Categories
2023_may golpo

ছন্দা বিশ্বাস

গ ল্প

ছ ন্দা  বি শ্বা স

chanda

পারাবাত প্রিয়া

আয় আয় আয় …

জয়তু পায়রাগুলোকে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ডাকে। ওর ডাক শুনে এক ঝাঁক পায়রা পাঁচ তলার ছাদের উপর থেকে ঘুলঘুলির ফোকর গলে, এসি মেশিনের পিছন থেকে মাটিতে নেমে আসে। গম হাতে উড়ন্ত পায়রাদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আর বাতাসে গা ভাসিয়ে নীচে নেমে আসার দৃশ্য দেখে দিনের শুরু হয় জয়তুর।

বহুকাল আগে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন জয়তুর ঠাকুর্দা। উনি এই অঞ্চলের নাম করা অ্যাডভোকেট ছিলেন। লোকের মুখে মুখে ঘুরত জয়ন্তনারায়ণের নাম। সারাটা দিন বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা চলত। জয়তুর বাবাও ওকালতি পাশ করে একই পেশায় মনোনিবেশ করেছিলেন। বাড়িটা বিখ্যাত অ্যাডভোকেট জে এন সান্যালের নামেই। সেটাই বংশানুক্রমিক ভাবে চলে আসছে। যদিও জয়তুর সময় এসে সেই বাড়ির লালিত্য কিছুটা ম্লান হয়েছে।

সকাল থেকে মৌনিমা কান পেতে থাকে। বিছানায় শুয়েই শুনতে পায় ‘আয় আয় আয়’  ডাক। পায়রাবাবুর ডাক শোনার অপেক্ষাতেই যেন ও বিছানা আঁকড়ে থাকে। এই ডাক কানে এলে ও বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। মৌনিমাদের ফ্ল্যাট থেকে জয়তুদের বাড়ির পিছনের অংশের সামান্যটুকু দেখা যায় মাত্র। ও ডাক শুনে উঠে জানালা দিয়ে পায়রাদের দেখে।

মৌনিমার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর। সংসারে সদস্য সংখ্যা বাড়েনি। এ বাড়িতে মানুষ বলতে ওরা স্বামী-স্ত্রী দুইজন। কিন্তু সারাটা বছর মৌনিমা একাই থাকে এই ফ্ল্যাটে। স্বামী ব্যবসার কাজে দুবাই-সিঙ্গাপুর-হংকং চষে বেড়াচ্ছে। মৌনিমার আঠারশো স্কোয়্যার ফিটের অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট দামী দামী কিউরিওতে ভরে উঠেছে। ওয়ারড্রোব উপচে পড়ছে পোশাকে। কিন্তু মৌনিমার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। যতটা মনোযোগ ওর এই পায়ারাগুলোর প্রতি। মৌনিমার আঠাশ বছরের যৌবন প্রতিদিন একটু একটু করে বিফলে যায়। টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি, বিলাসিতায় মোড়া হয়েও মৌনিমার কাছে সে সব মূল্যহীন।

কী গো বৌদি, তোমার পায়রা দেখা হল?

কাজের মেয়ে পুষির ডাকে চমক ভাঙ্গে মৌনিমার।

মৌনিকা ম্লান হাসি উপহার দেয় পুষিকে। সেই হাসিতে ধরা থাকে বিষাদ। শরীর আর মনের যন্ত্রণার কথা।

ও পুষির মুখে ‘পায়রাবাবু’র গল্প শোনে। জয়তু’র বৌ দ্বিরাগমনের পরে আর এ বাড়িতে ফেরেনি। শপিং করতে যাচ্ছি বলে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। কী কেচ্ছা, কী কেচ্ছা!

মাথা হেঁট করে ফিরে আসে জয়তু। পুষির কথায় মৌনিমার মনে হয় তাই হয়তো পায়রাগুলোর প্রতি নিবেদিত প্রাণ। পুষি বলে, ‘জয়তুদার শরীরের দোষ দিয়ে বৌটা ভেগেছে।’

জয়তু পায়রাগুলোকে খেতে দিতে দিতে ভাবে জোর করে কারো কাছ থেকে ভালোবাসা কিম্বা শ্রদ্ধা কোনোটাই আদায় করা যায় না। প্রথমটা স্বতঃস্ফূর্ত হলেও দ্বিতীয়টা অর্জন করতে হয়। বাবা রাগী মানুষ ছিলেন আর দাদু ছিলেন রাশভারী স্বভাবের। লোকে দাদুকেই কেন জানি বেশি ভালোবাসত এবং সম্মান-শ্রদ্ধা করত। দাদু একটা কথা বলতেন জয়তুকে, ‘দ্যাখো ভাই, যে তোমাকে ভালোবাসবে তাকেই তুমি ভালোবেসো। জোর করে কারো কাছ থেকে কিছু আদায় করার চেষ্টা কোরো না।’ এখন বুঝতে পারছে কত মূল্যবান কথা তিনি বলে গিয়েছিলেন জয়তুকে।

জয়তু পারতপক্ষে সেইভাবে কখনো কোনো মেয়েদের দিকে তাকায় না। সেও দাদুর চেম্বারে প্র্যাকটিস করে। তবে প্র্যাক্টিসে মন বসে না জয়তুর। কী হবে এতো টাকাপয়সা দিয়ে? কিছুই তো সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না। তাছাড়া কার জন্যে টাকা ইনকাম করবে! একটা হতাশা জাপটে ধরে। ও কাজ কর্ম শিকেয় তুলে ছাদে উঠে বাগান, পাখি, কাঠবেড়ালি আর বেজিদের লুকোচুরি খেলা দেখে। ভোরের আকাশ দেখে, পশ্চিম আকাশে বৈরাগ্যের রং দেখে। দিনান্তে পাখিদের বাসায় ফেরা আর সন্ধ্যাতারাটিকে দেখে। তখন খুব মায়ের কথা মনে পড়ে। মা এখন দূর-স্মৃতি। পূর্ণিমা সন্ধ্যায় চাঁদ উঠলে জয়তু আস্তে আস্তে ছাদে চলে আসে। তখন খুব মনে পড়ে তিন রাতের বৌটিকে। বুকের ভিতরটা পুড়ে খাক হয়।

ঠাকুরমা বলেন, পুরুষ মানুষের এতো বৈরাগ্য ভালো নয়। কে দোষ করল, তার জন্যে সারাটা জীবন ব্রহ্মচারী হয়ে থাকতে হবে? সে তো নাগরের সঙ্গে দিব্যি সুখে ঘরকন্না করছে। আর তুই? খালি চাঁদ তারা দেখে বেড়াচ্ছিস। গ্রহ দোষ কাটাতে ঠাকুরমা কী না করছেন জয়তুর জন্যে।

এমনই একটা রাতে জয়তু ছাদে উঠেছিল। সে জেনেছিল বিশ্বব্রহ্মান্ডের এক গভীর রহস্যের কথা। এই সপ্তাহে তিনটি গ্রহ খুব কাছে চলে আসছে। পৃথিবী থেকেই দেখা যাবে মঙ্গল, শনি আর বৃহস্পতিকে। আর শুক্রকে তো প্রতিদিন দেখা যায়।

মৌনিমার মন ভালো নেই। কিছুদিন ধরে একটা সন্দেহ তার মনের ভিতরে উঁকি দিচ্ছিল। তাদের হোটেল ব্যবসা। স্বামী বিশালকে তাই সারাটা বছর বাইরে ব্যস্ত থাকতে হয়। যখন বাড়িতে আসে তখন যেন অন্য এক মানুষ মনে হয়। যেন দূর আকাশের কোনো গ্রহ। যতক্ষণ থাকে মোবাইল নিয়েই কাটিয়ে দেয়। সেদিন মোবাইলে একটা ফটো দেখেছিল, সুন্দরী এক বিদেশিনীর। রাত জেগে মেয়েটির সঙ্গে প্রতিদিন রাতে চ্যাট করে। এতোদিন বাদে এসেও ওর সঙ্গ কামনাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বিশালের। মৌনিকা কাছে এসে নানা ভাবে আদর করে, গান-গল্প করতে এলে বিশাল রাগত স্বরে বলেছে, কী এসব ছেলেমানুষী করছ শুনি? আমার অনেক কাজ পড়ে গেছে। যাও, পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

মৌনিমা পরাজিতের হাহাকার বুকে নিয়ে দ্বিধা টলোমলো পায়ে পাশের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্না এসে পড়ছে ওর বিছানার উপরে। নরম জ্যোৎস্নায় ভিজে যাচ্ছে বিছানা বালিশ। ও চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেছে, আয় ঘুম আয়…।

সেদিন বিশালের মোবাইলে দেখেছে হোটেলের বিছানায় অন্তরঙ্গ ফটো বিশালের সঙ্গে। গ্যালারিতে বেশ কিছু ছবি আছে মেয়েদের। দেখে কল গার্ল বলে মনে হয়েছে। মৌনিমা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। বিশাল এবারে খুব বেশীদিন থাকতে পারেনি। মৌনিমাকে বলেছিল এটিএম থেকে টাকাপয়সা যা লাগে তুলে খরচ করতে। মৌনিমা শুনে ঠোঁট  কামড়েছিল। বলেছিল, আমার কিছুই দরকার নেই। তুমি শুধু আমায় মুক্তি দাও। আজকাল মৌনিমার কিছুই ভালো লাগে না। যার জন্যে ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখবে, সেই মানুষটা কোথায়? এই ধনসম্পত্তিতে আদৌ কি তার কোনো অধিকার আছে। যে পুরুষ তার নিজের স্ত্রী’র প্রাপ্য দাবিটুকু পর্যন্ত পূরণ করতে পারে না, তার জিনিসে কীসের অধিকার? মৌনিমার এইসব জিনিসপত্র ছুঁতে আজকাল ঘেন্না করে।

সেদিন বিষণ্ণ মনে সন্ধ্যের পরে ছাদে উঠেছিল। কলেজ লাইফের বান্ধবী ঝিলম দুপুরে বলেছিল আজ রাতে ছাদে উঠে দেখবি মহাজাগতিক এক দৃশ্য। মৌনিমা পারতপক্ষে কখনো ছাদে ওঠে না। আর সন্ধ্যের পরে তো নাই। মৌনিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছে সেই মহাজাগতিক দৃশ্য। এমন সময়ে ঝিলাম ফোন করল, ‘কিরে, দেখলি?’ মৌনিমা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, শুক্র, মঙ্গল আর শনিকে দেখছি কিন্তু বৃহস্পতিকে তো দেখছি না।’ ঝিলম যেমন ডিরেকশান দেয় সেইভাবে মৌনিমা ঘুরতে ঘুরতে ছাদের কার্ণিশে চলে আসে। ওদের আর জয়তুদের বাড়ির মাঝে যে নারকেল গাছটা আছে তার পাতাগুলো দুইদিকের ছাদেই ঝুঁকে পড়েছে। মৌনিমা খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়। ঝিলম বলে, ‘আমি যেমনটা বলছি শোন, দেখতে পাবি। আমি তো ছাদে উঠেই দেখছি, কী সুন্দর দৃশ্য!’  মৌনিমা বলে, ‘আমি কিন্তু এখনো খুঁজে পাইনি। এবারে আমি নীচে নেমে যাচ্ছি।’  

ঝিলমের সঙ্গে কথা শেষ হতেই একজনের গলা শুনতে পায় মৌনিমা, ‘এই যে ম্যাডাম, এই, এই দিকে তাকিয়ে দেখুন, ওই যে ভেনাসের পাশে জুপিটার।’ মৌনিমা ঘাড় ঘোরায়। দেখে উল্টো দিকের ছাদে একটি যুবক ছাদের কোণে এসে ওকে আঙুল দিয়ে আকাশের বুকে বৃহস্পতির অবস্থান চেনাচ্ছে। মৌনিমা এগিয়ে যায়। যুবকের নির্দেশ মতো আকাশের বুকে সেই মহাজাগতিক দৃশ্য দেখতে থাকে। মৌনিমা আর জয়তু দুই ছাদের কার্ণিশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাঝে হাত চারেকের ব্যবধান মাত্র।

‘আরো একটু ডান দিকে, এই যে আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসুন, দেখুন এবারে তিনটি গ্রহকেই দেখা যাচ্ছে।’ জয়তুর গভীর আবেগভরা কথাগুলো মৌনিমার হৃদয় স্পর্শ করে। একটা উত্তাল ঢেউ সহসা আছড়ে পড়ে বুকে। তোলপাড় হচ্ছে বুকের ভিতর। মুহূর্তের ভিতরে হাত চারেকের ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ওরা দুইজনে নক্ষত্র বনে হারিয়ে যায়।

ঠিক এমন সময়ে জয়তুদের পায়রার খোপে দুটি পায়রা মিহি সুরে প্রেমালাপ করে ওঠে, বক-বকম, বক… 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april golpo

শ্রীজিৎ দাস

গ ল্প

শ্রী জি ৎ  দা স

golpo2

গল্পবুড়োর গল্প

এক 

অলস দিনগুলোর ঘুম শান্তির হয় না। দীর্ঘ হয় কিন্তু গাঢ় হয় না। ঘুম গাঢ় হলে ভালো স্বপ্ন আসে। দীর্ঘ হলেও স্বপ্ন আসে। কিন্তু কিছু দুশ্চিন্তা তার মধ্যে মিশে যায়। স্বপ্ন সে যেমনটাই হোক, দেখতে মন্দ লাগে না। অবচেতনে অনুভূতির যে সূক্ষ্ম দড়ি বাঁধা থাকে তাতে একটু টান পড়লেই আবার সব ঠিকঠাক। সপ্তাহে দু’একদিন রাতে তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বিছানায় যাওয়া নিয়ম করে নিয়েছি। শহরে থাকলেও এমনটা করতাম। শহরে তাড়াতাড়ি মানে এই রাত এগারোটা। গ্রামের কিছুটা মন্থর জীবন গতিতে সেটা ন’টা কিংবা সাড়ে ন’টা। বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে এসে আছি। ডাক্তারবাবু বলেছেন, এখন আমার এক মাস বিশ্রামের প্রয়োজন।  চার হপ্তা হতে আর দুদিন বাকি। শহুরে জীবনটাকে এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়। সেই আটটায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে, দু’টি গরম ভাত মুখে দিয়ে ভিড় বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস দৌড়নো। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করা। বড়বাবুর বকুনি, সহকর্মীদের খেলো হাসিঠাট্টা, যানজট, গাড়ির ধোঁয়া, আবার সন্ধে ছ’টা নাগাদ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা।

এখন বিকেল বেলা ছাদে উঠি কিংবা বুড়ি নদীর ধারটায় গিয়ে বসি। মাঝেমাঝে মনে হয় চুয়াল্লিশ নম্বর বাস, মারগারেট বিল্ডিং, বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদার কিংবা গোটা শহরটাই এই পৃথিবীর মধ্যে নয়। হতেই পারে না এই পৃথিবীর। বুড়ি নদীর বয়ে যাওয়া জলে বিকেলের শেষ রোদটা এসে লাফায়। এই সময়টা নদীর ধারে খুব শীতল অথচ মৃদু একটা হাওয়া দেয়। আগেও যে ক’বার এসেছি, দেখেছি দুটো শামখোল নদীর তীরে কাঁটা ঝোপের পাশে বালিয়াড়িতে লড়াই করে। আমার মতো একটা কুকুরও তাদের দাঁড়িয়ে দেখে মাঝে মাঝে। আজ দেখি ওরা একটা গুগলি নিয়ে টানাটানি করছে। কিন্তু শামখোল এ অঞ্চলে আগে পাওয়া যেতো না, ইদানিং বোধহয় আসছে। আচ্ছা শামখোলে কি গুগলি খায়?

-“হ্যাঁ খায় তো।” পাশ থেকে একটা বুড়োর গলার আওয়াজ আসে। কখন আমার অজান্তেই একটা থুত্থুড়ে লোক আমার পাশে ঘাসের ওপর এসে বসেছে। পরনে এক অদ্ভুত জোব্বা, অনেকটা জাদুকরদের মতো। গায়ের রং ফর্সা, গালের চামড়া ঝুলে পড়েছে। ছোটো ছোটো চোখের দুটো পাতার মাঝে অনেকটা ফাঁক। এ দেশীয় লোকের মুখের গড়ন এমনটা হয় না। লোকটাকে দেখে তবু মনে হলো আগে কোথাও যেন দেখেছি। কিন্তু আমি তো কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলাম! লোকটা বুঝলো কীভাবে? তাছাড়া বলা নেই কওয়া নেই এমন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবার দরকারটাই বা কী! বুড়ো লোকটাকে বললাম, “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”

-“চিনবেই বা কেমন করে? আমার বাড়ি তো এ দেশে নয়। টরেগারমা বলে কোনো জায়গার নাম শুনেছো কখনো? সেখানেই আমার আসল ঘর ছিলো। আমার ছোট্ট খড়ের ঘরের সামনে ছিলো নীল সমুদ্র। বালুচরে ছোটো ছোটো শিশুরা সকাল বিকাল খেলা করতো। ভোরবেলা ডিঙি নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম আমি। সেই মাছ গ্রামের বাজারে বিক্রি করে আমার একার সংসার ভালোভাবেই কেটে যেতো। বিকেলে সমুদ্র তীরে খেলতে আসা বাচ্চারা সন্ধেয় গিয়ে জুটতো আমার ঘরে, গল্প শুনবে বলে। ল্যাম্পের আলোয় বসে দেশ বিদেশের রূপকথা কিংবা সমুদ্রের অদ্ভুত সব প্রাণীর গল্প শোনাতাম তাদের। তাই তারা আদর করে আমায় ডাকতো ‘গল্প বুড়ো’।”

কাল অফিসে যোগ দিতে হবে। ভোরেই বেরবো। এক মাসের লম্বা একটা ছুটি একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছিল। শরীরটা মোটেও ভালো যাচ্ছিল না। কাজে কিছুতেই মন বসতো না। এখনো যে বিশেষ ভালো আছি তা নয়। নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক মাস পর আমাকে দেখে, বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদার দশটা মোটা ফাইল দিয়ে হয়তো চোখ পাকিয়ে বলবেন, “অ্যাদ্দিন খুব ফাঁকি মেরেছো। আজকের মধ্যেই এগুলো শেষ করো।” এসব কাজ কারই বা ভাল্লাগে! তার ওপর আবার এই বুড়োটা কীসব ভুলভাল গল্প শোনাচ্ছে। বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “সবই তো বুঝলাম! কিন্তু আপনি এদেশে এলেন কেমন করে? আপনার নামটাই বা কী? সেসব কিছুই তো বললেন না।”

-“আমার নাম তিইমা ল্য মাতসু। অতো বড় নামে কাজ নেই। তুমি আমায় গল্পবুড়ো বলেই ডাকবে। সবাই তাই ডাকে। এবার আমার এখানে এসে পৌঁছনোর ব্যাপারটা বলি। সেদিন ছিলো ঝড়ের রাত। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে একখানা গল্পের বই হাতে বিছানায় ঢুকেছি, এমন সময় দরজার কড়াটা কেউ সজোরে নাড়তে লাগলো। দরজা খুলতে দেখি একটা কমবয়েসি ছেলে দাঁড়িয়ে। পিঠে তার একটা ঢাউস বোঝা, বড় বড় বাবরি ছাঁট চুলগুলো ঝড়ের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে। সে আমায় জানালো আজ রাতটুকুর জন্য সে আমার আশ্রয়প্রার্থী। খাবারদাবার কিছুই লাগবে না, কেবল একটু শোবার জায়গা দিলেই হবে। চাইলে এর জন্য উপযুক্ত মূল্য দিতেও সে রাজি। একেই অতিথি দেবতার সমান, তার ওপর ঝড়ের রাতে এই অবস্থায় শত্রুকেও ফিরিয়ে দেওয়া চলে না। আমি তাকে সানন্দে আমার ঘরের ভিতরে ডাকলাম। বিনামূল্যেই তার রাত্রিবাসের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলাম আমার ছোট্ট ঘরে। ছোকরার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম সে পেশায় জাদুকর। দেশবিদেশে জাদু দেখিয়ে মানুষজনের মনোরঞ্জন করে। পাশের গলদের গ্রামে যে মেলা বসেছে সেখানেই আজ তামাশা দেখানোর কথা ছিলো তার। কিন্ত হঠাৎ ঝড় আসায় সে মেলা ভেস্তে যায়। কাল সকালেই এখান থেকে সে আপন দেশে রওনা দেবে। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে জাদুকর ছোকরাটি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ছিলো। পরনের জোব্বাটা খুলে সে খুব তাড়াতাড়ি বিছানা ধরলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমের মাঝে নাক ডাকতে আরম্ভ করলো। রূপকথা পড়ে আর রূপকথার গল্প শুনিয়ে আমার মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল জাদুকর হওয়ার। সে শখ পূর্ণ যদিও হয়নি। কিন্তু চোখের সামনে জাদুকর ছোকরার খুলে রাখা জোব্বাটা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ওটা গায়ে দিয়ে নিজেকে কেমন লাগে দেখবার ভারী শখ হলো। জোব্বাটা গায়ে দিয়ে জাদুকরের পোঁটলা হাতড়ে একখানা আয়না বের করলাম। সেটা নিয়ে মুখ দেখতে গিয়েই তো যতো বিপত্তি। সোজা একেবারে এ দেশে এসে উঠলাম। এই দেখো আমার গায়ের পোশাক, এটা ওই জাদুকরেরই জোব্বাটা।” বলে কী লোকটা! পাগল-টাগলের পাল্লায় পড়লাম বোধহয়। এমনটা আবার হয় নাকি!

-“জানি হয়তো আমায় পাগল ভাবছো তুমি। ভাববারই কথা। কিন্তু কী জানো, এ বিশ্বের অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা নেই। এই পৃথিবীতে দু’চোখ দিয়ে তোমরা যা দেখো তার সবটার পিছনে কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করো। কিন্তু দু’চোখ খোলা রেখে ততোটুকুই দেখা যায় যতোটুকু আমাদের দেখতে দেওয়া হয়। সব জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। ঘুমের মাঝে চোখ বন্ধ করেও তো কতো জিনিস দেখা যায়। ইচ্ছেমতো ছোটোবড় জগৎ বানানো যায়। ঘুম ভাঙলেই সে জগৎ ভেঙে গেলো তেমনটা নয়। স্বপ্নের চরিত্রগুলোরও একটা জীবন আছে। তা বাস্তবের অত্যন্ত সমান্তরাল। তাছাড়া কোনটা বাস্তব কোনটা স্বপ্ন তা বলার আমরাই বা কে! যাই হোক, আমার মনে হয় তোমার আরো ক’দিন বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। কাল অফিস থেকে একবার ঘুরে আসতে পারো। সবার সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগবে। আজ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিও। আমার বাড়ি ফিরতে সুবিধে হবে। এখান থেকে টরেগারমা কম পথ নয় তো!”

ঝুপ করে কখন সন্ধে নেমে গেছে। নদীর ওপারটা আর দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটার চোখ দুটো জ্বলছে। আমি মুখ ঘোরাতে না ঘোরাতে বুড়ো লোকটা হাওয়া!

 

দুই

শৌর্য আজ অফিস এলো দীর্ঘ এক মাস পর। বাড়ি থেকে নিজের গাড়িতেই এসেছে আজ। সঙ্গে স্ত্রী অথৈ-ও আছে। হাফ-ডে অফিস করে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। শৌর্যকে এতোদিন পর দেখতে পেয়ে সহকর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। গোমড়ামুখো পুলকবাবু পর্যন্ত এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “ওয়েলকাম ব্যাক।” বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদারের ঘরে ঢুকতে তিনি ফাইল ছেড়ে শৌর্যের দিকে মন দিলেন। শরীরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, রাজনীতি-খেলা নিয়ে গল্প জুড়ে বসলেন শৌর্যের সঙ্গে। কথার ফাঁকে বড়বাবু শৌর্যের দিকে এগিয়ে দিলেন একটা কাগজ। সরকারি স্ট্যাম্প দেওয়া কাগজটা দেখিয়ে তিনি বললেন, “আরো দশদিন বিশ্রাম নাও। আমি হাই অথরিটির অনুমতি জোগাড় করে এনেছি।” কিন্ত বিশ্রাম আর ভালো লাগছে না শৌর্যের। এবার ও কাজে ফিরতে চায়। তবু বড়বাবুর মুখের ওপর কিছু বলতে পারলো না সে। লোকটাকে যতোটা খারাপ ভাবতো শৌর্য, অতোটাও খারাপ নয়। বেরনোর সময় দারোয়ানটাও শরীরের খবর নিলো। শৌর্য গাড়িতে উঠে বসতে অথৈ-এর ইশারায় ড্রাইভার ফ্লাইওভার ধরলো।

মারগারেট বিল্ডিং-এর সামনে এসে থামলো গাড়িটা। শহরের বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ সুতমাল্য মাইতির বাড়ি। শৌর্য বাড়িতে লাগানো সাইন বোর্ডের লেখাগুলো উল্টো করে পড়ার চেষ্টা করে। শব্দগুলো ওর চেনা চেনা লাগছিল। অশীতিপর বৃদ্ধ সুতমাল্য বাবু বাড়ির সামনের বাঁধানো পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিলেন। অথৈ একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে গাড়ি থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে চললো। চোখে তার জল টলটল করছে। এ অশ্রু কৃতজ্ঞতার। 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_april golpo

তথাগত দত্ত

গ ল্প

ত থা গ ত  দ ত্ত

tatha

ফ্যান

রুদ্র এক কাপ কফি নিয়ে বসল, ধোঁয়া উঠছে কফি থেকে। গরম কফি। তবে বেশিক্ষণ গরম থাকবে না। ঠাণ্ডাটা ভালই পড়েছে কলকাতায়। রুদ্র একটা সিগারেট ধরাল। পরপর দু’টো রিং ছাড়ল। ঘরের জানলা দরজা বন্ধ। আস্তে আস্তে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকল উপরের দিকে। রুদ্র’র আবার আহেলির কথা মনে পড়ে গেল। 

 চার বছরের সম্পর্কটা হঠাৎ এভাবে শেষ হয়ে যাবে, রুদ্র কোনোদিনও তা ভাবেনি। রামশঙ্করবাবুর বেশ চালু ব্যবসা। শিলিগুড়িতে বড় শাড়ির দোকান। দু’জন কর্মচারী আর সঙ্গে রামশঙ্করবাবু নিজে।  রুদ্রও বিগত কিছু মাস ধরে দোকানে বসা শুরু করে দিয়েছিল। অবশ্য, দোকানে বসার পিছনে আহেলির ভূমিকা রয়েছে। রামশঙ্করবাবু, তাঁর স্ত্রী মিতাদেবী অনেক বলেও রুদ্রকে ব্যবসামুখী করতে পারছিলেন না। কিন্তু আহেলির সঙ্গে পরিচয়, তারও কিছুদিন পর ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি মিলে একটা তাগিদ তৈরি হয়েছিল রুদ্র’র মধ্যে। যার ফলে সে উপার্জনের দিকে এগোতে বাধ্য হয়েছিল। তার মানে এই নয় যে রুদ্র কর্মবিমুখ। রুদ্র আসলে শিল্পী। সে খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে। তাই ধরাবাঁধা কাজের প্রতি তার একটা ভীষণ অনীহা ছিল প্রথম থেকেই।    

কফিটা শেষ করে রুদ্র একটা অর্ধসমাপ্ত ছবি নিয়ে বসল। রুদ্র আহেলির একটা ন্যুড করা শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন আগে। তারপর পরিস্থিতির চাপে ছবি আঁকার মানসিকতা তার সম্পূর্ণভাবেই নষ্ট হয়ে গেছিল। আহেলির দু’টি স্তনের মাঝখানে হালকা একটা আলোছায়া দিতে দিতে রুদ্র’র মনে হল আহেলির কাছ থেকে দূরে থাকার জন্যই তো এরকম সামান্য একটা চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসা। তাহলে নতুন করে আবার সেই আহেলির কাছে এভাবে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণই হয় না। বুকের কাজটুকু করে নিয়ে রুদ্র মুখমণ্ডলে রঙের আস্তরণ ফেলতে শুরু করল নতুন করে। রাত বাড়তে থাকল, আর পাল্টাতে থাকল মেয়েটির মুখ। 

মুখ থেকে রুদ্র আবার বুকে চলে এলো। একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো তার মনে পড়তে থাকল। কয়েকবার মাত্র প্রদর্শিত হয়েছে তার ছবি, আপাতত। ছবি দেখে আহেলি মুগ্ধ হয়েছিল। পরিচয় আর তারপর সম্পর্ক শুরু হয়েছিল আস্তে আস্তে। আহেলি ভীষণভাবে উৎসাহ দিয়ে গেছে তাকে। বারবার বলেছে, ‘এখানে থেকে হবে না, রুদ্র। কলকাতা তোমাকে যেতেই হবে।’ এমনকী ব্যবসায় ঢোকার পর আহেলি বলেছে, ‘ব্যবসা যেন তোমার শিল্পসত্ত্বা গ্রাস করতে না পারে। একটা ছবির জন্য তোমার যা করার দরকার, তাই করবে রুদ্র।’  আর সেটাই যেন কাল হল শেষে। দিন পনেরো আগের কথা, রুদ্র একজন মহিলা মডেলকে নিয়ে কাজ করা শুরু করল। বেশ কিছু দিন সে আহেলির শরীর পায়নি, অথচ তার মনে হচ্ছিল একটা মৈথুন ভীষণ দরকার তা না হলে ছবিটা যেন ফুটছে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে কোনো ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট না করেই আহেলি এলো এবং রুদ্রকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় নিজের চোখে দেখে গেলো। রুদ্র কিন্তু নিজেকে দোষী ভাবতে রাজি নয়। আহেলি তো নিজেই বলেছে যে একটা ছবিকে বুকের গভীর থেকে তুলে আনার জন্য যা দরকার, সেটাই করবে! রুদ্র তো তাই করেছে! তাহলে ওসব কথা কি আহেলির মনের কথা ছিল না? অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও রুদ্র ব্যর্থ হয়। শেষে দু’তিন দিন আগে যখন রুদ্র খবর পেলো আহেলি বিয়ের রেজিস্ট্রি করেছে, একটি ছেলের সঙ্গে, তার আর ভালো লাগল না। ওই শহর ছেড়ে সোজা কলকাতা। চেনা শহর, স্মৃতি সবই যেন তার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছিল। 

কিছুটা মদ রুদ্র গলায় ঢেলে দিল। আজই দুপুর নাগাদ সে কলকাতায় পৌঁছেছে। জিনিসপত্র বেশি কিছু আনেনি। বাড়িওয়ালার কিছু জিনিস রয়েছে, এ দিয়েই তার কাজ চলে যাবে। তাছাড়া রান্নার তো কোনো ব্যাপার নেই। বাইরে থেকে কিনে এনে খাবে। 

রুদ্র  সিগারেট ধরাল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল ছবিটার মুখের দিকে। সে যেন চমকে উঠল। অথচ চমকে ওঠার তো কিছু নেই। একটি নারীর মুখ। যাকে সে কোনোদিনও দেখেনি। অথচ তার চোখে এমন কিছু আছে, যার ফলে তার চোখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না।

রুদ্রর কাজ বিকেল তিনটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তবে অফিসে অনেক সকালে যেতে হয়। মিন্টোপার্ক থেকে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র রবীন্দ্র সদনের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতায় আসার পর থেকে রুদ্র এমনই করে থাকে। টালিগঞ্জ থেকে মেট্রো করে রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে অফিসে চলে যায় আর ছুটির পর মেট্রো ধরার আগে রবীন্দ্র সদন চত্বরে কিছুক্ষণ সময় কাটায়, চা খায়, ফাইন আর্টসে গিয়ে প্রত্যেকটা গ্যালারি রোজ দেখে অনেকক্ষণ সময় ধরে। 

একটা ছবি, চারকোলের অসাধারণ কাজ। নিমগ্ন হয়ে রুদ্র সেটাই দেখে চলেছিল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পাশে। বুদ্ধের একটা আবক্ষ তৈলচিত্রের সামনে এক মহিলা। কালো শাড়ি, কালো স্লিভলেস  ব্লাউজ। শৌখিনতায় একটা হলদে সানগ্লাস কপালের উপর তোলা রয়েছে তাঁর। মহিলার শরীরে এমন একটা ভাষা আছে, যা যে কোনো পুরুষকেই একবার হলেও তাঁর দিকে তাকাতে বাধ্য করবে। রুদ্র তাকিয়ে রয়েছে মহিলার দিকে। তবে শুধুমাত্র এই একটা কারণেই যে সে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেটা নয়। আসল কারণটা হলো, তার আঁকা সেই ছবিটার সঙ্গে এই মহিলার ভীষণ রকমের মিল। একজন অচেনা, না দেখা মানুষকে সে যেন এঁকে ফেলেছে নিখুঁত দক্ষতায়। রুদ্র এগিয়ে গেল মহিলার দিকে।

হোয়াটসঅ্যাপে ছবিটা দেখে নন্দিতা তাঁর সমস্ত ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ তো তাঁরই ছবি। রুদ্রর কিছুটা সংকোচ ছিল, যতোই হোক নগ্ন চিত্র, নন্দিতা কীভাবে দেখবেন ব্যাপারটা! তবে সে নিয়ে অবশ্য রুদ্রকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। 

আজকাল রুদ্রর মনে হয় আহেলির সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে ভালোই হয়েছে যেন।  ও জীবনে থাকলে নন্দিতার সঙ্গে হয়তো তার দেখাই হতো না। রুদ্র বুঝতে পারছে নন্দিতাকে তার কী ভীষণভাবে দরকার। একটু বয়সে বড় সুন্দরী মহিলাদের প্রতি রুদ্র’র বরাবরই আকর্ষণ ছিল খুব। নন্দিতা তার জীবনে প্রথম মহিলা যিনি বলেছেন, ‘রুদ্র, আমি তোমার ফ্যান হয়ে গেছি।’ 

নন্দিতার স্বামী জয়দীপবাবু কলেজে পড়ান। বছর তিনেক হল তাঁদের বিয়ে হয়েছে। এখনও সন্তান হয়নি। নন্দিতা এবং জয়দীপের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সেই ছবিটা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দোতলার কোণের ঘরে টাঙানোর পর থেকে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে কি একটু হলেও চিড় ধরল! নন্দিতা অবশ্য সম্পর্কে চিড় ধরার মতো কোনো সুযোগই দিতে চান না জয়দীপকে। জয়দীপকে তিনি সোজা কথাটা সোজা ভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন, ‘জয়, আমি কিন্তু রুদ্রর সামনে কাপড় খুলিনি। দেখতেই তো পাচ্ছো, মুখ বাদে ছবিটার সঙ্গে কোনো মিলই নেই আমার। আমার বুকে তো তিল আছে, কোথায় তিল ছবিটায়? তাছাড়া আমার নাভি অনেক গভীর। ছবির মতো নয় মোটেও। আমি ওকে ভালোবাসি না জয়, ভালো তোমাকেই বাসি। আমি জাস্ট ওর ফ্যান, ব্যস এটুকুই, ওর ছবির গুণমুগ্ধ ভক্ত।’ 

নন্দিতা কিন্তু জয়দীপকে ঠকাতে চান না। কারণ জয়দীপের মতো ভালো মানুষ তেমন হয় না আজকাল। তাছাড়া জয়দীপের মতো ভালবাসা দেওয়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু রুদ্র’র প্রতি তাঁর কী যে এক আকর্ষণ, নন্দিতা এর কারণ কিছুই ভেবে বের করতে পারলেন না।

আজকাল নন্দিতার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে কিছুটা। বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়েন। বিয়ের ঠিক পর পরই জয়দীপ টালিগঞ্জে ছোট দোতলা এই বাড়িটা কিনেছেন। যাদবপুরের বাড়িটা একতলা, মাত্র দুটো ঘর সেখানে। ও বাড়ি এখন ফাঁকা পড়ে থাকে। টালিগঞ্জ থেকে মেট্রো ধরে নন্দিতা রুদ্র’র মতোই চলে আসেন রবীন্দ্র সদন। বসে অপেক্ষা করেন রুদ্র’র জন্য। অফিস শেষ করে রুদ্র চলে আসে। তারপর দু’জনের  মনের মতো করে কিছুটা সময় কাটানো। পুড়তে থাকা সিগারেটে ভাগাভাগি করে চুম্বন, আড্ডা, একসঙ্গে সিনেমা দেখা। নন্দনের নান্দনিক অন্ধকারে হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট। 

রামশঙ্করবাবু রুদ্র’র এই কলকাতায় পড়ে থাকা নিয়ে ভীষণ রুষ্ট। এর আগে দু’বার টাকা পাঠালেও আর তিনি টাকা পাঠাবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। এসব সমস্যার কথা রুদ্র বলে চলেছিল। নন্দিতা বেশ কয়েকদিন ধরেই রুদ্রকে অফিস ছুটি নিয়ে ওঁর বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলেন। সারাটা দুপুর নিভৃতে কাটালে দুজনেরই মন ভাল হবে। ‘কাল এসো রুদ্র, আমি অপেক্ষা করব’, বলে নন্দিতা এগোতে থাকলেন দ্রুত পায়ে। রুদ্র আর এগোল না। সিগারেট ধরাল। দু’জনেরই গন্তব্য টালিগঞ্জ, তাই রুদ্র আর নন্দিতার সন্ধ্যাগুলো একসঙ্গে মেট্রো সফরের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় রোজ।

দেখতে দেখতে বসন্ত এসে গেল। দোলটা জয়দীপ আর নন্দিতা শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে এলেন দিন কয়েকের জন্য। এই সময়টা রুদ্র বেশ একাকিত্বে কাটিয়েছে। বেশ কয়েকদিন রুদ্র অফিসে যাওয়া বন্ধ করায় তার চাকরিটা গেছে। অফিসে না গিয়ে সে নন্দিতার বাড়িতে যায় দুপুরবেলা। নন্দিতা খুব অবাক হন জয়দীপের ব্যাপারে। জয়দীপ কি তাঁর চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারেন না যে তিনি কী গভীরভাবে ডুবে আছেন অন্য এক পুরুষের প্রেমে!  অবশ্য চোখে চোখ রেখে রুদ্র’র প্রতি তাঁর ভালবাসা বোঝার দরকার হয় না, কারণ ওঁরা দু’জনে গল্প করতে বসলে আজকাল নন্দিতা বেশিটা সময় রুদ্র’র কথাই বলেন জয়দীপকে। কী অদ্ভুত মানুষ এই জয়দীপ। নন্দিতাকে নিজের বুক দিয়ে আগলে রাখেন। রুদ্রর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র রাগ নেই! 

রুদ্র এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি এঁকেছে। নন্দিতার মতো মেয়ে জীবনে থাকলে সৃষ্টির একটা আলাদা উৎসাহ পাওয়া যায়। নন্দিতা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলেছেন, ‘রুদ্র, এখন আমার একটাই পরিচয়, আমি তোমার ফ্যান।’ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট দেখে এক ভদ্রলোকের কয়েকটা ছবি বেশ পছন্দ হয়েছিল। তিনি আজ কিনে নিয়ে গেলেন। অবশ্য তরুণ শিল্পীর আঁকা ছবি তো, কেউ তেমন দাম দিতে চায় না। রুদ্র’র এই টাকাটা ভীষণ দরকার ছিল। হাতের লক্ষ্মীকে সে পায়ে ঠেলতে পারেনি। 

ফাল্গুনের মাঝামাঝি গরম পড়তে শুরু করেছে। একটা পাখার দরকার হয়ে পড়ল। যদিও রুদ্র’র এখন ফ্যান কিনে পয়সা নষ্ট করার ইচ্ছে নেই মোটেও। কিন্তু কিছু করারও নেই। সন্ধ্যার দিকে রুদ্র পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ানের দোকানে গেলো। কখন যে কার হাতে কী চলে আসে, তা কেই বা বলতে পারে! আজ সকালেই নাকি এক ভদ্রলোক পুরনো একটা সিলিং ফ্যান বিক্রি করে গেছিলেন। অজিতবাবু সেটা রুদ্রকে ভাড়ায় দিতে রাজি হয়ে গেলেন। তখনই একটি ছেলেকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন রুদ্র’র সঙ্গে। পাখা লাগানো হয়ে গেলো। দু’দিন আগে ভাড়া করা পাখা নিয়ে রুদ্র’র কথা হচ্ছিল নন্দিতার সঙ্গে। নন্দিতা অবশ্য বলেছিলেন, ‘রুদ্র, দিনকাল পাল্টে গেছে, কলকাতায় আজকাল ভাড়ায় আর পাখা পাওয়া যায় না। পাখা তো দূরের কথা, দেখছোই তো এখন ঘরে ঘরে এসি।’ তারপর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একটা হাইস্পিড ফ্যান কিনে দিই তোমাকে, রুদ্র?’ রুদ্র অবশ্য সেই প্রস্তাব তখনই নাকচ করে দিয়েছিল। 

এইসব ছোটখাটো প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তিতে খুশি হওয়ার নামই জীবন। পাখার হাওয়া লেগে তার মনটা যেন ফুরফুর করে উড়ছে। নন্দিতাকে খবরটা জানানোর সে জন্য পকেট থেকে ফোন বের করল। কিন্তু খবরটা তাকে আর জানানো হল না। হোয়াটসঅ্যাপে নন্দিতার টেক্সট মেসেজ জমে আছে- ‘রুদ্র, পিরিয়ড মিস করেছিলাম। সন্দেহ হল, প্রেগা টেস্ট করে দেখছি আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট। রুদ্র, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। কী করবে এখন তুমি?’

রুদ্র কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। তার মনে হল পৃথিবীর সমস্ত ভার যেন তারই মাথায় চেপে বসেছে। সে ফোন করল নন্দিতাকে বেশ কয়েকবার। রিং হয়ে থেমে গেল। বাধ্য হয়ে টেক্সট করল তারপর। সীন হয়ে পড়ে রইল তার সমস্ত মেসেজ। কোনও রিপ্লাই এলো না।

রাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল রুদ্র’র। সে চোখ খুলে তাকাল আর নাইট ল্যাম্পের অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোয় সে দেখল মাথার উপর পাখাটা ঘুরছে বনবন করে। মৃদু আলো ফ্যানের ব্লেডে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কী এক রহস্যময় দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রুদ্র’র মনে হল সে যদি গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে পড়ে তাহলে তার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হবে মুহূর্তে। তার পরেই রুদ্র’র মনে হলো কী সব ভয়ংকর কথা সে ভাবছে! তার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? সে কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছে? এক লাফে সে বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। দরজা খুলে এসে দাঁড়াল এক চিলতে ব্যালকনিটায়। একটা সিগারেট ধরাল। সারা রাত তার আর ঘুম এলো না। 

সারা রাতের দুশ্চিন্তা আর রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে সে পরের দিন দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। হোটেলের ঘরে এক ব্যক্তি নাকি গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল, তারপর থেকে ওই পাখা চালিয়ে যে-ই শুয়েছে তারই নাকি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে— এমন একটা ঘটনার কথা রুদ্র শুনেছিল। ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষণ। তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। 

কলকাতায় আসার পর প্রায় আড়াই মাস কেটে গেছে। একবারও সে বাড়ি ফেরেনি। প্রথম প্রথম মা ফোন করে খুব ডাকাডাকি করতেন, আজকাল তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কলকাতার পরিবেশ কেমন একটা দমবন্ধকর হয়ে ওঠায় রুদ্র বাড়ি ফিরেছে আজ। মা ভীষণ খুশি, ‘বাবা, তুই জানিয়ে এলে কতো কিছু রান্না করে রাখতাম, এখন আমার হুটোপাটি লেগে যাচ্ছে।’ রামশঙ্করবাবুও খুশি হয়েছেন যথেষ্ট, কিন্তু মুখে তেমন কিছু প্রকাশ করলেন না। 

রুদ্র’র এখন বাড়ি ফেরার আরেকটি কারণ হল টাকা। সে ঠিক করেই এসেছে বাবার কাছে টাকা চাইবে এগজিবিশনের কথা বলে। না পেলে সে বাবার সিন্দুক থেকে চুরি করতেও পিছপা হবে না। কারণ টাকাটা তার চাই-ই চাই। ব্যবসার কারণে রামশঙ্করবাবুকে ভালো অ্যামাউন্টের ক্যাশ রাখতে হয় নিজের কাছে। রুদ্র আসলে নন্দিতার গর্ভপাত করাতে চায়। আর এই সব ইললিগ্যাল অ্যাবরশান করাতে টাকা কেমন জলের মতো বেরিয়ে যায়, সে তো সকলেরই জানা। 

শিলিগুড়িতে গরম নেই। পাখা চালানোর দরকার ছিল না, তবুও একটা উদ্দেশ্য নিয়েই রুদ্র গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে পাখা চালিয়ে শুলো। সারারাত ধরে সে ঘুমাল, অনেকদিন পর খুব সুন্দর একটা ঘুম হল তার। 

পরের দিন সকালবেলাটা তার আশ্চর্যজনকভাবে শুরু হল। হোয়াটসঅ্যাপে নন্দিতার টেক্সট- ‘আমি দেখছিলাম তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি কিনা। নাহ্, পারলাম না। বিয়ে করবে আমাকে? মানছি জয়দীপের মতো মানুষ হয় না। কিন্তু আমাকে তো একজনকে বেছে নিতে হবে। আমি না হয় তোমাকেই বেছে নিলাম রুদ্র। তুমি নেবে না আমাকে?’

এরপরে আর কোনো কথা থাকতে পারে না। ব্রেকফাস্ট করেই রুদ্র কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। অনেকদিন পর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। তাছাড়া বাপের টাকা চুরি করেও তাকে পাপের বোঝা বাড়াতে হলো না। 

ক্লান্ত ছিলো, তবু রুদ্র’র ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে সে উঠে বসল বিছানায়। তার সারা শরীরে ঘাম। পাখাটা দ্রুত ঘুরে চলেছে। সে পাখার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। পাখার স্যুইচ অফ করল। তার মনে হলো সত্যিই যেন কিছু রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই ফ্যানের মধ্যে। সে একটা চেয়ার নিয়ে খাটের উপর রাখল। তারপর চেয়ারের উপর উঠে ভালো করে দেখতে থাকল পাখাটাকে। অনেকক্ষণ চলায় বেশ গরম হয়ে রয়েছে পাখাটা। 

পরের দিন পুলিশ দরজা ভেঙে রুদ্র’র ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে নিয়ে গেল পোস্টমর্টেমের জন্য। নন্দিতা এই খবরটা কয়েকদিন পর পেলেন। তারপর থেকে তাঁর শরীর এবং মন দুটোই খারাপ হতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। নন্দিতার আজকাল মনে হয় খুব ভুল করেছেন তিনি। জয়দীপই তাঁর প্রকৃত বন্ধু, প্রকৃত ভালবাসা। এখন তিনি তীব্রভাবে ফিরে আসতে চাইছেন জয়দীপের কাছে কিন্তু পারছেন না। কিন্তু এই সন্তানের পিতৃপরিচয় কীভাবে জানাবেন তিনি জয়দীপকে? 

জয়দীপ এখন রাতে পাশের ঘরে শোন। তার কারণ, তিনি আজকাল সিগারেট খাওয়া ধরেছেন। ধোঁয়ায় নন্দিতার অসুবিধে হোক তা তিনি চান না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে নন্দিতাকে, ওষুধ চলছে।

পুলিশের তদন্ত মিটে গেল খুব দ্রুত। এটা যে আত্মহত্যা, সে বিষয়ে কারোরই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যে ভদ্রলোক ওই পাখাটা অজিতবাবুকে বিক্রি করে গেছিলেন, তিনিই আবার সেই পাখাটাই কিনবেন বলে দোকানে এসে হাজির। অজিতবাবু একটু অবাকই হলেন তারপর ভাবলেন, ভালই হল। ‘আপনার বাড়িটা বলে যান, আমার কাজের ছেলেটাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠাচ্ছি।’

রবিবারের দুপুর।  ভদ্রলোকটি ভাত বসিয়েছেন তখন। ইলেকট্রিশিয়ান ছেলেটি কাজ শেষ করে বেরিয়ে যেতে যেতে এমনিই জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, রান্নার কতদূর?’ 

হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। মুখটাকে কিছুটা চেপে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে জয়দীপ উত্তর দিলেন, ‘এখন শুধু ফ্যান গালা বাকি।’ 

আরও পড়ুন...

Categories
2023_mar golpo

ফাল্গুনী ঘোষ

গ ল্প

ফা ল্গু নী ঘো ষ

falguni

ভিড় ও মায়াপদ্ম

ক্লাবে আজকাল ভিড় বেড়ে গেছে। তিনজনের দল ফুলেফেঁপে উপচে পড়ছে। হিন্দোল, রৌণক আর পিকলু। এরা পাড়াতুতো বন্ধু, আবার এক স্কুলের জুড়িদার। তিনজন মিলে গাছতলায় বসে একদিন আড্ডা দিতে দিতে মনে হয়েছিল স্কুল-টিউশনির বাইরে এরকম আড্ডা মাঝে মধ্যে আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী! মন্দ হয় না! জীবনের প্রথম পরীক্ষা অর্থাৎ দশমের পরীক্ষা এরা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের হক আছে একটু আধটু নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার। এই দলে পিকলুটাই পড়াশোনায় কমজোরি। কিন্তু পিকলুর সাজ, পোশাক কেতাদুরস্ততায় তা বোঝবার কোনো উপায় নেই। পিতৃপ্রদত্ত একটা নাম পিকলুর আছে। সে নাম নিয়ে বন্ধুরা এত হাসি ঠাট্টা করে যে সে নামের প্রাচীনত্ব ঘরের কোণে মুখ লুকোয়। এর চেয়ে পিকলু নামটাই ভালো, স্বয়ং নামের অধিকারীর এটাই মতামত। 

তো, এদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার শখ পিকলুরই সবচেয়ে বেশি। ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু তার সমান সমান। উল্টে মেয়ে বন্ধু একটু বেশি হবে বৈ কম নয়। পিকলুর মেয়ে বন্ধুগুলোকে দেখে হিন্দোল ভাবে প্রায়ই, কী করে যে পিকলু পটায় মেয়েগুলোকে! এদিকে রৌণক চায়, পিকলুর মেয়ে বন্ধুগুলোর দু’একটাকে ভাঙিয়ে নিজের দলে নিতে। এমন পটাবে যেন পিকলুর সামনেই তার বন্ধুনীর দল রৌণকের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কিন্তু চাইলেই কি আর সব আশা পূরণ হয়! বইখাতা, স্কুল, টিউটোরিয়াল, এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি এদেরকে যেভাবে মাপে মাপে ঘিরে রাখে, সেসবের ফাঁক গলে অবসর মুহূর্তের মজা বা গভীর গুরুতর জীবনবোধ কোনোটাই এদের কাছে ঘেঁষতে পারে না। তাও যে পিকলুটা কী করে মেয়েদের মধ্যমণি হয় সেকথা ভেবে ভেবে অন্তরে অন্তরে জ্বলে রৌণক। 

হিন্দোলও ভাবে তার নিজের মতো করে। আড়চোখে দূর থেকে দেখে সুন্দরীদের। তার না আছে আফশোস, না আছে ঈর্ষা। শুধু আছে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যাতীত অস্বস্তি। যে অস্বস্তি তাকে সোজা চোখে তাকাতে দেয় না। কোনো সুন্দরীর চোখে রাখতে পারে না চোখ। অথচ সুন্দর মুখ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মনের মধ্যে অচেনা এক গুবরে পোকা অযথা ভিড় করে। ক্লাব গঠনের প্রস্তাবে হিন্দোলের সায় ছিল সে কারণে সব থেকে বেশি। জোর সওয়ালও করেছিল ক্লাব গঠনের পক্ষে। যদিও রৌণকের সঙ্গে এই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হয়েছিল হিন্দোলের। 

“ওরে দোল দোল! এরকম ক্লাব তৈরি করে লাভের লাভ কিচ্ছু হবে না।” এই ছিল রৌণকের মতামত। হিন্দোলের নাম নিয়েও বন্ধুমহল যথেষ্ট মজা করে। ওর লাজুক স্বভাবের জন্য কেউ ডাকে দোলা, আবার কেউ কেউ বলে দোল দোল! বয়ঃসন্ধিজনিত বড় হয়ে ওঠার চালচলন ঢংঢাং-এ হিন্দোল ততোটাও দুরস্ত নয়! তথাকথিত ছেলেমানুষী স্বভাব বোধহয় তার সহজাত। অবশেষে এই শর্তে ক্লাব গঠন হয় যে, ক্লাবের তিনজন মেম্বার যার যত ইচ্ছে চেনাজানা পরিচিতদের ক্লাবে যোগদান করাতে পারবে। শর্তকে কেন্দ্র করে শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা রৌণক আর পিকলুর মধ্যে। যে যতো পারে সুন্দরী মহিলা বন্ধুদের ক্লাবে সদস্য করতে শুরু করে।  

সপ্তাহে একদিন এদের মিটিং হয়। ক্লাব গঠনের সময় সেরকমই নিয়ম কানুনের লিস্টি তৈরি হয়েছিল। মিটিং-এর দিন মোবাইলের পর্দা জুড়ে শুধু সবুজ বিন্দুর সজীব উপস্থিতি। রঙিন মনভোলানো কিছু মুখ চকিতে জেগে ওঠে, আবার স্তব্ধ হয়। কিছু পরে আবার ফিরে আসে, কোনো কোনো বিন্দু হয়তো আর আসেই না। এসব মুখের অবয়বের উপস্থিতি এখানে জরুরি নয়। হয়ত তারা অবয়বহীন নয়। নয়তো অবয়ব আর বাহ্যিক পরিচয়ের সামঞ্জস্যহীন সে মুখগুলি উজ্জ্বল ধাতব আলোয় জেগে থাকে। আলোকবিন্দুর কেন্দ্রস্থলে সারি সারি সাজানো সুন্দর মুখ হিন্দোলের দৃষ্টিপথে আটকে দাঁড়ায়। মিটিং-এ কী কথা হয় কানে ঢোকে না তার। ইচ্ছেও করে না সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতে।  সুন্দরী মুখে চোখের ইশারা, নিপুণ হাতে আঁকা চোখ ও রাঙানো ঠোঁট, ভ্রু, চুলের রঙ এসব মন ভরে দেখে হিন্দোল। মিটিং ভেঙে গেলে আলোরা ঝুপঝাপ নিভে যায়। নিথর ছবির সারি তখন তারা। মোবাইল দূরে ঠেলে হিন্দোল পড়ার  টেবিলে উঠে যায়। টেনে নেয় বইখাতা। 

পাতার পর পাতা খোলে। খাতার পাতা সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে। খেলতে খেলতে হাওয়ায় অক্ষরেরা উড়ে যায় কাঁধে ডানা নিয়ে। হিন্দোল দেখে। তার চোখের পলকে বয়ে যায় কালো স্রোত। একের পর এক কালো অক্ষরেরা ঢেউ হয়ে ধাক্কা দেয় দৃষ্টিপথে। মাঝে মাঝে সে ঢেউয়ের  চূড়োয় ফসফরাসের মত জ্বলে ওঠে সুন্দর মুখেরা। হিন্দোল স্পষ্ট দেখতে পায়। খাতার পাতায় কালো অক্ষরের স্রোতে যে সাদা ফেনা জমছে, সুন্দরী মুখেরা সে ফেনার অবয়ব পাচ্ছে। ভিজে কাপড়ে শরীরী বিভঙ্গে তিরতির করে  কাঁপছে সে অবয়বগুলি। দেখতে দেখতে নেশা ধরে। গা ঝিমঝিম করে হিন্দোলের। দুলে যায় পড়ার চেয়ার টেবিল। টেবিল ল্যাম্পের সুইচ বন্ধ করে বড় টিউবলাইট জ্বেলে আলোর বন্যা বইয়ে দেয় সে ঘরময়। বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। বুকে ও মুখে চাপা দেয় বই। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। যেন অবয়বগুলি আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে হিন্দোলকে। কানে কানে ফিসফিস করে বলে,  

“ওগো শুনছ! এস, দোল দোল খেলি!”

কান গরম হয়ে ওঠে হিন্দোলের। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয় । দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তার সঙ্গেই বা কেন এরকম হচ্ছে! মেয়েগুলোকে সে চেনে না, জানে না। শুধুমাত্র একটা ভার্চুয়াল ভিড়ের অংশ যারা, যাদের অস্তিত্ব ডিজিট্যাল, তাদের মুখ দেখে এরকম আজেবাজে ভাবনা হিন্দোলের মাথায় আসবেই বা কেন! এরা সবাই আসলে অধরা। এমনকি আসল না নকল তাও জানে না সে। এতো যুক্তির পরে কেন তার মন ভয়ঙ্কর মাদকতায় মেতে উঠছে! বেশ কিছুদিন থেকে পড়াশোনা যেন তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। টপ টপ করে দু’চোখ থেকে জল ঝরে তার। সে অশ্রু বই-এর কালো অক্ষরেরা শুষে নেয় নিজের ঠোঁটে। 

এদিকে তার প্রাণের বন্ধুরা চায় ভার্চুয়ালের অবয়বগুলি রিয়ালে নেমে আসুক। কিন্তু হিন্দোলের মন সায় দিতে গিয়েও দিতে পারে না। দুলে যায় আশঙ্কার দোলায়— ভার্চুয়াল সুন্দরী মুখের অধিকারিণীরা যদি সত্যিই বাস্তবে আসে! কী হবে তখন তার! সে নিজেও নিজেকে জানে না! ভরসা করতে পারে না আজকাল নিজেকে!

এখন ভরপুর শীতকাল। হিন্দোলরা যে আবাসনে থাকে সেখানেই ভিতরের দিকে একটি বাচ্চাদের খেলার পার্ক আছে। একপাশে কোয়ারি করা শীতকালীন ফুল। গাঁদা, গোলাপ, জিনিয়া, সূর্যমুখী ডালিয়ার বাহার। সামনেই সবুজ মাঠে রঙ বেরঙের সোয়েটার টুপির কচি মালিকেরা ঠিক ফুলের মতোই ফুটে থাকে প্রায় দিনভর। ইদানীং এখানে এসেই বসছে  হিন্দোল। ঠিক এখন এই মুহূর্তে তার কোনো বন্ধু নেই। রৌণক, পিকলু তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে ক’দিন বিশ্রাম চাইছিল। কিন্তু পিকলুরা বুঝতে চায় না। তর্কাতর্কি হতে হতে শেষে গ্রুপ লিভ করল হিন্দোল। এসবই হয়েছে সেদিনের পিকনিকের পর থেকে। 

সবে দিন চারেক আগের কথা। শহরাঞ্চলে আজকাল জমাটি শীত তেমন পড়ে না কয়েক বছর ধরে। এ বছর সেসব রেকর্ড ভেঙে বেশ নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে উত্তুরে হাওয়া। হিন্দোলদের আবাসনের পক্ষ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয় প্রতি বছরই। কিন্তু অফিশিয়াল ব্যস্ততার জন্য এদের পরিবারের যাওয়া হয় না। এবার বাবা-মায়ের অবসর ও পিকনিকের তারিখ-সময় সহাবস্থানে আসায় সকাল ছ’টা থেকেই হাঁকডাক শুরু হয়। রাত জেগে পড়াশোনা করার অভ্যাস থাকায় হিন্দোল ভোর ভোর উঠতে পারে না কখনোই। ফলত পিকনিক যাওয়ার সময়ের কথা শুনেই হিন্দোল বিরক্তি বোধ করে। তাও বাবা মায়ের সঙ্গ ছাড়ে না। পিকনিক বলে কথা। স্বভাবতই ভোর ভোর উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আধা ঘুমন্ত অবস্থায় সে পৌঁছে যায় সবুজবনের ধারেকাছে। 

“কী হিন্দোল, জায়গাটা কেমন লাগছে বল! আমিই পছন্দ করেছি এই প্লেস!” মুখার্জী আঙ্কেলের গমগমে গলায় চমক ভাঙে হিন্দোলের। এই আঙ্কেল বেশ বন্ধুর মতো সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তার বাবার মত রাশভারী, কম কথা বলা কেজো মানুষ নয়। এমনিতেই এ পিকনিকে তার কোনো জুড়িদার বন্ধু নেই। ফলত মুখার্জী আঙ্কেলের সাহচর্য তাকে স্বস্তি দেয়। পড়াশোনা কেমন চলছে, ফিউচার প্ল্যান কী, এসব টুকরোটাকরা কথা বলতে বলতে আশেপাশে পা চালিয়ে দেখছিল হিন্দোলরা। 

ঘন সবুজ বনের ভিতরে লাল কাঁকুরে মাটি, এবড়ো খেবড়ো নুড়ি বিছানো পথ। সে পথ ধরে ছোট্ট সবুজ বন পেরিয়ে গেলে নাকি ওদিকে একটা টলটলে জলাশয় আছে।

“বুঝলি হিন্দোল! জোরে জোরে শ্বাস টেনে নে! এত তাজা বাতাস তো শহরে পাবি না!” মুখার্জী আঙ্কেলের আকুতি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে হিন্দোল। শ্বাস নেয় আর তন্ময় হয়ে দেখে, গাছপালা পাতালতাকে জড়িয়ে ধরে রোদ ঝুলে আছে পথের উপরে। আলতো চুমু খেয়ে হাওয়ায় পাক দিয়ে উঠছে ধুলোর রেখা। যেন এক গভীর প্রেমের আলেখ্য লেখা হচ্ছে নরম রোদেলা চিঠির পাতায়। অনাবিল আনন্দে মন ভরে ওঠে তার। 

পথের পাশে বসে পড়ে সে। রোদ মাখে গায়ে। হাওয়া আর ধুলোর রেখায় আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলপনা আঁকে জীবনের। সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে বসে। ভুলে যায় নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কথা। মনে মনে কৃতজ্ঞ হয় মুখার্জী আঙ্কেলের কাছে। এতক্ষণ বেশ একা একাই ঘুরছিল। নিজের গহীনে প্রবেশ করে ভুলেই গিয়েছিল আঙ্কেলের কথা। হঠাৎ সামনে থেকে পুরুষালি কণ্ঠের উদাত্ত গান ভেসে আসে। হারিয়ে যাওয়া ঘন সবুজের মধ্যে পুরুষালি গলার সঙ্গতে ভেসে আসে তীক্ষ্ণ সুরেলা নারী কণ্ঠও। প্রবল কৌতূহলে উঠে দাঁড়ায় হিন্দোল। পায়ে পায়ে এগোতে থাকে। 

কিছুটা এগিয়ে দেখে মুখার্জী আঙ্কেলের পাশে টাটকা তাজা এক সুন্দরী কিশোরী। পা আটকে যায় হিন্দোলের। আর যেন পা বশে নেই। মুখার্জীবাবু হিন্দোলের অস্বস্তি উপলব্ধি করে সাদরে টেনে নেন তাকে, “আরে! লজ্জা পাচ্ছিস নাকি! ও তো আমার মেয়ে দেবমৌলি! আমরা মলি বলেই ডাকি…।” এই বলে মলিকে হাঁক দেন, “কই? এদিকে আয় রে মলি। হিন্দোলের সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দিই।”

মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ায়। হিন্দোল আড়চোখে দেখে। চকচকে মার্বেল পালিশের মতো গায়ের রঙ। গাঢ় কাজলের প্রলেপ দেওয়া নেশাধরানো চাউনি! ঠোঁটটা কী লাল! রক্তের মতো। যেন মাংসল জীবনের হাতছানি! ধারালো পালিশ করা হাত আর নখ নিয়ে মেয়েটি এগিয়ে আসে বন্ধুতার সৌজন্যে।

হিন্দোলই তা গ্রহণ করতে পারে না। প্রচন্ড এক অস্বস্তিতে মুখ নামিয়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। উদভ্রান্তের মত এক ছুটে এসে গাড়িতে বসে। গাড়ির সিটে মাথা রেখে এলিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ সময় এভাবে যায় পেরিয়ে। সাময়িক অস্বস্তি কাটে হয়ত, কিন্তু সে ভঙ্গি, সে মুখ, অবয়ব অত সহজে হিন্দোলকে রেহাই দেয় না। 

তারপর থেকেই দেবমৌলির সুন্দর মুখ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। আগে পড়ার টেবিলে, নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে শুলে সুন্দর মুখগুলো তাকে আঁকড়ে ধরত। শিরশির করে উঠত সমস্ত রোমকূপ। অস্বস্তি হত তার। নিজেকে নিয়ে নিজেই লজ্জিতও হত। শাসনও করত নিজেকে। কিন্তু আজকাল অন্য স্তরে পৌঁছে গেছে এ অস্বস্তি। এখন মাঝে মধ্যেই তার গা গুলিয়ে ওঠে। ঘরের দেওয়াল জুড়ে সবুজ ঘন অন্ধকার নেমে আসে প্রায়শই। সে অন্ধকারের উৎসে এক সুতীব্র সুন্দরী অনিঃশেষ জড়িয়ে ধরে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। ঐ অন্ধকার থেকে একছুটে আলোর দিকে মুখ ফিরে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়। হাওয়ায় আঙুল ছুঁইয়ে রোদেলা ধুলোর আলপনা আঁকতে মন চায়, ঠিক যেমন পিকনিকের দিন সকালেই এঁকেছিল। নিজের অন্দরমহলের ভয়ানক অস্বস্তি ভুলে থাকার জন্য হিন্দোল পার্কে বসে রঙ বেরঙের ফুলেদের ফিসফাস কান পেতে শোনে। আবাসনে বাচ্চাদের পার্কে বসে সে প্রহর গোনে, যদি আবার কোনো রোদের চিঠি খাম খুলে তার কাছে ভেসে আসে। 

“বুঝলি হাঁদু, কাল তোকে আরো উত্তরে তিরপিতা নদীর ধারে নিয়ে যাব!”

“ম্যাজিক মামু! আবার তুমি আমাকে হাঁদু বলছ!”

“হা হা হা…” উদার প্রশস্ত গলায় হাসে হিন্দোলের ম্যাজিক মামু। সস্নেহে মাথার চুল ঘেঁটে দেয় তার আদরের হাঁদুর।

ম্যাজিক মামুর একটা নাম থাকলেও লোকে হয়ত ভুলে গেছে।  মিসেস বোসের আপন ভাই সে নয়। পড়শি ভাই বলা যায়। পড়াশোনা শেষ করে গ্রাম ছেড়ে কোথাও গেলই না। সোনাটিয়া অবশ্য ঠিক গ্রাম নয়, গঞ্জ এলাকা। এই এলাকা এবং আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে কার ঘরে মানুষ অসুস্থ, তাকে ডাক্তার বৈদ্য দেখানো, কার বাড়ির ছেলেমেয়ের পরনে কাপড় নেই, কে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে মাঠেঘাটে গোরু চড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে ধরে এনে বইমুখী করা– এসব নিয়েই মেতে থাকে ম্যাজিক মামু। ঘরের মানুষের কাছে এসব বড় বিরক্তির। তারা বলে, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’। কিন্তু সোনাটিয়া অঞ্চলে সে বকলমে ম্যাজিক মানুষ। ম্যাজিক করে সবার মুখে হাসি ফোটায়। 

হিন্দোল ছোট্টোটি থেকেই দেখেছে ম্যাজিক মামুকে হাতসাফাই-এর খেলা দেখাতে। তার মামারবাড়ি আসার অন্যতম আকর্ষণ আজও ম্যাজিক মামু। অবশ্য ছেলেবেলার হাতসাফাই আজ আর নেই। বদলে চেনা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ম্যাজিক মামু কীরকম নতুন নতুন অচেনা দারুণ সব জায়গায় নিয়ে যায় হিন্দোলকে। সেসব জায়গা এলাকার ধারেপাশেই, তবু কেউ কোনোদিন খোঁজ রাখেনি। 

মিস্টার আর মিসেস বোস আর কোনো উপায় না খুঁজে পেয়ে ছেলেকে মামারবাড়ি রেখে এলেন। কিছুদিন থেকেই ছেলেটার পড়াশোনায় মন নেই। চোখমুখ শুকনো। ঘরে থাকতে চায় না। কী যেন এক দমবন্ধকর অবস্থা থেকে সে মনে মনে মুক্তি চাইছে। প্রথমে মা ভেবেছিল, ছেলের উঠতি যৌবনের সমস্যা বুঝি। মন উড়ু উড়ু। মেয়েদের সঙ্গে ঘুরতে চাইছে। এইটাই তো বয়েস দু’চারটে মেয়েবন্ধু জোটানোর। সুতরাং ততোটা আমল দেননি তিনি।

কিন্তু ছেলের বাবা যেদিন বলল সন্ধের ছায়ায় পার্কের আধো আলো আঁধারে ছেলে একা একা বসে আছে, সেদিন বুকের পাঁজর দম ধরে এসেছিল মায়ের। এ আবার কেমন ধরণ! হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ-ফুর্তি কিছুই নেই। কেন এতো অবসাদ ছেলের! জীবনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে এই কচি বয়সে! এই বয়সে কি এত গভীর প্রেম হয় যে এতো অবসাদ আসবে! এ সমস্যা প্রেমঘটিত না হলে আরো গভীর ভাবনার বিষয়। অথচ ছেলেকে কিছু জিজ্ঞাসাও করা যায় না। অনেক ভাবনাচিন্তা করে বাবা-মা ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে। সেখানেই জানতে পেরে তারা অবাক হয়। ভিড়, হৈ-হট্টগোল, ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা এসব থেকে জোর করেই দূরে থাকতে চায় তাদের ছেলে! সব শুনে বাবা মা’র চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। এই বয়সের একটা ছেলে জীবন থেকে পালাতে চাইছে কেন! কী এমন মানসিক রোগে তাদের ছেলে আক্রান্ত! কীভাবেই বা এর সমাধান হবে ভেবে কুল পায় না হিন্দোলের বাবা-মা। 

এদিকে মুখার্জী বাবুর থেকেও মিস্টার এবং মিসেস বোস জানতে পেরেছেন, সেদিন পিকনিকে হিন্দোলের হজমের কোনো সমস্যাই হয়নি। মুখার্জীবাবুর মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় ছেলে! ছেলের বাবা ডাক্তার কনসাল্ট করে। মা রাত্রে ঘুমোতে গিয়েও বিছানা ছেড়ে ছেলের ঘরের পর্দার আড়াল থেকে ছেলেকে দেখে যায়। দেখে ঘরে আলো জ্বলছে, আর ছেলে উপুড় হয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। বোঝবার উপায় নেই ঘুমোচ্ছে কি না! এদিকে পড়াটাও হচ্ছে না। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কোনো পথ থাকে না! সব শুনে ডাক্তারের পরামর্শ ছিল, ছেলের মনের আনন্দ যাতে তাই করুন। ছেলেকে একা থাকতে যেন না দেওয়া হয়। বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে আরো ভালো। সেইমতো ক’দিনের জন্য মামারবাড়ি পাঠানো হয়েছে হিন্দোলকে। 

অবশ্য মামারবাড়ি আসতে ছেলেকে সাধতে হয় না। ম্যাজিক মামুর টান অপ্রতিরোধ্য। ম্যাজিক মামুর সঙ্গ পেলেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো। এবারের আগ্রহ তিরপিতা নদী। সোনাটিয়া এসে এই নামটা শোনার পর থেকে হিন্দোল যেন নিজেকেই ভুলে গেছে। একদিনেই কী ভীষণ হালকা আর ফুরফুরে লাগছে হিন্দোলের নিজেকে। কাল তিরপিতা নদী। আবার নতুন জায়গা, অচিন এক নদী। কে জানে সে কেমন! উত্তেজনায় ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায় তার। সকালের জলখাবার খাওয়া শেষ হতে না হতেই ম্যাজিক মামুর সাইকেলের ঘন্টি ক্রিং ক্রিং সুরে তাড়া লাগায়। একলাফে ছোট্ট হারকিউলিস সাইকেলটিতে চড়ে বসে হিন্দোল। 

লাল উড়ু উড়ু রাস্তা। পাশেই সে রাস্তার সঙ্গী ক্ষীণ এক জলধারা। ম্যাজিক মামুরা বলে, ‘কাঁদর’।  কাঁদরের দু’পাশে সবুজের মেলা বসেছে। চোখেরও আরাম। মনে মনে অধীর হয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে সে, “কী গো মামু, তিরপিতা নদী কখন পৌঁছাব?” 

“আরে হাঁদু , অতো ব্যস্ত করলে হয়! তিরপিতা এক আশ্চর্য নদী। সে নদীর ঘর-বসতে না আছে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি, না আছে কারো হৈ-হট্টগোল! চারদিকে শুধু পাখিদের কিচিরমিচির আর গাছপালার ঢলাঢলি।” 

উত্তেজনায় আরো জোরে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ পড়ে। ফলত শীতের দিন হলেও যুবক সূর্যের তেজে কপালে, চুলের রেখায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে দুই অসমবয়সী পুরুষের, তবু উৎসাহে ভাটা পড়ে না। শুধু একটু শিথিলতা আসে পায়ে। দু’দন্ড বসতে ইচ্ছে করে এদের। ততক্ষণে নড়বড়ে এক আদ্যিকালের লোহার সেতুর বুক চিরে সাইকেল গিয়ে থেমেছে আরো গভীরতর জঙ্গলের কিনারে। সে গভীরতায় সাপের চেরা জিভের মত দুটি রাস্তা গহীন সবুজকে দু’দিকে বিচ্ছিন্ন করেছে। পায়ে চলা হিলহিলে রাস্তা। সেই রাস্তার একটি হেলতে দুলতে সোজা গিয়ে বিঁধেছে তিরপিতার কুমারী হৃদয়ে। অপর রাস্তা  চলে গেছে মা চন্দ্রময়ীর পাহাড়িয়া থান।

অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে হিন্দোলের। অকারণেই রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠছে। শিউরে উঠছে শরীর। পায়ে চলা ঢালু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সজীব লতার মত কিশোরী তিরপিতা নদীর সঙ্গে হিন্দোলের প্রথম পরিচয়। তিরপিতা এক তিরতিরে নদী। তার কাকচক্ষু জল। যেন ঘন সবুজের একটুকরো টলটলে হৃদয় একটু দেখা দিয়েই আবার নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে গহীনের গোপনে। 

“হি হি হি… তু একেনে কেনে… অ বাবু…”

তীক্ষ্ণ নারী কণ্ঠের ঝঙ্কার বিস্ময়ের চমক ভাঙায় হিন্দোলের। এখানেও মেয়ে! সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে হিন্দোলের পুরুষ সত্তা। চমকে ফিরে চায় সে। চকচকে তামাটে বর্ণের খোদাই করা চলমান এক নারীমূর্তি। তিরপিতা নদীর কিনারে কোমরে টুকরি বেঁধে হেলেঞ্চা, কলমি শাক তুলছে। গাছ কোমর আঁটোসাঁটো শাড়ি হাঁটুর প্রান্তসীমায় জলের ঢেউ-এর তালে দুলছে। মাথায় পিঙ্গল কেশরাশির চূড়ো। সে চুলে একটি নরম আলোর মতো পদ্মফুল গোঁজা। গায়ে কোনো বাহারি ব্লাউজ নেই, নেই মেক-আপ, লিপস্টিকের রঙ বাহার। গলায় ঝুটো পুঁতির মালা নেমে এসেছে উদ্ধত যৌবনের দ্বারপ্রান্তে! বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকে হিন্দোল। 

হাঁদুর দিকে একঝলক চেয়ে ম্যাজিক মামু বলে, “আরে! ও হলো বাহা! সরল, সিধা বড় ভালো মেয়ে! তুই এখানে দাঁড়া, আমি নীচে নেমে ওর থেকে চাট্টি টাটকা কলমি শাক চেয়ে নিয়ে আসি…”

মামু হাঁক দেয়– “কি রে বাহা! কলমি শাক দিবি না চাট্টি…”

“হঁ রে বাবু ! লিঁয়ে যা। কথো আছে।” হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে সে। ম্যাজিক মামু যে তাদেরও ম্যাজিক বাবু। তাই মামুকে কষ্ট করে নীচে নামতে হয় না। বাহা-ই নদীর কিনার থেকে পারে উঠে এসে কলমি শাক দেয় ম্যাজিক মামুর হাতে, আর হিন্দোলের হাতে দেয় জল থেকে তোলা সদ্যোজাত একটি পদ্মকুঁড়ি। 

ঐ ঘটনার দু’একদিন পরেই হিন্দোল বাড়ি ফিরে আসে। টনক নড়েছে ছেলের। পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে মামারবাড়ি ঘুরে বেড়ালে– মা বাবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির এটাই উত্তর ছিল। জোর কদমে শুরু করে স্কুল, টিউটোরিয়াল। রৌণক-পিকলুকে ডেকে বলে, “চল, একটা আড্ডা হয়ে যাক। ক্লাবের সব মেয়েগুলোকে ডাকিস কিন্তু! কে কতো স্টাইলিশ আর সাজুনে দেখতে হবে না!” 

হিন্দোলের এই পরিবর্তনে বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মা খুশি হয়। ছেলেকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সব ভুলে যদি ছেলেটা ভালো থাকার মনোবল পায় নিজের মধ্যে তো সেই ভালো। বন্ধুরা বেশ কিছুদিন বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলে না। হিন্দোলের মা-বাবা আড়ালে আবডালে তাদের বারণ করে দেয়। 

হিন্দোল এখন পার্কে যাওয়ার সময় পায় না। পার্কের পাশ কাটিয়ে আসতে আসতে আড়চোখে দুলন্ত ফুলগুলোকে দেখে সে। তারপর মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে নিজের পড়ার টেবিলে ফেরে। ফিজিক্সের সূত্র, কেমিস্ট্রির ইকুয়েশন, অঙ্কের তত্ত্ব পেরিয়ে ক্লান্তি এলে তার ঘরের আদুরে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোয়। কখনও অন্ধকারে ঘ্রাণ নেয় পদ্মবীজের। কখনও ফটফটে দিনের আলো, না হয় টিউবলাইটের আলোয় অপলক চেয়ে থাকে দেওয়ালে ফুটে থাকা পদ্মফুলের দিকে। কী সরল, নিষ্পাপ, অমোঘ সে টান। অথচ শরীরে কোনো অস্বস্তি হয় না। ভালোলাগায় মন ভরে যায়। সমস্ত ক্লান্তি কেটে নতুন করে যেন প্রাণ ফিরে পায় হিন্দোল। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে তিরপিতা নদীকে। হাসতে ইচ্ছে করে ফুলের সঙ্গে। বাহা যে ফুলের মতোই সুন্দর আবার ভাস্কর্যের মতো অমূল্য। এ সৌন্দর্য মোহিত করে কিন্তু অস্থির করে না।

হিন্দোল আজকাল মোহিত হয়েই থাকে। তার নিজের পড়ার ঘরের দেওয়ালে সে একটি পদ্মদিঘি এঁকেছে। ক্লান্তি এলে, মন ভালো না থাকলে তার একান্ত আপন পদ্মদিঘির পারে গিয়ে বসে সে। হাজার ভিড়ের মাঝে অনিঃশেষ চেয়ে থাকে পদ্মমায়ার টানে। যতো ভিড় জড়ো হয় তাকে ঘিরে, ততোই সে মায়াপদ্মের টানে বুঁদ হয়ে থাকে…  টান বাড়তেই থাকে… বাড়তেই থাকে…

আরও পড়ুন...

Categories
2023_feb golpo

মহুয়া সমাদ্দার

গ ল্প

ম হু য়া   স মা দ্দা র

mahuya

উপহার

–“কত দিন বলেছি বাথরুম থেকে বের হলে লাইটটা অফ করবে। মনেই থাকে না নাকি? মনে থাকবেই বা কেমন করে! সারাদিন শুধু ফোনে কী ছাইপাঁশ লিখে চলেছে! আর মনে থাকে কিছু!  ছেলেটাও হয়েছে তেমনি!  বৌকে শাসন করবি কোথায়, তা নয়, মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচছে। আজ বারাসত তো কাল মালদায় নিয়ে ছুটছে। বৌ নাকি সাহিত্যিক হবে! ছ‍্যাঃ। সাহিত্যিক না ছাই। 

আমরা তো কোন ছোট্টটিতেই শ্বশুর ঘরে এয়েছিলুম। তারপর থেকেই তো স্বামী, সংসার, সন্তান। এর বাইরে কিছু ভেবেছি কোনও দিন? এত ভালো গাইতাম, সেই গানও ছেড়েছি।… আর বাবু তোকেও বলি এত দামি ফোন ঘরের মেয়েমানুষের হাতে দেওয়া কেন বাপু?”

বেশ রাগত স্বরেই কথাগুলো বলছিলেন সীমাদেবী।

–“আঃ মা, তোমায় কত দিন বলেছি না এভাবে কথা বলবে না? নিজে মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়েকে মিনিমাম রেসপেক্ট তো করো? আর রোজ একই কথা বলা কেন শুনি? ফোনটা তো ও শুধু কাজের জন্য ব‍্যবহার করে মা। পর্ণা লিখতে চায় লিখুক না। মেয়ে হলেই কি শুধুই সংসার, স্বামী, সন্তানেই আটকে থাকতে হবে? ওর গুণ আছে মা। গুণটাকে কাজে লাগানোই ভালো নয় কি?” ধীরে ধীরেই কথাগুলো বলল বিকাশ। এই রকম কথা চালাচালি রোজ চলে ছেলে আর মায়েতে। 

পর্ণা, বছর ছাব্বিশের সুন্দরী, বাংলায় এম.এ. পাশ মেয়ে। ছোট থেকেই লেখালেখি করে। নানা নামী পত্রিকায় গল্প, উপন্যাস বের হয়। নানা জায়গা থেকে ডাকও আসে। স্বামী বিকাশ কখনও এতে বাধা দেয়নি। বরং উৎসাহই দিয়েছে। শুধু পর্ণার শ্বাশুড়ি সহ্য করতে পারে না। পর্ণা বুঝতে পারে, আসলে আগেকার দিনের স্বল্প শিক্ষিত মানুষ বলেই হয়তো এমন। এমনিতে মানুষটা ভালোই। পর্ণার পছন্দের খাবার আচার, নাড়ু এসব সবসময় নিজের হাতে বানিয়ে রাখেন। পর্ণার শরীর খারাপ হলে এই মানুষটাই কি ভীষণ শান্ত হয়ে যান! 

সীমাদেবী আছেন বলেই পর্ণাকে সংসারের ব‍্যাপারে মাথাই ঘামাতে হয় না। শুধু যা একটু বকবক করেন। সব ভালো যার এটুকু তো সহ্য করে নেওয়াই যায়!  

আর দশটা মেয়ের থেকে পর্ণা আলাদা, সীমাদেবী বেশ বোঝেন। হাজার বকাবকি করলেও মুখে একটি কথাও বলে না মেয়ে। বাবু নতুন দামি ফোন কিনে দিয়েছে বলে রাগারাগি করেছেন ঠিকই, কিন্তু মনে মনে তারিফ করেছেন ছেলের। অন্তত ছেলেটা বাবার মতো হয়নি। হাড়কিপ্টে অতুলবাবু, সীমাদেবীর স্বামী কোনও দিনই বউয়ের কোনও শখ আহ্লাদ মেটাননি। এমনকি ভালোবাসার ক্ষেত্রেও বড়ই মাপা। স্বামী-স্ত্রীর যে বন্ধুত্বের সম্পর্কও হয়, তা কোনও দিনই বুঝতে পারেননি তিনি। গান গাইতে ভালবাসতেন সীমাদেবী। কতদিন বলেছিলেন, একটা হার্মোনিয়াম কিনে দিতে। কিন্তু না। কোনও দিনও দেননি। পুজোতে কোনও দিনও সীমাদেবীকে নিয়ে যাননি শাড়ি কিনতে। পাছে বেশি দামের শাড়ি দিতে হয়! সতেরো বছরে মাধ‍্যমিক পাশের পরেই বিয়ে হয়ে যাওয়া সীমাদেবী দশ জনের সংসারে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো সান্ত্বনা পাননি। বাবু সবে চাকরিতে ঢুকেছে, স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন অতুলবাবু। ততদিনে সংসারে এক হাঁড়ি আর নেই। অতুলবাবুর ভাইরা সবাই ছেলে মেয়ে ছোট থাকতেই হাঁড়ি আলাদা করেছেন। বাবুর পাঁচ বছর চাকরির মাথায় পর্ণাকে পছন্দ করে নিয়ে আসেন সীমাদেবী। 

পর্ণার চোখদুটো কেমন যেন দুঃখী দুঃখী। মা মরা মেয়ে তো। বুকে কেমন যেন চিনচিনে কষ্ট হয়েছিল মেয়েটার জন্য। তাই আর বাক‍্যান্তর না করে পর্ণাকেই বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলেন। 

ওরা সেবার পুরী গেছিল ঘুরতে। সীমাদেবীকেও বারেবারে অনুরোধ করেছিল পর্ণা। কিন্তু সীমাদেবী ইচ্ছে করেই যাননি সেবার। থাক, দুটোতে ক’দিন একসাথে ঘুরে আসুক। পর্ণার ঘরেই বেশিরভাগ ওষুধ রাখা থাকে। হঠাৎ খুব পেটের গণ্ডগোল হওয়ার জন্য ওষুধ নিতে ঢুকেছিল ছেলে-বৌমার ঘরে। ওষুধ নিতে গিয়ে দেখল একটা বেশ নামকরা পত্রিকা ওদের খাটে পড়ে আছে। একা একা কাজ বিশেষ কিছু নেই বলেই হাতে করে পত্রিকাটি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তারপর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা গল্পে চোখ আটকে গেছিল। গল্পের লেখিকা পর্ণা রায়। অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প ‘ঠিকানা-চোরাবালি’। গল্পটা পড়তে পড়তে দু’চোখে জল আর বাঁধ মানেনি। একটি মেয়ের জীবন নিয়ে লেখা। কিন্তু এই মেয়েটির জীবনের সঙ্গে কোথায় যেন তাঁর জীবনের বড় মিল! তবে কি আমার জীবন নিয়েই লিখেছে পর্ণা! এত বোঝে পর্ণা আমায়!… বিড়বিড় করেছিলেন সীমাদেবী। 

 সেই শুরু। তারপর থেকেই পাড়ার মোড়ের ম‍্যাগাজিন কর্ণার থেকে সূচিপত্রে পর্ণার নাম রয়েছে সেই সব পত্রিকা সংগ্ৰহ করে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতেন সীমাদেবী। পর্ণাকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে দেননি এসব বিষয়। কারণ, এতদিন ধরে যে লেখা নিয়ে এত গালমন্দ করেছেন, তাকেই যে আজ সীমাদেবী এত ভালবাসেন সেটা পর্ণা জানলে লজ্জা বাড়বে বৈকি। 

বিয়ের পর থেকেই পর্ণা লক্ষ্য করেছে কাজ করতে করতে সীমাদেবী গুনগুন করে গান করেন। বেশ সুন্দর গলা তাঁর। একদিন কথায় কথায় সে শুনেছিল তাঁর একটা হার্মোনিয়ামের ভীষণ শখ ছিল একসময়ে।

সীমাদেবীর শরীরটা আজ কয়েকদিন ভীষণ খারাপ। হাঁটুর ব‍্যথায় কাহিল। সীমাদেবী স্নানে গেছেন দেখে পর্ণা ভাবল, ওঁর ঘরটা একটু গোছাবে। টেবিল, খাট ইত্যাদি গোছাতে গিয়ে তোষকের একটা পাশ উঁচু দেখে সেটাকে ঠিক করতে গিয়ে দেখে কতগুলি পত্রিকা তোষকের তলায় রাখা। সেগুলি টেনে বের করল পর্ণা। 

ও অবাক হয়ে দেখল, তারই লেখা যেসব গল্প নানান ম‍্যাগাজিনে বেরিয়েছে সবগুলি সীমাদেবী নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন! –তার মানে আমার লেখা মা পড়েন! পছন্দও করেন নিশ্চয়ই। তাই জন‍্যেই এভাবে নিজের কাছে রেখেছেন!— পর্ণা বিড়বিড় করে বলল। কয়েক ফোঁটা জল চোখ থেকে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ল। বাথরুমের শব্দ পেয়েই পর্ণা বইগুলি যেমন ছিল রেখে বেরিয়ে এল। 

***

আজ পর্ণার একটি বড় উপন্যাস ভীষণ নামী একটি পত্রিকা কিনে নিয়েছে। বেশ ভালো টাকাই দিয়েছে ওরা। বাজারে এসেছে পর্ণা। সবার জন্য কিছু কিছু উপহার কিনবে। সবার জন্য এটা সেটা কেনার পর কী মনে হতে একটা হার্মোনিয়ামের দোকানে ঢুকল পর্ণা। দেখেশুনে একটা ভালো হার্মোনিয়াম কিনে বাড়ি ফিরল। 

দুপুরে শুয়ে ছিলেন সীমাদেবী। চোখটা লেগে এসেছে সবে। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর। কাকে যেন পর্ণা বলছে– “এই যে, এইদিকে। হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ এইপাশে।” আরে! তার ঘরের দিকেই তো পর্ণা কাকে যেন নিয়ে আসছে! লোকটার  মাথায় আবার কী! সেই কখন মেয়েটা বেরিয়েছে ‘একটু আসছি’ বলে। এতক্ষণে এল। তাও আবার কাকে সঙ্গে নিয়ে!   

ধড়মড় করে উঠে বসলেন সীমাদেবী। দেখলেন একটি লোক মাথায় একটি বাক্স নিয়ে এসে তাঁর খাটের এক কোণে নামিয়ে রেখে গেল। লোকটি বেরিয়ে যেতেই পর্ণা বাক্সটা খুলে একটা হার্মোনিয়াম বের করে সীমাদেবীর সামনে রেখে বলল, “মা দেখো দেখি বাজিয়ে, কেমন বাজছে।” 

সীমাদেবী চোখ বড় বড় করে বললেন– “ও মেয়ে, তুই কি লেখালেখি ছেড়ে এবার গান শিখবি নাকি?” 

পর্ণা সীমাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল– “মা, এটা শুধু তোমার। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে সংসারের পেছনেই পড়ে রইলে। কত স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছ। তুমি বলেছিলে না, তোমার খুব শখ ছিল হার্মোনিয়ামের। তাই আমার নিজের উপার্জনের টাকায় তোমার জন্য এটা এনেছি। তোমার পছন্দ হয়নি মা?” 

সীমাদেবী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছেন পর্ণার দিকে। 

 –“আমার জন্য হার্মোনিয়াম! তাও আবার ওর লেখালেখির টাকায়! যে লেখালেখিকে আমি সারাদিন গালমন্দ করি! বাবু আজ এত বছর চাকরি করছে, কই ওর তো মনে পড়েনি এই কথা! আর এই মেয়েটা সারাদিন আমার বকাঝকা খায়, তারপরেও ওর পাওয়া টাকা দিয়ে আমার জন্য এইরকম উপহার নিয়ে এসেছে!”— মনে মনে বললেন সীমাদেবী। চোখ দুটোতে জৈষ্ঠের প্রবল গরমেও শ্রাবণ নেমেছে জোর। 

দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন পর্ণাকে। পর্ণারও চোখের কোণে জল। মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলল— “তুমিই তো আমার ছোট্টবেলার হারিয়ে যাওয়া মা। নইলে, আমার লেখা এভাবে সব গুছিয়ে রেখে দাও! রান্নার লোক থাকতেও আমার পছন্দের খাবার এত শরীর খারাপ নিয়েও তুমি বানাও! তুমি আমার সোনা মা।” 

বিকাশ সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে একটা শান্ত, সুন্দর পরিবেশ আবিষ্কার করেছিল। তার মা সীমাদেবী নিজের ঘরে বিছানার উপর বসেছিলেন হার্মোনিয়ামটি নিয়ে— বাম হাত বেলোতে আর ডান হাতের পাঁচটা আঙুল পরমযত্নে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটা রিড থেকে আরেকটা রিডে। মাকে জড়িয়ে ধরে একনিষ্ঠ মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে বসেছিল পর্ণা। কলিং বেল-এ হাত রেখে, মায়ের ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে, কতক্ষণ যে নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিকাশ ঠিক খেয়াল নেই তার। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে এমন উপহারের জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।  

আরও পড়ুন...

Categories
2023_jan golpo

মনীষা মুখোপাধ্যায়

গ ল্প

ম নী ষা   মু খো পা ধ্যা য়

manisha

শিবাজিবাবুর ছাতা

বাড়ি থেকে বেরনোর মুখেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল শিবাজিবাবুর।

বাজখাঁই গলায় পথ আগলে হাতে ছাতাটা গুঁজে দিয়েছেন গিরিবালা। গিরিবালা শিবাজিবাবুর ৩৮ বছরের পুরনো বউ। ছাতাটার মতো নতুন নয়। তবে গুমর, ঝাঁজ আর মেজাজে এখনও ছাব্বিশের তরুণীটি। পাটভাঙা ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে রুমালে একটু কড়াগোছের এসেন্স মাখিয়ে সবে পকেটে পুরেছেন শিবাজিবাবু। আষাঢ় সবে শুরু হয়েছে, তবু মেঘের তেমন দেখা নেই। আজকাল কোনওটাই সময়ে হয় না। আষাঢ়ে বৃষ্টি হয় না, মাঘে শীত পড়ে না, টাইমকলে ঠিক সময়ে জল আসে না, ঠিকে কাজের লোকের কামাইয়ের কোনও ঠিক থাকে না, সময়ে ঠিক কথা বলা হয় না, ঠিক কাজ করা হয় না। মোটকথা কোথাও কিছু ঠিক হয় না। 

আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই দেখে খুশিই হয়েছেন শিবাজিবাবু। নেমন্তন্ন’র দিন ঝড়জল পোষায় না। খুশি খুশি মনে মুখে কয়েকটা মৌরি ফেলে ধুতির মালকোঁচা সামলে বেরচ্ছিলেন। হঠাৎই সামনে স্ত্রী গিরিবালা, হাতে একটি ছাতা। আজকাল স্ত্রীর চেয়েও এই ছাতাটাকে বেশি ভয় পান শিবাজিবাবু। এ ছাতা জীবনে আসা ইস্তক তাঁর সব সুখশান্তিই প্রায় ঘুচেছে। এমনিতে ছাতা হারানোয় বেশ সুনাম ছিল শিবাজিবাবুর। তাই একটা বয়সের পর আর ঘুণাক্ষরেও ওই বস্তুটি সঙ্গে রাখেননি। বর্ষায় বর্ষাতি আর গ্রীষ্মে রুমালটুমাল দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছেন। 

গণ্ডগোলটা হয়েছে মাস তিনেক। ছোট শালার ছেলে নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার পর। পিসেমশাইকে ভালোবেসে একটা বিলিতি ছাতা কিনে এনে দিয়েছে বুকুন। আর সেই ছাতা বাড়িতে পোঁছে দেওয়ার পর থেকে গিরিবালার গুমর আরও বেড়েছে। প্রতিবেশীদের ডেকে ডেকে ছাতা দেখানোর পালা একটা সময় অবধি চলল। তারপর খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেতে শুরু করলেন শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়রা। সঙ্গে ছাতাদর্শন ফ্রি। ছাতার গুণপনা বাড়িয়ে বলতে বলতে কল্পনার সব সীমারেখা মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলছেন গিরিবালা। নো-ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছে আর ম্যানেজ দিতে না পারলে হাল ধরতে হচ্ছে শিবাজিবাবুকে। এই হাল ধরার কাজটা মোটেই ভালোবেসে করছেন না তিনি। তবু দীর্ঘদিনের দাম্পত্যে এমন অনেক কাজই করতে হয়, যা না করলে ঝড় ওঠে, বৃষ্টি হয়। তারপর অতিবৃষ্টির মতো সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে কথা আটষট্টিতে এসে বিলক্ষণ জানেন নিঃসন্তান শিবাজি চাটুজ্জে। তবে সেদিন শিবাজিবাবুর মেজদি’কে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর ছলে ছাতাখানাকে ‘বিশ্বের এক নম্বর’ বলে ফেলায় একটু জোরে কেশে ফেলেছিলেন শিবাজিবাবু। ওটি ছিল সিগন্যাল। ‘এবার থামো, লাইন ক্রশ করে যাচ্ছ,’ বলার উপায়। কিন্তু গিরিবালা দুর্বার। কোনও সিগনালেরই ধার ধারেননি। যথারীতি ছাতার শিক থেকে শুরু করে কাপড়-ডাঁটি সবেতেই ইউনিক কিছু খুঁজে পেয়েছেন। 

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বউকে বাড়াবাড়িটা বুঝিয়ে বলবেন বলে ভাবলেন শিবাজি। ‘গিরি, বলছি কি, ছাতা না আমেরিকানরা ভালো বানায় না, ওটা আসলে জাপানিদের কাজ।’ 

ব্যস! আগুনে ঘি পড়তে ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল। 

খনখন করে বলে উঠলেন গিরিবালা, ‘তা তো বলবেই! আমার বাপের বাড়ির লোক দিয়েছে কি না! এখন তো আমেরিকার চেয়েও ভালো ছাতা জাপানিরা ওই কুঁদে কুঁদে চোখ নিয়ে বানাবেই।’ 

‘আহা কুঁদে চোখ তো কী? অন্ধ তো নয় যে বানাতে পরবে না!’

‘সেই তো, এখন তো এসব যুক্তি দেবেই। কোনওদিন তোমার দিকের আত্মীয়দের তো একটা দামি কিছু দিতে দেখিনি। এই তো সেবার বড়দিরা সবাই মিলে পুরী গেল। কী এনেছিল? না, খাজা আর সম্বলপুরী একটা ব্লাউজ পিস!’ 

‘গিরি তুমি বুঝতে পারছ না, পুরী থেকে ছাতা কী করে আনবে? ওখানে তো খাজা আর ওই সম্বলপুরীই বিখ্যাত। না মানে, এগুলো ছাড়া রথও বিখ্যাত। কিন্তু রথ তো আর অত দূর থেকে টানতে টানতে আনতে পারবে না বলো! 

কথাটা গিরিবালার মোটেই ভালো লাগল না। আরও দ্বিগুণ ঝেঁজে বলে উঠলেন, ‘থাক থাক, বুঝেছি। আমার বুকুন যে মনে করে পিসের জন্য একটা বিদেশি ছাতা এনেছে, সেইটেই সহ্য হচ্ছে না তোমাদের। দেখলে না, মেজদি কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে গেল, ‘আমাদের টুম্পাও তো আগেরবার দার্জিলিং থেকে একটা ইমপোর্টেড ছাতা এনে দিয়েছিল ওর বাবাকে।’ হুঁহ্! কোথায় আমার বুকুনের নিউ ইয়র্ক আর কোথায় তোমাদের টুম্পার দার্জিলিং!’

শিবাজি বুঝলেন, এভাবে লাভ হবে না। এ কেস জাত্যাভিমানের দিকে গড়িয়ে গিয়েছে। একটু পরেই ফ্যাঁচফেঁচে কান্না, তারপরেই একটানা গজরগজরের দিকে ব্যাপারটা গড়াবে। তাই তা ঠেকাতে আরও নরম স্বরে বউয়ের দিকে খানিক ঘেঁষে শান্ত হয় আরও দু’-চার কথা বলতে গেলেন শিবাজি।

‘তা বেশ তো, ভালো ছাতা বলছ, বলো। কিন্তু মসলিন কাপড়-টাপড় বোলো না লোকের সামনে। মানে, ইয়ে, ছাতার কাপড় মসৃণ হতে পারে গিরি, কিন্তু মসলিন কখনওই নয়।’

ভেবেছিলেন নরম স্বরে বললে গিন্নির মেজাজে একটু জল পড়বে। কিন্তু গিরিবালা পাকা গোলকিপার। অ্যাটাকিং কোনও প্লেয়ারেরই ডিফেন্স দেখে ভেবলে যান না। কোমরের ব্যথা ভুলে এক ঝটকায় উঠে বসে বললেন, ‘মসলিন নয় মানে? আলবাত মসলিন। বুকুন যেদিন বাড়িতে এল, সেদিন তুমি তো গুপ্তিপাড়া গিয়েছিলে। আমাকে ও বারবার বলে গিয়েছে, মসলিন কাপড় পিসি, আর সুইচ টেপা শিক। এমনকী, এই ছাতা প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট-বড়ও করা যায়। আর রংখানা দেখেছে? যেন গোটা আকাশ নেমে এসছে ছাতায়।’

‘এই, এইখানেই আমার ঘোর আপত্তি গিরি। এ ছাতা ঠিক আকাশি নয়, পুরো তুঁতেপানা। এই বয়সে অমন ছাতা আমার মতো বুড়োদের মোটেই মানায় না। মেয়েরা চেয়ে চেয়ে দেখে আর মুখ টিপে হাসে।’

শেষ বাক্যে কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন গিরিবালা। কিন্তু জাত খেলোয়াড় তো! বল বুঝতে দেরি হয় না। ‘তা মেয়েরা তাকালে তাকাক, তুমি তাকাবে না। মিটে গেল!’ সপাট সমাধান গিরিবালার। 

‘কিন্তু না তাকালে তো বুঝতে পারব না, ওরা ছাতাটা দেখে প্রশংসা করতে চাইছে, না ভীমরতিতে ধরেছে ভাবছে!’

‘আ মোলো, ভীমরতি ভাববে কেন? আমার বুকুনের দেওয়া ছাতা বলে কথা! অমন আশমান রঙের ছাতা জম্মে চোখে দেখেছ?’

‘না গিরি, দেখিনি। ছাতার যে অমন রং হতে পারে তা আমি কেন, আমার চোদ্দোগুষ্টিতে কেউ জানত না।’ কথাটা বলার সময় তেতে ওঠাটা কিছুতেই আড়াল করতে পারলেন না শিবাজি।

এরপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। হঠাৎই কাঁদো কাঁদো গলায়, ছলোছলো চোখে গিরিবালা বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ গো, ছাতাটা তোমার পছন্দ হয়নি, না? বুকুন বলছিল বটে, পিসের হয়তো ভালো লাগবে না পিসি, হাজার হোক বিলিতি ছাতা তো, আর পিসে তো আবার স্বদেশি করা বাপের ছেলে!’

এই রে একদম ভুল পথে বল গড়িয়েছে। এক্ষুনি না থামালে রাতের ঘুমের বারোটা। গিরিবালা কিন্তু বাপ-ঠাকুরদাতেই থামবে না। তুরন্ত বল আটকালেন শিবাজিবাবু।  ‘ছি ছি গিরি, অপছন্দ হবে কেন? বুকুন হল আমার সন্তানতুল্য।  শুধু এই তুঁতেরঙা ছাতা কি না! আর ছাতা তো সাধারণত অবসরের দিন বা শ্রাদ্ধে দেওয়া হয়। তা আমার তো অবসর হয়েই গেছে, পড়ে আছে শুধু শ্রাদ্ধটুকু। নইলে জ্যান্ত মানুষকে হঠাৎ করে ছাতা দিচ্ছে কেউ এমন তো শুনিনি!’ 

কী মোক্ষম এগচ্ছিলেন শিবাজিবাবু! কেঁচিয়ে দিলেন শেষদিকে এসে। শোওয়া থেকে প্রায় লাফ দিয়ে সটান উঠে বসলেন গিরিবালা। ‘কী বললে, আমার বুকুন শ্রাদ্ধের জিনিস দিয়ে গেছে? অ্যাঁ! এত বড় কথা! তোমার এত ছোট মন? কে বলল তোমাকে যে শুধু ওই দুটো দিনই ছাতা দেয় লোকে! হুবহু নিজের মায়ের মতো হয়েছ! যত্তসব হাড়জ্বালানে যুক্তি!’ এতেই থামলেন না গিরিবালা। শিবাজিবাবুর মা  কবে কবে কোথায় কোথায় কী কী ‘কুযুক্তি’ দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটা অতীতসফর সেরে খানিক দম নিলেন। দু’-চারটে শ্বাস ভেতরে পুরেই ফের ফুল ফর্মে। ‘আমি কালই বাপেরবাড়ি চলে যাব… না না তা কী করে হয়? আমি বাপেরবাড়ি চলে গেলে তুমি তো বেঁচে যাও। আমি আর কক্ষনও বাপেরবাড়ি যাব না। কিছুতেই না।’ এই অবধি বলে দুমদুম পা ফেলে পাশের ঘরে গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন গিরিবালা। একটু পরে ফুরুৎ ফুরুৎ নাকও ডাকতে শুরু করলেন। শিবাজিবাবুর বাকি রাত বিনিদ্র ও নিশ্চিন্তে কাটল।

 

ছাতাখানা নিয়ে মুশকিলের শুরু সেই সেদিন থেকেই। তাই আজ বেরনোর আগে ওটা গিরিবালা গছিয়ে দিতেই সতর্ক হলেন শিবাজিবাবু। মিনমিন স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। 

‘আজ নয় গিরি, আকাশে একদম মেঘ নেই, বৃষ্টি তো হবেই না। শুনলে না আবহাওয়ার খবর?’ 

‘বলুক, ওরা দিনরাত ভুল বলে।’

‘আরে না, না সে তো এককালে বলত। এখন তো সবই মিলিয়ে দেয়।’

‘দিক গে। শোনো, বর্ষায় ছাতা আর শীতে কাঁথা কখনও হাতছাড়া করবে না।’

বেরনোর আগে ঘরোয়া দুর্যোগে পড়তে চাইলেন না শিবাজি। বললেন, ‘আচ্ছা বেশ তো, তাহলে দাও না, আমাদের বিয়ের ওই পুরনো ছাতাখানা তো রয়েইছে, ওটাই না হয়…!’

কথাটা শেষ করার আগেই গিরিবালা এমন একটা মুখ করে শিবাজির দিকে তাকালেন যেন অবোধ শিশু না বুঝে কীসব বলে ফেলেছে। 

‘ওই মান্ধাতার যুগের শিক বের করা ছ্যাকরা মার্কা ছাতাটা? না ব্যবহার করে করে তো ওটাকে যমের বাড়িতে পাঠানোর দশায় নিয়ে গেছ। বৃষ্টি এলে খুলতে খুলতে তো বৃষ্টি থেমে যায়।’

শিবাজির রাগ হচ্ছিল খুব। কিন্তু অপোনেন্ট যতই রাগিয়ে দিক, এসব ট্রেন ধরার দিনে রাগলে চলবে না। রাগলেই দেরি, আর দেরি হলেই ট্রেন মিস। গলার আওয়াজ যতটা সম্ভব মিহি করে শিবাজিবাবু বললেন, ‘না না যাহ্! যতটা বলছ, ততটা মোটেই নয়। এই তো সেদিন হলধরবাবু ছাতাখানা ধার নিলেন। কই তেমন কিছু তো বললেন না। বরং ছাতাটা বেশ পছন্দ হয়েছে বলে গেলেন!’

ওসব হলধরটরকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না গিরিবালা। তাঁর স্পষ্ট জবাব, ‘হলধরের শালার ছেলে তো আর আমেরিকায় থাকে না, তাই তোমার ওই ধর্মতলার ছাতা উনি বুকে বেঁধে রেখেছেন। আমেরিকার ছাতা হাতে পেলে না, তোমার ওই ছাতা উনি কুকুর তাড়াতেও নিতেন না।’

মাথাটা ধাঁই করে তেতে উঠল শিবাজির। ইচ্ছে করল বলেন, তোমার ওই বুকুনের ছাতা না কুকুর তাড়াতেও কাজে আসবে না, উল্টে ওই ক্যাটকেটে তুঁতে দেখলে কুকুর উল্টে তাড়া করতে পারে। কিন্তু না থাক, এখন এসব বললে বেরনো তো হবেই না, উল্টে যাওয়াটাই কেঁচিয়ে যেতে পারে। শেষ চেষ্টা করলেন শিবাজি। 

‘কিন্তু গিরি, ট্রেনে করে এতটা যাব, তারপর আবার অটো… বুঝতেই তো পারছ, আর আমার যা ছাতা হারানোর স্বভাব, এত ভালো বিদেশি ছাতা, শেষে একটা কেলেঙ্কারি না করে বসি!’

ঠিক এই কথাটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন গিরিবালা। ঠিক যেন চেনা পাশ পেয়েই গোলের মুখ খুলে দিলেন। একগাল হেসে বললেন, ‘ওসব চিন্তা কোরো না গো, আমি আছি কী করতে? আমি মাঝেমধ্যেই তোমাকে ফোন করে ছাতার কথা মনে করিয়ে দেব।’ 

শিবাজি বুঝলেন কপালে আজ আরও দুঃখ আছে। 

 

বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে ট্রেনে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। সারা দিন যা ধকল গেল! গোটা দিনে বার কুড়ি ছাতার জন্য ফোন ধরেছেন বাড়ির। লক্ষ করেছেন, ওঁর বন্ধুর ছেলে-ছেলের বউ সহ নিমন্ত্রিত আরও অনেকেই ওঁর ছাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে। নইলে ফিসফিস করে কীসব যেন বলেছে। খাওয়ার সময় যাতে খাবারের তেলঝোল একটুও ছাতায় না পড়ে তার সাবধানতা প্রতি পলে আউড়ে গিয়েছেন গিরিবালা। ফোন ধরার ঠেলায় তো মাংসের নলিটা জুত করে টানতেও পারলেন না শিবাজি। পায়েসটাও আর একটু নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। ফোন আর ছাতা সামলাতে সেসবে আর মন দেওয়া যায়নি। ফোন যে অফ করে দেবেন, তাতেও বিপদ। বাড়ি ফিরলে তবে আর রক্ষে থাকবে না। তাই প্রায় সব ক’টা ফোনই হুঁ, হ্যাঁ করে সারলেও ধরতে হচ্ছিল শিবাজিকে। তাই দেখে অধীরের বউ হেসে-হেসে বলছিল, ‘কী দাদা, বউদি বুঝি এখনও খুব মিস করে? এ তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন!’ অধীরও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, একঘর লোকের মাঝেই হা হা করে হেসে উঠল। শিবাজির মনে হচ্ছিল, ধরণী দ্বিধা হও। এসব পরিস্থিতিতে মনে যাই আসুক, মুখে একটা হেঁ হেঁ ভাব বজায় রাখতে হয়। শিবাজিও তাই করলেন।

ট্রেন সবে বেলুড় ছেড়েছে। বুকপকেটে পিরিং পিরিং শুনতে পেলেন শিবাজি। তাচ্ছিল্য নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভুরু কুঁচকে গেল। ফের গিরিবালা!

‘হুঁ’।

‘ও মা, হুঁ আবার কী? ছাতাখানা সামলে রেখেছ তো? যা ভুলো মন তোমার!’

‘হুঁ রাখছি।’ ইচ্ছে করেই ফোনটা কেটে দিলেন এবার। তবু আড়চোখে একবার বাঙ্কে দেখে নিলেন, যেমনকার ছাতা, তেমনই আছে। ট্রেনের দুলুনিতে ফের চোখটা লেগে এল শিবাজির। চোখ খুললেন যখন ট্রেন তখন হাওড়া ঢুকছে। এই সময়টায় নামার ভিড় কম, বরং ওঠার চাপ বেশি। বাঙ্ক থেকে ছাতা হাতে নিয়ে স্টেশনে পা রাখলেন শিবাজি। এবার একটা ট্যাক্সি ধরলেই বাড়ি। একহাতে ছাতাটা নিয়ে ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখলেন। ক্যাটকেটে তুঁতের জায়গায় ম্যাড়মেড়ে কালো। শিক বের করা। ক্ষয়াটে ডাঁটি। 

নামার সময় বাঙ্ক থেকে ছাতা নিতে গিয়েই গণ্ডগোলটা টের পেয়েছেন শিবাজি। হুবহু তাঁর বিয়ের ছাতার মতো একটা ছ্যাকরা রং মজে যাওয়া কালো ছাতা। কোনও সুইচ টেপার ব্যাপার নেই, একেবারে গায়ের জোরে কসরত করে খোলা আদ্দিকালের ছাতা। গা থেকে যেন পুরনো যুগের গন্ধ বেরচ্ছে। বাঙ্কের এককোণে অবহেলিত প্রেমিকার মতো গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে। ছাতাটা হাতে নিতেই বুকে যেন আনন্দধ্বনি বাজছে শিবাজির। 

ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়িয়েই মোবাইলটা বন্ধ করলেন শিবাজি। এই প্রথম ছাতা জিনিসটাকে ভালোবেসে ফেলছেন তিনি।

আরও পড়ুন...

Categories
2022-nov golpo

একটি পাগলী ও কয়েকজন পুরুষ

গ ল্প

রি নি  গ ঙ্গো পা ধ্যা য়

rini2

একটি পাগলী ও কয়েকজন পুরুষ

খুব পেলব সঙ্গমের পর মন যেমন তুলো তুলো হয়ে যায়, ঠিক তেমন করে সে এগিয়ে আসছিল মোড়ের দোকানটার দিকে। এটা কলকাতা শহরই, তবে এক্সটেনডেড। এখানে বড়ো বড়ো হাউসিং আছে, কিছু দূরে শপিং কমপ্লেক্স আছে। বাকিটা নির্জন। গাছগাছালি, মাঠ, ডোবা বা বড়ো পুকুর। সামনেই হাইওয়ের মসৃণ রাস্তা। সাঁই সাঁই করে গাড়ি যাচ্ছে। সেই রাস্তার ধারেই মূর্তিমান বেআইনের মতো গজিয়ে উঠেছে এই ছোট্ট চা সিগারেটের দোকানটা। দোকানী বিশুই তাকে প্রথম দেখতে পেল। সম্পূর্ণ ন্যাংটো একটা মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পাগল। বিশু এই ভোরবেলা দোকান খুলতে এসে এ দৃশ্য দেখে হাঁ হয়ে গেল। বিশু থাকে একটু দূরের বস্তিতে। তার দোকান থেকে বস্তিটা আবছা দেখা যায়। কী করবে বুঝতে না পেরে বিশু দু’একবার বস্তির দিকে তাকিয়ে নিল। এখান থেকে শুধু ঝুপড়িগুলোই দেখা যায়। তার বেশি কিছু নয়। মেয়েটা রোগা। কিন্তু মাইদুটো জব্বর। ছত্তিরিশ না হয়েই যায় না। মেয়েটা হাঁটছে, আর ও দুটো লাফাচ্ছে। বিশু কেমন মোহিত হয়ে যাচ্ছিল। তার জিভ জলজলে হয়ে গেছে। চোখ দুটো চকচক করছে। বারবার এপাশ ওপাশ দেখছে আর মেয়েটাকে। পাগল মেয়েটা ততক্ষণে দোকানের সামনে বিশুকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে।

একটু জল দিবি? জল! খুব তেষ্টা পেয়েছে! একটু জল দিবি!

এতোটা কাছ থেকে মেয়েটাকে দেখে বিশু এবার একটু অবাক হয়। মেয়েটার সারা শরীরে ভিজে মাটি লেপ্টে রয়েছে কাদার মতো। সেই সঙ্গে ওর পা বেয়ে রক্ত নামছে। হাতে বুকে আঁচড়ানোর দাগ। বোঁটা দুটোর কাছে রক্ত না কাদা জমাট বেঁধে আছে বোঝা যাচ্ছে না। ঠোঁটে গালে রক্তের ছোপ। বিশুকে ওরম তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা হঠাৎ হেসে ফেলল,

দেবো, তোকেও দেবো। আমার মাই দুটো, আমার গুদ, তোকেও দেব। এখন নিবি??

বিশু হঠাৎ কি বলবে বুঝতে পারে না।

মেয়েটাই বলে ওঠে, একটু জল দিবি!! জল! 

বিশু ভাঁড়ে করে ওকে জল খাওয়ায়। আশপাশ দিয়ে তখন হুসহাস গাড়ি যাচ্ছে। দু’একটা গাড়ি থেকে একজোড়া দু’জোড়া চোখ ওদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। হাউসিং থেকে একটা গাড়ি বেরল। বিশুকে আর মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে গেল। প্রায় বিকারহীন। বড়োলোকেরা এমনই হয়। উদাসীন গোছের। পৃথিবীর চরম বিস্ময়েও তারা বিস্মিত হয় না। টাকা তাদের অবাক হওয়ার আনন্দটাই কেড়ে নিয়েছে। আর এ তো বোঝাই যাচ্ছে সমস্যার ব্যাপার। বিশু বয়াম খুলে মেয়েটার জন্য দুটো বিস্কুট বের করে ওর হাতে দেয়। 

মেয়েটা গদগদ হয়ে হাসে। বিস্কুট হাতে নিয়েই খেতে শুরু করে। 

বিশু বলে, এখানে বসো। আমি আসছি।

মেয়েটা হঠাৎই তড়িৎ গতিতে বিশুর পায়ে পড়ে যায়।

যেও না, যেও না, লক্ষ্মীটি। আমার বাচ্চাটা দিয়ে যাও।

বিশু আরো এক প্রস্থ অবাক হয়। সঙ্গে বাচ্চাও ছিল! বাচ্চাটার তবে কী হল? বিশু থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসাই করে বসে, তোমার বাচ্চা আছে? 

মেয়েটা হাসিহাসি মুখে বিশুর দিকে তাকায়। হ্যাঁ, হবে তো। আমার বাচ্চা হবে তো। তুই দিবি।

বিশু আকাশ থেকে পড়ে। একথার মানে সে বুঝে উঠতে পারে না। ওদিকে মেয়েটার পা থেকে থোকা থোকা রক্ত বেরিয়ে থাইয়ের পাশে জমাট বাঁধছে, গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দেখে বিশুর বমি উঠে আসতে চায়। দৌড়ে যায় সে বস্তিতে। প্রায় নিঃশব্দে ডাকে তপনা, বিল্টু, ব্যাঁকা, ঘন্টিকে। ন্যাংটো মেয়ের কথা শুনেই ওদের খাড়া অবস্থা। প্রায় দৌড়ে চারজন চলে আসে। মেয়েটা তখনও বসে বসে বিস্কুট খাচ্ছে। ওদের দেখে মেয়েটা প্রথমে একটু ভয় পায়। তারপর পেটের নিচের অংশ সামনের দিকে বাড়িয়ে ছেনাল মেয়েদের মতো ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

চুদবি?? আমাকে তোরা চুদবি?? কিন্তু লাগাবি না বল!! সেদিন ওরা খুব ব্যথা দিয়েছে। দেখ, রক্ত, রক্ত পড়ছে… তোরা ব্যথা দিবি না তো! ব্যথা দিবি না তো!!

বিল্টু বলে, শালা গাঁড় মারানি, সক্কাল সক্কাল কাকে তুলেছ গো বিশুদা!! পাখি যে নিজেই ছটপট করছে বাঁড়া! বলে সে নিজের হাতটাকেই খানিক ছটফটিয়ে নেয়। 

ব্যাঁকা বলে, এই, এই ওকে বিলের ধারের মাঠে নিয়ে চল। তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি।

উঁউউউ, খুব শখ বানচোদ। এখখনি চাই একেবারে। সবার আগে খাবি না কি রে ব্যাঁকা!

তপনা খিঁচিয়ে ওঠে। 

ঘন্টি বলে, শালার ব্যাঁকা তো, বাঁড়ার তাই খিদে বেশি। ব্যাঁকার যৌনাঙ্গে হাত দিয়ে বিশ্রী ইঙ্গিত করে। বাকিরা হেসে ওঠে। পাগলীটাও ওদের সঙ্গে হাসতে থাকে।

তপনা বিল্টুকে বলে, একটা কাপড় টাপড় নিয়ে এসে মাগীটাকে পরিয়ে দে। তারপর সারাদিনের জন্য কোথাও একটা শাল্টিং করতে হবে।‌‌ রাতে হবে যা হবার। 

পাগলী আবার হাসে। বলে, রাতে বাচ্চা হবে। কী মজা বাচ্চা হবে। সে হাততালি দিয়ে লাফাতে থাকে। 

হেই, পোঁদ মারানি, বলে কী রে!! বাচ্চা হবে। খুব শখ না কি বাচ্চার মামনি। চলো তোমাকে পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা দেব। তপনা পাগলীর থুতনি ধরে নেড়ে দেয়। 

রাতে ওরা সব বিলের ধারে উপস্থিত হয়। মুখে গামছা বেঁধে কেউ কোনো কথা বলে না। পাগলীকে নিয়ে রঙ্গ তামাশা শুরু হয়। একসঙ্গে পাঁচজনে ওরা হামলে পড়ে। পাগলীর স্তন, পেট, যোনি, শ্রোণিদেশ নিয়ে খাবলা খাবলি করতে করতে ওরা খুব মস্তি করে। প্রত্যেকেই দু’বার, তিনবার, চারবার যতবার ইচ্ছে… পাগলীটার কষ্ট হচ্ছিল। তবু সে সবাইকে আদর করে কাছে টেনে নিচ্ছে। আর মুখে তার একটাই কথা, আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা। তবে ওরা তখন ওসব শোনার অবস্থাতেই নেই। শুনলেও ওদের কানে পৌঁছচ্ছে না সে কথা।

খানকি মাগীর কি চোদনের নেশা মাইরি!! এতগুলো লোক চুদছে শালা, একবার উফ করছে না! 

শুধু ব্যাঁকার কানে বারবার ধাক্কা মারছিল- আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা।

প্রত্যেকবার শব্দটা উচ্চারণ হচ্ছে। আর ব্যাঁকার মাথায় যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। যেন মাথার অতল থেকে কী একটা পাক খাচ্ছে তার চোখের চারপাশে। যতবার আমার বাচ্চা বলছে, কার যেন মুখ ভেসে আসছে। ঠিক চিনতে পারছে না ব্যাঁকা তাকে। কে যেন! ভীষণ চেনা। তবু কিছুতেই মনে পড়ছে না। ব্যাঁকা আর পারছে না। ও পাগলীটার পাশেই মাটিতে বসে পড়ে। বন্ধুরা একে একে করে চলেছে। ব্যাঁকা পাশে বসেও যেন দেখতে পাচ্ছে না। এই কুয়াশা জড়ানো হালকা শীতের রাতেও ব্যাঁকা প্রবল ঘামছে। তার মনে হচ্ছে এই ‘আমার বাচ্চা’ শব্দটা তাকে যেন তাড়া করছে! তাকে যেন মেরে ফেলতে পারে এই শব্দবন্ধ। ব্যাঁকা উঠতে চেষ্টা করে, পারে না। তার চোখের সামনে পরপর কতকগুলো দৃশ্য পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। এক খানকি মাগী শালা আদ্ধেকটা মাই বের করে দরজায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরছে। খদ্দের একটা বাচ্চাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। বাচ্চাটা দিনের পর দিন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

তারপর সেই ছেলেটাই একটু বড়ো। শালা যেন ফিল্ম চলছে চোখের সামনে। একের পর এক সিন… ব্যাঁকা কিছুতেই বেরোতে পারছে না এই সিনের ঘোরালো নেশা থেকে। সে দেখতে পাচ্ছে নেশার ঘোরে মাগীটার কাছে পয়সা চাইছে ছেলেটা। মাগীটা শালী মেরে দিল ছেলেটাকে, ঠাস করে একটা চড়।

ছেলেটা ক্ষেপে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মাগীটার ওপর। দেওয়ালে ঠেসে ধরে মাগীটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে…. আর মাগীটা বলছে, মাগীটা বলছে…

ব্যাঁকা ঘোরের মধ্যেই কিল চড় ঘুষি মারতে থাকে তপনাকে। ওর চোখের সামনে তখন ভাসছে ওর মা’র মুখ।

তপনা মার খেয়ে ছিটকে যায়। ব্যাঁকাকে উল্টে দু’চার ঘা মারতেই ব্যাঁকা কাঁদতে শুরু করে। তারপরই হুড়হুড় করে বমি করতে থাকে। 

ওদিকে রাতের কুয়াশায় ভেসে উঠৈছে পুরনো দিনের তেমহলা বাড়ির সিংহদরজা। সাদা কাপড়ে আলতা রাঙা ছাপ ফেলে নতুন বউ প্রবেশ করছে বিরাট জমিদার পরিবারে অনেক স্বপ্ন আর একটু একটু ভয়কে সঙ্গী করে। তার সুপুরুষ স্বামী, উথলানো সংসার, বিত্ত সবই তার কাছে স্বপ্নের মতো। শাশুড়ি মা বরণ করছেন আর বলছেন, এ বাড়ির বংশধর আনার দায়িত্ব তোমার। যত শীঘ্র সম্ভব আমরা নাতির মুখ দেখতে চাই !

মেয়েটি বিস্মিত হচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে না। আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে লজ্জা পাচ্ছে। এ দাবির মধ্যে কোথাও অন্যায্য কিছু নেই, এই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু দৃশ্যের পর দৃশ্য পাল্টে যাচ্ছে। যে হাত একদিন আশীর্বাদ হয়ে মাথায় উঠেছিল, তা এখন হিংস্র ভাবে চুলের মুঠি ধরে দরদালান থেকে সিঁড়িতে ঠেলে দিচ্ছে। বাঁজা বলে তীব্র আক্রমণ চলছে। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে অচৈতন্য মেয়েটি ডাস্টবিনের পাশে জেগে উঠছে। বিস্ময় নয়, স্বাভাবিক….. ওদের যে বংশধর চাই। বংশধর এনে দিতে হবে। মেয়েটির মনে এখনো কোনো প্রশ্ন নেই। তার একটা বাচ্চা চাই। আর কিছু না। একটা বাচ্চা…

তারপর সব কিছুই অস্পষ্ট… ধোঁয়া ধোঁয়া… বাচ্চা চাইতে চাইতে কখন যে প্রাণের কাপড়টাও তার নেই হয়ে গেছে সে আর খেয়াল করে না। অত্যাচারে দীর্ণ হতে হতে তার মনে হয় সন্তানের জন্য সাধনা… এটুকু কষ্ট যে করতেই হবে। ওই দরদালান জুড়ে খসখসে নতুন শাড়ি, ঠিনঠিনে কঙ্কণ, আঁচলের গোড়ায় বেঁধে রাখা একগুচ্ছ চাবির ঝুনঝুন, চাকরবাকরদের ছুটোছুটি আর ছেলে কোলে করে মেয়েটি… এইসব পূর্ণতার জন্য দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অত্যাচারিত হয়ে যাওয়া। কোথায় সেই সব পেয়েছির দেশ আজ আর মনে পড়ে না। তবু আছে কোথাও! পৃথিবীর কোনো প্রান্তে! প্রশ্ন নয়, বিস্ময় নয়, আছে স্বাভাবিক সুখটুকু।

আরও পড়ুন...

Categories
2022_aug golpo

রাশিচক্র

গ ল্প

ফা ল্গু নী   ঘো ষ

falguni

রাশিচক্র

হলুদ চটা ছেড়ে যাওয়া দেওয়ালে একমাত্র সজীব নিশান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাল্লা দু’টি। টুকটুকে সবুজ রঙের। সে পাল্লায় জঙধরা কড়াগুলি বেমানান যেন। ঘন সবুজ জঙ্গলের বন্ধুত্বে এ পাল্লার অবস্থিতি হলে ছ্যাতলাপড়া গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মানানসই হত এ আবহটি। দরজা থেকে নজর একটু উপরের দিকে দিলে দেখা যাবে ঘোলাটে রঙের একটি সাইনবোর্ড। অনেক বছরের পুরনো তা সহজেই বোঝা যায়। আসল রঙটি ছিল দুধসাদা। দীর্ঘ দিনের অযত্ন, রোদ জল ঝড়ের সখ্য সে ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার উপরে ঝকমকে লাল রঙে লেখা কয়েকটি শব্দ–

‘সৌভাগ্য’

জ্যোতিষ আচার্যা ইন্দ্রাণী

সমস্ত রকম দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে

বদলের ইঙ্গিত দেওয়া হয় এখানে।

পথচলতি দুর্ভাগা মানুষ এখানে পা না রাখতেই পারে। কারণ মনে মনে সে হয়তো ভাববে যার নিজের বিজ্ঞাপনটিই ম্যাড়মেড়ে ধুলোমলিন, সে আর আমার দুর্ভাগ্যের গতিপথ কোন বিদ্যাতেই বা বদলাবে! কিন্তু যারা হাতেনাতে ফল পেয়েছে, ঘটে গেছে কোনো মির‍্যাকল, তাদের সূত্র ধরে গুটি গুটি কিছু পা প্রায়শই এসে দাঁড়ায় সৌভাগ্যে’র দরজায়। 

কার চাকরি হচ্ছে না, কার জমিজমা সংক্রান্ত আইনি গোলযোগ, মামলা-মোকদ্দমার হালহদিশ সব সমাধান রাশি -দিনক্ষণ- জন্মকুণ্ডলী মিলিয়ে করে দেন জ্যোতিষ আচার্যা। এবং সে সমাধান অব্যর্থ। সৌভাগ্যে’র দরজা দিয়ে ভিতরে পা গলালে কেমন যেন বিশ্বাস ভর করে আসে। মনে হয় ভাগ্যের বন্ধ দরজা খুলবেই।

ছোট্ট ঘরের চারকোণে চারটি উজ্জ্বল সাদা আলো। তবে আলোগুলি বৃত্তাকার ব্যাসার্ধে ছড়ায় না বেশি। ফলত আলো আবছায়ার চালচিত্র রচিত হয় সুনিপুণভাবে। অনেকটা সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের জলছবি যেন, পাশাপাশি আলো আর ছায়া। জ্যোতিষ আচার্যার আসনের উল্টোদিকে যে সবুজ টুকটুকে দরজার পাশে ভিতরের দিকের দেওয়াল সেখানে কালচক্রাকারে জল, পৃথিবী, বাতাস, আগুন ঘুরছে। যে পঞ্চভূতের সমন্বয়ে আমাদের দেহ গঠিত সে পঞ্চভূতের উপাদান মানুষের চরিত্র আর মনেও প্রভাব ফেলে। যেন এক একটি মানব চরিত্র এক একটি দিক। মূল চার দিক নির্দেশের চিহ্নগুলি পৃথিবী থেকে অন্তরীক্ষে ঘুরে ঘুরে ফেরে। একদিকে ক্ষিতি, আরেকদিকে অগ্নি, একপাশে অপ এবং অন্যদিকে মরুৎ। এসব চিহ্ন মিলিয়ে বারোটি রাশির জাতক জাতিকাদের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটাই মিলে যায়।

যারা জ্যোতিষের এসব হিসেব নিকেশে মুখ বাঁকিয়ে হাসে বা বুজরুকি মনে করে উল্টে তাদের দিকেই তাকিয়ে হাসেন আচার্যা ইন্দ্রাণী। নাতনির হাতের রেখা দেখেই নিতাই মজুমদারকে ইন্দ্রাণী বলেছিলেন, মেয়ে বেশ একগুঁয়ে আর স্বাধীনচেতা। ধনু রাশির জাতিকা তো! খুব সামলে সুমলে রাখবেন! তখন তাঁর কথা নিয়ে সে কী হাসাহাসি! অথচ আজ! আজ চারিদিকে শুধু বুনবুনি আর নান্টুর বিয়ের চর্চা। ইন্দ্রাণী জানে আগুনে মেয়েগুলো একটু এরকম হয়! 

আর্থ, ফায়ার, এয়ার, ওয়াটার- এই চার চিহ্ন অনুযায়ী আচার্যার গণনায় মানুষের স্বভাব বৈশিষ্ট্য কিছুতেই অমিল হয়নি আজ অবধি। শুধু একবারই নীরব থেকেছিলেন তিনি। হালদার বাড়ির মেয়েটার যখন ডিভোর্স হয়ে গেল। মেয়ের বাবা এসে বলেছিল– ‘আপনার সব বুজরুকি! এত বিচার করে জন্মছক, কুণ্ডলী, রাশি, গণ, লগ্ন মিলিয়ে বিয়ে দিলাম! আপনি বললেন, না কি বৃশ্চিক আর মীনের রাজযোটক। দু’জনেই জল রাশির বৈশিষ্ট্যের। সরল তরল মন। কোনো জেদ ধরে বসে থাকে না। মানিয়ে গুছিয়ে নেয়…’

ইন্দ্রাণী শুধু বলতে গিয়ে ঠোঁট দুটো নেড়েছিলেন যে, দুজনেই জল রাশি হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়… কিন্তু তাঁর সে বাক্য জিভের মধ্যে শুকিয়ে পেটের পথে সেঁধিয়েছিল।

‘ছাড়ুন তো! আপনার রাশি আর তার ঠিকুজি কুষ্ঠী! জামাইয়ের কী খুনে রাগ! জলরাশি না ছাই! মেয়েটাকে সময় মতো ডিভোর্স না করালে এতোদিনে খুন করেই দিতো বোধহয়! আর কোনো মেয়ের এভাবে সর্বনাশ করবেন না! এসব ধান্দাবাজির ব্যবসা বন্ধ করে শাড়ি গয়নার দোকান দিন…’। বলতে বলতে গজগজিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগান মেয়ের বাপ।

আচার্যার সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল, নিজের অক্ষমতায় নয়। মানুষের অবিশ্বাস দেখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্রও স্থান পরিবর্তন করে, সে কথা মানুষ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বোঝেও না, বুঝতে চায়ও না। তখন আরো গভীর বিচার, গৃহশান্তি, গ্রহরত্ন ধারণ করার দরকার পড়ে। আজকাল আচার্যা ফলত বিয়ে বা প্রেমের ভবিষ্যদ্বাণী করেন না তেমন। কেউ জোরাজুরি করলে যদিও উপায় বাতলে দেন, তার সঙ্গে পরামর্শও থাকে সব কিছু বুঝে শুনে চলার।

তবে ইদানীং তিনি আরো গভীর খোঁজে মত্ত। মেয়েটি প্রাণচঞ্চল, হাসিখুশি, যেখানেই গিয়ে দাঁড়ায় মাতিয়ে দেয় সবাইকে। ভাব-ভঙ্গি, ইশারা-ইঙ্গিতে জমিয়ে দেয় সবাইকে। ঠিকুজি-কুষ্ঠী, জন্মলগ্ন সবই ভালো, শুধু আগুনে ফাঁড়া আছে। ওইটাই ভাবিয়ে রেখেছে আচার্যাকে। আজকাল কেস তেমন আসে না। এলেও বাইরের ঘরে অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতে ছেড়ে দেন। চার মহাকালচক্রের পাশেই দরজা ফুঁড়ে একটি ছোট্ট বিশ্রামঘর বানিয়েছেন তিনি। সেই সকালে চাট্টি নাকে মুখে গুঁজে চলে এসে সন্ধে অবধি থাকা। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট জানে দুপুরের দিকে ঘন্টা দুয়েক আচার্যা গড়িয়ে নেন। 

আসলে ওই সময়টাই প্রশস্ত খোঁজার জন্য। মেয়েটি যে বড় ভালো। রাশি, লগ্ন, গণ, দোষ, নিপুণভাবে মেলালে কি  আর ভালো স্বভাব চরিত্রের ছেলে মিলবে না! এক দুটো ক্ষেত্রে না হয় ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁকে সফল হতেই হবে। ভাবতে ভাবতে চোখ মুখ দৃঢ় হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই। সামনে কোনো যুবক চাকরি বা পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এসে দাঁড়ালে কুষ্ঠী বিচার করে যদি দেখেন, যে জলরাশির মানুষ। চোখের পাতা নরম হয়ে আসে ইন্দ্রাণীর। মনে হয় এরকম নরম, ধৈর্যশীল, শান্ত মানুষ ঠিক বুঝবে প্রাণচঞ্চলতাকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই খটকা আসে। যদি না বোঝে! কখনও ভুল করে আর ভুল স্বীকার না করে! জলরাশির মানুষদের যে এটাই সবচেয়ে বড় দোষ।

আজকাল রাস্তা ঘাটে, বাসে ট্রেনে মানুষের মুখ চোখ দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোথায় কোন স্বভাব বা চরিত্র বৈশিষ্ট্য থেকে হাসিখুশি মেয়েটার জোড় খুঁজে পাওয়া যায় কে বলতে পারে! ধীর, স্থির, ধৈর্যশীল, ছটপটে, বিরক্ত, হাস্যমুখ, অশান্ত কতো রকম মানুষ আশেপাশে। হাস্যমুখ, ধৈর্যশীল, শান্ত মেজাজের মানুষ আচার্যার তালিকায় প্রাধান্য পায়। কিন্তু ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে ট্রেন ক্যানসেল শুনে হতাশ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে নিজেই অধৈর্য হয়ে পড়েন আচার্যা! মাথা নাড়েন, নাঃ! হবে না! এরকম মানুষ বাতাসের মতো ফুরফুরে মেয়েটাকে কী করে সামলে রাখবে! ছটফটে বিরক্তি ভরা মানুষেরা আগুনে রাশির না হয়ে যায় না। মেয়েটার যে আবার আগুনে ফাঁড়া আছে! 

বৃত্তাকার জটলাকে ঘিরে আরো বৃত্তাকারে হাসিগুলি ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশে বাতাসে। মিশে যাচ্ছিল রেণু রেণু হয়ে ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, উপধ্বনি। জটলাটি পাড়ার মহিলা মহলের। মফস্বল এলাকা বা গাঁ-গঞ্জে এখনও দেখা যায় এরকম বৈকালিক আড্ডা। এসব আড্ডায় কারো বাড়ির হাঁড়ির খবর থেকে পঞ্চব্যঞ্জনের স্বাদ যেমন থাকে, তেমনই এসব আড্ডায় ঘরোয়া সুখ দুঃখের পাঁচালিও পড়া যায়। শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে শোনে। আহা উহুও করে, আবার নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে মনে মনে বলে – “মিত্তির গিন্নীর টাকার খুব গরম; সুখের মুখ দেখছে এখন।” তেমনি মিত্তির গিন্নি চায়ের কাপ হাতে কত্তাকে বলে, “ঘোষেদের নতুন বউটা বড় ছিঁচকাদুনে। কথায় কথায় আমার কিছু নেই, আমার কিছু নেই বলে নাকি কান্না।”

তবে এসব জটলা প্রায়শই গড়িয়ে পড়ে বিয়ের বা প্রেমের আলোচনায়। কোন পাড়ার ছেলে এ পাড়ার কোন উঠতি মেয়ের সঙ্গে চুলবুলানি করছে, নয়তো কার মেয়ের বিয়ের ঠিক হল কী না! কে না জানে প্রেম আর বিয়ের রসের গাঢ়ত্বই আলাদা। সে গাঢ় রসে যদি মিঠিয়া উড়ে এসে বসে তো আরোই রস উপচে পড়ে। এই যেমন সেদিন ক্ষ্যাপা উদয়চাঁদের পুচকে মেয়ে বুনবুনি যে গোপনে ভচ্চাজদের নান্টুর সঙ্গে বিয়ে সেরে ফেলেছে, সে খবর মিঠিয়া না দিলে এদের জানাই হতো না। জটলার হল্লাগুল্লার পাশ দিয়ে মিঠিয়া দ্রুত বেগে চলেই যাচ্ছিল। ওদিকে জটলা তো হেসে হেসে ফুলে ফেঁপে উঠেছে বর্ষাকালীন বাঁধভাঙা নদীর মতো। স্বাভাবিকভাবেই নদীর স্রোত মিঠিয়াকে ঘিরে ধরল, “কি রে মিঠিয়া, এত তাড়াতাড়ি চললি কোথায়…”

“ইককুল পাড়া… ইককুল পাড়ায়…”। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত প্রৌঢ় মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, “এতো বয়েস হলো! ধিঙ্গিপনা আর কবে যাবে তোর!”

“ইঁইই… বুনি বুনি… উলুলুঁ… উলুলুঁ…… ও পাড়ার নান্টুর বউ বুনি… যাবঁ যাবঁ…”

মিঠিয়া বলে কী! ঐটুকু পুঁচকে মেয়ে বুনবুনির পেটে পেটে এতো বিয়ে করার শখ ছিল! আর মিঠিয়াও তেমনি! সারা দুনিয়ার সবার বিয়ের খবর না রাখলে যেন তার চলে না। জটলায় রঙ্গ রস চলতে থাকে। সঙ্গে চলে চটুল আলোচনা। হঠাৎ মুখুজ্যে গিন্নির বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিঠিয়া বলে ওঠে, “রিনা … রিনা… বড় হবে। ইককুল পড়বে…… তারপর রিনার উলুলুঁ হবে…”

এতক্ষণ মুখুজ্যে গিন্নি বেশ রসিয়ে রসিয়ে শুনছিলেন। হাসছিলেন একগাল ভরে। কিন্তু এইবার হাসিটি গেল বন্ধ হয়ে। বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “আমার এত ছোট মেয়ে। ওর এখন থেকে বিয়ে বিয়ে আবার কী রে মিঠিয়া…”

মিঠিয়া হি হি করে হাসতে হাসতে সরে যায় জটলা থেকে। মিত্তির গিন্নি মুখুজ্যে গিন্নির মুখ পড়ে নেন মুহুর্তে। কলকলিয়ে বলে ওঠেন, “খোনা গলায় পাগলামি করলে কি হবে! মিঠিয়ার পেটে পেটে অনেক বদবুদ্ধি আছে!”

প্রৌঢ় মহিলাটি মুখ বেঁকিয়ে বলেন, “হবে না! কোন মা বাপের মেয়ে দেখতে হবে…! সারাদিন ঘরে মা-বাপের টিকি থাকে!” যে যার বিরক্ত মুখে ঘরে ফিরে যায়। অন্যের ছেলে মেয়ের বিয়ে, প্রেম, স্বভাব চরিত্র নিয়ে আলোচনায় যতো রসের মাছি ভনভন করুক না কেন, নিজের নিজের ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে সে রস গেঁজে ওঠে প্রায়শ। সুতরাং বিরস বদনে যে যার বাড়ির পথ ধরে অগত্যা। আসর ভেঙে যায় সেদিনের মতো।

মেয়েটার নাম মিঠিয়া। তবে গলার আওয়াজটি নামের সঙ্গে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য সম্পর্ক বেঁধে রেখেছে। বহু দূর থেকেও এলাকার যে কোনো মানুষ নিশ্চিত হয়ে বলে দেবে এ আওয়াজ মিঠিয়ার। এমন খোনা খোনা ফাটা কাঁসরসম গলার আওয়াজ এ অঞ্চলে একমাত্র মিঠিয়ারই। কেন তার গলার আওয়াজ এমন খোনা বা কাঁসরফাটা হলো সে নিয়ে এলাকায় গুঞ্জন ওড়ে বিস্তর। কেউ কেউ বলে জন্মদোষ কেউ বা বলে অন্য কিছু হবে! আসলে কোনো না কোনো সূত্রে মিঠিয়াও ঐ বৃত্তাকার জটলার অংশভাগিনী। আত্মীয়গুষ্টির মধ্যে কবেই বা তেমন নিন্দেহীন ভালোবাসা জায়গা পায়! 

গলার আওয়াজ যতোই উত্তাল হয়ে কানে গিয়ে ধাক্কা দিক না কেন, কেউ যদি মিঠিয়ার চলে যাওয়ার পথরেখায় দৃষ্টি পাতে তো দেখবে, এক সহজ সরল ছন্দের দোলাচল। ঋজু তার ভঙ্গী। কোঁকড়ানো কালো একরাশ চুলের ঢেউ সহজ সরল ছন্দের তালে আনমনে খেলে ফিরছে। পরিছন্ন পরিপাটি পোশাক পরিচ্ছদ। কিন্তু মিঠিয়ার চলে যাওয়াটি ঘুর পথে এঁকেবেঁকে আপনার কাছে যখনই ফিরে আসবে, ঠিক তখনই আপনার আন্দোলিত মন চেতনার কাছে সজোরে এক থাপ্পড় খাবে। আপনি অবাক বিস্ময়ে দেখবেন, যার গমন পথের দৃশ্য দেখে মন বলে ওঠে আহা! সেরকম কিছু ইত্যাকার ভাবনার মিথ্যে হয়ে যাওয়া। দেবীস্বরূপ সে সামনে এসে দাঁড়ালে আপনি চমকে উঠবেন। এত জীর্ণ চামড়ার আবরণে কোনো যুবতী কি মুখ ঢেকে থাকে! কোনো এক অতি প্রাচীন পোড়া মাটির মন্দির বহু কালের ক্ষয়ে যে এবড়োখেবড়ো শ্রীহীন রূপ ধারণ করে তেমনই অনুজ্জ্বল ম্যাড়মেড়ে চামড়ায় সজীব ও উজ্জ্বল একজোড়া কৌতুকী চোখ আপনার দিকে চেয়ে থাকবে।

মিঠিয়ার চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় জীবনের প্রতি অনিঃশেষ কৌতুক তার। জেদ করেই একসময় স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। পড়াশোনা, জ্ঞান এসব কিছু তাকে আকুল করে না তুললেও ‘পাশ-ফেল’ শব্দবন্ধটি মাথায় ভালোভাবেই গেঁথে গিয়েছিল তার প্রাইমারি বেলায়। প্রতিটি ক্লাসে দ্বিবার্ষিক পঠনপাঠনের পর ‘পাশ’ এই সুযোগটি আসতো মিঠিয়ার জীবনে। পোড়া মুখে দু’চোখের মণি উঠত ঝিকিয়ে। সারা দিনমান তার মনে তখন একই ধুন—‘আমি পাশ… আমি পাশ… জানিস জানিস মাস্টার আমি পাশ…।’ সম্বোধনে অস্বস্তি মিঠিয়ার জন্মগত নয়।

মিঠিয়া ছাত্রী হিসেবে একই ক্লাসে দু’বার করে থাকলেও বয়েস কোনো খুঁটিতে বাঁধা থাকে না। সুতরাং সপ্তম অষ্টম শ্রেণির গণ্ডিতে সে মনে ও শরীরে পূর্ণবয়স্ক যুবতী। স্বভাবতই প্রেম, বিয়ে এসবে তার নজর গেছে বেশি। এলাকায় কবে কার বিয়ে, কোন কোন নতুন প্রাণে প্রেমের জোয়ার লেগেছে তা মিঠিয়ার নখদর্পণে। বিয়েবাড়ি, বউ, আলো, সানাই, ফুলচন্দনের গন্ধ সে খুব উপভোগ করে। যে কোনো বাচ্চা মেয়েকে দেখলে তার মনে হয়, এরা একদিন বড় হবে। শরীর জুড়ে পাহাড়ি ঝরনার মতো নেমে আসবে নদী। সে নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকবে তার প্রাণের পুরুষ! মনের মতো জুটি হয় যেন তারা, এই তার সবসময়ের প্রার্থনা।

রবিবার সকাল মানেই আয়েশ। সপ্তাহে এই দিনটাতে ঘর সংসার, রান্না খাওয়ার দিকেই নজর থাকে মজুমদার গিন্নির। তার সঙ্গে থাকে কতো বাড়তি কাজ। কাজ আর আয়েশ চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সঙ্গী হয় ভালো মন্দ খাওয়ার শখ সাধ। আজকেই যেমন মিঠিয়া সকাল থেকে চ্যাঁচাচ্ছে, “মা চাউমিন করো, চাউমিন করো!” মেয়ের সেই আব্দার মেটাতে কোমর বেঁধে লেগেছেন মজুমদার গিন্নি। চাউমিন সেদ্ধ হয়ে গেছে। সবজি ভেজে তাতে চাউমিন দিয়েছেন সবে। বাতাসে বাস ছড়িয়েছে। এমন সময় টুনা আর মিলির মা বারান্দায় এসে বসলো। এরা সবই মজুমদার গুষ্টির। এদের রবি, সোম, বুধ সব দিনই সমান। “এই এখন বকবক শুরু হবে…” মনে মনে বলল মিঠিয়ার মা। তবু পাড়াঘরের রেওয়াজ, অতিথি এলে সম্ভাষণ করতেই হয়।

“বলো বৌদি কেমন আছ?”

“আর কি বলবো বলো! তোমরা সারাদিন নিজেরা সব ব্যস্ত, তাছাড়া সারা সপ্তাহে রবিবার ছাড়া তোমাদের দেখা পাওয়া ভার।” মিলির মা ঢোঁক গিলে বলেন। মিঠিয়ার মায়ের মেজাজ বোঝা ভার। মিঠিয়ার মা টুনার মায়ের দিকে তাকান। এই মহিলা অনেক ভদ্র সভ্য। মৃদু হেসে টুনার মা বলে, “ঐ যে বুনবুনি আর নান্টু বিয়ে করে নিয়েছে… কী সাহস ঐটুকু মেয়ের!” মৃদু হাসেন মজুমদার গিন্নি। বলেন, “কী বলবে বলো দিদি! খুব অস্থির আর অশান্ত মেয়ে তো… ও মেয়েকে ধরে বেঁধে রাখা কষ্টের।”

“তা বলে এভাবে লোক হাসাবে, ছিঃ! খবর তো তোমার মিঠিয়াই দিলো”— মুখ বাঁকান মিলির মা। 

“তোমাদেরও বলিহারি যাই! অতো বড় মেয়েকে বাইরে ওভাবে চরে বেড়াতে দাও কেন! কোন দিন কী বিপদ না হয়ে বসে!” টুনার মায়ের গলায় স্নেহ ঝরে। আড্ডাপ্রিয় মিঠিয়াকে এসব কলরব ঠেলে নিয়ে আসে আড্ডাস্থলে। যদিও মিঠিয়ার মা চান না মিঠিয়া এ আড্ডায় যোগ দিক। তবুও মিঠিয়া আসে। এসেই জুড়ে দেয় কলকল, “বুনি বুনি… উলুলুলুঁ… হি হি… হি হি…।” মিলির মা বাঁকা হেসে বলেন, “এবার তোরও উলুলুলু…।” এ কথা শুনে মিঠিয়া চরম খুশি হয়। একপাক নেচে নেয় বারান্দায় আনন্দের আতিশয্যে। যায় ছুটে মায়ের কাছে । মায়ের আঁচল ধরে পাক খেতে খেতে বাতাসিয়া হয়ে ওঠে আরো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, “মা, মা আমার উলুলুলুঁ…” একমুখ হাসি নিয়ে নিজের সিঁথির দিকে ইশারা করে। মজুমদার গিন্নির ঘরোয়া আবহাওয়া তখন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পড়শিরা ধীরে ধীরে সরে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে মিঠিয়ার উত্তেজনা তুঙ্গে। সে হাসছে… সে হাসিতে বারান্দা জুড়ে নামছে গোধুলি আলো। একটি পোড়া মুখ সে গোধুলি আলোয় হয়ে উঠছে মোহময়, রাঙা নেশাজড়ানো অস্তছবি। মজুমদার গিন্নি দাঁতে দাঁত কষে মেয়েকে শাসন করতে গিয়েও পারেন না। কতো কী মনে এসে জড়ো হয়।

এই তো সেদিন মিঠিয়া জন্মাল দুর্গাপুজোর আগে আগে। মা দুগগার মত রূপ নিয়ে জন্মেছিল বলে শাশুড়ি গৌরি ডাকতেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই বোঝা গেলো, মেয়ের গলার আওয়াজ খোনা। তখন থেকেই মজুমদার গিন্নি ঠাকুরের থানে হত্যে দিতেন। যদি কোনো পুজোআচ্চায় মিঠাস এসে বসে মিঠিয়ার গলা জড়িয়ে। এর আরো পরে মেয়েটার অত রূপ আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পোড়া মাটি করে দিলো। মিঠিয়ার মা আর দেরি করেননি। ঠিকুজি কুষ্ঠী ঘেঁটে, জন্ম ছক বিচার করে বুঝেছিলেন এ মেয়ের আগুনে ফাঁড়া। বুঝেছিলেন মিঠিয়ার শরীরে বায়ুর বৈশিষ্ট্য, তাই সে এতো অস্থির, চঞ্চল। নাহ, কোনো জ্যোতিষীর কথায় তাঁর ভরসা হয়নি। নিজেই গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানের সঙ্গে নড়ে চড়ে বসেছিলেন। শুরু হয়েছিল খোঁজ। এ সংসারে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী চোখ বুজলে মিঠিয়ার কী হবে!

তখনই বুঝেছিলেন আচার্যা ইন্দ্রাণী, মিঠিয়ার পাশে জলের মতো শান্ত, নরম অথচ মাটির মত ধৈর্যশীল মানুষ চাই। শুরু করেছিলেন রাশি মিলিয়ে মিঠিয়ার সৌভাগ্যের খোঁজ… আজও খুঁজে চলেন আচার্যা… আর মনে মনে স্বপ্ন দেখেন মিঠিয়ার মা… একমাথা সিঁদুর নিয়ে মিঠিয়া এ জন্মের মতো সুখে সংসার করছে। আকাশ বাতাস ভেসে যাছে একটিই ধ্বনিতে… উলুলুলুঁ… উলুলুলুঁ… 

আরও পড়ুন...

Categories
2022_july golpo

শ্রীকান্ত অধিকারী

গ ল্প

শ্রী কা ন্ত  অ ধি কা রী

srikanta

বাঁক বদল

হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি কালো করগেট টিনের চালার সেই বাড়িটার সামনে। চারুদের বাড়ি। টিনের দরজায় ভেতর থেকে শেকল দেওয়া। দরজায় একটা ফুটো। অনায়াসে ফুটোতে আঙুল চালিয়ে দরজা খুলে আস্তে করে ডাকলাম— চারু…। সামান্য কয়েক পা সরু উঠোন পেরিয়ে চারুর এক খোপ ঘরের বারান্দার সামনে।

চারু কাঠের উনুনের ধারে। আগুনে মুখ লাল। এলোমেলো চুল। খোলায় চাল ফট ফট করে ফুটছে। চারু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ঠোটের কোণ ফাঁক। বললাম—চারু, আমাদের বাড়ি যাওনা কেন?

চারু নিরুত্তর। মাঝে মাঝে চ্যালাকাঠ আগুনের দিকে ঠেলে দিয়ে তুষের ছিটে দিচ্ছে। লক লক করে আগুনের শিখা নেচে উঠছে। ভাজা খোলায় গরম কালো বালিগুলোকে কুঁচি কাঠি দিয়ে নাড়তে থাকে। সেই অবসরে ওর মুড়ি ভাজার উনুনশালটা আবার অতি পরিচিতের মত আলাপ জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কালো দেয়ালগুলো আরো কালো হয়ে গেছে। থেবড়ানো মাটির দেয়ালে এখানে ওখানে খোলাঙ্কুচিগুলো আরও স্পষ্ট। টিনের চালে বহুদিনের পুরনো লম্বা ঝুলগুলো ছড়ানো চুলের মত আগুনের আঁচে তিরতির করে কাঁপছে। একদিকে গাদ হয়ে পড়ে রয়েছে ব্যবহৃত পলিথিনের ক্যারিব্যাগের বান্ডিল। আর এক কোণে স্তুপাকারে ঝুড়ি ঝুড়ি ঘুঁটে, চ্যালাকাঠ, শুকনো ডালের তাড়া। বস্তাখানেক তুষ। বাইরে বাথরুমের ভাঙা টিনের দরজাটা হাট করে খোলা। ঘরের মেঝেতে একটা থালা, তার চারদিকে ভেজা মুড়ি ছড়িয়ে। দেখলেই বোঝা যায় কেউ খেয়ে এঁটো গুটিয়ে নেয়নি।

—বোসো। চারু চাল নাড়া থামিয়ে বলল— ঐখানটায়।

কোনো ভণিতা না করেই বললাম, আমার মুড়ি চাই চারু। তোমার হাতের মুড়ি।

চারু খানিকক্ষণের জন্য চমকে উঠে বলল— অ্যাঁ!

— আমার পেটে ঐসব ছাইপাঁশ সহ্য হচ্ছে না চারু। আমার বাড়িতে তুমি মুড়ি দিয়ে এসো।

মনে হলো চারু এবার হেসে উঠল। বলল— বেশ। আজকে হবে না। এ মুড়ি অন্যদের বরাদ্দ। কাল বিকেলে।

ওকে থামিয়ে বললাম– না না, বিকেল হলে হবে না। অফিসের টিফিনে নিয়ে যাবো। তুমি সকালেই আমাকে দেবে।

চারু মাথা নেড়ে জানাল– তাহলে খুব ভোরে উঠতে হবে।

আগে লৌতুনিমাসির কাছে শুনেছি বেশি চাপ থাকলে ভোরে উঠে চাল ওলাতে হয়, তারপর মুড়ি ভাজলে বেশ ফুল ফোটার মত নরম খাস্তা মুড়ি ফোটে। খেতেও বেশ সুস্বাদু।

সেই সুস্বাদু মুড়ির প্রসঙ্গ মনে করেই বললাম– তাই করো।

জ্ঞানত জলখাবারে মুড়ি ছাড়া কিছুই খাইনি। ছোটবেলা থেকেই সকালে চা—মুড়ি। বড় স্টিলের গ্লাসে হাফগ্লাস র’চা। তাতে চারুর আনা কুড়কুড়ে মুড়ি যেন মোগলাই সরবতে মিছরির দানা। তারপর চামচ দিয়ে ঠুসে ঠুসে যতটা ঢোকানো যায় তার চেয়েও বেশি ঠোসানো মুড়ি। ততক্ষণে মুড়ি আর চায়ে মাখামাখি– আহা অপূর্ব! 

তখন এদিকটা অতটা শহুরে হয়ে যায় নি। বিকেলে গামছার কোঁচড়ে মা’র মাখানো তেলমুড়ি, হাতে আস্ত একটা পিঁয়াজ কিংবা মুলো। কিংবা কাঁচা বিলেতিবেগুন দিয়ে খাবলা খাবলা মুড়ি মুখে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। সঙ্গী সেই চারু। দু’দিকে লাল ফিতে বাঁধা ঝুটি নিয়ে একসময় পথ চলতে চলতে শুকনো মুড়ি চিবোনোর শব্দে পথেই হারিয়ে যাওয়া।  

সেই পথ এখন পাকা  হয়েছে। আমার জীবনে রমা এসেছে। তবু চারু ওর মা লৌতুনিমাসির অর্ধেক মাটি আর অর্ধেক ইটের ঘরে  থেকে গেল। আর আমার ঘরে মুড়ির জোগান দিয়ে গেল।

দেশি চালের মুড়ি, বিস্কুটের টিনে বাড়ি বয়ে দিয়ে যেত চারু। একদিন চারু আমার স্ত্রী রমাকে বলে, বেশ ক‘দিন আসতে পারব না গো। মা তো চলে গেল, আমি একা।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। যা! তাহলে খাবো কী? হাজার রকমের অসুখের ভয়ে আমার কলজে সেঁধিয়ে গেল। চারু কি আর আসবে না!

রমা বলল, ডোন্ট ওরি। পাড়ার মোড়ে ভজা মুড়ি ভাজার মেসিন বসিয়েছে। বস্তা নিয়ে গেলেই হলো।

মুড়ি তো এলো, মুখে রোচে না। কোনটাতে নোনতা লাগে, কোনটা আবার ফ্যানা কাটে। ইউরিয়া ভিজে জল না সোডা দেয় শুনেছি। কেউ কেউ আবার কেরোসিনের ছিটেও দেয় ভিজে চালে। বেজার মুখ দেখে রমা বলল, তোমার মুড়ি খেয়ে কাজ নেই। এই দ্যাখো আমাদের মতো দুধ—ডিম—পাঁউরুটি খাও। মুখে লাগবে, শরীরও ভালো থাকবে।

এদিকে চারুর পাত্তা নেই। শুনেছিলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যায় না। বরকে নিয়ে মায়ের উনুনশালে আবার মুড়ি ভাজতে শুরু করেছে। তবে যোগাযোগ ছিলই না একেবারে। ফোন নাম্বারও রাখা হয়নি। অগত্যা রমার কথামতো ডিমের সাদা অংশ দিয়ে ডিমটোস্ট খেতে শুরু করলাম। একসময়ে ডিমের সাদা অংশে হলুদ অংশ মাখামাখি হয়ে গেল।

এভাবে বেশ কিছুদিন যেতে না যেতেই বিকেল দিকে পেটে চাপ চাপ লাগছে মনে হলো। রমাকে বলাতে রমা বলল— ধুর! এমনিতেই তুমি বাতিকগ্রস্ত। ওরকম ছোটোখাটো ব্যাপার মাথায় এনো না। আনলাম না।                                                  

তার দু’দিন পরে অফিসের শেষবেলায় কেমন ধিকধিক করে বুকে ব্যথা শুরু হলো। অফিসের সুভাষদা সব শুনে বললেন— বদহজম থেকে অ্যাসিড। তারপর গ্যাস। মুড়ি খান বুঝলেন।

মুখ কুঁচকিয়ে বললাম—ঐ মুড়িই তো সর্বনাশ করলো।

—কিন্তু বাঙালির মুড়ি মানে চিনেদের চাউমিন, তামিল—তেলেগুর ইডলি—ধোসা। সহজাত বলে একটা কথা আছে। যে যেমন অভ্যাসে বড়ো হয় আর কি! আমরা বাঙালি, মুড়ি ছাড়া চলে? মুড়ি খান। আপনি বাঁচুন বাঙালির শিল্পকেও বাঁচান।

আর কোনো রিস্ক না নিয়ে ছুটলাম চারুর বাড়ির দিকে।

                                 

চারুর প্রতিশ্রুতি আমাকে অনেক ফুরফুরে করে তুলল।

পরদিন যথারীতি টিনভর্তি মুড়ি এলো। একটা কচি মুখের মেয়ে দু’দিকে লাল ফিতে দিয়ে মাথার মাঝে সিঁথি করে চুল বাঁধা।

রমা তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বলে, মুড়ি! কে পাঠাল?

— মা। কিশোরী সঙ্কুচিত।

বললাম, তুমি কে?

— আমি শিলা। আপনি কালকে আমাদের বাড়ি গেছিলেন।

রমা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। বলে, তুমি মুড়ি খাবে! তোমার না অ্যাসিডের সমস্যা? 

বললাম– টিনটা নিয়ে নাও।

— আর ঘরে আনা হেলদি ফুড!

রমার মুখ ভার। সেটা দূর করতেই বললাম, হেলদি ফুডও চলবে। মাঝে মাঝে মুখ পালটাতে মুড়ি।

কিন্তু সেটা কথার কথা। সকালে একবার, অফিসে একবার, অফিস ফেরত একবার। সাত দিন পেরল না টিন ফাঁকা।

রমা বলল, চারুকে খবর দাও।

বললাম, ফোন করে দিলেই তো হতো। আবার যাবো?

— ওর কি আদৌ ফোন আছে?

যখন থেকে বলা তখন থেকেই মনের মধ্যে সেই শান্ত নিরীহ মুখটা তোলপাড় করতে লাগল। একটা মেয়ে সারাজীবন উনুনে হাতা–কুঁচি—বালি—খোলা—খাপুড়ি—মুড়ি এই সব নিয়েই কাটিয়ে দিল। অন্যদিন হলে আটটায়—ও সকাল হতো না। আজ সূর্য ওঠার আগেই আমি বিছানা ছেড়ে দিয়েছি। ছাতে উঠে দু’একবার হাত—পা স্ট্রেচও করেছি। এমনকি প্রতিবেশী রামু সদগোল, যে কিনা দশ বছর ধরে আমার পাশেই রয়েছে। চোখে—চোখে কিংবা ঘাড় কাত করে ভাল থাকার রিহার্সাল দিয়েছি মাত্র, তাকে পর্যন্ত আমার গুমোর ভেঙে হাত নেড়ে ডেকে শুধিয়েছি – ভালো আছেন তো?

সারা সকাল এক অজানা উৎফুল্লতা সারা শরীরে ছড়িয়ে রইল।

মুড়ির বস্তাতে টিনের মুখটা উপুড় করে মুড়ি ঢালে চারু। ওর কচি লাউয়ের মতো মুখটা আমার অনেক কাছে। পলিথিনের বস্তায় মুড়ি পড়ার সরসর শব্দ। চারুর কানের কাছে আস্তে আস্তে বললাম– কেমন আছো চারু?

চারু মুখ তুলে ধরল। খানিকক্ষণ আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল আমি লজ্জা পেলাম। বললাম— তোমার মেয়েটা কোথায়?

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে কোত্থেকে একটা দড়ি এনে বস্তাটা বেঁধে দিলো। তখনই দেখলাম ওর ব্লাউজটা ফাটা। খানিকটা তেলচিটেও বটে।

মুড়ির বস্তা হাতে নিয়ে বাইরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল চারু। বললাম– একটা ফোন নাও চারু।

চারু মাথা নাড়ে।

                                   

দিন পাল্টেছে। সাধারণ ঘরে আগে সকালে—বিকেলে জলখাবার বলতে শুধু মুড়িই থাকতো। চা—মুড়ি, গুড়—মুড়ি, দুধ—মুড়ি ,চপ—ঘুগনি—মুড়ি ছাড়া ভাবাই যেত না। এখন প্যাকেটবন্দি নানান খাবার। রুটি—পাঁউরুটি—বিস্কুট পাওয়া যায় পাড়ার দোকানগুলোতে। হাত বাড়ালেই ফাস্ট—ফুড। মনের মধ্যে কু ডাকে— চারু কি এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে?    

দেশি মুড়ি ভাজা এমনিতেই অনেক ভজকট। শুনেছিলাম মুড়ি ভাজার হ্যাপা। একবার মুড়ি আনতে দেরি করেছিল বলে বিনা টিফিনে স্কুল গেছিলাম। রাগ হয়েছিল খুব। পরদিন যখন লৌতুনিমাসির সঙ্গে চারু মুড়ি নিয়ে এলো, দুম করে বলে ফেললাম— কী এমন করছিলে চাট্টি মুড়ি আনতে পারোনি। অমনি চারুও কোমরের দু’দিকে হাত রেখে তড়বড়িয়ে বলেছিল– তুমি জানো মুড়ি ভাজতে কত ঝামেলা! একজনকে চাল ধুয়ে নুনাতে হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে   দাঁতে কেটে দেখতে হয় খরা করে শুকিয়েছে কিনা। যদি কটাঙ না করে, তাহলে মুড়ি ভালো হবে না। তারপর আরেক জনকে বড়ো খোলাতে সব চাল উলাতে হবে। মানে বড়ো হাতা দিয়ে নেড়ে চেড়ে কষতে হবে মাংস কষার মতো। যতক্ষণ না তেঁতুলের বীজের মত রঙ না আসে। তারপর…

আমি বললাম, তারও পর?

—তারপর খাপুড়ির গরম বালিতে এক খাবল করে চাল দিলেই… উঁ, জানে না যেন! 

যাবার সময় বললাম— মুড়ি ভাজার বিজনেসটা বাড়াতে পারো। এখনো দেশি মুড়ি অনেকের পছন্দ।                                                          

আবারও কোনো উত্তর করল না। শুধু ক্লিশে হাসি হাসল।

বললাম— ব্যাঙ্ক—ট্যাঙ্ক থেকে সাহায্য নিতে পারো। বলো তো আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তো নানান প্রকল্প রয়েছে।

এবার সে কথা বলল— ভাববো। 

                                   

আমাকে নিয়ে রমার আর কোনো সমস্যা নেই। সময়ে মুড়ি ঘরে চলে আসে। সবসময় চারু না এলেও মেয়েকে দিয়ে মুড়ি ঠিক পাঠিয়ে দেয়। কখনো কখনো শিলাকে ডেকে বাড়ির ছোটোখাটো কাজ— তরকারি কাটা, পাশের মুদি দোকান থেকে নুন, সাবান কিংবা বিস্কুট এনে দিতে বলে। কখনো বা চারুকে রান্নাঘরের ভেতর ঢুকিয়ে ছ্যাঁচড়া, টক কিংবা কচি লাউয়ের পায়েস রান্নাটাও শিখে ফেলে।

সেদিন রমা বলল— পুজোতে চারুকে আর ওর মেয়েকে কাপড়জামা দিতে

হবে। একদিন দিয়ে এসো।

বললাম— আবার বাড়ি কেন? এখানেই তো ওরা আসবে, তখন না হয় দিও।

— বাড়ির কাছে পেয়ে উপহার দেওয়া ঠিক শোভা পায় না। ছুটির দিন দেখে

এক সময় দিয়ে এসো। রমা বলে, ওর বরটা আবার পালিয়েছে, জানো?   

বললাম– লটারির টিকিট বিক্রি—বাটা করত না?

—সে আর ক’দিন। উড়ে—আদিরে ছেলে সংসারের দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। লৌতুনিমাসি চারুর বিয়েটা ঠিকঠাক দিতে পারেনি। রমা গজগজ করে।

                                   

অনেকদিন পর আবার চারুর বাড়ি। সেই অভ্যাসবশে হাত ঢুকিয়ে বাইরের দরজা খোলা। তারপর হঠাৎ মনে হলো এভাবে দরজায় টোকা না দিয়ে দরজা না খুললেই হতো। তাই অকারণে টিনের দরজাতে লোহার শিকলের আওয়াজ করি। কিন্তু তাতেও কেউ এলো না দেখে কয়েক পা ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠি। চারুর উনুনশাল ভাঙা। আধপোড়া।  

মাথার ওপর চাল নেই। বাজপড়া গাছের মত খাঁকড়া চারটে পোড়া দেওয়াল নির্বাক দাঁড়িয়ে। উনুনশালের ভেতর দু’খানা ঝিকভাঙা উনুন ফাঁকা আকাশের দিকে তাকিয়ে হা—হুতাশ করছে। দেওয়ালের কোণে আধপোড়া দলা পাকানো সেই প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের গাদ। উপুড় করা ভাঙা খোলা খাপুড়ি। এক চটক দেখলেই মনে হবে এখানে একটা ঝড় বয়ে গেছে।

আঁতকে উঠি, চারুর কিছু হয়নি তো! চারু কোথায়? এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখি, ভেতরে মাটির মেঝেতে চারু শুয়ে। আমাকে দেখেই ওর চোখ ছলছল করে ওঠে। ইশারায় ডাকে। এক মুহূর্তে মনে হলো লৌতুনিমাসি শুয়ে। পরক্ষণেই ভুল শুধরে কাছে গিয়ে শুধোলাম– শিলা কোথায়?              

—আসছে। মুদিখানা গেছে।

হাতের প্যাকেটটা ওর পাশে নামিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করি— শরীর খারাপ বুঝি?

চারু নিস্পৃহ চোখে প্যাকেটের দিকে চাইল।

বললাম— তোমাদের জন্য দিদি পাঠিয়েছে।

শুকনো মুখে মরিয়া হাসি এনে বলে— দিদি আমাকে খুব ভালবাসে।

আমি মাথা নাড়ি। এবারে আসল কথাটা জিজ্ঞেস করি— উনুনশালটার ওরকম হাল হলো কী করে?

— দিদিকে বলো মাস দুয়েক অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে চালিয়ে নিতে। এখন মুড়ি ভাজা বন্ধ।

— কিন্তু কেন?

এর কোনো উত্তর সে দেয় না। শুধু চোখের কোণ বেয়ে কানের পাশে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি ঠিক কী করব বুঝে উঠতে পারি না, এই মুহূর্তে আমি থাকব ওর পাশে, না উঠে চলে যাবো।   

তখনই শিলা আসে। হাতে থলে। বলে— বাবা পুড়িয়ে দিয়েছে। খোলা খাপুড়িও লাথি মেরে ভেঙে দিয়েছে।

বললাম— বাবা কোথায়?    

— পালিয়েছে। শিলার নির্বিকার উত্তর।

চারু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে। শিলা পরম যত্নে একটা একটা করে মুদির দোকান থেকে আনা নুন তেল আলুর হিসেব দিচ্ছে— দু’টাকার নুন, পাঁচ টাকার আলু, আট টাকার সরষের তেল। চারুর সেদিকে আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না।

ঘরের এক কোণে কতগুলো স্টিল–অ্যালুমিনিয়মের বাসন—কোসন। একটা ছোটো গ্যাস সিলিন্ডার। মাথায় ওভেন। স্টিলের আলনা, কিন্তু ফাঁকা। কাপড়—চোপড় ছড়ানো ছিটানো।

বললাম— চিন্তা কোরো না চারু, ব্যাঙ্কে ফরটি পার্সেন্ট সাবসিডিতে একটা লোনের ব্যবস্থা করে দেবো। আবার নতুন করে শুরু করবে। আর তা যদি পছন্দ না হয় সেল্ফ হেল্প গ্রুপে নাম লেখাও। দেখো তোমার মতো অনেকেই আছে। কোনো অসুবিধা হবে না। আমি তো আছি। চারুর মুখের প্রতিক্রিয়া দেখার বহু কসরৎ করলাম, কিন্তু মুখটা এমনভাবে গুঁজে রইল দেখতে পেলাম না।  

আমি উঠে এলাম, তখনো চারু কোনও কথা বলল না। শুধু কাপড়ের প্যাকেটটা আঁকড়ে ধরে রইল।

বুকের মাঝে একটা চাপ নিয়ে কোনো রকমে চারু—শিলার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই মনে হলো, বাইরের আকাশটা এত সুন্দর! আগে কখনো দেখিনি তো!

কিন্তু দু’পা এগোতেই আমাকে আগলে ধরল চারুর আদরের উনুনশাল। সেই মুখপোড়া দু’খানা ভাঙা ঝিক, খাঁ খাঁ করা মাথা আর রক্ত জমাটে কালোর মত পোড়া ফাটা দেয়ালগুলো অদ্ভুত ভাবে দাঁত বের করে আমাকে যেন ব্যঙ্গ করতে  লাগল… — আমাদের তাড়ানো অত সহজ না। আমরা এ ভাবেই থাকি। তোমাদের মধ্যে, মানুষের মধ্যে। আজীবনকাল! সে কী কিম্ভূত হাসি। ভীষণ ভয়ে যখন প্রায় দৌড়ে উঠোনটুকু পেরিয়ে দরজার ওপারে, মনে হলো কে যেন ডাকছে— শিলা। হয়তো কিছু বলবে। হয়তো আরো কিছু দরকার। মা—মেয়ের একার সংসারে একটা শক্ত কাঁধ।

মনে পড়ে গেল, আমাকে অফিস বেরতে হবে। দ্রুত রাস্তার বাঁকটা ধরে ফেললাম।

আরও পড়ুন...

Categories
2022_june golpo

রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

গ ল্প

রি নি   গ ঙ্গো পা ধ্যা য়

rini

রাই কিশোরী ও একটি নগরী

সকালের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি সেরে কোনোরকমে দুটো ডাল-ভাত মুখে তুলেই রাই দাঁড়িয়ে পড়ে আয়নার সামনে। লম্বা চুলের সামনেটা পাফ করে পিছনে কোনোদিন খেজুর বেণী, কোনোদিন পনি ঝুলিয়ে দেয়। মুখে পাউডার লাগিয়ে আইলাইনার দিয়ে নিপুণ হাতে এঁকে নেয় চোখ। লিপস্টিক তার সাকুল্যে দুটো। তাই-ই জামার সঙ্গে মোটামুটি ম্যাচ করে লাগিয়ে নেয়। প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার আগে প্রসাধনে এটুকু সময় তাকে দিতেই হয়। এমনকি বাদ যায় না পরীক্ষার দিনগুলোও। ধ্যাত, যেমন তেমন করে বেরনো যায় না কি! তার ছিপছিপে, একটু বেশিই রোগা কিন্তু লম্বা শরীরটায়, ফিটিংস চুড়িদারে, গলার কাছে জড়ো করা ওড়নায় এইটুকু সাজ না হলে মানায়! বাড়ি থেকে কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে যাতায়াত করার সময় দু-একটা সিটি, ‘তোমায় হেব্বি লাগছে’ গান যে তার উদ্দেশ্যেই ছুটে আসে সে কি আর সে বোঝে না! এই রাস্তাটুকুই তো তার ওড়াউড়ি! বাদবাকি তো সেই কলেজ, লেকচার, ম্যাডামদের চোখপাকানো! কোনো কোনো স্যার অবশ্য একটু আধটু অন্যরকম হাসেন! কিন্তু ওই অব্দিই! 

জমে যায় যখন কোনো বন্ধু প্রেমে পড়ে। না না, কলেজের ছেলেগুলোর সঙ্গে না। ওরা মেয়েদের দিকে তাকায় না। রাত থাকতে উঠে মাছের ভেড়িতে কাজ করে। দুপুরে কলেজে এসে ঝিমোয়! প্রেমে পড়ার ছেলেরা হয় অন্য; ওই যে কলেজের বাইরে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মাথায় স্পাইক করা, ডগার কাছটা লালচে, কিংবা অটো চালাতে চালাতে সাইড কাঁচে একঝলক তাকিয়ে চোখ মারে! বন্ধু তখন সুযোগ পেলেই ফিসফিস করে! কবে কলেজের রাস্তায় ওড়না ধরে টান মেরেছে; কবে পিঠে ছুঁড়েছে ফুল; পুরো ‘দিদি তেরা দেওয়র দিওয়ানা’; ভাইজান স্টাইল; কবে সন্ধের আলো-ছায়ায় বাড়ির পিছনের বাবলা গাছের আড়ালে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে! আরো একটু নিচেও নামিয়েছিল হাতটা!

কোথায় রে! গলায়!

না, আর একটু।

কোথায় রে! ওখানে! একদম ভিতরে! আহা বল না বাবা!

তার দু-এক মাসের ভিতরেই বন্ধু নিখোঁজ হয়। বাপ-মা কান্নাকাটি করে আসে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ খোঁজ চালালেও খোঁজ মেলে না। কিন্তু একসময় বন্ধুদের মোবাইলের ইনবক্স ভরে যায় একমাথা টকটকে লাল সিঁদুরে মাখামাখি পাউট করা নানা বিভঙ্গের ছবি। পাশে অবশ্যই স্পাইক করা ভাইজান। 

তারপর হারিয়ে যায়। আর কোনো খোঁজ নেই। কোথায় যায়, কী হয়, বন্ধুরাও জানতে পারেনা। তারা তখন শুধু স্বপ্ন বোনে! আহা, পড়াশোনা নেই; বকাঝকা নেই; বরের ঘর; নতুন শাড়ি-জামা; সাজগোজ; সিনেমা-ফুচকা; আর রাতে… উউউফফফ! হাত পা কেমন শিরশির করে!! 

দু-একজন যে একেবারে ফিরে আসে না তা নয়! সিঁদুর, শাঁখা পলা লোহা বাদ দিয়ে কুমারী মেয়ের মতো আসে! জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। দু-একমাস বাপের ঘরে থেকে এবার বাপের দেখে দেওয়া ছেলেকে বিয়ে করে। অনেকে আবার বাচ্চা কোলেও ফেরে। তারাও বিয়ে করে। একটু বেশি বয়সী বর জোটে তাদের। কিন্তু এসব ঘটনার মাঝেই কলেজের ম্যাডামরা কেবল ভয় দেখায়! বলে- মন দিয়ে পড়াশোনা করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। তারপর বিয়ে করবে।

বলে- প্রেম তো হতেই পারে। প্রেমিককেও বলো তোমার মতো পড়াশোনা করে চাকরির চেষ্টা করতে!

বলে- বিয়ের লোভ দেখিয়ে এ অঞ্চল থেকে মেয়ে নিয়ে নোংরা জায়গায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। তোমরা চাও তেমন জীবন? এখন কষ্ট করলে সারাজীবন মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে  বাঁচতে পারবে!

আরে বাবা! ম্যাডামগুলো যেন কী! নিজেরা বিয়ে করে বসে আছে! আমাদের বেলা যতো আপত্তি! ভালোবাসলে আর অপেক্ষা করা যায়! মনটা ছটফট করে না! শরীরটা আছাড়ি-বিছাড়ি করে না! 

অবশ্য ঋতী ম্যাডাম আলাদা। বিয়ে-টিয়ে করেনি! অথচ বেশ দেখতে কিন্তু! একমাথা কোঁকড়া চুল। কি ঘন! অথচ বড়ো চুল রাখে না। সকলের সঙ্গে  কেমন হেসে কথা বলে। ঋতী ম্যাডামের ক্লাসে নেতিয়ে পড়া ছেলেগুলোও কেমন চাঙ্গা হয়ে যায়! শুধু যখন প্রেমের কবিতা পড়ান, জীবনানন্দ কিংবা গালিব, কেমন উদাসী হয়ে দূরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলতে থাকেন! সব কথা ভালো বোঝা যায় না। ক্লাসটা থমথমে ভারি হয়ে ওঠে। উনি চুপ করলেই রাইদের কারো কারো ভিতর থেকে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

যাক গে! বাবা-মাকে চেঁচিয়ে বলে বেরোতে গিয়েই দরজায় হোঁচট খেল রাই। আরে, সামনের ছোটো পাঁচিলটায় কিশোরদা বসে আছে না!

তুমি কবে এলে?

কিশোর এক থাবলা সাদা থুতু পাশের জমিতে ফেলে ব্রাশ চিবোতে চিবোতে বলে- এই তো কালই।

বাব্বা, কত্ত বছর বাদে!

হ্যাঁ, ছ’বছর।

তুই কি কলেজ যাচ্ছিস?

হ্যাঁ।

আর কতো পড়বি?

এই তো আর দুটো সেমেস্টার!

ও।

রাই বেরিয়ে আসে।

পরদিন বড় রাস্তা পার করে পুকুর পাড় ধরে কলেজের রাস্তাটায় ঢুকতেই সোঁওওওও করে একটা সাইকেল ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে দাঁড়ায়। রাই বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করছিল। খেয়াল করেনি। কিশোর ডাক দেয়- এদিকে শোনো।

রাই অবাক হয়। পিছন থেকে বন্ধুরা গুঁতো মারে। রাই এগিয়ে যায়।

এটা তোমার জন্য। একটা প্লাস্টিকে মোড়া লাল মতো কী যেন এগিয়ে দেয় কিশোর।

রাই নেয়।

কিশোর এঁকেবেঁকে সাইকেল চালিয়ে সিটি দিতে দিতে অদৃশ্য হয়।

রাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বন্ধুরাও হাসে। এসব ইশারা ওদের পরিচিত। প্যাকেট খুলে দেখা যায় একটা লাল রঙের ওড়না; জরি-চুমকিটুমকি বসিয়ে খুব কাজ করা। বন্ধুরা গান ধরে ‘লাল দুপট্টা উড় গয়ারে হাওয়াকে ঝোঁকে সে…’

ব্যস, তারপরই হয় বাবলা, নয় অশ্বত্থ, নয় অন্ধকার পুকুরের পাড়… শরীরী খেলায় মেতে ওঠে রাইয়ের কুমারী মন।

সেদিন সন্ধেবেলা বসে বসে কলেজের মিড-সেমের খাতা দেখছিল ঋতী। একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। কলেজের কোনো স্টুডেন্টরই হবে!

হ্যাঁ, বলছি।

ম্যাডাম, রাই বিয়ে করেছে।

কে রাই?

ম্যাডাম, ওই যে ফিফ্থ সেমেস্টারে পড়ে না! লম্বা করে! দেখতে ভালো!

ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। কী হয়েছে?

ম্যাডাম, ও বিয়ে করেছে।

সে কী!

হ্যাঁ ম্যাডাম, আর কালকেই বম্বে চলে যাচ্ছে।

মানে? বম্বে কেন? তুমি কে বলছো?

ওর বর বম্বেতে থাকে ম্যাডাম। বরের মা বারে নাচে। ওকে ওখানেই নিয়ে যাচ্ছে।

ঋতীর কান দিয়ে খানিকটা গরম হাওয়া বেরিয়ে গেল। কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করল- তুমি কে?

ফোনটা কেটে দিল। ছেলেটা কিছুতেই নিজের নামটা বলল না।

যাক, সেটা পরে ভাবলে চলবে। আপাতত ঋতী প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে সবটা জানাল। স্যার বললেন- দাঁড়াও, স্টিফেন আছে, সজল আছে; ওরা লোকাল লোক। আমি আগে দেখি ব্যাপারটা কী!

প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেছে। ঋতী পায়চারি করেই যাচ্ছে। বাবা বলছে, তুই এতো টেনশন করছিস কেন? প্রিন্সিপাল স্যার তো ব্যাপারটা দেখছেন!

তুমি বুঝতে পারছ না বাবা! মেয়েটাকে পাচারের চেষ্টা করছে! মেয়েটা দেখতে ভালো। পড়াশোনাটাও খারাপ করে না।

ঋতী হাতের তালুতে অন্য হাত মুঠো করে মারে। এতো করে বোঝাই! এতো বলি! তবু সেই ভুল করল!! ঋতীর অস্থির লাগতে থাকে।

আরো বেশ খানিকটা সময় পার করে প্রিন্সিপাল স্যার ফোন করে। ঋতী শোনো, ওই ছেলেটি এর আগেও একটি বিয়ে করেছিল। সেই বউ পালিয়ে এসে এখানে আবার বিয়ে করেছে।

কেন স্যার? পালিয়ে এসেছে কেন?

সেটা বলতে চাইছে না।

তবে কাল ওদের বিকেল চারটেয় ট্রেন। তার আগে দশটার মধ্যে কলেজে আসতে বলেছি।

আসবে স্যার? পালিয়ে যাবে না তো?

আমি লোকাল থানার ওসির সঙ্গে  কথা বলেছি। সাদা পোশাকে পুলিশ নজর রাখবে।

ঠিক আছে স্যার। আমি কাল দশটার আগেই পৌঁছে যাব।

চিন্তা কোরো না। মেয়েটাকে বাঁচাবোই।

পরদিন কলেজ পৌঁছেই ঋতী দেখা করে প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে। অন্য কয়েকজন অধ্যাপকও বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। স্যার বলেন- দে অলরেডি হ্যাভ ডান হোয়াটএভার দে ওয়ান্ট টু ডু। অ্যান্ড উই কান্ট ক্যানসেল দেয়ার ম্যারেজ, বিকজ দে আর অ্যাডাল্ট!

ইয়েস স্যার।

সো আওয়ার ইনটেনশন ইজ জাস্ট টু কিপ গোয়িং দ্য গার্লস স্টাডি অ্যান্ড অলসো টু স্টে হার হিয়ার ইন হার পেরেন্টস কেয়ার!

ইয়েস স্যার। উই জাস্ট ডোন্ট অ্যালাও হার টু গো উইথ হার হাসব্যান্ড!

প্লিজ ঋতী। ডোন্ট বি এক্সাইটেড! উই মাস্ট ট্যাকেল ইট ভেরি ট্যাক্টফুলি!

সরি স্যার। ওকে স্যার।

লেটস গো। দে হ্যাভ অলরেডি কাম।

ঘরে ঢুকেই ঋতীর চোখ পড়ে যায় রাইয়ের ওপর। একমাথা সিঁদুর লাগিয়ে, রোগা রোগা হাতে চারটে শাঁখা পলা নোয়া চাপিয়ে লাল রঙের একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে। ওকে দেখেই ঋতীর মনে হয় ওর সারা শরীর-মন ক্ষতবিক্ষত করে বুঝি অতো লাল রঙ পাওয়া গেছে!!

দেখুন স্যার, আমি আমার বৌমাকে পড়াব। মুম্বাইতে কলেজে ভর্তি করে দেবো। ও যতদূর খুশ পড়বে! রাইয়ের শাশুড়ি বলছে ভাঙা ভাঙা বাংলায়। বেশ ভারিক্কি চেহারা তার। সাজগোজে খুব একটা ভদ্রতার ছাপ নেই। তার হাবেভাবে তার পেশার একটা আন্দাজ করা চলে।

ঋতী বলে, রাই তো বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে। মুম্বাইতে সেটা কীভাবে সম্ভব?

আরে বাংলা পড়বে না তো, অন্য কিছু পড়বে!

রাই বাংলা মিডিয়ামের স্টুডেন্ট। ওর পক্ষে হিন্দি, মারাঠি বা অন্য ভাষায় পড়াশোনা করা সম্ভব নয়। আর তাতে তো সময়ও নষ্ট হবে!

স্যার বলেন- ওর আর দুটো সেমেস্টার বাকি আছে। এখানে ওকে পড়াশোনাটা শেষ করতে দিন। মাত্র তো একটা বছর, তারপর না হয় মুম্বাই যাবে!

ঋতী বলে, গ্র্যাজুয়েট হয়ে থাকলে পরে চাকরির চেষ্টা করতে পারবে।

শুনে মহিলা কেমন ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে।

এতক্ষণ কিশোর বা রাই, রাইয়ের বাবা-মা একটা কথাও বলেনি। ওরা যেন ভয় পেয়েছে। চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। হঠাৎ কিশোর ঋতীর পা চেপে ধরে। ঋতী চমকে উঠে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিতে চায়। স্যারও অবাক। কিশোর ওঠে না। বলে- আপনি ওকে এখানে রেখে দিন ম্যাডাম। ও পড়াশোনা করুক। আপনার পায়ে ওকে জায়গা দিন।

রাই জোরে কেঁদে ওঠে।

দরকার পড়লে আমি এখানেই কোনো কাজ ধরে নেবো। ওকে যেতে হবে না!

ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি ওঠো। ওঠো।

ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে স্যার বলেন- আমরা তো রাইকে পড়ানোর কথাই ভাবছি। সেইজন্য তো তোমাদের এখানে ডেকেছি কথা বলব বলে।

ওরা প্রিন্সিপাল স্যার আর অধ্যাপকদের  হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বারবার ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। শুধু শাশুড়ি মা’র বিরক্তি টা চাপা থাকতে চায় না। নিজের ছেলেকে গজগজ করে কী যেন বলতে থাকে। রাই ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকে।

পরদিন থেকে রাইকে ক্লাসে দেখে ঋতী কিছুটা স্বস্তি পায়। বন্ধুরা রাইকে নিয়ে হৈ হৈ করতে চায়। ঋতী গুরুত্ব দেয় না। সকলকে বুঝিয়ে দিতে চায় বিয়ে করে রাই জীবনের কোনো মহান ব্রত পালন করেনি। বরং তার যথেষ্ট ক্ষতির সম্ভাবনাই তৈরি হয়েছিল। মনে মনে ভাবে, আগামীতেও যে মেয়েটার কপালে কী দুর্ভোগ আছে! নজরে নজরে রাখতে হবে ওকে।

রাই কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত দুর্ভাবনা কাটিয়ে ওঠে। আবার বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করে, সাজগোজ করে; চেহারায় ওর একটা বেশ ঢলঢলে ভাব এসেছে; ফলন্ত লাউ ডগাটির মতো।

কলেজের অ্যানুয়াল স্পোর্টস। এবারে বেশ বড়ো করে আয়োজন করা হয়েছে। স্টুডেন্ট সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়ছে। নতুন নতুন স্ট্রিম খোলা হচ্ছে। স্যার তাই এই অঞ্চলের বেশ বড়ো মাঠটাই ভাড়া করেছেন। কলেজের নিজস্ব মাঠটা ছোটো; জায়গা কম। স্টুডেন্টদের ন’টার মধ্যে চলে আসতে বলা হয়েছে। সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে ছোটো করে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; তারপর প্রিন্সিপাল স্যারের বক্তৃতা; তারপর এমএলএ স্পোর্টস-এর উদ্বোধন করবেন। 

রাই আজ খুব সেজেছে। নাচের দলটাকে ও লিড করছে। সঙ্গে আছে দেবযানী। হৈ হৈ করে স্পোর্টস হলো; এক একটা রাউন্ডে সে কি উত্তেজনা! সবচেয়ে বেশি মজা হয়েছে টিচারদের ব্যালেন্স রেসে। পছন্দের টিচারদের নিয়ে স্টুডেন্টদের সে কী উন্মাদনা! সব মিটতে মিটতে প্রায় পাঁচটা বেজেছে। মাঠ খালি করে স্টুডেন্টদের রওনা করিয়ে তবে ঋতীরা বাড়ি ফিরেছে। সারাদিনের ক্লান্তি, হৈ চৈ… দিনটার রেশ যেন কাটতেই চাইছে না।

রাত তখন সাড়ে বারোটা হবে। ঋতীর ফোনটা বাজছে। ঋতী ধড়মড় করে উঠেছে। পাশের ঘর থেকে বাবাও ছুটে এসেছে। ছোটোমামু অসুস্থ; কিছু হলো না তো! ঋতী দেখে স্টিফেন ফোন করছে।

হ্যালো?

ম্যাডাম, স্টিফেন বলছি। কলেজের একটা মেয়ে পালিয়েছে। পুলিশ আপনাদের ওই রাই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেছে।

ঋতীর পুরোটা মাথার ওপর দিয়ে যায়। কে পালিয়েছে? রাইকেই বা তুলে নিয়ে গেছে কেন?

ম্যাডাম, স্যারকে ফোনে পাচ্ছি না। তাই আপনাকে বলছি।

কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলো?

সবটা জানি না ম্যাডাম।

আচ্ছা, আমি দেখছি।

ঋতী প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে; সুইচড অফ। একটু চিন্তা করে সরাসরি থানার ওসিকেই ফোন করে।

ও, আপনি তদবির করছিলেন না এই মেয়েটাকে আটকাবার জন্য?

হ্যাঁ, মানে, কী হয়েছে?

কী আবার হবে! এরা সব লোকালি র‍্যাকেট চালায়!

কী বলছেন আপনি এসব!

যা বলছি ঠিক বলছি। ফোনটা কেটে যায়।

ঋতী ঘামতে শুরু করেছে। রাই র‍্যাকেট চালায়! রাই!

ঋতী রাজদীপকে ফোন করে। ও কলেজের কাছাকাছিই থাকে। ওরা দু’জনে মিলে ওই রাতেই পৌঁছোয় থানায়। রাই ঋতীকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে- ম্যাডাম আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনি। আমি কিছু করিনি। ঋতী দেখে রাইয়ের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। কষ কেটে রক্ত পড়ছে। ঋতী আগলে নিয়ে ধরে রাইকে।

আপনারা ওকে মেরেছেন?

ম্যাডাম, আপনি জানেন না ও কতো ধুরন্ধর! ওই সরিয়েছে মেয়েটাকে। ক’দিন ওর সঙ্গেই দেখা যাচ্ছিল। শেষবারও ওর সঙ্গেই দেখা গেছে!

সেই জন্য আপনি ধরেই নিচ্ছেন দেবযানীর মিসিং-এর পিছনে ওর ভূমিকা আছে। ওরা দু’জন ভালো বন্ধু অফিসার!

ওসব বন্ধু-টন্ধু অনেক দেখা আছে ম্যাডাম! আরোও দু’ঘা পড়লে সব বেরিয়ে আসবে!

 ওর এগেন্সটে আপনাদের চার্জটা কী? কোনো এফআইআর হয়েছে?

সোমত্থ মেয়ে পাচার হলে বাপ-মা এফআইআর করে! কী বলছেন ম্যাডাম!

আপনি বিনা চার্জে ওকে থানায় এনে টর্চার করছেন? এটা তো পুরো বেআইনি!

আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না ম্যাডাম!

অবস্থা হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে রাজদীপ কথা বলতে এগোয়। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। সে রাতে রাইকে ছাড়া হয় না।

পরদিন প্রিন্সিপাল স্যার থানায় এসে কথা বলে রাইকে বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ রাইয়ের পিছন ছাড়ে না। বারবার বাড়িতে হানা দেয়; ভয় দেখায়; হুমকি দেয়। রাই কলেজ আসা বন্ধ করে দেয়। ওদিকে দেবযানীর কথা ভেবে ঋতীর কেমন পাগল পাগল লাগে। ইতিমধ্যে রাইয়ের শাশুড়ি এসে হাজির হয়েছে। রাইয়ের বন্ধুরাই ঋতীকে জানায়।

প্রায় পনেরো দিন পর দেবযানী ফোন করে ওর বাবার নম্বরে। ও বিয়ে করেছে। যোধপুরে আছে। ভালো আছে। শুরু হয় পুলিশী তৎপরতা। যোধপুর পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করে কলকাতা পুলিশের একটা টিম উদ্ধার করে আনে দেবযানী আর ওর বরকে। ছেলেটা এ অঞ্চলেরই। বিয়ে করে যোধপুরে মামারবাড়ি পালিয়েছিল। দেবযানী ফিরলে এখানে ওর ধুমধাম করে বিয়ে হয়। হানিমুন তো আগেই সারা হয়ে গেছিল। দেবযানী তাই এবার পড়াশোনায় মন দেয়। ফাইনাল পরীক্ষাটা দিতে হবে না!

ওদিকে এলাকায় বদনাম হওয়ার অজুহাতে শাশুড়ি রাইকে নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দেয়। এবার আর কলেজকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। খুব শিগগিরই ট্রেনিং কমপ্লিট হয় রাইয়ের। মুম্বাইয়ের এঁদো গলির মদের ঠেকে বুক-পিঠ প্রায় খোলা ব্লাউজ আর নাভির নিচে কোমরের ভাঁজ দেখিয়ে হাঁটু অব্দি ঘাঘরা পরে কাস্টমারদের খুশি করতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় রাইকে! ওর লাল জরিদার ওড়নাটা এখন রঙ্গিলা আশিকদের গলায় দোল খায়। শুধু কিশোর বসে বসে ভাবে কোথায় যেন সে পড়েছিল দুটো লাইন…

তোমাকে যে ছেড়ে যাই সে তোমারই জন্য

শ্রীরাধা যায় না কভু মথুরা জনারণ্য!

আরও পড়ুন...