ধা রা বা হি ক । পর্ব ৬
‘কারেজ! একটা ইংলিশ ওয়ার্ড। কারেজটাই আসল! তুই অত কেঁপে যাচ্ছিস কেন!’ বইমেলায় ঢুকে আমার কাঁধে একটা আলতো চাপড় দিয়ে বলল অরণ্য। তার পরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দ্যাখ তো, বেশ শান্তশিষ্ট, ল্যাজবিশিষ্ট দেখাচ্ছে কি না!’
সেদিনই কোত্থেকে একটা জিরো পাওয়ারের সস্তার চশমা যোগাড় করেছে অরণ্য। ওর সুনিশ্চিত ধারণা, ওই চশমা পরলে ও ‘নবীন কিশোর’ হয়ে যাবে, ওর জন্য অপেক্ষা করবে সুনীলদার কবিতার ‘ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ!’ আমি যদি বলি, ওকে চশমাটা মানাচ্ছে না, ও নিঘার্ত ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলবে, ‘তুই কবিতা-টবিতা লিখছিস ঠিক, কিন্তু হিউম্যান অ্যাপিয়ারেন্স নিয়ে কিসস্যু জানিস না!’
সে বহু যুগ আগের কথা। আটের দশকের শেষাশেষি বা নয়ের দশকের শুরু। তখন কলকাতা বইমেলা হতো পার্ক স্ট্রিটের পাশে ময়দানে। সবে কলেজে ঢুকে ডানা গজিয়েছে, ক্লাস কেটে টাইগার বা নিউ এম্পায়ারে লাইন দিই, পাড়ার দোকানে সিগারেট কিনে দড়িতে ঝোলানো আগুনে ধরিয়ে নিজেকে ব্যাড বয় মনে হয়। সদ্য প্রেমে পড়েছি। প্রেমিকার হাত ধরে নন্দনে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাই, বিভিন্ন কলেজ ফেস্টে নানারকম অ্যাডভেঞ্চারে থাকি, ‘আত্মপ্রকাশ’ বা ‘ঘুণপোকা’ সারা রাতে শেষ করে ফেলি, ডুবে থাকি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার আশ্চর্য রহস্যে।
অরণ্যের জীবনে তখন তিনটে নেশা। নম্বর টেন ব্র্যান্ডের সিগারেট, বাংলা ও ইংরেজি বই এবং সুন্দরী মেয়ে। তা, সে সময় ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে এত আদেখলাপনা ছিল না, আমাদের মতো বাপে খ্যাদানো, মায়ে তাড়ানো বখাটেদের জন্য প্রেম দিবস বলতে ছিল সরস্বতী পুজো। সব মেয়েকেই সেদিন শ্রীদেবী বা মাধুরী দীক্ষিতের মতো মনে হতো। সেবার বইমেলার মাঝেই পড়েছে সরস্বতী পুজো, আর অরণ্য ঠিক করে ফেলেছে, ওর তখনকার লাবণ্য মানে তোর্সাকে সরস্বতী পুজোর সকালে তুলে দেবে তিনটে বই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’ ও ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব।’ তোর্সা কবিতা ভালোবাসে।
এ বার অরণ্য ঠিক করলেই তো বই হাতে এসে যাচ্ছে না। সরস্বতী পুজোর দিন বিকেলে গড়িয়াহাটের দাশ কেবিনে তোর্সাকে নিয়ে যাওয়া আছে, সকালে অঞ্জলি দেওয়ার পরে একটা ক্যাডবেরি কিনে দেওয়া আছে, তার পরে নম্বর টেন কেনা, লেকের ধারে ঝালমুড়ি তো আছেই। তা এতসব করতে গেলে যে ট্যাঁকের জোর লাগে, তা ঠিক অরণ্যের বাজেট পারমিট করছে না। তা হলে?
সেখানেই অরণ্য বাড়তি অ্যাডভেঞ্চারে বিশ্বাসী। বইমেলায় সে আজ নিজের সঙ্গে একটা খেলা খেলতে চায়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘বাপের সিগারেট, স্কুলের লাইব্রেরির বই, ক্লাসমেটের নোটস, আমার একটাই পলিসি বুঝলি। চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা! আমি আজ স্টল থেকে তিনটে বই তুলব!’
আমি স্তম্ভিত, ‘তার মানে?’
‘তুই নিশ্চয়ই বিখ্যাত ইংরেজি কোটটা জানিস— দেয়ার ইজ নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়্যার! আমাকে তিনটে বই তুলতেই হবে! বাপের হোটেলে থাকি, এমনিতেই পুজোর দিন খরচা আছে। তার উপরে তিনটে বইয়ের জন্য এত খরচা পোষাবে না!’
বইমেলায় বই চুরি করে ধরা পড়লে কী হয়, ততদিনে একটা ধারণা আছে। হয় গিল্ডের অফিসে বসে রচনা লিখতে হয়, না হলে স্টলের সামনে কান ধরে ওঠবোস। অজানা একটা আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরে। আমি এই দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে মোটেই অরণ্যের সঙ্গী হতে চাই না। ভয়ে বুক কাঁপছে। বললাম, ‘আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। তুই চেষ্টা করে যা। ধরা পড়লে আমি তোকে চিনি না। নিশ্চিন্তে কেটে যাব!’
লালামোহনবাবু যেমন সোনার কেল্লায় ফেলুদার ‘সামনে বিপদ আছে’ শুনে বলেছিলেন, ‘ফিরে যাব?’ ঠিক তেমনই একটা গলায় অরণ্য বলে, ‘ধরা পড়ব? কী যে বলিস! তুই চলে যা, যা খুশি করিস। শুধু স্টলটায় আমার সঙ্গে ঢোক। তোকে কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু মন দিয়ে বই দেখবি। বাকি কাজ আমার! এইটুকু কর!’
‘তুই ধরা পড়লে আমি জাস্ট কেটে যাব। আমি তোকে চিনি না!’
অরণ্য অবিচলিত। ‘চিনতে হবে না। তোর মতো ভীরুদের জীবনেও কিছু হবে না। ওই দু’চার লাইন কবিতা লিখবি।’ তার পরে যথারীতি চার অক্ষরের গালাগাল।
আমি অবাক হই না। জানি, অরণ্য যখন ঠিক করেছে, বই তুলবে, ও তুলবেই। পৃথিবীর কোনও বিষয়ে ওর মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। তোর্সা বলে মেয়েটা কী করে ওকে ট্যাকল করে জানি না, কিন্তু ও সায়নী বা মধুপর্ণার সঙ্গে বিকেলে হাল্কা টাইম কাটিয়ে সন্ধেয় তোর্সার সঙ্গে দেখা করে অম্লানবদনে বলতে পারে, ‘আসলে মায়ের প্রেসারের ওষুধটা আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল’ বা ‘বুঝলি না, অনিরুদ্ধ স্যারের কোচিংয়ে আজ এতক্ষণ বসিয়ে রাখল!’ তোর্সা সব বিশ্বাস করে, কারণ ও অরণ্যের ওই রাগী টম বয় ইমেজটা পছন্দ করে। রাফ অ্যান্ড টাফ।
আমি এসব পারি না, দূর থেকে অরণ্যকে দেখি, হিংসেও করি। কী ভাবে যে পারে! প্রেমিকার চোখের দিকে তাকালেই আমার রক্ত হিম হয়ে যায়, মিথ্যে বলতে গেলে ঠিক ধরা পড়ে যাই। তখন যেসব ঘটনা ঘটে যায়, সেগুলো একদম পছন্দ হয় না।
যে সব বইগুলোর নাম লিখেছি, সেগুলো কোন প্রকাশনার, সবাই মোটামুটি জানে। সেই আটের দশকে বইমেলা আজকের মতো ছিল না। নিশ্চিন্তে মেলায় ঘুরে বেড়াতেন সুনীলদা বা শঙ্খবাবু, সামনে গিয়ে বই নিয়ে দাঁড়ালে সইও করে দিতেন। যেখানে সেখানে ঘুরতেন সুবোধদা বা মল্লিকাদি, জয় গোস্বামী বা ভাস্কর চক্রবর্তী। তার জন্য বইমেলার বাইরে বিশাল ব্যানার করতে হত না, বাউন্সার নিয়ে মেলায় কাউকে ঘুরতে হতো না। হাতে হাতে মুঠোফোনও ছিল না।
তা সেই আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন সাদা ধবধবে বুশ শার্ট আর ধুতি পরা বাদল বসু। তাঁর সিগারেটে টান দেওয়ার ভঙ্গিটি ছিল সিগনেচার। হাত মুঠো করে সিগারেটটি ধরে মুখটা সামান্য উঁচু করে সুখটান আজও মনে পড়ে।
চার দিক মেপে নিয়ে অরণ্য ঢুকে পড়ল স্টলে। একেবারে নবীন কিশোর সেজে। পিছুপিছু আমি। যথারীতি দূরত্বে আছি। যাতে বেঁফাস কিছু হলেই কেটে যেতে পারি। মিনিট সাতেকও হয়নি, দেখি স্টলের কোত্থাও অরণ্য নেই। গেল কোথায় ছেলেটা? তা হলে কি ধরা পড়ে গেল? আতঙ্ক গ্রাস করে আমাকে।
মিনিট পাঁচেক বই দেখে বাইরে বেরোই। দেখি স্টলের বাইরে সামান্য দূরে অরণ্য উদাস চোখে একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখছে। কাছে যেতেই বলল, ‘হেব্বি কিন্তু। কী করে আলাপ করা যায়, ভাবছি! সঙ্গে ছোকরাটা না থাকলে…’
আমি বিস্মিত। বললাম, ‘আবার মেয়ে? বইগুলো হয়নি তো? জানতাম হবে না!’
অরণ্য চুলে আঙুল চালায়। জিরো পাওয়ারের চশমাটা খুলে আমার দিকে তুলে ধরে বলে, ‘এটা পকেটে রাখ। চল, মোগলাই খাই। খিদে পেয়েছে!’
আমি উত্তেজিত, ‘বই কী হল?’
অরণ্য এ বার হাসে। তার দুচোখে আত্মবিশ্বাস খেলা করে। তার পরে আবার একটা চার অক্ষর, ‘শোন, আয়াম নট আ লুজার লাইক ইউ!’
তার পরে ব্যাগ সামান্য ফাঁক করে দেখায়। আমি দেখি, তিনটে নতুন বই নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে।
অরণ্য আবার বলে, ‘নে চল, মোগলাইটা কি খাওয়াবি? না সেটাও আমার ঘাড় ভেঙে?’
আমি কিছু বলি না। ফের স্টলের গেটে চোখ পড়ে। রাজার মতো দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন বাদল বসু।
পরে ওই প্রকাশনা থেকে প্রথম বই বেরোনোর সময় একদিন বাদলদাকে বলেছিলাম এই গল্প। হেসে বলেছিলেন, ‘যত্ত সব দস্যি ছেলের কাণ্ড!’
দস্যি ছেলে অরণ্য সরস্বতী পুজোর দিন তোর্সার হাতে তুলে দিয়েছিল বইগুলো, সঙ্গে ক্যাডবেরি। তার পরে তোর্সার দেওয়া ক্যাডবেরির একটা টুকরো মুখে পুরে চটচটে হয়ে যাওয়া হাতটা মুছেছিল ওর বাসন্তী রঙের শাড়িতে।
তোর্সা রেগেমেগে রক্তচক্ষু হেনে বলেছিল, ‘অসভ্য!’
মেয়েরা যেমন বলে, বলে থাকে!
ক্রমশ