Categories
2023_feb goddyo

মুক্তগদ্য

মু ক্ত গ দ্য

ব র্ণা লী  কো লে

barnali

“আমার যে সব দিতে হবে”

আবেগ শেষ হয়ে গেলে কিছু থাকে? আবেগ তাহলে আমাদের মন ও দেহ নামক ইঞ্জিনের চালিকা শক্তি। সত্য কিছু নয়? সুন্দর কিছু নয়? সবই ঘোর? সবই মোহ? আজ শান্ত সন্ধ্যা। যেভাবে বরফকে স্পর্শ করা যায়, হাওয়ার উপস্থিতি স্পর্শ করে আমাদের, সেভাবেই শান্তি আজ স্পর্শযোগ্য। করতলে অনেক ধুপ ধুনো। আমার আজ নিজের কাছ থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। দূর নদীতীরে যে কুপী জ্বলে, তার আগুন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।ধ্যান ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। অথচ আমার, আমারই ফোনের গ্যালারি খুললে দেখা যাবে থরে থরে সাজানো সেলফি। অদ্ভুত আত্মপ্রেমের মোহাক্রান্ত আমাদের হৃদয়ের সম্মিলিত এক দলিল। যুগ চিহ্ন। যে মুখ আমরা দেখাতে চাইছি, তাদের আত্মপ্রকৃতিতে কেবল-ই অস্থিরতা, কেবল-ই ছোটাছুটি। মনে পড়ে নার্সিসাসের মুখ— সেই গ্রীক যুবা যে জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আত্মপ্রেমে পড়েছিলেন ও সর্বদা জলের নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

আত্মপ্রেম চিরকালীন। আমরা নিজেকে ভালবাসা মানে বুঝি নিজের বহিরঙ্গকে পরিপাটি করা। উজ্জ্বল পোশাকে,উজ্জ্বল সজ্জায়। নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা। নিজেকে ভুলে যাওয়ায় আত্মপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের গানে, “শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা”। স্রোত দেখি। চলেছে পিপীলিকার মতো। অবসানে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা হলে যেমন ঝনাৎ, ঝনাৎ শব্দ হয়, তেমন। কিছু নেই। আমির শেষে পড়ে থাকে কয়েকটি কাজ। তাও কী বৃহৎ স্রোতে খড়কুটো? কালো পোশাক পরে আমাকে কত ভালো লাগছে,সে সম্পর্কে আয়না আমাদের বারবার নিশ্চিত করে। নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি তো, দিনে কতবার আমরা সুন্দর চেতনাকে হত্যা করেছি।এবং কেন করেছি। এক ইঞ্চি জায়গা আমরা সুন্দরকে ছেড়েছি তো? বৃহৎ সুন্দর ধরে ফেলছে না তো আমাদের চালাকি? স্বার্থপরতার বিষবৃক্ষ আমাদের হৃদয়ে গ্রথিত। আমরা অতি সহজেই চিনে নিয়েছি ওপরে ওঠার সোপান। সব কিছু আমাদের আমাদেরই ঝুলিতে চাই।যা পাচ্ছি আমি তার যোগ্য তো? আমরা সহনাগরিক যে আমার থেকে অনেক দক্ষ, তারা কেবল পিছিয়ে পড়ছে না তো, তারা যোগাযোগের সোপানগুলি চেনে না বলে।আমাদের আত্মপ্রেমে কোনও আত্ম-জিজ্ঞাসা নেই। এমন কোনও শিক্ষক নেই যে আমাদের আমাদেরকে নিয়ে মোহ ভাঙবে। যদি কেউ থাকে, যদি কেউ দ্রষ্টা হয়, তাকে আমরা বলতে দেব না। মাইক্রোফোন হাতে কারা? কারা? মুখের ভিড়ে মুখ কোথায়?

আমরা আসলে আমাদের খাঁচায় কমবেশি বন্দী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”। বিশ্বলোক সম্পর্কে আমাদের স্পন্দন আছে? নতুন সকাল হলে যেসব যুবক যুবতীর মুঠোফোন ছাড়া আর কোনও বন্ধু নেই, তাদের মুখগুলি মনে পড়লে সকালের সূর্যালোকের ওপর বিষাদ পড়ে। আমরা ব্যস্ত সর্বদা নিজের স্বার্থ নিয়ে। ১৯৭৯ সালে মাদার টেরেসা তাঁর নোবেল লেকচারে বলছেন, যাদের কেউ যত্ন নেয় না, যাদের কেউ ভালবাসে না, যারা অনাকাঙ্ক্ষিত, তাদের গ্রহণ করার জন্য আমরা আছি তো? অন্যের পাশে দাঁড়ানো, অন্যের ব্যথাকে ছুঁয়ে তার জন্য আকাশ আনাও আত্মপ্রেম। আমি কোথায় থাকি? আমরা কোথায় থাকি? করতলে? নক্ষত্রের মতো থাকি। আবেগের ঘন বিভ্রান্তি ছিঁড়ে সূর্যোদয় দেখা যায়? প্রেম পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার সমাপনে কামনার চোখ ধিকিধিকি জ্বলে। আমির দহনের শেষ নেই। এত কামনা, এত বাসনা। অথচ, আমার এই দেহখানি তুলে ধরতেও হবে। তোমার দেবালয়ের প্রদীপ হতে হবে। কিন্তু আলো অন্ধকারে গেলে মাথার মধ্যে এখনও বোধ কাজ করে। বাইরের পৃথিবী তোমার সম্পর্কে উদাসীন, কিন্তু নিজের বাঁচা খুবই জরুরি। অতি ইচ্ছের সংকট হতে বাঁচা জরুরি। কেউ-ই যে তোমার অন্তরের দোসর নয়, এটা অনুভব করেও একজন শিল্পীর বাঁচা জরুরি। তোমার হাত কারো হাতে রাখতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু যে হাতের মধ্যে তুমি হাত রাখতে পারো, তেমন হাত নেই। তাই তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে। তুমি নিজে জানো না, তুমি কত বিশাল শক্তির অধিকারী। কিন্তু কিছুতেই তুমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছ না, তুমি নিজের দিকে না তাকিয়ে, নিজেকে না দেখে অন্যের দিকে হাত বাড়াচ্ছ। মনের মধ্যে একটি মন দাসের মতো বেড়ি পরে আছে, নিজেকে লুটিয়ে দেবে বলে, বিলিয়ে দেবে বলে। কিন্তু কার কাছে নিজেকে বলি দিচ্ছি, এই বিষয়ে কোনও চেতনা নেই। আধো চেনা, আধো পরিচয়। জীবন তরণী আচমকা জোর ধাক্কার মতো বিস্ফোরণে থমকে যাচ্ছে। পরের দিন আবার সকাল। সকল চিন্তার, সকল দুর্যোগের অন্তরালে একটি শান্তধারা বয়ে চলেছে। নদী বয়ে যাচ্ছে, ভোর হচ্ছে, সবুজ ঘাস আনন্দিত, ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, চন্দ্র, সূর্য, তারা… পৃথিবীর লাবণ্য আমাদের ছোঁয় না আর। আমাদের কেবল চাই… আমিকে চাই না, রোমশ আমিকে চাই। লোম দীর্ঘ হচ্ছে, চারপায়ে চলছি আমরা। সর্বদা আঙুরফলের আকাঙ্ক্ষায় লাফালাফি। যদিও জানি সোনার হরিণ মোহ, কেবলি পালায়।

আজ এই ভালবাসার দিনে নিজেকেও ভালবাসা শুরু হোক। আমাদের শিক্ষা আমাদের বারবার যেন ব্যর্থ না করে। জ্ঞান আলো জ্বালাক। আমরা নিজেদের আত্মবিশ্লেষণ করি। বদলে নিই নিজেদের। ভালো করে বাঁচি। কথার স্রোতে, অলসতার স্রোতে সব যেন ভেসে না যায়। নিজেকে ধরতে হবে। আত্মগঠন করতে হবে। নিজেকে ভালবাসতে হবে। নিজেকে ভালবাসা মানে নিজেকে উন্নীত করা। আলোর দিকে যাত্রা। ভালো থাকা মানে সারাদিন কিছু ভালো কাজ করা, যার মাধ্যমে ভিতরের আমি বা বাইরের সমাজ কোথাও পূর্ণতা পাই। এই পূর্ণতার অনুভব হয়তো আমাদের ভালো রাখতে পারে।এত বিনোদনে ভরা জগতে যখন আমরা প্রতিনিয়ত একা হচ্ছি, আত্মপরিচর্যা খুব জরুরি। রবীন্দ্রগান সত্য হয়ে উঠুক, “আমার যে সব দিতে হবে”।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

প্রচ্ছদ কাহিনী | ফেব্রুয়ারি সংখ্যা

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

কি শো র  ঘো ষ

kishore

মশারিই কি মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার?

মশা শুধু ম্যালেরিয়া বাধায় না। সে রাজনীতিও করে। এই তো, মাস কতক আগে ডেঙ্গু না ডেঙ্গি (সম্ভবত ছেলেদের হলে ডেঙ্গু, মেয়েদের হলে ডেঙ্গি!) বিপদে ফেলছিল রাজ্য সরকারকে। শহর ও শহরতলির শয়ে শয়ে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন এই রোগে। অনেকেরই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল। সুযোগ পেয়ে বিরোধীরাও হাতা গুটিয়ে নেমেছিলেন ময়দানে। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, মশা নির্ঘাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী। তবে কিনা সে কেবল ক্ষমতায় থাকা রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকারের উল্টো দিকে ভন-ভন করে না, সে আদতে সমগ্র মনুষ্যকুলেরই বিপক্ষে। 

মশার রাজনীতি, ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার’:

এই গ্রহে ‘মানুষের সরকার’ চলছে! অর্থাৎ কিনা মানুষই ক্ষমতায়। বাকি প্রাণীকুল রাজনীতির পরিভাষায় অতি দুর্বল ‘বিরোধী পার্টি’। মানুষ জাতটা ল্যাজে খেলাচ্ছে তাদের, যা না তাই করছে। আল্ট্রা প্রযুক্তির যুগে পশু-পাখির সঙ্গমদৃশ্যেরও রেহাই নেই, ঘোসলায় ক্যামেরা ঘুসিয়ে ছবি তুলে বিক্রি করে মুনাফা কামাচ্ছে! তলিয়ে ভাবলে, বহুকাল ধরেই নিঃশব্দে নীরবে একটা তৃতীয় ‘বিশ্বযুদ্ধ’ চলছে— ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার’! সেখানে এক পক্ষ মানুষ তথা মানব সভ্যতা। অন্য দিকে দুনিয়ার যাবতীয় অবলা প্রাণীরা। হয়তো বা যাদের ‘গেরিলা সামরিক বাহিনী’ হল গিয়ে কোটি কোটি মশা! যাক গে, আসল কথা হল, মশা মারতে কামান না দেগে উপায় ছিল না সভ্য মানুষের। আজও নেই। কারণ গত ১০ হাজার বছরের পৃথিবীতে বাঘ-ভাল্লুক-সাপ-কুমির যত মানুষকে হত্যা করেছে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি মানুষ মেরেছে নিরীহ মশা। বলা বাহুল্য, মশা তথা মশাবাহিত রোগ (বিশেষত ম্যালেরিয়া) এবং মানব সভ্যতা ইতিহাসের হাইওয়ে ধরে পাশাপাশি হেঁটে আসছে। কখনও দেবতার অভিশাপের মিথ, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কোটি কোটি নির্ঘুম রাত, সাম্রাজ্যবাদীদের মাথা ব্যথার কারণ, শ্রমিকদের দুর্দশা, এমনকী আন্তর্জাতিক রাজনীতির, মহাযুদ্ধের কারণ হয়েছে মশা। যদিও দিন বদলেছে, মশাবাহিত জ্বরজারি নিয়ে গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছে। যেমন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ভ্যাক্সিন, নতুন অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগ এবং ম্যালেরিয়া জিনোম প্রজেক্টের উপর গবেষণা চলছে। মশা দিবস না থাকলেও ২৫ এপ্রিলকে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। তার মানে মশা ভার্সেস মানুষের যুদ্ধে একপক্ষ যে জিতে গেছে, এমনটাও নয়! অতএব, মশা নিয়ে কালে কালে দেশে দেশে পঞ্চায়েত পৌরসভার কর্মচারীরা পরেশান হবেন না কেন! 

কীটতত্ত্ববিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম, অত বড় চেহারার হাতি, যার আরেক নাম ‘মহাকাল’, তাকে নিয়েও তত গবেষণা হয়নি, যত হয়েছে মশা নিয়ে। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে আমেরিকার দেশগুলিতে মশা নিধনের জন্য বার্ষিক যত বাজেট ধরা হয়, পাগলা হাতি বা মানুষখেকো বাঘের আক্রমণ থেকে নাগরিকদের প্রাণ বাঁচাতে ততো বাজেট ধরা হয় না কখনই। অতএব, সাফ হিসেব— প্রাণীটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বের বিচারে তার স্থান শীর্ষস্থানীয়। সবচেয়ে বড় কথা, অনাদিকাল থেকে মশা ও মানুষের শত্রুতা চলছে। যেমন ধরুণ, অত বড় দিগ্‌বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তাকে পর্যন্ত নাকানিচোবানি খাইয়ে  ছেড়েছিল মশা!  

স্বদেশি মশা না সিকন্দর:

ভদ্রলোক অনায়াসে এ দেশটাকে কবজা করতে পারতেন, কিন্তু মশার ঝামেলায় পিছোতে হল! এই নিবন্ধে এমনি এমনি বলা হয়নি যে এরা পৃথিবীর প্রথম গেরিলা যোদ্ধা! সে যুগের সেরা অস্ত্রকেও ভয় খেতো না। ফলে বাধ্যতামূলক গ্রিকদের স্বদেশ-প্রস্থান। পথে দেহত্যাগ অ্যারিসটটালের প্রিয় ছাত্র সিকন্দারের। এই সত্য জানার পর আজ মনে হয়, আলেকজান্ডার সংক্রান্ত মিথ-বাক্যটি কালের নিয়মে খানিক কাটা পড়েছিল। আমরা জানি, ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ!’। যদিও তিনি বোধহয় বলেছিলেন, ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ, এখানের মশককুল কি কোনও দিন হইবে না শেষ!’ 

ইয়ার্কি না, ইতিহাসবিদদের মতে, মশার মারণ কামড়েই ক্রমশ গ্রিক সৈন্যের সংখ্যা কমতে থাকে। আন্দাজ করা যায়, এ ঘটনা কেবল আলেকজেন্ডারের সঙ্গেই ঘটেনি, সেই সকল শাসকের সঙ্গেও ঘটেছে, যারা গত কয়েক হাজার বছরে দফায় দফায় ভারত আক্রমণ করেছে, হয় ধনসম্পদের লোভে, নতুবা ক্ষমতালিপ্সায়। এবং এদের সর্বাগ্রে স্বদেশি মশা, পরে স্বদেশি রাজার সৈন্যসামন্তের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল। যাক গে, এ তো গেল প্রাচীন ভারতের মশাদের দেশাত্ববোধক ইতিহা! কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে?

ন্যাশনাল লাইব্রেরি যান, অনামা ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্টদের রোজনামচা বা আত্মজীবনী পড়ুন। চোখ ফেটে জল পড়বে আপনার! বাপ-মা-বউ-সন্তান ছেড়ে আইসিএস হয়ে বাংলায় এসে কী বিপদেই না পড়েছিল বেচারারা। জীবনানন্দের ঢের আগে ওঁদের প্রকৃতই ‘বিপন্ন বিস্ময়ে’ পাঠিয়ে ছেড়েছিল ভারতীয় মশারা। বহু ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্ট মশার কামড়েই বাংলা তথা ভারতের মাটিতে সমাধিস্থ হন। অতএব, মশার দল আদি স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বীকৃতি দাবি করতে পারে! কার্যত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে এদেশের বিখ্যাত পতঙ্গ বাহিনীই। মানুষ বিপ্লবীদের আবির্ভাব অনেক পরে। কিন্তু আসল প্রশ্ন, মশা এতখানি ভয়ঙ্কর কেন?

কারণ মশা ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, মস্তিষ্কপ্রদাহ, হলুদ জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর, পীত জ্বরের মত সংক্রামক রোগের কারণ। জেনে রাখা ভালো, জীব বিজ্ঞানের ভাষায় মশা হল নেমাটোসেরা মাছি বর্গের অন্তর্ভুক্ত পতঙ্গ। আরও স্পষ্ট করে বললে, মশা মূলত ক্রেন মাছি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কিছু প্রজাতির নারী মশাই রক্ত শোষে এবং মারাত্মক সংক্রামক রোগ বিস্তার করে। যাদের মধ্যে অ্যানোফিলিস অন্যতম। দুনিয়া জুড়ে আজ অবধি ৩,৫০০-এর বেশি প্রজাতির মশা পাওয়া গিয়েছে। যেসব মশা কামড়ায় তারা প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষের শরীরে রোগ সংক্রমণের চালক হিসেবে কাজ করে থাকে। যেসব প্রজাতি মানুষকে কামড়ায় না, তারা আবার অন্য প্রাণীদের শরীরে রোগ সংক্রমণে দায়ী। 

অ্যানোফিলিস, রক্তখেকো মহিলার কামড়:

আশপাশে উষ্ণ রক্তের উৎস থাকলে প্রকৃতিগত ভাবে বুঝতে পারে মশা। বিজ্ঞানীদের জানাচ্ছেন, মশার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় প্রখর। ১০ থেকে ৫০ মিটার দূরের মানুষের বাতাসে ত্যাগ করা কার্বন ডাই অক্সাইড শনাক্ত করে ফেলে মশা। এরপর শরীরের উত্তাপ বুঝে কামড় বসায়। স্ত্রী কিউলেক্স ও স্ত্রী অ্যানোফিলিস জাতীয় মশা রক্ত পান করে। একটি মশার ওজন সাধারণত ২.৫ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। মশা ১ থেকে ৩ মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে, ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২.৫ কিলোমিটার বেগে। মশারা উড়ন্ত অবস্থায় যৌন মিলন করে এবং সেক্সুয়াল ট্রান্সমিশনের জন্য সময় নেয় ১৫ থেকে ১৭ সেকেন্ড মতো। পরবর্তী ৩ থেকে ৬ দিনের ভিতর ডিম পাড়ে। এরা একবারে ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম পেড়ে থাকে। একটি স্ত্রী মশা তার জীবদ্দশায় কম করে ১০ হাজার ডিমা পাড়ে। স্ত্রী মশার ডিম উৎপাদনের জন্য প্রচুর প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। তারা যত বেশি রক্ত চুষবে তত ডিমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। গড়ে একটি মশা একবারে ০.০০১ থেকে ০.০১ মিলিলিটার রক্ত খেতে পারে। অর্থাৎ একজন মানুষের শরীরের সম্পূর্ণ রক্ত নিঃশেষ করতে ১২ লাখের বেশি মশার প্রয়োজন। একটি পুরুষ মশার আয়ু গড়ে ১০ থেকে ২০ দিন। সেখানে একটি স্ত্রী মশার জীবৎকাল ১০০ দিন পর্যন্ত হতে পারে।

গর্ভবতী মহিলারা মশার ‘সফট টার্গেট’। কারণ গর্ভবতীরা পরিমাণে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড (২১%-এর বেশি) ত্যাগ করেন। তাছাড়া তাঁদের দেহের তাপমাত্রাও সাধারণের চেয়ে ১.২৬ ডিগ্রি অতিরিক্ত হয়ে থাকে। ফলে মশককুলর পছন্দের। এর পরেই শিশু এবং অসুখের কারণে যাঁরা দ্রুত এবং জোরালো ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালান তাঁদেরকে কামড়ায় এরা। যাঁরা ব্যায়াম করেন তাঁদেরকেও অতি সহজে মশার ঝাঁক খুঁজে বের করে একই পদ্ধতিতে। যাঁরা মদ্যপান করেন, কিছু প্রজাতির মশা তাঁদের বেশি কামড়ায় বলেও দাবি করেন একদল গবেষক। 

একটা ঘটনা প্রায়ই ঘটে, মশা কামড়ে চলে যাওয়ার পর আমরা কষে চড় মারি নিজেকে। ফলে ব্যাটারা মরে না, ফালতু ব্যথা পাই আমরা। প্রশ্ন হল, এমন কেন হয়? কারণ এরা গায়ে বসেই হুল ফোটায় না। তাছাড়া এদের শরীর প্রায় ওজনহীন হওয়ায় ছয় পা বিছিয়ে ৫ মিনিট চামড়ার ওপর বসে থাকলেও টের পাওয়া যায় না। এই সময় এরা হুল পিচ্ছিল করার জন্য মুখে লালা আনে। হুল ফুটিয়ে মিনিট তিনেক ধরে রক্ত চোষে। পেট ভরে গেলে উড়ে পালায় ডিম পাড়ার জন্যে। ওই লালার কারণে মানুষের শরীরের চামড়া কিছুটা অবশ হয়, ফলে সহজে টের পাওয়া কঠিন হয়। লালার একটি উপাদান রক্ত মিশতেই অ্যালার্জি হয় এবং চুলকায়। তখনই মনে হয় মশা কামড়াচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে তারা রক্ত খেয়ে পগার পার! এর উপর মশার গান!

যদিও ‘বেচারা’রা ইচ্ছা করে ‘ভন ভন’ গান শোনায় না। আসলে এরা কানের কাছে এলে আমরা যে শব্দ শুনি তা অতি দ্রুত গতিতে ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। মশা প্রতি সেকেন্ডে ৩০০-৬০০ বার ডানা ঝাপটে থাকে। এতো বেশি বার ডানা ঝাপটায় বলেই ওই বিরক্তিকর শব্দ! তবে এতে করে বিপদ নেই। মশাবাহিত মারণ রোগগুলোই আসল।

তবে মানুষও হাত গুটিয়ে বসে নেই। বসে ছিল না কোনও দিন। কারণ উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপ-আফ্রিকা-এশিয়া-আমেরিকা সব মহাদেশেই ব্যাটেল ফিল্ডে নামা সৈন্যবাহিনীর অন্যতম ঘাতক প্রতিপক্ষ যুদ্ধ ছিল না মোটেই, ছিল মশাবাহিত রোগ। বিশেষত ম্যালেরিয়া। 

ড. লাভেরন, ক্যামেলিও গলগি:  

মশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তখন থেকেই শামিল সারা বিশ্ব। ফ্রেঞ্চ আর্মির ডা. আলফনসে লাভেরান এই সংগ্রামের প্রথম দিককার অন্যতম সফল ‘যোদ্ধা’। ভদ্রলোক ১৮৭৮ সালে আলজেরিয়ার মিলিটারি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাঁর কাছে যুদ্ধটা শুধু একটা রোগের বিরুদ্ধে ছিল না। মানুষের বহু ভ্রান্ত ধারণা, হাজার বছরের মগজধোলাই জনিত কুসংস্কার এবং বৈজ্ঞানিক ভিন্নমতের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। লাভেরনকে লড়তে হয়েছিল ছয় হাজার বছরের মতবাদের (‘ম্যালেরিয়া’ মানে এক ধরনের অপ বাতাস!) বিরুদ্ধে। পাশাপাশি স্বদেশী লুই পাস্তুরের প্রভাবশালী ‘জার্ম থিওরি’র সঙ্গেও দ্বিমত পোষন করার স্পর্ধা দেখাতে হয়েছিল।

‘জার্ম থিওরি’ অনুযায়ী প্রত্যেক সংক্রামক রোগের জন্য ব্যাক্টেরিয়া দায়ী। এই সূত্রে একদল বিজ্ঞানী ‘ব্যাসিলাস ম্যালেরিয়ায়ি’ নামক কল্পিত ব্যাক্টেরিয়াও আবিষ্কার করে ফেলেন। ওদিকে শত শত ম্যালেরিয়া রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে লাভেরান একটা জিনিসই পান, তা হল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে কালো রঙের একধরনের কণিকা রয়েছে। টানা বছর দুই অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি বুঝতে পারেন, এই কালো কণিকা একধরনের পরজীবী (মনে রাখতে হবে, তখনও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের রক্তকণিকা পরীক্ষা করার স্টেইন আবিষ্কৃত হয়নি)। সমসাময়িক বিজ্ঞানী বিষয়টি না মানলেও কাজ করে যান লাভেরন। এখানে উল্লেখ্য, ‘Malaria’ শব্দটি এসেছে ‘mal’ বা দূষিত এবং ‘Aria’ বা বায়ু থেকে। যে বায়ুর সঙ্গে জলাভূমি যুক্ত। লাভেরন জলাভূমিতে তাঁর আবিষ্কৃত পরজীবীর অনুপস্থিতি প্রমাণ করেন। এর ফলে তিনি পুরোনোপন্থীদের চরম বিরোধিতার মুখে পড়েন। অবশেষে ১৮৯৯ সালে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে রক্তকণিকা পরীক্ষার স্টেইন আবিষ্কৃত হলে লাভেরানের আবিষ্কার যে সঠিক তা প্রমাণিত হয়। যে পাস্তুর ইন্সটিটিউট ল্যাভেরনের কাজকে স্বীকৃতি দেয়নি প্রথমে, তারাই তাঁকে প্রোটোজোয়া নিয়ে গবেষণার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ১৯০৭ সালে লাভেরান নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। এর পরের ধাপে কাজ করেন ক্যামেলিও গলগি নামের আরেক বিজ্ঞানী। ম্যালেরিয়ার পরজীবীর একাধিক প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের জ্বর (কোয়ার্টা‌ন/টার্শি‌য়ান) সৃষ্টি করে—এই ধারণাকে হাতেকলমে প্রতিষ্ঠিত করেন ইটালিয়ান নিউরোফিজিওলজিস্ট ক্যামেলিও গলগি। যিনি ১৯০৬ সালে নিউরোফিজিওলজির জন্যে নোবেল পেয়েছিলেন।

ড. রোনাল্ড রস, কলকাতা, পিজি হাসপাতাল: 

এরপরেও ম্যালেরিয়ার সঙ্গে ‘দূষিত বাতাস’, জলাভূমির সম্পর্কের হাজার বছরের ধাঁধাঁ অমীমাংসিত থেকে যায়। অর্থাৎ কিনা শত্রু চিনে গেছি আমরা কিন্তু শত্রুর গোপন অস্ত্রটি তখনও অজানা। এদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তখন ব্রিটিশ। ফ্রেঞ্চদের থেকেও বড় শক্তি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘সূর্য অস্ত যায় না’! বলা বাহুল্য, ভারতও তাঁদের দখলে। তথাপি সাদা চামড়ার মানুষগুলো এই উপমহাদেশের দুটো জিনিসকে বেজায় ভয় পেত। এক, বাংলার বাঘ এবং দুই, ম্যালেরিয়া। ব্রিটিশ প্রশাসনে তখন তোড়জোড়, কীভাবে দমন করা যায় ম্যালেরিয়াকে।

ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের চাকরির দৌলতে এদেশে আসা ডা. রোনাল্ড রস অন্য সব বিজ্ঞানীর মতো শুরুতে ডা. লাভেরানের আবিষ্কারে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু ডা. রসের গুরু স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনের (ট্রপিকাল মেডিসিনের জনক) সমসাময়িক একটি আবিষ্কার রোনাল্ড রসকে ম্যালেরিয়া নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনই প্রথম জানান, যে জীবাণু এলিফেন্টিয়াসিস বা গোদ রোগের কারণ সেটা মশার শরীরেও থাকে। রস, স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনের কাজের সূত্র ধরে ডা. চার্লস লাভেরনের ধাঁধাঁ’র পথে হেঁটে ম্যালেরিয়া জীবাণু কীভাবে মানুষের শরীরে আসে তা নিয়ে গবেষণায় মগ্ন হন। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস তাঁকে মাদ্রাজ থেকে ম্যালেরিয়ামুক্ত অঞ্চলে বদলি করলে তিনি পদত্যাগ করতে চান। গবেষণার প্রতি এতটাই নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ডা. রস। অবশেষে সরকার তাঁকে এক বছরের জন্য ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বর ‘ইনভেস্টিগেশনে’ বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত করে।

এরপর সেই বহুশ্রুত ঘটনা, ১৮৯৭ সালে রোনাল্ড রস কলকাতার পিজি হাসপাতালে বসে আবিষ্কার করেন– ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু প্লাসমোডিয়াম কীভাবে মশার শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। রসই প্রথম নির্দিষ্ট করে বুঝেছিলেন যে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হল এক ধরনের পরজীবী, যার বৈজ্ঞানিক নাম প্লাসমোডিয়াম। পরে একটি অ্যানোফিলিস মশার পেটে প্লাসমোডিয়ামের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে রস বুঝতে পারেন যে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু প্লাসমোডিয়াম হলেও সেটা ছড়ায় অ্যানোফিলিস মশার মাধ্য‌মে। অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগীকে কামড়ালে রোগীর রক্তে মিশে থাকা প্লাসমোডিয়াম মশার শরীরে প্রবেশ করে। তা গ্যামেটোসাইটে পরিণত হয়ে মশার লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ করে। এই মশা এবার কোনও সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার শরীরে প্লাসমোডিয়াম গ্যামেটোসাইট ঢুকে তাকে ম্যালেরিয়া রোগাক্রান্ত করে। বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ হয় নিশ্চই এ কথা ভেবে, যে ড. রোলান্ড রস-এর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সূতিকাগার শহর কলকাতা। পিজি হাসপাতাল। ১৯০২ সালে মেডিসিনে নোবেল পান ড. রস।

সন্দেহ হয়, আদৌ কি আমরা এমন এক মানুষের, এত বড় আবিষ্কারের মর্ম উপলব্ধি করেছি! তাহলে কেন রসের গবেষণাগারটি ততোখানি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠল না আজও! কেন ময়দান অঞ্চলের প্রায় জনহীন একটি পথকে রোনাল্ড রস সরণি নাম দিয়ে দায় সারা হল! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যখন সুয়েজ খাল, পানামা খাল খননের প্রধান বাধা ছিল অসংখ্য শ্রমিকের ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু, তখন কর্তৃপক্ষ সেই মহামারি রোখার জন্য ডা. রোনাল্ড রসের শরণাপন্ন হয়। ১৯০৬ সালে মোট ২৬,০০০ শ্রমিক পানামা খাল খননে কর্মরত ছিলেন যাঁদের মধ্যে ২১,০০০ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রতি ১০০ জনে মৃত্যু হার ছিল ১১ জনেরও বেশি। পরবর্তীতে ড. রসের নজরদারিতে মশাবাহিত মারণ রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণের পর মৃত্যু হার কমে দাঁড়ায় ১ জন। এই প্রসঙ্গে আরও এক যুগ বদলে দেওয়া মানুষের কথা না বললে নয়। 

যুগান্তকারী ডিডিটি ও পল মুলার: 

তিনিও মশা তথা ম্যলেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে নোবেল পান, নাম- পল মুলার। চিকিৎসক না হয়েও ১৯৪৮ সালে মেডিসিনে নোবেল পেয়েছিলেন মুলার। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটির ব্যবহার যে কার্যকরী মুলার তা উদ্ভাবন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যে উদ্ভাবন হাজার হাজার যোদ্ধার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বলা হত, যত জন মার্কিন সেনা জাপানিদের হামলায় মারা গেছেন তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মারা যান মশাবাহিত রোগে। মার্কিন সেনার আস্ত একটি ইউনিট যুদ্ধের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মিত্রশক্তি যখন ইউরোপে জার্মানদের পরাজিত করে একের পর এক শহরের দখল নিচ্ছিল, তখন তারা আবিষ্কার করে, কোটি কোটি শরণার্থী, যুদ্ধবন্দি, দাস, সাধারণ মানুষ সবাই পোকা মাকড়বাহিত রোগে জর্জরিত। জার্মান গ্যাস চেম্বার যত মানুষকে হত্যা করতে পারেনি, তার চেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ আসন্ন ছিল। মিত্রশক্তির সৈন্যবাহিনী এরপর সারা ইউরোপ জুড়ে ডিডিটি স্প্রে করে। ইতিহাসে এর আগে কখনও একটা মাত্র রাসায়নিক পদার্থ কোটি (আনুমানিক ৫০০ মিলিয়ন) মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি। এর থেকে আরেকটা বিষয়ও স্পষ্ট, ছোট সাইজের প্রাণীটি কালে কালে নিজের জন্য সম্ভ্রম আদায় করেছে।

রোমান সাম্রাজ্যের পতন ও পতঙ্গ:

জেনে রাখুন, খ্রিষ্টের জন্মের ২ হাজার ৭০০ বছর আগে চিনের মানুষরা মশাকে হাড়ে হাড়ে চিনত। আগেই বলা হয়েছে, যে গ্রীক বীরেরা বার বার পরাজিত হয়েছে এই ‘দানবে’র কাছে। শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণও ছিল মশা। মিশরীয় প্যাপিরাসে, সুমেরীয় কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে, হিপোক্রেটিসের চিকিৎসা শাস্ত্রে, সংস্কৃত সুশ্রুত-এ, শেক্সপিয়ারের অন্তত ৮টি নাটকে উচ্চারিত হয়েছে মশাবাহিত নাম না জানা একাধিক রোগের কথা। এমনকী বঙ্গ সাহিত্যও মশাকে উপেক্ষা করতে পারেন।

বাংলা সাহিত্যে মশা, ‘মশামঙ্গল কাব্য’:

সংবাদ প্রভাকরের জনক কাঁচরাপাড়ার কবি ঈশ্বর গুপ্ত কবেই লিখেছিলেন, ‘রাতে মশা দিনে মাছি,/ এই নিয়ে কলকেতায় আছি’। তাছাড়া মশা না থাকলে শরৎ চাটুজ্যের অমর কীর্তি ‘শ্রীকান্ত’ লেখা হত কিনা সন্দেহ। মশার কামড় সহ্য করতে না পেরেই তো শ্রীকান্তকে সন্ন্যাসগিরিতে ইস্তফা দিয়ে সংসারজীবনে ফিরতে হল! নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদাতেও মশা আছে— বর্ধমানের মশা, চড়ুই পাখির মতো সাইজ। এমনকী মনসামঙ্গল কাব্যে মশা উপস্থিত কালকেতু আর ফুল্লরার সাংসারিক ব্যাক্যালাপে। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী ‘আলপনা’। সেখানিই ‘মশা’ গল্পে ঘনাদার সঙ্গে বাঙালির পরিচয়। সম্প্রতি নয়ের দশকের কবি অনির্বাণ দাস মশা নিয়ে লিখে ফেলেছেন আস্ত কাব্যগ্রন্থ- ‘মশামঙ্গল কাব্য’। 

কেন লেখা হবে না! গত বছরেও পৃথিবীব্যাপী শুধু ম্যালেরিয়াতেই মারা গেছেন ৬ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষ। তাছাড়া ৭০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে ৩২০ কোটি মানুষ যখন মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিতে, তখন পুঁচকে মশাকে বিরাট গুরুত্ব না দিয়ে উপায় কী বলুন! অপরপক্ষে, এ দুনিয়ায় ওরা আছে বলে কত মানুষের পেট চলছে! তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।

মশার কামড় আছে বলে যারা বেঁচে আছে:

টিভি চ্যানেলগুলোয় কোম্পানির পর কোম্পানি কত যে মশা প্রতিরোধক বন্দোবস্তের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে! কেউ ধূপ বেচে, তো কেউ ইলেক্ট্রিক লিকুইড, কারও স্প্রে আছে, তো কারও হাতে পায়ে মাখার মলমের ব্যবসা। ট্রেনে বাসে বাজারে এক ধরনের ব্যাটও মেলে। তাতে ফটাস ফটাস মশা মরে। তবে মশারির উপরে জাস্ট কোনও কথা হবে না!

আমার ধারণা ঘরের মধ্যে ঘর— আপাতভাবে অতি সাধারণ মশারিই মানব সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। যা প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানে মানব সভ্যতা বিরোধী ওই প্রাণীকুলের গেরিলা বাহিনীর বিষাক্ত হুল তথা ‘ভয়ঙ্কর’ ভন-ভন থেকে আরও কয়েক হাজার বছর হেলায় বাঁচিয়ে রাখবে মানুষ জাতটাকে।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb path_protikriya

কেতাবি কথা

কে তা বি  ক থা

সো না লী   ঘো ষ

sonali

চারটি ছোট পত্রিকার পাঠপ্রতিক্রিয়া

খোয়াই

সম্পাদক । অভিজিৎ দাশগুপ্ত

বনহুগলী, কোলকাতা

 

বনহুগলী থেকে প্রকাশিত ‘খোয়াই’ এই সময়ের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যপত্র। কবি, প্রবন্ধকার অভিজিৎ দাশগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদনা করে চলেছেন পত্রিকাটি। সাধারণ সংখ্যার পাশাপাশি ইতিমধ্যে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা। প্রতিটি সংখ্যাই তাঁর সম্পাদনার মুন্সিয়ানায় আদায় করে নিয়েছে নিবিষ্ট পাঠককুলের কুর্নিশ। গুণীজনদের পাশাপাশি ত‍রুণ লেখকদের উপস্থিতি এই পত্রিকার অন্যতম বৈশিষ্ট। আলোচ্য সংখ্যাটিতে আছে একাধিক কবির একাধিক কবিতা। আছেন গোলাম রসুল, স্বপন শর্মা, রাহুল ঘোষ, সঞ্চিতা ঘোষ, শমিত মন্ডল, বিশ্বজিৎ প্রমুখ। আছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আলোচনা। প্রচ্ছদ করেছেন অঙ্গিরা দাশগুপ্ত।

যাচ্ছেতাই

সম্পাদক । শুভদীপ দে

চুঁচুড়া, হুগলি

 

হুগলির চুঁচুড়া শহরের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। সেই শুরু থেকে দশ বছর ধরে পত্রিকাটি স্বমহিমায় মহিমান্বিত।  ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি আয়তনে তন্বী হলেও অসংখ্য নবীন এবং প্রবীন কবিদেরও চারণ ক্ষেত্র। পত্রিকার সর্বত্র সম্পাদক শুভদীপ দে-র যত্ন ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি নিজেও একজন কবি। সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে ‘বিজয়া ১৪২৯’-এ। এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ ছিল হরিৎ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়-এর কলমে কবি শংকর দাশ-এর স্মৃতিচারণ। এই সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন কবি জগদীশ শর্মা, সাধন বারিক, ঋজু ভৌমিক, শীর্ষেন্দু দত্ত, রক্তিম ভাত্যাচারিয়া প্রমুখ। সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন পৌলমী রায়চৌধুরী।

নিরন্তর

সম্পাদক । গৌতম বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

কল‍্যাণী, নদীয়া

 

‘কাল থেকে কালাতীতের যাত্রালিপি সাহিত‍্য শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক চতুর্মাসিক’— এই ভাবনা নিয়ে ২০১২ থেকে পথ চলা শুরু কল‍্যাণী শহরের অন‍্যতম গুরুত্ব এই পত্রিকাটির। প্রতিটি সংখ‍্যায় একটি মূলভাবনা থাকে। সমাজ-সাহিত‍্য-শিক্ষা থেকে শুরু করে রাজনীতি অবধি অবলীলায় বিচরণ পত্রিকাটির। প্রথম সংখ্যায় ভাবনা ছিল ‘বাংলা আমার ভাষা’ আবার পরের সংখ‍্যায় ভাবনা ‘শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ‍্য’। এমন ভাবনা-চিন্তায় সেজে উঠে এখনো অবধি প্রকাশিত হয়েছে ২৩টি সংখ‍্যা। প্রতিটি সংখ‍্যা যে পাঠককে ঋদ্ধ করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়াও থাকে নিয়মিত বিভাগ কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সমসাময়িক সমস‍্যা নিয়ে আলোচনা ও গ্ৰন্থ আলোচনা। সর্বশেষ সংখ‍্যার বিষয় ‘ভারতদ্রষ্টা আম্বেদকর’। বিষয় বৈচিত্রে সত্যিই পত্রিকাটি আন্তরিক প্রশংসার দাবি রাখে। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা অরিন্দম দে।

এখন তমোহা

সম্পাদক । সুরজিৎ সেনগুপ্ত

রিষড়া, হুগলি

 

‘এখন তমোহা’-র সর্বশেষ সংখ্যাটি শারদ সংখ‍্যা। সাত বছর ধরে এখনো অবধি বারোটি সংখ‍্যা করেছেন সম্পাদক ও প্রকাশক সুরজিৎ সেনগুপ্ত। রিষড়া, হুগলি থেকে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি ছিমছাম হলেও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রবীণ ও নবীন কবি-লেখকদের মেলবন্ধন পত্রিকাটিকে অন্য মাত্রা দেয়। সর্বশেষ সংখ্যায় আছে বেশ কিছু প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা। লিখেছেন সদ‍্য প্রয়াত কবি প্রণব বসুরায়, গোলাম রসুল, রত্নদীপা দে ঘোষ, দেবাশিস চন্দ, চন্দন রায়, অরুপ রতন হালদার, দেবাশিস ঘোষ, বর্ণময় বাড়ৈ, তমোঘ্ন মুখোপাধ‍্যায় প্রমুখ। আমাদের আশা পত্রিকাটি সকলের প্রিয় হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

ক্যানভাস

ক্যা ন ভা স

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

suvo

সত্তার আবির্ভাব ও আবরণ

তেইশ বছর আগের এক সকাল। সর্বরী রায় চৌধুরীর বাড়িতে আছি বিশেষ একটি কাজের সূত্রে, সর্বরী রায় চৌধুরী তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে মাটি দিয়ে একটি মূর্তি গড়ছেন তখন ।

মগ্ন এক শিল্পীর সত্তার সেই নিবিড় নির্জনতায় কোথাও একটা ভাষা গড়ে উঠছে, যে ভাষায় ওই মূর্তিটি হয়ে উঠছে । এই যে হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ এলো তা ওই মুর্তিটির হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী সত্তার যে উত্তরণ তাও তো ওই হয়ে ওঠাই একরকম, আর এ কারণেই হয়ত মাঝে মাঝে তাঁর শিল্পী সত্তার কোথাও একটা প্রবাহ আমাদের স্পর্শ করছিল।

কেননা আমরা ওই ভিন্নতা শুধু যে একজন শিল্পীর প্রবাহ হিসেবে স্পর্শ করছি তাই তো নয় বরং আমাদের চেতনায় সেই সত্তার একটা ছাপ পড়ছে ক্রমাগত ওই সময়ের, আর তার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন সত্তার প্রকাশ ‘রামদা বলতেন খেলা, নিজেকে নিয়ে একটা খেলা, বুঝলে ?” হঠাৎ যেন সেই মগ্নতা ভেঙে গেল, মূর্তিটির আশেপাশে সেই খেলার চিহ্ন যেন মুছে গেল, আর তাঁর চোখে মুখে একটা দ্বন্দ্বের আভা ছড়িয়ে পড়ল সেই মুহুর্তে। যেন কোথাও একটা গান হঠাৎ থেমে গেল।

এই যে সৃষ্টির মুহূর্ত আর তার মাঝখানে একটা সত্তার আবির্ভাব সে কি শিল্পের সত্তার আবির্ভাব নাকি তা একজন শিল্পীর সেই অভিজ্ঞতা যা সময়ের একটা ক্ষতও বলা যায়? ‘আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, সেই জন্য কাউকে আমার কাজ দেখাতে চাইছি না… এখন’ বলার পরই মনের গোড়ায় এসে গেল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিল্পবোধ, ‘আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন কবি, তিনি আমাদের সবাইকে পথ দেখিয়েছেন। বিনোদ দা বা কিঙ্করদা অনেক বড়োমাপের শিল্পী। আমি চেয়েছি গান যদি দেখতে পাওয়া যায় আমার কাজের ভিতর দিয়ে, একটা নির্জনতা যদি আমাকে জাগিয়ে রাখে, এই আর কি,  এই যে নির্জন ভাষার কথা বলা হচ্ছে সেটা কেমন তাহলে? আসলে কি ভাষাটা ওই সময়ের মধ্যেই হয়ে উঠছে এটা এই মুর্তিটির একটা নিজস্ব ভাষা বলতে পারো।’ বলার পর সর্বরী রায়চৌধুরী আবার হারিয়ে গেলেন, হারিয়ে গেলেন এই অর্থে যে সৃষ্টির মুহূর্তের সঙ্গে তাঁর আবার সংযোগ স্থাপন হলো তখন কিন্তু বাইরের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিন্ন হয়েছে।

এটাই একধরনের একজন শিল্পীর কাছে নিজের ভেতরে প্রবেশ করার একটা উপায় বলা যায়। কিন্তু এইরকম বলার অর্থ যে শিল্পী এই যে নিজের দুর্গমে প্রবেশ করছেন এর মাধ্যম হচ্ছে ওই শিল্প, আর এই আত্ম অন্বেষণ কখন উপলব্ধি হয় আমাদের ? একটু থেমে থেমে বললেন ‘আমি নিজের কাজ করতে চেয়েছি কেমন করে বলত ? আমার ভেতরে যখন… কখনও কখনও একটা আর্তনাদ হয়, ঠিক বুঝতে পারি না তবে এটা যে আমারই আর্তনাদ তা নাও হতে পারে, তখন মনে হয় একটা কিছু করি আমি ঠিক বোঝাতে পারলাম? অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইলেন যে সামগ্রিক সত্তার একটা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি আছে যেখানে একজন শিল্পী তিনি তার অংশ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সব শিল্পীর মধ্যে যে একটা সামগ্রিক ভাব আছে সেইটা আমাদের চেতনায় ধরা থাকে আর তা থাকে বলেই আমরা সেইসব শিল্পকর্মকে স্পর্শ করি নিজের জীবনবোধের আধারে।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

রূপ কথা

রূ প  ক থা

অ নু ক্তা   ঘো ষা ল

মডেল ও কবি

anukta

ট্রেন্ডি আই মেকআপেই লুক হিট

মেকআপের অন্যতম প্রধান অংশ হল আই মেকআপ।সুন্দর ও আকর্ষণীয় আই মেকআপ চোখের সৌন্দর্যকে করে তোলে দ্বিগুণ । ক্লিওপেট্রার সাজে এলিজাবেথ টেইলরের চোখের সাজ তো নিঃসন্দেহে মন কেড়েছে সকলের । চোখের পাতার বাইরেও টেনে আইলাইনার লাগানোর চলকে আরও জনপ্রিয় করেন অড্রে হেপবার্ন। থিমভিত্তিক সাজে এ স্টাইল খুবই জনপ্রিয়তা পায় তখন। আবার বর্তমানে রোজকার জীবনে ন্যাচেরাল আই মেকআপ এর ডিমান্ড ও বেশি । একটা সুন্দর আই মেকআপ যেন পুরো লুকটাকেই চেঞ্জ করে দিতে পারে মুহূর্তের মধ্যে।আর মেকআপ লাভার-দের কিন্তু নিজেদের লুকে তারতম্য আনতে বিভিন্ন আই মেকআপ স্টাইল সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। একঘেয়ে হেভি মেক আপ লুক বার বার করার থেকে ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল ট্রাই করলে, লুকে যেমন ভিন্নতা আসে তেমনি, ট্রেন্ডি-ও লাগে। আসলে, চোখের সাজ সুন্দর এবং পারফেক্ট-ভাবে করতে পারাটাই হচ্ছে মেইন চ্যালেঞ্জ।

আর আজ তাই বিউটিশিয়ান নিবেদিতা সরকারের ( লাবণ্য বিউটি ক্লিনিকের কর্ণধার) কাছ থেকে আমরা জেনে নেব বিভিন্ন ধরনের আই মেকআপ করার সহজ পদ্ধতি।

১. ন্যাচরাল আই মেকআপ

এই ধরনের আই মেকআপ এভরিডে বেসিস-এ করা হয়। যেমন- অফিস, কলেজ, ইউনিভারসিটি ইত্যাদিতে রেগ্যুলার বেসিসে চটজলদি এই আই মেকআপ করা যায়। নিউট্রাল বা ন্যাচারাল ধরনের আই মেকআপ করলে ১-২ টি আইশ্যাডো-এর প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আজকাল বিভিন্ন পার্টিতে অনেকেই ন্যাচেরাল আই মেকআপ করে অনায়াসে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সকলকে। এই ধরনের আই মেকআপের একটা মজা হল দেখে মনে হয় প্রায় নো মেকআপ কিন্তু এর উপস্থিতি যেকোনো লুককে করে তোলে ইউনিক ও আকর্ষণীয়।
প্রথমে একটি ফ্লাফি ব্লেন্ডিং ব্রাশের সাহায্যে পিচ, ব্রাউন, ডার্ক ব্রাউন, মভ ইত্যাদি কালার ক্রিজ-এ ব্লেন্ড করে নিতে হয়। অথবা কালার-টি পুরো আইলিড-এও লাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। চাইলে ক্রিজ-এর কালার-টি লোয়ার ল্যাশ লাইন-এও স্মাজ করে নেওয়া যেতে পারে এবং তারপর আইব্রো বোন, ইনার কর্নার হাইলাইট করতে হয়। এরপর লাইনার আর মাশকারা লাগিয়ে নিলেই আপনার লুক কমপ্লিট।

২. স্মোকি আই মেকআপ

স্মোকি আই মেকআপ-এর কথা অনেকেই শুনে থাকবেন। স্মোকি আই দিন এবং রাতের বেলায় অর্থাৎ যে কোন সময় করা যায়। যেকোনো পার্টিতে দারুন মানিয়ে যায় এই আই মেকআপ। তবে, এই আই মেকআপ-এর মূল শর্ত হচ্ছে ব্লেন্ডিং। যত বেশি আইশ্যাডো ব্লেন্ড করবেন, আপনার আই লুক তত সুন্দরভাবে ফুটে উঠবে। প্রথমে প্রাইমার দিয়ে আই লিড প্রিপেয়ার করে নিয়ে আই লিডের নিচের অংশে ডার্ক কালারের একটা আইশ্যাডো বেইজ লাগিয়ে নিতে হবে। এটা ডার্ক কোনো কাজল বা জেল লাইনারও হতে পারে।।এরপর এটি ভালোভাবে স্মাজ করে নিতে হবে। এর উপর পছন্দ মত ডার্ক কালার লাগিয়ে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। এরপর ডার্ক কালার -টির লাইন উপর দিকে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে তার থেকে লাইট একটি কালার লাগিয়ে ব্লেন্ড করতে হবে। এভাবে ২-৪টি কালার লাগিয়ে ব্লেন্ড করে ক্রিজ পর্যন্ত চলে যেতে হবে। মূলত এটি ডার্ক থেকে লাইট কালারের দিকে যাবে। লোয়ার ল্যাশ লাইনেও সেইমতো কাজ করতে হবে এবং ভালোভাবে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। চাইলে আইলিড-এ শিমারি কালার-ও লাগানো যেতে পারে । এরপর লাইনার, মাশকারা এবং আইল্যাশ লাগিয়ে নিলেই হয়ে যাবে পারফেক্ট স্মোকিং আইজ।

৩. গ্লিটারি আই মেকআপ

খুব গর্জিয়াস ও গ্ল্যামারাস লুক যারা পছন্দ করেন, তাদের জন্য গ্লিটারি আই মেকআপ পারফেক্ট। রাতের বেলা যে কোনো পার্টির জন্যই এটি মানানসই। কিন্তু দিনের বেলায় গ্লিটারি আই মেকআপ না করাই ভালো।প্রথমে নরমাল আই মেকআপ এর মতই সব কিছু করে নিতে হবে। যেমন- ট্রানজিশন কালার, ক্রিজ ডিফাইন, লিড-এ আইশ্যাডো, ব্রো বোন এবং ইনার কর্নার হাইলাইট ইত্যাদি। আইলিড-এর যে অংশে আপনি গ্লিটার লাগাতে চান সেখানে গ্লিটার গ্লু লাগিয়ে এর উপর লুজ গ্লিটার লাগিয়ে নিতে পারেন। অথবা, গ্লিটার লাইনার নিয়ে যে অংশে গ্লিটার লাগাতে চান, সে অংশে লাগিয়ে নিতে পারেন। ক্রিজের উপর চিকন করে ক্রিজ লাইন টেনে গ্লিটার লাইনার লাগানোটা এখনকার মোস্ট পপুলার ট্রেন্ড। দেখতে বেশ ভালো লাগবে।

৪. হ্যালো আই মেকআপ

যাদের চোখ ছোট তারা এই আই মেকআপ-টি ট্রাই করতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন পার্টিতে এই আই লুকটি বেশ মানানসই।প্রথমে আইলিড প্রিপেয়ার করে, ক্রিজের একটু উপরে ট্রানজিশন কালার লাগিয়ে নিতে হবে। এরপর ক্রিজ-টা ডিফাইন করে নিয়ে একটা ডার্ক কালার নিয়ে পুরো আইলিড-এই লাগাতে হবেশুধুমাত্র আইলিডের মাঝের অংশটুকু বাদ দিয়ে। এরপর কালার-টা ব্লেন্ড করে নিতে হবে। এরপর মাঝখানের খালি অংশে শিমারি, গ্লিটারি, মেটালিক আইশ্যাডো লাগিয়ে ডার্ক কালার-টির সাথে ব্লেন্ড করে নিতে হবে মাঝের কালার-টা লাইট হলে বেশ ভালো ফুটবে।

৭. স্পটলাইট আই মেকআপ

বিভিন্ন ধরনের আই মেকআপের মধ্যে স্পটলাইট আই মেকআপ বেশ জনপ্রিয়। পারফেক্ট-ভাবে করতে পারলে আপনি এর প্রশংসা পাবেনই। তবে, এটা করা একটু ট্রিকি। হ্যালো আই মেকআপ-এর মতই প্রথমটুকু করে নিতে হবে। আইলিড-এর মাঝখান বাদে পুরো আইলিড-এ ডার্ক একটা ম্যাট কালার লাগিয়ে নিতে হবে। এরপর একটা পাতলা ব্রাশ-এ কনসিলার লাগিয়ে ক্রিজের মাঝের অংশে ক্রিজ-টাকে ফলো করেই ইউ শেইপ এঁকে নিতে হবে এবং কনসিলার-টা নিচের দিকে নিয়ে এসে ব্লেন্ড করতে হবে। কনসিলার-টা সাবধানে পাউডার দিয়ে সেট করে নিতে হবে। এবার একটা লাইট শিমারি কালার যেমন- গোল্ডেন, শ্যাম্পেইন, রোজ গোল্ড, কোরাল ইত্যাদি কালার নিয়ে কনসিলার যেখানে লাগানো হয়েছে, ঠিক সেই খানে সাবধানে লাগিয়ে নিতে হবে। এবার, ডার্ক কালার এবং শিমারি কালার-এর দুই পাশের গ্যাপে দুই কালার-এর মাঝামাঝি ধরনের একটা কালার নিয়ে ব্লেন্ড করে নিতে হবে।এই কালার-গুলো ব্লেন্ড করার কারনে আই মেকআপ-এ একটা স্পটলাইট এফেক্ট আসবে। চাইলে ক্রিজের লাইনের উপর গ্লিটার লাইনার লাগানো যেতে পারে।

মেকআপ- বিউটিশিয়ান নিবেদিতা সরকার ( লাবণ্য বিউটি ক্লিনিকের কর্ণধার)
ফোটোগ্রাফি- দীপা বর্মন
মডেল- অনুক্তা ঘোষাল, সৃজা বিশ্বাস

নিবেদিতা সরকার :

বিউটিশিয়ান ও ‘লাবণ্য বিউটি ক্লিনিকে’র কর্ণধার

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

খেলাইডোস্কোপ

খে লা ই ডো স্কো প

শু চি স্মি তা  সে ন  চৌ ধু রী

shuchismita

ওরাওঁ সম্প্রদায়ের মানুষদের খেলা

খেলা খেলা দিয়ে শুরু…

জীবনের শুরু হয় খেলা দিয়ে এবং বিভিন্ন পর্যায় বিভিন্ন রকম খেলা নির্দেশ করে জীবনচক্রের পরিবৃত্তি। ছোটবেলা থেকে শুনেছি মেয়েদের খেলা, ছেলেদের খেলা বা ছোটদের খেলা, বড়দের খেলা ইত্যাদি। খেলা সব সময় আনন্দ দায়ক। গবেষণা বলছে, খেলা তিন রকমের— সুযোগ নির্ভর, কৌশলগত আর জীবনধারা

কেন্দ্রিক। অঞ্চল ভিত্তিক বা বিশেষ কোনো জনজাতির বিশেষ খেলা থাকতে পারে। সেরকমই কয়েকটি খেলার কথা বলি।

পশ্চিমবঙ্গে ওরাওঁ জনজাতির মানুষ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জেলায়। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের এক আদিম জনগোষ্ঠী ওরাওঁ। কুরুক এদের ভাষা। কুরুক শব্দের অর্থ ‘বক্তা’, যে চিৎকার করে তার বক্তব্য রাখে। ওরাওঁ শব্দের অর্থ ‘যারা ঘুরে বেড়ায়’। এই নামের কারণ তারা একসময় জঙ্গল নির্ভর ছিল এবং এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়াত খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ আমলে ওরাওঁরা বাংলায় এসেছিলো শ্রমিক হিসেবে। একদল চা শ্রমিক হিসেবে স্থায়ী বসবাস শুরু করে উত্তরবঙ্গে আর একদল সুন্দরবনে। কঠোর পরিশ্রমী ওরাওঁদের কাজ ছিল জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ যোগ্য জমি তৈরি করা। ধীরে ধীরে এরা হয়ে ওঠে কৃষিজীবী।

আলিপুরদুয়ার জেলার ফরেস্ট বস্তিতে বসবাসকারী ওরাওঁদের মধ্যে দেখা যায় ‘বিট্টি খেলা’। বিট্টি খেলায় অংশ গ্রহণ করে ১০ থেকে ১২ জন কিশোর। খেলা হয় দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে। উভয় পক্ষে থাকে ৫-৬ জন। এই খেলার জন্য প্রয়োজন ৩/৪ ফুট লম্বা একটি শক্ত নীম ডাল বা অন্য কোনো গাছের ডাল, একটি কাঠের টুকরো যার এক প্রান্ত সুচালো এবং আরো একটি ছোট কাঠ। এক দলের খেলোয়াড় নীম ডাল এর সাথে আটকানো সুচাগ্র কাঠের টুকরোটি দিয়ে ছোট কাঠের টুকরোটিকে সজোরে আঘাত করবে। প্রতিপক্ষের কেউ যদি সেই টুকরোটি ধরতে পারে তাহলে সে আউট বা পয়েন্ট প্রতিপক্ষের। এই খেলাটিকে সুযোগ নির্ভর।

এই সম্প্রদায়ের আর একটি খেলার নাম ‘আলু খেলা’। এটি বিশেষতঃ মেয়েদের খেলা। দুই থেকে চার জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে এই খেলায়। মেয়েরা মাটিতে বসে তিনটি পাথর নিয়ে খেলে। এই পাথর তিনটি আসলে তিনটি আলু রূপে কল্পনা করা হয়। চার জন অংশগ্রহণ করলে, তিনজন পাথর গুলো লুকিয়ে রাখে আর একজন সেই পাথর গুলো খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। খুঁজে পেলে সে খেলায় থাকে নাহলে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়। এই খেলাটিও সুযোগ নির্ভর। যদিও কৃষিজীবী ওরাওঁ দের জীবনে সবজির ব্যবহার আশ্চর্য নয়।

সুন্দরবনের বাসন্তী অঞ্চলের ওরাওঁ সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত ‘গোজি খেলা’। এ ক্ষেত্রেও দুটো দলে অংশ গ্রহণ করতে পারে ১০-১২ জন। প্রথমে উঠোনে একটি বড় চৌকো খোপ কাটা হয়, যা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মোটামুটি ২৫ মিটার। এর মাঝে আরো চারটি খোপ কাটা হয় এবং বাইরে থাকে ২ মিটারের পথ। বড় চৌকোর মাঝখানে আরো একটি চৌকো কাটা হয় এবং সেখানে তৈরি করা হয় ছোট একটি বালি বা মাটির স্তূপ। এই স্তূপটি আসলে লবণ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। বড় চৌকোর বাইরে উত্তর দিকে একটি খোপ কেটে তৈরি হয় গুদাম ঘর। শুরু হয় খেলা। নির্বাচিত হয় একজন পাহারাদার। তার কাজ লবণ অর্থাৎ সেই বালি বা মাটির স্তূপ রক্ষা করা। বিপক্ষের একজন সেই লবণ চুরির উদ্দেশ্যে বাইরের পথ ধরে দৌড়োতে শুরু করে আর একজনের হাত ধরে। যারা লবন রক্ষা করছে তারা চেষ্টা করে যাতে প্রতিপক্ষ ভেতরে না ঢুকতে পারে। ভেতরে ঢুকলেই মৃত্যু। যদি কেউ সফল হয় লবণ চুরি করতে তাহলে তাকে গুদাম পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। সম্ভব হলে সেই দলের জয়। এভাবেই খেলা চলতে থাকে। এই খেলা মূলত কৌশল ভিত্তিক। কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যায় এর সঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলের জীবনধারাও যুক্ত। লবণ মানুষের জীবনে একটি অপরিহার্য বস্তু। সুন্দরবনের জলে লবণের পরিমান বেশি। সে কারণেই সেখানে বসবাসকারী মানুষ লবণ ব্যবহার করেছে খেলায়।

এভাবেই খেলা হয়ে ওঠে জীবনের অংশ। সহজ সরল আদিবাসীদের জীবনে এই খেলাগুলোই বিনোদনের একমাত্র উপায়।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

উদাসীন তাঁতঘর | পর্ব ১৪

ধা রা বা হি ক পর্ব ১৪

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

ছোটো প্রকাশনী সম্পর্কে যে দু- একটি কথা আমি জানি না

এই তো কিছুদিন আগে,করোনা- পূর্ববর্তী সময়ে ভাবছিলাম ছোটো প্রকাশনীর ঐশ্বর্য আর সুদিনের কথা। খুশি হয়েছিলাম এই দেখে বাংলা প্রকাশনার মনোপলি ভাঙছে। প্রযুক্তি এসে বদলে দিচ্ছে পুঁজির অলৌকিক সম্ভাবনা। ছোটো পত্রিকা আর প্রকাশনী হয়ে উঠছে আরও প্রতিস্পর্ধী। ছোটো পত্রিকার সুদিন এসেছে অন্তত পনের বছর আগে। কিন্তু ছোটো প্রকাশনীর বানিজ্যসাফল্য তেমন ছিল না। কিন্তু অবস্থা বদলালো। ছোটো পত্রিকা আর ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ সংখ্যা করতে রাজি নয়। অনেকেই বুঝলেন নামমাত্র একটি পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশনী খুললে নিরাপত্তা আরও বেশি। নব্বইয়ে জয় গোস্বামীর মতো কবি এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার অলীক স্বপ্নের পর এখন বাংলার নাবালক তরুণেরা প্রকাশক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আপত্তি কিছু নেই। পাঠকের ছদ্মবেশে অনেক ক্রেতার নীরব অনুমোদন তো আছেই! আর লেখকের তেমন অভাব কোনোদিনই ছিল না। আর তাই কলেজস্ট্রিটের আশেপাশে গজিয়ে উঠল প্রকাশনা দপ্তর কাম হরেক বইবিক্রির আউটলেট। কয়েকটি আউটলেট জনপ্রিয় হল। তারা ছোটো প্রকাশনীর বইকে গুরুত্ব দিয়ে প্রমোট করছেন দেখে আনন্দের সীমা নেই। অনেকেই হয়ে উঠলেন আমাদের সত্যিকারের আশ্রয়। মুহুর্তে ভেবে নেওয়া গেল দূর্দিন আর নেই। সোনার ডিম নিছক অপেক্ষামাত্র। করোনা আর আমফান আমাদের কাবু করতে পারেনি। শুধু দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দিলাম প্রযুক্তির ঘাড়ে। কত সহজেই ছোটো প্রকাশনীর প্রকাশক কাম একদা প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবি বা লেখক বুঝে গেলেন’ কঠোর বিকল্পের কোনো পরিশ্রম নেই।’

প্রথম এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল বিস্মৃত লেখকের লেখা এবং আত্মীয়স্বজনেরের খোঁজ। ঝোপ বুঝে কোপ মারার নৈতিক দায়বদ্ধতা। প্রয়োজনে একের কাজ ভাঙিয়ে নিজের দিকে টেনে আনা। আজ বিস্মৃত কবির চারপাশে শকুনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছেন ছোটো প্রকাশনীর সব কর্ণধার। মানবিক দায়বদ্ধতার ছলনায় কার আগে প্রাণ কে করিবে দান তাই নিয়ে গোপন ছুরি প্রস্তুত। এদিকে বিস্মৃত কবির অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ভেবে বসে আছে বাবা বুঝি সোনার খনি রেখে গেছে। তাই সর্বস্ব সমর্পণের আগে সে ও লাভ ক্ষতির হিসেব বুঝে নিতে চায়। কথার খেলাপ করে। আরও সুবিধাজনক সম্ভাবনাগুলি গোপনে খতিয়ে দেখতে চায়। প্রোমোটার আর দালালের আঁতাত পেরোতে পেরোতে দিন যায়, কেবলই চলে যায় অহেতুক বইমেলার দিকে। ‘কেউ কথা রাখেনি’ হয়ে ওঠে তার স্বধর্ম।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে বেশিরভাগ ছোটো প্রকাশনীর সাফল্য আসলে এক প্রতারণার ইতিহাস। দায়বদ্ধতার সুযোগে আত্মপ্রতারণাও। তার যা কিছু বৈভব প্রেস মালিকের টাকা ফাঁকি দিয়ে। নৈতিক চরিত্র বদলের চেয়ে একের পর এক প্রেস বদলেই তার আগ্রহ বেশি। প্রচ্ছদশিল্পীর অর্থকে সে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। বরং সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার নামে বিনে পয়সার কাজে বন্ধুর পরিশ্রমকে বিনিয়োগ করে। লেখকের রয়্যালটি নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে সে রুচিহীনতা ভেবে এড়িয়ে যেতে চায়। অথচ বানিজ্যে তার ঘাটতি নেই। বিপণনে পিছিয়ে নেই। বিপজ্জনক ছাড় দিয়ে ভুল কাস্টমারকে বই বেচতে তার রুচিতে বাধে না। কিন্তু সুবিমল মিশ্রর মৃত্যু নিয়ে বইমেলার মাঠেই তার মায়াকান্না সগৌরবে বিরাজমান রাখতে এখনও তার বুক কাঁপে না। চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এমন নমুনা বিরল।
আজ ছোটো প্রকাশনীর সব প্রকাশকই জানেন বিস্মৃতির বানিজ্যমূল্য কিছু কম নয়। ‘নির্জন সাধক’ হাটে বেচার আরেকটি জনপ্রিয় পদ্ধতিমাত্র। বাকি রইলেন কয়েকজন কাব্যপ্রিয় সরকারি আমলা। তাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকাতি করে সে আর্থিক ভরাডুবি থেকে বাঁচতে চায়। টাকা, বিজ্ঞাপন ,অনুষ্ঠানের খরচ, সভার দায়ভার পেরিয়ে সরকারি আমলা তারপরও খোয়াব দেখেন আর গোপনে পরিচিত মানুষদের ঠিকানায় নতুন নতুন বই পাঠান সামান্য পাঠপ্রতিক্রিয়ার আশায়।বস্তুতপক্ষে ছোটো প্রকাশনীর বেশিরভাগ বই আসলে এক অলীক নিরুদ্দেশ যাত্রা। ঠাঁই নেই ঠাঁই নাই বলেও আত্মমুগ্ধ কবিকে রোধ করবে এমন মনোরোগের চিকিৎসা আজও সুলভ নয় বাংলা বাজারে।

ছোটো প্রকাশনীর সব চেয়ে বড় অপরাধ সে প্রফেশনাল নয়। উদ্যোগের চেয়ে উদাসীনতাকে সে আজও মহৎ স্বভাব মনে করে। আর তাই পাঠক প্রতারণা দিকে দিকে। পিওডিকে সে আর্থিক সুবিধা মনে করলে অসুবিধা ছিল না কিন্তু তাকে সে ব্যবহার করে নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চায়। প্রুফ রিডারের দায়বদ্ধতা এড়াতে চায়। লেখকের চোখে কত সংখ্যক বই মুদ্রিত এই তথ্য লুকোতে চায়। তাঁর সমস্ত ‘ প্রথম মুদ্রণ নিঃশেষিত ‘ আসলে পিওডির খেলা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দায়িত্ববোধের অভাব। সত্তরের একজন কবির ‘ সাক্ষাৎকার সংগ্রহ ‘ অনুষ্ঠানে প্রকাশের জন্য কয়েক কপি আনা হয়। কিছুদিন পর একই বই টীকাভাষ্যসমেত বাজারে আসে। পঞ্চাশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবির মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটি সুসম্পাদিত গ্রন্থ বেশ কিছু কপি বিক্রি হয়ে গেলে দ্বিতীয় মুদ্রণে একটি নতুন লেখাসমেত হাজির হয়। দুটি ক্ষেত্রেই প্রথম দিকের ক্রেতা যে প্রতারিত হলেন এই দুর্ভাবনা প্রকাশক মাথায় রাখেন নি। (কেউ কেউ অবশ্য ‘ বিফলে মূল্য ফেরত’ আশ্বাস দিয়েছেন)। তৃতীয় উদাহরণটি আরও বড় প্রতারণার দৃষ্টান্ত। কিছুদিন আগে একটি একটি ছোটো প্রকাশনী মনীন্দ্র গুপ্তর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন লেখকের টুকরো টুকরো গদ্য বইয়ের একটি সিরিজ করেন। প্রথম সিরিজে পাঁচটি বই ছিল। কিছুদিন পরে তাঁরা এই সিরিজে আরেকটি ছোটো বই যুক্ত করেন। যেহেতু সিরিজের পূর্ববর্তী বইগুলি আছে তাই নতুন একটি বই কিনতে গেলে প্রকাশনার তরফে জানানো হয় পুরো সিরিজ( অর্থাৎ ৬টি বই) আবার নিতে হবে। পৃথকভাবে বইটি পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পরবর্তীতে আবার একটা বই যুক্ত হলে পুনশ্চ প্রতারণা। এভাবেই চলছে। এভাবেই চলবে। ছোটো প্রকাশনীর মহান দুঃখটিকে প্রসারিত করে নিতে পারলেই আর কোনো ভাবনা নেই।

এটাই ছোটো প্রকাশনীর একমাত্র চরিত্র তেমন কিন্তু নয়। বরং ছোটো প্রকাশনা স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকখানি, এই সাফল্য আমাদেরও গর্বিত করে। অকারণ পুলকে আঁখি জলে ভাসে। নিজের জীবন দিয়ে ছোটো প্রকাশনী তার গুরুত্ব এবং সম্ভাবনার অনেকগুলি দিগন্ত খুলে দিয়েছে। আটের দশকের একজন অকালপ্রয়াত কবির সামান্য চটি বইটিকে আরও অনেক লেখা দিয়ে বিস্তৃত করতে একজন প্রকাশক প্রায় কুড়ি বছর তিল তিল শ্রমে তাকে সংগ্রহযোগ্য করে তুলেছেন। সস্তায় বাজার ধরতে নেমে পড়েননি। ষাটের একজন উল্লেখযোগ্য কবিকে নিয়ে একটি সংখ্যার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছেন একজন সম্পাদক। নির্বিচার সংকলনের অকালপ্রসবের পথে হাঁটেনি। একটি জীবনীমূলক উপন্যাসের জন্য একজন প্রকাশক অর্থ ব্যয় করে একজন সম্পাদক নিযুক্ত করেছেন। সমস্ত তথ্য লেখকের সঙ্গে পরামর্শ করে যাচাই করে নিয়ে তারপর প্রেসে পাঠিয়েছেন। নির্বিচার থ্রিলার ছাপার যুগে এই উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তগুলি ছোটো প্রকাশনীর ভেবে গর্ব হয় বৈকি! এই দায়িত্বগুলি ভুলে শুধুমাত্র মুনাফার জন্য যারা প্রকাশক সেজে বসে আছেন তাঁদের নিয়ে ভাবনা হয়। ভাবনা কিন্তু দুর্ভাবনা নয়। তাঁর কারণ সাহিত্য,অভিনয়, শিল্প, রাজনীতি সর্বত্রই ফড়ে ও দালাল আছে। তাঁরা দুদিন বই হাসবেন না। কিন্তু তাঁদের বিক্রির বাড়বাড়ন্ত দেখে একজন সৎ প্রকাশক যখন কেবলই হতাশ হন, নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস হারান তখন ভয় হয়। নিছক তাসের ঘর গড়তে আমরা কি এতটা পথ হাঁটলাম?

তাই আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া। মনে করিয়ে দেওয়া প্রকৃত সত্যটি – ‘কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।’ মনে করিয়ে দেওয়া, প্রযুক্তির দক্ষতা আছে কিন্তু প্রতিভা নেই। এই কথাটি সৃজিত মুখোপাধ্যায় না বুঝলেও আপনার অন্তত বোঝা উচিত। আপনার কাজের গভীরতা যদি গুগলকে নিরর্থক এবং অপ্রয়োজনীয় না করে দেয় তাহলে জমি বাড়ির দালালি আপনার আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বেশি উপযুক্ত একথা সহজে বুঝে নিলে মঙ্গল। প্রকাশনায় আসার আগে,সম্পাদনায় আসার আগে, এমনকি লিখতে আসার আগে কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পার্থক্য সেটুকু অন্তত বুঝে নিন। তারপর না হয় পথে নামুন। সুপবন বহিতেছে – সেই সুযোগে ঝাঁপ দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। তারপরও যদি এটাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র পথ তাহলে কলেজস্ট্রিটে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বইয়ের আউটলেট আবার সায়া ব্লাউজের দোকান হয়ে উঠতে বেশিদিন নেবে না।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

আবার রাণার কথা । পর্ব ১২

ধা রা বা হি ক । পর্ব ১২

রা ণা   রা য় চৌ ধু রী

আবার রাণার কথা

rana2

বৈশাখের দ্বিতীয় দিনে

বৈশাখের দ্বিতীয় দিনের সকাল কী সুন্দর! এখনো নির্জন চারিধার, পাখি ডাকছে, মৃদু রোদ, মৃদু ফেসবুক – মানুষ এখনো শান্ত হয়ে দুয়ারে জল দিচ্ছে, উঠোনে ঝাড়ু দিচ্ছে।এখনো কোনো তরুণ বিপ্লবের নামে অকারণ কাউকে ভাষা দিয়ে আক্রমণে নামেনি। ছোড়েনি অপমানের বোমা। সে হয়তো এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। নিষ্পাপ ঘুমোচ্ছে সে। ঘুম এক শুয়ে থাকা কবিতা।

আরেকটু বাদে ঢাকেশ্বরী মিষ্টান্ন ভান্ডারে গরম জিলিপি ও কচুরি ভাজা হবে। আমি মনে মনে কচুরির গন্ধ উপভোগ করি, কচুরির প্রতি লোভ ও লালসা জন্মায়।

আমাদের রাজীবপুরে সত্তর একাত্তর সালে বৈশাখের দুপুর ছিল গনগনে ও শান্ত। আমবাগানে পাখিরা বিশ্রাম নিত, পুকুরে হুস করে নেমে আসত পাখি নিজেকে শীতল করবে বলে, খর দুপুরে পোস্টাপিসের খগেনদা (ফর্সা) ফ্যাকাশে ছাতা মাথায় পায়ে হেঁটে মার স্কুলের মাইনে দিয়ে যেত, বাষট্টি টাকা। মা সই করে বাষট্টি টাকা নিত, সঙ্গে বৈশাখের দুপুরকেও নিত সই করে, একটা ছোট বৈশাখী আনন্দ আমাদের মনে খেলে বেড়াত, আমবাগানে শীতল গাছের নিচে তখন হয়তো বিশ্রাম নিতে এসেছে শান্ত চন্দ্রবোড়া।

চারিদিকে বৈশাখ আর বৈশাখ থৈ থৈ করছে। একটা শান্ত ও ভালোবাসার জেদ যেন বৈশাখের রোদে নিজেকে সুরে সুরে তাতিয়ে নিচ্ছে। পুকুরের জল গরম, ডুব দিলে নিচের জল ঠান্ডা। আমি আর সেই বালিকা আর তার ভাই ডুব সাঁতার দিয়ে দিয়ে বৈশাখ থেকে আষাঢ়ের দিকে যেতাম – রোদ থেকে বৃষ্টির দিকে।

এখন এই সকাল বড় শান্ত, বড় নির্মোহ, কোনো কুস্তি কোনো প্রতিযোগিতা নেই এখন।

সবাই বৈশাখ সাথে বেঁধে বেঁধে হাঁটছে, জল দিচ্ছে দুয়ারে, রুমি ফুল তুলছে ঠাকুরের…

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb goddyo

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি । পর্ব ৬

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৬

স ব্য সা চী   স র কা র

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি

sabyasachi

বই শুধু নয়, তোমাকেও চাই…

‘কারেজ! একটা ইংলিশ ওয়ার্ড। কারেজটাই আসল! তুই অত কেঁপে যাচ্ছিস কেন!’ বইমেলায় ঢুকে আমার কাঁধে একটা আলতো চাপড় দিয়ে বলল অরণ্য। তার পরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দ্যাখ তো, বেশ শান্তশিষ্ট, ল্যাজবিশিষ্ট দেখাচ্ছে কি না!’

সেদিনই কোত্থেকে একটা জিরো পাওয়ারের সস্তার চশমা যোগাড় করেছে অরণ্য। ওর সুনিশ্চিত ধারণা, ওই চশমা পরলে ও ‘নবীন কিশোর’ হয়ে যাবে, ওর জন্য অপেক্ষা করবে সুনীলদার কবিতার ‘ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ!’ আমি যদি বলি, ওকে চশমাটা মানাচ্ছে না, ও নিঘার্ত ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলবে, ‘তুই কবিতা-টবিতা লিখছিস ঠিক, কিন্তু হিউম্যান অ্যাপিয়ারেন্স নিয়ে কিসস্যু জানিস না!’

সে বহু যুগ আগের কথা। আটের দশকের শেষাশেষি বা নয়ের দশকের শুরু। তখন কলকাতা বইমেলা হতো পার্ক স্ট্রিটের পাশে ময়দানে। সবে কলেজে ঢুকে ডানা গজিয়েছে, ক্লাস কেটে টাইগার বা নিউ এম্পায়ারে লাইন দিই, পাড়ার দোকানে সিগারেট কিনে দড়িতে ঝোলানো আগুনে ধরিয়ে নিজেকে ব্যাড বয় মনে হয়। সদ্য প্রেমে পড়েছি। প্রেমিকার হাত ধরে নন্দনে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাই, বিভিন্ন কলেজ ফেস্টে নানারকম অ্যাডভেঞ্চারে থাকি, ‘আত্মপ্রকাশ’ বা ‘ঘুণপোকা’ সারা রাতে শেষ করে ফেলি, ডুবে থাকি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার আশ্চর্য রহস্যে। 

অরণ্যের জীবনে তখন তিনটে নেশা। নম্বর টেন ব্র্যান্ডের সিগারেট, বাংলা ও ইংরেজি বই এবং সুন্দরী মেয়ে। তা, সে সময় ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে এত আদেখলাপনা ছিল না, আমাদের মতো বাপে খ্যাদানো, মায়ে তাড়ানো বখাটেদের জন্য প্রেম দিবস বলতে ছিল সরস্বতী পুজো। সব মেয়েকেই সেদিন শ্রীদেবী বা মাধুরী দীক্ষিতের মতো মনে হতো। সেবার বইমেলার মাঝেই পড়েছে সরস্বতী পুজো, আর অরণ্য ঠিক করে ফেলেছে, ওর তখনকার লাবণ্য মানে তোর্সাকে সরস্বতী পুজোর সকালে তুলে দেবে তিনটে বই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’ ও ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব।’ তোর্সা কবিতা ভালোবাসে। 

এ বার অরণ্য ঠিক করলেই তো বই হাতে এসে যাচ্ছে না। সরস্বতী পুজোর দিন বিকেলে গড়িয়াহাটের দাশ কেবিনে তোর্সাকে নিয়ে যাওয়া আছে, সকালে অঞ্জলি দেওয়ার পরে একটা ক্যাডবেরি কিনে দেওয়া আছে, তার পরে নম্বর টেন কেনা, লেকের ধারে ঝালমুড়ি তো আছেই। তা এতসব করতে গেলে যে ট্যাঁকের জোর লাগে, তা ঠিক অরণ্যের বাজেট পারমিট করছে না। তা হলে? 

সেখানেই অরণ্য বাড়তি অ্যাডভেঞ্চারে বিশ্বাসী। বইমেলায় সে আজ নিজের সঙ্গে একটা খেলা খেলতে চায়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘বাপের সিগারেট, স্কুলের লাইব্রেরির বই, ক্লাসমেটের নোটস, আমার একটাই পলিসি বুঝলি। চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা! আমি আজ স্টল থেকে তিনটে বই তুলব!’

আমি স্তম্ভিত, ‘তার মানে?’

‘তুই নিশ্চয়ই বিখ্যাত ইংরেজি কোটটা জানিস— দেয়ার ইজ নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়্যার! আমাকে তিনটে বই তুলতেই হবে! বাপের হোটেলে থাকি, এমনিতেই পুজোর দিন খরচা আছে। তার উপরে তিনটে বইয়ের জন্য এত খরচা পোষাবে না!’

বইমেলায় বই চুরি করে ধরা পড়লে কী হয়, ততদিনে একটা ধারণা আছে। হয় গিল্ডের অফিসে বসে রচনা লিখতে হয়, না হলে স্টলের সামনে কান ধরে ওঠবোস। অজানা একটা আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরে। আমি এই দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে মোটেই অরণ্যের সঙ্গী হতে চাই না। ভয়ে বুক কাঁপছে। বললাম, ‘আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। তুই চেষ্টা করে যা। ধরা পড়লে আমি তোকে চিনি না। নিশ্চিন্তে কেটে যাব!’

 লালামোহনবাবু যেমন সোনার কেল্লায় ফেলুদার ‘সামনে বিপদ আছে’ শুনে বলেছিলেন, ‘ফিরে যাব?’ ঠিক তেমনই একটা গলায় অরণ্য বলে, ‘ধরা পড়ব? কী যে বলিস! তুই চলে যা, যা খুশি করিস। শুধু স্টলটায় আমার সঙ্গে ঢোক। তোকে কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু মন দিয়ে বই দেখবি। বাকি কাজ আমার! এইটুকু কর!’

‘তুই ধরা পড়লে আমি জাস্ট কেটে যাব। আমি তোকে চিনি না!’

অরণ্য অবিচলিত। ‘চিনতে হবে না। তোর মতো ভীরুদের জীবনেও কিছু হবে না। ওই দু’চার লাইন কবিতা লিখবি।’ তার পরে যথারীতি চার অক্ষরের গালাগাল।

আমি অবাক হই না। জানি, অরণ্য যখন ঠিক করেছে, বই তুলবে, ও তুলবেই। পৃথিবীর কোনও বিষয়ে ওর মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। তোর্সা বলে মেয়েটা কী করে ওকে ট্যাকল করে জানি না, কিন্তু ও সায়নী বা মধুপর্ণার সঙ্গে বিকেলে হাল্কা টাইম কাটিয়ে সন্ধেয় তোর্সার সঙ্গে দেখা করে অম্লানবদনে বলতে পারে, ‘আসলে মায়ের প্রেসারের ওষুধটা আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল’ বা ‘বুঝলি না, অনিরুদ্ধ স্যারের কোচিংয়ে আজ এতক্ষণ বসিয়ে রাখল!’ তোর্সা সব বিশ্বাস করে, কারণ ও অরণ্যের ওই রাগী টম বয় ইমেজটা পছন্দ করে। রাফ অ্যান্ড টাফ।

আমি এসব পারি না, দূর থেকে অরণ্যকে দেখি, হিংসেও করি। কী ভাবে যে পারে! প্রেমিকার চোখের দিকে তাকালেই আমার রক্ত হিম হয়ে যায়, মিথ্যে বলতে গেলে ঠিক ধরা পড়ে যাই। তখন যেসব ঘটনা ঘটে যায়, সেগুলো একদম পছন্দ হয় না। 

যে সব বইগুলোর নাম লিখেছি, সেগুলো কোন প্রকাশনার, সবাই মোটামুটি জানে। সেই আটের দশকে বইমেলা আজকের মতো ছিল না। নিশ্চিন্তে মেলায় ঘুরে বেড়াতেন সুনীলদা বা শঙ্খবাবু, সামনে গিয়ে বই নিয়ে দাঁড়ালে সইও করে দিতেন। যেখানে সেখানে ঘুরতেন সুবোধদা বা মল্লিকাদি, জয় গোস্বামী বা ভাস্কর চক্রবর্তী। তার জন্য বইমেলার বাইরে বিশাল ব্যানার করতে হত না,  বাউন্সার নিয়ে মেলায় কাউকে ঘুরতে হতো না। হাতে হাতে মুঠোফোনও ছিল না। 

তা সেই আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন সাদা ধবধবে বুশ শার্ট আর ধুতি পরা বাদল বসু। তাঁর সিগারেটে টান দেওয়ার ভঙ্গিটি ছিল সিগনেচার। হাত মুঠো করে সিগারেটটি ধরে মুখটা সামান্য উঁচু করে সুখটান আজও মনে পড়ে।

চার দিক মেপে নিয়ে অরণ্য ঢুকে পড়ল স্টলে। একেবারে নবীন কিশোর সেজে। পিছুপিছু আমি। যথারীতি দূরত্বে আছি। যাতে বেঁফাস কিছু হলেই কেটে যেতে পারি। মিনিট সাতেকও হয়নি, দেখি স্টলের কোত্থাও অরণ্য নেই। গেল কোথায় ছেলেটা? তা হলে কি ধরা পড়ে গেল? আতঙ্ক গ্রাস করে আমাকে। 

মিনিট পাঁচেক বই দেখে বাইরে বেরোই। দেখি স্টলের বাইরে সামান্য দূরে অরণ্য উদাস চোখে একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখছে। কাছে যেতেই বলল, ‘হেব্বি কিন্তু। কী করে আলাপ করা যায়, ভাবছি! সঙ্গে ছোকরাটা না থাকলে…’

আমি বিস্মিত। বললাম, ‘আবার মেয়ে? বইগুলো হয়নি তো? জানতাম হবে না!’

 অরণ্য চুলে আঙুল চালায়। জিরো পাওয়ারের চশমাটা খুলে আমার দিকে তুলে ধরে বলে, ‘এটা পকেটে রাখ। চল, মোগলাই খাই। খিদে পেয়েছে!’

 আমি উত্তেজিত, ‘বই কী হল?’

 অরণ্য এ বার হাসে। তার দুচোখে আত্মবিশ্বাস খেলা করে। তার পরে আবার একটা চার অক্ষর, ‘শোন, আয়াম নট আ লুজার লাইক ইউ!’

 তার পরে ব্যাগ সামান্য ফাঁক করে দেখায়। আমি দেখি, তিনটে নতুন বই নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে।

 অরণ্য আবার বলে, ‘নে চল, মোগলাইটা কি খাওয়াবি? না সেটাও আমার ঘাড় ভেঙে?’

আমি কিছু বলি না। ফের স্টলের গেটে চোখ পড়ে। রাজার মতো দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন বাদল বসু। 

পরে ওই প্রকাশনা থেকে প্রথম বই বেরোনোর সময় একদিন বাদলদাকে বলেছিলাম এই গল্প। হেসে বলেছিলেন, ‘যত্ত সব দস্যি ছেলের কাণ্ড!’

দস্যি ছেলে অরণ্য সরস্বতী পুজোর দিন তোর্সার হাতে তুলে দিয়েছিল বইগুলো, সঙ্গে ক্যাডবেরি। তার পরে তোর্সার দেওয়া ক্যাডবেরির একটা টুকরো মুখে পুরে চটচটে হয়ে যাওয়া হাতটা মুছেছিল ওর বাসন্তী রঙের শাড়িতে।

তোর্সা রেগেমেগে রক্তচক্ষু হেনে বলেছিল, ‘অসভ্য!’

মেয়েরা যেমন বলে, বলে থাকে!

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb uponyas

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা । পর্ব ৭

উ প ন্যা স । পর্ব ৭

ম ল য়   রা য় চৌ ধু রী র

জাদুবাস্তব উপন্যাস

malay_roy_choudhury

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা

(গত সংখ্যার পর)

তিন

তোর আবদার ছিল আমরা ফার্স্ট ক্লাস এসির একটা ক্যুপে রিজার্ভ করে ট্রেনের চাকার তালে-তালে প্রেম করতে করতে যাই, তাতা ধিন না, তাতা ধিন না, দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম ব্রিজের ওপর দিয়ে, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

তা সম্ভব ছিল না, আমার পক্ষে অতদিন ছুটি কাটানো অসম্ভব, জানাজানি হলে ঘুষখোর অফিসাররা টানাহেঁচড়া করবে ; তারা ওৎ পেতে আছে বহুকাল যাবত।

আমি আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দুটো এয়ার টিকিট কাটলাম, মিস্টার প্রভঞ্জন প্রধান, মিসেস নেতি প্রধান, দমদমের, ভোরের ফ্লাইট। 

আট নম্বর রোতে সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে তুই বললি, ড্যাড, প্লেনটা যদি ক্রাশ করার মতো হয়, আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরব, তুমিও তক্ষুনি জড়িয়ে ধোরো আমায়।

ছি ছি, কি বলছ গো, যাত্রা আরম্ভ হবে, এখন ওসব কি অলুক্ষুনে কথা। পেছন ফিরে দেখলাম, রিমলেস  বৃদ্ধা। আমি পেছন ফিরেছি দেখে বললেন, আপনার মেয়েকে যথাযথ শিক্ষাদীক্ষা দেননি, এতগুলো মানুষ, আপনার মেয়ে চাইছেন সবাই এক সঙ্গে মরি।

উনি আমার মেয়ে নন, স্ত্রী।

পেছন থেকে ফিসফিসগুলো ভেসে আসতে লাগল।

ফাঁসিয়েছে মালদার আসামী।

না, তেমন বুড়ো নয় লোকটা, বেশ স্মার্ট, পঁয়তাল্লিশ হবে মনে হয়।

মেয়েটা তো তার অর্ধেক, দেখছিস না, তাও আধুনিকা, খাঁজ দেখা যাচ্ছে।

বাপের সঙ্গে বেরোলেও মেয়েরা খাঁজ দেখায়, খাঁজ তো আর বাপকে দেখাচ্ছে না, পাবলিককে দেখাচ্ছে; নতুন কি এতে ?

আমি তো বলব লোকটা টাকার টোপ দেখিয়েছিল, মেয়েটা তো কম স্মার্ট নয়, সুশ্রী।

               ম্যাট্রিমোনিয়াল ডট কমে দিয়েছিল হয়ত, সেখান থেকে খুঁটে তুলেছে রে।

দুটোই ডিভোর্সি হবে বোধহয়।

ঘাটে-ঘাটে জল খেতে গিয়ে নদীকূলে পরিচয়।

মেয়েটা ভাবছে ক্র্যাশ হলে ও বেঁচে যাবে আর আমরা সবাই থেঁতলে ছড়িয়ে থাকব সর্ষের খেতে।

হ্যাঁ, গায়ে পড়া টাইপের, হাই-হ্যালো করেছে, ক্যান্ডললাইট ডিনার খেয়েছে, ডিসকোয় নেচেছে, আর ব্যাস, আঙটি বদল আর লেংটি দখল।

আমি পেছন ফিরে বলতে চাইছিলাম, না সেসব কিছুই হয়নি, নেতি আমার হাত চেপে বলল, দাও না বলতে, এনজয় করছি, আলোচনার পাত্রী হয়ে উঠেছি, ল্যাজটা না হয় খানিক মোটা হল, বাজেট এয়ারলাইন্সে চাপার এটাই প্লাস পয়েন্ট ; অন্য এয়ারলাইন্সে গেলে বিজনেস ক্লাসে সবাই মুখ গোমড়া করে দার্শনিক সেজে থাকে, বাঞ্চ অফ ওল্ড হ্যাগার্ডস, যেন আইনস্টাইনের পেট থেকে জন্মেছে।

ফিসফিস বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল, পেছন ফিরে বললাম, আমি সাতচল্লিশ আর উনি চব্বিশ, প্রেম করে বিয়ে করেছি। উনি আমেরিকা থেকে আমাকে বিয়ে করার জন্য এসেছেন।

তা উনি আপনাকে ড্যাড বলছিলেন যে, একজনের যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন।

উত্তরটা তুইই দিলি, আমেরিকায় এই কিছুকাল আগে অব্দি হাজব্যাণ্ড আর প্রেমিককে মেয়েরা বেবি বলে ডাকত, এখন বেবি পুরোনো হয়ে গেছে, ড্যাডি বলে ডাকা হয়, আদর করে ডাকতে হলে ব্যাড ড্যাড, শোনেননি সেই গানটা, ব্যাড ড্যাড, ডোন্ট ফিল স্যাড, ইউ আর এ ল্যাড, লে মি ওন ইওর প্যাড, স্নুপি বিচের গাওয়া ?

##

এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুটের ঝিলিক থেকে গানের টুকরো।

কিছুটা অপরিচিত থাকার আহ্লাদ।

##

এয়ারপোর্টের কাছের হোটেলে বাক্স-ব্যাগ রেখে তোকে পাশে বসিয়ে বাঁশদ্রোণী বাজারের দিকে চললাম, হোটেলের নির্ধারিত গাড়িতে। তুই চুড়িদার পরে নিয়েছিস ;  বাচ্চাদের মতো চারিদিকে মাথা ঘুরছে তোর। গাড়ির ভেতর থেকে স্মার্টফোনে ছবি তুলছিস, ডাবের ঠেলা, মিনিবাস, রাজনৈতিক দলের ছেঁড়া পোস্টার, মোড়ের হিজড়ে, রাস্তা পেরোনো অলস ভিড়, যা  তোকে অবাক করছিল, তারই।

একটাও আঁস্তাকুড় দেখলুম না এখনও, বললি।

সমবেদনার মুচকি ঠোঁটে খেলিয়ে, ড্রাইভার বলল, আঁস্তাকুড়ের ফোটো তুলবেন নাকি, দিদি। একটু অপেক্ষা করুন, সকাল এদেশে কুঁড়ে-স্বভাবের, সূর্য একটু জোর পাক গায়েগতরে, দেখতে পাবেন।

তুই উত্তর দেয়া দরকার মনে করলি না , ঘাড় নাড়াটা সন্মতিসূচক কিনা বুঝতে পারলাম না।

আচমকা উচ্ছ্বসিত, বললি, এটা আমার দেশ, ওই বউটা কি বাচ্চা-ফেলে দেয়া মা, আরে ওই লোকটা আমার মতন ঢ্যাঙা, ও নিশ্চয়ই ফেলে দেয়া বাচ্চার বাবা, নাঃ, রাসকেলটা  বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে, কিংবা নরকে গিয়ে গরম তেলে ঝলসে মরছে। কে জানে, মুসলমানও হতে পারে, মুসলমানরা বেশ লম্বা-চওড়া হয়, তা যদি হয় তাহলে জাহান্নমে অপেক্ষা করছে কয়ামতের জন্য।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলি, যতই যাই হোক, আঁস্তাকুড়ে জন্মে থাকি বা না থাকি,  এটা আমার মাতৃভূমি, আই লাভ ইট।

তোকে চিমটি কাটতে হল, ড্রাইভার তো আমেরিকা বা গুড়গাঁওয়ের নয়, যে বাংলা বুঝতে পারবে না!

তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাতৃভূমি মানুষকে মূর্খ করে তোলে, আবেগের গাধা বানায় ; মাতৃভূমির প্রেমে পড়ে রাশিয়ানরা কার্ল মার্কসকে বদনাম করে দিলে। শুনেছিস তো মার্কসের নাম।

শুনেছি, শুনেছি, দাড়িগোঁপ ছিল, তোর কন্ঠস্বরে অন্য চিন্তাকে বিপথগামী করে দেবার অভিযোগ।

ড্রাইভার শুনছিল তোর কথা, বলল, দিদি, মাতৃভূমি আর নেই, এখন যে দল সরকার চালায় সেই দলকে ভালোবাসতে হয়। দেশটাকে তো সবাই মিলে  আঁস্তাকুড় বানিয়ে ফেলেছে। যে লোক নেতা হয়, সে মনে করে সে-ই বুঝি সরকার, তার হুকুম সবাইকে মানতে হবে, নইলেই কেলেঙ্কারি, খুনোখুনি, মাটির তলায় হাড়পাঁজর, ছেলেপুলে কাঁখে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে।

তুই বললি, কী যে বলছেন, সরকার আর মাতৃভূমি তো এক নয়।

এখন লোকে মাতৃভূমির জন্য জান দেয় না গো দিদি, দলের জন্য দেয়, শহিদ হয়, যারা মরে আর যারা মারে, সবাই তা দলের জন্য করে, মাতৃভূমির জন্য নয়, বলল ড্রাইভার , নিজের মাকেই বুড়ো বয়সে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দ্যায়, আর আপনি মাতৃভূমির কথা বলছেন। এই তো সেদিন পড়লুম,  মাকে খুন করে তার সম্পত্তি হাতিয়েছে চার ছেলে ষড়যন্ত্র করে, মুখে অ্যাসিড ঢেলে তারপর পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল, যাতে পুলিশ চিনতে না পারে ।

যাক, ড্রাইভারটা অন্তত তোকে চুপ করিয়ে দিতে পারল, নয়তো কি-কি বকে যেতিস মাথামুণ্ডু।

নাঃ, তুই দমবার নয়, আবার আরম্ভ করলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ওরা সব প্যারানয়েড, বুঝলেন, পশ্চিমবাংলা হল আমার আর আপনার, আমাদের, আমি নলেন গুড়ের সন্দেশ ভালোবাসি, পাটালি গুড়, পাটি সাপটা, জামদানি শাড়ি, দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভাপা ইলিশ, ট্যাংরা মাছের ঝোল, শিষপালঙের চচ্চড়ি, চালতার অম্বল, আমার চাষি-ড্যাডিকে ভালোবাসি, এইগুলোতে কি পশ্চিমবাংলা নেই ?

এবার ড্রাইভার যা বলল, তাতে তুই একেবারে চুপ করে গেলি, জিগ্যেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?

তুই বললি, আমেরিকা, আর সামনের আয়নায় দেখতে পেলি ড্রাইভারের ঠোঁটে মৃদু শ্লেষের হাসি।

হঠাৎ বলে উঠলি, আচ্ছা, জোনাকি কোথায় দেখতে পাবো ? আমি আজ অব্দি জোনাকি দেখিনি।

ড্রাইভার এবারে তোকে বিপদে ফেলল ওর অনুসন্ধিৎসা প্রয়োগ করে, দিদি, কোথায় জন্মেছেন, পশ্চিমবাংলায় কোথায়, যে জোনাকি দেখতে চাইছেন ?

আঁস্তাকুড়ে, বললি তুই।

 ড্রাইভার ভাবল ঠাট্টা করছিস, আমাকে জিগ্যেস করল, স্যার কোথাকার লোক আপনারা, আপনার মেয়ে এখনও পশ্চিমবাংলা দেখেননি ?

উনি আমার মেয়ে নন, আমার স্ত্রী, বললুম, তারপর যোগ করলুম, তুমি আমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছ, বাঁশদ্রোণী বাজার, সেই বাজারের বাইরে জঞ্জাল ফেলার যে আঁস্তাকুড় আছে, সেখানে এনাকে ফেলে গিয়েছিলেন এনার বাবা কিংবা মা, তখন এনার কয়েকদিন মাত্র বয়স, তারপর স্হানীয় ক্লাব, যাদবপুর থানা, হাসপাতাল, স্হানীয় এনজিও  হয়ে ইনি দিল্লির জনসেবামূলক এক সংস্হায় পৌঁছোন, একটি বাঙালি পরিবারে পড়াশুনা করে আমেরিকায় বড়ো চাকরি করছেন ; ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় দিল্লিতে।

দিদি, আপনাকে দেখে বাংলা ফিলিমের  নায়িকা মনে হয়েছিল, এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে ঘটনাটা সত্যি।

তুই বললি, গ্রেট, সিনেমা হলে বসে বাংলা ফিল্ম জীবনে দেখিনি, একটা ফিল্মও দেখব ড্যাড। হিরোরা কি বলিউডের মতন মারামারি করে ? নাচে ? ঝিনচাক ঝিনচাক ? আইটেম ডান্স হয় ? বিড়ি জালাইলে ? ঝাণ্ডুবাম ? বেবি ডল ম্যায় সোনে দি হয় ?

ড্রাইভার বলল, সব শিল্প পশ্চিমবাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

 শিল্প আবার চলে যাবে কেন, কোটি-কোটি টাকায় আজকাল বাঙালি শিল্পীদের পেইনটিং বিক্রি হচ্ছে ; যারা আর্টিস্ট নয় তাদের পেইনটিংও অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে, পশ্চিমবাংলার আর্ট জগদ্বিখ্যাত।

আর্টের কথা বলছে না, বলছে কলকারখানার কথা, ইনডাসট্রির কথা। আমি বললুম।

ইনডাসট্রিকে আর্ট মনে করা ভুল, মনে হবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলকারখানা বসিয়ে গেছেন।

তাই করলেই ভালো হতো দিদি, ড্রাইভার বলল।

তুই বললি, এখন তো তাই মনে হয় ; শান্তিনিকেতনে যাবার কথা ভাবি , এবার হবে না।  রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করব।

রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগে মারা গেছেন, বললাম আমি।

 মারা গেলেই বা, মারা গেলেই তো আর মানুষ মরে যায় না, আমি শান্তিনিকেতনে গেলে রবীন্দ্রনাথের অবশ্যই দেখা পাবো ; জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সবাই কে কেমন আছেন খোঁজ নেবো। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব আর স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে দেখা করব। সুভাষচন্দ্র বসু তো বাড়ি ফেরেননি, নয়তো ওনার সঙ্গেও দেখা করতুম। লোকে বোধগয়ায় যায় কেন ? গৌতমবুদ্ধের সঙ্গে কথা বলবে বলে, ওওওওউউউম মণিপদ্মে হুমমমমমম।

তুই ইনকরিজিবল, বললাম গলার স্বর নামিয়ে।

##

এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

##

বাঁশদ্রোণী বাজারের কাছে পৌঁছে ড্রাইভার বলল, এখানে পার্কিং নেই, আপনারা যা কেনাকাটা বা দরকারি কাজ সেরে আমায় ফোন করে দেবেন, এসে যাবো, দেখি কোথায় গাড়ি পার্ক করা যায়।

গাড়ি থেকে নামলি, সামনেই সেই জঞ্জালের ভ্যাট বা আঁস্তাকুড়, তুই একেবারে কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিস, তোর মায়ের স্মৃতি টিকে আছে কিনা, হয়তো সেকথাই ভাবছিস, কিংবা কি করে এরকম নোংরা জায়গায় পড়ে থেকেও বেঁচে রইলি।

 আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দূরে, যাতে তুই নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারিস, বোঝাপড়া করতে পারিস। ফোটো তুলছিস না কেন, বলেছিলিস ফোটো তুলবি, মনে করিয়ে দেব কিনা ভাবছিলাম, তখনই তুই আঁস্তাকুড়ের ভেতরে ঢুকে পচা সবজি, ছাই, মাছের আঁশপোঁটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লি, নানা ভঙ্গীতে একের পর এক সেলফি তুলতে লাগলি, আর লোক জড়ো করে ফেললি ; আমি দৌড়োলাম তোর দিকে, পরিস্হিতি সামলাবার জন্য।

হাত ধরে তোকে টেনে তুলতে যাব, তুই বললি, আমি চিৎ হয়ে, পাশ ফিরে, নানা পোজে শুচ্ছি, তুমি ফোটো তুলে নাও তো।

তুই পোজ দিতে লাগলি, আমি ক্লিক করতে লাগলুম। হলুদ রঙের কুর্তার ওপর সবুজ ফুল, সবুজ চুড়িদার, ওড়না নেই।

যখন উঠে দাঁড়ালি, ঠাকুমার ঝুলি বইয়ের গাছপাতা-চরিত্র, তোর পোশাকে  ডাস্টবিনের নোংরা জঞ্জাল জেঁকে বসেছে, মাছের আঁশ ঝরছে।

দু’হাত দুপাশে ছড়িয়ে বললি, এই দ্যাখো, জঞ্জালমাতা হয়ে গেছি, বিশ্বসুন্দরী প্যাজেন্টে চললুম।

কোনো প্রতিযোগীতা আছে কি ম্যাডাম, আঁস্তাকুড়ে সেলফি নেবার ? জানতে চাইল এক পথচারী।

অনেক ভালো সেলফি উঠত, আপনার কাছে যদি সেলফি স্টিক থাকত, বলল একজন যুবতী, থলে থেকে লাউ, পালং শাকের আঁটি, সজনে ডাঁটা  বেরিয়ে রয়েছে।

আরেকজন জানতে চাইল, কিসের বিজ্ঞাপনের মডেলিং করছেন ম্যাম, হার্বাল প্রডাক্টের ? দেখিনি তো আগে  আপনাকে টিভিতে বা কাগজে।

 চব্বিশ বছর আগে ওনার মা বা বাবা ওনাকে এই আঁস্তাকুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিলেন, বললাম আমি, অগত্যা ।

ভিড়ের মেজাজ বোঝা বেশ কঠিন, কখন কোন দিকে মোড় নেবে বলা যায় না। তোর বাহু ধরে একটু এগিয়ে ড্রাইভারটাকে ফোনে ডাকলাম। তোকে বললাম, কি করলি কি, এখন এগুলো পালটাবি কি করে?  ইনফেকশান হয়ে যাবে।

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তুই বললি, কিছুই হবে না, দেখে নিও, আমি জঞ্জালপ্রুফ, লাথিপ্রুফ, ঘেন্নাপ্রুফ, গলাধাক্কাপ্রুফ, নয়তো বাঁচতুম না, তখনই মরে যেতুম। তোমার কি মনে হয় জীবনে ধাক্কা খাইনি ? শুনলে তোমার মাথায় রক্ত উঠে যাবে।

একটি লোক আমাদের পেছু নিয়েছিল, বলল, স্যার, আমাদের দোকানে ওনার মাপের চুড়িদার আছে, পোশাক পালটাবার ঘরও আছে।

দারুণ তো, বলে লোকটার সঙ্গী হলি তুই, আমি পেছন-পেছন, ড্রাইভারকে বললাম, এক্ষুনি আসতে হবে না, একটু পরে এসো।

লাল রঙের কুর্তা কিনলি, তাতে কালো ডোরা লম্বালম্বি, চুড়িদারও লাল। তোকে ঘিরে থাকা ভিড়ে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে তোর মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়েছিল, তুই তাকে নোংরা পোশাকের প্যাকেটটা দিয়ে বললি, খোকাবাবু, এটা ওই আঁস্তাকুড়ে ফেলে এসো তো।

ছেলেটি বলল, আমার নাম খোকাবাবু নয়।

তুই বললি, আচ্ছা নবীনকিশোর, ফেলে এসোতো এটা।

ছেলেটি : আপনি কি করে জানলেন আমার নাম নবীনকিশোর ?

তুই : তোমার গোল মুখ দেখে ; যাদের মুখ গোল হয়, তাদের নাম সাধারণত নবীনকিশোর হয়।

বৃদ্ধ কেশিয়ার টাকা গুণতে-গুণতে বলল,  শুনলাম আপনাকে আঁস্তাকুড়ে পাওয়া গিয়েছিল, আমি জানি ব্যাপারটা, অষ্টম সন্তানকে ত্যাগ করার ঘটনা, হইচই হয়েছিল বেশ। শান্তনুর বাচ্চাদের গঙ্গাদেবী জলে ভাসিয়ে দিতেন, গল্প শুনেছেন তো ? শেষে অষ্টম সন্তানকে ভাসাতে গেলে শান্তনু বাধা দিয়েছিলেন, সেই অষ্টম সন্তান ছিলেন মহাভারতের ভীষ্ম ; কত কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল ওনাকে, বিয়ে করতে পারেননি, সংসার করতে পারেননি।

তুই আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ভাগ্য ভালো যে জোর করে দখল করে নিয়েছি পছন্দের লোকটাকে।               গেঞ্জি কিনছিল এক প্রৌঢ়, বলল, ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টম তিথিতে মথুরার রাজপরিবারে বাসুদেব আর দেবকীর অষ্টম পুত্র হয়ে জন্মেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, জানেন কি ?

             তুই বললি, গল্পটা জানি, অষ্টম গর্ভের কথা জানতুম না, জানা ছিল না, শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে যেমন বয়সে অনেক বড়ো ছিলেন ওনার প্রেমিকা রাধা, তেমনি আমার আর আমার শ্রীকৃষ্ণের বয়সের পার্থক্য ; আমি ওনার এলেকট্রারাধা। আমার দিকে তাকিয়ে তোর উক্তি, কি ঠিক বলেছি না, ড্যাড ?

              বৃদ্ধ বলল,  আমরা শুনেছিলাম সেই বাচ্চাকে কোনো বিদেশি কোল নিয়েছে। নিচের তলায় যান, মাছের বাজারে, অনন্ত নামে একজন মাছ বিক্রি করে, ওর কুটুমের গ্রামের ঘটনা, অবশ্য অনন্ত তখন ছোটো ছিল, গ্রামের এবং পরিবারের তো হালহদিশ দিতে পারবে।

           শুনেই তুই দৌড়োলি নিচে, মাছের বাজারে, ঢুকেই চেঁচালি, অনন্ত, অনন্ত কে, আপনাদের মধ্যে কার নাম অনন্ত ?

            আঁশবঁটিতে ধড় থেকে তিন কেজি রুইয়ের মুড়ো আলাদা করছিল, লুঙ্গি-পরা মাঝবয়সী মাছবিক্রেতা, সে বলল, আমিই অনন্ত, বলুন, কবেকার অর্ডার, যত ওজনের চাইবেন এনে দেবো, বিয়ের সিজন, দিন পাঁচেক আগে অর্ডার দিতে হবে।

             আমাদের পেছনে যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের একজন বলল, উনি তোমার কুটুমের গ্রামে যাবেন, তোমার কোন এক জ্ঞাতি তার অষ্টম মেয়েকে ফেলে গিয়েছিল বাজারের জঞ্জাল ফেলার জায়গায়, সেই যে কত থানা-পুলিশ কাগজ-কিচাইন হয়েছিল, তারপর যাদের বাচ্চা তারা ধরা পড়ার পর বললে যে, না, তাদের নয়, মনে নেই ? কত কচাল করেছিল লোকেরা। উনি বলছেন যে উনিই সেই বাচ্চা।

             লুঙ্গিতে হাত পুঁছে উঠে দাঁড়াল চশমা-পরা তেলালো টেরিকাটা অনন্ত, যেন মাছেদের নিশিডাক দিয়ে জালে তুলতে চলেছে। বাকরহিত বলতে যা বোঝায়। বসল, কাৎ করে রাখল মেগাসাইজ বঁটি। বলল, আজকে হবে না দিদি, আজকে আমার ছেলে আসতে পারেনি, আপনি কালকে ভোরবেলা আসুন, ভোর-ভোর না বেরোলে  ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে আপনাদের, দিনকাল ভালো নয় জানেনই তো। গ্রামর নাম লক্ষ্মীপুর, ঈশ্বরপুরের কাছে, জীবনপুরে যাবার পথে, রাজপুর-সোনারপুর বা বারুইপুর হয়ে যেতে হবে। আজকে আপনি ক্লাবে হয়ে আসুন বরং, ওনারাই আপনাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

            তুই : ঈশ্বরপুর, জীবনপুর, লক্ষ্মীপুর, বাঃ, পারফেক্ট নাম, গডলি-গডলি। ঠিক এই কথাই রইল তাহলে, কাল সকাল সাতটায় এসে যাবো, গাড়ি ভাড়া নিয়েই আসব, আমার বরের সঙ্গে।

            অনন্ত : বিয়েও হয়ে গেছে আপনার ? বর পক্ষ ব্যাপারটা জানে ?

            তুই : ওই তো আমার সুপুরুষ বর দাঁড়িয়ে আছেন।

            অনন্ত : বড়লোক বর পেয়েছেন দিদি, কি ভাগ্যি আপনার। গিয়ে আপনার বোনেদের দেখবেন, দু-বেলা খেতে পায় না, সবায়ের অ্যাণ্ডাগ্যাণ্ডা  ছেলে-মেয়ে।

            তুই : বোন ? কতগুলো বোন ? জিগ্যেস করে আমার দিকে ফিরে জয়ের হাসি খেলালি ঠোঁটে।

            অনন্ত : আপনি অষ্টম গর্ভের সন্তান তো, আপনার আগে আরো সাত বোন, সবাই হয়তো বেঁচেবর্তে নেই, কারা আছে কারা নেই বিশেষ জানি না গো, ছেলেপুলেরা থাকবে। দশ-বারো বছর হয়ে গেল ওমুখো হইনি। ছেলে হয়েছিল ওদের,  আপনার পর, শুনেছি, সেই ছেলে বিয়োতে গিয়ে আপনার মা মরে গিসলো। কি করবে বলুন, খাওয়াতে পারে না, বাচ্চা বিইয়ে চলেছে, গেল শেষে সগগে।

             তুই : বিইয়ে চলেছে, শুনতে কতো ভালো লাগে, তাই না ? অষ্টম গর্ভ ? এইটথ চাইল্ড ! হুউউউশ ওয়ান, হুউউউশ টু, হুউউউশ থ্রি, হুউউউশ ফোর, এই করে আটবার। ঈশ্বরপুরের মেয়ে, যেতেই হবে, আপনি রেডি থাকবেন, আমরা সাতটায় পোঁছোচ্ছি।

              বিশাল ভেটকি কেটে খদ্দেরের জন্য ফিলে বানাচ্ছিল যে, সে বলল, কিন্তু ক্লাব তো এখুন তৃণমূল নিয়ে নিয়েচে।

              শিঙিমাগুর বিক্রেতা : আরে ঘেঁচুবাবু সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে চলে গেচেন, ফুটানিবাবুও ওনার পেচন পেচন গেচেন, ভালোবাবু তো তৃণমূলের কি একটা পুরস্কারও পেলেন, ওনার হ্যাদানে ফোটো আছে ক্লাবঘরে, দুহাতে সেই কেঠো তকতিখানা ধরে আচেন, মুচকি হাসিতে গুটকা-দেঁতো ফোকলা ঢেকে।

              ভেটকি : তখুন তো অ্যামবুলেন্স পায়নি ওঁয়ারা, চাঁদুচৈতনের বউ রিকশায় চেপে আপনাকে কোলে করে থানায় নিয়ে গিসলো।

              রুই : চাঁদুচৈতনকে পাবো কি ক্লাবঘরে ?

             শিঙি : না ওনারা দুজনেই গত হয়েছেন।

              তুই : ক্লাবটা কোথায় ?

             কুচোমাছ বিক্রেতা : অ্যাই বদনা মাছ বাচা বন্ধ রেখে এনাদের নিয়ে যা তো ক্লাবঘরে, ক্যারাম খেলছে বোধহয় ঘেঁচুবাবুর ছেলেরা। তোকে মাছ ছাড়াবার ভরতুকি দিয়ে দেবেন দিদি।

             তুই : কত দূরে ?

             কুচো : ওই তো রাস্তায় বেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই বাঁদিকে।

             তুই : এটা কি মাছ ?

              অনন্ত : ফলুই।

             তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, কত্তো রকমের মাছ, কত টাটকা, পাবদা, পারসে, খয়রা, বাটা, গুড়জাওলি, কাজরি, আহা, মনে হচ্ছে কাঁচাই খেয়ে নিই। বাসি মাছ খেয়ে বোর হয়ে গেছি। যে মাছে কাঁটা থাকে না, সে মাছে বোধহয় স্বাদ হয় না ; কাঁটাহীন ইলিশ কি ভাবা যায় ?

             অনন্ত : যা বলেছেন, এদেশে একবার আসে হেঁটে কাঁটার দল, তারা গিয়ে আসে ওপরে কাঁটার দল।

             তুই : মানে ?

             অনন্ত : মানে ওই ওপরে কাঁটা হেঁটে কাঁটা, এদেশে থাকলে টের পেতেন।

             নবীনকিশোর ছুটতে ছুটতে এসে জানাল, ক্লাবঘর বন্ধ, তালা দেয়া, ঘেঁচুকাকু আর ফুটানিকাকু দুজনেই কলেজ ইউনিয়ানের নির্বাচন সামলাতে গেছেন।

             তুই : ধ্যুৎ, এই বয়সে কলেজে পড়েন নাকি তাঁরা ?

             নবীনকিশোর : দিদি, ঘেঁচুকাকু-ফুটানিকাকুকে বাদ দিয়ে এই এলাকায় কোনো ছাত্রের ইয়ে ঝরে না আর কোনো ছাত্রির উয়ো পড়ে না।

            অনন্তর দিকে তাকিয়ে বললি, সেই কথাই রইল, কাল সকাল সাতটা।

             আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ইয়ে ঝরার পর কিন্তু উয়ো পড়া বন্ধ হয়ে যায় ; ড্যাড, অবসিনিটি ব্যাপারটা জেনারেশান গ্যাপের সঠিক মেজারমেন্ট করে।

            আমাদের বয়সের পার্থক্যকে টিটকিরি মারলি কিনা বুঝতে পারলাম না, বললাম, জানি, ওসব কুকথা শুনে-শুনেই এখান-ওখানের চুল পাকিয়েছি।

             তুই কাপড়ের দোকানটায় গিয়ে আবার ঢুকলি, বললি, শুনলুম আমার সাত বোন আছে, তাদের ছেলেপুলে আছে, কতজন তা তো জানি না, আপনি গ্রামে পরা যায় এমন কুড়িটা শাড়ি প্যাক করে দিন, আর আমার মাপের যেকোনো রঙের ব্লাউজ দিন, গ্রামে পরা যায় এমন।

             দেখলিও না ব্লাউজ আর শাড়িগুলো, দাম যা চাইল মিটিয়ে দিলি। আমি দিতে পারতাম, কিন্তু তোর তো মুখের আগল নেই, বেফাঁস কি বলে ফেলবি, পকেটে হাত ঢুকিয়েও বের করে নিলাম।

             বাজার থেকে বেরিয়ে দেখলাম আঁস্তাকুড় ঘিরে ভিড় ; একজন করে তার ভেতর ঢুকে জঞ্জালের ওপর শুয়ে সেলফি তুলছে, আরেকজন দ্রুত ঢুকতে চাইছে, বেশ ঠেলাঠেলি, বুম হাতে একজন সাংবাদিকা আর কাঁধে ক্যামেরা তার আধাযুবক সঙ্গী। জঞ্জালের ওপর শুয়ে যে প্রৌঢ়া সেলফি নিচ্ছে, তাকে জিগ্যেস করল, কেমন লাগছে আপনার ?

             সে বলল, ওঃ অসাধারণ অভিজ্ঞতা, কি যে ভালো লাগল, দারুণ দারুণ !

             তোর বাহু ধরে ছুটলাম গাড়ির দিকে।

##

 

            মায়ের ঘরেই শুয়েছিলি তুই, আমাকেও টেনে নিয়ে গিয়েছিলি, দুজনের বেশি আঁটে ওই খাটে, বলেছিলি। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিলি ভোর পাঁচটার, উঠতে যাবো, বললি, অ্যালার্মটা মরনিং গ্লোরির জন্য, বিছানা থেকে বেরোবার জন্য নয়, ভোরের স্পার্ম অব্যর্থ, ঠিক পথ কেটে পোঁছে যায় গন্তব্যে।

              তোর নির্দেশ  অনুযায়ী গন্তব্যে পাঠিয়ে উঠে পড়লাম, মিনিট তিরিশেক জিমে কার্ডিও না করলে শরীর বেশ ঢিলেঢালা ঠ্যাকে।

##

 

            বেরোবার সময় দেখলাম তুই তোর ব্যাগে একশো টাকার বেশ কয়েকটা প্যাকেট ঢোকালি ; আমিও নিয়েছি, সঙ্গে, যদি দরকার পড়ে। শাড়িগুলো নিয়েছিস প্লাসটিকের প্যাকেটে।

            তুই পারফিউম লাগাসনি, লিপ্সটিক বোলাসনি ঠোঁটে, নখপালিশ তুলে ফেলেছিস, হাফহাতা সবুজ ব্লাউজ পরেছিস, তার সঙ্গে মানায় না এমন  খয়েরি সিনথেটিক শাড়ি। পায়ে ফ্ল্যাপার। কিন্তু একবার আধুনিকতা যদি আঁকড়ে ধরে, যতই পোশাক-আশাক পালটাও, ছাড়াতে পারবে না।

##

           সকালে বাজারের সামনে অনন্ত ধুতি পাঞ্জাবিতে, টেরিকাটা তেলালো চুল, হাতে থলে, সম্ভবত আত্মীয়ের জন্য উপহার নিয়ে যাচ্ছে।

           ভাজা হচ্ছে দেখে, তুই চেঁচিয়ে উঠলি, জিলাপি জিলাপি জিলাপি জিলাপি।

           এক চ্যাঁচারি জিলিপি আর রাধাবল্লভি-আলুর দম কিনলাম। তোর বোনেদের জন্য সন্দেশ আর রসগোল্লার হাঁড়ি।

           অনন্ত ড্রাইভারকে বলল, দুধানি, সাহেবপুর, বোদরা, হয়ে চলুন, বারুইপুর থেকে টার্ন নেবেন, নেত্রা পর্যন্ত ভালো বাঁধানো রাস্তা ছিল, এখন কেমন বলতে পারব না ; জানেন তো রাস্তটা ?

            ড্রাইভার ঘাড় নাড়ল, যারা ভাড়া নিয়েছে তাদের বদলে একজন সামান্য লোক হুকুম দিল বলে ওর মুখের অস্বস্তি তুই দেখলি আয়নায়, সামলাবার জন্য আমাকে জিগ্যেস করলি, তুমি জানো ?

           বললাম, না, এদিকে কখনও আসিনি, সুন্দরবনে যাবার পরিকল্পনা একবার করেছিলাম, সঙ্গী পেলাম না।

            মুখে জিলিপি নিয়ে বললি, এবার তো সঙ্গিনী রয়েছে, চলো না ঘুরে আসি, দারুণ হবে, টাইগ্রেস অ্যাণ্ড দি টাইগার ইন টাইগারল্যাণ্ড, ঘ্র্যাঁআওওওও।

            যে কয়দিন ছুটি, তার ভেতরেই সেরে ফেলতে হবে তোর মিশন ; প্রথম মিশন সফল, সেলফি তুলে নিয়েছিস, জেনেও ফেলে থাকবে তোর বন্ধুবান্ধব, নেট থেকে।

            গ্রামে আমার আত্মীয়স্বজন কারা আছে দেখি, তাদের ফোটো আপলোড করা যাবে কিনা গিয়ে দেখা করলে টের পাবো , গ্রামের ফোটো তুলে নেব।

            গাড়ি বারুইপুর ছাড়ার পর মেঠো সবুজ বাতাসে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। তুই ঠেলে তুললি, বললি, দ্যাখো-দ্যাখো ধানখেত, খেজুর গাছ, কতো গাছের সারি রাস্তার দুপাশে, আমার মাতৃভূমি। এটা কি গাড়ি, অন্য কোথাও দেখিনি তো, গাদাগাদি মানুষ ?

            মোটরসাইকেলভ্যান, ভটভটিরিকশা।

            ড্রাইভার মনে রেখেছে তোর কালকের কথোপকথন, পেছন ফিরে হাসল, সমবেদনার মুচকি ।

           পাখি দেখে চেঁচিয়ে উঠলি, মাছরাঙা, মাছরাঙা।

          অনন্ত বলল, দিদি ওটা নীলকন্ঠ পাখি।

          বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবাক করে দিয়ে আরম্ভ করলি, তোর চরিত্রের এই দিকের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না, এত বেশি কনভেন্টি অক্সব্রিজ ইংরেজি দিয়ে আমার বাংলা-টানের ইংরেজিকে আঘাত করছিলি এসে পর্যন্ত, জানতে পারিনি যে আঁস্তাকুড়ে পড়ে থাকার স্মৃতি তোকে এভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে, শুনতে-শুনতে কাঁটা দিতে লাগল গায়ে :

##

 

          আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে– এই বাংলায়

          হয়তো মানুষ নয়– হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;

          হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

          কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় ;

          হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,

          সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে ;

          আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবাসে

          জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায় ;

##

          হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে ;

          হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে ;

          হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;

          রূপসার ঘোলাজলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে

          ডিঙা বায় ; — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে

         দেখিবে ধবল বক : আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে–

##

 

          ড্রাইভারই প্রথম মন্তব্য করল, দেখছেন তো আপনিও মানুষ হয়ে আসতে চাইছেন না, শালিক, কাক, হাঁস, লক্ষ্মীপেঁচা, বক হয়ে আসতে চাইছেন, কেউই আর মানুষ হয়ে জন্মাতে চায় না এই পোড়া দেশে।

         অনন্ত বলল, আপনার গলাটা বেশ মিঠে, শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিসলুম, ঠিকই বলেছেন আপনি, কেউই আর মানুষ জন্ম চাইছে না , আমি মাছ হয়েও জন্মাতে চাই না, শেষে এই পাপীদের পেটের খিদে মেটাতে হবে, তারচেয়ে মাছরাঙা হব, পানকৌড়ি হব, শকুন হতেও রাজি আছি।

         তুই বললি, কবিতাটা আমার নয়।

         আমি জানতে চাইলাম, কার ?

         তুই বললি, বইগুলো তো তুমিই পাঠিয়েছিলে, ভুলে গেলে কি করে।

         বললাম, আমার এক জুনিয়ার অফিসার, কলকাতায় বাড়ি, তাকে বলেছিলাম, বাংলা সেলেকটেড বইয়ের অর্ডার দিয়ে দিতে, যাতে তোর নামে ওরা জগদীশের গুড়গাঁয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দ্যায়। এরকম যে কবিতা হয় জানতাম না, স্কুলের পর তো আর পড়া হয়নি কবিতা। কার লেখা ?

         তুই বললি, খুঁজো।

##

        

         এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

         যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

##

         পথের বোর্ড দেখে বুঝলাম আমরা ঈশ্বরপুরের  কাছাকাছি এসে পড়েছি। অনন্ত বলল, এবার নাবুন, লক্ষ্মীপুর যেতে কিছুটা কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে হবে।

         গাড়ি আসছে দেখে দূর থেকে গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা ছুটে এইদিকেই আসছিল।

         অনন্ত তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, মানিক সর্দারের বাড়িটা কোন দিকে রে, নিয়ে চল তো আমাদের।

         মানিকবুড়ো তো কবেই মরে গেচে, বলল একটি কিশোরী, বেশ কয়েকদিন স্নান করেনি বোধহয়, চুল শুকনো, বাসি বিনুনি, বয়সের চেয়ে বড়ো মাপের ফ্রক।

         তা জানি, অনন্ত বলল, বাড়ি তো আছে, বাড়ির লোকজন তো আছে ?

         তুই আমার দিকে তাকিয়ে বললি, সি, আই নিউ আই অ্যাম এ সরদারনি। দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলি, জো বোলে সো নিহাল, সত শ্রী অকাল।

         কয়েকজন বাচ্চা তোর দেখাদেখি দুহাত তুলে চেঁচালো, অকাল অকাল অকাল অকাল, কি মজা, অকাল অকাল, চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়োলো খড়ের চাল দেয়া  কুঁড়েঘরগুলোর দিকে।

       এরা না চেঁচানো পর্যন্ত মনে হচ্ছিল গ্রামটা মৌনতায় ঝিমিয়ে , দুঃখি-দুঃখি, চুপচাপ শোক পালন করছে।

        কাপড়ের থলেটা আমার হাতে ধরিয়ে বাচ্চাদের ফোটো তুললি, আমাকে বললি, এদের সঙ্গে কয়েকটা গ্রুপ ফোটো তুলে দাও তো। দিলুম। তুই দুই কিশোরীকে জড়িয়ে উবু হয়ে পথের ওপর। একটি কিশোরী কেঁদে ফেলল, তুই তাকে জড়িয়ে ধরিসনি বলে ; সবাইকে জড়িয়ে সাতটা ফোটো তোলালি। জিলিপি আর রাধাবল্লভির চ্যাঁচারিটা একটি কিশোরীর হাতে দিয়ে বললি, তোমাদের জন্য।

         আমার দিকে তাকিয়ে বললি, জড়িয়ে পাঁজরের হাড় ঠেকলো, এই পশ্চিমবাংলা দেখতে পাইনি, বাইরে-বাইরে সবুজ দেখছি তখন থেকে, গুড়গাঁওয়ের ময়লাকুড়ুনিয়াদের হাড়পাঁজর দেখি না তো । এত এত সবুজ অথচ হাড়পাঁজুরে ছেলেমেয়ে ! ম্যালনিউট্রিশান, দেখেই বুঝতে পারছি।

         বললুম, আঁস্তাকুড়ে সেলফি তুললি আর এখন দারিদ্র দেখতে পাচ্ছিস গ্রামে এসে ?

         তুই বললি, জানি জানি, গরিবের মাংস খেয়ে লোকে ধনী হয়, ধনীর মাংস যদি খেতে না পায় তাহলে গরিব কি করেই বা স্বাস্হ্যবান হবে ! এসে পর্যন্ত যা দেখছি, খাওয়া যেতে পারে এমন ধনী চোখে পড়ল না।

        অনন্ত বলল, আচে আচে দিদি, তেনারা সব নেতা, গরিব সেজে থাকেন, গরিবেরই মাংস হাপুস-হুপুস করে খান, খেয়ে পিচ করে রক্তের পিক ফ্যালেন।

##

        মানিক সর্দারের বাড়ি, খড়ের চালা, বাঁশের বেড়া ভেঙে পড়েছে, একটা খুঁটিতে বাদামি রঙের শিড়িঙে গাইগোরু, পৌঢ়া বেরিয়ে এলেন ডাক শুনে, তোমরা কারা, কাকে খুঁজচ ? কন্ঠস্বর বুড়িদিদিমার মতন, যেন জীবন আর মৃত্যু সম্পর্কে  জানার কিছু বাকি নেই, চোখে বিষন্ন দৃষ্টির অপ্রতিরোধ্য টান, ছানির আড়ালে।

        অনন্ত বলল, তোমায় তো চিনতে পারলুম না, আমি প্রমথ মাঝির নাতজামাই, অনন্ত।

        ইনি যে তোর বোন, সন্দেহ নেই, প্রায় তোর মতোই দেখতে, ঢ্যাঙাও তোর মতন , দাঁড়াবার ধরণে যৎকিঞ্চিত টিকে আছে যৌবনকালের মহনীয়তা।

       নাতজামাই ? অনন্ত ? না গো, মনে পড়তেছে না। প্রমথ নেই, মারা গেচে, দ্যাকো কারা আচেন ওনার বাড়ি, আর তো কোতাও যেতে পারিনে, ভালোও লাগে না।

       ভবিষ্যতকে অবিশ্বাস করার বয়সে প্রৌঢ়া, যখন জীবন বললে অতীতের কালো গহ্বর বোঝায়, যাদের চাই না, অতীত থেকে তাদের ঝেড়ে ফেলে দিতেও অনিচ্ছা ; এখন আর অতীত থেকে খুঁটে-খুঁটে আহ্লাদের স্মৃতিগুলো তুলে নেবার অবসর নেই।

       তুমি মানিক সর্দারের কে হও ?

        আমি ? আমি বিন্তি, আমিই আচি শুদু। বাবা তো সব জমিজমা বেচেবুচে বিয়ে দিলে আমার বোনগুনোর, এখন এই এগারো কাটা জমিই বেঁচেচে আর পুকুরটা, এতেই যা হয়, চলে যায়। আমি বাবার বড় মেয়ে, এই যে দুহাতে বাবার ছেঁকা দেয়া বিড়ির দাগ ; সব কান্নাই তো আর দ্যাকা যায় না, শোনা যায় না। দাগ দেকে ভেবোনি যে রক্ত শুকিয়ে গেচে। ছেলে তো হয়ে বাঁচেনে, ছেলে-ছেলে করে মাটাকে মেরে ফেললে।

      ভাবলাম, বিড়ির ছেঁকায় রয়ে গেছে অতীত ; দাগগুলোকে গোপনে ভালোবাসেন বলেই তো মনে হল। আহত বোধ করাও মানুষের অধিকার বৈকি।   

       তুই জিগ্যেস করলি, বোনেদের কোথায় বিয়ে হয়েছে ? কারোর সঙ্গে দেখা করা যাবে কি ?

        না গো, দুই বোন রিমি আর ঝিমি পাকা সড়কের ওই পারের গাঁয়ে ছেল, এখন সব গ্রামছাড়া, পার্টি করত তো ওদের বরেরা, ওরাও তাতে পোঁ ধরত। ফেলি, কুমু আর চিনুর  বীরভূম-মালদায় বিয়ে হয়েছে, খবরাখবর নেয় না, কোতায় ওদের শশুরবাড়ি, তাও জানিনে। দাঁড়াও তোমাদের বসার মাদুর আনি, আমি বেশিক্ষুণ দাঁড়িয়ে কতা বলতে পারিনে।

        গ্রাম ছাড়া ? গ্রামও ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি, পার্টি করলে ; পাঞ্জাবের ডিভিশানের সময়ে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল আণ্টিমায়ের আত্মীয়রা, এখানে এখনও সেই ডিভিশান চলছে ?

        বললাম, ঠিক ধরেছিস, ওই সোয়াইনফ্লুটাই ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবাংলার গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়।

##

 

        মেঘেদের গায়ে খোসপাঁচড়ার দাগ, শূন্যতা চলেফিরে বেড়ায়, অপূরণীয় গহ্বরে একফোঁটা জলের বীজ।

        জোঁকেদের তুলতুলে ব্যক্তিত্ব, হাওয়ায় মানুষের খোসা উড়ছে।

        যে মরে যাচ্ছে তার সঙ্গে কথা বলতে শেখানো হয়নি কোনো স্কুলে কলেজে।

        তলিয়ে যাবার মাধুর্য, সৌষ্ঠব, সদগুণ, কৃপা, প্রসন্নতা, করুণা।

##

        গোবর নিকোনো মাটির দাওয়ায় বসে তুই বললি, মাদুরের চেয়ে মাটিতে বসে বেশি আনন্দ। মামারবাড়ি পানিপতে ছোটোবেলায় গিয়েছিলুম একবার, এরকমই দাওয়া ছিল।

      কি বলতে কি বলে ফেলবি, তোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলতে হল, ডোন্ট টক অ্যাবাউট দোজ থিংস, দিস ইজ ইয়র ফাদার্স হাউস।

        তুমি কে গা ? তোমাদের তো চিনতে পারচিনে। প্রৌঢ়ার শাদা শাড়ি অতিব্যবহারে ময়লা, মুখও দারিদ্র্যের অন্তর্ঘাতে  বয়সের তুলনায় কুড়ি বছর বেশি বলেই মনে হল।

        তোমার সবচেয়ে ছোটো বোন কোথায় আছ জানো ?

        বাবা তো কলকাতা যাবার সবজির গাড়িতে চেপে তাকে ফেলে দিয়ে এস্ছিল কলকাতার বাজারের আঁস্তাকুড়ে। থানা-পুলিশ হয়েছেল, বাবা বললে, না, বাচ্চাটা আমাদের বাড়ির নয়। জানিনে সে মরে গেল না বেঁচেবর্তে আচে কোতাও।

        তুই ফোঁপাতে আরম্ভ করে সামলে নিলি।

       তোর মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ক্লাস টেনের ইনটারভিউতে তুই সিসটার অ্যানিকে বলেছিলি টি এস এলিয়টের কবিতা ভালো লাগে। আশ্চর্য, হঠাৎ মনে পড়ে গেল সিলভিয়া প্লাথের নাম আর তাঁর ড্যাডি কবিতাটা, তুই আবৃত্তি করছিলি ;  তখন তোর  কন্ঠস্বরে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম বলে মনে পড়েনি, এখন তোর ক্ষণিক ফোঁপানির জন্য মনে পড়ে গেল।

       তোর কাঁধে হাত রেখে বললুম, খুঁজে পেয়ে গেছি, সিলভিয়া প্লাথের ড্যাডি।

        জানতুম ড্যাড, পাবে, বাংলা কবিতার কবির নাম এখন খোঁজো, তুই চোখের মৃদু হাসি খেলিয়ে বললি।

       মানিক সরদারের বড় মেয়ে জিগ্যেস করলে, আপনি ওনার বাবা ?

       তুই বললি, না, উনি আমার ড্যাড, মানে বর। আর আপনি আমার দিদি, আমাকেই আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিল আপনার বাবা।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...