ধা রা বা হি ক । পর্ব ৮
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাই বলতে হবে!
যাদবপুরের আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে বিখ্যাত ঝিলের ধারে বসে তিন বান্ধবীর সামনে বসে বাদাম ভাজা খেতে খেতে বলে ফেলেছিলাম, ‘জীবনে দুটো প্রতিজ্ঞা আছে। এক লর্ডসের প্রেস বক্সে বসে টেস্ট ম্যাচ কভার করব। দুই, উইম্বলডনটাও করতে হবে। একটাই কারণ। কোর্টে স্বচক্ষে স্টেফি গ্রাফকে দেখতে চাই!’
এসব প্রতিজ্ঞায় বান্ধবীরা কেউ প্রভাবিত হয়েছিল বলে মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। নয়ের দশকের ওই সময়টায় সবে কুড়ি পেরোনো বয়সে স্বপ্নগুলোর মধ্যে ডিজিট্যাল গন্ধ ছিল না, ছিল না সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত ‘আমাকে দ্যাখ’-এর ইঁদুরদৌড়। সেই কলেজ বয়েসে এসব অদ্ভুত প্রতিজ্ঞার মধ্যে লুকিয়ে থাকত উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস আর হার না মানা সংকল্প। সেই সময়টায় গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনে ফরাসি ভাষাটা শিখছিলাম মন দিয়ে। দেশ পত্রিকায় গোটা তিনেক কবিতা বেরিয়ে গিয়েছে। কবি শ্যামলকান্তি দাশ আনন্দমেলার দফতরে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন তৎকালীন সম্পাদক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেখানে খেলা নিয়ে লেখাও শুরু হয়ে গিয়েছে। যাদবপুরে এমএ পড়তে পড়তেই চাকরিজীবন শুরু। আনন্দবাজারের নিউজ ডেস্কে।
ছ’মাসের মধ্যে নিউজ থেকে স্পোর্টসে। মাসটা ডিসেম্বর ১৯৯২। গুয়াহাটিতে বাংলা বনাম আসাম রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ দিয়ে শুরু, কয়েক মাসের মধ্যে ভাগ্যচক্রে ওয়ান ডে-ও। কিন্তু তিরানব্বইয়ের ৩০ এপ্রিল ক্রীড়া দফতরে নাইট ডিউটি করতে গিয়ে ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা।
ঘটনাটা বলার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা দরকার। যে কোনো খবরের কাগজে নিউক্লিয়াস বলতে দুটো। ডেস্ক আর রিপোর্টিং। দুটো বিভাগের সম্পর্ক ঠিক ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’-র মতো নয়। ডেস্ক হল যে কোনো কাগজের ‘লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স।’ যে কোনো লেখা, যাকে খবরের কাগজের ভাষায় কপি বলে, তা পাতায় সাজিয়ে ফাইনাল প্রোডাক্ট প্রেসে পাঠায় ডেস্কই। কাজেই ডেস্ক হল কাগজের প্রাণভোমরা। আবার রিপোর্টার হল ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার। সে চমকপ্রদ এক্সক্লুসিভ নিয়ে আসবে, তার নাম কাগজে ছাপা হবে, যাকে বলে বাইলাইন। দুঁদে রিপোর্টার মানে সে এমন কিছু নিয়ে আসবে, যা কাগজের প্রথম পাতায় এসে বাকি সব শুষ্ক খবরকে পিছনে ফেলে দেবে। ডেস্ক মনে করে, তারাই শেষ কথা, আবার রিপোর্টার মনে করে, তারা খবর না আনলে ডেস্ক ঠুঁটো জগন্নাথ।
আজকের দিনে খবরের কাগজে ডেস্কে নাইট ডিউটি মানে মূলত খবর বাছাই এবং কম্পিউটারে সামনে বসে পেজ মেকিং। আর রিপোর্টারের নাইট ডিউটি মানে টিভি আর বিভিন্ন খবরের পোর্টালে চোখ রাখা, যাতে কোনও খবর মিস না হয়ে যায়। নয়ের দশকে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। তখন ডেস্কের নাইট ডিউটি মানে সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে রাত আড়াইটে। রিপোর্টারেরও তাই। আর স্পোর্টসের ব্যাপারটা ছিল একেবারে ইউনিক। ক্রীড়া বিভাগে আলাদা করে ডেস্ক বা রিপোর্টিং বলে কিছু ছিল না। ডেস্কে নাইট ডিউটিও করতে হতো, আবার একই সঙ্গে রিপোর্টিং করাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ত। ফলে দুটো কাজই শিখতে হয়েছিল, যে বিনিয়োগ পরে প্রচুর চড়া হারে রিটার্ন দিয়েছে।
ইন্টারনেটহীন সে যুগে খবরের খোঁজ রাখতে ভরসা ছিল মাত্র দুটো বস্তু। টেলিপ্রিন্টারে আসা খবরের স্তুপ আর টেলিফোন। টেলিপ্রিন্টারে খবর আসত দেশ-বিদেশের। কখনও পিটিআইয়ের খবর, কখনও ইউএনআইয়ের। এর বাইরে লোকাল খবরের জন্য ভরসা করতে হত ফোনের। লোকাল বলতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, সিএবি, হকি বা অন্য খেলা, যা কলকাতায় হয়েছে বা সেদিনের বড় কোনো ইভেন্ট।
তা সেই ঘটনাটা ঘটে গেল ৩০ এপ্রিল, ১৯৯৩। আর্টিস্টের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে পেজ রিলিজ করে চার তলায় স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের এক চিলতে ঘরে এসে বসেছি। টেলিপ্রিন্টারে জমে ওঠা খবরের স্তূপ থেকে স্পোর্টসের খবর বাছাই করে নিয়ে এসেছি। হঠাৎই চোখে পড়ে। চার লাইনের একটা খবর। কিন্তু হেডলাইনটা চমকে দেওয়ার মতো—‘MONICA SELES STABBED’.
ছোট খবর। মাত্র চার লাইন। যা বলছে, জামার্নির হামবুর্গে সিটিজেন কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ম্যাগডালিনা মালিভার সঙ্গে খেলছিলেন মোনিকা। একটা গেম শেষ করে মোনিকা যখন প্লেয়ারের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে ব্রেক নিচ্ছিলেন, পিছন থেকে এসে এক দর্শক তাঁর পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়। মোনিকা তখন বিশ্বের এক নম্বর, স্টেফি গ্রাফকে দুইয়ে পাঠিয়ে গিয়েছেন। তার আগে জানুয়ারিতে জিতে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন।
কাগজে কোনোরকমে খবরটা ধরানো গিয়েছিল সেই রাতে। যে কেউ আনন্দবাজার আর্কাইভ খুলে ১৯৯৩ সালের ১ মে-র কাগজে দেখে নিতে পারেন। হেডিং সম্ভবত ছিল ‘ছুরিকাহত মোনিকা’। কাগজ ছেড়ে ফের টেলিপ্রিন্টারে সামনে গিয়ে দেখি পাতার পর পাতা এই খবরের ফলো আপ আসছে। জানা যাচ্ছে, গুন্থার পার্চ নামে স্টেফির এক অন্ধ ভক্তই নয় ইঞ্চি লম্বা ছুরি হাতে কোর্টের আশেপাশে ওৎ পেতে ছিলেন। মোনিকার পিঠে প্রায় ছ’ইঞ্চি ঢুকে গিয়েছিল ছুরি। মেরুদন্ডের ঠিক পাশে বিঁধেছিল বলে বেঁচে যান মোনিকা। কিন্তু টেনিস কোর্টে ফিরতে লেগে যায় দু’বছর। পার্চকে তখনই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল, কিন্তু বিচারের সময় মানসিক বিকারগ্রস্ত থাকায় মাত্র কয়েক বছরের সাজাই তাঁর হয়েছিল।
সেই সময়ে প্রতিদিনই মেয়েদের টেনিসে এক নম্বর হিসেবে স্টেফির শ্রেষ্ঠত্ব চ্যালেঞ্জ করে চলেছেন মোনিকা। কোর্টে স্ট্রোক নেওয়ার সময় মোনিকার মুখ দিয়ে একরকম আওয়াজ বেরোত। যা নিয়ে এক নামী টেনিস লিখিয়ে লিখেছিলেন, ‘ওই আওয়াজটা পুরোপুরি শীৎকারের মতো!’
ওই ছুরি খাওয়ার ঘটনার আগে একের পর এক টুর্নামেন্ট জিতে চলেছিলেন মোনিকা। শুধু ১৯৯২ সালে উইম্বলডন বাদ দিলে জিতেছিলেন বাকি তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম। ওই আক্রমণের পরে মোনিকা বছর দুই পরে পেশাদার টেনিসে ফিরলেও আর মাত্র একটা গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন। ১৯৯৬ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। ওই ঘটনার ফলে অবশ্যই উপকৃত হয়েছিলেন স্টেফি। তাঁর কাঁটাই দূর হয়ে যায়। ২২টি গ্র্যান্ড স্লামের মালিক স্টেফি বলেছিলেন, ‘মোনিকা থাকলে কারো কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হতো। আই মিস হার!’
তিরানব্বইয়ের সেই রাতে অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফেরার সময় এক সিনিয়র সহকর্মী বলেছিলেন, ‘এসব লক্ষ লক্ষ ডলারের ব্যাপার! স্টেফিই নিশ্চয়ই কাজটা করিয়েছে!’ সার্বিয়ার জন্ম মোনিকার, রাজনীতির গন্ধও উঠে এসেছিল।
সেই রাতে স্টেফিই এর পিছনে শুনে তাঁর ভক্ত হিসেবে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু সিনিয়র সহকর্মীকে কিছু বলতে পারিনি। মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, আবার মোনিকা কোর্টে ফিরবেন, উইম্বলডন ফাইনালে স্টেফির সঙ্গে তাঁর দেখা হবে।
১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে পা। নিউ জিল্যান্ড। কয়েক মাস পরে শারজা। তার কয়েক মাস পরে অনেকটা অযাচিত ভাবেই সুযোগ এসেছিল উইম্বলডন কভার করার। অ্যাক্রিডিটেশনের জন্য অ্যাপ্লাই করে পেয়ে যাব, ভাবিনি। যখন পেয়েই গেলাম, অল্প বাজেটে ‘কুছ পরোয়া নেই’ বলে নেমে পড়লাম।
তখন এয়ারবিএনবি’র মতো অ্যাপ ছিল না। সিনিয়র সহকর্মী ও বন্ধু দুর্বার গঙ্গোপাধ্যায় ঠিক করে দিয়েছিলেন আস্তানা। ইস্কনের গেস্ট হাউস। অক্সফোর্ড স্ট্রিটের কাছে গেস্ট হাউস, টটেনহ্যাম কোর্ট রোড মেট্রো স্টেশনের কাছে। ১৯৯৫-এর জুলাইয়ে সেই প্রথম আমার লন্ডনে পা রাখা। আন্ডারগ্রাউন্ড বা মেট্রো ছাড়া লন্ডন শহরটাই অচল। ওটাই যাতায়াতের সেরা রাস্তা।
মেট্রোর সার্কল লাইনে সাউথফিল্ডস স্টেশন। সেখানে নেমেই বিখ্যাত অল ইংল্যান্ড ক্লাব যেতে হয়। যেখানে বসে উইম্বলডনের আসর। উইম্বলডন মানেই ঐতিহ্যের শেষ কথা। এখনও একমাত্র গ্র্যান্ড স্লাম, যেখানে সাদা পোশাক ছাড়া ম্যাচে নামাই যাবে না। অ্যাক্রিডিটেশন পেলেও আমার ভাগ্যে জুটেছিল রোভার পাস, অর্থাৎ কোনও সিট ফাঁকা থাকলেই প্রেস বক্সে প্রবেশের অধিকার মিলবে। তারকার ছড়াছড়ি। পুরুষদের সিঙ্গলসে পিট সাম্প্রাস, বরিস বেকার, আন্দ্রে আগাসিরা আছেন। মেয়েদের বিভাগে স্টেফি গ্রাফ, আরান্থা, সাঞ্চেজ, কনচিতা মার্টিনেজ, গাব্রিয়েলা সাবাতিনি, আরান্থা সাঞ্চেজ ভিকারিও।
আমি যখন পৌঁছলাম, দু’সপ্তাহের টুনার্মেন্টের ছ’দিন হয়ে গিয়েছে। স্টেফি পৌঁছে গিয়েছেন চতুর্থ রাউন্ডে। সেই ম্যাচের পাস হাপিত্যেশ করে বসে থেকেও জুটল না, কিন্তু জুটে গেল স্টেফি বনাম মেরি জো ফার্নান্ডেজের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের পাস। সেন্টার কোর্টে বেকারের ম্যাচের পাসও জুটল। কিন্তু স্টেফির ম্যাচ যখন পেয়েছি, বেকারের পিছনে ছোটাটা বেকার হয়ে যাবে, স্বাভাবিক।
এক নম্বর কোর্টে ম্যাচ। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কোর্টে ঢোকা থেকে শুরু করে প্রতিটি পয়েন্ট, কোর্টে বাঘিনীর মতো চলাফেরা আর অপ্রতিরোধ্য সেই ফোরহ্যান্ড একেবারে সামনে থেকে তারিয়ে তারিয়ে দেখলাম। আজকের মতো মোবাইল ক্যামেরা ছিল না, আমার ছোট্ট সাধারণ ক্যামেরা দিয়েই যা ছবি তোলার তুললাম। কোর্টে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে আভিজাত্য, শিল্প, গতি আর সৌন্দর্যের চমকপ্রদ মিশেল। কোয়ার্টার ফাইনালে ৬-৩, ৬-০ সেটে উড়ে গেলেন প্রতিদ্বন্দী মেরি জো। কানে মোৎজার্টের সুরের মতোই বাজল চেয়ার আম্পায়ারের গলা, ‘গেম, সেট অ্যান্ড ম্যাচ, মিস গ্রাফ!’
ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেও স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। পাশ থেকে এক ইউরোপীয় সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘হে, ম্যাচ ইজ ওভার! কাম অন, বরিস প্লেয়িং অ্যাট সেন্টার কোর্ট! ডোন্ট ইউ হ্যাভ দ্য পাস?’
বেকারের ম্যাচ নয়, আমি ছুটলাম প্রেস কনফারেন্স রুমে। আগে না পৌঁছলে জায়গা মিলবে না। প্রেস কনফারেন্স রুমে কোনো রকমে শেষদিকে একটা জায়গা পেলাম। নেভি ব্লু জ্যাকেট, একমাথা খোলা সোনালি চুল, ম্যাচের মতো ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা নয়। হাতে একটা স্পোর্টস ড্রিঙ্কের বোতল। সঙ্গে ভুবনমোহিনী হাসি। চোখের সামনে দশ ফুট দূরে স্টেফি! এসব সময়ে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে হয়, যুক্তি-বুদ্ধি-বোধ সব ভুলে যাই, ওই মুহূর্তে সব তোলপাড় হয়ে কোথাও যে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়, বলা খুব কঠিন।
ঠিক করে এসেছিলাম, একটা প্রশ্ন করার চেষ্টা করব। আর প্রশ্ন? কিন্তু সামনে স্টেফিকে দেখে সব ঘেঁটে ঘ! শেষ দিকে ধাতস্থ হয়ে পেশাদারি বিবেকের খোঁচায় দু’বার হাত তুলেছিলাম বটে, কিন্তু যিনি প্রেস কনফারেন্স কন্ডাক্ট করছিলেন, সেই জাঁদরেল মহিলার আমাকে চোখেই পড়ল না।। সব প্রশ্নই সাদা চামড়াদের। আমার পাশেই বসেছিলেন এক রোমানিয়ান সাংবাদিক। তিনি টোটকা দিলেন, ‘একেবারে সামনে না বসলে কোনো দিনই সুযোগ পাবে না। দেখছ না, কী ভিড়! সব সময় ম্যাচ শেষ হলেই ছুটে এসে আগে জায়গা নেবে!’
স্টেফির পরের ম্যাচ ইয়ানা নোভোত্নার সঙ্গে সেমিফাইনাল। সেই নোভোত্না, যিনি ৯৩ ফাইনালে শেষ সেটে স্টেফির বিরুদ্ধে ৪-১ এগিয়ে থেকেও চোক করে হেরে গিয়েছিলেন। তার পরে পুরস্কার বিতরণীতে রানার্সের ছোটো থালা হাতে নিতে গিয়ে ডাচেস অফ কেন্টের কাঁধে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কান্না কী করে ভুলি! স্টেফির অসামান্য প্রত্যাবর্তন যেমন মনে আছে, তেমনই মনে আছে ওই অঝোরে কান্না। নোভাত্না সেবারও চমৎকার ফর্মে, ঘাসের কোর্টে তাঁর খেলা বেশি খোলে। সাত সকালে অল ইংল্যান্ড ক্লাবে পৌঁছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো সেই সেমিফাইনালের পাস পেয়ে গেলাম।
এ বার ম্যাচ সেন্টার কোর্টে। কানায় কানায় ভরা। সাদা ফেট্টি পরে নেমেছিলেন স্টেফি। কিন্তু প্রথম সার্ভিসটা ঠিকঠাক পড়ছিল না। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে প্রথম সেট জিতে নিলেন নোভোত্না, ৭-৫। দ্বিতীয় সেটের মাঝামাঝি সময় থেকে বুঝলাম, স্টেফি কেন স্টেফি! শুরু হল প্রত্যাবর্তন। প্রতিটা পয়েন্টের জন্য নিজেকে নিংড়ে দেওয়া। অবিশ্বাস্য সব ডাউন দ্য লাইন শট, ঝলসে দেওয়া আগ্রাসী নেট প্লে। সেই সেট স্টেফি জিতলেন ৬-৪। শেষ সেটটায় নোভাত্না একেবারেই দাঁড়াতে না পেরে উড়ে গেলেন, ৬-২। ফাইনালে স্টেফি! মানে আবার একটা ম্যাচে দেখার সুযোগ।
এ বার আর ভুল নেই। পড়িমরি করে দৌড়ে প্রেস কনফারেন্স রুমে। যথারীতি বিশাল বপু হোমরা চোমরা সব শ্বেতাঙ্গদের দাপট। সামনের সব সিটেই কারো না কারো ব্যাগ রাখা। মাঝের দিকে কোনোমতে একটা সিট মিলল। কিন্তু এ বারও হাত তুলে বারবার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হল না। যে প্রশ্নটা করব ভেবেছিলাম, অন্য একজন করলেন। নোভোত্নার সঙ্গে ১৯৯৩-এর ফাইনালের প্রসঙ্গ উঠতেই সোনালি চুলে আঙুল চালিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালেন স্টেফি। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। উত্তরটা ভুলব না, ‘সেদিন ইয়ানা জিতলে হয়তো ভালো হতো, ও আমার যথেষ্ট ভালো বন্ধু। কিন্তু টেনিস কোর্টে যখন নামছি, আর সেটা যদি উইম্বলডন ফাইনাল হয়, তখন আপনি ছাড়া কেউ আপনার বন্ধু নয়! তাই না?’
খেয়াল করে দেখলাম, প্রেস কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দু’তিনজন পরিচিত সাংবাদিকের সঙ্গে হেসে দু’এক মিনিট কথা বললেন স্টেফি। তা হলে কি ওদের ধরব ফাইনালের আগে? যদি প্রেস কনফারেন্সে ওদের পাশে একটু বসা যায়!
ফাইনালে সামনে আরান্থা সান্চেজ ভিকারিও। তীব্র ঘাত-প্রতিঘাতের সেই ম্যাচে স্টেফি জিতেছিলেন, ৪-৬, ৬-১, ৭-৫। রুপোর থালা হাতে বিজয়িনীর হাসি-সহ স্টেফিকে দেখতে পাওয়াটা নিঃসন্দেহে জীবনের স্মরণীয়তম মুহূর্তগুলোর একটা।
ফাইনালে ভিড়ে ঠাসা প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্ন করার সুযোগ পাব না, জানতাম। অন্য ধান্দায় ছিলাম। বসেছিলাম দরজার কাছে। যেখানে সিকিওরিটি দাঁড়িয়ে। ওখান দিয়েই বেরোবেন স্টেফি। প্রেস কনফারেন্সে ছবি তোলার নিয়ম নেই। সেটা সেলফি যুগ নয়। কিন্তু অটোগ্রাফ তো চাওয়া যেতে পারে। এমনই কপাল, স্টেফি বেরোনোর সময় আমার আগেই খাতা বাড়িয়ে দিলেন গোটা তিনেক চিনা সাংবাদিক। স্টেফি দাঁড়াতেই আরও জনা দুয়েক। দুটো খাতায় সই করতে না করতে সিকিওরিটি এসে গেল। সঙ্গে রক্তচক্ষু। ‘নো অটোগ্রাফ হিয়ার!’
ইচ্ছে থাকলেও আর খাতায় সইয়ের রাস্তায় গেলেন না স্টেফি। কিন্তু সিকিওরিটিকে দাঁড় করিয়ে ‘কনগ্র্যাটস’ বলে এগিয়ে দেওয়া তিনটে হাতের সঙ্গেই মেলালেন হাত। তার মধ্যে একটা আমার! সেদিন আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোতে ফেরার সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, স্টেফি নয়, উইম্বলডনটা আমিই জিতেছি!
স্টেফি এখন থাকেন আমেরিকার লাস ভেগাসের নেভাডায়। স্বামী আন্দ্রে আগাসি, পুত্র জাডেন আর কন্যা জাজ এলকে নিয়ে সুখী সংসার। একেবারেই প্রচারবিমুখ। ছেলে এখন ২২, মেয়ে ২০। কেউই টেনিসে আসেনি। ছেলে জাডেন বেসবলে আগ্রহী আর মেয়ে প্রথমে হর্স রাইডিং এবং হিপ-হপ ড্যান্সিংয়ে আপাত ফ্যাশনের দুনিয়ায়।
ভারতে এসেছিলেন, তাজমহলের সামনে আগাসির সঙ্গে ছবিও আছে। কিন্তু কোথাও প্রেসকে মিট করেছেন বলে জানা নেই।
১৯৯৫ থেকে ২০২৩, ২৮টা বছর হু হু করে উড়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও নিস্তব্ধ রাত বা নিঝুম দুপুরে চোখ বুজলেই ভেসে আসে বাড়িয়ে দেওয়া ওই হাতের স্পর্শ। চোখে চোখ রেখে মিষ্টি হেসে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’!
দেখতে পাই সবুজ ঘাসের চিরকালীন রাজকন্যাকে। স্টেফানি মারিয়া গ্রাফ!
ক্রমশ