গ ল্প
ছ ন্দা  বি শ্বা স

পারাবাত প্রিয়া

আয় আয় আয় …
জয়তু পায়রাগুলোকে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ডাকে। ওর ডাক শুনে এক ঝাঁক পায়রা পাঁচ তলার ছাদের উপর থেকে ঘুলঘুলির ফোকর গলে, এসি মেশিনের পিছন থেকে মাটিতে নেমে আসে। গম হাতে উড়ন্ত পায়রাদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আর বাতাসে গা ভাসিয়ে নীচে নেমে আসার দৃশ্য দেখে দিনের শুরু হয় জয়তুর।
বহুকাল আগে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন জয়তুর ঠাকুর্দা। উনি এই অঞ্চলের নাম করা অ্যাডভোকেট ছিলেন। লোকের মুখে মুখে ঘুরত জয়ন্তনারায়ণের নাম। সারাটা দিন বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা চলত। জয়তুর বাবাও ওকালতি পাশ করে একই পেশায় মনোনিবেশ করেছিলেন। বাড়িটা বিখ্যাত অ্যাডভোকেট জে এন সান্যালের নামেই। সেটাই বংশানুক্রমিক ভাবে চলে আসছে। যদিও জয়তুর সময় এসে সেই বাড়ির লালিত্য কিছুটা ম্লান হয়েছে।
সকাল থেকে মৌনিমা কান পেতে থাকে। বিছানায় শুয়েই শুনতে পায় ‘আয় আয় আয়’ ডাক। পায়রাবাবুর ডাক শোনার অপেক্ষাতেই যেন ও বিছানা আঁকড়ে থাকে। এই ডাক কানে এলে ও বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। মৌনিমাদের ফ্ল্যাট থেকে জয়তুদের বাড়ির পিছনের অংশের সামান্যটুকু দেখা যায় মাত্র। ও ডাক শুনে উঠে জানালা দিয়ে পায়রাদের দেখে।
মৌনিমার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর। সংসারে সদস্য সংখ্যা বাড়েনি। এ বাড়িতে মানুষ বলতে ওরা স্বামী-স্ত্রী দুইজন। কিন্তু সারাটা বছর মৌনিমা একাই থাকে এই ফ্ল্যাটে। স্বামী ব্যবসার কাজে দুবাই-সিঙ্গাপুর-হংকং চষে বেড়াচ্ছে। মৌনিমার আঠারশো স্কোয়্যার ফিটের অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট দামী দামী কিউরিওতে ভরে উঠেছে। ওয়ারড্রোব উপচে পড়ছে পোশাকে। কিন্তু মৌনিমার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। যতটা মনোযোগ ওর এই পায়ারাগুলোর প্রতি। মৌনিমার আঠাশ বছরের যৌবন প্রতিদিন একটু একটু করে বিফলে যায়। টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি, বিলাসিতায় মোড়া হয়েও মৌনিমার কাছে সে সব মূল্যহীন।
কী গো বৌদি, তোমার পায়রা দেখা হল?
কাজের মেয়ে পুষির ডাকে চমক ভাঙ্গে মৌনিমার।
মৌনিকা ম্লান হাসি উপহার দেয় পুষিকে। সেই হাসিতে ধরা থাকে বিষাদ। শরীর আর মনের যন্ত্রণার কথা।
ও পুষির মুখে ‘পায়রাবাবু’র গল্প শোনে। জয়তু’র বৌ দ্বিরাগমনের পরে আর এ বাড়িতে ফেরেনি। শপিং করতে যাচ্ছি বলে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। কী কেচ্ছা, কী কেচ্ছা!
মাথা হেঁট করে ফিরে আসে জয়তু। পুষির কথায় মৌনিমার মনে হয় তাই হয়তো পায়রাগুলোর প্রতি নিবেদিত প্রাণ। পুষি বলে, ‘জয়তুদার শরীরের দোষ দিয়ে বৌটা ভেগেছে।’
জয়তু পায়রাগুলোকে খেতে দিতে দিতে ভাবে জোর করে কারো কাছ থেকে ভালোবাসা কিম্বা শ্রদ্ধা কোনোটাই আদায় করা যায় না। প্রথমটা স্বতঃস্ফূর্ত হলেও দ্বিতীয়টা অর্জন করতে হয়। বাবা রাগী মানুষ ছিলেন আর দাদু ছিলেন রাশভারী স্বভাবের। লোকে দাদুকেই কেন জানি বেশি ভালোবাসত এবং সম্মান-শ্রদ্ধা করত। দাদু একটা কথা বলতেন জয়তুকে, ‘দ্যাখো ভাই, যে তোমাকে ভালোবাসবে তাকেই তুমি ভালোবেসো। জোর করে কারো কাছ থেকে কিছু আদায় করার চেষ্টা কোরো না।’ এখন বুঝতে পারছে কত মূল্যবান কথা তিনি বলে গিয়েছিলেন জয়তুকে।
জয়তু পারতপক্ষে সেইভাবে কখনো কোনো মেয়েদের দিকে তাকায় না। সেও দাদুর চেম্বারে প্র্যাকটিস করে। তবে প্র্যাক্টিসে মন বসে না জয়তুর। কী হবে এতো টাকাপয়সা দিয়ে? কিছুই তো সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না। তাছাড়া কার জন্যে টাকা ইনকাম করবে! একটা হতাশা জাপটে ধরে। ও কাজ কর্ম শিকেয় তুলে ছাদে উঠে বাগান, পাখি, কাঠবেড়ালি আর বেজিদের লুকোচুরি খেলা দেখে। ভোরের আকাশ দেখে, পশ্চিম আকাশে বৈরাগ্যের রং দেখে। দিনান্তে পাখিদের বাসায় ফেরা আর সন্ধ্যাতারাটিকে দেখে। তখন খুব মায়ের কথা মনে পড়ে। মা এখন দূর-স্মৃতি। পূর্ণিমা সন্ধ্যায় চাঁদ উঠলে জয়তু আস্তে আস্তে ছাদে চলে আসে। তখন খুব মনে পড়ে তিন রাতের বৌটিকে। বুকের ভিতরটা পুড়ে খাক হয়।
ঠাকুরমা বলেন, পুরুষ মানুষের এতো বৈরাগ্য ভালো নয়। কে দোষ করল, তার জন্যে সারাটা জীবন ব্রহ্মচারী হয়ে থাকতে হবে? সে তো নাগরের সঙ্গে দিব্যি সুখে ঘরকন্না করছে। আর তুই? খালি চাঁদ তারা দেখে বেড়াচ্ছিস। গ্রহ দোষ কাটাতে ঠাকুরমা কী না করছেন জয়তুর জন্যে।
এমনই একটা রাতে জয়তু ছাদে উঠেছিল। সে জেনেছিল বিশ্বব্রহ্মান্ডের এক গভীর রহস্যের কথা। এই সপ্তাহে তিনটি গ্রহ খুব কাছে চলে আসছে। পৃথিবী থেকেই দেখা যাবে মঙ্গল, শনি আর বৃহস্পতিকে। আর শুক্রকে তো প্রতিদিন দেখা যায়।
মৌনিমার মন ভালো নেই। কিছুদিন ধরে একটা সন্দেহ তার মনের ভিতরে উঁকি দিচ্ছিল। তাদের হোটেল ব্যবসা। স্বামী বিশালকে তাই সারাটা বছর বাইরে ব্যস্ত থাকতে হয়। যখন বাড়িতে আসে তখন যেন অন্য এক মানুষ মনে হয়। যেন দূর আকাশের কোনো গ্রহ। যতক্ষণ থাকে মোবাইল নিয়েই কাটিয়ে দেয়। সেদিন মোবাইলে একটা ফটো দেখেছিল, সুন্দরী এক বিদেশিনীর। রাত জেগে মেয়েটির সঙ্গে প্রতিদিন রাতে চ্যাট করে। এতোদিন বাদে এসেও ওর সঙ্গ কামনাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বিশালের। মৌনিকা কাছে এসে নানা ভাবে আদর করে, গান-গল্প করতে এলে বিশাল রাগত স্বরে বলেছে, কী এসব ছেলেমানুষী করছ শুনি? আমার অনেক কাজ পড়ে গেছে। যাও, পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
মৌনিমা পরাজিতের হাহাকার বুকে নিয়ে দ্বিধা টলোমলো পায়ে পাশের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্না এসে পড়ছে ওর বিছানার উপরে। নরম জ্যোৎস্নায় ভিজে যাচ্ছে বিছানা বালিশ। ও চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেছে, আয় ঘুম আয়…।
সেদিন বিশালের মোবাইলে দেখেছে হোটেলের বিছানায় অন্তরঙ্গ ফটো বিশালের সঙ্গে। গ্যালারিতে বেশ কিছু ছবি আছে মেয়েদের। দেখে কল গার্ল বলে মনে হয়েছে। মৌনিমা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। বিশাল এবারে খুব বেশীদিন থাকতে পারেনি। মৌনিমাকে বলেছিল এটিএম থেকে টাকাপয়সা যা লাগে তুলে খরচ করতে। মৌনিমা শুনে ঠোঁট কামড়েছিল। বলেছিল, আমার কিছুই দরকার নেই। তুমি শুধু আমায় মুক্তি দাও। আজকাল মৌনিমার কিছুই ভালো লাগে না। যার জন্যে ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখবে, সেই মানুষটা কোথায়? এই ধনসম্পত্তিতে আদৌ কি তার কোনো অধিকার আছে। যে পুরুষ তার নিজের স্ত্রী’র প্রাপ্য দাবিটুকু পর্যন্ত পূরণ করতে পারে না, তার জিনিসে কীসের অধিকার? মৌনিমার এইসব জিনিসপত্র ছুঁতে আজকাল ঘেন্না করে।
সেদিন বিষণ্ণ মনে সন্ধ্যের পরে ছাদে উঠেছিল। কলেজ লাইফের বান্ধবী ঝিলম দুপুরে বলেছিল আজ রাতে ছাদে উঠে দেখবি মহাজাগতিক এক দৃশ্য। মৌনিমা পারতপক্ষে কখনো ছাদে ওঠে না। আর সন্ধ্যের পরে তো নাই। মৌনিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছে সেই মহাজাগতিক দৃশ্য। এমন সময়ে ঝিলাম ফোন করল, ‘কিরে, দেখলি?’ মৌনিমা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, শুক্র, মঙ্গল আর শনিকে দেখছি কিন্তু বৃহস্পতিকে তো দেখছি না।’ ঝিলম যেমন ডিরেকশান দেয় সেইভাবে মৌনিমা ঘুরতে ঘুরতে ছাদের কার্ণিশে চলে আসে। ওদের আর জয়তুদের বাড়ির মাঝে যে নারকেল গাছটা আছে তার পাতাগুলো দুইদিকের ছাদেই ঝুঁকে পড়েছে। মৌনিমা খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়। ঝিলম বলে, ‘আমি যেমনটা বলছি শোন, দেখতে পাবি। আমি তো ছাদে উঠেই দেখছি, কী সুন্দর দৃশ্য!’ মৌনিমা বলে, ‘আমি কিন্তু এখনো খুঁজে পাইনি। এবারে আমি নীচে নেমে যাচ্ছি।’
ঝিলমের সঙ্গে কথা শেষ হতেই একজনের গলা শুনতে পায় মৌনিমা, ‘এই যে ম্যাডাম, এই, এই দিকে তাকিয়ে দেখুন, ওই যে ভেনাসের পাশে জুপিটার।’ মৌনিমা ঘাড় ঘোরায়। দেখে উল্টো দিকের ছাদে একটি যুবক ছাদের কোণে এসে ওকে আঙুল দিয়ে আকাশের বুকে বৃহস্পতির অবস্থান চেনাচ্ছে। মৌনিমা এগিয়ে যায়। যুবকের নির্দেশ মতো আকাশের বুকে সেই মহাজাগতিক দৃশ্য দেখতে থাকে। মৌনিমা আর জয়তু দুই ছাদের কার্ণিশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাঝে হাত চারেকের ব্যবধান মাত্র।
‘আরো একটু ডান দিকে, এই যে আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসুন, দেখুন এবারে তিনটি গ্রহকেই দেখা যাচ্ছে।’ জয়তুর গভীর আবেগভরা কথাগুলো মৌনিমার হৃদয় স্পর্শ করে। একটা উত্তাল ঢেউ সহসা আছড়ে পড়ে বুকে। তোলপাড় হচ্ছে বুকের ভিতর। মুহূর্তের ভিতরে হাত চারেকের ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ওরা দুইজনে নক্ষত্র বনে হারিয়ে যায়।
ঠিক এমন সময়ে জয়তুদের পায়রার খোপে দুটি পায়রা মিহি সুরে প্রেমালাপ করে ওঠে, বক-বকম, বক…
আরও পড়ুন...
কোথায় কী
‘বন্দ্যোপাধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিষদ’-এর কবিপক্ষ উদযাপন | মৌসুমী সরকার READ MOREঅমিত মজুমদার
পৃথিবীর সব বিপদ কেটে যাবার পর বাঘ আর হরিণ একঘাটে জল খেতে আসে আমাদের কাজ সকাল সকাল প্রতিটা ঘাট... READ MOREসোমা দত্ত
পাখির ভাষায় কথা বলি চলো কুহুতে বলি খিদে, কুহুতে বলি প্রজনন কলহ বিবাদ রাখি কূজনে বাকিটা উড়িয়ে দিক হাওয়া... READ MOREজিভে জল
চিকেন মুইঠা মালাই কোরমা | তনুজা পাল READ MOREরূপ কথা
অনুক্তা ঘোষাল | বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানদের ম্যাচিং পোশাক পরা এখন নতুন ট্রেন্ড। এর নাম ‘মিনি মি’ ফ্যাশন... READ MOREআবার রাণার কথা
রাণা রায়চৌধুরী | একা একটা ঘরে শুয়ে আছি। একা থাকতেই ভালো লাগে আজকাল। পাহাড় থেকে দীর্ঘ বাতাস... READ MOREকেতাবি কথা
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পতাকার বদলে দিগন্ত' | অনির্বাণ চৌধুরী | বাস্তব জীবনের রঙ্গমঞ্চে কিছু কিছু ... READ MOREনিষিদ্ধ সব সোনার খনি । পর্ব ৯
সব্যসাচী সরকার । জীবনের প্রথম বিদেশ সফর। সালটা ১৯৯৫। মাস ফেব্রুয়ারি। গন্তব্য নিউ জিল্যান্ড। বয়স সবে চব্বিশ পেরিয়েছে... READ MOREবনশ্রী রায় দাস
গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি, বর্ষামাস এখন ঝিনুক ভিজলেও ভেজে না বালি, কোথাও জমে নেই শ্রাবণের টুকরো... READ MOREরবিন বণিক
ইদানিং চিলের চঞ্চু দিয়ে, লিখছি কলম স্বাধীনতা লিখছি সাঁতারের মত জীবিত যুদ্ধপুরুষজানি তুমি অতীত পরাজিত... READ MORE