

“তুমি ভেবেছিলে উন্মাদ করে দেবে? / উদ্বায়ু আজও হয়নি আমার মন, / লোকায়ত মোর স্বেচ্ছা বর্মে লেগে / বর্শা তোমার হয়ে গেল খান-খান। ”                    

(কাব্যগ্রন্থ: চোরাবালি)

 অ্যান্টিপ্রেমের আহত মুখটি মার্জিত করে আলোক সরকার ঘুরিয়ে দেন শুশ্রুষাকারী প্রকৃতির দিকে:

“ফুলকে তো বলতে হয় না তুমি বেলফুল, জুঁইফুল, অর্পিত সম্মান / দুই চোখে অনায়াস দিঘি। / তোমার বাড়িতে আর যাবো না কখনো। সারাদিন নিবিড় বাগান। / তোমার নামের ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি না। একদিন নিশ্চিত প্রেমিক / তোমাকে ডেকেছি আর রুগ্ন সাদা হেমন্ত পৃথিবী।

 জিহ্বার জড়তা এক অভিশাপ৷ ক্লান্ত অসুস্থতা শারীরিক / মানসিক দুর্বলতা আনে। / ভাষা ব্যবহারে ভুল হয়?সেই দিন ভালবাসি / বলতে চেয়েছিলুম। তুমি তার কোন মানে / করেছিলে? নিখিল রাত্রির শুভ্র বাগানে সার্থক ফিরে আসি।”

(কবিতা: ঘাসের আড়ালে, কাব্যগ্রন্থ: বিশুদ্ধ অরণ্য )

 তবু মানুষের মন তো, শত লাঞ্ছনা, যন্ত্রণালাভের পরেও একটু খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে স্মৃতি কণামাত্রও ধরে রেখেছে কিনা নিহিত যৌথযাপনছায়াটুকু। অ্যান্টিপ্রেমের উচ্চারণেই লগ্ন হয়ে থাকে সেই উদ্ভাস:

“পোকাটাকে দুই পায়ে পিষে ছুঁড়ে দিল বাইরে অন্ধকারে / আমার প্রেমিকা। আমি অবজ্ঞাত লাঞ্ছিত প্রেমিক / পরিত্যক্ত ঘরের বাইরে এসে দেখলাম শুভ্র ব্যবহারে / সমগ্র নিশীথ সান্দ্র অভিসার।…… / তোমার সিঁড়ির শূন্যতায় / একাগ্র মাকড়সা নিঃস্ব স্বাভাবিক জাল বোনে। স্বাভাবিক / ধুলো, বাদামের খোসা, মৃত্যুর নিশ্চিত সত্যে স্থির। / ভালবাসা, আমাদের দুজনের নির্মিত বিকেল মনে পড়ে?” 

(কবিতা: পারিজাত, কাব্যগ্রন্থ: বিশুদ্ধ অরণ্য)

 ধীরে খুব ধীরে শান্ত হয়ে আসে সেই আকুতিও। মার্জিত রুচির মানুষটি নিষ্কৃতি খুঁজে নেন তাঁর পারিপার্শ্বিকে, প্রকৃতিতে। দোষারোপের কণামাত্র ধুলোও আর বহন করে না তাঁর অন্তঃকরণ। মেনে নেন, যা আদতেই তাঁর হওয়ার নয়, তাঁর আহরণক্ষমতার বাইরে, তা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর হয়নি, এ নিয়ে তো বিলাপের বা কালক্ষেপের কারণ নেই। অ্যান্টিপ্রেম এক অন্য উচ্চতা পায়:

“বৈশাখের নির্জন নীলিমা / উচ্ছ্বসিত নীল রিনিঝিনি সুরে সুরে গেয়ে ওঠে, লাল কৃষ্ণচূড়া / দিগন্তের শান্ততায় উদ্ধত অভীপ্সা তার কেনই বা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়! / আমার তো জানা নেই সহসা এ রঙের প্রণয় / কেন এত কথা কয়! / আমাকে তা দেওয়া কেন আমার যা নয়?       

(কবিতা: স্বজ্ঞা, কাব্যগ্রন্থ: উতল নির্জন )

 অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র অ্যান্টিপ্রেম ‘অধ্যাপিকা’কে তর্জনী তুলে বলে আসে:

” ম্যূর অ্যাভিনিউর শেষ বাঁকে / স্পষ্ট বলে এলাম ‘তোমাকে / অন্তত — গোটা জীবনে একবার — বিধাতার কাছে / নগ্ন হতে বলি, / এবং নগ্নতা মানে সভ্যতার প্রচ্ছাদন নয় / কিংবা এক ফাঁকে / কন্দর্পনির্দেশে খুব ঢেকে ঢেকে রাখা কুন্দকলি; / এবং নগ্নতা নয় অভিনীত সুদীর্ঘ প্রণয়।। “

(কবিতা: অধ্যাপিকা, কাব্যগ্রন্থ: লঘু সংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে)

 যে সমর্পণ তিনি পাননি, তা তাঁর চেনা মানুষটি, একবার, শুধু একবার বিধাতার কাছে তো করুন, এই সততাটুকুই তাঁর একান্ত দাবি। একই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রেমিকা’ কবিতায়:

 “চেয়েছিলাম সহাবস্থান / দেখিয়ে দিলে মহাপ্রস্থান আঙুল তুলে; / যেই না করতে গেছি ভক্তি / দেখি অথৈ রক্তারক্তি দশ আঙুলে৷ / রক্ত মুছতে জামার কাপড় / ছিঁড়তে গেছি অমনি ‘পামর’ বাজল কানে — বাজল ব্যথা তার চেয়েও / বললে যখন: ‘খেয়ে যেয়ো আজ এখানে।’”

 ভক্তি করতে গেলেই রক্তক্ষরণ! কেন? ভক্তিযোগ্য পরিচিত লক্ষণগুলো কি ঠিক মিলছে না? কানে বাজছে কারণে-অকারণে রূঢ় ভাষণের মুহূর্তগুলো? আঘাতের icing on the cake ঘটে যখন পোশাকি ভদ্রতার আবরণে এসে হাজির হয় সৌজন্যের ক্রূরতা — যে অমোঘ অস্ত্রটি শীলিত সমাজে ব্যবহৃত হয় চরম মূহূর্তটির জন্য, নিশ্চিত এবং নিদারুণভাবে এটুকু স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য যে– তুমি আমার কাছে অন্যদের মতোই, আলাদা কিছু নও। তাই আমার বাড়ির সৌজন্যের প্রথা অনুযায়ী অতিথি সৎকারের বরাদ্দটুকু তোমার জন্যও অক্ষুণ্ন আছে।

 এরকম নির্দয় সরলীকরণ এক ধরনের delirium-এর জন্ম দিতে পারে। অ্যান্টিপ্রেম যন্ত্রণার হাহাকারে চিৎকার করে ওঠে কৃত্তিবাস আন্দোলনের পুরোধা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছাকৃত পুনরাবৃত্তির স্বরে:

“সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন

 সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন

 সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, নীরা, কেন হেসে উঠলে, কেন

 সহসা ঘুমের মধ্যে যেন বজ্রপাত, যেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে

 সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নীরা, হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন

 সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে কেন সাক্ষী কেন বন্ধু কেন তিনজন কেন?

 সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন!”

(কবিতা: অপমান এবং নীরাকে উত্তর, কাব্যগ্রন্থ: আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি )

 নীরার কাছ থেকে ফিরে এসে প্রেমিক সত্তাটি অ্যান্টিপ্রেমের ঘোরে যেন নিজেকে দেখতে থাকে একটি নিকৃষ্ট সত্তা রূপে — যেন Beauty-র থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া একটা Bestial (মনুষ্যেতর/জান্তব) presence(উপস্থিতি)। এ এক ধরনের self flagellation, এক মৃদু মর্ষকামপ্রবণতা ( masochistic tendency ) যা একই কাব্যগ্রন্থের ‘নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা’ শীর্ষক কবিতায় ঘনিয়ে তোলে এহেন উচ্চারণ:

“এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কমা ড্যাস রেফ / ও রয়ের ফুটকি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার / আধোঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও / বিছানায় আমার নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলি / এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু / তোমার জন্য এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে / তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও,… / আমার ভয়ঙ্কর হাত তোমাকে ছোঁবে না,… / শুধু মোমবাতির আলোর মতো ভদ্র হিম, শব্দ ও অক্ষরের কবিতায় / তোমার শিয়রের কাছে যাবে– এরা তোমাকে চুম্বন করলে তুমি টের পাবে না। / এরা তোমার সঙ্গে সারারাত শুয়ে থাকবে এক বিছানায়– / তুমি জেগে উঠবে না / সকালবেলা তোমার পায়ের কাছে মৃত প্রজাপতির মত এরা লুটোবে।”

 মাফ করবেন। কেন জানিনা কিশোরবেলায় হলিউডের উপস্থাপনায় দেখা রুপোলি পর্দার ভীষণদর্শন অথচ পেলব চোখের দৈত্যাকৃতি গরিলা আর তার আগলে রাখা রূপসী মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। চোখে অজান্তেই একটা ঝাপসা পর্দা নামল। সিরিয়াস সাহিত্য আলোচনার মাঝখানে এই প্রগলভতা মাফ করে দেবেন।

 কবির প্রবাদপ্রতিম ‘দেখা হবে’ কবিতা থেকে অ্যান্টিপ্রেমের, তুলনায় সমাহিত একটি উদাহরণ তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না:

“ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে… এতকাল ডাকোনি আমায় / কাঙালের মতো আমি এত একা, তোমার কি মায়া হয়নি, / শোনোনি আমার দীর্ঘশ্বাস? / হৃদয় উন্মুক্ত ছিল, তবুও হৃদয় ভরা এমন প্রবাস!… / আমার দুঃখের দিনে বৃষ্টি এল, তাই আমি আগুন জ্বেলেছি, সে কি ভুল?/ শুনিনি তোমার ডাক, তাই মেঘমন্দ্র স্বরে গর্জন করেছি, সে কি ভুল?/ আমার অনেক ভুল, অরণ্যের একাকিত্ব, অস্থিরতা, ভ্রাম্যমান ভুল!”

(কাব্যগ্রন্থ: আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি)

 শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরস্ত্রী’ কবিতায় সাক্ষী হই অ্যান্টিপ্রেমের তীব্র অভিমানের, প্রায় কৈশোরসুলভ আকুলতার:

“যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী  পরেছো / যাবো না আর ঘরে / সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না / ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না /বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো / কখন যেন পরে।”

( কাব্যগ্রন্থ: হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য )

 অ্যান্টিপ্রেম এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ও নৈরাশ্যবোধ বহন করে আনে নান্দনিক উৎকর্ষতায় অনন্য ‘হৃদয়পুর’ কবিতাটিতে:

“তখনো ছিল অন্ধকার তখনো ছিল বেলা / হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা /………. / কী কাজ তারে করিয়া পার যাহার ভ্রূকুটিতে / সতর্কিত বন্ধদ্বার প্রহরা চারিভিতে / কী  কাজ তারে ডাকিয়া আর এখনো, এই বেলা / হৃদয়পুরে জটিলতার ফুরালে ছেলেখেলা ”   

(কাব্যগ্রন্থ: ধর্মে আছো জিরাফেও আছো )

 ওপার বাংলার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের কলমে অ্যান্টিপ্রেমের উচ্চারণে লাগে এক বিচ্ছেদমেদুর অথচ কমনীয় আন্তরিকতার ছোঁয়া:

“তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার / কুরুলিয়ার পুরোনো কই ভাজা; / কাউয়ার মতো মুন্সি বাড়ির দাওয়ায় / দেখব বসে তোমার ঘষা মাজা / বলবে নাকি, এসেছে কোন গাঁওয়ার?

ভাঙলে পিঠে কালো চুলের ঢেউ / আমার মতো বোঝেনি আর কেউ, / তবু যে হাত নাড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায় / শহরে পথ দেখিয়ে দিলে যাওয়ার।”

কাব্যগ্রন্থ: সোনালি কাবিন)

‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত সনেটসিরিজের প্রবেশক সনেটের শেষ দুই পংক্তিতে যেন সময়ের ফলকে খোদাই হয়ে থাকে আপামর কবির অ্যান্টিপ্রেমের স্পর্ধা:

“পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;

 দারুন আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।”

 ‘আপামর কবি’ বলেছি বলে ভ্রূ পল্লবে কিঞ্চিৎ কুঞ্চন লক্ষ্য করলাম কি? উদ্ধৃত পংক্তিদ্বয়ে ব্যবহৃত একটি শব্দের জন্য দোষ নেবেন না মহাশয়া। আপনি ‘নারী’ শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রিয়’ শব্দটি বসিয়ে নিন না! ভ্রূ পল্লবের কুঞ্চন স্তিমিত হয়ে আসবে আর বক্তব্যের নির্যাসটুকুও আমরা কোনো বিভেদের শিকার না হয়েই  উপভোগ করতে পারব।

 আমাদের অর্ধেক পৃথিবী অর্ধেক সত্তা অর্ধেক জীবনের কাছে প্রেম কখন আসে?কিভাবে আসে?কিভাবে এসেছে বলে মনে হয়?কিভাবে প্রেমকে আনতে হবে বলে শতাব্দীর পর শতাব্দীর লোকাচার সেই সত্তাটিকে প্রস্তুত করে রেখেছে? Conditioned করে রেখেছে? শুনব না আমরা? ভলকে উঠে ছিটকে বেরোনো অ্যান্টিপ্রেমই সংজ্ঞায়িত করে তাকে, কবিতা সিংহের কলমের তির্যক প্রয়োগে:

“যখন পায়ের তলায় পেতে দিতে হয় বুক / বুকের ভিতর তুলে নিতে হয় পা / যখন অহংকার সকল অহংকার হে আমার / ঝরিয়ে দিতে হয় মানুষের চরণধূলায় / ভিতর-সেতার থেকে ছিঁড়ে ফেলতে হয় একটি ছাড়া / অযথা সব তার / একটি একতারা হয়ে / শেষ বিকেলের সূর্যকে বলতে হয় ‘থামো’ / — থামো দিনমণি থামো / ‘তাঁর মৃত্যু হয়েছে’ লিখতে গিয়ে কেউ / মৃত্যু শব্দটাকে উপড়ে ফেলে দেয় / ডুবন্ত সূর্যের আর্কল্যাম্পের দিকে / দুই হাত তুলে চিৎকার করে ওঠে — ‘থামো’ / দিনমণি থামো তার প্রেম হয়েছে  প্রেম হয়েছে  প্রেম’

(কবিতা: প্রেম, কাব্যগ্রন্থ: বিমল হাওয়ার হাত ধরে )

 নারীকে ব্যবহার করে, তার সঙ্গে ঘটা আদান-প্রদানের ওপর রং চড়িয়ে, কখনো কখনো তার নাম বা পরিচয়টুকু আড়ালে রাখার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও না করে সাহিত্য রচনার একটা প্রবণতা আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। একে অ্যান্টিপ্রেম বলে কি? এ এক বিকৃত পুরুষতন্ত্র যা খেয়াল রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না এতে একটা মানুষ কতটা বিব্রত হচ্ছেন, তাঁর জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। নাকি এটাই অভীষ্ট চাঁদমারি?প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার এক স্বাদু শিল্পসম্মত প্রকরণ? কবিতা সিংহের অ্যান্টিপ্রেমের স্ক্যানার থেকে বাদ যায় না এ প্রবণতা:

“না আমি হব না মোম / আমাকে জ্বালিয়ে ঘরে  তুমি লিখবে না / হব না শিমূল শস্য সোনালী নরম / বালিশের কবোষ্ণ গরম।

কবিতা লেখার পরে বুকে শুয়ে ঘুমোতে দেব না। / আমার কবন্ধ দেহ ভোগ করে তুমি তৃপ্ত মুখ, / জানলে না কাটামুণ্ডে ঘোরে এক বাসন্তী-অসুখ / লোনা জল ঝাপসা করে চুপিসাড়ে চোখের ঝিনুক। /………. / যন্ত্রণা আমাকে কাটে, যেমন পুঁথিকে কাটে উই।” 

(কবিতা: না, কাব্যগ্রন্থ: সহজ সুন্দরী)

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল তারাপদ রায়ের ‘যমুনাদি’ কবিতাটি:

“তুমি ঠিক প্রেমিকার পর্যায়ে পড়োনা, যমুনাদি, / তোমার বুকের দিকে তাকালে কৈশোর মনে পড়ে! / তুমি কি এখনো ভাবো আমি সেই ষোলো বছরের / সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আছি, মাসে একদিন / চুল-দাড়ি একসঙ্গে কামাই, ক্ষীণ গোঁফ, দ্বিতীয়ার / বাঁকা চাঁদ, তোমারই ঠোঁটের কূলে কবে অস্ত গেছে।”

(কাব্যগ্রন্থ: কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু )

আমরা এটুকু আশা করতেই পারি যে ‘যমুনা’ নামটি কাল্পনিক; নিদেনপক্ষে কবিতায় বর্ণিত চরিত্রটির লেখকের পরিচিত জীবনে অস্তিত্ব থাকলেও, তার বাস্তবজীবনে ব্যবহৃত নামটি কোনো নদীর নামের সঙ্গে সাদৃশ্য বহন করে না বা যমুনা শব্দটির সঙ্গে ছন্দে মেলে না, অর্থাৎ কাউকে ‘চিনিয়ে’ দেওয়ার সুচারু সন্ত্রাস কবিতায় অনুপস্থিত। আমরা অবশ্য শুধু আশাটুকুই করতে পারি। অ্যান্টিপ্রেমে দগ্ধ যৌবন আসলে পরাজয় শব্দটাকে বড় ভয় পায়, জয় বা পরাজয়ের উর্ধ্বে ওঠার মনস্তত্বটুকু তখনও আয়ত্তে আসে না:

“সম্রাজ্ঞীর মতো যাচ্ছ, যাও / দেখা হবে, যেখানেই যাও / দেখে নেবো, ঠিক একদিন, / আজ হোক কাল হোক কবে, / ঠিক একদিন দেখা হবে। / হংসীর মতন যাচ্ছ, যাও, / দেখা হবে, ডোবায় না হোক, / খালে বিলে, ঘাটা আঘাটায়, / সাগরে? না হয় তাই যাবো, / একদিন তোমাকে দেখাবো। “

(তারাপদ রায় — কবিতা: সম্রাজ্ঞীর মতো — কাব্যগ্রন্থ: ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকাতলে স্বাধীন )

 লক্ষ্যণীয় — ‘সম্রাজ্ঞী’ কিভাবে তপ্ত হৃদয়ের আঁচে কয়েকটি মাত্র পংক্তির ব্যবধানে ডোবার ‘হংসী’তে পরিণত হচ্ছে!

অ্যান্টিপ্রেমছন্দে বর্ণে চিত্রকল্পে দ্যুতিময় হয়ে ওঠে শিল্পী কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর কলমে:

“আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে। / এর আকাশে ওর আকাশে / ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে / পায়রাকে ধান খুঁটতে দিলে খোয়াই জুড়ে / বুকের দুটো পর্দা ঢাকা জানলা খুলে / কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে। /……

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে। / একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে তুমি / আলমারিটার ঝুলন চাবি।”

(কবিতা: অনেককেই তো অনেক দিলে, কাব্যগ্রন্থ: শব্দের বিছানা)

ওই ‘ঝুলন চাবি’ই অ্যান্টিপ্রেমে রেখে দিয়েছে, টেনে রেখেছে একফালি আলোয়, আড়াল করে রেখেছে বিরহের রাস্তা। ওই প্রাণভোমরার আশায় পথের পাশে অপেক্ষা, আবার ফেরার কথা ভাবা:

“সে ভোমরাটি সকল জানে / কোন হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল হাসির মতো / সে ভোমরাটি সকল জানে / কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে বুকের ক্ষত………. / তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন চাবি / আমায় দেবে?”

এই অপেক্ষা কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দমচাপা অবসাদের এবং আরও ঘনীভূত অ্যান্টিপ্রেমের ঘূর্ণির — এমন উদাহরণও বিরল নয়। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায়:

“এখন শীতের রাতে ওই ট্রেন / কত দূরে যাবে / আমি যাব। / জানলার দেশ থেকে / তোমাকে লিখেছিলাম কত চিঠি — / কত কথা তোমাকে বলেছিলাম / পথে-পথে, নির্জন টেবিলে। / অনেক বছর হলো / সেই সব — / মনে পড়ে, আজও মনে পড়ে / সমস্ত তাচ্ছিল্য আজ মনে পড়ে। / নির্জন চোখের জল মনে পড়ে। / মাথা, ভারী হয়ে আসে — / মৃত্যু / দুই-তিন পয়সার খেলা।

(কবিতা: মৃত্যু সম্পর্কে আরো, কাব্যগ্রন্থ: এসো, সুসংবাদ এসো )

 অযথা অপেক্ষায় অস্থির হতে হতে অ্যান্টিপ্রেমে বিধ্বস্ত মানুষটি ঠিক করে অপর মানুষটিকেও শান্তিতে থাকতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই :

“এমনকি আমার চুরুট, বন্দুকের মতো, ছুটে যাবে তোমার ঘরে — / সকালবেলা আমি / বসে থাকব আমার বিছানায় — একটা বিড়াল, রোজ, রুটিন মাফিক / চেটে দেবে আমার পা — কোথাও যাব না আমি — / আমার ঘাম, বিশাল জলের মতো / আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে তোমার ঘর — তুমিও কোনোদিন / যেতে পারবে না কোথাও — দু হাজার মাইল দূরের / ছোট্ট এক ঘর থেকে প্রতিদিন, আমি কথা বলবো তোমার সঙ্গে / তুমি খেতে পারবে না ঘুমোতে পারবে না / তুমি গান গাইতে পারবে না হাসতে পারবে না / তুমি থেকে থেকে — সারাজীবন — কেবলই আঁতকে উঠবে ভয়ে — ”  

(কবিতা: প্রতিহিংসা ১, কাব্যগ্রন্থ: শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা)

 উৎফুল্ল আশা নিয়ে শুরু হওয়া প্রেমে এভাবেই অনিচ্ছাকৃত ঘনিয়ে ওঠে অ্যান্টিপ্রেমজনিত সন্ত্রাস। বিনয় মজুমদারের ভাষায়:

“কী  উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে। / কৌটোর মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা / উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল। / সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা / বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু। / দৃষ্টিবিভ্রমের মত কাল্পনিক বলে মনে হয় / তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত। / অথবা করেছ ত্যাগ অবৈধ পুত্রের মতো, পথে। ”   

( কবিতা: কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে)

 শেষ পংক্তিগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে কাষায়, প্রায় কটু এক উচ্চারণে। এরকম সম্ভাষণে সম্বোধিত কারও পক্ষে আবারও প্রেমের স্বাভাবিক সরণিতে সাবলীল পদচারণা একটু দুষ্কর বৈকি! তাই কি বিনয় ‘মাংসল চিত্রের কাছে’ কবিতায় তাকে একটু সংহত করতে সচেষ্ট হন?

“কোনো যুগে কোনো আততায়ী / শত্রু ছিল বলে আজও কাঁটায় পরিবেষ্টিত হয়ে / গোলাপ যেমন থাকে তেমনি রয়েছো তুমি, আমি / পত্রের মতন ভুলে অন্য এক দুয়ারের কাছে”

 এহেন অ্যান্টিপ্রেমের উৎসারেই, না কি অ্যান্টিপ্রেমে তিতিবিরক্ত হয়ে মল্লিকা সেনগুপ্তের কলম থেকে উদগীরণ ঘটে তীব্র প্রদাহী শ্লেষের:

“প্রেমের কথা লিখতে গেলেই / সামনে দাঁড়ান প্রেম চোপড়া

 আমার দিদি দুঃখী মানুষ / বলেন, প্রেমের ভেতর ফোঁপরা

 বলেন প্রেমের নামেই ওরা / কত মিথ্যে চালিয়ে গেলেন

 সব ছেড়ে যেই আসেন রাধা / কৃষ্ণ রাজার মুকুট খোঁজেন”

(কবিতা: দিদির প্রেমিক, কাব্যগ্রন্থ: মেয়েদের অ আ ক খ)

 প্রেম-অ্যান্টিপ্রেম ছাড়িয়ে কবি আমাদের পৌঁছে দেন এক তোলপাড় করে দেওয়া প্রশ্নের অলিন্দে — নারীকে যথেচ্ছভাবে পাওয়া হয়ে গেলে পুরুষের কি প্রয়োজন হয় নতুন এক অ্যাড্রেনালিন-বর্ধকের? কি সেই পেপ-পিল (pep pill )? ক্ষমতা? যা পুরুষকে যোগায় আনুষঙ্গিক সব উপকরণ — Big boys’ toys! এ আলোচনার পরিসর অবশ্য অন্য৷ ফিরে আসা যাক কাব্যে, প্রেমে এবং অ্যান্টিপ্রেমে। ফিরে যাওয়া যাক সেই প্রশ্নে — অ্যান্টিপ্রেমের কুয়াশার পর্দাটার কি সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে? সরলে কি সত্যিই মেলে সেই প্রথম দিনের স্বচ্ছতা?এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে আমাদের খুঁজতে হবে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর?অ্যান্টিপ্রেমের এই দ্রোহের বয়স কত, কবিতায়?তার বেশিরভাগ প্রকাশটাই কি গত একশ বছরে?না হলে প্রেম আর বিরহের মাঝখানে কোন ছায়াচ্ছন্ন কুলুঙ্গিতে তার বাস? বৈষ্ণব পদাবলীর দিকে মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পাব পূর্বরাগ এবং অভিসার পর্বের মাঝখানে আছে অনুরাগ পর্ব। এই অনুরাগ পর্বটি তিন ভাগে বিভক্ত – রূপানুরাগ, আক্ষেপানুরাগ এবং অভিসারানুরাগ। একটি বহুল প্রচলিত আক্ষেপানুরাগের পদ দেখে নেওয়া যাক:

 সুখের লাগিয়া   এ ঘর বান্ধিলুঁ 

      আনলে পুড়িয়া গেল।

 অমিয়া সাগরে   সিনান করিতে

      সকলি গরল ভেল।।

      (সখি হে) কি মোর করমে লেখি।

 শীতল বলিয়া    ও চান্দ সেবিলুঁ

      ভানুর কিরণ দেখি।।

 নিচল ছাড়িয়া    উচলে উঠিতে

      পড়িলুঁ অগাধ জলে।

 লছিমী চাহিতে   দারিদ্র বাঢ়ল

       মাণিক হারালুঁ হেলে।।

 পিয়াস লাগিয়া   জলদ সেবিলুঁ

       বজর পড়িয়া গেল।

 জ্ঞানদাস* কহে কানুর পিরিতি

       মরণ অধিক শেল।।

 (*মতভেদে চণ্ডীদাস )

এই উচ্চারণে হতাশা আছে, দীর্ঘশ্বাস আছে, অভিযোগ আছে, আছে দ্রোহও। অপেক্ষার অস্থিরতা, অবসাদ এবং মৃত্যুর চকিত অনুষঙ্গও উপস্থিত। অর্থাৎ আক্ষেপানুরাগই যে অ্যান্টিপ্রেমের পূর্বসূরী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তর্জনী উত্তোলন আর দোষারোপের তীব্রতা ও প্রকারভেদটুকুই বৃদ্ধি পেয়েছে সময়ের সঙ্গে, যাপনজনিত জটিলতার হাত ধরে। ডিভোর্স, সেপারেশন, সিঙ্গল পেরেন্টিং, ডেটিং অ্যাপস, লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, লিভ-ইন, ক্রস জেনারেশনাল কাপলিং-এর মতো লাইফস্টাইল চেঞ্জসমূহ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অ্যাটিটিউড এই আক্ষেপানুরাগের হীরকখণ্ডে নতুন নতুন পৃষ্ঠদেশ যোগ করে তাকে দ্যুতি বিকিরণে প্রকৃতই মহার্ঘ করে তুলেছে। তাই এখন আর তাকে অ্যান্টিপ্রেম বলে না ডাকলে চলে না। এবার আসা যাক পরের প্রশ্নে — কুয়াশার পর্দাটা সরলে কি পাওয়া যাবে প্রথম দিনের স্বচ্ছতা? প্রতিপ্রশ্নে আসি – প্রথম দিনটি কি আদৌ স্বচ্ছ ছিল ? মায়াঞ্জনপরিহিত দৃষ্টি কি আদৌ স্বচ্ছ থাকে? সে তো সত্যকে বর্জন করে কাঙ্খিতটুকুই দেখতে চায়, দেখাতে চায়! অভিযোগের মাধ্যমে, অভিমানের মাধ্যমে, দোষারোপের মাধ্যমে, দ্রোহের মাধ্যমে একে অপরকে যে চিনে নেওয়া সেটাই তো সত্তার কাছে সত্তার উন্মীলন। একে অপরের দেবত্বকে নয়, মনুষ্যত্বকে গ্রহণ করে তাতে মুগ্ধ হওয়ার নামই কি প্রেম নয়? কুয়াশা কেটে গেলে সেটাই তো কাঙ্খিত স্বচ্ছতা যা অ্যান্টিপ্রেমের অনুপস্থিতিতে কোনোদিনই পাওয়া সম্ভব হতো না।

 অন্তরাত্মার ঋদ্ধ উচ্চারণে তবে অনুরণিত হোক:

“এবার তবে খুলে দেওয়া, সব বাঁধনই আলগা ক’রে নেওয়া

 যখন বলি, কেমন আছো?ভালো?

 ‘ভালো’ বলেই মুখ ফিরিয়ে নেবার মতন মরুভূমি

 এবার তবে ছিন্ন করে যাওয়া।

 বন্ধ ছিল সদর, তোমার চোখ ছিল যে পাথর

 সেসব কথা আজ ভাবি না আর

 যাওয়ার পরে যাওয়া কেবল যাওয়া এবং যাওয়ায়

 আকাশ গন্ধরাজ।

 শিরায় শিরায় অভিমানের ঝর্না ভেঙে নামে

 দুই চোখই চায় গঙ্গাযমুনা

 মন কি আজও লালন চায়? মনকে বলো ‘না’

 মনকে বলো ‘না’, বলো ‘না’। “

( শঙ্খ ঘোষ — কবিতা: মনকে বলো না — কাব্যগ্রন্থ: বাবরের প্রার্থনা )

এরপর

আর তো অভিসারে কোনো বাধা থাকে না… 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april goddyo

মানস চক্রবর্ত্তী

প ছ ন্দে র  ব ই

মা ন স   চ ক্র ব র্ত্তী

manas2

"আরো একটু চেষ্টা করি সুমঙ্গল, এসো বাঁচি, বেঁচে থাকা যাক"

ভাস্কর চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা

ভাস্কর চক্রবর্তী

“তথাকথিত ছন্দ ছাড়া আমার কবিতাকে আমি হাঁটতে শিখিয়েছিলাম |” ভূমিকার এই লাইনটুকুর ঘোর আমি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি | ছন্দ বিছিন্দতায় সদা ভাস্বর ভাস্কর চক্রবর্তী | তিনি ছন্দ ছাড়া হলেও ছন্ন ছাড়া নন | ‘ভাস্কর চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ – তার জীবন্ত উদাহরণ | তাঁর ‘উৎকন্ঠা’ আজকেও সমান সত্য ও সমান প্রাসঙ্গিক | তিনি লিখলেন – 

“আমাদের ঘষটাতে ঘষটাতে মরতে হবে | 

 ঘরের অভাবে আর ভাতের অভাবে মরতে হবে |

 আমাদের পরমাণু খেয়ে মরতে হবে | 

 সাত স্বর্গ ঘুরে ঘুরে বন্ধুর অভাবে 

 সাতটা নরক ঘুরে প্রেমের অভাবে 

 একা একা কথা বলবার অপরাধে 

 একা শুয়ে থাকবার অপরাধে 

 রাস্তাজুড়ে বিড়ালের মতো 

 আমাদের একদিন চেপ্টা হয়ে পড়ে থাকতে হবে |

 

কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাতেই শুনলাম নতুন স্বর- “সকলেই কবি আজ- শুধু কেউ কেউ নয় কবি |” মানুষকে সম্মান করার নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম | সত্য কথা বলতে কী আত্মশ্রদ্ধা জাগাল এই লাইন |  

 

কী ছোটো কথায় ভালোবাসার অদ্ভূত সংজ্ঞা দিলেন তিনি | “ভালোবাসা শুধুই বোতাম খোলার শব্দ নয় |”  

 

কবি ভাস্কর চক্রবর্তী শখের কবি নন | “আমার নিজের কাছে আমার একটাই দায় ছিল, জ্যান্ত আর নতুন কবিতা লেখার দায় |” কবি মানুষের প্রতিনিধি | কবি ভাস্কর চক্রবর্তী সেই দায়িত্বকে অস্বীকার করেননি | মানুষের জন্য, মানুষের হয়ে সমস্ত জীবন ধরে তাঁর কীসের যেনো অন্বেষণ – “একটা সরলরেখার খোঁজে আমি বেরিয়েছিলাম সকালবেলায় |” অথচ লালায়িত প্রেমিক মানুষ, যে লিখে রাখে : শম্পা আমার প্রেম, তাঁরই ( মানুষের) জন্য উপসংহারে লেখা হয় – 

“আজ হেসে চলেছি আমি শব্দহীন এক হাসি 

 আজ নুয়ে পড়েছি আমি অশ্রুহীন এক কান্নায়” 

 

কবিরা স্বার্থপর নন | “সর্বে ভবন্তু সুখিন” – এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী কবি ভাস্কর চক্রবর্তী | তা না হলে তিনি কখনোই লিখতে পারতেন না – 

“এবং যে খেতে পায় না সারাদিন, তুমি প্লেট-ভর্তি খাবার পাঠিয়ে দিয়ো তাকে | 

 এবং রাত্রিবেলা যার ঘুম হয় না 

 তুমি লিখে জানিয়ো তাকে ঘুমিয়ে পড়ার সহজ উপায়গুলো |  

 যার কোনো প্রেমিকা নেই, তুমি 

 অঢেল বন্ধু দিয়ো তাকে- 

 এবং যে অসুখী আমার মতো, তুমি তাকে চিরকালীন শান্তি দিয়ো ”  

 

কবিরাই পারে মানুষের মেকি, ফাঁকির মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলতে –

 “আমরা ভান করি যে আমরা অপরের জন্য জন্মেছি 

 আর অনুভূতিহীন এমন একটা স্রোতে গা ভাসাই 

 আর এমন সব কথা আমরা ছুঁড়ে দিই চারপাশে 

 চারপাশ কাঁটাতারে ভরে ওঠে 

 চারপাশ রক্তে ভেসে যায় …..”  

 

তবুও কবিরা আশাবাদী | তাই কবি জীবনের কথা ভেবে লিখলেন – 

             “উদ্বন্ধন ভালো নয় 

              ভালো নয় , রেলে মাথা 

              অথবা ছ’তলা থেকে 

                                        লাফ – 

              এসো, ধরো টেলিফোন 

             এসো , ধরো টেলিফোন 

             হেসে বলো- দেখা হবে 

             রাস্তায় আবার |”  

আশাবাদের জয় হোক, কবির জয় হোক, কবিতার জয় হোক, মানুষের জয় হোক | মানুষের জয়যাত্রার পথে কবির বাণী পাথেয় হোক – “আরো একটু চেষ্টা করি সুমঙ্গল, এসো বাঁচি, বেঁচে থাকা যাক |”  

 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april goddyo

অমৃতাভ দে

প ছ ন্দে র  ব ই

অ মৃ তা ভ   দে

amritava

কবি দেবদাস আচার্যের করোনা ডায়েরি: সময়ের বর্ণমালা

করোনা ডায়েরি

দেবদাস আচার্য

প্রকাশক: জীবনকুচি

‘করোনা’– এক মারণ ভাইরাস।প্রায় দুটো বছর আমাদের সকলের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে এই শব্দটি। গৃহবন্দি থেকেছে মানুষ, দূরত্ব বেড়েছে পরস্পরের। ‘মাক্স’,’স্যানিটাইজার’, ‘সামাজিক-মানসিক দূরত্ব’ শব্দগুলি আমাদের নিত্যসঙ্গী হলো। জীবনযাত্রা চূর্ণ হয়ে গেল,নতুন জীবনচেতনা এনে দিল আমাদের। নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে ডুবে যেতে থাকল সমগ্র পৃথিবীবাসী।”আতঙ্কে ভাসছে দুনিয়া/বিমূঢ় এ পৃথিবীর মন ভালো নেই/অস্পৃশ্য হয়ে গেল পরস্পর/ মানুষ।”দেবদাস আচার্যের কথায় ‘কালের প্রহার সইতে হচ্ছে আমাদের’।বাংলা কবিতার আচার্য দেবদাসের ডায়েরির পাতা ভরে উঠলো নতুন অভিজ্ঞতার ফসলে।করোনাকালে দেবদাস লিখে ফেললেন একগুচ্ছ কবিতা। ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠলো এইসব কবিতা।২০টি কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘জীবনকুচি’ পত্রিকায়। বাকি ২২টি কবিতা ‘কবিতীর্থ’,’নিরন্তর’,’কোরক’ এবং ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতাগুলি একত্রিত করে ‘জীবনকুচি’ প্রকাশ করল দেবদাসের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘করোনা ডায়েরি’। আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় এই কাব্যগ্রন্থ বিশেষ সংযোজন।

 

“সভ্যতা কি ফুরিয়ে আসছে?

অদৃশ্য এ কোন শত্রু

মানুষের সাজিয়ে-রাখা অস্ত্রভাণ্ডার পরোয়াই করে না

 

আমার স্ত্রী আজও

বাগান থেকে পুজোর ফুল তুলেছে

 কাল তুলতে পারবে তো?

 

 ভয় হয় ভুল করে

আমার স্ত্রী যদি

ঈশ্বরের পা ছুঁয়ে দেয়”

 

এত ভয় এত শঙ্কা নিয়ে দীর্ঘ সময় আমাদের বেঁচে থাকা– কিন্তু এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? কবি তো বাঁচতে চান, আমাদের মনে বেঁচে থাকার সুর রোপণ করতে চান– এক কণা জীবনও জীবনই। করোনার আক্রমণ চলছে বিশ্বময়,দিন কাটছে মাথার কাছে নিবু নিবু আলোর মতন।দুর্ভাগ্যবশত কবি দেখছেন এই অসহায় পৃথিবীর মুমূর্ষু-কাল। বিমূঢ় পৃথিবীর মন ভালো নেই, অস্পৃশ্য হয়ে গেল পরস্পর মানুষ।”মানুষ মানুষকে দেখে ভয় পাচ্ছে/মানুষ মানুষকে দেখে/পালিয়ে যাচ্ছে/মানুষই শত্রু আজ/মানুষের/ এ কোন সময়।” মুখোশটাই মুখ, হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার ঘন-ঘন হাত ধুচ্ছি,মন ততই অপরিষ্কার হচ্ছে। পরস্পর পরস্পরের দিকে আতঙ্কে তাকিয়ে রয়েছি। সভ্যতার এপ্রকার অন্ধকার দেখব ভাবেননি কবি। চারিদিকে করোনার নির্মম প্রহার। সারাদিন নানা রঙের ফুল দেখে সময় কাটালেও একসময় সেই ফুলেও ক্লান্তি আসে, ‘কত দেখব আর’। কেবল বাঁচার জন্য ক্রমে অসামাজিক হয়ে ওঠা–

 

“সভ্যতা মনস্তাপে ভুগছে এখন

পথ একটাই

একা হয়ে বাঁচো

একা

অসামাজিক।”

 

“এ কোন দুঃসময়/মানুষ দেখলে মানুষ/দূরে সরে যায়।”

শিল্প-বিপ্লবের আগের সেই ছায়ামাখা দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায় কবির। করোনা ঠেলতে ঠেলতে আমাদের তিনশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।”মনে মনে পৌঁছে গেছি রোমান্সের যুগে…হাপর-হাতুড়ি, নিড়িনি-কোদাল,কুমোরের চাকি,ছায়া- ছায়া নির্মল বাতাস,আঙিনায় মনসামঙ্গল।”

পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা,কষ্ট কবিকে ব্যথিত করে। নিজের দেশেই পরিযায়ী হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ।দুঃস্বপ্নের রক্তে-মাখা রুটি লাইনে ছড়ানো থাকে। রেললাইনের পাশে পড়ে থাকে রুটি আর অপঘাতে মৃত শ্রমিকের দেহ। তবু তো হাঁটতেই হবে রেলপথধরে হাজার হাজার মাইল।কবি দেবদাস লিখছেন–

 

“মনে পড়ে সেই কিশোরীর কথা

লকডাউনের সময় মে তার অক্ষম রিক্ সাচালক পিতাকে

দেড় হাজার কিলোমিটার পথ

নিরুপায় হয়ে

তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে

বিহারের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল

 

কোন ভাষায় তার স্তুতি করব, জানিনা

তাকে

স্যালুট”

 

ঘরবন্দী পৃথিবী কিন্তু প্রকৃতি উল্লসিত, যেন বহুকাল পর নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা পেয়েছে সে। কিন্তু মানুষ সে কী করে থাকবে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে? কাছে না-গিয়ে,কথা না বলে,হাতের উপর হাত না- রেখে? কবি দেবদাস লেখেন–

 

“ময়ূর নাচছে রাজপথে

কালো মেঘ আকাশ ছুঁয়েছে

পুব-আকাশে হালকা রামধনু

 

জন্মাবধি এত নৈঃশব্দ্যে থাকিনি

পৃথিবী কি চুপ-চাপ ঘুমোতে চলেছে!

জন-কোলাহলহীন আকাশ-বাতাস

ভুতুড়ে শহরের বাগান-বাড়িতে রয়েছি

 

এত শান্ত তবু,

মন বলে– পালাই পালাই।”

 

কিন্তু পালাবে কোথায়?আশার যে মৃত্যু নেই, এই পৃথিবী আলোকিত হবে পুনরায়। আমরা আশায় বুক বাঁধি‌‌। মানুষের জয় হবে মানুষের জয় হবে জানি।অতিমারির মহাশ্মশান রোজ বড় হলেও কবির মতো আমিও দেখতে পাই, “এখনও জলঙ্গীনদী/ কুলুকুলু বয়/এখনও পাখিরা খেলা করে/ মেঘ সরে গেলে চাঁদ জোছনা ছড়ায়/শ্মশানে করবীগাছ/ নিঃসঙ্গ,তবু/উৎফুল্ল ফুল ফুটে আছে।”

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april anubad

সুমিত নাগ

অ নু বা দ  ক বি তা

সু মি ত   না গ

নেওমি শিহাব নাই

নেওমি শিহাব নাই (১৯৫২–) আধুনিক কালে আমেরিকার প্রধান কবিদের অন্যতম। প্যালেস্টাইন থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে আগত পিতা এবং জার্মান-সুইস মায়ের সন্তান হওয়ায় শিহাব নাই শৈশব থেকেই বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মননে এবং কবিতায় সেই ছাপ সুস্পষ্ট ভাবে পাওয়া যায়। এই কবিতাটি মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বাস্তু সমস্যার প্রেক্ষিতে লেখা। তাঁর বাবার উদ্বাস্তু পরিচয়ের ছায়া, তাঁর জীবনে কতটা প্রভাবশালী তা এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ভূমধ্যসাগরীয় নীল

তুমি যদি এক উদ্বাস্তুর সন্তান হও,যখন তারা ছোট্ট ভেলাতে

সাগর পেরোয়, তুমি সহজে ঘুমোবে না। তুমি জানো,

তারা সাঁতার জানে না।

আমার বাবাও সাঁতার জানতেন না। অথচ সাঁতরে তিনি

দুঃখ-সাগর পেরিয়েছিলেন, আর জাহাজে চড়ে ওপারে পৌঁছেই,

মাটিতে নেমে পুরনো পোশাক ছুঁড়ে ফেলেন,

চেষ্টা করেন সুখী হতে, নতুন জীবন বানাতে।

কিন্তু, তাঁর মধ্যে কিছু একটা ছিল যা তাঁকে ভিটের দিকে টানত,

আঁকড়ে রাখত ভাসমান কোনও গল্প, কোনও খাবারের পদ, বা কোনও মুখের সঙ্গে।

এই মুহূর্তে ওরা পৃথিবীর সবথেকে সাহসী লোক,

ওদের নিচু নজরে দেখার স্পর্ধা দেখিও না। তোমার মতোই,প্রত্যেক মনে

এক মহাবিশ্ব পাক খায় তার অনুপুঙ্খ বিবরণ নিয়ে,

থাকে একঅখ্যাত ভিটের প্রতি ভালোবাসা। এখন জামাটা ছেঁড়া,

বিস্তীর্ণ সাগর অস্বস্তি দেয়, তাছাড়া একটা চিঠি আসার মতো

ঠিকানাটুকুরও অভাব আজ বহুদিন৷

 

আমরা যদি সত্যিই হাত বাড়িয়ে দিতে পারি, বাড়ানো যাক।

জেনি জোসেফ

জেনি জোসেপের (১৯৩২–২০১৮) জন্ম ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে। এই কবিতাটি, তাঁর আঠাশ বছর বয়সে লিখিত, যা তাঁকে প্রবল খ্যাতি দেয়। সহজ এবং সুস্পষ্ট উচ্চারণে লেখা কবিতাটি ১৯৯৬ সালে, বিবিসির সমীক্ষায় যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয়তম পোস্ট-ওয়ার কবিতা রূপে স্থান পায়। দ্বিতীয় কবিতাটি ছিল ডিলান টমাসের বিখ্যাততম কবিতা ’do not go gentle into that good night’।

সাবধানবাণী

যখন বুড়ি হব, পরব ময়ূরপঙ্খী পোশাকের সঙ্গে

মানানসই নয় এমন একটা লাল রঙের টুপি,

যা আমাকেও মানায় না।

আমার পেনশনটুকু উড়িয়ে দেব ব্র্যান্ডি ওদস্তানা কিনে

সঙ্গে সাটিনের স্যান্ডেল, আমাদের আর মাখন

কেনার মতো পয়সা বাঁচবে না।

ফুটপাথে বসে পড়ব ক্লান্ত হলে,

দোকানে ফ্রি-খাবার দিলে গপগপ করে গিলব,

অ্যালার্ম বেল টিপে পালাব

লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে যাব রেলিঙে—

এগুলো আমার যৌবনের সংযমের ক্ষতিপূরণ।

আর চটি পায়ে বৃষ্টি ভিজতে বেরব,

ফুল চুরি করব অন্যের বাগান থেকে,

শিখব থুতু ছোঁড়া।

 

তুমি বিচ্ছিরি শার্টগুলো পরতে পারো

পারো আরও মোটা হয়ে যেতে।

একসঙ্গে তিন পাউন্ডের সসেজ খাবে

কিংবা গোটা সপ্তাহ জুড়ে শুধু রুটি আর আচার।

পেন, পেন্সিল, বিয়ার-বোর্ড, হাবিজাবি সব

জমিয়ে রাখতে পারো বাক্সে। 

 

কিন্তু, আপাতত আমাদের পোশাকের ব্যাপারে

সচেতন থাকা চাই

ভাড়া মেটাতে হবে, রাস্তাঘাটে গালাগালি করা চলবে না

আর বাচ্চাদের সামনে ভালো আদর্শ স্থাপন করতে হবে।

বন্ধুদের ডাকতে হবে ডিনারে আর

পড়তেই হবে খবরের কাগজ।

 

তবে, আমার কি উচিত নয় এখনই অল্পস্বল্প করে

এসবের অভ্যেস শুরু করা?

যাতে হঠাৎই আমি বুড়ি হয়ে

ময়ূরপঙ্খী পরতে শুরু করলে

যারা আমাকে চেনে তারা ঘাবড়ে-টাবড়ে না যায়?

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april goddyo

আবার রাণার কথা । পর্ব ৪

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৪

রা ণা   রা য় চৌ ধু রী

আবার রাণার কথা

rana2

দরজা ও নেই-দরজার স্রোত

          একটা খোলা দরজা মুহূর্তের মধ্যে মনে একটা আনন্দ, একটা সম্ভাবনার হাওয়া বইয়ে দিতে পারে। দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে দেখি একটা বাগানে একজন অসুস্থ বৃদ্ধা বসে আছেন। গাছেদের সান্নিধ্য তাঁকে সুস্থতা এনে দেবে এই বিশ্বাসে তিনি বাগানে বসে আছেন।

          ভাগ্যিস আমি এই বাড়ির মূল দরজা খোলা পেয়েছিলাম, এবং ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলাম। না হলে এই মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির একটা যৌথ সঙ্গীতের যে আয়োজন চলেছে তা জানতেই পারতাম না। দরজা খোলা পাওয়া, এবং দরজা খুলে কেউ ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে, এ একেবারে গানের মতো আনন্দ। যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে— একজন সুন্দর বা সুন্দরীর বা সাধকের বা একজন কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্যে— তার মনের অবস্থা সেই প্রবেশের মুহূর্তে কী হতে পারে তা ভাবি। নিশ্চয়ই সেই দরজা পেরিয়ে যাওয়া সাক্ষাতকারীর মনে তখন হঠাৎ পাহাড় দেখার আনন্দ হয়, অথবা দরজা পেরোলেই এক অগাধ নীল জলরাশি ও নীল জলরাশির সৈকতে ঝাউবন ও ঠান্ডা বাতাসের ছোটাছুটি। 

          কিন্তু কারোর মনের দরজা খোলা পেলে আমার সবচেয়ে খুশি লাগে মন। একধরণের শান্তি আসে মনে। যেন হঠাৎ ‘মন্দিরে মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা, দয়াময় দেবতার নামে…’ এইরকম মনে হয়। যে মানুষের মনের দরজা সবার জন্য খোলা, তাকে মানুষ বেশি পছন্দ করে, এটাই স্বাভাবিক। আমি কী ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই মনোভাব নিয়ে নিজের মনের দরজা সবার জন্য খুলে রাখি? রাখি না হয়তো। কারণ এই সমাজের এই পাড়ার সকল মানুষকে আমার ভালো লাগে না। যেমন, আমাকেও সবাই পছন্দ করেন না বলেই, সকলেই তাঁর মনের দরজা আমার জন্যে খোলেন না। এবং এটাই স্বাভাবিক। তবু অন্যজনের মনের দরজা খোলা পেলে, বা এমনটা আমি পেতে চাইছি, কিন্তু অপরপক্ষ দরজা খুলছেন না— ভেজিয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন— তখন আমরা সকলেই ব্যথিত হই। মনের এই ব্যথা, এই বেদনা থেকেই সুরের সৃষ্টি, কবিতার জন্ম, এই অভিমান থেকেই প্রেম আরো তীব্র হয়ে বিকেলের রাস্তায় এলোমেলো পায়চারি করে!

          যে বাড়িতে যতো দরজা, সে বাড়ির ততো ছন্দপতন। যেমন আমাদের বাড়ি। অহেতুক অনেক দরজা, ফলত অনেক ছন্দহীনতা, তার ফলে আমাদের বাড়ির কেউ শ্লোকের মতো বা পয়ারে কথা বলে না। সকলেই টানা গদ্যে জীবনযাপন ও নিত্যের রুটিনমাফিক গান গায়। তবু অনেক দরজার একটা সুবিধাও আছে। এ দরজা অতিথির জন্য বন্ধ তো, ওই দিকের দরজা খোলা আগত আত্মীয়ের জন্য, প্রিয়জনের জন্য। নানান দরজার নানান মন। আমি খেয়াল করে দেখেছি। সিঁড়ির দরজা একটু গায়ক টাইপের, কারণ তাকে পেরোলেই ছাদ, এবং বিপুল আকাশের সমুদ্র। ফলত আমাদের ছাদের সিঁড়ির দরজা অনেকটাই উদার উদাসীন ও বাউল টাইপের। সে সবসময় একতারা হাতে আকাশ-প্রবেশের পথে প্রবল সুর নিয়ে যেন গাইছে।

          বাড়িতে ঢুকতেই যে দরজা, সে অনেকটাই সাবধানী। একটু কিপটেও। সহজে সে নিজেকে খরচ করতে চায় না। সে সজাগ, সে সন্দেহবাতিক। বাড়িতে কেউ এলেই, সে ‘কে কে’ করে সন্দিহান প্রশ্ন ছুড়ে দেবে, যে এলেন আমাদের বাড়িতে, বাড়ির প্রথম দরজার হাজার প্রশ্নেই – তাঁর ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছেটা চলে যায়। আমি বুঝি। আমাদের বাড়িতে ঢোকার যে প্রথম দরজা, তারও দোষ নয়, কারণ তার হাতে একটা প্রবল ওজনের তালা ঝুলছে সবসময়। আর আমরা তো জানিই, যে তালাচাবি মানেই, সন্দেহ – অবিশ্বাস! সেই সন্দেহের তালাচাবি নিয়ে বেচারা ‘প্রথম দরজা’ জীবনে কোনোদিন ‘উদার’ ও ‘প্রেমিক’ হতে পারল না, সে চিরকাল ‘প্রহরী’ হয়েই জীবন কাটাল আমাদের সঙ্গে।

          ওইরকম কঠিন কঠোর আমাদের বাড়িতে ঢোকার প্রথম দরজাকে আমি মাঝে মাঝে কবীর সুমনের গান শোনাই। ‘আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই’ ‘শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই’ তাকে শোনাতেই তার সব স্থবিরতা কেটে যায়। রুক্ষতা ক্রুরতা চলে যায়। সে তখন উদার উদাস মাঝি যেন। সেও ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই’ ‘দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই’ বলে উদাত্ত গেয়ে উঠল । আমি তাকে জিগ্যেস করি, তুমি কাকে চাও গো ‘বাড়িতে ঢোকার প্রথম দরজা?’ সে কিছুতেই তার মনের ‘তোমাকে’-র কথা বলল না। সে যখন গাছ ছিল, সে যখন এক বিশাল অরণ্যের বাসিন্দা ছিল, সেই অরণ্যের ধারে ছিল এক ঝর্না, সেই ঝর্নায় আসত এক গ্রাম্য তরুণী— সেই তরুণীই বোধহয়, আমাদের বাড়ির প্রথম দরজার প্রেমিক ছিল! কিন্তু সে কিছু বললে না। সে শুধু লাজুক হাসল। ‘আমাদের বাড়ির প্রথম দরজা’কে এই প্রথম আমি হাসতে দেখলাম। তাকে এখন, আজ আর প্রহরী লাগছে না, তাকে আমার প্রবল প্রেমিক বলেই মনে হচ্ছে। আসলে দোষ আমাদের। আমরাই ‘আমাদের বাড়ির প্রথম দরজা’-কে প্রেমিক হতে দিইনি, উদার হতে দিইনি। আমরাই ওকে ‘সন্দেহবাতিক— অবিশ্বাসী’ করে গড়ে তুলেছি। এও আমাদের এক সংস্কার, এও এক অলিখিত ডিসিপ্লিন আমাদের হয়তো।

          সেদিন দেখলাম— এক বাড়ির দরজায় লেখা আছে, ‘অবনী বাড়ি আছে, আপনি এখন তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন!’ এরকম ‘প্রিয় বন্ধুর মতো দরজা’ আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমার সঙ্গে অবনীর আলাপ নেই, তবু সে বাড়ি আছে। এবং তার সঙ্গে যে কেউ দেখা করতে পারে, এমন আহ্বানে আমার ভিতরের নানান দোষে দুষ্ট, মনের দরজাও হঠাৎ খুলে গেল। অহংহীন ব্যাপক আকাশের মতো সেই মনের দরজার খুলে যাওয়া। আমার খুব হাল্কা লাগল, এবং আমিও নিজের ভিতরের খোলা দরজা নিয়ে, অবনীর বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করি— আরো খোলা মনের একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলব বলে। ভিতরে কেউ এস্রাজ বাজাচ্ছে, ভিতরে ফুলের সুগন্ধ, ভিতরে কেউ খোলা আকাশের ধ্যান করছে, নীরবে, অথচ তার মন সবাইকেই কাছে পেতে চায়। আসলে বাইরের খোলা দরজা দেখেই বোঝা যায়, ভিতরের মানুষেরাও খুব খোলা হাওয়ার গান জানে।

          আমাদের বাড়ির সবচেয়ে রসিক ও খোলা মনের দরজাটি হল, আমাদের রান্নাঘরের দরজা। তার মুখে সবসময় হাসি, কোনো অভিযোগ কোনো বিদ্বেষ নেই। কোনো ক্ষোভ নেই তার। সে রান্নার সুবাস ও স্বাদের মতোই সদা হাস্যময় ও সদা খুশি। আমাদের রান্নাঘরের দরজা খুব ভোজন রসিকও, সে অন্যকে খাওয়াতেও খুব ভালোবাসে। দরদী মন তার, স্নেহ ও মায়ায় ভরপুর। অন্যকে ভালোবেসেই তার সুখ, অন্যকে কাছে পেয়েই তার আনন্দ।

          অনেক দরজা দেখা যায় না। সে অদৃশ্য দরজা। সবাই মিলে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চাই, কিন্তু সে তো আছেই জেনে— আমরা দেখবো এমন আশায় বেঁচে আছি চিরকাল। কিন্তু সে মেঘে মেঘে নিজেকে আড়াল করে রাখল। সে ধ্যানের উপাসনার দরজা অল্প একটু খুলে রাখল, কিন্তু পুরো খুলল না, ফলে সম্পূর্ণ করে তাঁকে আর পাওয়া হয় না আমাদের। আমরা ওই নিবিড় ভালোবাসার পাহাড়চূড়াটিকে কাছে পেতে চাই, তাকে চাই আপন করে পেতে। কিন্তু সে এক অদৃশ্য দরজার আড়ালে রয়ে যায়, আর আমাদের তাকে পাওয়ার ইচ্ছে আরো প্রবল বেড়ে যায়, আমরা তাঁর অদৃশ্য দরজা খোলার জন্য শিশুর মতো কেঁদে উঠি। কিন্তু তাঁর সেই জয়যাত্রার দরজা একটু খোলে আবার খোলেও না। এ এক পাওয়া— না পাওয়ার মজা— এও এক সাধনভঙ্গী আমাদের। 

          মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর দরজার প্রয়োজন হয় না। মানুষ সবচেয়ে সংকীর্ণ, সবচেয়ে অবিশ্বাসী ও সন্দেহপ্রবণ এবং লাজুক। তাই তার দরজার প্রয়োজন। মানুষ খুব লাজুক ও অভিমানী বলেও হয়তো তার দরজার দরকার। কারো ওপর অভিমান হল তো, দরজা বন্ধ করে সে কাঁদল অনেকক্ষণ, তারপর গান শুনল রবীন্দ্রনাথের। তারপর চোখের জল, অভিমানের জল মুছে সে আবার দরজা খুলে বাইরে এলো, বাইরে নীল নির্মল আকাশ। অল্প ঠান্ডা বাতাস বইছে, সে দেখল দরজার বাইরে একটা নাম না জানা পাখি এসে বসেছে তার প্রিয় টগর গাছের ডালে। টগর গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় সেই অচেনা ছোট্ট পাখি যেন জলতরঙ্গের মতো গাছতরঙ্গ বাজাচ্ছে। এখন তার আফশোস হচ্ছে, সে কেন দরজা বন্ধ করেছিল একা হওয়ার জন্য! ভাগ্যিস দরজা খুলেছিল বলেই তো, সে দেখল ও শুনল পাখির গাছতরঙ্গের বাজনা!

          পৃথিবীর কোনো দরজা নেই, সে উদার উন্মুক্ত ও বিশাল। সমুদ্রেরও কোনো দরজা নেই, সেও বিশাল ও ব্যাপক। এই ছোট্ট পাখিটিরও কোনো দরজা নেই, সে দরজাহীন— আকাশময় এক তীব্র গান ও শুশ্রুষা। সে ঝেঁপে বরষা ও ভালোবাসার বরিষণ, পালকে ডানায় যেন তার খোলা গীতবিতানের পৃষ্ঠা উড়ছে।

            

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april

কোথায় কি

কো থা য়  কি

শান্তিপুরে এই প্রথম "কবিতা উৎসব ও আলোচনাচক্র"

একালের কবিকণ্ঠ ও ধানদূর্বা পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে শান্তিপুর কলেজের সহযোগিতায় ২৬ মার্চ ও ২৭ মার্চ বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দুদিনের কবিতা উৎসব ও আলোচনাচক্র এবং সম্মাননা জ্ঞাপন অনুষ্ঠান শুরু হয় শান্তিপুর কলেজের আধুনিক প্রেক্ষাগৃহে। শুরুতেই স্বাগত ভাষণ দেন শান্তিপুর কলেজের অধ্যক্ষা ড. চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এরপর সম্মানিত কবিরা গাছে জল দিয়ে শুরু করেন প্রথম দিনের শুভ উদ্বোধন।

আজীবন কবিতা যাপনের জন্য একালের কবিকণ্ঠ পত্রিকা দীর্ঘ কয়েক বছর উল্লেখযোগ্য কবিদের হাতে অর্পণ করছেন “একালের কবিকণ্ঠ সম্মাননা”।করোনা আবহে দুবছর সম্মান দেওয়া হয়ে ওঠেনি, এবছর ২০২০ সালের “একালের কবিকণ্ঠ সম্মাননা” তুলে দেওয়া হয় বনগাঁ শহরে বসবাসকারী সকলের প্রিয় কবি জলধি হালদার মহাশয়কে। এছাড়া ২০২১ সালের “একালের কবিকণ্ঠ সম্মাননা” তুলে দেওয়া হয় হুগলি জেলার চুঁচুড়া শহরে বসবাসকারী (অনুমাত্রিক পত্রিকার সম্পাদক) কবি দীপক রায়। দুই কবিকে গামছা দিয়ে বরণ করেন তরুণ প্রজন্মের কবিরা এবং সম্মাননা স্মারক, ফুল, মিষ্টি দিয়ে সম্মান জানানো হয়।

কবি জলধি হালদার আন্তরিকতার সঙ্গে বক্তব্য রাখেন, তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি থেকে কয়েকটি কবিতা সকলকে পাঠ করে শোনান। সেই সাথে কবি দীপক রায়ও তার কবিতা যাপনের দু-চার কথা বলেন।


ধানদূর্বা পত্রিকা এবছর (২০২২) থেকে শান্তিপুরের পাঁচজন কবির নামাঙ্কিত স্মৃতি সম্মান প্রদান করার উদ্যোগ নেয়। কবি কৃত্তিবাস ওঝা স্মৃতি সম্মান পেলেন কবি-প্রাবন্ধিক -অধ্যাপক জহর সেনমজুমদার। কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি সম্মান পেলেন কবি-অধ্যাপক বিজয় সিংহ। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত স্মৃতি সম্মান পেলেন কবি প্রাণেশ সরকার। কবি মোজাম্মেল হক স্মৃতি সম্মান পেলেন কবি-অধ্যাপক মন্দিরা রায়। কবি ফল্গু বসু স্মৃতি সম্মান পেলেন কবি-অধ্যাপক পঙ্কজ চক্রবর্তী। সম্মান প্রাপক পাঁচ কবিকে গামছা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। তারপর কবিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মান স্মারক , ফুল, মিষ্টি ইত্যাদি। প্রত্যেক কবি তাদের কবিতা যাপনের কথা শুনিয়েছেন, শুনিয়েছেন কবিতা।


এ পর্যন্ত ছিল প্রথম দিনের প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় কবিতা পাঠ ও আলোচনা। কবিতা পড়েন দেবজ্যোতি রায় সমরেশ মুখোপাধ্যায় সুব্রত চক্রবর্তী সুব্রত পাল গৌতম হেঁস শ্যামল দেবনাথ প্রাবন ভৌমিক রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দেবাশীষ সিংহ সুভাষ বিশ্বাস উৎপল বসাক অনিমেষ মণ্ডল।প্রত্যেক আলোচক তিনজন কবির কবিতার ওপর কবিতাবিষয়ক আলোচনা উপস্থাপন করেন। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক শান্তনু মণ্ডল, কবি-সম্পাদক-প্রকাশক গৌতম মণ্ডল, প্রাবন্ধিক শাহিদুর রহমান মণ্ডল, কবি সমিত মণ্ডল।


দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ রবিবার এক ঝাঁক কবির কবিতা পাঠ দিয়ে শুরু। কবিতা পড়েন সোনালী ঘোষ বিশ্বজিৎ সমরেশেন্দু বৈদ্য প্রবীর চক্রবর্তী সব্যসাচী মজুমদার প্রতাপ মুখোপাধ্যায় বিশ্বজিৎ কর্মকার সোমা প্রামাণিক সুতনু হালদার সৌরভ বর্ধন প্রতাপ হালদার শুভজিৎ সেন বিমল বিশ্বাস অমিত কুমার বিশ্বাস সায়ন্তনী হোঁড় তাপস মিত্র প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ সহ আরও অনেকে।


সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অভিমান্য পাল ও অসীম সরকার।

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april goddyo

উইন্ডো সিট

উ ই ন্ডো  সি ট

পা র্থ জি ৎ   চ ন্দ

partha

আনন্দবাবুর মেয়েরা…

বিকেলের দিকে সাভানা-হাইপোথিসিসের ছায়া গাঢ় হতে শুরু করে। এই যে বিষণ্ণ আর আনন্দিত মানুষ… মফসসলের পেটের ভেতর ক্রমশ ঢুকে পড়া মানুষ… সব যেন ব্যক্তিগত সাভানার দিকে ঝুঁকে রয়েছে বহু দিন। মাথার ভেতর তড়িৎ-ইঁদুর ঢুকে কুটিকুটি করে কেটে দিয়ে গেছে একটা-দুটো ফ্রেম, ফলে নষ্ট হয়ে গেছে ক্যানভাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্মৃতির ভেতর নির্মিত হচ্ছে সে সব অংশ; রং ধুয়ে যাবার নিজস্ব যন্ত্রণা আছে। মাথা খসে পড়ছে সে যন্ত্রণায়। 

জীবনে কাছ থেকে উঁচু গথিক গির্জা দেখিনি, অথচ আমি দিব্যি নিজে হাতে তার ভারি দরজার পাল্লা খুলে ফেলতে পারি। বেলফ্রে-টাওয়ার পর্যন্ত উঠে গেছে অন্ধকার ও পায়রার ডানার শব্দ। আমার মফসসলের অদৃশ্য গির্জার মাথায় উঠে আমি দেখি দিনান্তে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। দিনান্তে বাড়ি ফিরে আসছে মানুষের দল; ভীষণ রোম্যান্টিক সে ফেরা। যেন কালেকটিভ আনকনশাসনেসের পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে সবাই চলেছে ব্যক্তিগত-আফ্রিকার সন্ধানে। সভ্যতার সে প্রথম দোলনা… সাভানা।

কিন্তু আনন্দবাবুর মেয়েরা, আপনারা কোথায়? আড়াই দশকের ব্যবধানে আপনারা কোথায় হারিয়ে গেলেন আনন্দবাবুর মেয়েরা?

আপনাদের বাবা স্কুলে পড়াতেন, ধুতি পরতেন; বুক-পকেটের কাছে খুব সরু হয়ে ঝরে থাকতে এন সি নস্য। আপনারা পড়াশোনাতে খারাপ ছিলেন না; গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। দরকার হলে এম এ করতেন অথবা করতেন না। আপনারা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন এ মফসসলের জানালা; যে জানালা খুলে দিলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। 

আপনারা যে একটু আলাদা ছিলেন সে নিয়ে মফসসলের মাথাব্যথা কম ছিল না; অথচ আপনাদের ছিল হালকা রঙের মোটা পাড় শাড়ি। পায়ে হাওয়াই চপ্পল, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। সময়টা ছিল সেই সময় যখন মফসসলের কলেজে দামি পোশাক পরে যাওয়াকে অশ্লীলতা বলেই গণ্য করতে মানুষজন। আপনারা ছিলেন তার থেকেও সাধারণ; সাধারণের থেকেও সাধারণ। খুব সাধারণ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন আপনারা মনেপ্রাণে।

আপনারা গ্রীষ্মের দুপুরে ছাতা-ছাড়া টংটং করে সাইকেল চালিয়ে স্টেশনরোড ধরে বাড়ির দিকে ফিরতেন। সাইকেল থামিয়ে এক টাকার আইসক্রিম খেতেন চুষে চুষে। আইসক্রিমওয়ালা বরফের মাথায় এক চিমটে বিট-লবন দিয়ে দিত। বরফ গলত দ্রুত; আপনাদের রোদে পোড়া গালে হাতে এসে পড়ত নীলঅঞ্জনঘনপুঞ্জছায়ার একটি দু’টি ক্ষণ। 

খুব সাধারণ, খুব সাধারণ হতে চেয়েছিলেন আপনারা; শুধু একটি বিষয়ে আপনারা ছিলেন অসাধারণ। 

আপনাদের অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া তিনটি ঘরের একটিতে ছিল হাপরটানা হারমোনিয়াম; পাশের পাড়ার একটি ছেলের বাড়িতে ছিল তবলা। আপনাদের হারমোনিয়াম আর ওই তবলার দেখা হয়েছিল; সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝি ওই দেখা হওয়াটি ছিল একটি পবিত্র ঘটনা। 

বিকেলের দিকে গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া ছুটে এসে ঢুকে পড়তে কলোনির দিকে; হলুদ-ল্যাম্পের আলোয় আপনাদের রিহার্সাল শুরু হত। আপনাদের বাবা ছিলেন অবধারিতভাবে ওপার বাংলার মানুষ। কলোনির মানুষের মুখে মুখে আপনাদের গানের নাম রটে গিয়েছিল, ‘কমরেড-গান’। 

প্রায়-অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াত তীব্র প্রাণখোলা সুর, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না…।’

বেঞ্জামিন, প্রিয় বেঞ্জামিন মোলায়েজ… তখনও জানি না তোমাকে কেন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল… শুধু জানতাম, তুমি শাসকের ফাঁসিতে চড়েছো মানে তুমি ভাল-মানুষ। তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম মোলায়েজ; বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম আমাদের গান আমাদেরই গাইতে হবে। সে গান বন্ধ করবার জন্য হায়না ঝাঁপিয়ে পড়বে… কিন্তু আনন্দবাবুর মেয়েরা… আপনারা আমাকে শিখিয়ে ছিলেন গান বন্ধ করলে চলবে না… গেয়ে যেতে হবে, গেয়ে যেতে হবে। ঠিক যেভাবে হাস্কি-গলা নিয়ে, নিচের দিকে সুর ঠিক লাগে না; তবুও আমরা গেয়ে চলেছি শীতগ্রীষ্মবর্ষা। 

‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’ গানটির সঙ্গে অ্যাডেসিভের মতো সেঁটে রয়েছে কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ। দিনের পর দিন শুনেছি ওই গান; তবু একদিন গানটির ভেতর ঢুকে পড়েছিল কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ। আজও গানটির থেকে সে গন্ধকে আমি পৃথক করতে পারিনি। 

আপনাদের গণনাট্য-শাখার নাম কী ছিল? ‘সংগ্রামী উদ্বাস্তু কলোনি’ শাখা? স্মৃতি প্রতারক, আপনাদের কথা মনে আছে অথচ ধীরে ধীরে ভুলে যেতে বসেছি সে শাখার নাম। দলের যে ছেলেটা ম্যারাকাস বাজাতো তাকেও স্পষ্ট মনে আছে। ফিকে হয়ে যাওয়া নীলচে জামার ভেতর ধুকপুক করছে ছোট্ট একটা শরীর; কিছু না-করাই তার মন্ত্র। সে যে কিছু হবে না এবং ম্যারাকাস বাজিয়ে বাজিয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে, এরকম এক অসম্ভব স্বপ্ন দেখা তখন রীতিমতো বাস্তব ছিল। 

আনন্দবাবুর মেয়েরা, আমি কতদিন চেয়েছি আপনাদের গানের পাশে বেড়ালের মতো চুপটি করে বসে ওই ম্যারাকাস বাজানোর থেকেও সহজ কোনও একটা কাজ খুঁজে নিতে। 

স্ট্রিট-কর্নার শুরুই হত আনন্দবাবুর মেয়েদের গান দিয়ে, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি/ এখানে থেমো না…।’ বালুচরে আশার তরণী কেউ বাঁধে না, কিন্তু সংশয়ী মানুষ ছিলেন এক; সেরিব্রাল কিছুটা। ঠোঁটের কোণে বিড়ি ঝুলে থাকত; এক কোণে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ‘আমি শ্রান্ত যে, তবু হাল ধর/ আমি রিক্ত যে, সেই সান্তনা’ সলিলবাবু বলছেন বটে, তবে কমরেড, আমি কিছুতেই ওই শ্রান্ত আর রিক্ত শব্দদুটিকে গ্রহণ করতে পারি না… একজন কমরেড কেন শ্রান্ত আর রিক্ত হবেন! দিনের পর দিন এ ধাঁধার মধ্যে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের; অনেক পরে যুৎসই উত্তর পেয়েছি, কারণ সলিলবাবু তো লিখেছিলেন, ‘এ যে কুয়াশা, এ যে ছলনা/ এই বঞ্চনাকে পার হলেই পাবে / জন সমুদ্রের ঠিকানা…।’ 

শীর্ণ গঙ্গা হয়ে উঠত সমুদ্র, সূর্য পিঠে নিয়ে শুশুক ঘাই মারত। ক্ষয়াটে বুকের ভেতর থেকে কে যেন ডাক দিয়ে যেত, ‘নো পাসারান… নো পাসারান…।’ গানটির শেষ দিকে এসে দ্রুত লয় বদলে যেত, আনন্দবাবুর মেয়েরা বুক ভরে শ্বাস নিতেন। তাদের ঘামে ভেজা ব্লাউজ ফুলে উঠত, ‘আহ্বান, শোন আহ্বান…।’ 

ঘোড়ার দল ছুটে যাচ্ছে… দলে দলে ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। দিগন্ত পেরিয়ে। সে প্রথম মস্তিষ্কের কোষে কোষে প্রবেশ করেছিল একটা বোধ, সমস্ত জয়ের প্রথমে ও শেষে ফুটে থাকে গান। 

কিন্তু আনন্দবাবুর মেয়েরা সব কি প্রবল ‘রাজনৈতিক’ ছিলেন? ছিলেন না হয়তো, মিটিং শুরু হলে তারা সরে যেতেন এক কোণে। গ্যাট-চুক্তির বিরোধীতা আর কেন্দ্ররাজ্য বঞ্চনার মধ্যে তারা ছিলেন দারুচিনি দ্বীপের মতো। 

ক্ষমতা দখল করতে চায়নি তারা, তারা শুধু খুব সাধারণ হতে চেয়েছিল, এক অস্পষ্ট মুক্তির স্বপ্ন দেখে যেত তারা। তাত্ত্বিক দিক থেকে এ অস্পষ্ট স্বপ্নের তেমন কোনও গুরুত্ব নেই হয়তো; কিন্তু স্বপ্ন তো তত্ত্বকে অতিক্রম করে উড়ে যেতে পারে মাইলের পর মাইল। 

আনন্দবাবুর মেয়েরা অ্যাপলিটিক্যাল হবার মতো নিরাপদ দূরত্ব বাস করতেন না, আবার প্রবলভাবে পলিটিক্যাল হয়ে ওঠাও সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। 

নিশ্চয় বহু ‘আনন্দবাবু’র মেয়েরা এ দু’টির কোনও একটি হয়ে উঠেছিলেন; কিন্তু আমার দেখা আনন্দবাবুর মেয়েরা এমনই। 

তাদের নিয়ে মফসসলে মৃদু রটনা ছিল; তবলা-বাজানো ছেলেটার সাইকেল-ক্যারিয়ারে বসে তাদের ফ্যাটফেটে জ্যোৎস্নারাত্রে দেখা যেত মাঝে মাঝে। ‘অসুন্দর’ কিন্নরী… অসুন্দর বলেই এতদিন পর তারা মাঠঘাট পেরিয়ে ঝাঁপিয়ে আসছে। 

বহুদিন পর জোয়ান বায়েজের কণ্ঠে ‘উই শ্যাল ওভারকাম…’ শুনেছিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, পঁচিশ বছর আগের সেই আনন্দবাবুর মেয়েরা, আমার মফসসলের সে সব ‘আপাত রুক্ষ’ জোয়ান বায়েজ কোথায় হারিয়ে গেলে্ন আপনারা? কোথায়… কোথায়?

হাই-মাস্টের নীচে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘রাজনৈতিক’ দলগুলি কি আপনাদের খুঁজছে? না কি খুঁজে খুঁজেও পাচ্ছে না আপনাদের? 

আপনারা যেখানেই থাকুন দ্রুত ফিরে আসুন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী। ঈষৎ হাস্কি… খাদের দিকে সুর ঠিকঠাক লাগে না… ওই কোরাস ছাড়া কে মানুষকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে মাইলের পর মাইল? কে তাদের শেখাবে সেই মন্ত্র- ‘নো পাসারান… নো পাসারান…।’

আরও পড়ুন...