ধা রা বা হি ক । পর্ব ৭
‘অ্যাই ছেলে, তোর মুখটা অমন শুকনো কেন রে? চুরমুর খাবি?’
আমাকে দেখতে পেয়েই তিস্তাদি হেসে এগিয়ে এসেছে। তখন ক্লাস ইলেভেন, ইংলিশ স্যারের কোচিং ক্লাসে গিয়ে টুসি বলে একটা মেয়ের প্রেমে ফেঁসে গিয়েছি, কিন্তু সাহস করে কিচ্ছু বলতে পারছি না। তাকে নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতা লিখে ফেলছি, কিন্তু দিনের শেষে হাতে থাকছে পেন্সিল! তার উপর আবার টুসির জন্য ছেলেদের লম্বা লাইন। কোচিং ক্লাসের শেষে বান্ধবীদের সঙ্গে খিলখিল করে হাসতে হাসতে টুসি চলে যায়। দু’একদিন ওর বাবাও বাইক নিয়ে নিতে আসেন। জাঁদরেল গোঁফ, লম্বা-চওড়া চেহারা, দেখলেই মনে হয়, ভদ্রলোক কোনও হোমরা-চোমরা হবেন।
একা একা বাড়ি ফেরার সময়ে আমার সব কিছু বিচ্ছিরি মনে হয়। মনে হয়, দেওয়ালে একটা ঘুষি মারি, বা নেড়ি কুকুরটাকে টেনে মারি একটা লাথি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছুই করা হয় না, মনের ভিতরে কিলবিল করে নানা রঙের রহস্যময় সব ভাবসম্প্রসারণ। তা এই একা একা বাড়ি ফেরার সময়ে গোলপার্কের মোড়ে কখনও-সখনও দেখা হয়ে যায় তিস্তাদির সঙ্গে। তখন দিনটা কেমন করে যেন ভালো হয়ে যায়। এই ধরা যাক, টিউশন সেরে ফিরছে। খোলা চুল, পানপাতার মতো মুখ, চোখে নিখুঁত করে দেওয়া কাজল, বাঙালি মেয়েদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। মাথাটা একদিকে একটু কাত করে ‘কী রে?’ বললেই শেষ! আমার হৃৎপিন্ড দপ করে ওঠে, কোনও এক আশ্চর্য ম্যাজিকে মন খারাপ ভ্যানিশ করে যায়, আমি ভ্যাবলার মতো হাঁ করে তিস্তাদিকে দেখি। তিস্তাদি তখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এমএ ফার্স্ট ইয়ার, ইকনমিক্স অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস। তার উপরে একটু তাকালেই চোখ পুড়ে যেতে পারে। একেবারে ‘চনমন করে রক রাস্তারা’ কেস। এককথায়, আমাদের পাড়ার সবচেয়ে মহার্ঘ্য কোহিনূর।
আমি দেখেছি, তিস্তাদি যখন সন্ধেয় ফেরে, পাড়ার ক্লাবে ক্যারম পেটা স্তব্ধ হয়ে যায়, পার্টি অফিসের সজলদা-খোকনদারা বিশ্রীভাবে তাকায়। শুধু ওরাই বা কেন, আরও অনেকে তাকায়। মিষ্টির দোকানের বুড়ো মালিক বাহাত্তুরে খগেন ঘোষ এগিয়ে এসে দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘অ্যাই যে মেয়ে, বাবা ভালো আছে?’ খগেন ঘোষের কুতুকুতে চোখ ঘোরাফেরা করে তিস্তাদির শরীরে। তিস্তাদি ‘হ্যাঁ, ভালো’ বলে মৃদু হেসে চলে যায়। একদিন সজলদাদের রক থেকে কেউ একটা আওয়াজ দিয়েছিল, ‘ওই যে মাধুরী যাচ্ছে! এক-দো-তিন!’
‘চার-পাঁচ-ছে’ বলার আগেই তিস্তাদি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল রকের দিকে, ‘কে বলল? দম থাকলে সামনে এসে বলুক!’ ব্যস, মুহূর্তে রক স্তব্ধ। এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি। কেঁচোর মতো গুটিয়ে যাওয়া সব চোখমুখ। কিন্তু সেটা সাময়িক। আমি জানি, তিস্তাদির রাত করে ফেরার সময় সজলদাদের গ্রুপটা ওত পেতে থাকে।
সজলদাই একদিন আমাকে ধরেছিল, ‘অ্যাই, তোর সঙ্গে তিস্তার এত কথা কীসের রে? সেদিনও দেখলাম, গোলপার্কের মোড়ে মৌচাকের সামনে…’
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বলি, ‘তিস্তাদিই আমাকে চুরমুর খাওয়াল…’
সজলদা কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘বড় দিদি পাতানো হচ্ছে? বলে দিবি, আমরা সব খবর রাখি! কোথায় কী লটরপটর চলছে, সব জানি! পাড়ার ট্রফি পাড়াতেই থাকবে, বুঝেছিস?’
আমি কিছু বলি না। কিন্তু লটরপটর ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারি। তিস্তাদির বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পাড়ার লোক জানে শেখরবাবু সজ্জন মানুষ। আমরা ছোটরা জ্যেঠু বলি। জ্যেঠু খুব একটা বাইরে বোরেন না। মাঝে মাঝে দোতলার বারান্দায় বসে দীর্ঘ সময় ধরে খবরে কাগজ পড়তে দেখেছি। তাঁর কাছে মাঝে মাঝেই আসে জয়দীপদা বলে একজন পুরনো ছাত্র। মাঝে মাঝেই তিস্তাদি দোতলা থেকে নেমে আসে জয়দীপদা ফেরার সময়ে। দু’জনে কিছুক্ষণ কথাও বলে। তার পরে সাইকেলে করে জয়দীপদা চলে যায়।
জ্যেঠুর সঙ্গে তিস্তাদি একা থাকে, মা বছর পাঁচেক আগেই চলে গিয়েছেন। জ্যেঠু একাই মেয়েকে বড় করেছেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তিস্তাদির সঙ্গে জয়দীপদার কিছু একটা আছে। কিন্তু সাহস করে তিস্তাদিকে সেসব বলা যায় নাকি!
এ ভাবেই চলে যাচ্ছিল, যেমন চলে যায় দিনগুলো। আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে গেল দোলের দিন। সকাল থেকে পাড়ায় রঙ খেলা চলছে, আমরা আমাদের গলিতে খেলছি। পিচকিরি দিয়ে বেলুন ফোলাচ্ছি আর একে-ওকে মারছি। ঘিয়ে রঙের একটা পাঞ্জাবি আর নীল জিন্স, জয়দীপদার সাইকেলটা এসে দাঁড়িয়েছিল শেখর জ্যেঠুদের দোতলা বাড়ির দরজায়। সাইকেল বাইরে পার্ক করা, আমরা দেখেছি। কিছুক্ষণ পরে জয়দীপদা নেমেছে, চুলে আর মুখে আবিরের গুঁড়ো, জামাতে রঙ। সঙ্গে নেমেছে তিস্তাদি। চোখে-মুখে আবির, সালোয়ার কামিজে রঙের ছিটে। দোলের দিন রঙ মেখে ভূত হয়ে গেলে মেয়েদের কেন এত বেশি সুন্দর লাগে, কে জানে!
আমাদের গ্রুপের ভুতো সোজাসুজি জয়দীপদার পাঞ্জাবিতে একটা বেলুন মেরে হি হি করে হাসছে। তিস্তাদি হেসে বলছে, ‘দে দে, ভিজিয়ে দে!’
আমরা কয়েকজন চারপাশে। তার মধ্যেই কোত্থেকে চলে এলো দুটো বছর কুড়ির মেয়ে। দু’জনের মুখেই প্রচুর রঙ, ভিজে পোশাক। একজনের গায়ে সালোয়ার কুর্তা, অন্য মেয়েটা প্যান্ট শার্ট। সালোয়ার কুর্তা সোজা এগিয়ে এসে জয়দীপদার সাইকেলটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘হ্যাঁ, এই ছেলেটাই। ভেবেছিস, পালিয়ে বাঁচবি! দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি!’
জয়দীপদা হতচকিত। তিস্তাদিও। জয়দীপদা বলে, ‘সাইকেলটা ফেলে দিলেন কেন? কী হয়েছে?’
এটুকু বলেছে কি বলেনি, দ্রুত সেখানে ম্যাজিকের মতো সজলদা-খোকনদা, সঙ্গে পাশের বস্তির চাঁদু। চাঁদুর ষণ্ডা চেহারা, বলা নেই, কওয়া নেই, সোজা জয়দীপদার গালে একটা থাপ্পড় মেরে বলে, ‘বেপাড়ায় ঢুকে বেলেল্লাপনা হচ্ছে? আজ তোর শেষ দেখে ছাড়ব!’
আরও তিন-চারজন মুহূর্তে হাজির, এই মুখগুলো আমি পার্টি অফিসে দেখেছি। তার মধ্যেই সালোয়ার পরা মেয়েটা কাঁদছে, ‘আমি আর সীমা পুরনো গলির পাশ দিয়ে আসছিলাম। ও সাইকেলে ছিল। আমাদের একা পেয়ে জোর করে আবির মাখিয়ে… তারপর— আমি বলতে পারব না…’
সজলদার গলা পাওয়া গেল, ‘তোরা ছেড়ে দিলি?’
জিন্স পরা মেয়েটা বলে, ‘ধরব কী করে, তার আগেই সাইকেল নিয়ে পালাল…’
তিস্তাদি বলার চেষ্টা করছে, ‘আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এটা হতেই পারে না!’
চাঁদু পাল্টা তুই তাকারি শুরু করে, ‘তুই ভেতরে যা! লাভার ধরা পড়েছে! এখন রামক্যালানি হবে!’
শুরু হল বেধড়ক মার। আওয়াজ উঠল, ‘ভদ্দরলোকের ছেলে হয়ে এই কীর্তি!’ চলে এলেন খুচরো নেতা। বসে গেল খাপ পঞ্চায়েত। পুলিশ ডাকার কথা উঠছে। দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন বৃদ্ধ শেখর জ্যেঠু। আশেপাশের বারান্দায় উৎসুক মুখ, যেন সার্কাস দেখছে সবাই!
খুচরো নেতা বিকাশ মল্লিক তার মধ্যেই বিধান দেন, ‘আর মারিস না সজল, মরে যাবে! পার্টি অফিসে নিয়ে চল। জামা প্যান্ট খুলিয়ে কান ধরে ওঠবোস করা। তাতে যদি শিক্ষা হয়!’
জয়দীপদার মুখ ফেটে গিয়েছে, রক্ত বেরচ্ছে। তার মধ্যেও বলছে, ‘আপনারা ভুল করছেন!’
কিন্তু কেউ শুনছে না। তিস্তাদি ঝাঁপিয়ে পড়তে যেতে কয়েকটা মেয়ে টেনে সরিয়ে দেয়। জয়দীপদাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে সজলদারা।
বিকাশ মল্লিক এ বার গলা তোলে, ‘ভিড় করার কিছু নেই। যান, সবাই দোল খেলুন। যত সব উটকো ঝামেলা!’
তিস্তাদিকে কোথাও দেখতে পাই না। দরজা বন্ধ। জ্যেঠুকেও না। আমাদের দোলের তার কেটে যায়। যে যার বাড়ি থেকে ডাক আসে। কোথাও একটা কেটে যায় তাল। শ্যাম্পু আর সাবান মেখে বাথরুমে রঙ তোলার সময় গা চিড়বিড় করে। জয়দীপদা এরকম করেছে?
দোলের পরে দিন দুই কেটে গেলেও তিস্তাদিকে দেখতে পাই না। জ্যেঠুকেও না। কিন্তু পার্টি অফিসে সজলদাদের সঙ্গে একদিন সেই মেয়ে দুটোকে চোখে পড়ে। পোস্টার লিখছে।
তিন দিন পরে কাগজে ছোট করে একটা খবর বেরোয়। শিরোনাম, ‘যুবকের আত্মহত্যা!’
মাত্র কয়েকটা লাইন। ভিতরের পাতায়। স্টাফ রিপোর্টার লিখছেন:
‘শনিবার দুপুরে ঢাকুরিয়ার পঞ্চাননতলার এক ফ্ল্যাটে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় এক যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। যুবক মেধাবী ছাত্র হলেও দোলের দিন তাঁর নামে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল বলে খবর। যদিও যুবকের মা এই অভিযোগ মিথ্যে বলে দাবি করেছেন। মৃতের নাম জয়দীপ চক্রবর্তী। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। পুলিশ আত্মহত্যা বলেই সন্দেহ করছে। অন্য কারণ থাকলেও তা খতিয়ে দেখছে।’
তিস্তাদি? তার কী হল? মাসখানেকের মধ্যে জ্যেঠু মারা যান। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার গাড়িতে শেষবার দেখেছিলাম তিস্তাদির মুখ। প্রতিক্রিয়াহীন। পাথরের মূর্তির মতো। তার পরে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল, কোথাও একটা হারিয়ে গেল তিস্তাদি।
আমাদের পাড়ার ট্রফি!
ক্রমশ