ছো ট গ ল্প । ২
ধ্রুব মুখোপাধ্যায় কবিতার সাথে সাথে লেখেন গল্পও। বাংলা ও ইংরাজী দুই ভাষাতেই লিখে থাকেন তিনি। সম্প্রতি ‘বিভা প্রকাশনী’ থেকে বই আকারে প্রকাশ হয়েছে তাঁর প্রথম ইংরাজী উপন্যাস। এই সংখ্যায় রইল তাঁর একটি ছোট গল্প। প্রতি সংখ্যায় আমরা হাজির করব এমন কাউকে যিনি কবিতার সাথে সাথে লেখেন গল্পও। ধ্রুবকে ধন্যবাদ তাঁর গল্পের জন্য।
স্কুলটা একদম পছন্দ হয়নি দেবযানীর। প্রেয়ারের জন্য একটা আলাদা হল পর্যন্ত নেই! সামনে একটা বারান্দায় তিনজন ছাত্র, তিনজন স্যার, আর তার সামনে কাদা-ঘাসে ভর্তি বিশাল একটা মাঠ, সেখানেই চারটে লাইনে সব ছাত্র-ছাত্রী। হাত জোড় করে প্রথমে “আগুনের পরশ মনি” আর তারপর জাতীয় সঙ্গীত। প্রেয়ারের লাইনে দেবযানী যেন অন্য গ্রহের কেউ। সবাই কেমন একটা হাঁ করে তাকিয়ে। অস্বস্তির চোটে মাঝে মাঝেই চোখে চোখ রাখলে, না দেখার ভান করছিল বাকিরা।
দেবযানী, দেবাঞ্জন গাঙ্গুলীর একমাত্র মেয়ে। এই গ্রামে গাঙ্গুলীরা সব বংশ পরম্পরায় ডাক্তার। তবে ডাক্তার হলেও কেউ গ্রাম ছাড়ে নি। শহরে চেম্বার থাকলেও আগে গ্রামের লোকেদের চিকিৎসা। তাই খাতিরটাও অন্যরকম। কিন্তু দেবযানীর মা কোনোদিনও চাননি, মেয়ে গ্রামেথেকে পড়ুক। তাই সেই ছেলেবেলা থেকেই দার্জিলিঙের সেন্ট পলস। কিন্তু গত বছর, মানে ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকে কীসব যেন ঘতে চলেছে। রোগ, ঘুমের প্রবলেম, মানসিক অবসাদ এবং সবশেষে বাজে রেজাল্ট। ডাঃ দেবাঞ্জন বেশ বুঝেছিলেন, মেয়েকে কাছে না নিয়ে এলে বিপদ ঘটে যেতে পারে। তাই ক্লাস এইটে ভর্তি করলেন এই গ্রামের স্কুলে।
প্রেয়ার শেষে দোতালায় ঘণ্টা ঘরের সামনেই ক্লাস এইট। ক্লাসরুম যে এরকমও হতে পারে, দেবযানী প্রথমে ভাবতেই পারেনি। চুন রং করা দেওয়াল, তার উপর পেনসিলে ব্যাঙের হৃদপিণ্ড, অঙ্কের নানা উপপাদ্য এককথায় সম্ভাব্য যাবতীয় প্রশ্নের সাংকেতিক উত্তরময় একখানা ঘর, যার উপরে দুটো ফ্যান আর নীচে সারি করে পাতা বেঞ্চ। একটা বেঞ্চেপাঁচজন, তার উপর আবার ব্যাগ রাখারও আলাদা কোনও জায়গা নেই। বেঞ্চ গুলোও যেন খাতা শেষ হওয়া কোনও সাইন্টিস্টের। এসব আবিষ্কার করতে করতেই একজন ধুতি পরা স্যার এলে, সিলিং ফ্যানের হাওয়ার থেকে আওয়াজটা যেন বেশী হয়ে গেল। রোল কলের সময় দেবযানী ভালো করে মনে মনে গুছিয়ে নিল নিজের ইন্ট্রোডাক্সনটা। কিন্তু সে সুযোগ পেলে তো! স্যার নিজেই দেবযানীর কাছে এসে বলে দিলেন “এ দেবযানী গাঙ্গুলী, আজ থেকে তোমাদের বন্ধু। দার্জিলিঙের সেন্ট পলসে– পড়ত। তোমরা সুযোগ বুঝে ওর সাথে আলাপ করে নিও। “সেন্ট পলস” শব্দটা শোনার পর “বন্ধু” শব্দটার পরে যেন একটা বিস্ময় সূচক চিহ্ন বসে পড়ল।সেদিন টিফিনে দার্জিলিং, সেন্ট পলস, মিশনারি, ক্রিশ্চান এসব বোঝাতে বোঝাতে দেবযানী বেশ বুঝেছিল এই স্কুলের অলিখিত ফার্স্ট গার্ল সেই-ই।
গাঙ্গুলীদের মেয়ে, আর তার উপর একটা অন্য সিলেবাসে অভিজ্ঞ,তাই স্যারেরাও বেশ স্নেহ করেন; যদিও নেহাত অন্যের স্নেহতে নিজেকে প্রমান করা ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে দেবযানী নয়! কিন্তু এখানে কেউই যেন ফার্স্ট হতে চায়না! ভালো নাম্বার পেলেই সবাই যেন খুশি!এই করেই একটা বছর কেটে গেল এবং যথারীতি মার্কশসিটে টোটালে চার নাম্বার কম – ফার্স্ট। রেজাল্টের দিন মার্কশসিটটা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসতেই সুমন এলোঃ “এই দ্যাখ আমি সেকেন্ড হয়েছি।“ নব্বই নাম্বার কম পেলেও যেন পরিতৃপ্ত। ঝলমলে হাসিমুখে সুমনের কাছে সেকেন্ডটাই যেন ফার্স্ট। তবুও নিজেকে প্রমান করা ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে দেবযানী নয়। তাই কম পাওয়া চার নম্বরটাকে একটা পরাজয়ের বাক্সে ভরে একটু বেজার মুখেই বললঃ “টোটালের থেকে চুরানব্বই কম যে!” “ফার্স্ট ডিভিশন এটা; কম কি!” হাসতে হাসতে মনের খুশিটাকে আর একটু বাড়িয়ে নিল সুমন।
সুমন ফার্স্ট হতে না চাইলেও শিখতে চায়, জানতে চায়; ইতিহাস খুব ভালবাসে। দেবযানী আবার অঙ্ক ছাড়া কিছুই বোঝেনা – নম্বর, ফার্স্ট আর একশোয় একশো; তাই সুমনের থেকে সময় পেলেই ইতিহাসের নানা জিনিস শোনে। ছেলে বন্ধুদের অনেককে হারালেও সুমন দেবযানীকে ক্লাসের বাইরে একটু সময় দিতে ভালোই বাসে! কিন্তু ইদানিং অঙ্ক ইতিহাস কিছুতেই যেন মন নেই দেবযানীর। সুমন রসিয়ে ইতিহাসের গল্প বললেও দেবযানী মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করেঃ “পার্থদাকে স্কুলের স্যারেরা বকেন না?” সুমন অনেকবার বলেছে “কেন বকবেন? ও আছে বলেই তো আমরা এতো বারের ইন্টারস্কুল ফুটবলের চ্যম্পিয়ান।“
পার্থ স্কুলের এক নম্বর ডানপিটে, বখাটে, বেয়াদপ হলেও কেউ কিছু বলেনা, এমনকি স্যারেরাও পার্থকে স্নেহও করে এবং সেটা যেন দেবযানীর থেকেও বেশী– ভাবলেই কেমন একটা রাগ হয় দেবযানীর। ফুটবল ম্যাচের আগে টিমের সবাই ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে স্যারেদের প্রণাম করে। সেদিনই প্রথম চোখাচুখি হয়েছিল দেবযানীর সাথে। প্রথমে দেবযানীর চোখে চোখ রেখে একটা নিষ্পাপ হাসি হাসল পার্থ। দেবযানীও বিনিময়ে হাসতে গেলে,পার্থ মুখটা গোমরা করে এমন ভাবেবিকৃত করল যে দেবযানী লজ্জায় মুখ লুকাবার জায়গা পর্যন্ত পেলনা! তারপর বাইরে বেরিয়ে বলটাকে আঙ্গুলের উপর ঘোরাতে ঘোরাতেহুস করে একবার ভ্রুটাকে উপরে তুলে নামিয়ে নিল। দেবযানী আর রিস্ক নেয়নি; চুপচাপ চোখটা সরিয়ে নিয়েছিল। এরপর অনেকবার এসেছে পার্থ। চোখের দিকে না তাকালেও, ফুটবলের জার্সিতে, মেদহীন হাত আর পায়ের পেশীগুলোঅবাক হয়ে দেখেছে দেবযানী।
সুমনের কাছে পার্থর ব্যাপারে যতই জেনেছে ততই একটা অদ্ভুত রাগ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তিন বছর ধরে পার্থ এই স্কুলেই হায়ার সেকেন্ডারি দিচ্ছে, শুধু স্কুলের জার্সিতে ফুটবল খেলবে বলে। – পাগল নাকি! ছেলেটা নাকি ভীষণ ফাজিল। এই তো সেদিন সুমন আর দেবযানীকে ডেকেছিল, বলে “বলোতো অরুণাচলের উলটোদিকের শহরের নাম?” সুমন অনেক ভেবেচিন্তেও যখন কিছু বলতে পারলনা, তখন হাসতে হাসতে বলল ”এটাও পারলে না!… অরুনাথাক”। “এই নামে তো কোনও শহর আমি শুনিনি!” দেবযানী বললে পার্থ গলাটা একটু গম্ভীর করে বলেছিলঃ “তাহলে ওই ভূগোলের প্রদীপ বাবু কে জিজ্ঞেস করো।“ দেবযানী জিজ্ঞেসও করবে ভেবেছিল কিন্তু সে যাত্রায় সুমন বাঁচিয়ে দিয়েছিল – “এসবই ফাজলামি রে!” তবে নিজেকে প্রমান করা ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে দেবযানী নয়! তাই ঘুরে গিয়ে বলেছিলঃ “ওটা অরুনা থাক নয়, অরুনা দাঁড়া হবে!”
এভাবেই ‘মালদার পাশের শহর মালদিদি’, বাগমারী আর বাগনানের মধ্যে সম্পর্ক বের করতে করতে ওদের দুজনের মধ্যে কখন যে একটা সফট কর্নার গড়ে উঠেছিল নিজেরাও বোঝেনি। কিন্তু সম্পর্কটা কক্ষনও ঝাপটের ঢাল, পিচকুড়ির ঢালের পর নোয়াদার ঢালের মত সিরিয়াস হয়নি। দেবযানী বরাবর ফার্স্ট হতে চেয়েছিল আর পার্থর উদ্দেশ্য ছিল ফেল – ফুটবল। এরকমও হয় নাকি! মাঝে মাঝেই অবাক লাগতো দেবযানীর আর তারপরেই সেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। স্যারেদের স্নেহটা কি এতই সস্তা!বেশ কয়েকবার বলেছে পার্থকেঃ “তোমার ভালো লাগে এভাবে একই ক্লাসে থাকতে।“ “না! তবে দারুন লাগে স্কুলের হয়ে ট্রফিটা হাতে তুলতে!” পার্থ অবলীলায় বলে দিলে রাগটা যেন আরও বেড়ে যেত দেবযানীর, তবে আর কথা বাড়াত না।
এখন ওরা দুজনেই ক্লাস টুয়েলভ। তবে সুমন আর সেভাবে মেশে না –ইতিহাসকে ইতিহাস করে দিয়ে সুমনেরও এখন সাইন্স। পার্থর সাথে এক ক্লাসে পড়াটা যেন মেনে নিতে পারছিলনা দেবযানী। তাই চাপা রাগটা বাড়তে বাড়তে একদিন বেরিয়েই গেল। “তুমি জানো তুমি একটা অসভ্য জানোয়ার। ফেল করে ফুটবল খেলাটার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই! ইচ্ছে করে কেউ ফেল করে নাকি? আমিতো বাপু কাওকে শুনিনি। আমি মরে গেলেও পারব না।“
পার্থও বেশ বিরক্ত হয়েছিল সেদিন। “আমি যা ইচ্ছে তাই করব, তুমি বলার কে?” কথা গুলো বলতে গিয়েও বলল না। বরঞ্চ একটা হাসি মুখে লাগিয়ে বলল “সবাই কি সব পারে! শোনো, একটা ফ্রি জ্ঞান দিই,তুমি চেষ্টা না করে, হিংসা করো। কেন না তোমার দ্বারা হবে না।“ রাগে মুখটা তখন লাল দেবযানীর।হয়তো এটারজন্যই পার্থ এতদিন ছিল এক ক্লাসে; দেবযানীর চেষ্টা আর হিংসার মাঝের হিসাবটা মিলিয়ে দিতে।