Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৫

স ব্য সা চী   স র কা র

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি

sabyasachi

পাকিস্তানে দেওয়ালে পিঠ…

দুরুদুরু একটা বুক নিয়ে করাচি এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম।

জীবনে প্রথমবার পাকিস্তান বলে কথা! সিনিয়র কলিগরা পইপই করে সাবধান করে দিয়েছেন, কোথাও যেন অতি উৎসাহ না দেখাই। কোথাও একটি বাড়তি কথা নয়। ম্যাচ দ্যাখো, কভার করো, হোটেলে ফিরে যাও। সন্ধের পরে একা একা হোটেলের বাইরে নয়!

এসব সাবধানবাণী আমার জীবনে কখনওই খুব একটা কাজে লাগেনি। যতোই আমাকে কোনও কিছু নিয়ে সাবধান করা হয়, তত বেশি সেই জিনিসটার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি। হোটেলে বসে থাকার জন্য এসেছি? করাচির ক্লিফটন বিচ, লাহোর ফোর্ট, এসব তো দেখতেই হবে। লাহোরের বিখ্যাত ফুড কোর্ট গুলবার্গে একবার যাব না?  

ইমরান খানের দেশ, জাভেদ মিয়াঁদাদের দেশ, হানিফ মহম্মদের দেশ! মাথায় আছে, লাহোরে ইমরান খানের জামান পার্কের বাড়িটা দেখে আসতেই হবে। সেটা ১৯৯৭। তখনও কার্গিল যুদ্ধ বলে কোনও শব্দ পৃথিবী শোনেনি, নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারের পেটে প্লেন ঢুকে পড়েনি, সীমান্তে রুটিন গোলাবর্ষণের বাইরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল, নিয়মিত ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হত। তার আগের বছর থেকে কানাডার টরন্টোয় শুরু হয়েছে দু’দেশের মধ্যে  বাৎসরিক সাহারা কাপ। সেখানে কভারও করে এসেছি সিরিজ। 

 দু’দেশের মধ্যে তিন ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। ভারতের ক্যাপ্টেন সচিন তেন্ডুলকর, পাকিস্তানের সইদ আনওয়ার। সিন্ধ প্রদেশের হায়দরাবাদে প্রথম ওয়ান ডে। তারিখটা আজও মনে আছে ২৮ সেপ্টেম্বর। সকালে শুরু হয়ে ম্যাচ নির্বিঘ্নে শেষ হল, বিকেল চারটের মধ্যে। কিন্তু সমস্যাটা শুরু তার পরে।

আমাদের ভারতীয়দের জন্য সে বার যে ভিসা দেওয়া হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, করাচি বা লাহোরে থাকতে কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু সিন্ধ প্রদেশের হায়দরাবাদে সন্ধে ছ’টার পরে থাকা যাবে না। কারণ, স্টেডিয়ামের পাশেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। এটা মাথায় রেখেই কলকাতার খবরের কাগজের অফিসে ম্যাচ রিপোর্ট পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা। করাচির হোটেল থেকে গাড়ি ভাড়া করে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন সাংবাদিক। কলকাতার দু’জন এবং মুম্বইয়ের মরাঠি কাগজের নামী সাংবাদিক পাপ্পু সংসগিরি। ঠিক ছিল, সাড়ে পাঁচটার মধ্যে লেখা শেষ করে গাড়িতে উঠে পড়ব। হায়দরাবাদ থেকে করাচির দূরত্ব গাড়িতে আড়াই ঘণ্টা। যদি কোনও লেখা পরে লিখতেও হয়, করাচিতে পৌঁছে লিখব। সেই প্ল্যানিং অনুযায়ীই চলছিল। কিন্তু সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাদের গাড়িতে সঙ্গী হওয়া কলকাতার ইংরেজি কাগজের এক সাংবাদিকের কপি বা প্রতিবেদন ফ্যাক্স মারফৎ কলকাতার অফিসে পৌঁছে গেলেও লাইন না পাওয়ায় আমার কপি যেতে দেরি হচ্ছিল। মরাঠি কাগজের পাপ্পুও লাইন পাচ্ছিল না। ব্যাপারটা এখনকার মতো নয় যে, যখন খুশি কম্পোজ করে ই-মেলে সেন্ড বাটন টিপলেই কপি নিমেষে কলকাতায় পৌঁছে যাবে। তখনও মোবাইল আসেনি, বহু খরচ করে ইন্টারন্যাশনাল লাইন পেতে হতো। 

তা, আমাদের দু’জনের দেরি হচ্ছে দেখে কলকাতার ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক মশাই ‘আমি পাঁচ মিনিট ওয়েট করব’ বলে নীচে পার্কিংয়ের দিকে চলে যান। আমরা কপি-টপি পাঠিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে পার্কিং লটে পৌঁছে দেখি, গাড়ি নেই। সেই ‘মহান’ সাংবাদিক পাঁচটা চল্লিশ বাজতে না বাজতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। 

তা হলে? কী করে ফিরব? ক্যান্টনমেন্ট এলাকা বলে মাঝে মাঝেই সামনের রাস্তা দিয়ে সেনাবাহিনির গাড়ি চলে যাচ্ছে। জনতার ভিড় কমে আসছে, স্টেডিয়ামের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে আমরা দু’জন। মোবাইল নেই, কাজেই অ্যাপ খুলে আজকের মতো উবার ডেকে নেওয়ার সুযোগ নেই। 

কম বয়স, পেশার জন্য যে কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে পারি, কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? পাকিস্তান বোর্ডের কর্তারাও বারবার ম্যাচের সময় বলে দিয়েছিলেন, ‘ছ’টার আগে হায়দরাবাদ ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন কিন্তু। ভিসা ছাড়া এই এরিয়ায় ধরা পড়লে কপালে দুর্ভোগ আছে।’

আমি ঘামছি। পাপ্পু ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তাকেও চিন্তিত লাগছে। বলল, ‘যে ভাবে হোক, বেরোতে হবে। ক্রিকেট কভার করতে এসে পাকিস্তানি আমির্র হাতে বন্দি হওয়ার চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না! নির্ঘাত গুপ্তচর বলে চালান করে দেবে!’

প্রায় ফাঁকা পার্কিং লট, একটা দুটো গাড়ি তখনও দাঁড়িয়ে। বাকি সব বেরিয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে ছ’টা দশ। ঠিক তখনই একটা গাড়ির দিকে এগোতে দেখলাম এক মাঝবয়সী পাকিস্তানি সাংবাদিককে। আমাদের দু’জনকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা এখনও এখানে? গাড়ি কই?’

ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম আমরা। এক মিনিট সময় লাগল তাঁর। তার পরে এহসান কুরেশি  রীতিমতো আদেশের সুরে বললেন, ‘এখনই চেকিং শুরু হয়ে যাবে। উঠুন। এখনই গাড়িতে উঠুন!’ পাপ্পু আর আমি একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি, বুঝতে পারছি না, কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না। একেবারে অজানা একজন মানুষ, হতে পারেন সাংবাদিক, কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবেন, কী করবেন, কিছুই তো জানা নেই।

এ বার এহসান কুরেসি গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘আপ লোগ মেহমান হ্যায় হামারা! হাম আপকা দুশমন নেহি। আইয়ে!’ মেন রাস্তা দিয়ে না গিয়ে সম্পূর্ণ ঘুরপথে এগোতে লাগল এহসানের গাড়ি। হেসে বললেন, ‘মেন রাস্তায় দুটো চেকপোস্ট আছে। সেখানে চেক করলে আপনারা ধরা পড়ে যাবেন। তাই অন্য রাস্তা! আমি যতক্ষণ স্টিয়ারিংয়ে আছি, আপনারা সেফ!’ 

সরু গলিঘুঁজি আর বিভিন্ন মহল্লা পেরিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল একটা ছিমছাম ছোটখাটো বাড়ির সামনে। গাড়ি পার্কিং করার জন্য দালান আছে, সেখানে এক বৃদ্ধ বসে হুঁকো টানছিলেন। ‘আব্বাজান’ বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন এহসান। বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাদের বসিয়ে পর্দা সরিয়ে ভিতরে গেলেন। 

মিনিট তিনেকের মধ্যে সামনে সালোয়ার কামিজ পরা এক মহিলা, চোখে-মুখে আভিজাত্যের চিহ্ন। এহসানের স্ত্রী নাজমা। তার পরেই বললেন, ‘দাঁড়ান, আপনারা সারা দিন খাননি। একটু অপেক্ষা করুন।’

এ বার পাপ্পু বলল, ‘না না ভাবী, ওসবের দরকার নেই। আমাদের যে ভাবে হোক, করাচি ফিরতে হবে!’

পাশ থেকে হেসে উঠলেন এহসান, ‘সেটা কি আমি জানি না? দুটো অপশন আছে। রাতটা আমার বাড়ি থেকে যান আপনারা। আমাদের একটা ঘর আপনাদের দিয়ে দেব, কোনও অসুবিধে হবে না। সকালে উঠে গাড়ি ভাড়া পেয়ে যাবেন, তখন চেকিং হয় না। আর সেকেন্ড অপশন, ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি! এখান থেকে প্রচুর ট্রাক যাচ্ছে করাচি। রাত ন’টা থেকে ছাড়ে। আমার চেনা লোক আছে। সেরকম একটা ট্রাকে আপনাদের তুলে দিতে পারি। সে ক্ষেত্রে রাত বারোটা-একটা নাগাদ করাচি পৌঁছে যাবেন। আপ ডিসাইড কিজিয়ে!’

পাপ্পু আর আমি বললাম, ‘কিন্তু কাল সকালে যদি চেকিং হয়? আমরা ট্রাকে করেই যাব। আপনি প্লিজ ব্যবস্থা করে দিন!’

এহসান হাসেন, ‘আগে তো ডিনার করুন। তার পরে ভাবব!’

ব্যবস্থা বলে ব্যবস্থা! নাজমা ভাবীর হাতে বানানো গরম তন্দুরি রুটি, গোস্ত কাবাব, কালি ডাল আর সুজির হালুয়া খেয়ে আমরা যখন ঢেকুর তুলছি, এহসান বললেন, ‘মেহমান হিসেবে কোথাও কোনও ভুল হলে মার্জনা করবেন। আমার বন্ধুর ট্রাক বেরোবে আর আধ ঘণ্টা পরে। আমি আপনাদের তুলে দিয়ে আসছি।’ বেরোনোর সময় নাজমা ভাবী দু’জনের হাতে তুলে দিলেন দুটো জলের বোতল আর এক বাক্স টফি। নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আবার আসবেন!’

রাত ন’টা নাগাদ ফের ঘুরপথে এহসান আমাদের পৌঁছে দিলেন ট্রাকের আড্ডায়। সেখানে আলাপ হল ড্রাইভার মহম্মদের সঙ্গে। এহসানের বন্ধু। ট্রাকে ওঠার সময় এহসানকে ধন্যবাদ দিতে যেতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন, এই যথেষ্ট। মেহমানের কাছ থেকে ধন্যবাদ নিতে নেই। ইনসাআল্লাহ, ঠিকঠাক করাচি পৌঁছে যাবেন। আমি মহম্মদের কাছে খবর পেয়ে যাব!’

রঙবাহারি ট্রাকের ড্রাইভারের পিছনে আরামদায়ক আরও তিনটে সিট। বেশ পা ছড়িয়েই বসা যায়। মহম্মদের সঙ্গে গল্প করতে করতে রাতের হাইওয়ে ধরে ফিরছিলাম। পাপ্পু বলল, ‘এহসান আমাদের বাঁচিয়ে দিল বললে কিছুই বলা হয় না! অথচ আমরা ভাবছিলাম…’

 সত্যিই তো ভাবছিলাম! গাড়িতে ওঠার সময়ে মাথায় কাজ করছিল অনিশ্চয়তা। কিডন্যাপ? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

আজও যখন ঘটনাটা ভাবি, কী হতে পারতো, ভাবলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তার পরে এহসানের হাসিমুখটা মনে পড়ে, ‘আপ মেহমান হো, দুশমন নহি!’

কাঁটাতারের বেড়া কি মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নিতে পারে? সম্ভবত নয়। এখনও এহসানরা আছেন এই পৃথিবীতে, সে জন্যই এখনও পৃথিবীটা সুন্দর। 

ক্রমশ

আরও পড়ুন...