সিনেমা যখন কবিতা । পর্ব ৩
ছবির নাম । পেঙ্গুইন ব্লুম
পরিচালক । গ্লেন্ডিং আইভিং
অভিনয় । নাওমি ওয়াটস, আন্ড্রু লিঙ্কন, রেচেল হাউস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তালগাছ’ কবিতার কথা মনে পড়ে, আমার ছবিটা দেখে। আকাশপাড়ে উড়ে যাওয়ার ডানা মুড়ে রাখতে বাধ্য হয় যারা, ‘পেঙ্গুইন ব্লুম’ তাদের ছবি। সাম,মধ্য তিরিশের তরুণী, স্বামী-পুত্রদের সঙ্গে থাইল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছিল। সেই প্রমোদ ভ্রমণ, শেষ পর্যন্ত সুখকর হয় নি। ব্যালকনি থেকে নীচে পড়ে যায় সে। আকস্মিক সেই দুর্ঘটনায় হাঁটার ক্ষমতা হারায় সাম। হুইল চেয়ারে বন্দী হয়ে যায় তার দিন – যাপন । মেয়ে, হারিয়ে ফেলে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার তাদের বাড়িটি সাগর পারে। এবং সেই ছবির মতো বাংলো থেকেই সাম সটান সমুদ্রে নেমে পড়তো সার্ফ করতে। নামকরা সি-সার্ফার সে। থাইল্যান্ড থেকে ফেরার পর, সবকিছতেই তালা পরে যায়। সারাদিন জলের গর্জন শুনে, কান্না চাপে সাম। এর মধ্যেই ঘরে আসে এক ম্যাগপাই পাখির ছানা। ছেলেরা সাগর পাড়ে খেলতে গিয়ে সেই আহত শিশু-পাখিকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। নাম রাখে ‘পেঙ্গুইন’। সাম পছন্দ করে নি, তার মতোই ডানা-ক্ষত নিয়ে থাকা পাখিটিকে। তবে ধীরে ধীরে, তারা একাত্ম হয়ে ওঠে। পাখির কিচির-মিচির থেকে ঝরতে থাকে আনন্দ। ইচ্ছেরা ফুটে ওঠে আবার ! আসলে ইচ্ছের তো মৃত্যু হয় নি। হয়ও না কক্ষনও ! সে কথা নতুন করে বোঝে বিষণ্ণ নারীটি।
সামের বাড়িতে, ‘পেঙ্গুইন’ নামের ম্যাগপাই পাখি সুস্থ হতে থাকে। সমবেত দানা-পানি-আদর থেকে ডানায় জোর বাড়ে তার। শক্তি বাড়ে তার। সেই পেঙ্গুইন আকাশ পায় আবার । অথর্ব সামের সামনে ফের খুলে যায় জলের বারান্দা। কায়াকিং শিখতে শুরু করে সে। হুইল-চেয়ারের বন্ধন ঘুচিয়ে সে ঝাঁপ খায় প্রিয় সাগরে। পুত্ররা ফিরে পায় মাকে। স্বামীর কাছে আবার সে ফিসফিসিয়ে ভালবাসার গল্প করে। মায়ের সঙ্গে বাদানুবাদের দিন শেষে, জড়িয়ে ধরে ছোট মেয়ের মতো। বোনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে হই হই করে। বিষাদের ঝারোখা সরিয়ে বাইরে আসে তার পুরনো হাসি- উচ্ছ্বলতা। এর মধ্যেই ঘটে যায় – আর একটি জীবন বদল করা ঘটনা। সাম বুঝতে পারে, জীবনের এগিয়ে চলাতেই তাল মেলানো দরকার সবচেয়ে বেশি। রবি ঠাকুরের সেই ‘একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ’ যেভাবে হাওয়া থেমে গেলে, মাটির দিকে মনোযোগ ফিরে পায়, সেই ভাবেই সাম খুঁজে পায় জীবন যাপনে আস্থা রাখার বিশ্বাস। নিমগ্নতার আনন্দ তাকে পুনরায় সমুদ্রের কাছে নিয়ে যায়। আকাশ বেয়ে ফিরে আসে পেঙ্গুইন নামের পাখি। জলে নামে মেয়েটি। আকাশ-জলের মাঝের সেতুতে তাদের শান্তির সহাবস্থান নির্মাণ করে জীবন। আসলে তারা সব পারে। সব । ইচ্ছে এবং আত্মবিশ্বাসের পাখায় তো উদযাপনের অক্ষর। ফিরে পাওয়ার স্বাক্ষর।