Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৩

স ব্য সা চী   স র কা র

নিষিদ্ধ সব সোনার খনি

sabyasachi

এক টানেতে যেমন তেমন…

নিষিদ্ধ গল্পে আসল নামটা গোপনই থাক। ধরা যাক, ছেলেটির নাম অর্জুন। পড়ে কলেজে। এখান থেকেই শুরু হোক তা হলে…

ক্যান্টিন থেকে বেরোনোর মুখে হঠাৎ সামনে অর্জুন। ‘টিফিনের পরে তোর অনার্স ক্লাস আছে?’

‘কেন বল তো?’

‘ইম্পর্ট্যান্ট না হলে কেটে যা! এক ঘণ্টা পরে বাড়িতে আয়।’

‘বাড়িতে?’

 ‘হ্যাঁ, বাড়িতে। আর কথা বাড়াস না। আসিস কিন্তু।’ উদাস একটা মুখ করে ক্যান্টিন ছাড়ল অর্জুন। অদ্ভুত ভাবে হাসতে পারত ছেলেটা। আর যখন ওই ভাবে চোখ মেরে ‘আসিস কিন্তু’ বলত, তার একটা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল। চুম্বকের মতো টানত আমাকে ওদের বাড়িটা। মল্লিকবাজার মোড় থেকে পার্ক সার্কাসের দিকে সোজা হাঁটলে প্রথমেই ডান দিকে পড়ত বিখ্যাত সিরাজ রেস্তোরাঁ। যা এখন রাস্তার উল্টোদিকে। তারপরে আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলে গ্রিন হাউস বলে একটা স্ন্যাক্সের দোকান। তার পরেই ছিল অর্জুনদের বাড়ি। ঠিকানা ৮৪বি, পার্ক স্ট্রিট। আলো আঁধারি অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিন তলায় ছিল ওদের ফ্ল্যাট। পুরনো আমলের বাড়ি।

মাধ্যমিকের পরে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে ইংলিশ অনার্স। ইলেভেনের শুরুর দিনগুলো থেকেই অর্জুন অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে। আমি ইংরেজিতে হলেও ও ছিল অঙ্ক অনার্সে। ক্যালকুলাস হোক বা অনার্স ক্লাসের জটিল সব অঙ্ক, অত্যাশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় সে সব সমাধানের দুর্লভ ক্ষমতা ওর ছিল। আর ভালোবাসত কবিতা। তখন কলেজে কবিতার ভূত মাথার মধ্যে অষ্টপ্রহর নাচছে। ডায়েরির পাতা ভরে উঠছে দ্রুত, প্রেমেও পড়েছি সহপাঠিনীর। পার্ক স্ট্রিটের ওই তিন তিলার ফ্ল্যাটে ওর ছোট ঘরটায় বহু আশ্চর্য সময় সেই আটের দশকের শেষে ও নয়ের দশকের গোড়ায় কাটিয়েছি। ওই ঘর জানে আমাদের প্রথম অনেক কিছু।

তা সেদিনও অনার্স ক্লাসটা শেষ করেই দৌড়োলাম অর্জুনের বাড়ি। অর্জুনের বাবা হোমিওপ্যাথির নামী ডাক্তার, ভালোই পসার ছিল। মা কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। এক বোন ছিল, কিন্তু আমি যখন ওদের বাড়িতে যেতাম, তখন প্রায় রোজ দিনই সে কোচিং ক্লাসে। কলেজ শেষে যখন দুপুর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ অর্জুনদের বাড়ি যেতাম, মা-বাবা বাইরে, বোনও থাকত না। ফলে সেই সব মহার্ঘ্য দুপুরে অর্জুনের ‘খেল’ শুরু হতো।

সেদিন যেমন ওর বাড়িতে পৌঁছে দেখি, পুরো ঘর অন্ধকার। দরজা-জানালা বন্ধ। একটা গোল গলা টি-শার্ট আর বারমুডা পরা অর্জুন। বলল, ‘দরজায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে ঢোক এ বার!’

‘ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?’

‘চুপ,’ বলে আমার হাতটা ধরে নিজের ছোট্ট ঘরটায় নিয়ে এলো অর্জুন। এই ঘরটাও অন্ধকার, শুধু পাখা চলছে। আর নীলাভ নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। চারদিকে ছড়ানো বই-খাতা। বিছানার চাদর দুমড়ে-মুচড়ে আছে। পুরোপুরি অগোছালো আর অবিন্যস্ত একটা ঘর।

‘তুই তো ক্যান্টিনে আমার দিকে ভালো করে তাকালিই না। কীভাবে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছিলাম, দেখেছিস?’

আমি চুপ করে আছি। খেয়াল করিনি। এ বার অর্জুন হঠাৎ ‘এই দ্যাখ’ বলে গোল গলা টি-শার্টটা খুলে ফেলল।

‘পিঠটা দ্যাখ!’

পিঠের উপরে কালো কালশিটে পড়ে গিয়েছে। বেশ কয়েকটা আঘাতের দাগ। আমি বললাম, ‘বেদম মার খেয়েছিস মনে হচ্ছে! কোথায় চাঁদু? অন্যের প্রেমিকার দিকে হাত বাড়িয়েছিলি?’

অর্জুন হাসল। ওর সেই অদ্ভুত হাসিটা। কিছুটা নিষ্পাপ, কিছুটা জটিল সেই হাসি। ‘নাহ, তেমন কিছু নয়। জানিস, বলা নেই, কওয়া নেই, বাপ বেধড়ক কেলাল!’

 ‘কেন?’

 ‘বললে হাসবি। তুই তো আবার কবিতা-টবিতা লিখিস!’

 ‘বল কেন মার খেলি? বল? এ ভাবে কেউ মারে?’

‘মারে, আমার বাপ মারে! কেন মেরেছে জানিস? উল্টোদিকের গলিতে রেজিনা বলে যে মেয়েটা থাকে, তার সঙ্গে সন্ধেয় দু’দিন পার্ক সার্কাস ময়দানে বেরিয়েছিলাম। কেউ এসে আমার ঢ্যামনা বাপকে লাগিয়ে দিয়েছে। আলটিমেটাম দিয়েছে, রেজিনার সঙ্গে আর একটা কথা বললে বা কোথাও দেখলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে!’

‘রেজিনা? সে কে? আগে বলিসনি তো?’

‘আরে সবে আলাপ, নিরঞ্জন স্যারের কোচিংয়ে। উল্টোদিকের গলিতে থাকে। মুসলিম ফ্যামিলি। আর আমার বাপের ওখানেই অবজেকশন!’

‘বাওয়াল হয়েছে?’

‘হেব্বি বাওয়াল। বলছে, বামুন বাড়ির ছেলে হয়ে মুসলিম মেয়ের সঙ্গে ঘুরছ? বাপের হোটেলে থেকে এসব চলবে না! আমি বলেছিলাম, বেশ করেছি। তখনই মার শুরু হলো। শোন— আমি রেজিনার প্রেমে পড়ে গেছি। তুই সেদিন সেই কবিতাটা বলছিলি না— সেই কবিতাটার মতো!’

‘কোন কবিতাটা?’

‘ওই যে বল না— তিন মাস না কী যেন? ওই জায়গাটা পড়— যেখানে ছিল না, হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার—’

 ‘ওহ, ভাস্কর চক্রবর্তী?’ তখন কলেজের ব্যাগেই বাইবেলের মতো থাকে ভাস্করদার বই। শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা। খুলে পড়তে বাধ্য করে অর্জুন। আমি পড়তে থাকি…

‘এখন আমি মানুষের মতো না— রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে

হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার— ভালোবাসার কাছে দীর্ঘ তিনমাস

আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না— আমি

মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই

তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি এখন— যে-দিক দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই

কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো’

পড়া শেষ হতে না হতে অর্জুন বলে, ‘আমারও জানিস লাফ দিতে ইচ্ছে করে হঠাৎ। আমাদের এই তিন তলার বারান্দা থেকে— যদি দিই?’

আমি আঁতকে উঠলাম। ‘গাণ্ডুর মতো কথা বলিস না। ছেলেমানুষির একটা সীমা আছে!’

অর্জুন বলে, ‘তুই ইডিয়ট। আমাকে মারল অমানুষের মতো, সেটা মেনে নিতে পারি। কিন্তু আমি জানি, সকালে রেজিনাদের বাড়ি গিয়ে ওর আব্বুকেও কথা শুনিয়ে এসেছে আমার হারামজাদা বাপ! ওর বাড়ি থেকে বেরনোই বন্ধ হয়ে গেছে! এরা আবার ডাক্তার! একগাদা মুসলিম পেশেন্ট!’

চুপ করে বসে থাকি। ফের ভাস্কর চক্রবর্তী মাথার পোকা নড়িয়ে দেন অনায়াসে—

‘সে পেতে রেখেছিল পুরোনো বিছানা—

           নতুন ভাবে ঘুমোতে চেয়েছিল কিছুক্ষণ—’

অর্জুন ততক্ষণে বেডসাইড টেবলের পাশ থেকে বের করেছে একটা কাগজের মোড়ক আর সিগারেটের প্যাকেট।

একটা সিগারেট বের করে সেটা ঘুরিয়ে তামাকটা ফেলে দিতে থাকে একটা কাগজের উপরে। তার পরে কাগজের পুরিয়াটা বের করে বলে— ‘কী জিনিস এটা জানিস?’

‘কী?’

‘গাঁজা। শিব ঠাকুরের প্রসাদ। একেবারে অরিজিনাল মাল। ফ্রেশ! বানিয়ে দিচ্ছি। দুটো টান দিয়ে দ্যাখ কেমন লাগে?’

‘তুই কবে থেকে এসব ধরেছিস?’

 ‘চোপ! একদম জ্ঞান দিবি না!’

 অপটু হাতে গাঁজার পুরিয়া থেকে বিচিগুলো ফেলে তালুতে ফেলে দলছিল অর্জুন। এক সময় বানিয়েও ফেলল গোটা দুই সিগারেট। তার পরে বলল, ‘একটা কল্কে কিনতে হবে বুঝলি? কুমোরটুলি থেকে! নে, ধরা!’

সিগারেটে বহুদিনই হাতেখড়ি হয়েছিল, কিন্তু গাঁজা? ওই বিষণ্ণ আবহে অর্জুনের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। প্রতিক্রিয়া যে কী হতে পারে, তা নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। হতে শুরু করল কিছুক্ষণের মধ্যেই। অর্জুনের চোখ ঘোলাটে হয়ে এসেছে। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঘরে গিয়েছে ঘরটা। নীলাভ আলো। তার মধ্যে হলুদ একটা টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে অর্জুন। কিছুতেই টিউব লাইট জ্বালাতে দেবে না। তাতে নাকি ধুমকি কেটে যাবে। আমি ফের পড়ছি কবিতা— ডুবে যাচ্ছি ভাস্কর চক্রবর্তীর মধ্যে…

‘সত্যি, ইদানীং আত্মহত্যার কথাও ভাবি। নোংরা মশারির নীচে কাণ্ডজ্ঞানহীন শুয়ে আছি দুমাস তিন মাস। সন্ধে হলেই ঘরের ভেতর প্রতিদিন একটা হলুদ আলো জ্বলে ওঠে, আর জানায় যে বেঁচে আছি আমি। ঠোঁট দুটো বোধহয় ফুলতে শুরু করেছে। তবে, মাথাটা ঠিক আছে এখনও। বিছানা থেকে উঠে বারবার নিজের মুখদেখি আয়নায়। আজকাল একটুও আর কষ্ট পাই না। – একটি মেয়ে, ট্যাক্সির ভেতর গতকাল একা-একা কাঁদছিল।’

এ বার অর্জুন সত্যিই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। হা হা করে হাসছে, তার পরেই হাউহাউ করে কান্না। আবার ড্রয়ার খুলে বের করেছে ব্লেড। হাতের উপর সেটা দিয়ে রেজিনার নাম লিখবেই। যত ব্লেডটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তত হা হা করে হাসছে— ‘তুই তো কবি। কোনওদিন ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটেছিস?’

এক সময়ের অসতর্ক মুহূর্তে ব্লেডটা কেড়ে নিই। কিন্তু তাতে অন্য সমস্যা। এ বার অর্জুন বলছে, ‘ভাবছিস, এ ভাবে জিতে যাবি? আমি এখন লাফ দেব তিন তলার বারান্দা থেকে। দেখি, কী ভাবে আটকাস তুই!’

ওর মতো গোটা তিনেক সিগারেট না হলেও একটা গাঁজা ভরা সিগারেট তো আমিও টেনেছি। চোখ ঘোলাটে আমারও। শরীরটা পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। পা টলে যাচ্ছে। তা-ও অর্জুনকে আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার মতো রোগাসোগা নয়, অসুরের শক্তি তখন ওর গায়ে। এক ধাক্কা মেরে আমাকে টেবিলের ধারে ছিটকে দিয়েছে। তবু মরিয়া আমি কোনওরকমে ঘরটার ছিটকিনি খুলতে দিচ্ছি না। যদি সত্যিই বাইরে বেরিয়ে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেয়, ওর সঙ্গে আমি পারব না।

এক সময় ক্লান্ত হয়ে কাঁদতে লাগল অর্জুন। মাটিতে উবু হয়ে বসে হাউহাউ করে কাঁদছে। তার পরে বেসুরো গলায় গাইছে, ‘এক টানেতে যেমন তেমন/ দুই টানেতে রুগী/ তিন টানেতে রাজা উজির/ চার টানেতে সুখী!’

গাইতে গাইতেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিধ্বস্ত। হাঁফাচ্ছি। প্রায় সন্ধে হবো হবো। ঘরের জানালাগুলো খুলে দিই নিশ্চিন্তে। ও ঘুমিয়ে পড়েছে। কী ভাবে ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরেছিলাম, আমিই জানি। পরে বহুবার আমি আর অর্জুন হাসাহাসি করেছি সেদিনের ঘটনা নিয়ে। এখন অর্জুন আর নেই। হঠাৎ হৃদরোগ তাকে অনেক দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখনই অফিস থেকে ফেরার পথে রাতের গাড়ি মল্লিকবাজার থেকে পার্ক সার্কাসের দিকে যায়, জানালায় বসে চোখ চলে যায় সেই তিন তলার বারান্দার দিকে। ভাস্করদাও আর নেই। প্রথম জীবনে ব্যাগে তাঁর বই নিয়ে ঘুরতাম শুনে যিনি পিঠে হাত দিয়ে হেসেছিলেন, ‘আমার জানো, আজহারউদ্দিনের ব্যাটিং ভালো লাগে! কেমন কবিতার মতো খামখেয়ালি না- ব্যাটিংটা?’

কবিতার মতো খামখেয়ালি ব্যাটিং! কী আশ্চর্য কয়েকটা বাক্য। এতো বছর পরেও তাঁর বলা ওই কয়েকটা শব্দ মাথায় থেকে গিয়েছে। আর থেকে গিয়েছে তাঁর কবিতা—

‘ভাষা-প্রেমিকের কাছে বসে আছি

এখন বিকেল যায়, আস্তে চলে যায়।

 

মনে পড়ে আলিঙ্গন—

মনে পড়ে যায় শান্ত হাসিমুখ।

 

রক্তে বিষ মিশে আছে, প্রিয়তমা

এখন জীবন যায়, আস্তে চলে যায়।’

 

ক্রমশ

আরও পড়ুন...