Categories
2023_mar goddyo

সিনে দুনিয়া

সি নে  দু নি য়া

শং ক র  চ ক্র ব র্তী

sankar_chakrabarty_hm

বিরহ মধুর হল আজি…

প্রথমেই সানাইয়ের সুরে ছুঁয়ে যায় একটা ফ্রেমে-বাঁধা নববধূর ছবি ও পরমুহূর্তেই তাকে দেখা যায় সন্তানসহ সুখের নৌকোয়। এই ধারাবাহিকতা অবিচ্ছেদ্যভাবে একটা সময় পেরোনোর গল্পে এসে ক্যামেরা স্থির হয় এক দম্পতির পারস্পরিক দূরত্বটুকু নিখুঁতভাবে লেন্সবন্দি করে। একটা অদৃশ্য পাঁচিলের দু’পাশে শুয়েই একজন আরেকজনের ‘প্রেসার’-এর খোঁজ নেয় তো অন্যজন ‘থায়রয়েড’-এর। এবং স্ত্রী যখন স্বামীর প্রেসারের খবর জানতে চায়, আর অন্যমনস্ক স্বামী ‘কার’ প্রশ্নটি ছোড়ে, তখন ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর ‘তোমার’ বলার অসাধারণ ভঙ্গিতেই বিরহের ভিতরেও প্রকৃত আনন্দ ও শোকের সন্ধান পায় দর্শক। তার পরেই নিজেদের ‘ছাড়াছাড়ি’-র পরিকল্পনাটা বাবা বা শ্বশুরকে না জানানো নিয়ে ক্রমাগতই ঘরের অমোঘ নির্জনতা ভাঙতে শুরু করে। এবং দর্শকদের এই ভাঙন থেকে গড়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে অনেক টানাপোড়েন। বাবা তথা শ্বশুরের স্ত্রী বিয়োগ এবং তার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হয়ে ওঠা গাছ যেন ফ্রেমের পর ফ্রেম পেরিয়ে, ছোটো ছোটো অন্য কিছু দৃশ্যে, অল্পকথায় এক বিশাল ক্যানভাস তৈরি করে দেয়। আর সবশেষে, নানা দুর্দৈবের মধ্যেও অতি-সত্য ও বাস্তবতার জোড় খুলতে শুরু করে। সত্যি কথা বলতে, এই পারিপার্শ্বিকতা ও জীবনকে খুবই নিপুণ ভঙ্গিমায় প্রতিষ্ঠা পেতে দেখি। কোনো আমোদ বা মনোরঞ্জনের ভাষায় নয়। সবই সম্ভব হয়েছে নির্দেশক অনুরাধা কুন্ডা, যিনি কবি, গল্পলেখক ও একজন নাট্যকর্মী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত— তাঁরই সুপরিকল্পিত গভীর ভাবনার দরুন।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে খুবই যত্ন ও মায়াময়তায় ‘বিরহ যদি’ শব্দবন্ধটি তুলে ছবিটির শরীরে জলছবির মতন এঁকে দেওয়া হয়েছে। আবার আশ্চর্য সুতোয় বাঁধা শঙ্খ ঘোষের কবিতাও।

তিনটি চরিত্রই অভিনয়ের গুণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বরুণ চন্দ ও অর্ক খুবই বলিষ্ঠ ভাবে তার প্রমাণ রেখেছেন। আর মিতুল, ওই যে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তোমার’ শব্দটি বলার ধরনেই যেন সর্বস্বতায় চরিত্র হয়ে ওঠা তাঁর। অসাধারণ। আরও ভালো লাগছে এই ভেবে যে দুই কবি নির্দেশক ও অভিনেতা হিসাবে যথাক্রমে অনুরাধা ও মিতুল চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। যা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

প্রচ্ছদ কাহিনী | মার্চ সংখ্যা

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

অরিজিৎ চক্রবর্তী ও অনুক্তা ঘোষাল

arijit
anukta

পাঁচ নারী হাতে তরবারি

বৈদিক যুগের ঘোষা, অপালা, লোপামুদ্রা ও বৈদিক পরবর্তী যুগের গার্গী, মৈত্রী— এই পাঁচ মহীয়সী নারীর কথা আমরা কে না জানি। তবু নারীশক্তিকে খাটো করার প্রবণতা আমাদের চিরদিনের। লিঙ্গ রাজনীতি পৃথিবীর আদিম ব্যাধিগুলির মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর জন্মের পর  ‘নারী পুরুষ’— এই বিভাজন রেখাই মানবজাতিকে বিভাজিত করে দুর্বল করে ফেলার প্রথম ও সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য প্রয়াস। এরপর আস্তে আস্তে বর্ণ এলো, ধর্ম এলো, এলো মহদেশ, দেশ, কাঁটাতার আরও কত কী। একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে তার মজা নেওয়া— কিছু বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের চিরদিনের বিনোদন। আর আমরা সবাই সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি। 

কিন্তু সব কিছুরই একদিন বদল হয়। বদল হয় দৃষ্টিভঙ্গির। এই কাজ মহিলাদের, এই কাজ পুরুষদের— এমন বিভাজন রেখা যে নিতান্তই এক প্রহসন, এক আদিম ব্যাধি তা আজ প্রমাণিত। আর তা প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু মহিলা পুরুষ উভয়েরই সাহচর্যে। মহিলারা যেমন এগিয়ে এসেছেন, সহকর্মী পুরুষরাও কিন্তু তাঁদের সাদরে বরণ করেছেন। শানিত বাঁকা দৃষ্টি এনেছেন মুষ্টিমেয় কিছু সেই আদিম রিপুর মানুষ। তাদের মধ্যে আছেন মহিলা পুরুষ উভয়ই। আমরা আজ জানব তেমনই পাঁচ নারীর কথা, যাঁরা কাজের জগতে মুছে দিয়েছেন নারী-পুরুষ বিভাজন রেখা। কুর্নিশ সেই সব পুরুষদেরও যাঁরা তাঁদের দেখেছেন একজন সহকর্মী হিসাবেই। পোশাক নয়, আসুন আমরা আধুনিক হই মননে।  

গৌরী আম্মা

শ্মশানে ডোমের দায়িত্বে থাকেন সাধারণত পুরুষেরাই। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর শহরের হরিশচন্দ্র ঘাটের শ্মশানে এই দায়িত্ব পালন করেন একজন মহিলা। বয়স সত্তরের কাছাকছি। এলাকাবাসীর কাছে তিনি গৌরী আম্মা নামেই পরিচিত। আসল নাম গৌরী দেও। মৃতদের নাম নথিভুক্ত করা থেকে কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো, অস্থি নিয়ে আসা— সব কাজই একা হাতে করে এসছেন দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে।  

তাঁর স্বামী কাকারু দাও তিন কন্যা রেখে মারা যান অকালে। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে স্বামীর করে আসা কাজটিকেই জীবন ধারণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি। টানা বারো ঘণ্টা এক নাগাড়ে ডিউটি করে যান গৌরী আম্মা। মুখে রা নেই। নেই ভয় বা ভীতি। যদিও এই মহাশ্মশানে ডোমের দায়িত্বে পুরুষকর্মীরাও রয়েছেন। কিন্তু সবাই এখানে কাজে চায় গৌরী আম্মাকেই। তাঁর কাজে নিষ্ঠার তারিফ শ্মশানযাত্রীদের মুখে মুখে। এইটুকুই প্রাপ্তি তাঁর। না, কোনো সর্বভারতীয় চ্যানেল বাইট নিতে ছুটে আসেনি বা ঝলসে ওঠে না আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কাজের শেষে কেউ যদি একটু ভালো বকশিস দেয়, তাতেই খুশি গৌরী দেবী। বর্তমানে বয়সের ভারে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। তবু দিনের খানিকটা সময় এখনও শ্মশানেই কাটান। কাজে হাত লাগান। শ্মশান লাগোয়োই তাঁর বাড়ি। পুরসভা থেকে মাসিক ভাতা পান। কিছুদিন আগে ‘বইতরণী’ পত্রিকা গোষ্ঠীর উদ্যোগে তাঁকে কলকাতা প্রেসক্লাবে সম্মান জানানো হয়। নারীর ক্ষমতায়নে গৌরী আম্মা থুড়ি গৌরী দেও-র জীবন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

প্রতিমা পোদ্দার

‘আস্তে লেডিস কোলে বাচ্চা’— না বরং তাঁকে শুনতে হয়েছিল— ‘আস্তে লেডিস, হাতে স্টিয়ারিং’। প্রথম প্রথম হাসি পেলেও বা কখনো কখনো রাগ হলেও… আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে গেছিল কথাটা প্রতিমা দেবীর। প্রতিমা পোদ্দার। নিমতা-বেলঘরিয়া-হাওড়ার রুটে মিনিবাস চালান তিনি। কলকাতার প্রথম মহিলা বাসচালক। 

অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় প্রতিমাদেবীর। বিয়ের পর উচ্চমাধ্যমিকও পাশ করেন প্রতিমাদেবী। অভাব অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী। তবু সুখেই চলছিল ঘর সংসার। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন স্বামী। তিন-চার মাস রোজগারহীন সংসার। স্বামীর চিকিৎসার খরচ। এই দিশাহীন অবস্থায় নিজেই হাতে তুলে নেন স্টিয়ারিং। ২০০৬ সালে লাইসেন্স পান তিনি। শুরু হয় লড়াই। বাঁকা চাহনি, টোন, টিটকারি কোনো কিছুই টলাতে পারেনি তাঁকে। অকুতোভয় প্রতিমাদেবী শুধু বাসই নয়, এর আগে চালিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্সও। করেছেন বাসের কন্ডাক্টারি। এখন মিনিবাস চালান নিমতা-বেলঘরিয়া-হাওড়ার রুটে। হ্যাঁ, সহকর্মীরা কিন্তু সব সময় পাশে থেকেছেন তাঁর এই লড়াই-এ, সাহস যুগিয়েছেন। তারা কিন্তু পুরুষই। খারাপ স্মৃতি নয়, দুঃখের স্মৃতি নয়— আনন্দের স্মৃতি সম্বল করে বাঁচতে ভালোবাসেন তিনি। তাঁর হাসিতে যে আত্মবিশ্বাস লেগে থাকে তা সকালের নরম রোদের মতো।  

শর্বরী দাস

ভারতীয় পোর্ট সেক্টরের প্রথম মহিলা কমান্ডার শর্বরী দাস। তিনি কখনোই মনে করেননি যে, তিনি পুরুষের জগতে ব্যতিক্রমী এমন কিছু করছেন যা অতিরিক্ত সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বরং তাঁর মতে নারীরা সকল কাজেই স্বয়ংসিদ্ধা। তিনি নিজেকে  পুরুষদের থেকে আলাদা করে কখনোই ভাবেননি। নিজেকে একেবারে একজন সাধারণ অফিসার হিসাবে তুলে ধরতেই বরাবর পছন্দ করতেন তিনি। আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করেই তিনি পেরিয়ে গেছেন জীবনে একের পর এক মাইলস্টোন। 

তানিয়া সান্যাল

ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল নতুন কিছু করার। সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়েই ভাগ্যের মোড় ঘুরল। চোখে পড়ল এয়ারপোর্ট অথরিটির দমকল বিভাগের একটি কর্মী নিয়োগের একটি বিজ্ঞাপন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানে কখনো কোনো মহিলা কর্মীই নিয়োগ হয়নি। কিছুটা জেদের বশেই আবেদন জানিয়ে বসলেন। অনেকেই কপালে চোখ তুললেন। মেয়ে হয়ে আগুন নেভাবে? তানিয়া, তানিয়া সান্যাল কিন্তু পিছু হটলেন না। একে একে কর্মী নির্বাচনের সমস্ত পরীক্ষা, প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সাফল্যের সঙ্গে সব অতিক্রম করে ভারতের প্রথম মহিলা ফায়ার-ফাইটার হিসেবে ‘এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এএআই)’-তে যোগ দিলেন। পূর্ণ করলেন তাঁর স্বপ্ন। এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেই যোগ দিয়ে থেমে থাকেননি, এখন স্রোতের বিপরীতে তাঁরই মতো হাঁটতে চাওয়া আরও একঝাঁক উজ্জ্বল মেয়েকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি।

রূপা চৌধুরী

জীবন মানেই পরীক্ষা। কিন্তু জীবনকে নিয়ে পরীক্ষা করার সাহস ক’জনের আছে? শুধু পরীক্ষা নয়, জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে জীবনকে আলোকিত করা… সেও কি মুখের কথা? এর সঙ্গে আছে সহ্যশক্তি, সততার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মনোবলের মতো আনুষঙ্গিক বিষয়ও। রূপা চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই কথাগুলি প্রথম মনে আসে। তাঁকে সততার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রতীক বলা যায়। তাঁর কাহিনি শুধুমাত্র মহিলাদেরই নয়, প্রেরণা দিতে পারে যে কোনো লড়াকু মানুষকে। কে  রূপা চৌধুরী? 

সদ্য ত্রিশ পেরিয়েছেন রূপা। জীবনসংগ্রাম চালাতে গিয়ে সুইগি (Swiggy), ওলা (Ola), উবেরের (Uber) প্রথম মহিলা ড্রাইভার তিনি। ২০১৮ সাল থেকে এই কাজ করছেন। সুইগি ডেলিভারির পাশাপাশি বর্তমানে ওলা, উবেরের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহণের কাজও করেন। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নানান সামগ্রী আমাদের ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পর কাজ করেন যাত্রী পরিবহণের। কীভাবে এতোটা ক্লান্তিহীন হন তিনি? লাজুক হেসে জানান, কাজেই তাঁর মুক্তি। সততার সঙ্গে জীবন চালানোর এক উজ্জ্বল রূপকথা রূপা চৌধুরী। 

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

মুক্তগদ্য

মু ক্ত গ দ্য

রূ প ক  ব র্ধ ন  রা য়

rupak

পাঠক কে? খুড়োর কল নাকি রূপ সাগরের মনের মানুষ?

যে কথাগুলো লিখতে বসেছি, তারাই নিজে নিজে আমার কাছে এসেছে। আমিও যে তাদের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি বহুকাল ধরে নিচ্ছি সে কথাও মিথ্যে নয়, কিন্তু ওদের তর সইলো না। আর এসে এমন তোলপার বাঁধালো যে, আঙুল থেঁতলে আজ একটা রক্তারক্তি কাণ্ড না বাঁধিয়ে ছাড়বে না বুঝে খানিক ভয়েতেই তড়িঘড়ি লিখতে বসা! জমে থাকা কথা বেরোনোর পথ খুঁজলে কেমন একটা বুকে পেটে জ্বালা ধরে না? তেমন। কথাগুলো কবিতার মত শারীরিক। সে জিনিস আমি কেবল পড়তেই পারি, লিখতে পারি না! কাজেই যা লিখছি তার না আছে সৃজন-মস্তক, না আছে সাহিত্যের মুণ্ডু। না আছে তার গদ্যরূপ, না আছে কাব্যধর্ম। কেবলমাত্র নিজের শরীরকে শান্ত করার প্রয়োজনে এই কয়েটা কথার দলা ছুড়ে দিলাম…

একান্ত মনে এবং একক সত্তায় একটা লেখা পড়তে বসলে তবেই কি কেবল পাঠক হয়ে ওঠা যায়? তবে কি পড়ার পরতে-পরতে দুম করে এই যে রান্নাঘর থেকে চা-টা বা পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে আলুটা-চিনিটা আনতে গেলাম, অথবা বৈঠকখানায় টিভির পর্দায় মেসি-জাদুর ঝড়ের মধ্যেই হঠাৎ মনে পড়া কোনো কবির এক ছটাক পঙক্তিই যখন আমায় স্বপ্ন আর জাদু-বাস্তবতার মধ্যিখানের পানাপুকুরে নোঙর করে রাখলো অনেক্ষণ, সেবেলা আমার কি আর শুদ্ধ পাঠক হয়ে ওঠা হল না? কিন্তু সে কথাটা ঠিক করছে কে? আমার সঙ্গে সে লেখার ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার মালিকানা কার হাতে? বাজার নাকি নিসর্গ? যুক্তি নাকি আবেগ?

বন্ধুবান্ধবরা এ-নিয়ে মাঝেমধ্যে ঝগড়া করি বটে, গলাও হয়তো এক-আধবার সপ্তমে চড়ে যায়, কিন্তু তেমন মাঝি কই যে সৃজন-ভবের পাড়ে এ প্রশ্ন-তরী ভিড়িয়ে আমাদের শান্ত করে? সে প্রশ্ন নিয়ে এই যে আমাদের কথায় কথায় চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি, হপ্তা হপ্তা কথা, বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন, ঘুরেফিরে সবই শেষমেশ সে জ্বালারই প্রগলভ বিচ্ছুরণ! কোথায় সে পাঠক? কে সেই পাঠক? যার এতটুকু আদর-ছোঁয়ায় রাতবিরেতের আঁধার-কোনে একলা-মনে জমতে থাকা বদ্ধ-গলার কান্না-দলা শান্ত হবে?

গুরুজনেরা জানেন হয়তো সত্যিটা কি। কিন্তু আমার শরীর-মনের ভাবনাগুলো বিড়বিড়িয়ে কানের কাছে তাদের মত মন্ত্রনা জুগিয়ে বলে, কোথাও একজন আছেন যিনি বাজারের বাইরে বসে আমার লেখার ক্ষনজন্মা প্রভাব পেরিয়ে তাকে মহাকালের চোখ দিয়ে বিচার করেন, আর আমিও লিখি সে পাঠকের জন্যেই। আমায় অনর্থক ও বড্ড বেশি আশাবাদী ভেবে নেওয়াই যায়, তবে তার মানে এই নয় যে আমি বলছি তিনি এই সমাজের বাইরের লোক। বলতে চাইছি সমাজ মাধ্যম,গণমাধ্যম, শহর, মফস্বল, ককটেল, মাছের-বাজার, বন্ধু, শত্রু, গুরুজন সবাইকে মিলিয়ে-মিশিয়েও এই পাঠকটির এক ও অদ্বিতীয় স্পর্শনাতীত অস্তিত্ব থাকতে পারে। সঙ্গীত আর গদ্যের মাঝে কবিতার মত, বাজার আর নিসর্গের মাঝে সাহিত্যের মত, আবেগ আর যুক্তির মাঝে মধ্যবিত্তের মত, বেগ আর ভর-বেগের মাঝে অনিশ্চয়তার মত, কণা ও তরঙ্গের মাঝে দৈত্বতার মত, সৃষ্টিশীলতা আর পাগলামির মাঝে একটা সরু সুতোর ভারসাম্যহীনতায় তাঁর সেই একান্নবর্তী যাপন। তাঁর দেখা পাওয়ার তৃষ্ণাই আমার লেখার মূলধন, আমার রাস্তা; আবার তাঁর দেখা পেয়ে গেলেই আমার সৃজন-সত্তার মৃত্যু অবধারিত! তিনিই আমার খুড়োর কল, আমার রূপ সাগরের মনের মানুষ, আমার লিপিবদ্ধ বিভ্রম!

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

উদাসীন তাঁতঘর | পর্ব ১৫

ধা রা বা হি ক পর্ব ১৫

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

চারপাশে শুধু আলালের ঘরের দালাল

নব্বইয়ের দশকের মফস্বলের একজন যুবকের কথা মনে পড়ে। রুচির তোয়াক্কা না করেই একই সিনেমা হলে সে দেখেছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘তাহাদের কথা’ এবং অঞ্জন চৌধুরী ঘরানার ছবি ‘মেজবউ’। সেদিন বন্ধুদের কাছে তার জাত গেলেও মনে মনে সে সুখী ছিল। কেননা তার মনে হয়েছিল বাংলা সিনেমায় লগ্নীকৃত অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দায় তার আছে। ব্যক্তিগত সামান্য আয়োজন তবুও সে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি সেদিন। অথচ ভালো ছবি সম্পর্কে তার ধারণা বা পড়াশোনার অভাব ছিল না। কিন্তু উন্নাসিকতার চেয়ে অপেক্ষার মূল্য তার কাছে ছিল অনেক বেশি। তখন নব্বইয়ের সূচনা। কিছুদিন আগেই ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ শহর- মফস্বলের দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিল। তারপর চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়। ‘অমরসঙ্গী’ বা ‘গুরুদক্ষিণা’র মতো ছবির ভরসায় সামান্য সজীবতা এসেছিল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। গৌতম ঘোষ ( পদ্মানদীর মাঝি), অপর্ণা সেন ( যুগান্ত), বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ( চরাচর) একটি দুটি ছবি করে দূরত্ববাচক ভূমিকা নিয়েছেন। মফস্বলের দুএকটি সিনে ক্লাবে বিদেশি ছবি দেখানো হয় বটে কিন্তু সেই ছবির দর্শক বা সদস্য হাতে গোনা। এবং বাংলা ছবি নিয়ে তাঁদের ভরসা বা ভাবনা নেই। এই আবহেই এসে পড়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘ উনিশে এপ্রিল ‘ । সাধারণ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শক হলে গিয়ে ছবি দেখবার আগ্রহ বোধ করেন আবার। রুচির সঙ্গে আপোষ করতে হয় না। অপরদিকে প্রভাত রায়, বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের একটি দুটি ছবি প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছে গুণমান বজায় রেখেই। তবুও থমকে আছে চারপাশ। নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়ে লড়ছেন অঞ্জন চৌধুরী,বাবলু সমাদ্দার,হরনাথ চক্রবর্তী, অনুপ সেনগুপ্ত এবং এক ও একমাত্র স্বপন সাহা প্রমুখ। শিক্ষিত দর্শক সেই ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। মূলত গ্রাম এবং মফস্বলে তার প্রধান বানিজ্য। বাংলা ছবি আরও বেশি আঞ্চলিক এবং অসহায়। দৈনিক কাগজে বিপুল হিন্দি ছবির বিজ্ঞাপনের পাশে তার অসহায় উপস্থিতি কোনোরকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। দর্শকদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন। ক্রুদ্ধ স্বরে কোনো কোনো পরিচালক বলছেন গ্রামের অশিক্ষিত দর্শকের জন্য আমি সিনেমা বানাই না। অশিক্ষিত শব্দটির ভুল প্রয়োগ নিয়ে সেদিন খুব বেশি কথা ওঠেনি ।

শুধু নব্বইয়ের দশকেই স্বপন সাহা ছবি বানাচ্ছেন পঁয়ত্রিশটি। বছরে গড়ে পাঁচটি। পাশাপাশি রয়েছেন আরও কয়েকজন পরিচালক, তাঁরা একাধিক ছবি তৈরি করে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির হাল ফেরানোর চেষ্টা করছেন। এই পর্বে তরুণ মজুমদার থমকে আছেন। ‘আপন আমার আপন’,’ পথ ও প্রাসাদ’ বা ‘সজনী গো সজনী’ উল্লেখযোগ্য নয়। তুলনায় প্রভাত রায়ের ‘লাঠি’, ‘শ্বেত পাথরের থালা’, ‘সেদিন চৈত্রমাস’ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং চিরাচরিত সাধারণ দর্শকদের মন জয় করছে। এই পর্বে তাপস পাল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং রঞ্জিত মল্লিক একাই হিট ছবি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনজন নায়ক ( চিরঞ্জিত- অভিষেক-তাপস) দিয়ে ছবি হিট করানোর অসহায় চেষ্টা চলছে। হয়তো খরচ কমাতেই নায়িকার মা নেই এবং নায়কের বাবা নেই। অথবা উল্টোটা। অবস্থা এমন ভিলেনের মারুতি ভ্যান এবং সাঙ্গোপাঙ্গ পর্যন্ত কমন হয়ে গেছেন। চিত্রনাট্যের যুক্তি খোঁজা অর্থহীন। এমনকি অভিনয়ের মাত্রা মেলোড্রামার দিগন্তে পাড়ি জমিয়েছে। ‘বাবা কেন চাকর’, ‘কমলার বনবাস’,’সখি তুমি কার’ এইসব ছবির নাম শুনে কোনো কোনো দর্শক ভাবছেন এখনকার সিনেমা আসলে যাত্রাপালা। কিছুদিন পর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রত্যাখান করবেন ‘ সাথী’ ছবির কাজ। তাঁর মনে হল নতুন কোনো অভিনেতা এই ছবির পক্ষে মানানসই। এরপর জিৎ,দেবের হাতে উঠে আসছে দায়িত্বভার। উত্তরসূরী নির্বাচন করে প্রসেনজিৎ অনিবার্য হয়ে রইলেন ভিন্ন ধারার ছবিতে এবং প্রাসঙ্গিক। বাংলা ছবির চিরাচরিত প্রেক্ষাপট বদলে গেল। বিদেশের লোকেশন ,উন্নত ক্যামেরা সর্বভারতীয় বানিজ্যিক ছবির আবেদন ফিরে এল বাংলা সিনেমায়। এখন আর বাজেটের দৈন্য নেই। দক্ষিণী ছবির রিমেক এবং তার পাশাপাশি পার্শ্ব চরিত্রের অভিনব গুরুত্ব নিয়ে সে কিছুদিন পথ এবং পন্থায় দ্বিধাগ্রস্ত। এই ছবির দর্শকের সঙ্গে সেদিনের দর্শকের যোজন যোজন দূরত্ব। সব একধাঁচ,সব এক রং তবু কী নিদারুণ দৈন্য! বিনিয়োগে এবং বিনোদনে কর্পোরেট চাহিদাই শেষ কথা। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে ইদানীং হয়তো বাংলা সিনেমা দর্শকের চেয়ে কর্পোরেট এবং মিডিয়ার আনুকূল্য প্রার্থনা করছে বেশি। তাঁর অন্ধ আকুলতা লগ্নীকৃত অর্থের উৎস নিয়ে বিচলিত নয়। তাই চতুর্দিকে আগাছার মতো প্রযোজকের বিনিয়োগকে সে সুদিন ভেবে নিশ্চিন্ত হতে চায়।

নব্বইয়ের বাংলা সিনেমায় ঋতুপর্ণ ঘোষের আবির্ভাব একটি ঘটনামাত্র নয়। বরং তার ঐতিহাসিক এবং সামাজিক তাৎপর্য আছে। ‘উনিশে এপ্রিল’ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শককে আবার হলমুখী করল। স্বপন সাহার ছবি দেখতে রুচিবোধের সমস্যা ছিল তাঁর। এই ছবি একইসঙ্গে বিনোদন এবং মার্জিত রুচির মেলবন্ধন। অনেকদিন দর্শক যেন এমন একটি ছবির অপেক্ষায় ছিলেন। চিত্রনাট্যের বাঁধন এবং ছবি নির্মাণের অনেকখানি পরিচ্ছন্ন ও মৌলিক বোধ দেখে দর্শক মনে করলেন এই পরিচালকের উপর ভরসা করা যায়। নব্বই দশকে ঋতুপর্ণর তেমন তাড়া ছিল না। ‘দহন’,’বাড়িওয়ালি’ এবং ‘অসুখ’ করেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর পরবর্তী ছবি ‘উৎসব’ একটি চ্যানেলের জন্মদিনে সম্প্রচারিত হল। আর দূরদর্শন নয়। বরং অনেক কেবল চ্যানেল আর প্রতিদিন হরেকরকম ছবির হাতছানি হয়ে উঠল দর্শকের ভবিষ্যৎ। হিন্দি কিংবা বাংলা ছবি প্রতিদিন এত বেশি সম্প্রচারিত হল যে সিনেমা যে হলে দেখতে হয় এই ভাবনা অবান্তর হয়ে গেল কিছুদিন। দর্শক ঘরের কোণে নিশ্চিন্ত হতে চাইলেন। এমনকি লোকাল কেবল চ্যানেল হল প্রিন্ট সাম্প্রতিক ছবির প্রচার শুরু করল গোপনে। সুখী গৃহকোণ গ্রামাফোনের বদলে স্মার্ট টিভি দখল করল। তখনও প্রযুক্তির হাত ধরে হরেকরকম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসেনি।

ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা সিনেমার প্রথম সেলিব্রিটি পরিচালক। এর আগে আমরা কিংবদন্তি বা প্রতিভাবান পরিচালক দেখেছি। এই প্রথম সেলিব্রিটি পরিচালকের দেখা পেলাম। এই পরিস্থিতি বাংলা চলচ্চিত্রের পক্ষে খুব সুখকর হয়নি। তাঁর পাশে দাঁড়াল জনপ্রিয় মিডিয়া। তাঁর দুর্বল ছবি ফাঁকা মাঠে জাতীয় পুরস্কার আনল ঘরে। দেশি বিদেশি নানা পুরস্কার, আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মুড়ি মুড়কির মতো কেবলই নির্বিচার স্বীকৃতি দিল তাঁকে। স্বঘোষিত এক অভিভাবকের সম্মান পেলেন তিনি। সাধারণ দর্শক বুঝতে পারছেন না তিনি কার প্রকৃত উত্তরসূরী? অজয় কর? সত্যজিৎ রায়? তরুণ মজুমদার? কার? নাকি তিনি নিজেই একটি পথভ্রষ্ট পথ! বিপুল উচ্ছ্বাসে বিচারের তেমন সুযোগ রইল না। শুধু অঞ্জন চৌধুরী বা স্বপন সাহাকে উপেক্ষার আগে আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা না করলে শিল্প শেষপর্যন্ত মুখথুবড়ে পড়ে।

তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠলেন একদল মধ্যমেধার অনুসরণকারী পরিচালক। তাঁদের হাতে প্রতিভার চেয়ে প্রযুক্তির কদর বেশি। এঁরাও তাঁরই মতো সেলিব্রিটি। কোনো বিষয়ে দুটি একটি বই পড়ে চিত্রনাট্যকে গবেষণা মনে করতে ওস্তাদ। ছবির আগে দৌড়োয় তাঁদের জীবন ও বিতর্ক। পঞ্চাশের দশকে কবিতার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল কবির রঙিন জীবন। এখানেও সিনেমা নয় মুখ্য হয়ে উঠল ব্যক্তিজীবন বা হাস্যকর এবং বিতর্কিত অগভীর গবেষণা। তবুও প্রশ্ন ওঠে না। নৈশভোজের অর্থই ঠিক করে দেয় রিভিউয়ের নামে জনস্বার্থে প্রচারিত অলৌকিক কয়েকটি সম্ভাবনা। আজ বাংলা ছবির বিপণন বদলেছে অনেকখানি। আজ প্রযোজক পরিচালক অভিনেতা অভিনেত্রীর তরফে প্রিমিয়ার নিয়ে যতখানি ভাবনা, ছবিটি সম্ভাবনা হিসেবে প্রিম্যাচিওর কিনা সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। এমনই এক পরিস্থিতিতে আওয়াজ উঠেছে ‘ বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান।’ হয় দাঁড়াবার জায়গা নেই অথবা প্রয়োজন নেই।

এইমুহূর্তে কী করছেন বাংলা সিনেমার সেইসব পরিচালকের দল? যাঁরা রুচির সঙ্গে সমঝোতা না করেই বানিজ্যসফল ছবি করে আমাদের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন একদিন । দক্ষিণী ছবির রিমেকের রুদ্ধ পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন আবার বাংলা ছবির দর্শকদের। সিনেমা হলে,হোক সে মাল্টিপ্লেক্স, তাঁরা আবার ভীড় জমাচ্ছেন। তবুও আজ তাঁদের অহেতুক আপোষ আর আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখে ভয় হয়। যে ভাবনা দিয়ে একটি দৃশ্য নির্মিত হয় সেই ভাবনাকে টেনেহিঁচড়ে একটা গোটা ছবি বানিয়ে ফেলছেন তাঁরা নির্দ্বিধায়। মাথায় যেকোনো ভাবনা এলেই তাকে চিত্রনাট্যে রূপ দিচ্ছেন। সর্বব্যাপী চিটফান্ডলালিত প্রযোজকের অভাব নেই। বহুপ্রসব হয়ে উঠেছে এখন তাঁর ধর্ম। প্রশ্ন করলেই শুনতে হয় আমাদেরও তো রোজগার করতে হবে, অন্তত আর্থিক নিরাপত্তাটুকু। যুক্তিহিসেবে অস্বীকারের উপায় নেই। শুধু বলা যায় রোজগারের জন্য অন্য কোনো পথ( চাকরি বা নিছক জমির দালালি) আরও নিরাপদ নয় কি? তাছাড়া রোজগারের জন্য আপোষ করব আবার শিল্পীর ( জাতীয় বা আন্তর্জাতিক) মর্যাদা চাইব একসাথে দুটি কিন্তু নাও মিলতে পারে! শিল্পীর অভিমান অতি বিষম বস্তু। এমনকি বেদনাও। তবুও আবেদন চলছে। নিবেদন চলছে। নিজের অতিকায় ছায়াটিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে লালন করেও চাহিদা ফুরোয় না। জীবনের সঙ্গে তাঁর প্রাত্যহিক যোগ শিথিল। তাঁকে কেউ বুঝিয়ে দেবার নেই একজন পরিচালককে সেলিব্রিটি হলে চলে না বরং সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পর্ক খুব কাছ থেকে না দেখলে সে পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। এদিকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত টাকার লেনদেনে ফুলেফেঁপে ওঠে নায়ক- নায়িকার মহিমা। প্রিমিয়ার, সাকসেস পার্টির তামাশায় কোটি কোটি টাকার ফানুশ ওড়ে। সেই আকাশে বাংলা সিনেমার জন্য সামান্য ভাবনার ছায়া পড়ে কি?আজ বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানো এক অর্থে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রযোজকের পাশে দাঁড়ানো। কয়েকজন সাংস্কৃতিক বেশ্যার জন্য অশ্রুসংবরণমাত্র। মিডিয়া – কর্পোরেটের গোপন আঁতাতের পাশে দাঁড়ানো। আজ দর্শক কিংবা সমালোচকের বলার অধিকার নেই আপনার ছবি কিস্যু হয়নি। বলা সাজে না আপনি এই চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেননি। শুধু গোলগাল রিভিউ। যাঁর পুঁজির জোর নেই তাঁর মুদ্রাদোষ নিয়ে আস্ফালন। নীরবতার রাজনীতি দিয়ে বাতিল করে দেওয়া স্বল্পপুজির সম্ভাবনাময় সিনেমাগুলিকে। আজ বাংলা সিনেমার পাশে অনেক রাজনৈতিক মাফিয়া, ছদ্মবেশী তোলাবাজ। তাই ‘ বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান ‘ কথাটি শেষপর্যন্ত জনান্তিকে ঝুলে থাকে। দর্শক না হলেও তাঁর দিব্যি চলে যায়। সব আয়োজন আজ প্রয়োজন বিমুখ। এখন নব্বইয়ের দশকের মফস্বলের সেই যুবকটি বেশ বুঝতে পারে বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য তার গোপন অনুরাগ আজ বৃথা এবং উচ্ছিষ্ট। বরং সিনেমা হলের দর্শক ছাড়াই আজ বাংলা সিনেমার দিব্যি চলে যায়। এখন তার কোন অসুখ সে চিনতে পারে না। আরোগ্যের প্রতিভা তার নেই। আজ চারপাশে শুধু রঙিণ মাল্টিপ্লেক্স। চারপাশে শুধু আলালের ঘরের দালাল।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি । পর্ব ৭

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৭

স ব্য সা চী   স র কা র

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি

sabyasachi

পাড়ার ট্রফি পাড়ায় থাকবে…

‘অ্যাই ছেলে, তোর মুখটা অমন শুকনো কেন রে? চুরমুর খাবি?’ 

আমাকে দেখতে পেয়েই তিস্তাদি হেসে এগিয়ে এসেছে। তখন ক্লাস ইলেভেন, ইংলিশ স্যারের কোচিং ক্লাসে গিয়ে টুসি বলে একটা মেয়ের প্রেমে ফেঁসে গিয়েছি, কিন্তু সাহস করে কিচ্ছু বলতে পারছি না। তাকে নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতা লিখে ফেলছি, কিন্তু দিনের শেষে হাতে থাকছে পেন্সিল! তার উপর আবার টুসির জন্য ছেলেদের লম্বা লাইন। কোচিং ক্লাসের শেষে বান্ধবীদের সঙ্গে খিলখিল করে হাসতে হাসতে টুসি চলে যায়। দু’একদিন ওর বাবাও বাইক নিয়ে নিতে আসেন। জাঁদরেল গোঁফ, লম্বা-চওড়া চেহারা, দেখলেই মনে হয়, ভদ্রলোক কোনও হোমরা-চোমরা হবেন। 

একা একা বাড়ি ফেরার সময়ে আমার সব কিছু বিচ্ছিরি মনে হয়। মনে হয়, দেওয়ালে একটা ঘুষি মারি, বা নেড়ি কুকুরটাকে টেনে মারি একটা লাথি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছুই করা হয় না, মনের ভিতরে কিলবিল করে নানা রঙের রহস্যময় সব ভাবসম্প্রসারণ। তা এই একা একা বাড়ি ফেরার সময়ে গোলপার্কের মোড়ে কখনও-সখনও দেখা হয়ে যায় তিস্তাদির সঙ্গে। তখন দিনটা কেমন করে যেন ভালো হয়ে যায়। এই ধরা যাক, টিউশন সেরে ফিরছে। খোলা চুল, পানপাতার মতো মুখ, চোখে নিখুঁত করে দেওয়া কাজল, বাঙালি মেয়েদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। মাথাটা একদিকে একটু কাত করে ‘কী রে?’ বললেই শেষ! আমার হৃৎপিন্ড দপ করে ওঠে, কোনও এক আশ্চর্য ম্যাজিকে মন খারাপ ভ্যানিশ করে যায়, আমি ভ্যাবলার মতো হাঁ করে তিস্তাদিকে দেখি। তিস্তাদি তখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এমএ ফার্স্ট ইয়ার, ইকনমিক্স অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস। তার উপরে একটু তাকালেই চোখ পুড়ে যেতে পারে। একেবারে ‘চনমন করে রক রাস্তারা’ কেস। এককথায়, আমাদের পাড়ার সবচেয়ে মহার্ঘ্য কোহিনূর।

আমি দেখেছি, তিস্তাদি যখন সন্ধেয় ফেরে, পাড়ার ক্লাবে ক্যারম পেটা স্তব্ধ হয়ে যায়, পার্টি অফিসের সজলদা-খোকনদারা বিশ্রীভাবে তাকায়। শুধু ওরাই বা কেন, আরও অনেকে তাকায়। মিষ্টির দোকানের বুড়ো মালিক বাহাত্তুরে খগেন ঘোষ এগিয়ে এসে দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘অ্যাই যে মেয়ে, বাবা ভালো আছে?’ খগেন ঘোষের কুতুকুতে চোখ ঘোরাফেরা করে তিস্তাদির শরীরে। তিস্তাদি ‘হ্যাঁ, ভালো’ বলে মৃদু হেসে চলে যায়। একদিন সজলদাদের রক থেকে কেউ একটা আওয়াজ দিয়েছিল, ‘ওই যে মাধুরী যাচ্ছে! এক-দো-তিন!’ 

‘চার-পাঁচ-ছে’ বলার আগেই তিস্তাদি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল রকের দিকে, ‘কে বলল? দম থাকলে সামনে এসে বলুক!’ ব্যস, মুহূর্তে রক স্তব্ধ। এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি। কেঁচোর মতো গুটিয়ে যাওয়া সব চোখমুখ। কিন্তু সেটা সাময়িক। আমি জানি, তিস্তাদির রাত করে ফেরার সময় সজলদাদের গ্রুপটা ওত পেতে থাকে।

সজলদাই একদিন আমাকে ধরেছিল, ‘অ্যাই, তোর সঙ্গে তিস্তার এত কথা কীসের রে? সেদিনও দেখলাম, গোলপার্কের মোড়ে মৌচাকের সামনে…’

আমি কাঁচুমাচু হয়ে বলি, ‘তিস্তাদিই আমাকে চুরমুর খাওয়াল…’

সজলদা কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘বড় দিদি পাতানো হচ্ছে? বলে দিবি, আমরা সব খবর রাখি! কোথায় কী লটরপটর চলছে, সব জানি! পাড়ার ট্রফি পাড়াতেই থাকবে, বুঝেছিস?’

আমি কিছু বলি না। কিন্তু লটরপটর ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারি। তিস্তাদির বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পাড়ার লোক জানে শেখরবাবু সজ্জন মানুষ। আমরা ছোটরা জ্যেঠু বলি। জ্যেঠু খুব একটা বাইরে বোরেন না। মাঝে মাঝে দোতলার বারান্দায় বসে দীর্ঘ সময় ধরে খবরে কাগজ পড়তে দেখেছি। তাঁর কাছে মাঝে মাঝেই আসে জয়দীপদা বলে একজন পুরনো ছাত্র। মাঝে মাঝেই তিস্তাদি দোতলা থেকে নেমে আসে জয়দীপদা ফেরার সময়ে। দু’জনে কিছুক্ষণ কথাও বলে। তার পরে সাইকেলে করে জয়দীপদা চলে যায়।  

জ্যেঠুর সঙ্গে তিস্তাদি একা থাকে, মা বছর পাঁচেক আগেই চলে গিয়েছেন। জ্যেঠু একাই মেয়েকে বড় করেছেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তিস্তাদির সঙ্গে জয়দীপদার কিছু একটা আছে। কিন্তু সাহস করে তিস্তাদিকে সেসব বলা যায় নাকি! 

এ ভাবেই চলে যাচ্ছিল, যেমন চলে যায় দিনগুলো। আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে গেল দোলের দিন। সকাল থেকে পাড়ায় রঙ খেলা চলছে, আমরা আমাদের গলিতে খেলছি। পিচকিরি দিয়ে বেলুন ফোলাচ্ছি আর একে-ওকে মারছি। ঘিয়ে রঙের একটা পাঞ্জাবি আর নীল জিন্স, জয়দীপদার সাইকেলটা এসে দাঁড়িয়েছিল শেখর জ্যেঠুদের দোতলা বাড়ির দরজায়। সাইকেল বাইরে পার্ক করা, আমরা দেখেছি। কিছুক্ষণ পরে জয়দীপদা নেমেছে, চুলে আর মুখে আবিরের গুঁড়ো, জামাতে রঙ। সঙ্গে নেমেছে তিস্তাদি। চোখে-মুখে আবির, সালোয়ার কামিজে রঙের ছিটে। দোলের দিন রঙ মেখে ভূত হয়ে গেলে মেয়েদের কেন এত বেশি সুন্দর লাগে, কে জানে! 

আমাদের গ্রুপের ভুতো সোজাসুজি জয়দীপদার পাঞ্জাবিতে একটা বেলুন মেরে হি হি করে হাসছে। তিস্তাদি হেসে বলছে, ‘দে দে, ভিজিয়ে দে!’

আমরা কয়েকজন চারপাশে। তার মধ্যেই কোত্থেকে চলে এলো দুটো বছর কুড়ির মেয়ে। দু’জনের মুখেই প্রচুর রঙ, ভিজে পোশাক। একজনের গায়ে সালোয়ার কুর্তা, অন্য মেয়েটা প্যান্ট শার্ট। সালোয়ার কুর্তা সোজা এগিয়ে এসে জয়দীপদার সাইকেলটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘হ্যাঁ, এই ছেলেটাই। ভেবেছিস, পালিয়ে বাঁচবি! দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি!’

জয়দীপদা হতচকিত। তিস্তাদিও। জয়দীপদা বলে, ‘সাইকেলটা ফেলে দিলেন কেন? কী হয়েছে?’

এটুকু বলেছে কি বলেনি, দ্রুত সেখানে ম্যাজিকের মতো সজলদা-খোকনদা, সঙ্গে পাশের বস্তির চাঁদু। চাঁদুর ষণ্ডা চেহারা, বলা নেই, কওয়া নেই, সোজা জয়দীপদার গালে একটা থাপ্পড় মেরে বলে, ‘বেপাড়ায় ঢুকে বেলেল্লাপনা হচ্ছে? আজ তোর শেষ দেখে ছাড়ব!’

আরও তিন-চারজন মুহূর্তে হাজির, এই মুখগুলো আমি পার্টি অফিসে দেখেছি। তার মধ্যেই সালোয়ার পরা মেয়েটা কাঁদছে, ‘আমি আর সীমা পুরনো গলির পাশ দিয়ে আসছিলাম। ও সাইকেলে ছিল। আমাদের একা পেয়ে জোর করে আবির মাখিয়ে… তারপর— আমি বলতে পারব না…’

 সজলদার গলা পাওয়া গেল, ‘তোরা ছেড়ে দিলি?’

জিন্স পরা মেয়েটা বলে, ‘ধরব কী করে, তার আগেই সাইকেল নিয়ে পালাল…’

তিস্তাদি বলার চেষ্টা করছে, ‘আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এটা হতেই পারে না!’

চাঁদু পাল্টা তুই তাকারি শুরু করে, ‘তুই ভেতরে যা! লাভার ধরা পড়েছে! এখন রামক্যালানি হবে!’

শুরু হল বেধড়ক মার। আওয়াজ উঠল, ‘ভদ্দরলোকের ছেলে হয়ে এই কীর্তি!’ চলে এলেন খুচরো নেতা। বসে গেল খাপ পঞ্চায়েত। পুলিশ ডাকার কথা উঠছে। দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন বৃদ্ধ শেখর জ্যেঠু। আশেপাশের বারান্দায় উৎসুক মুখ, যেন সার্কাস দেখছে সবাই!

খুচরো নেতা বিকাশ মল্লিক তার মধ্যেই বিধান দেন, ‘আর মারিস না সজল, মরে যাবে! পার্টি অফিসে নিয়ে চল। জামা প্যান্ট খুলিয়ে কান ধরে ওঠবোস করা। তাতে যদি শিক্ষা হয়!’

জয়দীপদার মুখ ফেটে গিয়েছে, রক্ত বেরচ্ছে। তার মধ্যেও বলছে, ‘আপনারা ভুল করছেন!’

কিন্তু কেউ শুনছে না। তিস্তাদি ঝাঁপিয়ে পড়তে যেতে কয়েকটা মেয়ে টেনে সরিয়ে দেয়। জয়দীপদাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে সজলদারা।

 বিকাশ মল্লিক এ বার গলা তোলে, ‘ভিড় করার কিছু নেই। যান, সবাই দোল খেলুন। যত সব উটকো ঝামেলা!’

তিস্তাদিকে কোথাও দেখতে পাই না। দরজা বন্ধ। জ্যেঠুকেও না। আমাদের দোলের তার কেটে যায়। যে যার বাড়ি থেকে ডাক আসে। কোথাও একটা কেটে যায় তাল। শ্যাম্পু আর সাবান মেখে বাথরুমে রঙ তোলার সময় গা চিড়বিড় করে। জয়দীপদা এরকম করেছে? 

 দোলের পরে দিন দুই কেটে গেলেও তিস্তাদিকে দেখতে পাই না। জ্যেঠুকেও না। কিন্তু পার্টি অফিসে সজলদাদের সঙ্গে একদিন সেই মেয়ে দুটোকে চোখে পড়ে। পোস্টার লিখছে। 

তিন দিন পরে কাগজে ছোট করে একটা খবর বেরোয়। শিরোনাম, ‘যুবকের আত্মহত্যা!’

মাত্র কয়েকটা লাইন। ভিতরের পাতায়। স্টাফ রিপোর্টার লিখছেন: 

‘শনিবার দুপুরে ঢাকুরিয়ার পঞ্চাননতলার এক ফ্ল্যাটে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় এক যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। যুবক মেধাবী ছাত্র হলেও দোলের দিন তাঁর নামে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল বলে খবর। যদিও যুবকের মা এই অভিযোগ মিথ্যে বলে দাবি করেছেন। মৃতের নাম জয়দীপ চক্রবর্তী। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। পুলিশ আত্মহত্যা বলেই সন্দেহ করছে। অন্য কারণ থাকলেও তা খতিয়ে দেখছে।’

তিস্তাদি? তার কী হল? মাসখানেকের মধ্যে জ্যেঠু মারা যান। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার গাড়িতে শেষবার দেখেছিলাম তিস্তাদির মুখ। প্রতিক্রিয়াহীন। পাথরের মূর্তির মতো। তার পরে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল, কোথাও একটা হারিয়ে গেল তিস্তাদি। 

আমাদের পাড়ার ট্রফি!  

ক্রমশ

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar anubad

থিক নাত হানের কবিতা

অ নু বা দ

ভাষান্তর: শী র্ষা

sirsha

থিক নাত হানের কবিতা

থিক নাত হানের জন্ম ১৯২৬ সালের ১১ই অক্টোবর। সমগ্র বিশ্বে এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পরিচয় একজন জেন সন্ন্যাসী হিসেবেই। বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধ মতবাদের প্রচারকার্যে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষকতাও করেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় (১৯৬৩-১৯৬৬) তাঁর শান্তিবার্তার প্রচার সর্বজনবিদিত। কিন্তু এসবের বাইরেও তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে – তিনি একজন কবি। তাঁর কবিতায় শান্তি, প্রেম এবং অহিংসা একমাত্র সত্য হয়ে ফুটে ওঠে। তাঁর লেখা ‘কল মি বাই মাই ট্রু নেমস’ (Call Me by My True Names) বইটির পাতায় পাতায় তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অহিংসার গন্ধ। দীর্ঘ রোগভোগের পর গত ২২ জানুয়ারী, ২০২২ তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন তথাগতের দেশে। রেখে গিয়েছেন তাঁর চিরন্তন অস্তিত্ব। তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

আমরা আবার ফিরে আসব

এক থেকে তিন হবে।

এক থেকে চার হবে।

এক থেকে এক হাজার হবে।

আমরা আবার ফিরে আসব।

আবার আমরা ফিরে আসব।

 

এখানে বৃষ্টির ছুটোছুটি,

আর মনের সুবিশাল সমুদ্র।

আমি চমৎকারভাবে এই সুউচ্চ ঢেউয়ের

ওপর দিয়ে এগোচ্ছি –

পাহাড় ও পর্বতমালা, পাহাড় এবং পর্বতমালা,

সমুদ্র ও নদী, সমুদ্র এবং নদী –

আলবাট্রসের ডানা খেলা করছে

প্রভাতী সূর্যোদয়ের সঙ্গে

 

তুষার এবং আলো কি একই জিনিস?

শিশুর ঠোঁটে গানটি এভাবেই চলতে থাকুক!

 

তুমিই আমার বাগান

আমার বাগানে একটি গাছ মৃত্যুমুখী।

তুমি দেখছ সেটা,

পাশাপাশি তুমি অন্যান্য গাছগুলিকেও দেখতে পাচ্ছ

যারা এখনও প্রাণোচ্ছ্বল এবং আনন্দময়।

 

এবং আমি কৃতজ্ঞ।

 

আমি জানি আমার বাগানে একটি গাছ মৃত্যুমুখী,

কিন্তু এটিকেই

আমি আমার সম্পূর্ণ বাগান হিসেবে

দেখি না

 

আর আমাকে একথা মনে করানোর জন্য

আমার তোমাকে প্রয়োজন।

 

আমাকে বলা হয়েছিল

পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া এই বাগানের যত্ন নিতে।

একটি বাগান জুড়ে সর্বদাই অনেক সুন্দর  

এবং কিছু অপুষ্ট গাছও থাকে

যে কারণেই আমাদের

বাগানের যত্ন নেওয়া উচিত।

 

তুমিই আমার বাগান,

আর আমি জানি আমার একজন

মালী হয়ে ওঠাটুকু অভ্যাস করা উচিত

 

আমি একটি পুরোনো ও যত্নহীন বাগান দেখেছি

যেখানে চেরি আর পিচ গাছগুলো

আজও বিস্ময়করভাবে ফুলে ভরে ওঠে

সঠিক সময়মতো 

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

ক্যানভাস

ক্যা ন ভা স

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

suvo

একা মানুষ কর্পোরেট দুনিয়ার উৎকৃষ্ট জ্বালানি। ‘দলবদ্ধ প্রতিবাদের ভাষা’ এই প্রদর্শনীর ছবিগুলির অন্তর্লীন যোগসূত্র...

সম্প্রতি ‘দ্য ফ্রেম’ তাদের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বর্ষব্যাপী কর্মসূচীর সমাপ্তি হিসাবে বিড়লা একাডেমীতে আয়োজন করেছিল এক চিত্র প্রদর্শনীর। শিরোনাম ছিল ‘Quest’। দলবদ্ধ প্রয়াসকে অর্থহীন প্রমাণ করার যে কুটিল চক্রান্ত চলছে  চারপাশে তাকে বুড়ো আঙুল দেখানোই ছিল ‘দ্য ফ্রেম’-এর উদ্দেশ্য। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই এখন কর্পোরেট দুনিয়ার লক্ষ্য। তাহলে তাকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে অনায়াসে। চিরকালই কর্পোরেট দুনিয়ার অলিন্দে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের দল বিপদের কালো ছায়া ফেলে আসে। একক মানুষ বলা ভালো একা মানুষ কর্পোরেট দুনিয়ার উৎকৃষ্ট জ্বালানি। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ‘দলবদ্ধ প্রতিবাদের ভাষা’-ই এই প্রদর্শনীর ছবিগুলির অন্তর্লীন যোগসূত্র। অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের এই প্রদর্শনী উপলক্ষে বলা বিষয় ধারণার লেখাগুলির উপর চোখ বোলালেই তা স্পষ্ট হয়। প্রখ্যাত শিল্পী গণেশ হালুই-এর উপস্থিতি ‘দ্য ফ্রেম’-এর এই উদ্যোগের সফলতারই ইঙ্গিত করে।  তাঁদের এই প্রয়াস জারি থাক। মানুষ বাঁচুক সংঘবদ্ধ ভাবে।

অরুণাংশু রায়, আধুনিকতাকে দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করতে চাইছেন। আধুনিক সমাজের জটিল বিন্যাস, কুটিল গতিবিধি এড়িয়ে প্রাক আধুনিক সমাজ জীবনের সহজ যাপনের হদিস পেতে চাইছেন, যে আধুনিকতা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে যে বিজ্ঞান, রসায়নাগারে মারণ ভাইরাস তৈরি করে সারা পৃথিবীকে এক মৃত্যুউপত্যকায় পরিণত করেতোলে, সেই বিজ্ঞান মনস্ক আধুনিক সমাজের থেকে দুরে সহজ জীবনের খোজ করতে চান। সহজ এক চিত্রভাষা তৈরি করতে চান, যা  আদিম সমাজের চিত্রভাষার লক্ষণ সম্পৃক্ত। যে চিত্রভাষা, রেখায় এবং আকারে আধুনিক সমাজকে বিদ্রুপবিদ্ধ করতে সক্ষম।

বিশ্বজিৎ সাহা তার বর্তমান চিত্রগুচ্ছে ভারতিয় পুরাণের একগুচ্ছ দেবপ্রতিমা নিয়ে ভেবেছেন , মানবেতর প্রাণীর, পক্ষীমস্তক মানবশরীরধারী দেবদেবী চিত্রপ্রতিমা এঁকেতুলেছেন, যে প্রতিমা সেই সমাজের নির্মাণ যেখানে মানুষ,প্রকৃতি,এবং মানবেতর প্রাণের সহঅবস্থান। আরও বিস্তৃত অর্থে এই জল, এই মাটি, এই আলোর উপর সর্বপ্রাণের সমান অধিকার । বিশ্বজিৎ যে রং রেখায় এবং যে আকার ব্যাবহার করেছেন তা আহরণ করছেন উত্তর ধ্রুপদী চিত্রভাষা থেকে।

বিভূতি চক্রবর্তী তার ছবিতে বিষয় হিসাবে ভেবেছেন সমকালের মানুষের সমস্যা। এই বর্তমান সময়ে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ কর্পোরেট দুনিয়ার লাভের জোগানে প্রতিবন্ধক ।একলা, স্বয়ংসম্পূর্ণ,প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন একক মানুষ যন্ত্র বিশেষ। তবে আর এই নতুন সমাজে শিল্প,সাহিত্য চর্চার ভবিতব্য কি? হেতুই বা কি? এই একলা, নিসঙ্গ,স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষকে নিয়ে ছবি আঁকছেন বিভূতি চক্রবর্ত্তী ।

দেবাশিস সামন্ত তার ছবির বিষয়ে বলছেন।যে সচল এবং অচল বস্তু আমার চারপাশে । যে ঘটনার সংঘাত এড়ানো গেল অথবা এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। সেই সংঘাত সংস্পর্শে যে নতুন বোধ জন্মনিলো আমার মনে। সেই বহুধাবিস্তৃত ঘটনা  আমার দিনযাপনের অংশ। সেই সব সংঘাতের সারাৎসার চিত্ররূপে প্রকাশ পায় সহজ সরল আকার , রঙ এর সংঘাতে। সে সব রং এই মাটির। সে সব আকার এই বাঙলার। প্রাচীন অথবা আধুনিক সে সব রেখা লোকশিল্পের ধারা বেয়ে এসে উঠেছে আমার ছবির শরীরে।

জয়ন্ত ভট্টাচার্য তার ভাস্কর্যে সমকালীন সময়ের ফুলে ওঠা,  ফেঁপে ওঠা রঙচংএ বেলুনের মতন অন্তসার শূন্য সমাজের শিৎকার, অর্থহীন সংস্কৃতির ঢঙ্কানিনাদ, নীতিহীন রাজনীতির বজ্রনির্ঘোষ তার ভাস্কর্যে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। বেলুনের মতনই নির্বোধ দম্ভ যেকোন মুহুর্তে ফেঁসে যেতে পারে। চুপসে যেতে পারে রংচংএ ফাঁপা আধুনিকতা ।

প্রাণগোপাল ঘোষ, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তার চিত্রপটে আশ্রয় দিয়েছেন। এই প্রকৃতি যা কিনা সমস্ত জটিলতা থেকে দূরে এক শান্তিনিকেতন রচনা করে।

রবীন রায়, এই বিশ্বজোড়া ক্ষমতার নজরদারির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।  তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন নজরদারি চলছে ক্ষমতার কর্তৃত্ব কায়েম রাখবার স্বার্থে। আপামর জনসাধারণ তাদের নিজের দেহের এবং মনের  অধিকার , ভাবনার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে পুজিবাদি ক্ষমতার আগ্রাসী আক্রমণে । রবিনের কালি তুলির ব্যবহারে মানব শরীর নির্মানের পদ্ধ্তির মধ্যে  চাবুকের ঘায়ে ক্ষত বিক্ষত কীটের জীবন প্রকট হয়ে ওঠে।

সীতাংশু মন্ডল, মানব দেহ, সমাজ দেহ একাকার করে ভেবেছেন। সমাজ দেহ সচল রাখতে রসদ জোগান দেবার, সংযুক্ত রাখবার জন্য জলধার থেকে ঘরে ঘরে বিস্তৃত জলনালির জাল এখানে মানবদেহ অভন্তরে কোষে কোষে রক্তসংবহন তন্ত্রের রূপক । জলের ভাণ্ডার মানব হৃদয়ের রূপক, জলনালিগুলি রক্তনালিকা রূপক । এই বন্টন ছাড়া শরীরের সমস্ত অঙ্গগুলি যেমন বেঁচে থাকতে অক্ষম । সুষম বন্টনও তেমনি সমাজের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে ।

স্বপন কুমার মল্লিকের এই প্রদর্শনীর চিত্রগুচ্ছ তৈরি হয়ে উঠেছে কভিদ পরিস্থিতির আবহে। কভিদ সারা পৃথিবীর মানব জাতির সামনে জীবনের অনিশ্চয়তা উদ্ঘাটিত করে তুলেছে। সেই প্রচন্ড অভিঘাতে মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা মিথ্যা ঠেকে । জীবন এবং মৃত্যুর এই সহাবস্থান মানুষকে জীবনের মূল অর্থ নতুন করে খুঁজে নিতে আত্মগত হতে, নিজের মনের সুশ্রষার কাছে ফিরতে বাধ্য করে তোলে। একজন শিল্পীহিসাবে এই উপলব্ধি উচ্ছল রং,প্রতীকী আকারের আশ্রয়ে চিত্রপটে স্থায়ী করবার প্রেরণা জোগায় তাকে।

শুভ্রকুমার ব্যন্দ্যোপাধ্যায়, নানান মাধ্যমে, বিচিত্র সার্ফেসে, উচকিত রঙের ব্যবহারে, পরস্পর বিরোধী  আকার, ইমেজ ,বস্তুর সমাবেশে দর্শককে, দর্শকের ভাবনাকে ঝাঁকুনি তোলে। সমকালের প্রতি তির্যক খোঁচা শুভ্রর ছবিতে দেখা যাবে ।

সৌমিত্র কর, বর্তমান চিত্রগুচ্ছে প্রাচীন সমাজের থেকে সমস্ত আধুনিকতাকে এড়িয়ে টিকে থাকা অতি আদরের এক রীতি অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। নবান্ন, সে সব পুরাতন গোষ্ঠীজীবনের টিকে থাকা স্মৃতি। যেখানে মানুষ একলা একলা বাঁচে না। মানুষ একক নয়, দেবতা, অপদেবতা, আত্মীয়, অনাত্মীয় থেকে কীট পতঙ্গ অবধি সকলকে নিয়ে বাঁচার, বেঁচে থাকার জীবনদর্শন এই অনুষ্ঠানের শরীরে মিশে আছে। লোকশিল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ট সংসর্গ সৌমিত্র করের ছবির বিষয় এবং চিত্রভাষা নির্মাণে  উল্লেখ যোগ্য উপাদান ।

সুমিতাভ পাল পি ৩ অর্থাৎ পাওয়ার, পার্ভার্সন, পেন নামে একটি বস্তুপুঞ্জের সমাহার পেশ করেছেন। সমকালীন পৃথিবীর সর্বত্র আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, ক্ষমতার অপরিসীম প্রকাশ সে শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন মধ্যকার ক্ষমতার দেখনদারিতে আটকে আছে এমন নয়, আফ্রিকান সমাজের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু নয়। ক্ষমতার নখ দাঁত সর্বত্র প্রকট। শান্তির ললিতবাণী সমৃদ্ধ বৌদ্ধ শাসক অধ্যুষিত দেশের রহিঙ্গা বিতাড়ন সেই একই ক্ষমতার দম্ভের প্রকাশ। যুদ্ধ , মানুষের ধংস প্রবণতার প্রকাশ। কামক্রিয়া এখানে সৃষ্টির জন্য নয়, অন্যের শরীর মনের স্বাধীনতার অধিকার দলনের ক্ষমতার প্রকাশ মাত্র। এই সমস্ত ঘটনার যন্ত্রনার প্রতীকী প্রকাশ মেঝের উপর ছড়ানো ধারালো কিছু আকার।

শেখরবরণ কর্মকার তার ছবির বিষয় ধারনা হিসাবে বলছেন, তার ছবি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিথলজি,এবং সাহিত্যের মিলনে উঠে আসা কিছু চিত্রকল্প। ফুঁসে ওঠা ঢেউ কবন্ধ,পচা মাংস, হাড়,রক্তের স্রোত বেয়ে ঢেউ তোলে আকাশে।বুকের উপর এসে আছড়ে পড়তে চায় । তার সামনে সটান দাঁড়িয়ে একজন মানুষ ট্রাফিক পুলিশের মতন বদলাতে চাইছে ঢেউএর গতিপথ। নাকচ করছে সেই ঢেউয়ে ভেসে যাবার আবদার । পায়ের তলায় স্রোতের টানে বালির শিরশির গতি। সব প্রতিকূল ঢেউ এর সামনে চিরন্তন মানুষের চিরকালীন প্রতিবাদ।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar path_protikriya

কেতাবি কথা

কে তা বি  ক থা

কু ব ল য়   বসু

kubaloy

‘কলকাতা শুয়ে থাকা, তীব্র এক রাক্ষসের নাম’

মিথ ও মাশরুমের শহরে

শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়

প্রকাশক: ধানসিড়ি

১০০ টাকা

কবি শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়ের এই দু’ফর্মার বইটি যেন এক স্বপ্নচারণ। পুরনো কলকাতা আর নতুন কলকাতার দ্বৈরথ চলতে থাকে এই বইয়ের ছোটো ছোটো লেখাগুলিতে। বইটি সমাপ্ত হবার পরও রেখে দিতে ইচ্ছা করবে না, বরং মনে হবে আবারও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি বৃষ্টির কলকাতা, সন্ধের কলকাতা, রাতের কলকাতা। যে সব নস্টালজিয়া আমাদের মধ্যে এখনো কাজ করে পুরনো কলকাতাকে ঘিরে, তার সব কিছুই প্রায় মানসভ্রমণ করিয়েছেন কবি। সবগুলি লেখা পড়বার পরে মাথায় রয়ে যাবে মন কেমন করা গ্যালিফ স্ট্রিট, কলুটোলা, বাগবাজারের ঘাট অথবা ঝাঁ-চকচকে সেক্টর ফাইভ, নিউটাউন। এইভাবেই কবি কলকাতার গন্ধ, রূপ তুলে এনেছেন সেই সময় থেকে আজকের ধারাবাহিকতায়। সাবেকি, আটপৌরে দিনগুলোর মাঝে আটকে যেতে ইচ্ছে করবে বারবার।

 

‘কলকাতার কোনখানে                                                                              ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা হয়?

 

বাংলা মদের সঙ্গে মারিজুয়ানার                                                                       আড্ডা হোক

 

তরল আগুন ঘোরে                                                                                   হাত থেকে হাতে, এসে দেখি                                                                              গ্লাস হাতে মিটিমিটি হাসছেন ঋত্বিক ঘটক’

 

(খালাসিটোলা)

 

এই কবিতাটির সঙ্গে যে কোনো বাঙালি নিজেকে একাত্ম করে ফেলতে পারবেন, সে তিনি খালাসিটোলা যান বা না-ই যান। সুনীল-শক্তি, কমল মজুমদার খ্যাত এই স্থানটির মাহাত্ম্য এমনই যে এই লেখাটি সেই সময়কার আমেজ ধরে রাখতে পেরেছে। অথবা এই বইয়ের ‘ভিক্টোরিয়ার বাগানে’ কবিতাটি দেখে নেওয়া যাক। কোনো এক মেঘলা দিনে ভিক্টোরিয়ার সামনে বা ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে লেখাটির আসল মাধুর্য।

 

‘আকাশ মেঘলা হলে,                                                                               পরিটির মনখারাপ হয়

 

পরিযায়ী পাখিদের মতো                                                                                   সে-ও ডানা ঝাপটিয়ে

 

একপাক ঘুরে নেয়,                                                                                       উড়ে যাবে… বাগানের ঘাসে                                                                          কিন্নর-কিন্নরী বসে, এর হাতে ওর মুঠো নিয়ে’

 

এইভাবেই মনকেমন, মনখারাপ হাত ধরাধরি করে এসে জড়ো হয় কবিতার লাইনগুলির পাশে। আর, এইভাবে স্মৃতিমেদুর করে তুলতে তুলতেই কবি সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমাদের এনে ফেলেন আধুনিক, স্মার্ট কলকাতার অলিগলিতে। প্রাচীনত্বের পোশাক খুলে যে কলকাতা আজ দাঁড়িয়ে আছে ‘চিকেন ফ্রায়েড চুমু’, ‘সামনে ধোঁয়া-ওঠা হুক্কাবার’-এর আহ্বান নিয়ে। সে কলকাতাকেও ঘুরেফিরে দেখতে দিব্বি লাগে। এই কলকাতা আজ জানে ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি’র কথা। আজকের কলকাতার যুবক প্রেম শুরুর প্রথম দিন থেকেই জানে কীভাবে মোবাইলে ‘ট্রায়ো রুম’ বুক করে সে ‘একটানে খুলে দেবে/ বান্ধবীর পাতার পোশাক’…। এই কলকাতাকে ছুঁয়ে দেখতে নিষিদ্ধ এক লোভ হয়।  

 

তবু সব ক’টি কবিতা পড়বার পরে শেষমেশ আশ্রয় নিয়ে ফেলতেই হয় কখনো চোখে না দেখা, অথচ আজকের দিনে দাঁড়িয়েও প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা কলকাতার সমস্ত পুরনো দিনগুলির কাছে। ‘নিমতলা’ হোক বা ‘কেওড়াতলা’, জীবনের এই অন্তিম পর্বের দিকে আসার আগে যদি একবার ফিরে তাকিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে অমোঘ এই পঙক্তিগুলো মনে রয়ে যাবেই—

 

…‘ধ্বংসের দিনেও এসে দেখি                                                                           বিষণ্ণ রবীন্দ্রনাথ গান লিখছেন ভোররাতে’

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

জিভে জল

জি ভে  জ ল

রা গে শ্রী  মি ত্র  সা ম ন্ত

শেফ ও রাগেশ্রীস বেক হোমের কর্ণধার

jib_jol

স্পঞ্জ কেক

রেসিপি

ডিম,গুঁড়ো চিনি সহযোগে ব্লেন্ডারের সাহায্যে প্রথমে একটা ব্যাটার তৈরি করে নিতে হবে। এরপর ময়দা, বেকিং পাউডার ও বেকিং সোডা ঐ মিশ্রনটিতে Cut and Fold পদ্ধতিতে মিশিয়ে দিতে হবে। পুরোটা মেশানো হয়ে গেলে কেকের ফ্লেভার অ্যাড করতে হবে। বেকিং পাত্রে তেল মাখিয়ে তাতে বেকিং পেপার লাগিয়ে ঐ মিশ্রন ঢেলে মাইক্রোওভেন বা ওটিজি তে ১৮০°সেন্টিগ্ৰেডে বেক করতে হবে ২০ মিনিট।

এরপর তৈরি করা কেকটি ঠান্ডা হলে ক্রিম তৈরি করা শুরু করতে হবে। ফ্রেস ক্রিম নিয়ে ব্লেন্ডারের সাহায্যে ক্রিম প্রথমে ফেটিয়ে নিতে হবে। এরপর যে ফ্লেভারের কেক হবে সেই ফ্লেভার অ্যাড করতে হবে। এরপর কেকটিকে সমান তিনটি ভাগে ভাগ করে একটা করে লেয়ার তৈরি করতে হবে। প্রথমে একটি কেকের লেয়ারে চিনিজল স্প্রে করে তাতে ক্রিম দিয়ে,তার ওপর ক্রাস/চকোচিপস্ প্রয়োজন মতো দিয়ে আবার একটা লেয়ার চাপাতে হবে। এরপর পরপর তিনটি লেয়ার তৈরি হয়ে গেলে কেকের সাইড ও ওপরে ক্রিম লাগিয়ে পছন্দমতো ডিজাইন দিলেই তৈরি মনের মতো হোমমেড কেক।

ব্রাউনি

রেসিপি

একটি পাত্রে ½ কাপ টকদই নিয়ে ফেটিয়ে নেবো। এরপর ডার্ক কম্পাউন্ড ও ফ্রেসক্রিম গলিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করে দৈ তে দিয়ে হাতে করে ফেটিয়ে নিতে হবে। এরপর ½কাপ ঠান্ডা দুধ, অল্প ভ্যানিলা এসেন্স এবং ½ চা চামচ ভিনিগার দিয়ে ঐ মিশ্রনটি আবার ফেটিয়ে নিতে হবে। সবকিছু ভালো করে ফেটানো হয়ে গেলে ২ কাপ ময়দা, ½ চা চামচ বেকিং পাউডার ও ¼ চা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে ঐ মিশ্রনে ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে বেকিং পাত্রে তেল ও বেকিং পেপার লাগিয়ে মিশ্রনটি ঢেলে মাইক্রোওভেন বা ওটিজি তে ১৮০° সেন্টিগ্ৰেডে ৩০ মিনিট বেক করতে হবে। হয়ে গেলে মেশিন বন্ধ করে ভিতরে ১ঘন্টা মতো রেখে তারপর বের করতে হবে।

ফ্রুটকেক

রেসিপি

একটি পাত্রে একটি ডিম ফেটিয়ে তাতে ½ কাপক্যারামেল চিনি দিয়ে,ভ্যানিলা এসেন্স, ¼ কাপ দুধ দিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে।এরপর½ কাপ সাদা তেল ঐ মিশ্রনে মিশিয়ে ফেটিয়ে নিতে হবে। এরপর এতে ২কাপ ময়দা,½ চা চামচ বেকিং পাউডার ও ¼ চা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে ঐ মিশ্রনে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। পছন্দমতো ফ্রুট একঘন্টা আগে অরেঞ্জ জুসে ভিজিয়ে রেখে সেই জুস সমেত ফ্রুটস মিশিয়ে বেকিং পাত্রে তেল মাখিয়ে তাতে বেকিং পেপার লাগিয়ে মিশ্রনটি ঢেলে মাইক্রোওভেন বা ওটিজি তে ১৮০° সেন্টিগ্ৰেডে ৩০ মিনিট বেক করতে হবে। একঘন্টা রেখে তারপর বের করতে হবে।

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar goddyo

চরৈবেতি

চ রৈ বে তি

পা র্থ  সা হা

partha

‘ছোটনাগপুরের রাণী’ নেতারহাট

খারাপ রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলা হয়ে গিয়েছে। এবার বিরক্ত লাগছে। বাইক চালানোর সময় এমন রাস্তা ক্লান্তি এনে দেয়। 

সকাল আটটায় রাঁচি থেকে বেরিয়েছি। এবার লক্ষ্য নেতারহাট। তা, ঘণ্টাখানেক এইভাবে চলার পরে একটি চায়ের দোকান দেখে বিরতি নিলাম। সময়টা ডিসেম্বর, তবে ঠাণ্ডার লেশ মাত্র নেই। দোকানে ঢুকেই জ্যোতিদা ‘পাখা খুলে দিন, পাখা খুলে দিন’ বলতে লাগলো। আমাদের শরীরে বাইক চালানোর নানারকম বর্ম, গরম লাগছিল সবার। একটু ঠাণ্ডা হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। গুগল বাবাজি এমন রাস্তাতে এনে ফেলেছে! ‘আরে আপনারা এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন কেন?’ চায়ের দোকানদারের কথা শুনে আমরা সবাই তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আমাদের রাস্তা বলে দিলেন। কয়েক কিলোমিটার দূরে বজরংবলীর বিশাল মূর্তি আছে, সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে গেলেই হবে। 

আমরা যারা বাইক চালাই, তাদের স্বপ্নের কিছু রাস্তা আছে। এই রাস্তাটা অনেকটা সেরকমই। না, ভালো রাস্তা শুধু তো তা নয়, সঙ্গে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও। শাল-মহুয়া-পলাশে ছাওয়া উঁচু নিচু অর্ধবৃত্তাকারে সে রাস্তা এগিয়ে চলেছে নেতারহাটের দিকে। আমরা তখন বাইক নিয়ে নদীর স্রোত হয়ে গেছি। আমি একটা গান ধরলাম। 

‘ছোটনাগপুরের রাণী’ নেতারহাট একটা ছোট পাহাড়ি জনপদ। ঝাড়খণ্ডের লাটেহার জেলাতে ১০৭১ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। চোখে পড়ার মতো পাইন আর ইউক্যালিপ্টাস-এর বাহার। আমরা গন্তব্যে প্রবেশ করার আগে খানিক বিরতি নিয়েছিলাম। পাইন আর পাহাড়ি শীতলতার মাঝে ছবি তোলা হলো। গতকাল কলকাতা থেকে সকাল আটটা নাগাদ বেরিয়ে এই প্রথম সবাই যে যার মুঠোফোন বার করে ছবি তোলায় মেতে উঠলাম। নেতারহাট তখন আর মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। 

যাঁরা জমজমাট জায়গা খোঁজেন, নেতারহাট তাঁদের জন্য নয়। মাত্র কয়েকটি দোকানের সমাবেশ, সেটাই বাজার। আমরা বাইক নিয়ে প্রথমে সেখানে থামলাম, চা খেয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলাম। এখানকার সব হোটেলই মধ্যম মানের। বাজারের অনতিদূরে হোটেল রয়্যাল প্যালেস, অবশ্য রাজকীয় কিছু নয়। আমরা বাইক রেখে প্রথমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। মেনুর হিট পার্ট হলো মুরগির ঝোল। সবথেকে বড় কথা ব্রয়লার মুরগির আসাধারন স্বাদ। কলকাতা শহরে এ জিনিস মিলবে না। এরপর সবাই মিলে কোলাহল করতে করতে বাইক বার করলাম, এবারের গন্তব্য যেখানে সূর্য অস্ত যায় সেই জায়গাটা। 

ম্যাগনোলিয়া পয়েন্টে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবু ডুবু। এই সময় সূর্যকে খোলা চোখে দেখা যায়, মানে তাকিয়ে থাকা যায় আর কি। চারিদিক কোমল রক্তবর্ণ, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝবেন আমি ঠিক কী বলতে চাইছি।  পৃথিবীটা যে গোল তা আবার প্রমাণ পেলাম, যখন নিজের এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে সেখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা হাসাহাসি, আর সঙ্গে চা-পেঁয়াজি। গল্পে গল্পে আঁধার নামল। 

সারাদিন বাইক চালানোর পরে শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তবু আমাদের নিয়ম হল এই যে, রাতে খাওয়াদাওয়া করার আগে নিজেদের সারাদিনের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে আলোচনা করা। কেউ তার অভিজ্ঞতা সবার সামনে বলতেও পারে। গঠনমূলক এই আড্ডায় অংশগ্রহণ না করলে এর মজা বুঝতে পারবেন না। পরের দিন পাত্রাতু হয়ে তোপচাঁচি যেতে হবে। খাওয়াদাওয়া করে আমরা পস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে দিলাম। কাল প্রথম ডেসটিনেশন নেতারহাটের সূর্যোদয়। 

খুব ভোরে আটটা বাইক একসঙ্গে গর্জন করে উঠল। আমরা প্রস্তুত। এগিয়ে চললাম সূর্যোদয়ের পথে…।

আরও পড়ুন...