সিনেমা যখন কবিতা । পর্ব ২
ছবির নাম । মাই হ্যাপি ফ্যামিলি
দেশ । জর্জিয়া/জার্মানি
অভিনয় । লা সুগ্লিয়াভিলি, মেরাব নিনিডজা, ব্রেটা কেপাভা
পঞ্চাশ বছরের মানানা যখন পরিবার ছেড়ে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, আত্মীয়-পরিজনেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মানানার বাহাত্তুরে মা, যিনি সকাল থেকে মেয়েকে খিটখিট করতে শুরু করেন এবং নিত্যনতুন রান্নার ফরমাশ করেন – তিনি ছোট পুত্রকে ডেকে পাঠাতে চাইলেন। মানানার স্বামী, তারই জন্মদিন উপলক্ষে, কাজের দিন একগাদা বন্ধু-আত্মীয়দের ডিনারে ডেকে বসে এবং তাকে দিয়েই রান্না করায়, সে ভাবতেও পারে না – কী কারণে বউ বাড়ি ছাড়ছে। পুত্র-কন্যা-পুত্রবধূ পায়ের ওপর পা তুলে হুকুম করে অভ্যস্থ – শিক্ষয়িত্রী মা, হাড়ভাঙা খাটনির পর সে সব তামিল করে – তারাও বুঝতে পারে না কিছুই। এমন সুখের সংসার ছেড়ে, মধ্য বয়েসী নারী বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে কেন তাহলে?
পুরো পরিবার দফায় দফায় হাজির হয় মানানার ঘরে। মা ডেকে পাঠান ছেলেকে। মেয়ের প্রতিটি সিদ্ধান্তকে ছেলের ও জামাইয়ের কাছ থেকে শিলমোহর ছাপ দিইয়ে নেওয়াটা তাঁর দীর্ঘকালের অভ্যাস! এক্ষেতেও তাই ভাইয়ের ডাক পড়ে – দিদিকে বোঝাতে সে ছুটে আসে। কাজের জায়গায় দেখা করে – এবং হতাশ হয়ে শেষ অব্দি মানানার নতুন আস্তানার পাড়ার ছেলেদের জানিয়ে রাখে, একা মেয়ে থাকছে – একটু যেন দেখেশুনে রাখে তারা। এসবের পরোয়া না করে মানানা সাজিয়ে নেয় তার বাসা। ব্যালকনি, ছোট্ট বেডরুমের ফ্ল্যাট। সারাদিন হাওয়া বয় এলোমেলো – বিকেলে ফিরে মানানা নিজের মুখোমুখি বসে। বেড়াতে যায় ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে। গালগল্পের মধ্যে দিয়ে এমন এক সত্যি তার সামনে এসে দাঁড়ায় – যা জীবনের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে এক মুহুর্তে! মানানা কী করে এবার ? কিভাবে সে এতোদিনের দাম্পত্যকে শেষ হয়ে যেতে দেখে? – হেঁটে ফেরে। ডেসার্ট খায় ডিনারের আগে। রান্নাঘরে ঢোকে , পড়াশুনো নিয়ে বসে, কফির পট রেডি করে, ভারহীন সময় বয়ে যায় তার নিজস্ব ফ্ল্যাটটিতে – এরই ভেতর, মেঘ কেটে যায়। সে বোঝে, আর তার শোক নেই – যে সম্পর্ককে সে ইতিমধ্যেই ‘ডিসওনড’ করে দিয়েছে – তার থেকে আসা আঘাতও একই সঙ্গে অভিঘাত হারিয়েছে। এবং এই-ই তার প্রকৃত মুক্তি। এটাকেই আসলে ‘স্বাধীনতা’ বলে। সম্পর্ক যখন দাবি-দাওয়ার শেকলে হাত-পা বেঁধে রাখে ও বাধ্যতামূলক উদযাপনে সামিল করতে থাকে – তখন ধীরে ধীরে স্বতঃস্বফূর্ততা হারিয়ে সেই সম্পর্ক অন্ধকূপে ঢুকে পরে । শ্বাস রোধ হয়ে আসে। অধিকাংশ মেয়ে সেই অন্ধকারে মুখ গুঁজে দিন যাপন করে।
মানানার মতো সাহস হয় আর ক’জনের! আগের বাড়িতে আকাশ দেখা যেত না – রাতে, আঁধারের বারান্দায় সে কেবল ক্লান্ত মুখ লুকোতে দাঁড়াত – এখন তার ঘরের ব্যালকনিতে ঝড়ের মতো বাতাস বয় – সেই শব্দ শুনতে শুনতে শান্তির ঘুম আসে মানানার – ‘হাওয়া বয় শনশন তারারা কাঁপে’। আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কাজ করতে শুরু করি – প্রদীপের সলতে পাকাতে থাকে কেউ, কেউ ভাবে শিকলের বন্ধনে সুখ মিলে যাবে একদিন, অন্তত নিরাপত্তাটুকু পাওয়া যাবে – আমাদের সব্বারই যে বড় সুখের সংসার !