সিনেমা যখন কবিতা । পর্ব ১
ছবির নাম । চেঞ্জলিং (২০০৮)
পরিচালনা । ক্লিন্ট ইস্টউড
অভিনয় । এঞ্জেলিনা জোলি, এমি র্যান, জন মাকোভিচ
আমাদের এই গল্পের শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় একশো বছর আগের কথা – ১৯২৮ সালের লস এঞ্জেলেস। মা এবং ছেলের ছোট্ট সংসার – ছবির মতো বাড়ি – সামনে রুমালের মতো বাগান। পশ্চিম উপকূলে সে সময় টেলিফোনের ব্যবহার শুরুর মুখে। মা ব্যস্ত সেই কাজে। সিঙ্গল মাদার। সিপিয়া রঙের সেই সব দিন – পথে পথে ট্রাম – লম্বা ভিক্টোরিয়ান টুপি এবং পেন্সিল হিলে সেজে মেয়েরা কাজে, পার্টিতে হইচই করতো! ক্রিস্টিন কলিন্স (এঞ্জেলিনা জোলি) কাজে যেত বটে – তবে শিশুপুত্রের জন্য তার অবসর বন্দি থাকত। দু’জনে মিলে ছবি দেখতে যেত তারা। আইসক্রিম খেত। কত রং – আনন্দ – খেলা – এরই মধ্যে একদিন হারিয়ে গেল ছেলে। বাড়ি থেকেই। ঠিক ছিল, সেদিন মায়ে-ছেলেতে সিনেমা দেখতে যাবে – শেষ মুহূর্তে কাজ থেকে ডাক আসে মায়ের। পুত্র বিষণ্ণ বসে থাকে একা ঘরে। ক্যামেরা রোল করে! তারপর আর পাওয়া যায়নি তাকে ।
এরপর আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটতে থাকে। একলা মায়ের বিপরীতে অস্ত্র তোলে এবং দেওয়াল হয়ে ওঠে রাষ্ট্রযন্ত্র। কাজ থেকে, বাড়ি থেকে সেই মায়ের ঠাঁই হয় পাগলাগারদে। সে আর এক কঠিন আখড়া – যে সব মেয়েরা প্রশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করতে বাধ্য হতো – তাদের নির্বিচারে কয়েদ করে দেওয়া হত পাগলাগারদে। সে দেশে তখন জীবিকার স্বাধীনতা ছিল বটে – কিন্তু আদতে সেখানেও মেয়েরা তখন দ্বিতীয় লিঙ্গ, যাদের ‘প্রতিবাদ’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও রাষ্ট্রের অনুমোদন দরকার হত। তাই রাষ্ট্র তাদের মুখ অব্দি বন্ধ করে দিত এমনভাবে, যাতে মুখ খুললেও মানসিক অসুস্থতার কারণে তাদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া না হয়।
আজ সারা দুনিয়া, আমেরিকাকে ‘ফ্রি কান্ট্রি’ নামে ডাক দেয় – কিন্তু সে দেশেই মাত্র একশো বছর আগেও যেভাবে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে মেয়েদের কণ্ঠ রোধ করে রাখা হত – তাকে ফ্যাসিজম বলে। আজও কিন্তু নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগের ভুরি ভুরি নজির মেলে মার্কিন পুলিশের বিরুদ্ধে। সবারই মনে আছে বছর খানেক আগেই জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিস বিনা বিচারে মেরে ফেলে এবং উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বিশ্ব। সামাজ্যবাদের এ এক অভিশাপ! তাই সেই অহমিকায় পুলিশের কাছে বেশ্যা নিজের উপার্জন দাবি করলে তাকে জেলে যেতে হয়। এবং পাগলা গারদের অন্ধকার তার জন্যে অপেক্ষা করে। এক্ষেত্রে মেয়েরা অপেক্ষাকৃত দুর্ভাগ্যের অধিকারী। পুরুষদের অন্তত এই কারণে মানসিক অসুস্থতার তকমা মিলতো না।
ক্রিস্টিন কলিন্সকে প্রথমে যে শিশুটিকে এনে দেওয়া হয় তার পুত্র বলে, সে আদপেই তার ছেলে নয়। মায়ের নজর ফাঁকি দেওয়া কঠিন ! ক্রিস্টিন স্বীকার করে না তাই। শত অত্যাচারেও সে অটল- এ তার সন্তান নয়। পুলিশ নিজেদের হার মেনে নেওয়ার পাত্র নয় – ওদিকে মায়ের হৃদয় মরিয়া। এই সময় এক বিকৃতমনস্ক খুনি ধরা পড়ে। সে বেশ কয়েকটি কিশোরকে হত্যা করেছে তার খামারবাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে। ফাঁসির আগের মুহূর্তে সে আশা দিয়ে যায় কাতর মাকে, কিন্তু সন্ধান দেয় না। বছর কাটতে থাকে – পাল্টাতে থাকে দিন। প্রবল প্রতাপশালী মার্কিন পুলিশবাহিনী ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয় ! প্রমাণিত হয় – সৎ লড়াইয়ের কোনও বিকল্প নেই। হতে পারে না। পরিণাম যাই হোক – লড়ে যাওয়াই আসল কথা। স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা অর্জন করাই বেঁচে থাকার মুকুট। সেই মুকুটের সবচেয়ে বড় মণিটিই হল – আশা!
জীবন নিজের নিয়মে মোহনার দিকে পাড়ি দিতে থাকে – কিছুই অপেক্ষা করে না! শুধু মা – একমাত্র মায়ের প্রতীক্ষার শেষ নেই। সে আশা নিয়ে বাঁচে – সন্তানমুখ দেখার আশা। গল্প শেষ হয় না – ছবি শেষ হয় – আমাদের গল্পেও কোথাও কোথাও সেই অপেক্ষারতার ছায়া ভেসে থাকে! আর ‘হোপ’ শব্দের হাত ধরে আমরা আয়ুর নদীতে জল কাটাতে থাকি…