বি শে ষ র চ না । পর্ব ৪
নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় থেকে তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের ফরাসী ও মার্কিনি বিশিষ্ট মহিলা কবিদের এক গুচ্ছ জানা অজানা কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছেন বর্তমানে কর্মসূত্রে ফ্রান্স নিবাসী ম্যাডিকেল আল্ট্রাসাউণ্ডের তরুণ বিজ্ঞানী…
“এম-এল-এফ” আন্দোলন, “লূ টর্চোঁ ব্রুল” পত্রিকা এবং তার কবিতা—
১৯৭০-১৯৭৫ খৃষ্টাব্দ ফরাসী নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৬৮ সালে ঘটে যাওয়া ফরাসি ইতিহাসের বৃহত্তম ছাত্র ও কর্মী হরতালের ঘটনা ও প্রায় একই সময়ে গড়ে ওঠা মার্কিন নারীবাদী আন্দোলনের উত্তরসূরি এই সময় একাধিক নারীবাদী মতাদর্শের আঁতুড় ঘর।
MLF (এম-এল-এফ) বা “Mouvement de libération des femmes” এমনই এক নাম।
২৬ আগস্ট, ১৯৭০ সালে ক্যাথি বার্ণহাইম, খ্রিস্টিন ডেলফিন, মনিক উইট্টিজ, খ্রিস্টিয়েন রশফোর্ট এবং নমস্কার শক্তিনি-র নেতৃত্বে প্রায় বারোজন মহিলা রাজনৈতিক কর্মী কিছু ব্যানার হাতে প্যারিসে “প্লাস দূ ল’এটয়েল”-এ এক নারীবাদী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। ব্যানারগুলোর কিছু কথা যেমন “That one man out of two is a woman” কিম্বা “There is even more unknown than the unknown soldier, his wife” ফরাসী নারীবাদের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। সমস্ত বিক্ষোভকারীকেই সেদিনই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন, সংবাদ মাধ্যম এই আন্দোলনের সমর্থনে বিবৃতি দেয় এবং নারীবাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সুত্রপাত ঘটে। তারই নামকরণ হয় ‘এম-এল-এফ’। এম-এল-এফ কর্মপদ্ধতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা আদর্শের থেকে বিচ্ছিন্নতা । দলের কর্মীরা ছোটো ছোটো স্বাধীন দলে ভাগ হয়ে শহর জুড়ে কাজ করতেন। “দা প্রাইভেট ইজ পলিটিকাল” বা “যা ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক” এই উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের শুরুর দিকে মূল শক্তি ছিলেন ১৩-১৭ বছরের অন্তঃসত্ত্বা যুবতীরা। পরবর্তী সময়ে যৌন-স্বাধীনতা-আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার কারণে এম-এল-এফ মুভমেন্টের প্রধান কার্যাবলীর বিষয় তালিকার মধ্যে :
এম-এল-এফের কাজের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হওয়ার পর সিমন দ্য বাভোয়া নিজে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ১৯৭২ সালে সিমন “Manifeste de 343” নথিতে সর্বসম্মুখে তাঁর স্বেচ্ছাকৃত গর্ভপাতের কথা উন্মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেন। এমনও বলা হয়ে থাকে যে হালফিলের #metoo আন্দোলন এম-এল-এফ মুভমেন্টেরই উত্তরসূরি।
এম-এল-এফ এর এক সাধারণ অধিবেশনে জন্ম নেয় সে সময়ের এক বিখ্যাত নারীবাদী ছোটো পত্রিকা, যার নাম “লূ টর্চঁ ব্রূল (Le Torchon Brule)” [অর্থঃ ন্যাকড়াটা জ্বলছে]। এই পত্রিকার কার্যকরী কমিটির প্রধান সদস্যা ছিলেন মারি দেদিউ (আলোকচিত্রী), জুলিয়েট কাহান, মারিয়েল বুর্কহাল্টার, নাদিয়া রিঙ্গার্ট, এবংসিল্ভিনা বয়েসসোন্নাস-এর মতো বিশিষ্ট এম-এল-এফ কর্মীরা।
১৯৭0 সালে প্রকাশিত কাগজের “শূন্য” সংখ্যার প্রচ্ছদ। ( https://www.franceculture.fr/ )
এই পত্রিকার “শূন্য”তম সংখ্যা “L’Idiot Liberté” খবরের কাগজের সম্পূরক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়। প্রত্যেকটি লেখার নীচে “—” আকারের একটি লাইন দেওয়া হয়েছিল যাতে যে কেউ চাইলেই কোনো একটি লেখাকে নিজের মত করে কেটে নিজের ব্যক্তিগত পুস্তিকার অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারেন। Le Torchon Brule-এর প্রথম স্বতন্ত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের বসন্তে। দাম ছিল ১ ফ্র্যাংক। ১৬ পাতার এই কাগজের ৩৫০০০ কপি বিক্রি হয়। এই কাগজ প্রকাশের কোনো নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক বাধ্যবাধকতা না থাকায় সম্পাদকমণ্ডলী এই কাগজকে “মেন্সট্রুয়াল” বলেই প্রচার করতেন। তাদের নিজেদেরই কথায় এই কাগজ ছিল “menstrual, not monthly journal”। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে Le Torchon Brule পত্রিকার ৬ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ পঞ্চম সংখ্যা (প্রথমটি “শূন্য” সংখ্যা) এবং সম্পূরক কাগজ হিসাবে প্রকাশিত বিশেষ “মাতৃ দিবস” সংখ্যার সাথে “Le Torchon Brule”-এর উজ্জ্বল যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে।
কবিতা, প্রবন্ধ, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, কার্টুন, ছবি, চিত্রকল্প ইত্যাদি সবকিছুই এই কাগজে জায়গা করে নেয়। এই পত্রিকায় যেমন ফরাসী নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বটবৃক্ষের মত নামেরা নিয়মিত লিখতেন, ঠিক তেমনই নিজের মতো করেই জায়গা করে নেন ফ্রান্সের প্রত্যন্ত গ্রামের অজানা অচেনা অনামী-রাও । যার লেখাই ছাপা হয়ে থাকুক, বেশিরভাগ প্রকাশিত লেখাগুলির ক্ষেত্রেই লেখিকা/লেখকদের নাম থাকতো না।
“নারী শহরের সম্পদ” ধারাবাহিকের বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত হল “Le Torchon Brule” পত্রিকায় প্রকাশিত “শূন্য”, প্রথম ও শেষ তথা পঞ্চম সংখ্যায় প্রকাশিত এমনই অনামী জনের তিনটি কবিতা। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে এই ধরণের কাজ সম্ভবত এই প্রথম। যেমন বলা হল, এই কবিতাগুলি কাদের লেখা তা আমরা জানি না, জানার উপায়ও বোধহয় এখন আর নেই।
কবিতা নির্বাচন, মূল কবিতাগুলির ফরাসী থেকে বাংলায় অনুবাদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনুবাদক, তাঁর দুই সহযোগী, ব্রিটেনবাসী অধ্যাপক নিনা পারিশ (Nina Parish, Professor of Literature and Languages, University of Stirling) ও অধ্যাপক সান্ড্রা ডারোকজি (Sandra Daroczi, Lecturer of Politics, Languages & International Studies, University of Bath) এর থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নারী-স্বাধীনতার এই ইতিহাসের মূল্য অপরিসীম।
নঃ ০, পৃঃ ১৮
শ্রেণী নিরেটদের সাথে
আর গেছো মহিলাদের সাথে
আর ছোট্ট মেয়েদের সাথে যারা ভীষণ ভাল
আর মোমের পুতুলদের
আর নারীসুলভ নারী ও শিশুসুলভ মেয়েদের সাথে
আর আমাজন ও নারী-যোদ্ধাদের
আর অযোগ্য মায়েদের ও সর্বনেশে মেয়েদের
আর জাদুকরী ও মডেলদের সাথে
এই ধুলিধূসরিত নাট্যশালায়
যেখানে আমি আহ্বান জানাই তুমি নিজেকে চেনো
তুমি
আমি তোমার সাথে থাকতে চাই
ব্যস ওটুকুই
আর যথেষ্ট হয়েছে
আর-যথেষ্ট-বলা-হয়েছে যে জুলি সেই তিমিকে ব্যভিচারী মনে করে
ঈশ্বরের দিব্যি যথেষ্ট হয়েছে আমায় নিঃশ্বাস নিতে দাও
গানটায় যেমন বলা আছে
আমার সম্মুখে আমারই অচেনা প্রতিবিম্বের দিকে
তাকিয়ে দেখতে দাও, আমায় কেমন তোমার মতো দেখায়!
নঃ ১, পৃঃ ১২
নীল রাতে গোলাপী টুপি
আমি আমার মাষ্টারমশাইয়ের দিকে হেঁটে যাই
হাতের ডগায় স্কুলের ঝোলা
ভারী
শেখার মতো জ্ঞান
আমার মাষ্টারমশাইয়ের কাছে আমার আঙুলের ডগাগুলোর দিয়ে
পড়া উগরে দেব বলে
নীল রাতে গোলাপী জামা
আমি আমার মাষ্টারমশাইয়ের দিকে হেঁটে যাই
ওর হাতের
দিকে এগোনো নরম রেশম
ভারী
শেখার মতো জ্ঞান
আমার মাষ্টারমশাইয়ের কাছে আমার আঙুলের ডগাগুলোর দিয়ে
পড়া উগরে দেব বলে
কালো রাতে লাল হৃদয়
আমি আমার স্কুলমাষ্টারের দিকে হেঁটে যাই
তার অসংখ্য তুচ্ছ অস্ত্রের
বিরুদ্ধে
আমার নগ্ন হাত এবং আমার বোনেদের রক্ষা করতে
আমি আমার মাষ্টারমশাইকে হত্যা করতে চলেছি
নঃ ৫, পৃঃ ২১
একজন নারী, তার তো সবজি হওয়ার কথা!
একজন নারী চটকদার, চকমকে, জমাট,
উদীয়মান নারী, পুঞ্জীভূত নারী, আবদ্ধ নারী;
ওরা আছেন যাদের আমরা মজুত করে রাখি
তারা যারা আমাদের হাতে স্তুপাকৃত
তারা যাদের আমরা কবর দিয়ে রাখি
একজন নারী, তার তো সবজি হওয়ার কথা!
দুর্গন্ধী ধনী তাকে একটা চারাঘরে রাখে, দালালটা ওকে একটা ভস্মাধারের মত ব্যবহার করে।
নবমুকুল পেড়ে ফেলা হয়, ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যায়,
আমরা ওকে তাজা রাখি, রক্তটা বিযুক্ত…
নিস্তব্ধতার জন্য কেউ আছেনঃ একজন নারীকে স্থির থাকতেই হবে।
দুঃখের জন্য আছেন কেউ কেউঃ বৈধ ধ্বংসাবসশেষে এক নারী।
কেউ আছেন আরামের উদ্দেশ্যেঃ বিনামূল্য উপহারের মত এক ত্রুটিহীন নারী।
একজন নারী, তার তো সবজি হওয়ার কথা!
আরোগ্যের জন্য প্রণীত তাবিজের মতো নারী,
আবরিত নারী, প্রতারিত নারী, ধর্ষিতা নারী, নারীর অনুপস্থিতি।
একত্রিতের জমি থেকে অলৌকিকভাবে নিষ্কাশিত নারী,
নারী উপহ্রদ, নারী জলাভূমি, নারী পাঁক,
নারী গাছ, ঝুলে পড়া মৌসুমী নারী, ব্যয়িত অলংকৃত নারী, নিমজ্জিত নারী
রূপক বর্ধন রায়
অনুবাদক
GE Heathcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত, ফ্রান্স-এর নীস শহরে থাকেন। টার্কি-র সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্ত্রাস্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভারসিটি ও পি এইচ ডির পর বছর খানেক জার্মানির ফ্রনহফার সোসাইটিতে সায়েনটিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। লেখালেখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ট্রাভেলগ, সাহিত্য মনন নিয়েই। কলেজজীবনে বন্ধুরা মিলে “দেওয়াল” নামক কবিতা পত্রিকা চালিয়েছেন কয়েক বছর। এছাড়াও কবিতা, গদ্য প্রকাশ পেয়েছে একাধিক বাঙলা অনলাইন পত্র পত্রিকায়। লেখা লেখি ছাড়াও গান বাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে রূপকের সমান আগ্রহ রয়েছে।