ধা রা বা হি ক । পর্ব ৪
‘রুকুদা, জোরে আরো জোরে…।’
এক তলার রক থেকে ভেসে আসছে গোলাপি ফ্রকের গলা। আর সে দিকে তাকিয়ে মাথার ফেট্টি ঠিক করে নিচ্ছে রুকুদা, মানে সোমক বিশ্বাস।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ফর্সা, লম্বা পেটানো চেহারা। গলি ক্রিকেটে সেভেন আ সাইড ম্যাচের সেমিফাইনাল, ক্যাম্বিস বলে। খেলা ১২ ওভারের। আমরা মানে সিক্স ফ্রেন্ডস আগের ম্যাচগুলোয় হারতে হারতে কোনোরকমে জিতে সেমিফাইনালে উঠেছি। কিন্তু উঠেই শুনলাম, এ বারের প্রতিপক্ষ নেতাজি স্পোর্টিং। শুনলাম, গত বছরে টুনার্মেন্টের সেরা প্লেয়ার সোমক বিশ্বাস ওদের হয়ে খেলে। যখন তখন যেমন ছক্কা মারতে পারে, ঠিক তেমনই প্রতি ম্যাচে তিন-চারটে উইকেট পায়। সঙ্গে ভয়ঙ্কর পেস। বল নাকি দেখা যায় না।
গড়িয়াহাট বাজারের একটু আগে এখন যেখানে ট্রাইব রেস্তোরাঁ, তার ডান দিকের রাস্তার নাম বালিগঞ্জ গার্ডেন্স। কাঁকুলিয়া রোডের দিকে যেতে যে চার মাথার মোড়, সেই রাস্তাটাকে আমরা বলতাম ফর্টি ফিট। চল্লিশ ফুট, কারণ চওড়া রাস্তা, অনেক চওড়া ফুটপাথ। সেখানেই পরপর ইঁট পেতে উইকেট, রাস্তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য এক দিকে ব্যাটিং। কারণ অফসাইড আর লেগসাইড খোলা। ফুটপাথের উঁচু রকগুলোতে ছোট ছোট জটলা। তার একটায় আমাদের সিক্স ফ্রেন্ডসের প্লেয়াররা বসেছে। বাকিগুলোতেও উৎসাহী জনতা। মাসটা ডিসেম্বর, রবিবারের অলস দুপুর। আটের দশকের সেসব দুপুরে এই সব গলি-ক্রিকেটের ম্যাচ আমাদের কাছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে কিছু কম উত্তেজক ছিল না।
টস জিতে আমরা ব্যাটিং করছি। আমি আর টুবলু ওপেন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম ওভারের তিন নম্বর বলে টুবলু সিলি মিড অফে ঠেলেই রানের জন্য দৌড়ল। বলটা একটা রকের দেওয়ালে লেগে ফিল্ডারের হাতেই গেল। ততক্ষণে টুবলু অনেকটা চলে এসেছে। আমি ‘নো নো’ বলতে না বলতে ফিল্ডারের থ্রো ইঁটের উইকেটে ধাক্কা খেল। ০ রানে এক উইকেট। টুবলু আমাকে গালাগাল করতে করতে আমাদের সিক্স ফ্রেন্ডসের রকে গিয়ে বসল। এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি খুন করেছি। রান আউট হলে ব্যাটার যেমন ভাবে তাকায় আর কী!
তিন নম্বরে ব্যাট করতে আসছে সুজন। স্টান্স নেওয়ার আগে আমি মাঝ পিচে এগিয়ে এলাম। বললাম, ‘টুবলু আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করছে। তুই প্লিজ রান নেওয়ার আগে ইয়েস বা নো বলবি। না হলে গণ্ডগোল হবেই।’
সুজনের ব্যাটিংয়ে আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বলল, ‘নামটা দিতি। আমি জেনে নিয়েছি।’
‘কে দিতি?’
‘ওই যে রক থেকে চেচাঁচ্ছে! ওই মেয়েটা!’
আমি রক্তচক্ষু হেনে বললাম, ‘ও দিকে তাকাস না। সোমক বিশ্বাস তোর মাথা ভেঙে দেবে!’
সুজনের মাথায় ঢুকল বলে মনে হল না। কোনোরকমে সেই ওভারের বাকি দুটো বল খেলে দিল। এর পরেই বল করতে এল সোমক। প্রথম বলটাই অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে বুলেটের মতো আমার অফ স্টাম্প ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। কী পেস! চারধারে প্রশংসাসূচক দৃষ্টি, বড়দের গলা আসছে, ‘ওয়েল বোল্ড সোমক। ভেরি গুড।’ আর দ্বিতীয় বলটা করার আগে গোলাপি ফ্রকের গলা, ‘রুকুদা, জোরে আরো জোরে…।’
এ বার বলটা একটু ঠুকে দিয়েছে সোমক। কাঁধের বাড়তি জোর প্রয়োগ। বল শর্ট পিচ হয়ে আমার প্রায় নাক ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল কিপারের হাতে। রক থেকে আওয়াজ আসছে, ‘এ তো বল দেখতেই পাচ্ছে না রে। স্টাম্পে কর সোমক। করলেই বোল্ড!’
বাঁ হাতি ব্যাট আমি। পুলটা ভালোই করতে পারি। কিন্তু পুল মারার মতো বল তো পেতে হবে। এ তো সত্যি বল দেখতে পাচ্ছি না। এতোটাই পেস। তার উপর এটা নেতাজি স্পোর্টিংয়ের নিজেদের পাড়া। পাড়ার রকগুলো চনমন করছে আর চিয়ার লিডার ওই গোলাপি ফ্রক। মাখনের মতো রঙ, একমাথা চুল, গোলাপি পদ্মের মতো ফুটে আছে পিচ রাস্তার ধারে।
আমার হাতে কিছু নেই। শুধু একটা ব্যাট। এইটুকু সম্বল। শুধু এটা নিয়েই লড়ে যেতে হবে। ১২ ওভারের খেলা। কোনো বোলার তিন ওভারের বেশি করতে পারবে না, নিয়মে আছে। অন্য বোলারটাকে তেমন জুতসই মনে হচ্ছে না। সোমকের তিনটে ওভার খেলে দিতে পারলে…।
মনে মনে বললাম, গোলাপি ফ্রক, তুমি আমার চোখ টেনে নিচ্ছ। যখন নিচ্ছ, তোমার প্রেমিককে আমি উইকেট দেব না। কিছুতেই না।
‘কোত্থেকে হাওয়া ছুটে এসে কী জানি করল কী কৌশল
দু-চক্ষু তার ভাসিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে
ছুটিতে চলল ঝর্ণাদল!’
(উন্মাদের পাঠক্রম, জয় গোস্বামী)
সোমকের ওভারের শেষ বলটা লেগে পড়ল। ওই যে কবিতায় আছে—
‘কোত্থেকে হাওয়া ছুটে এসে কী জানি করল কী কৌশল..।’ বলটা লেগে পড়তেই নিখুঁত ফুটওয়ার্কে শর্ট আর্ম পুল। গলির মুখে স্কোয়ার লেগে দাঁড়ানো ফিল্ডারের পাশ দিয়ে চার।
সেই শুরু। পরের ওভারে লেগস্পিনার। ফ্লাইট করাচ্ছে। কিন্তু আমি বাঁ হাতি বলে মিডলে পড়ে লেগের দিকে পড়ছে। দুটো বল অনায়াসে তুলে দিয়ে ছক্কা পেলাম। উল্টোদিকে সুজনও মাঝে মাঝেই চালাচ্ছে।
একটু একটু করে রান বাড়ছে। সাত ওভারে আমরা ৫২-১। লং অফে ফিল্ডিং করছে সোমক। মাঝে মাঝেই পাশের রকে গোলাপি ফ্রকের সঙ্গে কথা বলছে। মাথা নেডে় কলকল করছে গোলাপি ফ্রকও। সুজন সেটা দেখিয়ে বলল, ‘আমি শালা আজ আউট হব না। দেখি ওর বয়ফ্রেণ্ড কীভাবে ওদের জেতায়!’
‘মারের চোটে শুইয়ে দাও, শুয়ে আদর করো
গলায় যেই পরাও হাত— প্রেমিক জড়োসড়ো
মাটিতে দাও ঘষটে মুখ, মুখে লাগাও দড়ি
আঘাতে যেই নামাও মুখ—প্রেমিক যায়-যায়’
(বাঁকা, ভুতুম ভগবান, জয় গোস্বামী)
এগারো নম্বর ওভারে আবার সোমক এল বল করতে। প্রথমটা হাফভলি। একটু এগিয়ে নিখুঁত ফুটওয়ার্কে লংয়ের উপর দিয়ে তুলে দিল সুজন। দুরন্ত টাইমিং। ছক্কা। ওই ওভারে এলো ১৪। শেষ পর্যন্ত আমরা ১১৩-২। শেষ ওভারে চালাতে গিয়ে বোল্ড হল সুজন। কিন্তু করেছে ৫৩ রান। আমি ৫৯ নট আউট।
এর পরে ওদের ৮১ রানে অলআউটে খুব একটা বিস্ময়ের কিছু নেই। টোটনের স্টাম্প টু স্টাম্প বোলিংয়ে এলো তিন উইকেট। আর বিস্ময়করভাবে শুরুতেই চালাতে গিয়ে ৪ রানে বোল্ড হয়ে গেল সেই সোমক বিশ্বাস। নিস্তব্ধ পাড়া। রকগুলো ফাঁকা হচ্ছিল। কিন্তু সেই গোলাপি ফ্রক বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল রকে। শুধু আর চেচাঁচ্ছিল না।
আর কোনোদিন পাড়া ক্রিকেটে আমি ৫৯ নট আউট করিনি। সুজনও করেছে কি? জানি না। ম্যাচ শেষে মেয়েটির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাটা মনে আছে। সিনিয়র দাদাদের পাশাপাশি সেখানে ছিল সোমক তথা রুকুদা। রুকুদার কাঁধে প্রকাশ্যে মাথা রাখেনি মেয়েটি। কিন্তু সজোরে হাতটা খিমচে দিয়ে বলেছিল, ‘কেন পারলে না? কেন হেরে গেলে?’
বিধ্বস্ত প্রেমিকের মতো দাঁড়িয়েছিল সোমক বিশ্বাস। শীতের দুপুর দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আমরা ফিরছিলাম। সোমক বিশ্বাসের প্রেমটা টিকেছিল? ও কি এখন দিতির সঙ্গে থাকে? কে জানে। সেদিন সত্যিই আমরা একটু কড়কে দিয়েছিলাম আর কি! হিংসেয়, মুগ্ধতায়। ভালোবাসায়!
‘সংকোচে জানাই আজ; একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনও ঝর্ণাজলে লুন্ঠিত হবার—
আজ দেখি, অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে—’
(স্নান, ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা, জয় গোস্বামী)
ক্রমশ