Categories
2022_june goddyo

প্রচ্ছদ কাহিনী | জুন সংখ্যা

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

সে লি ম   ম ণ্ড ল

selim2

মানুষ এ-কোন শিকল পরে থাকতে চায়!

ধর্ম, একটা বোধ। একটা বিশ্বাস। তাহলে এত ঠুকনো হয় কীভাবে? কোথায় কে কী বলল, তাতে যদি ধর্ম কালিমালিপ্ত হয়; তাহলে সেই কালি তৈরী করেছি আমরা নিজে। আমাদের নিজের কালো হাত নিজের মুখে পড়ে আয়নায় যখন দেখছি আঁতকে উঠছি! ধর্মগুরুরা আরও উসকে দিচ্ছে মানুষকে; দেখো মোহাম্মদের নামে এই বলেছে! এতে সাধারণ মানুষ বুনো ষাঁড়ের মতো ছুটছে। সাধারণ মানুষ জানে না কেন তারা ছুটছে? শুধুই কি তাদের ছোটা জরুরি বলে? তারা কোন মুক্তির পথ দেখতে চায়? একটা অস্থির অপ্রতিকূল পরিবেশে বাইরে বেরিয়ে একটি শিশু রোজ একটু একটু করে বৃদ্ধ হচ্ছে। একেকটা দিন তার কাছে যেন অভিশাপ! তার কথা কি ভাবছি? আগামীদিন সে কী করবে? কী খাবে? কোন পরিবেশে বেড়ে উঠবে?

riot

ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র করার পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। পুরাণকথিত রামকে কেন্দ্র করে; যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাবরি মসজিদ ভাঙার রায় দেয়, সেই দেশের সেই দলের এক নুপূর শর্মা এটা বললে এত ভাবিত হওয়ার কী আছে? ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র না বলে বলা যায়, ভারত ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র। নানা ধর্মকে পুঁজি করে একেক দল একেকসময় আখের গুছিয়েছে। দেশভাগের ইতিহাস বদলেছে। এই হিন্দুস্থান তার পূর্বের এক দলিল। বহুমানুষ এখনো দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে পূর্ব-প্রজন্মের স্মৃতি আওড়ায়। তাদের স্মৃতি শুধুই কি ভাঙা ঘর, শুকিয়ে যাওয়া কান্না আর লাল রক্ত? তাদের মধ্যে কি আপেক্ষ নেই? যন্ত্রণা নেই? ভাইয়ের-ভাই ভাগ হওয়ার? একটি নদী ভাগ হওয়ার? বিশাল আকাশ ভাগ হওয়ার?

কোভিড মহামারীর সময় মনে হচ্ছিল— এবার হয়ত মানুষ ফিরবে বিজ্ঞানের কাছে। মন্দির-মসজিদ-গির্জা তালবন্ধ করে মানুষ ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। যুক্তির কাছে। কোনো ধর্মীয় ভণ্ডামির কাছে গচ্ছিত রাখেনি তার নিয়ত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কুকুরের লেজ সোজা হয়নি। আমরা নিজেরাই লেজ নেড়ে এগিয়ে গেছি ধর্মগুরু বা নেতাদের বিস্কুটের কাছে। আধখানা বিস্কুট মানুষকে এতটা অন্ধ করে দেয় মধ্যযুগেও মানুষ দেখেনি। এ কোন আধুনিক যুগ! অন্ধবিশ্বাস আরও প্রশস্ত হয়!

ভারতের বাইরে তাকিয়ে দেখলেও বোঝা যায়, এই অন্ধকারের সুতো বিশ্বব্যাপী। এই কিছুদিন আগে আফগানিস্তানে মিলিটারি শাসনের পরিবর্তে শুরু হল তালিবানি শাসন। ভাবা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে এসে! অন্ধকার এত কালো হয়, কেউ কি ভেবেছে? ভাবে? সব যেন একটা পরিকল্পিত গ্রাফ। এর ঊর্ধ্বসীমা, নিম্নসীমা আমরা ঠিক করে রেখেছি!
বিশ্ব-রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবীমহল যদি এই নিয়ে ভাবত তাহলে আমাদের এই দিন হয় দেখতে হত না। কিন্তু কেন ভাববে? ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি একই জ্যামিতিবক্সে স্কেল, চাঁদা, পেনসিল। ভালো গ্রাফের জন্য সবটা প্রয়োজন…

কর্মসংস্থান, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জালিয়াতি, খুন, ধর্ষণ এসবের বিরুদ্ধে যদি মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বড়ো বড়ো মিছিলে নামত তাহলে পরবর্তী প্রজন্মকে টিকি বা দাড়ির দাসত্বে গলা ফাটাতে হত না। তারা দেখত আগামী প্রজন্ম ধর্মগ্রন্থকে পাঠ্যবই হিসেবে নিচ্ছে। আর যাবতীয় কুসংস্কার আর মিথ্যাচারের কাছে ছুঁড়ে দিচ্ছে জমানো থুতু। তাদের স্কুল হয়ে উঠত একেকটা উপাসনালয়। সেখানে সবাই আল্লা, সবাই ঈশ্বর।

মানুষ এ কোন শিকল পরে থাকতে চায়। একটা সময় পর হাতে-পায়ে দাগ বসে। ক্ষতের দাগ। নিজেই নিজের দাগে মলম দেয়। কিন্তু শিকল ছেঁড়ে না। এই শিকল তার প্রভুর দান!

মানুষ ভুলে যায়— মুক্ত হওয়ার আনন্দ। মানুষ ভুলে যায়— বিজ্ঞানের যুক্তি। ধর্মের সাজানো তাসে বাজি জিতবে বলে জুয়ার আসরে বসে। হেরে যায়। খুনোখুনি করে।

চকচকে শিকলের জং দূরের পাড়ায় ধুয়ে দেয় তাজা রক্ত!

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june uponyas

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা । পর্ব ২

উ প ন্যা স । পর্ব ২

ম ল য়   রা য় চৌ ধু রী র

জাদুবাস্তব উপন্যাস

malay_roy_choudhury

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা

(গত সংখ্যার পর)

নৈনিতাল তোর পছন্দ হল। কত সুন্দর না? জায়গাটা? বিশেষ করে শীতের সময়ে, তুষার দেখতে দেখতে তোর স্কুল ছুটি। বৈদেহীরও প্রিয় ছিল স্কুল আর শহরটা, শুনেছি।

সতীর নয়ন পড়েছিল বলে নৈনিতাল, শুনেছি।

সতীর চোখ, ভেবেছিস কখনও!

অমরিন্দরের মতে সতীর মতন চোখ কোনো মহিলা পেতে পারে না; ওই তিনটে চোখই তৈরি হয়েছিল।

আইডেনটিটিকার্ডে তোর ফোটো, আইগ্লাস দিয়ে এনলার্জ করে দেখে,  অনুমান করতে পারি,  চোখ দুটো কত সুন্দর, যতো তোর বয়স বেড়েছে, ঠিক জানি,  তত সুন্দর হয়েছে তোর চোখ, কালো গভীর আর বেশ বড়ো, যেমন বাঙালি মেয়েদের হয়। কাঁদলে কেমন হয় তোর চোখজোড়া? হাসলে কেমন হয়? কারোর সঙ্গে ঝগড়া করলে কেমন হয়? তোর এখনকার জীবন্ত চাউনিগুলো দেখার বড়ো ইচ্ছা হয় রে।

কবে দেখলাম তোর চোখ ? দেখেছি বৈকি। চোখ বুজলেই দেখতে পাই আর ভাবি কত ভুল যে করেছিল তোর মা তোকে ডাস্টবিনে  ফেলে দিয়ে। আমার মনে হয় দূর থেকে লক্ষ্য রেখেছিল, তোকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্য ; তখনই তোর চোখের টান এড়ানো ছিল অসম্ভব।

আমি তোর চোখের টানেই সন্মোহিত হয়েছিলাম। তোর গন্ধে। কেন বল তো ? কারণ তোর গন্ধ অন্য শিশুদের থেকে আলাদা ছিল, তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি, বোতলের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছিস।

 

এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

বড়ো হয়ে উঠলি, বড়ো হয়ে উঠলি, অমাবস্যাকে একরাতে পরিযায়ী করে চলে যাবি বলে !

 

তোর ক্লাস সেভেনের ডায়রিতে, হস্টেলের ওয়ার্ডেন দেখেছিলেন, একটা পৃষ্ঠায় তুই লিখে রেখেছিস, লাল ডটপেন দিয়ে, “আই নো, সামওয়ান ওনস মি, বাট ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” পৃষ্ঠাখানা ছিঁড়ে অমরিন্দরেকে দিয়েছিলেন ওয়ার্ডেন, এই ভেবে যে তুই কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিস।

ওই স্কুলে ছেলেরা পড়ে না, কি করেই বা কোনো ছেলের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হবে, তা নিজেও চিন্তা করেছিলেন ওয়ার্ডেন।

জগদীশ বুঝিয়েছিল অমরিন্দরকে, না, না, ও জেনে ফেলেছে, যে ওর পড়াশুনা থাকা খাওয়া পোশাক আর জীবনে যা প্রয়োজন তা কেউ একজন অলক্ষ্যে যুগিয়ে যাচ্ছে, আর তার জন্য তুমিই দায়ি অমরিন্দর, আমাদের ছেলে আর মেয়ের চেয়ে দামি জুতো জামা উপহার ইত্যাদি কিনে  ওর মনে সন্দেহ তৈরি করে দিয়েছ। ও ভাবে, ওকে কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে।

মেয়ে বৈদেহী আর ছেলে আরিয়ানও প্রশ্ন তোলে, কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট। শুনেছি।

অমরিন্দর উত্তরে বলেছিল, আর ব্রো-প্রো যে অন্যদের দিয়ে নেতিকে বাংলা-ইংরেজি বই পাঠায়, প্রতি বছর দূর্গাপুজোয় দামি টোম্যাটোরেড পোশাক পাঠায়, তার বেলা ?

যাতে ওর জ্ঞান বাড়ে, কালচার্ড হয়, সেজন্য পাঠায় ; ব্রো-প্রোর মগজে আঁস্তাকুড়ের ভয় কি আর নেই !

তা বইগুলো বৈদেহী আর আরিয়ানই বেশি পড়ে, নেতি স্কুল থেকে ছুটিতে এলেও ম্যাথস ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতেই বসবাস। বৈদেহী বইগুলো পেয়ে সাহিত্যের পোকা হয়ে গেছে ; বাংলা সিডি এনে গান শোনে। শুনেছি।

আমি চেয়েছিলুম তোকে সবচেয়ে ভালো পোশাক আর জুতো কিনে দেয়া হোক ; বই কিনে দেয়া হোক। কিন্তু কি করেই বা তুই জানলি, বিশ্বাস করলি ? বিশ্বাস আর সন্দেহ  তো একই ব্যাপার নয়। জানিস তো, মানুষের সন্দেহ হল বিশ্বাসঘাতক প্রক্রিয়া, কিন্তু নিজের ভেতরের আলো-অন্ধকার খুঁজে পেতে হলে সন্দেহ ছাড়া উপায় নেই, না রে ?

তোর কি মনে হয় না যে বিশ্বাস ব্যাপারটা জঘন্য, দূষিত, মন্দ ? বিশ্বাসের বিপরীত হল সন্দেহ, কিন্তু তা যদি বিশ্বাসের উপাদান হয়, তাহলে কি করবি ? তোর মাথায় নিশ্চয়ই এই দোনামনা দোল খেয়েছে, টিং টুং টিং টুং, জানি আমি, ফর শিওর।

পথপ্রদর্শকের হাত ধরে প্রতিবিম্ব পালটে যায়, পাহাড় ফাটিয়ে বের করে আনে প্রতিধ্বনি।

রোদে নিকানো আকাশে তখন ঝুলে থাকে পরিযায়ী পাখির একাকীত্ব।

রোদ্দুর উত্তরায়ন মেনে চললে কী-ই বা করার ! অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো।

সেভেনথ স্ট্যাণ্ডার্ড থেকে তোর প্রতিটি ক্লাসের আইডেনটিটি কার্ড রেখেছি যত্নে, চণ্ডীগড় থেকে ডাকে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোর অভিভাবক পরিবার , যখন তোর বারো ক্লাস শেষ হল, আমি তখন সিলভাসাতে পোস্টেড।  তুই কি টের পাসনি  যে কোথায় গেল স্কুলের আইডেনটিটিকার্ডগুলো ? ওগুলো দেখি মাঝেসাজে, কেমন একটু একটু করে ডাগর হয়ে উঠেছিস; ফিচার্স স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জগদীশের বাড়িতে আছিস বলে তোকেও নাকি বৈদেহী আর অমরিন্দরের  মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে, শুনেছি।

জাঠনি ! ভাবা যায় !

তুই তো বাঙালি ; মোষের দুধ হজম করতে পারিস তো ?

আশ্চর্য না ? তুই কলকাতার আঁস্তাকুড় থেকে এসে যাদের বাড়ির সদস্য হলি, তাদের মা-মেয়ের মতনই দেখতে হয়ে গেলি ক্রমশ, বারো ক্লাস পর্যন্ত তোর আইডেনটিটি কার্ডের ফোটো দেখে তেমনটা অনুমান করতে ভালো লাগে।

তুই কি  ঢ্যাঙা হয়েছিস,  তোর পাদুটো লম্বা হয়ে চলেছে নাকি, বৈদেহী-আরিয়ানের মতন, জাঠদের মতন?  নাচ শিখতে পারতিস, তা নাচ তোর প্রায়রিটিতে নেই, শুনেছি।

ক্লাস টেনে যখন ফার্স্ট হলি, সিস্টার অ্যানি তোর সাক্ষাৎকার নিয়ে ছাপিয়েছিলেন স্কুল ম্যাগাজিনে, তার কপি আছে আমার কাছে, পড়ে পড়ে মুখস্হ হয়ে গেছে প্রশ্ন আর উত্তরগুলো ; শুনবি ?

তুই তো এখন আমেরিকায়, চাকরি করিস, শুনেছি গাড়িতে অফিস যাস, তবু শোন, তোরই ইনটারভিউ।

সিসটার অ্যানি: তোমার নাম নেটি, এর অর্থ কী ?

তুই: নেটি মানে নিও টেরেস্ট্রিয়াল, শর্টে নেটি রেখেছিলেন আমার ফসটার ফাদার। বাংলায় নেতি।

সিসটার অ্যানি: তুমি বড়ো হয়ে কী হতে চাও ?

তুই: আমি অ্যাস্ট্রনট হতে চাই, স্পেস সাইন্টিস্ট হতে চাই। চাঁদের মাটিতে, মঙ্গলগ্রহের মাটিতে হাঁটতে চাই।

সিসটার অ্যানি: কেন ? তোমার সহপাঠিরা বেশির ভাগই ডাক্তার হতে চাইছে, বা কমার্স পড়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে চাইছে, পলিটিশিয়ান, উকিল, বিজনেসউওম্যান হতে চাইছে।

তুই: জানি। আমার ম্যাথেম্যাটিক্স খুব ভালো লাগে, ফিজিক্স ভালো লাগে; সীমাহীনতার বিস্ময় আমাকে মোটিভেট করে। আমি আইআইটিতে কমপিট করতে চাই।

সিসটার অ্যানি : তোমার প্রিয় ফিল্ম নায়ক কে ?

তুই: ব্র্যাড পিট।

সিসটার অ্যানি: কেন ? দেখতে অ্যাট্রাকটিভ বলে ?

তুই: শুধু তাই নয়, উনি আর অ্যানজেলিনা জোলি বেশ কয়েকজন শিশুকে অ্যাডপ্ট করেছেন। একিলিসের ভূমিকায় মানিয়েছিল ওনাকে।

সিসটার অ্যানি : তুমিও বড়ো হয়ে কোনো শিশুকে অ্যাডপ্ট করার কথা ভাবো কি ?

তুই: হ্যাঁ, আমি বিয়ে করব না। কয়েকটি শিশুকে অ্যাডপ্ট করব।

সিসটার অ্যানি: যদি কাউকে তুমি ভালোবেসে ফ্যালো ? কিরকম সঙ্গী চাও ?

তুই: আমি চোখ বুজে তাকে দেখতে পাই, কিন্তু বর্ণনা করতে পারব না। আমি আমার ফসটার ফাদারকে আজও দেখিনি, তাঁকে আমি আমার ফাউনডিং ফাদার মনে করি, আমার প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর মতো পুরুষ আমার পছন্দ, তাঁকেই পছন্দ।

সিসটার অ্যানি: তোমার উড বি হাজব্যান্ড কোথায় তোমাকে প্রোপোজ করুক, তুমি চাও ?

তুই: যদি বিয়ে করি, চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রোপোজ করলে ভালো। তবে আমি ওই পুরোনো প্যাট্রিয়ার্কাল রিচুয়াল রিভার্স করতে চাই, আমিই প্রপোজ করব, সে গ্রহণ করবে। বিয়ে আমি করব না বলেই মনে হয়।

সিসটার অ্যানি:  ফিল্ম দ্যাখো, মুভিজ ?

তুই: না, ফিল্ম দেখতে আমার তেমন ভালো লাগে না, ওয়েস্টেজ অফ টাইম মনে হয়।     

সিসটার অ্যানি: কোন ধরণের ফিকশান তোমার ভালো লাগে ?

তুই: ফাইভ সিক্সে পড়ার সময়ে হ্যারি পটার সিরিজের  বইগুলো ভালো লাগত ; এখন ট্র্যাশ মনে হয়। এখন আমার  সিমপ্লিফায়েড শেক্সপিয়ার ভালো লাগে, বিশেষ করে ট্র্যাজেডিগুলো।

সিসটার অ্যানি: কমিকবুকের কোন চরিত্র তোমার পছন্দ ?

তুই: অ্যাস্টারিক্স আর ওবেলিক্স। ওতে আমি নিজের একটা চরিত্র কল্পনা করে নিই, নেটিফিক্স, যে নেটওয়র্কিং করে সকলের সমস্যা সমাধান করে, কেননা ওই কমিকবুকে চরিত্ররা কেবল একের পর এক সমস্যা গড়ে তোলে।

সিসটার অ্যানি: কোন খেলা ভালো লাগে?

তুই: ফুটবল।

সিসটার অ্যানি: কোন টিমকে সমর্থন করো?

তুই: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

সিসটার অ্যানি: কার কবিতা ভালো লাগে?

তুই: টি এস এলিয়ট, কবিতায় গল্প না থাকলে ভালো লাগে না।

সিসটার অ্যানি: ওনার কবিতা তো বেশ কঠিন, বুঝতে পারো ?

তুই: বুঝতে বিশেষ পারি না, অনুভব করতে পারি।

সিসটার অ্যানি: বেঙ্গলি পোয়েট্রি পড়ো না ?

তুই: না, পড়ি না , পড়তে ইচ্ছা করে না। আমার বেঙ্গলি বার্থ পোয়েটিকাল নয়, আই অ্যাম এ ডিসাকার্ডেড বেঙ্গলি। তবে একজন বেঙ্গলি কবির আত্মহত্যার ঘটনা আমায় সন্মোহিত করেছে।

সিসটার অ্যানি : তোমার প্রতি বছরের ডায়েরিতে একটা লাইন লেখো, “ আই নো, সামওয়ান ওনস মি, বাট ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” তুমি কি ঈশ্বরের কথা ভেবে লেখো ? নাকি তুমি কবিতা লিখতে চাইছ?

তুই : হ্যাঁ, উনি আমার ব্যক্তিগত ঈশ্বর, আমার ফাউনডিং ফাদার। ওই লাইনটা লিখে ওনার আরাধনা করি, সম্পর্ক পাতাই। আই লাভ হিম ইন অ্যাবসেনশিয়া।

এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

জগদীশ একবার বলেছিল,  নিজের ছেলেমেয়ের চেয়ে তোকে বেশি ভালোবাসে, ও যা চায়, তুই তেমন করেই গড়ে তুলছিস নিজেকে, কখনও অবাধ্যতা করিস না। প্রায় তোর মতনই ওদের গায়ের রঙ ; জগদীশের রঙ পেয়েছে দুজনেই। হাইট পেয়েছে অমরিন্দরের। ফর্সা হলে তিনজনের মধ্যে কমপ্লেক্স গড়ে উঠত, সে আরেক হ্যাঙ্গাম। কী করে এরকম মানিয়ে নেবার চরিত্র পেলি রে ?

বৈদেহী আর আরিয়ানের খারাপ লাগতে পারে, তুই ওদের বাবা-মায়ের ওপর ভাগ বসাচ্ছিস ভাবতে পারে বলে, জগদীশকে আঙ্কলবাপি আর অমরিন্দরকে আন্টিমা সম্বোধন আবিষ্কার করে ফেললি। সবই অবশ্য শোনা, একবছর বয়সের পর  তো আজও দেখিনি তোকে, আর ওদের ছেলেমেয়েকে।

জগদীশ জানিয়েছিল, বৈদেহী আর আরিয়ান নাকি চাইত না  যে তুই বাপি আর মা বলে সম্বোধন করিস  ওনাদের, বাপি আর মা কেবল ওদের।

তুই জেনে ফেলেছিস যে তোর জন্মের পরেই তোর মা তোকে অনাথ করে দিয়েছিল ; অনাথ শিশুদের হামাগুড়ি থেকে কেউ একজন তোকে পছন্দ করে তুলে দিয়েছিল  ‘এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড’ সংস্হার হাতে।

বৈদেহীর সঙ্গে ঝগড়ায় ওর আলটপকা মন্তব্যে সন্দেহ হয়েছিল তোর ; তারপর জগদীশ-অমরিন্দরের কথাবার্তা শুনে ফেলে থাকবি কখনও। ওরা দুজনেই মদ খাবার পর বড্ড বকবক করে, বিছানায় শুয়েও গ্যাঁজায়, ব্রো-প্রোর টাকা এসে পড়ে আছে রেলিভ্যান্ট অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দাও, এই ধরণের কথাও বলাবলি করে থাকবে।

আমি তোকে দিতে চেয়েছিলাম কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতের বসন্তকাল, শীতের পশ্চিমবাংলার ফিনফিনে গ্রামীণ রোদ, চিরসবুজ অ্যামাজন অরণ্যের ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও পাখিদের রঙিন উড়াল।

তুই চাইলি আরও ওপরের আকাশে ভেসে বেড়াবার স্বাধীনতা, আরও উঁচু, আরও উঁচু, আরও উঁচু, বাধাবন্ধনহীন  নীল, যেখানে পাখিদের ডানার রঙ কালো বা ধূসর।

যে আঁস্তাকুড়ে অবহেলায় ভোররাতের শিশিরে ভিজছিলিস তা পশ্চিমবাংলায়; তোর  রোষ চাপিয়ে দিলি পশ্চিমবাংলার ওপর, কলকাতা শহরের ওপর।

জানি, ব্লু-গোল্ড পোশাকে তোকে মানায়। কিন্তু আমার পছন্দ টোম্যাটোরেড লাল রঙের পোশাক।

কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতের কথা  কেন বলছি বলতো ? তোর গায়ের রঙ শ্যামলা, বৈদেহীর চেয়ে এক পোঁচ বেশি,শুনেছি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর ওই সমুদ্র সৈকতে পয়লা জানুয়ারি অজস্র মানুষ-মানুষীর ভিড় হয় ; অন্য সময়েও নগ্নিকারা শুয়ে থাকেন বালির ওপর নরম ম্যাট বিছিয়ে। তারা তোর মতোই শ্যামলী, অনেকে কৃষ্ণাঙ্গীও। কেবল শেতাঙ্গিনি আর শেতাঙ্গদের জমায়েত তোকে বিব্রত করত, যেমনটা ইউরোপের সমুদ্র সৈকতগুলোয় হয়। গোয়ার সমুদ্র সৈকতের কথাও বলতে পারতাম, সেখানে রাশিয়ার নগ্নিকারা ভারতীয় চোরাদর্শকদের হাতছানি দ্যায়।

যখন রিও ডি জেনেরিও আর সাও পাওলো যাবি, দেখিস সেখানকার কার্নিভাল, চোখ জুড়িয়ে যাবে, ইচ্ছা করবে কার্নিভালের নর্তকীদের সঙ্গে নাচতে।

আমি তো ছিলাম রিও ডি জেনেরিওর ভারতীয় এমব্যাসিতে, ট্রেনি হিসাবে, প্রোবেশানারি  পোস্টিঙের আগে। সেসময়ে পরিচয় হয়েছিল দূতাবাসের অফিশিয়াল ট্রানস্লেটর-ইনটারপ্রেটার কণিকা হালদারের সাথে, হৃদ্যতা বলতে পারিস; দজনেই বুঝতে পারছিলাম একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি, বাঙালি বন্ধুর অভাব মেটাতে, বাংলায় কথা বলার লোভে। আমরা দুজনেই টের পেয়েছিলাম যে প্রেম বিয়ে সংসার করা টাইপের নই, দুজনেই, ক্যারিয়ারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে শেষকালে, জীবনকে রুদ্ধ করে দেবে, পরস্পর আলোচনা করে আর এগোইনি।

কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতে অন্য যুবক-যুবতীরা চুমু খাচ্ছিল, দেখাদেখি বলতে পারিস, আমরাও খেলাম, কণিকা হালদার বলল, ছিঃ, চুমু জিনিসটা নোংরা, স্মেলি, কি যে হয় চুমু খেয়ে।

আমারও মনে হয়েছিল, একে তো ভালোবাসি না, কেনই বা একে চুমু খাচ্ছি, এর মুখে ক্যাণ্ডললাইট শুয়োর-ডিনার খাবার দুর্গন্ধ। ব্যাস, আমার জীবনে শেষ তরুণী।

এখন ভেবে দেখলে, মনে হয়, ভাগ্যিস কণিকা আর আমি জড়িয়ে পড়িনি। পড়লে, তোকে অন্য কেউ স্পনসর করত, আর আমার জীবনের অভিমুখ থাকত না কোনো।

অভিমুখ সব সময় যে নিজের নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করে না, তাও জেনেছি, পরে।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june goddyo

উইন্ডো সিট

উ ই ন্ডো  সি ট

পৌ লো মী   মু খা র্জী

paulami2

বসন্ত, কালুরাম এবং সেকেন্ড লেন

বসন্ত কেমন রোগ জানি না। আমাদের ৭/১এ, অনরাইট সেকেন্ড লেনের বারো ঘর বাড়িতে সে হয়তো ঢুকতে ভয় পেত। কখনো কখনো চৌখুপি জানলা দিয়ে সন্ধে নামলে শাঁখের আওয়াজ, নামাজের সুরের সঙ্গে সঙ্গে বৈকালিক হারমোনিয়ামের রিদমিক আর্তনাদ শোনা যেত। হকি মাঠের দিক থেকে ক্রমান্বয়ে হকি স্টিকের ঠোকাঠুকির শব্দ, পাশের বাড়ির শাউড়ি-বউয়ের উদোম চিৎকার সেই সব দিনে দখিনা বাতাসকেও প্রাণপনে আটকে রাখতো। আমরা তো বসন্ত মানে বুঝতাম ‘মায়ের দয়া’। এ রোগ একবার যাকে ধরে তার থেকে শত হস্ত দূরে থাকাই শ্রেয়। 

কালুরাম নামে একটা কোকিল ছিল আমাদের বাসায়। সারা বছর সেই কোকিলের কুহুরবে প্রাণপাখি যায় যায়। বিশেষ করে পড়তে বসার সময়টুকু সেই একঘেয়ে কুউউউ কুউউউ ডাক যেন ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো।’ বইপত্র ছুঁড়েটুড়ে ফেলে মনে হতো খাঁচা খুলে কালুরামকে উড়িয়ে দিই। 

অবশ্য ঋতুচক্রের আবর্তনের খবর সে বেচারা কী করে জানবে? গলির আয়তাকার রোদ্দুরে আলো ছায়ার কাটাকুটিতে, হালকা বৃষ্টির জমে যাওয়া জলে, গুমোট বাতাসে বসন্ত পা রাখতেও চিন্তা ভাবনা করতো। বেচারা কালুরাম, তার যুবক মনের আকুতি জানাতে তাই বছরের বিশেষ কোন ঋতুকে খুঁজে নেয়নি। সারা বছরই তার কাছে একইরকম ছিল। 

দোলখেলা নিয়েও আমাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না, কারণ এই দোলের পরেই আসবে পরীক্ষা। কাজেই রঙের কোন বিলাসিতা ছিল না আমাদের এবং কালুরামেরও। জগতের সব রঙ শুষে নিয়ে মিশমিশে কৃষ্ণ গহ্বরের মতো একলা দাঁড়ে বসে গলা ফুলিয়ে ডাক ছাড়ত কালুরাম। সেই ডাক শুনে মনে হতো বসন্ত না জানি কি ভয়ানক ঋতু। দরকার নেই কোনো। ও না হয় থাক রচনা বইয়ের পাতাতে। 

এরই মধ্যে একটা হুলো বেড়াল তক্কে তক্কে থাকতো। কীভাবে জানি না কেউ বোধহয় খাবার দিয়ে গিয়ে কালুরামের খাঁচার পাল্লাটা টানতে ভুলে গেছিল। রাতের আঁধারে সেই খোলা পাল্লার ভেতর দিয়ে কালুরাম বেরিয়ে এলো কিন্তু মুক্তির স্বাদ আর তার পাওয়া হোল না। বেচারা দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে উড়তে গিয়েও পারলো না। তক্কে তক্কে থাকা হুলোটা তাকে থাবার নখরে ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত করে পালিয়ে গেল। খুব ভোরে উঠে দেখি সারারাত লাল রঙের ফাগে হোলি খেলে ঠিক খাঁচার পাশটিতেই রক্তাক্ত কালুরাম পড়ে আছে। তার রঙ খেলার শখ চিরতরে মিটে গেছে। 

৭/১ এ, অনরেইট সেকেন্ড লেনের বাড়িতে তাই বসন্ত-টসন্ত কোনোদিনই কিছু মনে হয়নি। শুধু জানতাম বসন্ত খুব ছোঁয়াচে রোগ। একবার ছুঁয়ে দিলে সারা শরীরে, মুখে দাগ ধরে যায়। সারা জীবনেও সে দাগ মুছবার নয়।

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june goddyo

কারাবাসের কবিতা । পর্ব ৪

বি শে ষ  র চ না । পর্ব ৪

ডঃ রূপক বর্ধন রায়

rupak2

কারাবাসের কবিতা: বাংলা অনুবাদে ব্রায়টেন ব্রায়টেনবাখ

( গত সংখ্যার পর )

‘The true confessions of an albino terrorist’ বই থেকে।

মোটা দাগের বরফ পড়ে  

আমার ঘুমের ভিতর মোটা দাগের বরফ পড়ে

আর সাদা সেই সৈকত আর সাদা 

সেই নিষিদ্ধকর সমুদ্র– ঘষটে হওয়া দাগগুলোর

মাঝে এক বিষণ্ণ পথ চলা, কোলাহল আর কচকচানি, ত্যারছা হয়ে নেমে আসা আঘাতেরা।

 

ধূসর সিমেন্টের

নিঃসঙ্গ শহরগুলো।

ধূসর সিমেন্টের রাস্তারা আর গাছেদের

গায়ে ছোটো মাইক্রোফোনের মতো

ঝুলে থাকা জলকণা

যা ধূসরতাটিকে লুফে নেয় আর তাকে আরো প্রবল করে তোলে।

 

লোমশ জানলা-শার্সি ধোয়ানো জলপাইপগুলোয়

আমাদের পড়শিরা আছে, আইরিসের ভেজাভাবের উপর

চোখের পাতা। তোমার এলিয়ে পড়া শরীরের 

সাদা চোখে আমি নেমে

আসবো। তোমার দাঁতগুলো খুদে বরফ-মানুষ।

মণির অভ্যন্তরে নিশ্চিহ্ন হব আমি।

 

কালো জিভের প্রহরীরা

আছে– পুঁজভর্তি চাঁদের মতো

জিভগুলো– আর

ছেঁড়া 

সমুদ্রটা ও অভ্যন্তরের তলবিহীন বরফ-প্রান্তরের

মধ্যবর্তী গলাটায় রূপোলি মেশিনগানেরা:

একটা বর্ডারপোস্ট–

‘Buffalo Bill’ বই থেকে (জুন ১৯৭৬ – জুন ১৯৭৭-এর মধ্যবর্তী সময়ে লেখা কবিতা)

ফাঁসি

এখন ভোর পাঁচটা

পাখিরা গান গায়

যারা বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখে বিদায় নেবে গান গায়

 

আজ হয়তো ওরা

তবুও উড়তে শিখবে

কিন্তু কাল ভোরে আবার পাখিরা গান গাইবে

‘Eklips’ বই থেকে (১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে লেখা কবিতা)

৭.৪

 

এটা আলকাতরাজ নাও হতে পারে

তবু পাখিটা আর

তার ক্ষুদ্র সাদা দানাগুলো সম্বন্ধে

আমিও সবটা জানি

 

 

আমার মেঝের রাত্রি যাপনে যখন আমি মাথার উপর দাঁড়াই

জেটমোটোরের উষ্ণ ঘ্যানঘ্যানানি শুনি আমি

আর থুতুর মতো কমলা আগুন ছিটানো ওদের সেই দপদপে প্রতিশ্রুতি

কালো রূপকের উপর দিয়ে আমায় দূরে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে

 

১০.২

 

এই সমস্ত মৃত রাত্রিরা

ছাই স্তূপাকৃত সকালগুলো

ক্রমশ

লেখক পরিচিতি :  GE Heathcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত, ফ্রান্স-এর নীস শহরে থাকেন। টার্কি-র সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্ত্রাস্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভারসিটি ও পি এইচ ডির পর বছর খানেক জার্মানির ফ্রনহফার সোসাইটিতে সায়েনটিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। লেখালেখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ট্রাভেলগ, সাহিত্য মনন নিয়েই। কলেজজীবনে বন্ধুরা মিলে “দেওয়াল” নামক কবিতা পত্রিকা চালিয়েছেন কয়েক বছর। এছাড়াও কবিতা, গদ্য প্রকাশ পেয়েছে একাধিক বাঙলা অনলাইন পত্র পত্রিকায়। লেখা লেখি ছাড়াও গান বাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে রূপকের সমান আগ্রহ রয়েছে।

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june goddyo

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি । পর্ব ২

ধা রা বা হি ক । পর্ব ২

স ব্য সা চী   স র কা র

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি

sabyasachi

মেঘলা দিনে দুপুরবেলা

মেঘ করলেই কেন মায়ের শাড়ির গন্ধ মনে পড়ে? কেন মনে পড়ে কাঁকুলিয়া রোডের সেই সরু গলি? সেই আশ্চর্য ঝুল বারান্দা, যেখানে সে বিকেলবেলা এসে একা দাঁড়াতো? আর দাঁড়ালেই বুকের মধ্যে টুপ টুপ করে ঠিক ঝরে পড়ত বৃষ্টির ফোঁটা। একটা বাঘ তখন আশেপাশের ঝোপ থেকে বেরোত। তখনই পাশের বাড়ির পাপু নীচ থেকে আমাদের দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে গলা তুলত, ‘সাড়ে চারটে বাজে। খেলতে যাবি না? আজ বুবলাদের সঙ্গে ম্যাচ। নাম এ বার!’

ব্যস, ছুট। ফুটবলের জন্য ছুট। কোনওরকমে গলায় গলিয়ে নেওয়া গড়িয়াহাটের হকার্স কর্নার থেকে কেনা সবুজ মেরুন জার্সি। আর ভাইয়ের গায়ে লাল-হলুদ। একই বাড়িতে দুই ভাইয়ের একজন মোহনবাগান আর একজন ইস্টবেঙ্গল কেন? প্রতিপক্ষ না থাকলে কখনও বাড়ির বারান্দায় ছোট রবারের বলে ওয়ান ভার্সেস ওয়ান ফুটবল জমে নাকি? 

শীতকালে গলি ক্রিকেটে আমাদের সরু গলিটা হয়ে যেত ইডেন গার্ডেন্স আর বর্ষায় সেই ইঁটগুড়ি রঙের গলিটাই মোহনবাগান মাঠ। সাদা কভার, রুল টানা বঙ্গলিপি খাতায় তখন সাঁটা থাকতো আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় বেরোনো মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে সাদা-কালোয় শ্যাম থাপার ব্যাকভলির ছবি। বিকেল হলেই রেডিওয় ভেসে আসত অজয় বসুর গলা, আর কলকাতা লিগ তখন সেই ফোর বা ফাইভে আমাদের কাছে ছিল বিশ্বকাপের মতো। সেই সত্তরের দশকের শেষে তখনও সব বাড়িতে সাদা-কালো টিভি ঢোকেনি।

আমার মায়ের একটা অদ্ভুত ধারণা ছিল, বাড়িতে টিভি এলেই নাকি আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনা লাটে উঠবে এবং খুব তাড়াতাড়ি গোল্লায় যাবো। বহু চেষ্টা করেও মা অবশ্য গোল্লায় যাওয়া আটকাতে পারেনি।

পাড়া ক্রিকেট আর পাড়া ফুটবল, ঝোপে বল হারানো আর ইঁটের গোলপোস্ট। দুরন্ত ছক্কায় পাশের বাড়ির কাচ ভাঙা, বাড়িতে নালিশ এবং মায়ের হাতে চটাস চটাস স্কেলের বাড়ি। এসবের মধ্যেই একদিন গলা ভাঙল, ঠোঁটের উপরে গোঁফের রেখা দেখা দিল আর বারবার চোখ চলে যেতে লাগল দূরের ওই বারান্দা আর আকাশি নীল স্কার্টের দিকে। তার মধ্যেই সুযোগ পেলেই আনন্দমেলা শেষ করে হাত বাড়াতাম দেশ পত্রিকার দিকে। বাবার বইপ্রীতি ছিল, বাড়িতে দু-তিন আলমারি বই, আরও কিছু সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু তার মধ্যে বেশ কিছু বইয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের হাত দেওয়া বারণ ছিল। মোটা মোটা ইংরেজি নভেল বা কাশীদাসের মহাভারতে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ক্লাস এইটে পড়ে ফেললাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওসবের চেয়ে পুজোসংখ্যার নীললোহিত, শীর্ষেন্দু বা সমরেশ বসু বেশি টানতেন। আলমারিতেই ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাও।

সেটা বের করে একদিন পড়তে গিয়ে দুপুরবেলাটাই বদলে যেতে শুরু করল। মাথায় মধ্যে  ঢুকে পড়ল, ‘বাঘ’।

‘মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে

চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরুলো বনে…

আমি দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললাম: খা

আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না।’

 

কেন দুপুরবেলা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে এই কবিতাটা? কেন আজকাল রোজ মেঘ করছে আর মন চলে যাচ্ছে নীল স্কার্ট আর ওই ঝুল বারান্দার দিকে? ভালোবাসার বাঘ ব্যাপারটা এ ভাবে টানছে কেন?

আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না— পড়ছি আর ভেবে যাচ্ছি। বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু বুঝতে ইচ্ছেই করছে না। কেন বুঝবো? দরকার নেই তো। কোনও যুক্তির দরকার নেই। শুধু রহস্যময় ঘোরে ডুবে যাচ্ছি­…

‘আমার ভয় হলো তাই দারুণ কারণ চোখ দুটো কৌতুকে

উড়তে-পুড়তে আলোয়-কালোয় ভাসছিল নীল সুখে

বাঘের গতর ভারি, মুখটি হাঁড়ি, অভিমানের পাহাড়…

আমার ছোট্ট হাতের আঁচড় খেয়ে খোলে রূপের বাহার।’

 

মাঝে মাঝে সন্ধের দিকে যখন সে বাবা-মায়ের সঙ্গে রঙচঙে ফুলছাপ স্কার্ট পরে বেড়াতে যায়, তখন ফুটবল খেলে ফেরার সময় সে দিকে তাকালেই বুকটা দুরদুর করে। মুখটা এত গম্ভীর করে রাখে কেন? হাসলে ওই ফর্সা গালে একটা টোল পড়ে, ওই গালটায় একটা আলতো আঁচড় দিলে কি রূপের বাহার খুলবে? যেমন লিখেছেন কবি?

স্কুলে ভাবসম্প্রসারণের ক্লাসে ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’-এর সম্প্রসারণ করতে গিয়ে লিখতে ভুলে যাই। এক পৃথিবী লিখব বলে একটা খাতা দূরের কথা, একটা লাইনও শেষ করে উঠতে পারি না। সন্ধেয় বাড়ি ফেরার মুখে অবধারিত আমাকে ধরে তমালদা। বাবা প্রোমোটার, তমালদার চুল মিঠুন চক্রবর্তীর মতো। একটা ইয়ামাহা বাইক আছে। গত বছরের ভাসানে ডিস্কো ডান্সারের মতো নেচে পাড়া কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তমালদা ক্যারমটা দারুণ খেলে, মাঝে মাঝেই আমাদের জুনিয়র গ্রুপটাকে গোল্ড স্পট আর আলু কাবলি খাওয়ায়। আর আমাকে দেখলেই বলে, ‘একটু এদিকে শোন তো…’

এই ‘এদিকে শোন’ ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগে না। তমালদা তখন পাড়ার হিরো। বাকি বন্ধুদের সামনে তমালদা আলাদা করে আমাকে ডাকে আর এই বাড়তি ইম্পর্ট্যান্স পাওয়াটা আমি উপভোগ করি। বাইকটা পার্ক করে কাঁধে হাত রাখে। তার পরে এদিক ওদিক দেখে কাগজটা এগিয়ে দেয়। ‘দ্যাখ তো, কী লেখা যায়?’

মেয়েলি বাঁকা বাঁকা অক্ষরে লেখা এক পাতার চিঠি। রুল টানা কাগজে। সযত্নে ভাঁজ করা। তার মধ্যে দুটো লাইন আজও মনে আছে— ‘তোমার বাইকের পিছনে বসে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে—নিঃসীম শূন্যে। পারবে তুমি উড়তে?’  আর একেবারে শেষে ‘ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?’ তার তলায় ইতি লিখে কোনও নাম নেই— ডট পেন দিয়ে একটা পান পাতা আঁকা শুধু।

‘এ বার কী লিখব তমালদা?’

‘সে আমি কী জানি! গত চারটে চিঠিই তো তুই লিখে দিয়েছিস। জমিয়ে ফেলেছি পুরো। তুই কাল বিকেলের মধ্যে একটা জমাটি আনসার নামিয়ে দে শুধু— তা হলেই একটা গোল্ড স্পট। সঙ্গে বলাইয়ের দোকানের চিকেন রোল। মনে থাকবে?’

বলাইয়ের দোকানের চিকেন রোলের তখন আশ্চর্য খ্যাতি। কিন্তু ঠিক চিকেন রোল বা গোল্ড স্পটের লোভে নয়। অন্য কোনও কারণে বাড়ি ফিরে হোমওয়ার্কের ফাঁকে চিঠিটা নিয়ে পড়ি। তার পরে ফের উত্তর লিখতে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার পাতায় ডুবে যাই—

‘ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো

যেদিকে দুচোখ যায়—যেতে তার খুশি লাগে খুব।’

তমালদার সে গীতবিতানের গান দিয়ে চিঠি শেষ করেছে বলেই সেই রবীন্দ্রনাথে যাবো? কখনওই না। যাবো না। এই লাইনগুলো দিয়ে চিঠিটা শেষ করব ঠিক করি। নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে চিঠি শেষ করে পরের দিন তমালদার হাতে তুলে দিই। বলাইয়ের দোকানের সামনে চিকেন রোলের গন্ধ ম ম করছে। তমালদা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে। কিন্তু শেষে এসে আটকে যায়। ‘এটা আবার কী লিখেছিস? ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো মানে কী? আমি তো ওর লাভার। আমি লণ্ডভণ্ড করে চলে গিয়ে অন্যের লাইন ক্লিয়ার করতে যাব কেন? জানিস ওর পিছনে কত ছেলের লাইন?’

আমি আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই তমালদা বলে ওঠে, ‘কাটতে হবে। এসব কাটতে হবে। ও যেখানে যাতনাময়-টাতনাময় দিয়ে লিখেছে, সেখানে তুই লিখলি, লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো! কোনও সেন্স নেই! ইডিয়ট কোথাকার!’

‘তা হলে কি আবার লিখব?’ চিকেন রোলের গন্ধ পেরিয়ে অন্য রকম সব কষ্ট ঢুকে পড়ছে ভিতরে। চোখ ছলছল করছে। কিচ্ছু দেখছে না তমালদা।

বলছে, ‘ছাড়। তোকে আর কিচ্ছু করতে হবে না। ওই শেষের কয়েক লাইন কেটে দিলেই হবে। ও আমি করে নেবো। নে, চিকেন রোল খা!’

বলাইয়ের চিকেন রোলও খুব তিতকুটে লাগল সেদিন। নির্ঘাত ঝালটা বেশি দিয়েছিল। নয়তো ফেরার পথে কেন হু হু করে মন খারাপের দেশে পৌঁছে যাচ্ছিলাম?

বাড়ি ফিরে আবার বইটা পড়ি। পরের কতকগুলো লাইন—

‘ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে। না পেলে তোমায়

আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো? চীৎকার করবো না,

হৈ হৈ করবো না, শুধু বসে থাকবো, জব্দ অভিমানে?’

 

তমালদা বোঝে না, বুঝতে পারেনি। কিন্তু আমার ভালো লাগছে। ঠিক এই কথাগুলোই লেখা উচিত ছিল। লিখতে দিল না শুধু!

দিন দুই পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে দীঘা যাত্রা। তিন দিনের ট্রিপ। সমুদ্রে দাপাদাপি করে ফিরে পরের দিনই বিকেলে ফুটবল মাঠে। সেখানেই তমালদা ধরল। কাঁচুমাচু মুখ। ‘শোন না, একটা কেলো হয়ে গেছে… তোর সেই চিঠিটায়…’

‘কী হলো?’

‘আমি কয়েকটা লাইন অ্যাড করেছিলাম। তাতেই গণ্ডগোল হয়েছে। ও ধরে ফেলেছে, কেউ না কেউ আমার চিঠিগুলো লিখে দেয়। বলেছে, যে চিঠি লেখে, তাকে না দেখালে আর কথা বলবে না। একমাত্র তুই আমাকে বাঁচাতে পারিস—’

‘না না, আমি এসব পারবো না। কী অ্যাড করতে গেলে তুমি?’

‘বিশ্বাস কর, দুটো লাইনের বেশি অ্যাড করিনি। লিখেছিলাম, তোমাকে সারা জীবন স্মরণীয় করে রাখবো—আর বানানটা…’

‘স্মরণীয় করে রাখব? উফফ, কাউকে স্মরণীয় করে রাখা যায় নাকি?’

‘দূর বে, আমি কি তোর মতো বাংলায় পণ্ডিত নাকি? ওসব ছাড়। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তুই সামলে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! জানিস, চিঠিটা পর্যন্ত রাখেনি। ফেরত দিয়ে দিলো!’

 ‘দাও তো একবার!’

ঠিক যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই। তমালদা লিখেছে, ‘তোমাকে সারা জিবন সরোণিয় করে রাখবো!’

এ বার বল আমার কোর্টে। একটুও না হেসে গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘এ আর সামলানো যাবে না। পুরো গুবলেট করে দিয়েছো!’

তমালদা নাছোড়বান্দা। ঠিক নাকি সব ম্যানেজ করে নেবে। শুধু আমাকে একবার সে স্কুল থেকে ফেরার সময় তমালদার বাইকে করে যেতে হবে। আমি যতোই না বলি, ততো চেপে ধরে তমালদা।

পাড়ায় তমালদা হিরো। জলে থেকে কি আর কুমিরের সঙ্গে লড়া যায়? তাই যেতেই হল। লেকের কাছে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে কমলা গার্লস স্কুলের গেটের কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছি। এক দঙ্গল মেয়ের মধ্যে দু’টি মেয়েকে দেখে এগিয়ে গেলো তমালদা। হল্যান্ডের জার্সির মতো কমলা রঙের স্কার্ট, সাদা টপ। দু’দিকে বিনুনি করা, কাটা কাটা চোখ-মুখ, সামান্য চাপা নাক, ফর্সা গাল, চোখ দুটোর মধ্যে বিস্ময়কর চঞ্চলতা। এক ঝাঁক মেয়ের মধ্যে এই মেয়েকে আলাদা করে চোখে পড়বে। মুখে সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে আছে গোপন অহঙ্কার। সঙ্গিনীর সঙ্গে কলকল করে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে। তমালদাকে দেখেই অন্য দিকে মুখ করে হাঁটার গতি বাড়িয়েছে। তমালদা আমার হাতটা চেপে ধরে দৌড়ে গিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘সুকন্যা, এক মিনিট…’

মেয়ে চোখ ঘুরিয়ে চঞ্চলা হরিণীর মতো তাকায়। যেন চোখ দিয়েই পুড়িয়ে সব ছাই করে দেবে। তার পরে বলে, ‘তুমি?’

‘এই যে— এ-ই লিখে দিয়েছিল চিঠিটা—’

আমাকে দেখছে সে। মাপছে। বলছে, ‘এ লিখেছে? কে হও তুমি ওর? কে হও?’

আমি কিছুই বলতে পারছি না। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তমালদা মিউমিউ করে বলছে, ‘পাড়ার ছেলে। ভাইয়ের মতো।’

শুনছেই না কমলা স্কার্ট। আমার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলছে, ‘তুমি ভাই তো? তোমার দাদাকে একটা বাংলা ডিকশনারি কিনে দিও। সেখানে দেখে নেবে, কী ভাবে স্মরণীয় বানানটা লিখতে হয়, বুঝেছো?’

তমালদা কী একটা বলতে যাচ্ছিল। মেয়েটা হাত তোলে, ‘একদম পিছন পিছন আসবে না। যে ওই বানান লেখে, তার সঙ্গে প্রেম করা যায় না! চল নন্দিনী।’

সঙ্গিনীকে নিয়ে সে এগিয়ে যায়। তমালদা বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি হাসে। তার পরে বাইকে স্টার্ট দেয়। তার পরে বলে, ‘একটু সময় লাগবে। ঠিক ম্যানেজ করে নেবো, তুই দেখে নিস।’

সাদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে বাইক ছুটে চলে। তমালদার পিছনে নির্বোধের মতো বসে থাকি আমি। যতদূর চোখ যায়, সামনে শুধু বিস্ময়কর সব সরলরেখা। কানের পাশ দিয়ে সোঁ সোঁ করে হাওয়া দিচ্ছে। আবার লাইনগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে, করতেই থাকে।

‘ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো

যেদিকে দুচোখ যায়—’

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june goddyo

উদাসীন তাঁতঘর | পর্ব ৯

ধা রা বা হি ক পর্ব ৯

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

বিস্মৃত এক কবির উঠোন

চল্লিশের কবিদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন যে পাঠকরা তাঁরা মনে করতেন রাজনৈতিক প্রসঙ্গ কবিতার শত্রু এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায় অনেকসময় কবিতা শেষপর্যন্ত স্লোগান হয়ে ওঠে। এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল বুদ্ধদেব বসুর মতাদর্শ। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের কবিরা বিষয়টি লুফে নেন এবং জীবনের নানা উচ্ছৃঙ্খলা দিয়ে চল্লিশের কবিদের অবান্তর করে দেন এক লহমায়। সামাজিক দায়বদ্ধ কবিদের পাশাপাশি চল্লিশের কবিতায় আরেকটি ধারা ছিল। নিভৃত এবং অনুচ্চার। একদিন তাঁরাই ‘ আরো কবিতা পড়ুন’ স্লোগান নিয়ে পথে নেমেছিলেন। নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকারের পাশাপাশি এইরকম একজন নিভৃতচারী কবি অরুণ ভট্টাচার্য। গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং সম্পাদক। অথচ আজকের পাঠক তাঁকে চেনেন না। তাঁর নামটি পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে আছে অনেকদিন।

কবি অরুণ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৫ সালে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। পিতৃনিবাস অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমায়। দীর্ঘদিন তিনি সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘উত্তরসূরি’। সংগীততত্ত্ব এবং নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিয়েছিল একদিন। ওস্তাদ আত্তা হোসেন খাঁ-এর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, কালীপদ পাঠকের কাছে প্রাচীন বাংলা টপ্পা এবং আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন দুই দশক ধরে। ছিলেন একজন সঙ্গীত সমালোচক। এসব ছাড়িয়ে শেষপর্যন্ত তাঁর প্রধান পরিচয় চল্লিশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে।

অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা। কখনও তা একমুখী, কখনও সর্বাত্মক। নিজেকে নিঃস্ব করে রচনা করে আত্মপরিচয়ের আড়াল। এই ভালোবাসা নির্জন আবার কখনও সংসারের গোপন বলয় থেকে উঠে আসে। অজস্র কবিতার থেকে একটি কবিতা তুলে নেওয়া যাক–

“কত দূর, দূরাগত সমুদ্রের কানে কানে অনেক আশ্বাস
শূন্য তীর,ছায়াবন প্রান্তরের তীরে নামে আরেক আকাশ।

হৃদয়ের অনাবৃত সুরে আজ যে প্রার্থনা উচ্চারিত,
সকল কান্নার শেষে সেই শ্লোক নিয়ত ধারায়
দূর প্রান্তে প্রবাহিত। তবু তার নাম
প্রাণের প্রসন্ন কোণে কি এক অপূর্ব অর্থে প্রত্যহই স্মরণীয়।

অথবা সে ভুল? যদি ভুলের অন্বিষ্ট শুধু প্রেমের প্রণাম
যদি কথার ধ্বনিতে শুধু সংগীতের গভীর ব্যঞ্জনা,
তবু তার দাম। সময়ের নির্ভুল হিসেবে
এ পৃথিবী,নদী,মাঠ মানুষের অমৃত সাধনা
নিঃসংশয়ে ব্যর্থকাম। শুধু সময়ের, জলের ধারায়
অথবা আশ্বিনে কোনো রাজহংসী মেঘের মিছিলে
এই সত্য অধিগত, অথচ এ কীসের প্রহার?”

(কবিতার জন্য)


অরুণ ভট্টাচার্য আদ্যন্ত প্রেমের কবি। তাঁর কবিতার প্রধান ভরকেন্দ্র সমর্পিত ভালোবাসার দিনগুলি। প্রত্যাখ্যান পেরিয়ে উজ্জ্বল এক স্মৃতির গোধূলি। আহত অভিমান আছে কিন্তু তা প্রকৃতির সর্বব্যাপী আনন্দে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে রাখে। দুঃস্বপ্নের রথে পাড়ি দেয় যে মন তা শেষপর্যন্ত ‘তোমাতে নিবিষ্ট’। সবচেয়ে বড়ো কথা এই আলো হাওয়ার সংসারে ধুলোবালিছাই মাখা এক নির্মল প্রেম কবিকে নিয়ে যায় যেকোনো প্রৌঢ়তা পেরিয়ে যৌবনের চিরন্তন স্মৃতিতে।

“যদি সে পাখির ডাক ভরে দেয় আমার আকাশ
এই আলো রোদ্দুরের গানে গানে ফিরে পাই প্রেম
জীবনকে ভালোবেসে, দুই হাতে জুঁই একরাশ
নিয়ে তাকে বলব এবার: রানি, আমাকে দিলেম।
নাও তুমি গ্লানিময় এই দেহ, অশুচি অন্তর,
ফিরে দাও যৌবনের নিরিবিলি দুরাশার ঘর।

( ফিরে দাও [অংশ] )


আর এখানেই অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় জয় গোস্বামীর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য যা বহুরৈখিক – ‘কবি অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতার দিকে তাকিয়ে আমি একটি মিলনের আয়োজন দেখতে পাই। এই মিলন এক সর্বজাগতিক মিলন। দুঃখ এখানে আছে, কিন্তু সেই দুঃখের পশ্চাৎপটে দেখা দিচ্ছে প্রসন্ন গোধূলির আলো। রক্তক্ষরণ কি নেই কবিতার অন্তঃস্থলে? আছে, কিন্তু তাকে মুছে দিচ্ছে, তার উপর প্রলেপ দিচ্ছে ব্যাপ্ত ভালোবাসার বনৌষধি।’ এই “ভালোবাসা’ শব্দটি তাঁর কবিতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনও কখনও এইসব কবিতায় এসেছে তরল আবেগ যেখানে ব্যঞ্জনা নেই শুধু আছে সরল বিশ্বাস। আর এখানেই মাঝেমধ্যে শিথিল এবং দুর্বল কবিতার জন্ম হয়েছে। একটি উদাহরণ দিই

“তোমার মুখ মনে পড়লে
এই মুহুর্তে
কাঙাল হয়ে ফিরতে পারি
হিরন্ময় আলোর রেখা দুহাত দিয়ে ধরতে পারি
এই মুহুর্তে
তোমার ও-মুখ মনে পড়লে
বিশ্বজোড়া আঁধার আমি ঘোচাতে পারি
টবের মধ্যে সরোবরের বিশাল পদ্ম ফোটাতে পারি।”
( তোমার ও-মুখ)

অরুণ ভট্টাচার্যর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সায়াহ্ন’ প্রকাশিত হয় ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে। এই বইটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল। এখানে কবির নিজস্ব স্বর নেই। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ ময়ূরাক্ষী’ (১৩৬০) থেকে কবি স্বতন্ত্র স্বর খুঁজে পেয়েছেন। এই বইটি কবির মনোধর্ম বোঝার জন্য অত্যন্ত জরুরি। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – মিলিত সংসার (১৩৬৬), সমর্পিত শৈশবে(১৩৭০), ঈশ্বর প্রতিমা(১৩৮২), সময় অসময়ের কবিতা (১৩৮৩), চারিদিকে খেলাঘর (১৩৯০)। এইসব কবিতায় তিনি ধরে রেখেছেন নিঃস্ব স্মৃতির এক যাপিত জীবন। এক সমর্পিত শৈশবের প্রচ্ছন্ন আলো। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর কবিতা আসলে পদ। সেখানে উত্থান পতনের চেয়ে বড়ো কথা একমুখী গীতিময়তার প্রবাহ। ফলত তাঁর কবিতায় কোনো উত্তরণের দেখা চাইলে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন।গুঞ্জনের মতো শুধু কিছু নম্র প্রতিমার যাতায়াত আছে। হে পাঠক, আসুন তাঁর কয়েকটি কবিতায় প্রবেশ করি।


বাঁশি বাজলে যেতে হয়।

যত দূর দেখা যায়
সামনে কিছু নেই শুধু
দিঘিকালো অন্ধকার।
অতীতে তাকালে কিছু ক্ষতচিহ্ন।

তাহাকে পাবার নেই তাহাকে দেবার কিছু নেই।

চারিদিকে শূন্যতার মাঝে
থেকে থেকে ট্রেনের সুতীক্ষ্ণ স্বর কানে বাজে:
বাঁশি বাজলে চলে যেতে হয়।

(বাঁশি বাজলে)


চারদিকে সব মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কারা
সং সেজেছে আপাদমস্তক
বলবে না কেউ এমন কথা অসীম দুঃসাহসে:
নদীর জলে রাখব আমার শব।

(রাখব আমার শব)


প্রতিমাগৃহের কাছে একরাশ বাতাস বহিছে।

প্রতিমাগৃহের কাছে আমাদের
নতজানু হতে হবে।

ওইখানে উন্মুখর ইতিহাস
আমাদের বলে গেছে
মানুষের মৃত্যু আছে। মানুষের
দেশকালসন্ততির মৃত্যু নেই।

প্রতিমাগৃহের কাছে আমাদের
পিতামহীদের শব
উন্মনা বাতাস ঘিরে আজও স্থির
হিরন্ময় রয়ে গেছে।

(মহাকবি মাস স্মরণীয়েষু)


একটু স্থির হও। এখন
পিছন ফিরে তাকাবার সময়। এখন

মগ্নতার সন্ধ্যা। আকাশের
নক্ষত্রদীপ তোমারই জন্য, সূর্যের
দাহ নয়। এখন

ধীরে ধীরে চৈতন্যের
নীলিম জ্যোৎস্নায়
অবগাহন। এখন

প্রসন্ন আঁখি মেলে
সরোবরের স্থির পদ্মটির দিকে
তাকাও।

(জন্মদিন)

প্রাথমিকভাবে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধের দ্বিমাসিক হিসেবে ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে নারায়ণ চৌধুরী এবং শিবনারায়ণ রায়ের সম্পাদনায়। পরবর্তী সময়ে বিশুদ্ধ কবিতাপত্র হিসেবে চল্লিশের কবি অরুণ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১৩৬১ বঙ্গাব্দ থেকে। এই পত্রিকা নিয়মিত গ্রামগঞ্জের কবিতা পত্রিকা থেকে নবীন কবির অজস্র কবিতার পুনর্মুদ্রণ করেছে। চিত্রকলা,ভাস্কর্য, সংগীতের পাশাপাশি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। ১৯৮৫ সালের শেষ সংখ্যাটির অনেক আগে থেকেই এই পত্রিকার প্রচ্ছদপটে মুদ্রিত হয়ে আসছে তরুণ কবিদের প্রতি আবেদন :
” ১৯৩০-৮০ পঞ্চাশ বছরের অস্থির দিনগুলি পার হয়েছে। বন্ধুগণ! এবার আপনারা র্্যাঁবো, বোদলেয়ার অথবা এলুয়ার,মায়াকভস্কি থেকে ফিরে আসুন মহাজন পদাবলী রামপ্রসাদের কবিতায় শ্রীধর কথক নিধুবাবুর গানে। দেশের মাটির গন্ধ বুক ভরে নিন। ধর্মকে আবার স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করুন। ধর্ম মানে কুসংস্কার নয়, ধর্ম মানে চিত্তের সুস্থির প্রতিবিম্ব, চৈতন্যের উন্মোচন। আসুন , একবার মা বলে তরী ভাসাই।”
সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্য সার্থক এবং শক্তিশালী। পুনরায় বলতে চাই তাঁর কবিতায় আছে পদের সৌন্দর্য। মনে হয় নির্জন প্রেমের কথা পৃথক পৃথক কবিতায় নয় বরং অন্তহীন গীতিময় প্রবাহে ধরা আছে।

অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন কবি জয় গোস্বামী। দ্বিতীয় পাঠ। তাঁর ধারণা প্রথম পাঠে উল্লেখযোগ্য মনে না হলেও দ্বিতীয় পাঠে অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতা গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাঞ্জনাময় মনে হয়। কথাটা সত্যি এবং কিছুটা অতিশয়োক্তি। এমন অনেক কবিতা পাওয়া যাবে যেখানে দ্বিতীয় পাঠে ও কবিতাটি শেষপর্যন্ত দুর্বল মনে হয়। আবার অনেক কবিতা আছে দ্বিতীয় পাঠে তার তাৎপর্য বোঝা যায়। এর একটি বড়ো কারণ হয়তো সংগীতধর্ম। হয়তো সুরের কারণেই অরুণ ভট্টাচার্য অনেক ক্ষেত্রে ইপ্সিত শব্দের অভাব বোধ করেননি। আরেকটি কথা বলা যায় তাঁর কবিতায় সময়ের উত্তাপ নেই। দু-একটি বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ ছাড়া জনতার জীবন এবং রাজনীতি নিয়ে তিনি নীরব। বরং ‘ব্যক্তিগত ছোটো একটা জগৎ’ তাঁর কবিতা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় অভাব নেই অথচ নিভৃত জীবনের বেদনা আছে। পথ চলা মানুষের চেয়ে ঘরের কোণে অন্ধকার মানুষের দিকেই তাঁর কবিতার অভিপ্রায়। একটি বই থেকে অন্য বইয়ে তাঁর স্বর খুব একটা বদলায় না। কোনো উত্তরণও জরুরি হয়ে দেখা দেয়নি। তবে তাঁর কবিতা সংহত এবং আঙ্গিকে নিপুণ। শব্দ মধ্যবর্তী শূন্যতায় কখনো কখনো সংবেদনশীল পাঠক খুঁজে পাবেন অক্ষরের ঐশ্বর্য, পুনর্নির্মাণের যাবতীয় সম্ভাবনা।

আজকের পাঠক অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতা পড়েন না। নামটুকু শোনেননি এমন পাঠকের সংখ্যাই বেশি। তবুও আমাদের এই চর্চা জারি রাখতে হবে নতুন দিনের পাঠকের জন্য, পুরোনো পাঠকের আবিষ্কারের জন্য। শক্তির জীবন এবং কিংবদন্তি বেঁচে আছে অথচ তাঁর পাঠক কমে গেছে আজ। আসলে যেকোনো বিস্মৃতি সময়ের ধর্ম। গ্রহণ- বর্জন, নস্যাৎ, বিস্মৃতি, আবিস্কার এবং পুনরাবিষ্কারের জটিল মনোধর্মেই লুকিয়ে আছে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ। হে পাঠক, আপনার চলার পথে একজন অরুণ ভট্টাচার্য আছেন মনে রাখবেন।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june goddyo

আবার রাণার কথা । পর্ব ৬

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৬

রা ণা   রা য় চৌ ধু রী

আবার রাণার কথা

rana2

রূপ

রূপে মোহিত কে না হয়? সে শুধু নর বা নারীর রূপ নয়, আমি তো জলের রূপেও মুগ্ধ হয়ে যাই।

‘রূপ’ এক পাখি যেন, যুগযুগান্ত ধরে ‘রূপ’ পাখির মতো উড়ে চলেছে মন থেকে মনে, বিস্ময় থেকে আরো কোনো গোপন বিস্ময়ের দিকে। রূপে তোমায় ভুলেছি বলেই তো আমি এমন উদাস, আনমনা। মন পড়ে থাকে তোমার রূপের নানান সত্যের ছটার দিকে, তোমার রূপের নানান ইশারার দিকে! অমন নিবিড় ও স্নিগ্ধ রূপ তোমার, আছে বলেই, আমি ভাবি– এ অশ্রু নদী সাঁতরে পার হয়ে যাব একদিন– ‘আনন্দ’ তোমার কাছে।

এই যে রোদের রেখা এসেছে পড়েছে আমাদের সংসারে– এই রোদের রেখার মধ্যেই তো তাঁর ‘রূপ’ ও রূপের ঐশ্বর্য আমাদের মুগ্ধ করে, এবং এই মুগ্ধতা নিয়েই আমরা তোমার ‘রূপ’-রাস্তায় হেঁটে চলেছি অনেকদূর যাবো বলে।  

অনেকদূর আমরা যাই না, কাছে কাছেই আমরা একে ওপরকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছি। এই জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকার মধ্যেও এক লুকনো ‘রূপ’ আছে, আমরা তা বুঝতে পারি। এই একসঙ্গে– সুখ ও দুঃখের সাথী হয়ে আমরা আছি– কারণ এক রূপবান বা রূপবতী ‘অভিমান’ ও রূপবান বা রূপবতী ‘আনন্দ’– নদীর মতো ভিতরে ভিতরে বয়ে যায় আমাদের মধ্যে, আমাদের সংসারে। তোমার রূপের এক স্নিগ্ধ বাতাস বয় আমাদের মধ্যে, আমরা বুঝতে পারি, টের পাই।   

ক্রোধের যেমন এক ‘রূপ’ আছে, জয়ের যেমন এক ‘রূপ’ আছে, তেমন পরাজয়ের মধ্যেও এক বিশাল রূপের ছটা আছে।  

পরাজিতের যে ‘রূপ’ তা অনেকটা গানের মতো, যে গান শোনা যায় না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তা অনুভূত হয়। পরাজিতের রূপের আলো গোপনে পরাজিতকে বাজায়, আলোকিত করে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়– বিভূতিভূষণের ‘দৃষ্টি প্রদীপ’ উপন্যাসের কাছে।   

‘রূপ’ আসলে, অরূপের মধ্যেই লুকোনো থাকে। অরূপের ভিতর থেকে রূপকে ভালোবেসে, স্নেহে, আন্তরিকতায় কাছে টেনে নিতে যে জানে, সে সুখী। সে অপ্রচারের আনন্দিত সাধক।    

রূপের পিপাসা সকলের মধ্যেই আছে। যার মধ্যে রূপের তৃষ্ণা নেই, সে অভাগা। শিশুটি বিরাট বটগাছ দেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছে– বটের শাখাপ্রশাখায় কত সবুজ পাতা– কত অজানা পাখিরা সেখানে থাকে– শিশুটি অবাক– বটের এই নানান সুরের ‘রূপ’ দেখে। সে স্বপ্নে ডুবে যায়।   

নদী বয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে তো কে জানে? তবু নদীর এই বয়ে যাওয়ার ‘রূপ’ দেখে এক অভিমানী তরুণী আনন্দে কেঁদে ফেলে, সেও নদীর এই বয়ে যাওয়ার– এই রূপের সঙ্গে যেতে চায় অজানায়, অচেনায়। সে নদীর রূপে ডুব দিয়ে ডুব দিয়ে নিজেকে খুঁজে পায়, সে নদীর ‘রূপ’ দিয়ে চোখের জল মোছে, চেয়ে থাকে পাড়ের দিকে, দিগন্তের দিকে।     

দিগন্তের যে ‘রূপ’ তা বড় মন কেমনের। দিগন্তে তরুণীর বাল্যকালের হারিয়ে যাওয়া বালক বন্ধুটি আছে বোধহয়, সে কল্পনা করে। দিগন্তে নিশ্চয় দীর্ঘশ্বাসেরা থাকে না। সেখানে যারা থাকে তারা মেঘের রূপে মুগ্ধ। মেঘেরা ‘কে চলিতে পারে সহজ লোকের মতো!’ – সেইভাবে সহজ লোকের রূপের মতো মেঘেরা দিগন্তে হাঁটে পায়চারি করে, গান গায়, বালিকা মেঘের রঙিন ফ্রকের দিকে অবাক চেয়ে থাকে।

কুৎসিত, তার প্রবল ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে এসেছিল আমাদের বাল্যবিধবা বড় পিসিমার কাছে। আমাদের বড়পিসিমা কোনোদিনই রূপবতী ছিলেন না। কিন্তু তার আন্তরিক ব্যবহারের ‘রূপ’ ফুলে ফুলে ভরা এক করবী গাছের মতো।  

কুৎসিত, বড় পিসিমার স্নেহভরা স্নিগ্ধতার ‘রূপ’-এর কাছে নতজানু যেন। তার ঘৃণা ক্রোধ হিংসা পরশ্রীকাতরতা কে যেন চোখের জল মোছার মতো মুছে দিল নিমেষে। কুৎসিত রূপবান হয়ে উঠল। কুৎসিতের ভিতর এক মহাজগতের বিরাট ‘রূপ’-এর আলো জ্বলে উঠল।     

‘রূপ’ আসলে আমাদের মনেই থাকে। বিভিন্ন মন, ভিন্ন ভিন্ন ‘রূপ’-কে তৈরি করে। যে অভাবী, যে অনটনে অনটনে মনের দিকে থেকে দুর্বল, তার কাছে ‘রূপ’ বিলাসিতা। তবু সে কী হঠাৎ আকাশের চাঁদের ‘রূপ’ দেখে আনন্দ পায় না! তবু সে কী হঠাৎ আকাশের বিশাল ‘রূপ’ দেখে মনে মনে উঠে দাঁড়াবার সংকল্প করে না? করে হয়ত। নিশ্চয় করে।   

আবার কারোর কাছে ‘রূপ’-এর কোনো মানেই নেই। তাদের কাছে ‘রূপ’ মানে আসবাব– তাদের কাছে ‘রূপ’ মানে ফার্নিচার। ‘রূপ’ এই জগতে– এই সংসারে থাকলেও চলে না থাকলেও চলে। এই ‘রূপ’-কে অস্বীকার করার মধ্যেও ‘রূপ’-এরই একপ্রকার সাধনা চলে মনে মনে।

‘রূপ’ সে তো দূরে থাকে, তাই তাকে কাছে টেনে নিতে বা নিজের করতে আর ইচ্ছে করে না অনেক সময়ে। তার ওপর একধরণের অভিমান করেই, ‘রূপ’কে আমি দূরে রাখি। আবার কাছে পেতেও তাকে ইচ্ছে করে, বা করেও না। এক দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলে নিজের ভিতরে।  কিন্তু ‘রূপ’ সে তো অন্তর্যামী! তাই ‘রূপ’ নিজেই একদিন চলে আসে, আমার কাছে, আমাদের কাছে। যেন সে তো ছিলই আমার কাছে, আপনজন হয়ে। আমিই বরং ‘রূপ’কে উপেক্ষা করেছি। হতেও পারে তা।

মানুষ নিজেই জানে না, ‘রূপ’ কত কাছে আছে আমাদের। ‘রূপ’ আমাদের মধ্যেই আছে। কিন্তু আমরা তাকে দূরে দেখতে যাই। অনেক আয়োজন করে আমরা ‘রূপ’-এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। আসলে, ‘রূপ’ আয়োজনে নেই– সে খুব সাদামাটা হয়ে, আমার কাছেই লুকিয়ে আছে। তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে। ‘রূপ’-কে খুঁজে বের করা, তাঁকে কাছে ডেকে নেওয়া এক অভ্যাস, এক সাধনা যেন।

এই যে জল নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাছেই। পাগলের সংসারে কোনো কাজ নেই– তাই সে আপনমনে জলের নিরন্তর বয়ে যাওয়ার মধ্যে নিজের ‘রূপ’কে খুঁজছে। জলের ‘রূপ’-এর মধ্যে সে তার ছোটবেলার সুস্থ অবস্থাকে দেখতে পাচ্ছে। জল আর পাগলের মনের ‘রূপ’ আসলে এক কবির– এক শিল্পীর– নতুন পথের দিশা।

‘রূপ’ জ্যোৎস্না রাত্রির মতো চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন। আমরা তাঁর সেই জ্যোৎস্না ছড়ানো ‘রূপ’-এর সন্তান, আমরা তাঁর ‘রূপ’-এর রং-তুলির কারিগর। তিনি ‘রূপ’ দিয়ে আমাদের গড়েছেন, আমরাও সাধন দিয়ে তাঁর ‘রূপ’কে গড়েছি।

হে উদাসীন বাতাস আমরা তোমার রূপে মুগ্ধ, হে পাগল আমরা তোমার রূপে বিস্মিত!

হে রণে হেরে যাওয়া বীর, আমরাও তোমার চোখের জলের ‘রূপ’ দেখে– এই চুপের কাছে বসে আছি নিরন্তর। আমাদের এই ‘চুপ’ থাকা– হে বীর তোমার ‘রূপ’কে জয়ী করে তুলুক।

হে বালক, তোমার লাটাই ঘুড়ির ‘রূপ’ আমাদের আরো ব্যাপক ও উদাসীন করুক।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june goddyo

স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলন ও ফরাসি কবিতা । পর্ব ৪

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৪

সৈয়দ কওসর জামাল

jamal_sm

স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলন ও ফরাসি কবিতা

স্যুররেয়ালিস্ত পত্রিকা ‘লা স্যুররেয়ালিস্ত রেভল্যুসিয়ঁ’-র চতুর্থ সংখ্যা (মে, ১৯২৫)-তে প্রকাশিত হয়েছিল আঁদ্রে ব্রতঁ-র লেখা—‘কেন আমি লা স্যুররেয়ালিস্ত রেভল্যুসিয়ঁ-র সম্পাদকের দায়িত্বভার নিজের হাতে নিচ্ছি’। এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ আগের সংখ্যার সম্পাদক পিয়ের নাভিল, যিনি লিখেছিলেন যে স্যুরয়ালিস্ট পেন্টিং বলে কিছু নেই। অথচ ব্রতঁ-র ধারণা বিপরীত। তিনি নাভিলের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে প্রবন্ধ লিখলেন ‘স্যুররেয়ালিসম ও পেন্টিং’ নামে। আর এই বছরেই প্রথম স্যুরিয়ালিস্ট ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।

        ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে খ্যাতনামা কবি পল ক্লোদেল, যিনি তাঁর কবিতায় ক্যাথলিক ধ্যানধারণারপ্রকাশ করে থাকেন, ‘কমেদিয়া’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে দাদাইজম বা স্যুররিয়ালিজম-এর আর কোনো অর্থ নেই সমকামিতা ছাড়া। এর পরপরই ‘জাপানে ফ্রান্সের অ্যাম্বাসাডার মসিয়্য পল ক্লোদেলের প্রতি খোলা চিঠি’তে স্বাক্ষর করে ২৮ জন বিশিষ্ট কবি-লেখক ও শিল্পী জানান–“লিখুন, প্রার্থনা করুন আর আবোলতাবোল বকুন”। এই খোলা চিঠি ছেপে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়—“আপনাকে একজন নীতিবাগীশ ও বজ্জাত লোক হিসেবে আমরা ঘোষণা করছি”। একই সময়ে প্রায় স্যাঁ-পল রু নামে একজন অবহেলিত কবি যাঁকে স্যুররিয়ালিস্টরা পছন্দ করতেন, প্যারিসে ফিরে আসেন। তাঁর সম্মানে স্যুররিয়ালিস্টরা ক্লোজারি দ্য লিলা নামের এক অখ্যাত কাফেতে ভোজসভার আয়োজন করে সাহিত্য জগতের নামী মানুষদের সেখানে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। সবাই আসন গ্রহণ করে দেখেন যে প্রত্যেকের ন্যাপকিনের নীচে রাখা আছে পল ক্লোদেলকে লেখা খোলা চিঠিটি। সেই সঙ্গে স্যুররিয়ালিস্টদের ডিনার-পরবর্তী বিদ্রোহমূলক বক্তৃতার প্রতিবাদ করেন কেউ কেউ এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে পুলিসের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

        এই ঘটনা স্যুররিয়ালিস্টদের কম্যুনিজমের আরো কাছাকাছি নিয়ে যায়। ‘লা রেভোল্যুসিয়ঁ স্যুররেয়ালিস্ত’ পত্রিকায় এক ইস্তেহারে লেখা হয়েছে—‘বিপ্লব এখনই কিংবা কখনই নয়’। এই ইস্তেহার লেখা হল দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে এবং মরক্কোয় ফ্রান্সের উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। এই ইস্তেহারে স্বাক্ষর করেছেন স্যুররিয়ালিস্টরা ও বিপ্লবী ধ্যানধারণার সঙ্গে যুক্ত ক্লার্ত, করসপঁদাঁস, ফিলোজফি ইত্যাদি পত্রপত্রিকার ব্যক্তিরা। এখন থেকে মার্ক্সীয় নীতিগুলো স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনকে সংহত করেছে এবং দিশা দেখিয়েছে। এই কারণে কেউ কেউ মনে করেন যে মার্ক্সীয় প্রভাবের কারণেই স্যুররিয়ালিজম এতদিন সক্রিয় থেকেছে।

       তবে ১৯২৫ এর শেষ দিক থেকে ১৯২৯ এ দ্বিতীয় স্যুররেয়ালিস্ট মানিফেস্টো  প্রকাশ পর্যন্ত কম্যুনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক একই রকম থাকেনি। কম্যুনিস্টরা কবিলেখকদের দেখেছে সন্দেহের চোখে। আবার তাঁদের প্রতি দুর্বলতাও দেখিয়েছেন তাঁরা। স্যুররিয়ালিজম ক্রমশ যে একটি সাংস্কৃতিক শক্তি হয়ে উঠছেকম্যুনিস্টরা তা লক্ষ করেছেন। এই সমইয়ের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ব্রতঁর ‘নাদজা’, পল এল্যুয়ার-এর ‘কাপিতাল দ্য লা দুল্যর’, ‘লে দেসু দ্যুন ভি’, ‘লামুর লা পোয়েজি’, বেঞ্জামিন পেরে-র ‘দরমির’, ‘দরমির দাঁ লে পিয়ের’, ‘ল্য গ্রঁদ ফ্য’, রনে ক্রভেল-এর ‘লেস্পিরিত কন্ত্র লা রেজোঁ, লুই আরাগঁ-র ‘পেইজাঁ দ্য পারি’, রবের দেসনস-এর ‘লা লিবার্তে উ লামুর’ এবং মাক্স আর্নস্ট-এর উপন্যাস ‘লা ফাম ১০০ তেত’। এইসব রচনায় বিদ্রোহের যে উচ্চ সুর ধরা পড়েছিল, তা একেবারেই অভিনব। এই পাশাপাশি স্যুররিয়ালিস্ট চিত্রকরদের ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর তাতে অংশ নিয়েছেন আর্প, শিরিকো, আর্নস্ট, মিরো, পিকাসো, মান রে, ইভ তাঁগু প্রমুখ শিল্পীরা।

        আঁদ্রে ব্রতঁ-র ‘নাদজা’  তাঁর জীবনের বাস্তব ঘটনাবলির কথা। তাঁর জীবনের এক পর্বে তিনি এক অবিস্মরণীয় নারীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। এই নারীর মধ্যে অদ্ভুত সব স্যুররিয়ালিস্টিক গুণাবলি ছিল। ব্রতঁ-র এই কাহিনি পড়ে পাঠকের মনে জীবনের স্বাভাবিকতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগতে পারে। এই কাহিনির দুঃখজনক দিক হল নাদজা শেষ পর্যন্ত উন্মাদ হয়ে যান। আর গ্রন্থটি শেষ হচ্ছে লুনাটিক এসাইলাম ও সেখানকার কর্মীদের সম্পর্কে ব্রতঁ-র বীতশ্রদ্ধ সমালোচনা। এই গ্রন্থ প্রকাশের পরে বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে ব্রতঁ-কে আক্রমণ করা হতে থাকে। সব আক্রমণের জবাব দিতে তিনি লেখেন ‘মানসিক রোগের চিকিৎসা ও স্যুররেয়ালিসম’ নামের একটি প্রবন্ধ। তিনি তাঁর সমালোচনায় স্থির থাকেন।

        স্যুররিয়ালিজম-এর সঙ্গে প্রথম থেকেই চিত্রকরদের যোগ। আধুনিক চিত্রকলায় পিকাসোর মতো চিত্রকরদের গুরুত্ব নতুন কওরে বলার অপেক্ষা রাখে না, তবে বলা দরকার এঁরা ছিলেন প্রধানত স্যুররিয়ালিস্ট। মাক্স আর্নস্ত্ এর ‘ইস্তোয়ার নাত্যুরেল’ ছবি কাঠ ও পাথরের অসমতলে কাঠকয়লার ওপর সাদা কাগজ ঘষে বানানো ছবিকে যথার্থ স্যুররিয়ালিস্টিক বলা হয়েছে। তাঁর ছবিতে আঁচে পাখি সূর্য দেবতাদের মিথ, স্বপ্নের ভিতরে আসা বন্যপ্রাণ ও প্রাণী। আর এক নামী স্যুররিয়ালিস্ট চিত্রকর সালভাদর দালি। তাঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯২৯ সালের নভেম্বরে।

        পল এল্যুয়ার-এর কবিতায় আবেগ ও বিদ্রোহের স্বচ্ছতা ও কোমলতার স্বতঃস্ফূর্ততা বেশি করে লক্ষণীয়। স্যুররিয়ালিস্ট কবিতাকে এক উচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন এল্যুয়ার। তাঁর ‘লে দেসু দ্যুন ভি, উ লা পিরামিদ য়্যুমেন’ স্বপ্ন, স্যুররিয়ালিস্ট রচনা ও কবিতার সমাহার। ভূমিকায় এল্যুয়ার লিখেছেন—“কবিতার ব্যবহারহীনতা, স্পর্শযোগ্য পৃথিবী স্যুররিয়ালিস্ট রচনার বাইরে রাখা থাকে, আর সবচেয়ে উচ্চমৃদু আলো সেই উচ্চতায় জ্বলে, আর সেখানে মন যে স্বাধীনতা পায় তার পরিমাপ স্বপ্নেও করা যায় না।” আরব এক কবি লুই আরাগঁ-র ভূমিকা কোনোভাবেই স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে খাটো করে দেখা যাবে না। এই আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক ছেদ করেছিলেন একসময় সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু তাঁর ‘ল্য পেইসাঁ দ্য পারি’ স্যুররিয়ালিস্ট কল্পনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কবি হিসেবে এঁদের সমতুল না হলেও বেঞ্জামিন পেরে ছিলেন আন্দোলনের অগ্রপথিক। স্যুররিয়ালিস্ট বিপ্লব পত্রিকায় পেরে-র একটা ছবি ছাপা হয়েছিল, যার নীচে লেখা হয়েছিল—“আমাদের লেখক বেঞ্জামিন পেরে এক যাজককে অপমান করছেন”। ফ্যান্টাসি তাঁর রচনার বিষয়। বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি পেরে-র ঘৃণা ছিল অপরিসীম, আর তা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচনায়। আধুনিক সমাজকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছে রনে ক্রভেল।তাঁর উপন্যাস মাত্রই যেন স্বপ্ন, যা বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে এক গভীর অস্তিত্বের কথা বলে। ১৯২৯ সালেই প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোয় রনে শার-এর—‘আরসেনাল’। স্যুররিয়ালিস্টদের মতো অনেক যুক্তিবিবির্জিত চিত্রকল্পের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর কবিতায়। এভাবেই স্যুররিয়ালিস্টরা সৃষ্টিশীলতার বিশেষ পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছিলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকেই তাঁরা নিজের নিজের সৃষ্টি-স্বাতন্ত্র ও বৈচিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। শুধুমাত্র ‘অটোম্যাটিজম’-এর সরল ব্যাখ্যায় তাঁদের সৃষ্টিকে বোঝা যাবে না।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june kobita

কৌশিক সেন

গু চ্ছ ক বি তা

কৌ শি ক   সে ন

কনফেসান

তোমাকে বলিনি যেকথা। কুহকমিলনে ভেসে গেছে

অন্তর্দাহ। মালিকানাহীন বাস্তুভিটে একলা দাঁড়িয়ে থেকেছে

রৌদ্রের অপেক্ষায়। চান্দ্রমাসে বিফলে গেছে অদেখা অভিসার।

 

বলা হয়নি। যে সুখ পুষে রেখেছিলাম আদিম মন্দিরগাত্রে,

বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তাও!  আস্ফালনে যে কোকনদ প্রত্যাখ্যান

করেছিলে, একদিন মানুষের জলহাওয়া পেয়ে সুগন্ধ ছড়াবে

অরুপকথার।

 

পাতার আদলে যেসকল কিংকর্তব্যবিমূঢ় নক্ষত্র হাওয়ায়

ভেসেছিল, সকলকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম একদিন, তোমারই

প্রত্যাশায়। এসব কথা বলা হয়নি এতকাল।  আজ বলছি…

pujo_16_sketch2

মোহদানব

পাড় হয়ে যায় ঘন জারুলের বন, সুদীর্ঘ তট রেখা।  মাধবীকুঞ্জে

বেঁধে রাখা রিপুগ্রন্থি খুঁটে খায় বেলা দশটার কাঠবিড়ালি।  কোনো

স্পর্শসুখ নেই, এই প্রকাণ্ড হাঁমুখ গণ্ডগ্রামে।  আলজিভে ক্ষতচিহ্ন।

তবুও পেড়িয়ে এসেছি ভাদ্রের দুপুরের একপেট ক্ষুধা, ঝোলভাতের মায়া।

 

ফিরে তাকালে দূর থেকে আবছা দেখতে পাই ছেড়ে আসা জাদুলন্ঠনের

আলো।  কান্না আসেনা আর!

pujo_16_sketch2

সিফিলিস

আকাশ থেকে নেমে আসছে কৃষ্ণবর্ণের পুরুষ

এসো, মর্দন করি!

 

গণিকাপথ থেকে যে অটোরিক্সাটি এসে ফেঁসে আছে

আলোকিত অণ্ডকোষে, সেখানে এক অলৌকিক মিনাবাজার

বসে প্রতি সন্ধেয়, বিকিকিনি হয়। গমগম করে…

 

ওকে বোলো, অন্তর্বাস ছেড়ে যেতে, সবথেকে তেজী ঘোড়ার

আস্তাবলে। কুড়িয়ে আনবো ঘন কালো সুখ। কোনো ব্যাধিকেই

ভয় পাইনা আর!

pujo_16_sketch2

প্রদাহ

যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড়ালে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা হয়ে ওঠে পৃথিবী,

মাটির টানে টানে কাব্যিক হয়ে ওঠে স্বর, পুড়ে যাওয়া উদ্যানে

নষ্ট পরীদের চলাচল।  মালসায় পূর্বনারীদের নাভিভস্ম।

 

যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড়ালে গর্ভধারণ করে কবিরা।  নির্দয় সঙ্গমে

কারা যেন রক্তবীজ ছড়িয়ে দেয় তাদের রোগজর্জর রাতবিছানায়।

শব্দে শব্দে স্পষ্ট হয় অব্যক্ত রমণদাগ।

 

যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড়ালে অনাবৃষ্টি নেমে আসে শস্যশ্যামলা

বসুন্ধরায়।  শকুনে ছিঁড়ে খায় মঙ্গলকাব্যের উত্তরভাগ।  মাটির

গভীর পর্যন্ত খনন করলে কোনো প্রত্নসুখ নেই, প্যালিওলিথিক

অস্থি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবেনা!

pujo_16_sketch2

ওয়াচ টাওয়ার

পুরুষগন্ধ থেকে বেরিয়ে আসে মিনারের কবিতা। 

সাময়িক সুখ, মধ্যরাতের রমণচিহ্ন, পেঁচার বদ্বীপ

ছেড়ে ভেসে আসে সামুদ্রিক আকাশবার্তা। মেঘে

মেঘে বেলা হয়।  পুরনারীরা কলস ভরে নেয়

রিরংসার জলে।  ঋতুরক্ত ভাসিয়ে দেয় গভীর প্রবাহে।

দূর পাহাড়ের ওপাড় থেকে ভেসে আসে সুর, পলাতকা

গান্ধর্বী রমণীদের বৃন্দগান।

 

চিল উড়ে যায় অজানায়।  শুধু পুরুষগন্ধি কবিতার

নামটা জানা হয়না কখনও!

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june kobita

অর্ঘ্যকমল পাত্র

গু চ্ছ ক বি তা

অ র্ঘ্য ক ম ল  পা ত্র

কলেজে বসে…

স্বীকারোক্তি

 

মুগ্ধতা পেয়েছি বলে, মগ্ন হতে পারিনি কখনও

এসব বোঝো না তুমি। বুঝতে হবে না কোনোদিন

 

বরং সাজাও গ্রাফ, সাবধানে স্লোপের বিস্তার…

নইলে তো পন্ড হবে শ্রম, অচিরে উঠবে ভুল

 

আমার ভুলের পাশে, দেখি, ঝুলে আছো আজও;

কখনও প্রশ্রয় দাও, কখনও সরাও নিজহাতে

                মুখের বাঁ-পাশ থেকে দু-গাছি ও চুল…

 

 

ছাপ

 

বরং, ব্লেডের দাগ ফুটে থাকে কিছুকাল ধরে…

বলেছি, লিখেছি কত কথা স্পষ্ট গোপন অক্ষরে—

 

একবার অন্তত আসুক বন্ধুত্ব ভাবনা ছেড়ে

বসুক নাহয় ম্লান; প্রকাশ্যে লাগে না সব কথা

 

তবুও নিছকই প্রেম

                    এভাবে কি কখনও গড়ে না?

 

ব্লেড, রক্তদাগ, ক্ষয়—ফুটিয়ে তোলাই তবে সত্য?

বান্ধবী তোমার যদি সে, কখনও কবিতা পড়ে না?

pujo_16_sketch2

খেলাপ

 

হেরে যেতে, হেরে যেতে যেতে

আমি তো খুঁজেছি রোজ, তুমিও কি না পেয়ে কাতর?

 

বিষণ্ণতার গায়ে লাগা এটুকু জমাট দেখি

বাকিসব মৃদুমন্দ

হাসি, গান, হুল্লোড় ও আঘাত…

 

দূরত্ব তৈরির মধ্য দিয়ে, আর যা যা উঠে এল

সেসব কি অনুরাগ? নাকি প্রতিবাদ?

 

 

অতঃপর

 

তোমাকে পেয়েছি ভেবে

উচাটন বৃষ্টিদিনে, ক্রমশ দিঘির জলে নেমে

ঝাপসা দেখেছি সব

উপরে যা স্পষ্ট ছিল খুব…

 

তোমাকে পেয়েছি আদৌ?

নাকি এ সমস্তই নিশ্চুপ?

 

আদতে এসেছে দ্বিধা; দ্বিধার পিছনে আসে ভয়…

 

কবিতা? নাকি ওষুধ?

কার কাছে এ-বিপদে সাহায্য নিতে হয়?

pujo_16_sketch2

দোষ

 

তোমার জীবন থেকে তবে

আমাকে কি সরে যেতে হবে?

শেষে বিসর্জনে,  তা তো  যাওয়াই যায়…

 

হাবুডুবু খেতে খেতে রোজ

মাটি তার কাঠামো হারায়…

 

তোমারও তেমনি ভ্রম

এ-কাঠামো ফাঁকা দেখে, এল নাকি দয়া?

ওহে! দয়াপরবশ মেয়ে, মন দিয়ে শোনো—

 

এতদিন জলে ডুবে  কীভাবে ছিলাম ভয়ে

তোমাকে কি বলেছি কক্ষণও?

 

 

বিশ্বাস

 

তোমাকে চেয়েছে আরও যারা

তাদেরও চেয়েছি আমি

 

নইলে এই প্রতিযোগিতাকামী দিনে

হারাব কাকেই আর তুলব কলার?

 

বিস্মিত চশমা মুছে দেখো মন দিয়ে—

কেবল তোমাকে ছাড়া

কারোর কাছেই হারিনি আমি আর…

pujo_16_sketch2

মুখোমুখি

 

ইশারা কিছুটা আরও জমাট করাই যেত বটে

করিনি নিখুঁত তবু। বুঝেছি, মেধাবী দৃষ্টি আছে

 

তারই পাছে পাছে ঘুরে

থেমেছি যেখানে ভয় না-পাওয়া ঘিরে…

যাইনি তবুও ফিরে— কিছুটা সময় দিও

 

শান্তিতেই বসো তুমি আর

চোখে  যদি পড়ে রোদ

আমাকে তোমার শুধু সামনে ডেকে নিও…

 

 

না-হওয়া

 

যেকোনো সম্ভাবনাহেতু আমাদের দেখা হল;

হল-ই যখন, বাড়াবে হাত? সমুদ্রের দিকে?

 

সমুদ্রে আমি হাঁটুজল। সামান্যই তো

শিখেছি খেতে; বাড়েনি তাই খিদে…

 

অবিশ্বাসে ভাবছ ভীরু?

ওরে হারামজাদি

তোর জন্যই কাব্য লিখি;

                নাছোড় কোনো জিদে

pujo_16_sketch2

আরও পড়ুন...