ধা রা বা হি ক । পর্ব ১
যত দিনটা এগিয়ে আসত, ততই শুরু হত সে সব। অবধারিত পেট গুড়গুড়, বুক ধুকপুক।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখতাম। একবার বিছানার কোণে পড়ে থাকা কেসি নাগ আর খাতাটার দিকে তাকাতাম। তার পরে সিদ্ধান্ত নিতাম, মোটামুটি পাশ মার্ক পেতে হলেও অন্তত ঘণ্টা দুই হাতে নিয়ে বেরোতে হবে। কপাল ক’রে যদি টাইমে বাস স্টপে পৌঁছে সাড়ে ন’টার ষোলো নম্বর বাসটা পাওয়া যায়, তা হলেই ওস্তাদের মার! অরিন্দমের ঠিক পাশের সিটটা কনফার্মড!
কিন্তু পাব তো ঠিক পাশের সিটটা? যদি না পাই? তা হলে? প্ল্যান বি কী হতে পারে? কাল্পনিক পরীক্ষার হল আর কড়া কোনও ইনভিজিলেটরের নিঃশব্দ পদচারণার ফাঁকে কী ভাবে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়তে হবে, তা নিয়ে একটা ছক মাথার মধ্যে খেলা করত। স্কেলের পিছনে ক্ষুদ্রতম হরফে সময় নিয়ে লিখে রাখতাম কিছু প্রয়োজনীয় উপপাদ্য, কয়েকটা দরকারি ফর্মুলা।মোজার ভিতরে বা বেল্টের ফাঁকে বিস্ময়কর দক্ষতায় চোতা লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে স্কুল জীবনে বহু মেসি বা রোনাল্ডোকে দেখেছি। মুগ্ধ চোখে সেসব শিল্প দেখেছি এবং আত্মস্থ করা চেষ্টা করেছি। চোতা বরাবরই একটা মহৎ শিল্প। যার বুকের পাটা আছে, সে পারে। যার নেই, সে হাঁ করে দেখে।
মাঝে মাঝে বিবেক জাগ্রত হতো। বারবার দুলে দুলে পড়ে মুখস্থও করে ফেলতাম কয়েকটা সমীকরণের অঙ্ক। কিন্তু মুখস্থ করে কে আর কবে অঙ্ক পরীক্ষার মহাসমুদ্র পার করেছে?
আর মুশকিল হল, আমাদের সেই ছেলেবেলায় প্রতিবারই অঙ্ক পরীক্ষা হতো একেবারে শেষে। সব কিছুর মতো এরও প্লাস-মাইনাস আছে। প্লাস বলতে, প্রথমেই বাউন্সারের মুখোমুখি হতে হতো না। নিশ্চিন্তে বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, জীবন বিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞানের সব গাঁট পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে মনে হত—অঙ্ক? ধুত্তোর, এখনও অ-নে-ক দেরি আছে! কিন্তু তার পরে একদিন সব শেষ হয়ে অঙ্ক পরীক্ষা আসতই। তার মানে একেবারে স্লগ ওভার। ছ’বল বাকি, ২২ করতে হবে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়! সেই আটের দশকে আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, টি-টোয়েন্টি বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। মহেন্দ্র সিং ধোনি বলে কোনও ফিনিশারও জন্মায়নি। ফলে ধোনিকে দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে ‘শেষ ওভারে দেখা যাবে’ কেস করতে গেলে যে টিনের মতো দুমড়ে মুচড়ে যেতে হবে, তা নিয়ে একটু একটু ধারণা ছিল। তবু জ্ঞানপাপীর মতো ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতাম।
অগত্যা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের সেই দিনটা শেষমেশ এসেই পড়ত। সাড়ে ন’টার মধ্যে কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে পড়িমরি করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড়নো। আমরা থাকতাম গোলপার্কের কাছে কাঁকুলিয়া রোডে। পড়তাম বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে। ইংরেজিতে যা-ই বলা হোক, বাংলায় বরাবরই বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত স্কুলবাস ছিল, কিন্তু এইট থেকে প্রাইভেট বাস। ফুলপ্যান্ট। সাদা শার্ট, সঙ্গে খাকি ফুলপ্যান্ট। সব গোঁফ বেরোচ্ছে, গলা ভাঙছে আর নিষিদ্ধ সব সোনার খনির প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। বিশাল একটা হলঘর ছিল স্কুলে, সেখানে দোতলার একটা গ্যালারি টাইপ ব্যালকনি। সেখানে স্কুল শুরু হওয়ার আগে আমরা সবাই কোরাসে হেঁড়ে গলায় ‘ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী’ বা ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গাইতাম।বাধ্যতামূলক। ওই গানের পরে শুরু হতো স্কুল।
স্কুলে যাওয়ার জন্য বাস ধরতাম রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচারের সামনে বাসস্ট্যান্ড থেকে। বেশির ভাগ সময়ই টার্গেট থাকত সরকারি ১৬ নম্বর বাস। নামতে হত ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের সামনে। সেখান থেকে হেঁটে স্কুল। আর পাঁচটা পরীক্ষার দিনের মতো মা অঙ্ক পরীক্ষার দিনও কপালে দইয়ের ফোঁটা দিত, বেরোনোর সময় দুগ্গা দুগ্গা বলতো। কিন্তু তাতে কী? অঙ্ক খাতায় মা দু্গ্গা উতরে দেবেন, এই ভরসা করতে পারিনি।
ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত বেশ চলছিল। একশোয় একশো বা পঁচানব্বই না পেলেও সত্তর-আশি অবধি দিব্যি মুখস্থ করে মেরে দেওয়া যেত। কিন্তু নাইন থেকেই হল মুশকিল। একে তো অ্যালজেব্রার গেরো, তার উপরে সুগ্রিবের দোসর হিসেবে যোগ হল অনুপাত-সমানুপাত, পরিমিতি-ত্রিকোণমিতি। বাড়তি বলতে জ্যামিতির ভয়ঙ্কর সব একস্ট্রা। উপপাদ্য মুখস্থ করে ম্যানেজ করা যায় ঠিক, কিন্তু এক্সট্রার নাম শুনলেই হু হু করে জ্বর আসত। পরে যখন খেলার সাংবাদিকতায় পেশায় এলাম, ক্রিকেটের স্কোর লিখতে গিয়ে সবশেষে এক্সট্রার অনুবাদে লিখতে হত অতিরিক্ত। কে না জানে, ক্রিকেটের একটা ইনিংসে নো বল, বাই, ওয়াইড বল, লেগ বাই—এসব যোগ করে যা দাঁড়ায়, তা ইনিংসের শেষে এক্সট্রা হিসেবে লেখা হয়। স্কোরে এক্সট্রা থেকে স্রেফ বাংলা অনুবাদ করে অতিরিক্ত শব্দটা বসিয়ে দাও। ব্যাস, কাজ শেষ! আনন্দবাজার স্পোর্টসে জয়েন করার পরে যতবার স্কোর লেখার সময় এক্সট্রা লিখতে হত, ততবার আশ্চর্য আনন্দে উদ্ভাসিত হতাম আমি। কী সোজা—এক্সট্রা। মাত্র একটা শব্দ অনুবাদ করলেই হল! অথচ মাধ্যমিকের আগে জ্যামিতির ওই এক্সট্রা কী তুর্কি নাচন না নাচিয়েছে এককালে! ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, সমকোণ—বড় জটিল ব্যাপারস্যাপার।
বালিগঞ্জ প্লেসের কাছে সোমেনদা বলে একজনের কোচিং ক্লাসে যেতাম বটে, কিন্তু ক্লাসে বসেই অঙ্ক খাতার পিছনে অবধারিত ঠাঁই পেত সদ্য বেরোনো ইন্দ্রজাল কমিক্সের সংখ্যা। সপ্তাহে সপ্তাহে বেরোত সেই সব আশ্চর্য কমিক্স। কী সব নাম ছিল সেই চটি বইগুলোর—মহাকালের চাবুক, বিষাক্ত নিঃশ্বাস, জলার ড্রাগন, শয়তানের স্বর্গ। বেতাল, জাদুকর ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডনের সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাহাদুর—গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা রোগা-সোগা যুবক। যার গার্লফ্রেন্ডের নাম ছিল বেলা। বাহাদুর চম্বলের ডাকাতদের সঙ্গে লড়ে শেষ পর্যন্ত জিতে যেত।
বাড়িতে আসত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা, সেখানে এক পাতা জুড়ে থাকত রঙিন অরণ্যদেব। কে আগে সেটা পড়বে, তা নিয়েও আমি আর আমার ভাই কম কাড়াকাড়ি করিনি। এর সঙ্গে ছিল আনন্দমেলার টিনটিন, সন্তু-কাকাবাবু, গোগোল, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, শুকতারার বাঁটুল দি গ্রেট। সপ্তাহে সপ্তাহে আমাকে মোহিত করে রাখত ডেনকালির জঙ্গল, খুলিগুহা, বুড়ো মজ, রেড ইন্ডিয়ানদের মতো টুপি পরা গুরান, রেক্স, মিস তাগামা আর অবশ্যই বেগুনি রঙের পোশাক ও নৌ-নীল রঙের ডোরাকাটা জাঙিয়া পরা বেতাল। চলমান অশরীরী।
কিন্তু চলমান অশরীরী তো আর অঙ্ক পরীক্ষার দিন আমাকে বাঁচাবেন না। জাদুকর ম্যানড্রেকও না। বাঁদরের বাঁশে ওঠানামার অঙ্কই হোক বা পরিমিতির ড্রামের ব্যাসার্ধ, দেখলেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা সাপ হু-উস করে নেমে যেত। আর অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাত? সেইসব রাত মানেই বিভীষিকা। বিভিন্ন সাইজের সব রাক্ষস আর খোক্কস নিরেট মস্তিষ্কে অহেতুক হামলা চালাত!
বিছানার উপরে অঙ্ক খাতা, কেসি নাগ আর এবিটিএ-র থান ইঁট সাইজ টেস্ট পেপার খোলা। গোমড়াথেরিয়ামের মতো মুখ করে কয়েকটা অঙ্কে শেষবার চোখ বুলোতে না বুলোতে প্যান্টের গোপন খাপ থেকে বেরোত সামান্য দুমড়ে যাওয়া নম্বর টেনের প্যাকেট। বহুদিন অবলুপ্ত, কিন্তু আটের দশকের মাঝামাঝি নম্বর টেন আর চার্মস ছিল আমাদের মতো বখাটেদের কাছে তখন খুব হ্যাপেনিং সিগারেট। নাইনের শেষদিকে সিগারেটে হাতেখড়ি, ধরা পড়ে বাড়িতে বেদম উত্তমমধ্যম—এসব পর্যায় পেরিয়ে ক্লাস টেনে তখন রীতিমতো নম্বর টেন প্রেমী। বিপদ বুঝলে এক চান্সে জ্বলন্ত সিগারেট ম্যাজিশিয়ানের মতো কৌশলে হাতের তুলোয় রেখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতে পারি, ফেলুদা স্টাইলে রিং ছাড়তে পারি আর ধরা না পড়ার জন্য অভূতপূর্ব মিথ্যের আমদানি করতে পারি অম্লানবদনে।
সে যা-ই হোক, সেই সব রাতে ফেরা যাক। রাত বাড়লে পাড়া যখন স্তব্ধতায় ডুবে যেত, রাস্তার নেড়িদের চিৎকার ছাড়া কিছুই শোনা যেত না, তখন অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাতে চুপিচুপি বারান্দায় গিয়ে নম্বর টেন ফুঁকে এলে কিছুটা টেনশন তো কাটতই। কিংবা মনে পড়ত ইতিহাস পরীক্ষা দিয়ে বেরোনোর সময় সহপাঠী ভুতোর মন্তব্য, ‘অঙ্ক নিয়ে এত দুঃস্বপ্ন দেখিস কেন? জানিস আরডি বর্মণ আমাদের স্কুলে পড়ত? বলতো, ক্লাস টেনে অঙ্কে কত পেয়েছিল? মাত্র ২২!’
সত্যজিৎ রায় আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিলেন। আরডি বর্মণও আমাদের স্কুলের প্রাক্তনী, সেটাও জানতাম। কিন্তু অঙ্কে কোনওদিন ২২ পেয়েছিলেন কি না, বা সেই তথ্য ভুতো কোন আশ্চর্য সংগ্রহশালা থেকে বের করেছিল, তা অবশ্য জানা হয়নি। জিগ্যেস করলে অবশ্য ভুতো কী বলত, আমার জানা ছিল। উদাস একটা চোখে বলত, ‘স্কুলের এক্স স্কলারদের নিয়ে কিসস্যু জানিস না। আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করাটা এ বার বন্ধ কর!’
ভুতোর কথায় যে খুব মোটিভেটেড হতাম তা নয়, কিন্তু জটায়ুর মতো মনে একটা আশ্চর্য বল পেতাম। সেই বয়সে লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসে পড়তে শুরু করেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’, পুজোসংখ্যায় হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছে নীললোহিতের সঙ্গে, সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ পড়ে শিহরিত হয়েছি। আর এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, মাথায় ঢুকে পড়েছে কবিতার ভূত। শৈশবে বিভিন্ন ফাংশনে রবি ঠাকুরের প্রশ্ন, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, আফ্রিকা, পুরাতন ভৃত্যের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি শুনে শুনে যখন ক্লান্ত, তখনই কী ভাবে যেন হাতে এসেছে ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’। কবির নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। একটা কবিতার নাম, ‘যদি পারো দুঃখ দাও’
পড়ে দেখছি আর একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ছি। এসব কী লিখেছে লোকটা?
‘যদি পারো দুঃখ দাও, আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি
দাও দুঃখ, দুঃখ দাও—আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি।
তুমি সুখ নিয়ে থাকো, সুখে থাকো, দরজা হাট-খোলা।’
এই লেখা তো আমার মনের কথাই বলছে। আমিও তো দুঃখ পেতে ভালোবাসি। অঙ্ক পরীক্ষা মানেই তো একরাশ দুঃখ। পাশের পাড়ার বারান্দার মেয়েটার চোখ মানেও দুঃখ। ওই যে মেয়েটাকে মাঝে মাঝে দেখি, সন্ধেবেলা কোচিং ক্লাস থেকে ফেরার সময় কীরকম ভাবে যেন তাকায়। কিন্তু তার পরেই মুখ ফিরিয়ে নেয়! কেন অঙ্ক করতে করতে ওই মুখটা মনে পড়ে? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে? ও কি কোনওদিন কথা বলবে আমার সঙ্গে? একদিন? সাহস করে বলব একদিন কথা? সেদিন পাশের পাড়ার রাজুকে বলতেই খিলখিল করে হাসি, ‘ওদিকে তাকাস না। ও মেয়ে ডেঞ্জারাস জিনিস। তোকে ছবি করে ছেড়ে দেবে! জানিস না, সুজনদার সঙ্গে ওর প্রেম?’
ছবি করে দেবে? তাই? সত্যিই মেয়েটা পারে ছবি করে দিতে? আবার একটা কবিতার কথা চলে আসে। অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাতে ঝরঝর করে বৃষ্টি আর বইয়ের মধ্যে চোখ।
‘বৃষ্টির ভিতরে কিছু অভিমান আছে।
জলে প’ড়ে ঠোঁট ফোলায়, করে লুকোচুরি,
ক্ষেতে ও খামারে প’ড়ে সোঁদা গন্ধ তোলে।
কেন তার অভিমান? পতনে-পীড়নে?’
তা হলে বৃষ্টিরও অভিমান আছে। এই বিপুল জলধারার অভিমান কি আমার মতো? কেন আমার মাথায় অঙ্ক ঢোকে না? সবাই টপাটপ অঙ্কগুলো করে ফেলে আর আমি কেন পারি না? সমীকরণের অঙ্কে বন্ধুরা কি সহজে এক্স ধরে নামিয়ে দেয় সেটা। টপাটপ সব সল্ভ হয়ে যায়। আমি কেন এক্স, ওয়াই, কিছুই ধরতে পারি না?
একে তো অঙ্ক দেখলেই শিরদাঁড়া দিয়ে সাপ নামে, তার উপরে গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো ছিল ঘরশত্রু বিভীষণের দল। কেন বুধবার সন্ধেয় চিত্রহার দেখলেই ছেলে বখে যাবে, কেন বাড়িতে এজন্য টিভি রাখা উচিত নয়, কেন ইন্দ্রজাল কমিক্স পড়লে পড়াশোনা আর কিছুই হবে না, এ নিয়ে বাবা-মায়েদের কানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কুমন্ত্রণা ভরে দেওয়ার মতো লোকজন চারপাশে গিজগিজ করত। অমুকের ছেলে আইআইটি পেয়েছে, তমুকের সেজ জ্যেঠুর নাতি জয়েন্টে ফাটিয়ে দিয়েছে—এসব শুনে শুনে কান পচে গিয়েছিল। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র না হতে পারলে জীবন পুরো ঠাণ্ডা চাউমিনের মতো হয়ে যাওয়া অবধারিত, এই প্রবাদবাক্য সেই যুগে ক্লাস নাইন থেকে কানে কাটা রেকর্ডের মতো বাজত।
কিন্তু সব কিছু সামলেও মনের মধ্যে আর একটা ভূত ঠিক ঘুরঘুর করত। সে ফিসফিস করে ঠিক বলত, বেশ করো, পারো না! ক্রিকেট তো খেলতে পারো। ওই যে আগের দিন পাশের পাড়ায় বুবলাদের সঙ্গে ম্যাচটায় একা জেতালে তুমি? উল্টোদিকে পটপট করে উইকেট পড়ে যাচ্ছে আর তুমি করাচি টেস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুনীল গাভাসকরের মতো দাঁতে দাঁত চিপে দাঁড়িয়ে থাকোনি? বেপাড়ার উইকেট, রকে পাজামা পরা সে পাড়ার বিশেষজ্ঞ কোচ সিগারেট হাতে দীপুদা, সে স্লেজিং করেনি? তুমুল করেছে। বারবার বুবলাকে বলেছে, পেসারটা আন। থ্রি কোয়ার্টারে ফ্যাল। ছেলেটা পারবে না। ধুসর রঙের ক্যাম্বিস বলটা যখন সোঁ সোঁ করে আসছিল, তখন তুমুল চাপ সহ্য করেও তুমি ক্রিজে থেকেছ। লাস্টম্যান বাবুনকে যাতে পরের ওভার খেলতে না হয়, লাস্ট বলে সিঙ্গল নিয়ে নিয়ে ম্যাচটা বের করে দাওনি?
দিয়েছ তো! কিন্তু কেউ বোঝেনি। ক্রিকেটটা মন দিয়ে খেলার কথা উঠলেই কানের কাছে ভেসেছে, ‘তুই কি গাভাসকর? যা, টেস্ট পেপার খুলে অঙ্ক নিয়ে বোস!’
সেসব দুঃসহ সন্ধেয় লো়ডশেডিং হতো আর হ্যারিকেনের আলোয় বসে টেস্ট পেপার খুলে অঙ্ক করতে বসতে হতো। কত অভিশাপ যে কেসি নাগ বলে ভদ্রলোককে দিয়েছি!
আসলে ক্যাম্বিস বলে বেপাড়ার বুকুনের পেস সামলানো এক জিনিস, অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আর এক। অগত্যা সকাল সকাল উঠে ষোলো নম্বর বাসের জন্য চোঁ-চা দৌড়। ক্লাস নাইন অনায়াসে অরিন্দমের পাশে বসে ওর খাতা টুকে হাফ ইয়ার্লি আর অ্যানুয়াল অনায়াসে উতরে দিয়েছিলাম, ক্লাস টেনের হাফ ইয়ার্লিও মেরে দিয়েছিলাম। কিন্তু মুশকিলটা হল প্রি-টেস্টে। আগের দিনই ভুতো একটা কাণ্ড করে বসল। অঙ্ক পরীক্ষার আগে সম্ভবত শেষ পরীক্ষা ছিল জীবনবিজ্ঞান। সেটা নামিয়ে দেওয়ার পরে দু’দিন গ্যাপ। তার পরে মহাযুদ্ধ। তা জীবনবিজ্ঞান পরীক্ষা শেষে অরিন্দমের সঙ্গে অঙ্ক পরীক্ষার দিন কোন বেঞ্চে বসাটা স্ট্র্যাটেজিক্যালি ঠিক হবে, এই ছকটা করছি, হঠাৎ ভুতো এসে অরিন্দমকে বলল, ‘গ্ল্যাক্সো, আমি বেশি চাই না। ১০০-এর মধ্যে ৩০টা নম্বর শুধু আমাকে তুলে দিস। বেশি চাইব না। তোর পিছনে বসব। না হলে একেবারে গাড্ডা খেয়ে যাব!’
টকটকে ফর্সা, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, গাবলু-গুবলু টাইপ। ক্লাস নাইন-টেনেও অরিন্দমের মুখে একটা বেবি ফ্যাট ছিল। সে সময় বেবি ফুড গ্ল্যাক্সোর বিজ্ঞাপনে বাচ্চাদের ছবি দেখিয়ে একটা গান হত, ‘আহা দেখলেই বোঝা যায় গ্ল্যাক্সো বেবি…।’ তা ক্লাসে অরিন্দমের নাম দ্রুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল গ্ল্যাক্সো। পরে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে এখন অরিন্দম বেঙ্গালুরুনিবাসী। নামী বহুজাতিক সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আজ নিউইয়র্ক তো কাল লন্ডন, পরশু জাপান তো পরের সপ্তাহে সুইৎজারল্যান্ড, এসব করে বেড়ায়। তার উপরে চমৎকার গানের গলা, আরডি-র সুরে কিশোরের গানে যে কোনও আড্ডা মাত করে দেওয়ার ব্যাপারে চোখ বুজে সেরা বাজি।
ভুতো তার আগেই আমাকে ম্যানেজ করেছে। আমি অনেকটা নিমরাজি টাইপস। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশটা ঠিক কতটা রিস্কি, বুঝতে পারছি না। গ্ল্যাক্সো সাহস দিল, ‘ভুতো তো পিছনে বসবে। তুই তো আমার পাশে। ম্যানেজ হয়ে যাবে!’
তা ঠিক সময়েই হাতে এল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। উপরে লেখা গণিত। তার তলায়, বাঁ দিকে পূর্ণমান ১০০। এর পরে লেখা থাকত, ‘প্রতিটি প্রশ্নের পাশে প্রদত্ত সংখ্যা প্রশ্নের পূর্ণমান দ্যোতক।’ যতদূর মনে আছে, অবজেক্টিভ দুই নম্বর করে দশটা মানে ২০ নম্বর, পাটিগণিত ২০, অ্যালজেব্রা ৩০, জ্যামিতিতে ১০, পরিমিতি-ত্রিকোণমিতিতে ২০ নম্বর থাকত।
এক একটা ছোট বেঞ্চে দু’জন বসতে পারত। গ্ল্যাক্সো মানে অরিন্দমের পাশে আমি, পিছনের বেঞ্চে ভুতো। সকাল এগারোটায় ঢং ঢং করে বাজল স্কুলের নেপালি দারোয়ান বাহাদুরের ঘণ্টা আর শুরু হল ম্যাচ। প্রথমেই অবজেক্টিভ মানে টি-টোয়েন্টির পাওয়ার প্লে। চার-পাঁচ লাইনের অঙ্ক, নামাতে পারলেই দু’নম্বর।
সেই সময় পরীক্ষকরা ছিলেন একেবারে হিটলার ইন্টু একশো। সেই ক্লাস টেন থেকে শুনে আসছি, টেস্ট বা মাধ্যমিকে প্রশ্ন সহজ হতে পারে, কিন্তু প্রি-টেস্ট হচ্ছে গাঁট। যত কঠিন প্রশ্ন, ততই বিজাতীয় আনন্দ পান হিটলাররা। প্রশ্নপত্র হাতে আসতেই বুঝলাম, যা বুঝছি, মেরে-কেটে ২৫-৩০ পেতে পারি। তার পরে ‘হাতে রইল পেন্সিল’ হয়ে যাওয়া অবধারিত। স্বয়ং ভগবান আমার হয়ে ব্যাট হাতে ক্রিজে গেলেও তার বেশি একটুও এগোতে পারব না।
আর এমনই কপাল, সেদিনই ইনভিজিলেটর হিসেবে ক্রিজে দেবব্রতবাবু! রাশভারী চেহারা, মোটা গোঁফ, শেষ কবে জীবনে মন খুলে হেসেছেন, কেউ দেখেনি। অঙ্ক পড়াতেন বটে, কিন্তু থানার অতিরিক্ত দক্ষ বড়বাবু হিসেবে বেশি মানাবে। যেসব ইনভিজিলেটর পরীক্ষার হলে দশ পনেরো মিনিট ঘুরে তার পর ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পড়েন, তাঁরা আমাদের খুব ভালোবাসার। তখন জীবন মানেই, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!’
কিন্তু সে ভাগ্য বেশির ভাগ সময়েই হতো না। বেশির ভাগ সময় দেখেছি, গার্ড দেওয়ার সময়ে কেউ কেউ অকারণে শার্লক হোমস বা ফেলুদা হতে পছন্দ করেন। সব সময়েই চোখ ঘুরছে, সারাক্ষণ এপাশ থেকে ওপাশ গম্ভীর মুখ নিয়ে টহল চলছে। দেবব্রতবাবু এই শার্লক ঘরানার। সব সময়ই রেড অ্যালার্ট জোনে থাকতে হয়। কাজ সারতে হয় অত্যন্ত সন্তর্পণে। একটু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যাওয়া অবধারিত। তিনটে স্টাম্পই মাটিতে গড়াগড়ি খাবে!
ম্যাচ তো শুরু হয়েছে। বাঁ দিকে গ্ল্যাক্সো। দ্রুত নামাচ্ছে একের পর এক অবজেক্টিভ। আড়চোখে ওর খাতায় চোখ রেখে নিখুঁত দক্ষতায় কপি করছি। পাশের লোকের খাতা দেখে টুকতে চাইলেই কিন্তু টোকা যায় না। মাথা সোজা থাকবে, চশমা এমন ভাবে নামানো থাকতে হবে, যাতে ইনভিজিলেটর ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না করে। তাকাতে হবে আড়চোখে, নির্দিষ্ট একটা অ্যাঙ্গলে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নার্ভ। একেবারে টি-টোয়েন্টিতে শেষ ওভারের নার্ভ। কোনও পরিস্থিতি থেকেই যেন বোঝা না যায়, টোকাটুকি চলছে। স্কেলের পিছনে খুদে অক্ষরে লেখা ফর্মুলা টোকা বা পকেট থেকে চোতা বের করারও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ইনভিজিলেটর যখন ঘুরতে ঘুরতে হলের অন্য প্রান্তে যাবেন, তখনই বের করতে হবে সোনার খনি। খাতার ফাঁকে এমন ভাবে রাখতে হবে, যাতে কাক পক্ষীও ধরতে না পারে। শহরের যে কোনও স্কুল বা কলেজের ক্লাসরুমে যান, দেওয়ালে চোতা শিল্পের নানা আশ্চর্য ভ্যারিয়েশন চোখে পড়বেই। কোথাও অ্যালজেব্রার ফমুর্লা পেন্সিলে বা ডট পেনে লেখা, কোথাও বা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের দশটি কারণ এক সেন্টিমিটার জায়গার মধ্যে লেখা আছে পিঁপড়ের সাইজের অক্ষরে।
সে যা-ই হোক, প্রথম আধ ঘণ্টা নিশ্চিন্ত। গ্ল্যাক্সো হু হু করে রান তুলছে, পাশে আমি। কিন্তু ভুতো আমাদের সঙ্গে পারবে কেন? সেই স্কিলই তো ওর নেই। নেট প্র্যক্টিসই তো কোনওদিন করেনি! ও দিকে, গ্ল্যাক্সোর সঙ্গে আমার আশ্চর্য বোঝাপড়া। একেবারে সচিন-সৌরভ জুটি। ইতিহাসে আমাদের ঠিক করা থাকে, কে চন্দ্রগুপ্তটা মন দিয়ে পড়বে, কে আকবর বা ঔরঙ্গজেব। জীবন বিজ্ঞানে ও যদি ব্যাঙের পৌষ্টিক তন্ত্রটা গ্রিপে রাখে, তো আমি মাথায় রাখি সালোকসংশ্লেষ। এইরকম আর কী! সব কিছুতেই সিলেবাসে মোটামুটি ফিফটি-ফিফটি শেয়ার। তার পরে হলে খাতা পাল্টাপাল্টি করতাম তুমুল দক্ষতায়। শুধু অঙ্ক পরীক্ষায় আমার নন স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনও ভূমিকা নেই। সেদিন আমি নেহাতই লাস্টম্যান। লাস্টম্যানকে যেমন বড় ব্যাটার শেষ বলে সিঙ্গল নিয়ে নিয়ে বাঁচায়, সেরকমই আমাকে বৈতরণী পার করে দেওয়ার পুরো দায়িত্ব গ্ল্যাক্সোর উপর।
মুশকিলটা হল কী, সেদিন আধ ঘণ্টা পর থেকেই ভুতো উসখুস করতে শুরু করল। ও গ্ল্যাক্সোর স্পিডের সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না। ফলে অধৈর্য হয়ে শুরু করেছে আমার পিঠে আঙুল দিয়ে খোঁচা মারা। ওর খোঁচায় বিরক্ত হয়ে একটু সাইড করে বসেছি, যাতে আমার খাতাটা ও পিছন থেকে দেখতে পারে, আর তার থেকেই হয়ে গেল সর্বনাশ।
সোজাসুজি দেবব্রতবাবুর খপ্পরে। ‘অ্যাই, তোদের এত গুজুরগুজুর কীসের রে? তখন থেকে দেখছি–’ এর পরেই একেবারে আমার সামনে এসে কড়া গলায়, ‘ওঠ তুই। যা ফার্স্ট বেঞ্চে গিয়ে বোস।’
‘কিছু করছিলাম না স্যর,’ বলে শেষরক্ষার একটা ট্রাই নিতে হয়। নিয়েওছিলাম। কাঁচুমাচু মুখে এসব কাকুতি-মিনতি কবেই আর শার্লক হোমসরা শুনেছে?শোনেনি! তাই অবধারিত উত্তর এল, ‘ওঠ বলছি। ফার্স্ট বেঞ্চ! যা!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ভুতোর দিকে রক্তচক্ষু হেনে বিড়বিড় করে উঠে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ফার্স্ট বেঞ্চ! সামনের সারি। সারা জীবন ব্যাপারটা থেকে শত হস্ত দূরে থেকেছি। সুবোধ বালকেরা ওখানে বসে। যারা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে স্কুলে আসে, প্রতি ক্লাসে প্রতিটা হোমওয়ার্কে ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পায়, টিফিন বক্স খুলে নিজের টিফিন মন দিয়ে গুছিয়ে খায়। স্কুলের গেটে দাঁড়ানো ফুচকাওয়ালার দিকে মা বারণ করেছে বলে যায় না, তেঁতুল গোলা জল খায় না, সিঁড়ির নীচে গোপালদার দোকানের বাদাম বিস্কুটে ভুলেও কামড় দেয় না। জিগ্যেস করলে বলে, ‘ওসব খেলে পেট খারাপ করবে!’
আমার আবার ওসবেই বরাবরের অপরিসীম আগ্রহ। বাদাম বিস্কুটের জন্য প্রাণ দিতে পারি, টিফিন বক্সের ডিম টোস্ট, অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের চিনির গোলার মতো খেতে শুকনো ক্ষীর কদম্ব আর কলা, মায়ের যত্ন করে কেটে দেওয়া আপেল একেবারেই মুখে রোচে না। বাড়ি ফেরার আগে মায়ের ভয়ে সাবধানে স্কুলের নর্দমায় ফেলে দিই। তার বদলে লুকিয়ে জমানো আট আনা দিয়ে গেটের ফুচকা অনেক আকর্ষণীয়। ক্লাসে সুনীলবাবু যখন অঙ্ক পড়ান, ফার্স্ট বেঞ্চ যখন গভীর মনোযোগে সেসব লেখে, আমি তখন লাস্ট বেঞ্চে বসে অঙ্ক খাতার পিছনে রাখি ইন্দ্রজাল কমিক্সের গত শনিবার বেরোনো সংখ্যা। এত অনাচারের একটা ফল ভুগতে হবে না? তাই অঙ্ক পরীক্ষার দিনই আধ ঘণ্টার মধ্যে ফার্স্ট বেঞ্চ!
যথারীতি পেন মুখে করে বসে। ততক্ষণে ২২ নম্বরের উত্তরও করতে পারিনি। তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় মোটামুটি দেড় ঘণ্টা হতে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে শীর্ষেন্দুর সেই অমর লাইন, ‘বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো!’ টিনটিনের কমিক্সে চরিত্রদের মাথায় আঘাত লাগলে যেমন নানা রকম চিহ্ন আর তারা আঁকা ছবি থাকে, মাথার মধ্যে সেই সব হচ্ছে। একটা অ্যালজেব্রার অঙ্ক কমন পড়েছিল বলে কোনওরকমে নামিয়েছি, কিন্তু আর এগোতে পারছি না। চার পাশে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, বাকিরা সবাই আইনস্টাইন! শুধু আমিই গণ্ডমূর্খ! সবাই খসখস করে অঙ্ক কষেই চলেছে।
তখনও বিশ্বাস করতাম, আজও করি- জীবনে একটা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আর একটা দরজা ঠিক খুলে যায়। শুধু দরজাটা চিনতে হয়, সাহস করে ঢুকে পড়তে হয়। জীবন ঠিক রাস্তাটা সাজিয়ে রাখে। ওই যে ইংরেজিতে বলে না, ‘নো রিস্ক, নো গেইন।’ কী হলে কী হতে পারে, সেই নেতিবাচক ভাবনায় মনকে আচ্ছন্ন না করে ঝুঁকিটা নিয়ে ফেলাই আসল। মনের মধ্যে একটা সম্ভাবনার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সুযোগটা নিতে পারব কি না, নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু জানতাম, ওটাই লাস্ট চান্স। পারব?
ঠিক দেড় ঘণ্টায় ইনভিজিলেটর বদল হয়। তখন দেবব্রতবাবু রিসেস নেবেন। টানা তিন ঘণ্টা কোনও টিচারই গার্ড দেন না। দেড় ঘণ্টা পরে অন্য কেউ আসেন বাকি দেড় ঘণ্টার জন্য। আজ কেউ আসছে না কেন?
এল ঠিকই। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট নাগাদ। দরজার কাছাকাছি কাশীনাথ খামরুইয়ের মুখ। কাশীনাথবাবুও অঙ্ক পড়াতেন, সাদা ধুতি, সাদা গিলে করা পাঞ্জাবি, শার্লক হোমস গোত্রের মোটেই নন। বীরদর্পে গোটা হল ঘুরে বেড়ানো নয়, চেয়ারে বসে মাঝে মাঝে চারদিকে তাকানোই তাঁর প্রিয় হবি। সেফ বেট!
গার্ড বদল হচ্ছে, দরজার দিকে যাচ্ছেন দেবব্রতবাবু, কাশীনাথবাবু ঢুকছেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনের হাসি বিনিময় হচ্ছে। হাতে বড়জোর পনেরো সেকেন্ড। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে একটু নীচু হয়ে একটা লম্বা লং জাম্পে গ্ল্যাক্সোর পাশে পুরনো সিটের সামনে এবং সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ওরই পাশের সিটে। এই কয়েক মাস আগে গ্ল্যাক্সো মানে অরিন্দম ওর একটা ফেসবুক পোস্টে লিখেছে, অমন চমৎকার লং জাম্প নাকি ও জীবনে একবারই দেখেছে! জিও!
তা দেখুক। দেবব্রতবাবু বেরিয়ে গেলেন, কাশীনাথবাবু ঢুকে নিজের চেয়ারে বসলেন হেলেদুলে। সহপাঠীরা দু’একজন কেসটা দেখেছে বটে, কিন্তু বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া কী আর করবে? কী ঘটে গেল, বাকিরা বুঝলই না। শুধু ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে আমি ব্যাক টু পুরোনো সিট! গ্ল্যাক্সোর পাশে। বাকিরা? আইনস্টাইন হতে ব্যস্ত ছিল।
অতএব পরবর্তী দেড় ঘণ্টায় রান উঠল ঝড়ের গতিতে। গ্ল্যাক্সোর খাতাটাই তো আমার জিম্মায় চলে এল! আর দ্রুত লিখতে পারার ব্যাপারে আমার সুনাম আজও নকুড়ের সন্দেশ লেভেলের। মারাত্মক ব্র্যান্ড ভ্যালু! এখানে চলমান অশরীরী এলেও কোনও কথা হবে না। আমার সঙ্গে পারা একটু মুশকিল আছে। যারা জানে, তারা জানে। যারা সাংবাদিকতায় আমার সহকর্মী ছিল বা এখনও আছে, তারা সব্বাই জানে।
প্রি টেস্টে অঙ্কে গ্ল্যাক্সো সম্ভবত ৯২ পেয়েছিল, আমি ৭১। ওই দেড় ঘণ্টা নষ্ট না হলে আমিও কাছাকাছি থাকতাম। আর মাধ্যমিকে কত পেয়েছিলাম? ৯৫! কী করে? অবশ্যই সৌজন্য গ্ল্যাক্সো তথা অরিন্দম! রেজাল্ট দেখে আমি নিজেই চমকে চৌষট্টি! তাতে গ্যাস খেয়ে অতি উৎসাহী হয়ে হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্স নিতে গিয়ে অবশ্য মাস দুয়েকের মধ্যে ৪২ অল আউটের মতো ভরা়ডুবি হয়েছিল। কেমিস্ট্রি ক্লাসে ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ আর ফিজিক্স ক্লাসে ‘ঘুণপোকা’ পড়লে যা হয়! অঙ্ক ক্লাসে পাতার পর পাতা কবিতা লিখলে যা হয়!
সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রবাদপ্রতিম ফাদার হুয়ার্ট ভাগ্যিস তিন মাস পরে আমাকে ইকো-স্ট্যাট-ম্যাথস স্ট্রিমে অ্যালাও করেছিলেন। আবার ম্যাথস? কী করব, আর সাবজেক্ট ছিল না যে!
এ বার হায়ার সেকেন্ডারিতে অঙ্কে কত? এমনিতে ফার্স্ট ডিভিশন, কিন্তু অঙ্কে ২০০-র মধ্যে ৪৩! বুরুন তুমি অঙ্কে তেরোর চেয়ে ভালো তো বটেই! গর্বিত হওয়ার মতো, বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখার মতো রেজাল্ট!
গ্ল্যাক্সো ছাড়া স্কুলে সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল পার্থ। দীপ্ত জ্বলজ্বলে চোখ, চমৎকার ফুটবল খেলত, গায়ের রঙটা কালোর দিকে ছিল বলে নাম হয়ে গিয়েছিল কেলটে। আজও খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কলকাতার ফর্টিস হাসপাতালের অত্যন্ত নামী ডাক্তার। গ্ল্যাক্সো চমৎকার বাংলা লেখে, একটা উপন্যাসও লিখে ফেলেছে সম্প্রতি। পার্থও লেখে দারুণ। কোভিডের দিনলিপি বলে ফেসবুকে যে লেখাগুলো লিখেছিল, বড় ভালো সেসব লেখা। আমরা তিনমূর্তি একটা সময়ে যে সব দিন কাটিয়েছি, অরিন্দমদের একডালিয়া প্লেসের বাংলো টাইপ বাড়ির প্রতিটি ইঁট সেসব জানে। অরিন্দমের মা মানে আমাদের কাকিমা এখনও বেঁচে, আমাদের বহু অত্যাচার কাকিমা হাসিমুখে সহ্য করতেন।
সে যাই হোক, গত বছর যখন সেকেন্ড ওয়েভের সময়ে হঠাৎ কোভিড হল, চারপাশে শুধু মৃত্যুর খবর, যথারীতি পার্থের নম্বরে ডায়াল করলাম। ‘শোন না, আমি পজিটিভ বুঝলি। ভাইরাল লোড কী একটা সেভেনটিন বলছে। মানে কী রে? মরে যাব? বলবি?’
উল্টোদিকে খিকখিক হাসি। ‘মরে যাবি? ফোট! যা বলছি শোন। হোয়াটসঅ্যাপে যা যা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, আনিয়ে নে! একটা স্ক্যান করা। তার পরে রিপোর্টটটা আমাকে পাঠা। আর সিনেমা-টিনেমা দ্যাখ। চাপ নিস না। মাচ ডিজার্ভড ব্রেক। বুঝলি।’
‘খুব ভয় করছে রে। টেঁসে যাব মনে হচ্ছে!’
পার্থ আবার হাসে, ‘সে তো প্রতিবার অঙ্ক পরীক্ষার আগে তুই টেঁসে যেতিস। মনে নেই?’
মনে আবার নেই? অক্ষরে অক্ষরে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মনে আছে। পরের ২১ দিন পার্থ যে ভাবে আমার সঙ্গে ছিল, তা ঠিক লিখে বলার কোনও মানে হয় না। এখন আর অঙ্ক করতে হয় না। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দেখি অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির মোটা মোটা বই। দোকানি জিগ্যেস করে, ‘নেবেন দাদা?’
ওরে বাবা! আমি ফুটপাথ বদল করে নিই। বরং ধ্যানবিন্দুর স্টলের দিকে যাই। কিংবা দে’জ বা সিগনেট।
আমার কৈশোরের দিনগুলোয় অঙ্ক খাতার প্রতি খাতায় এই সব রহস্য ছিল, ছিল নিষিদ্ধ সব সোনার খনি। ইন্দ্রজাল কমিক্স আবার চলে আসছে মাথায়। জাদুকর ম্যানড্রেকের গল্পে একেবারে শেষে প্রেমিকা নার্দা জিগ্যেস করত ম্যানড্রেককে— কী করে করলে?
ম্যানড্রেকের মুখে থাকত অদ্ভুত একটা হাসি। তার পর কী বলতেন?
‘জাদুকররা কখনও বলে না!’
ঠিক তেমনই আমিও কিছু বলি না। শুধু সোম থেকে শনি, দিনগুলোকে গড়িয়ে দিই। যাক না, যে দিকে খুশি যাক!
ক্রমশ