পা ঠ প্র তি ক্রি য়া
আজকাল আর নিছক আনন্দ বা তাৎক্ষণিক সুখ উদ্রেকের জন্য কবিতা পড়ি না। আমি এমন কবিতা পড়তে চাই যার সামনে দীর্ঘদিন দীর্ঘ বছর আমি বিস্মিত হয়ে বসে থাকতে পারব। কোনো অর্থপূর্ণ প্রতিক্রিয়া নয়, শুধু কবিতার রেশটুকু থাকুক। গভীর নিদ্রা ভেঙে যাওয়ার পরও যেমন ঘুম থেকে যায়। ঘুমের জন্য শুধু নয়, সেই গভীরতার রেশটুকু থাকুক এটাই চাই। উৎপলকুমার বসুর ‘লোচনদাস কারিগর’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ছিলাম বেশ কিছুদিন হল। ওই বইয়ের ‘সপ্তর্ষি’ কবিতাটি আমার খুব প্রিয় কবিতা। উৎপলকুমার বসুর কবিতা আমার কাছে বড়ো একটা উদ্যানের মতো। এখানে সবরকম আশ্চর্যের বস্তু আছে, লোভের বস্তু আছে, প্রলোভন আছে, আবার এই সবকিছু থেকে দূরে একটা ফাঁকা নির্জন কোণ আছে যেখানে গিয়ে পাঠক একবারটি বসলে অনন্তের অনুভূতি পায়। যেন কোনো কিছুর ভেতর প্রবেশ করছি আমি, যে-জগৎটাকে বিশেষ জানি না আমি। যে-কবিতাটি উল্লেখ করেছি সেটার মধ্যে ‘সুষুপ্তি’ বলে একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এই শব্দটা আমি প্রথম জানতে পারি প্রশ্ন উপনিষদ পড়ার সময়। তখন শুধু জানতাম তার অন্তর্গত উদ্দেশ্য সাধনা। একটা মানসিক নিবৃত্তির স্তর।
‘সপ্তর্ষি’ কবিতায় ‘ভয়াবহ’ আর ‘সুষুপ্তি’ পাশাপাশি অবস্থানরত। হ্যাঁ, ওখানেই আবার ‘সাতখানি ঘুম’-এর উল্লেখ আমরা পাই। ‘উদ্বেগ’ শব্দটা কবিতাটিকে দিশা দেওয়া শুরু করে। আর আবিষ্কার করি তিনটি অদ্ভুত শব্দ ‘শূকরবাহিতা’, ‘খগবিলাসিনী’ আর ‘ডিগবাজিপ্রিয়’। পুরো কবিতাটি শ্লেষ এবং ব্যঙ্গ প্রবণতায় সিক্ত। অবক্ষয়ের কবিতা হতে গিয়েও কবিতাটি নিজ মহিমায় এই সবকিছু থেকে সুষুপ্তির দিকে ভয়াবহ হয়ে উঠল। এই জন্য শুধু নয় তার মধ্যেকার উত্তরণ প্রবণতা বাক্য গঠিত করল এমনভাবে যে, এখানে সুষুপ্তির হয়তো নতুন বিভঙ্গ তৈরি হল। অর্থহীন করে দিল সব। কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:
“গভীর উদ্বেগ নিয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়
সাতখানি ঘুম
আমাকে রয়েছে ঘিরে—
কেউ শূকরবাহিতা, কেউ খগবিলাসিনী, কেউ
ডিগবাজিপ্রিয়
বয়স্য ক্লাউন, তার কুষ্ঠের সঙ যেন, ঐ পেটায় ঢোলক
মাথায় কাগজটুপি
পরনে ইজের
টানে শিল্কী ধরে সাধের ছাগলে—
ওরা
সাতখানি ঘুম আমাকে রয়েছে ঘিরে, বলে
এখনি সঙ্গে চলো,
বলে—আয়
গভীর উদ্বেগ থেকে
ভয়াবহ সুষুপ্তির দিকে।”
ওলোট-পালোট করে দেওয়া ভূখণ্ড মনে হয়। মনে হয় বহু বছর কোনো মানুষ এমন বোধের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে পারে। সে পাঠক হতে পারে কিংবা স্বয়ং কবি। স্রষ্টাকেও অপেক্ষা করতে হয় জীবন তাঁকে কবিতা কীভাবে ফিরিয়ে দেবে। উৎপলকুমার বসুর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘হাঁস চলার পথ’ যেটা জয় গোস্বামী ও প্রশান্ত মাজীর উদ্যোগে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। সেখানে প্রথম কবিতাটি ‘হাঁস চলার পথ’ শিরোনামে কবি জীবিতকালে অনেকগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। আর প্রতিটি নতুন প্রকাশকালে কবিতাটি বদলে গিয়েছিল নানাভাবে। প্রতিটি কবিতাই একই শিরোনামে প্রকাশিত হলেও সেগুলো আলাদা আলাদা অস্তিত্বের মর্যাদা দাবি করে বলে আমার মনে হয়। সেই কবিতায় ‘হাঁস চলার পথ’ বোঝাতে গিয়ে যেভাবে আস্তে আস্তে মন্থর পদে স্মৃতিকে রোমন্থন করা আর তা নিয়ে আবিষ্কার আছে সেটা বড়ো আশ্চর্যের। সেখানে কবি বাড়ির ঠিকানা ভুলে যাওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন। যদি যুক্তি-বুদ্ধি সহকারে ভাবি তাহলে কবি তাঁর বাড়ির ঠিকানা ভুলে যেতে পারেন না। যতক্ষণ না তিনি ভোলার আপ্রাণ অভিপ্রায় নিয়ে নতুন কোনো ঠিকানার আশ্রয় চাইছেন। অতীত হাতড়ে হাতড়ে একটি হাঁস পরাবর্ত ক্রিয়া যেন। যেখান দিয়ে এসেছিলেন তারই অলিগলি, বিপুল টান আর মিশে যাওয়া— এটাকে গভীরভাবে চাইছেন। তারপর একটা ঘুম। তাঁর বহু কবিতায় ঘুমের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে আসে। একে কোনো সংজ্ঞায় বাঁধার চেষ্টা আমি করব না। বরং কোনো অভিপ্রায়হীন মিলিত হওয়া মনে করি। নিজের সঙ্গে নিজেরই মিলিত হওয়া। সেরকই ওই ‘সাতখানি ঘুম’-এর প্রসঙ্গ। ঘুরে ফিরে আসে। যেখানে সময়ের যোগাযোগ কিংবা যোগসূত্র কেবল সময়হীনতার অন্ধকারে। ‘সপ্তর্ষি’ কবিতাটি অনেকবার পড়ে আমি দেখেছি সেখান থেকে সরাসরি কোনো অর্থ কেউ খুঁজে পাবে না। কবি সেখানে ঘুমের তারে বেঁধেছেন জীবনকে। সাতখানি ঘুম আর ভয়াবহ সুষুপ্তির এই অখণ্ড যোগাযোগ যেন চিরকালের বিচ্ছেদ আর সংযোগের কথা বলে। ছিঁড়ে যেতে যেতে ক্রমাগত যে-মানুষ চরম নেয় বিরতির পর আরও একবার ছিঁড়ে যেতে হবে তাকে। অদ্ভুত এই পৃথিবীর নিয়ম। অদ্ভুত যোগসূত্র আমাদের। সবকিছুর সঙ্গে এক বিপুল টান।
এর আগের কবিতাটিই হল ‘তীর্থ’। যেন কবি তীর্থই করছেন। যাত্রা করছেন আবার কোনো সূক্ষ্ম জগতে। আলোহীনতার উদ্দেশে। এখানে কোনো নির্ণায়ক নেই। যে-কোনো পাঠক যেভাবে ইচ্ছে কবিতার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে পারেন। মানুষের সবার আগে মানস ভ্রমণ। বিচরণ করতে করতে সে শেখে। উৎপলকুমার বসুর কবিতায় বারবার নিত্যদিনের স্মৃতির টুকরো টুকরো মানচিত্র জুড়ে কবিতা হয়ে ওঠে। সেখানে যে-বৃহৎ চিত্রটির খোঁজ আমরা রাখি তার খানিকটাই আমরা পাই। কবি নিজেই ভালোবাসেন তীর্থ করতে। নানা অভিজ্ঞতার মিলিত ফসল তাঁর কবিতা। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা সরাসরি লুপ্ত হয়ে কোনো নিরাময় হয়ে আসে নয়তো নির্ণায়ক হয়ে দেখা দেয়। আর বাক্যের ভেতর শাব্দিক গঠনের সূক্ষ্মতা সেই তীব্র বাসনারই প্রতীক। কবি যেভাবে তীব্রভাবে যুক্ত এবং বিযুক্ত হতে চাইছেন। ‘তীর্থ’ কবিতাটির দুই নম্বর কবিতাটি পড়া যাক:
“যাই সুখের ভিতরে নেমে, সিঁড়ি আছে, আলোও জ্বলছে, অনেক
অনেক বছর পর এই পথে কুয়াশায় দৌড়ে নামছি, বৃষ্টি পড়ছিল,
মহাবীর মন্দির-গুহায় রুপোর টুকরো, ভুল নয় নামার মুহূর্তে
ঠিক এ-ভাবেই দৌড়ে থাকি, সোনার ভিতরে নামি ধাতু ও তামার
উজ্জ্বল দণ্ড কাঁধে, সুখের ভিতরে নামি, হয়ত এমন
জটিল নামার জন্য মনগড়া শর্ত আছে, কেন বা পুরুষ
সুখের সন্ধানে যায় একা একা তারো কানুন রয়েছে, আমরা জানি না,
দৌড়তে ব্যস্ত থাকি, পাথরে পিছলে পড়ি, যাই গাছের শিকড়ে বেঁধে,
সেখানে ভোরের
আলোর ভিতরে জ্বলছে রাস্তার বাতিগুলি। আজো আমরাই প্রথম এসেছি।”
‘লোচনদাস কারিগর’ বইয়ের প্রথম কবিতাটি ‘প্রকৃতি’ পড়তে গিয়েই লক্ষ করি একটা সুপ্ত তেজ সুপ্ত কারণ। কেন বেঁচে আছি তারই সুপ্ত কারণ লুকিয়ে আছে। ‘আগুন’ শব্দটি কবিতায় অনেকবার এসেছে। নিজেকে গোপন করে রাখার কবিতা এটি। নিজের গোপন থেকে বেরিয়ে আসার কবিতাও এটি। শূন্যে ভাসমান থাকার প্রসঙ্গ থেকে বহু জটিল আবর্তে কবি ফিরে এসেছেন ভ্রূণরূপী হয়ে। সেখানে নানা চিত্র বারবার ফিরে আসে। নানা আবর্ত নানা অবস্থানের কথা। সহাবস্থানের কথাও আসে। শ্বেত মেষরেখা আর শ্বেত শকুনের ডানা আসে। বুনো হাঁস। ভুলের কথা আসে। এটাই তো চিরন্তন বিভ্রম আমাদের। জড়িয়ে থেকেও কোথায় আবার লুপ্ত হয়ে যাই। শেষে পথের ফাটলের উল্লেখ তো এই আত্মগোপনকেই নির্দেশ করে। আর এই সবকিছুর কোনো যুক্তি কোনোদিন হয় না।
‘শীতকাতর ঘুমের ভিতর গভীরতর শীতের ঘুম আছে’ কবিতায় ‘অবরোহিতেশ্বর’-কে সম্বোধন করা হয়েছে। এই কবিতাকে কোন মাপকাঠিতে মাপব? এর কোনো সুরাহা করতে পারব না। ক্রমশ নানা ধরনের ইঙ্গিত কবিতাকে লক্ষ্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার গতি করেও কোথাও কোনো অন্ধকার বিজনে পাঠককে নিয়ে যায়। নিশ্চয় আর অনিশ্চয়তার যাত্রা। অনেক কিছু। অবরোহন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে বারবার ভাবতে থাকা। পুনরায় সবকিছু হারানোর আশ্বাস আর ধ্বনি। একটু পরই লুপ্ত হওয়া। আর ঘুমের প্রসঙ্গে আবার বলতে ইচ্ছে হয় সেই পুরোনোকে আদিমকে আটপৌরে করে বেঁধে রাখা আরকী। এখান থেকে ভ্রমের উৎপাদন। ভ্রমনাশও এখানেই।
‘সুখের কথা আর বোলো না’ কবিতাটি টানা গদ্যে লেখা। এখানেও জীবন আছে। গল্প আছে। কোনো বোধের কথা নেই। ইঙ্গিত নেই। শুধুই গল্প। এই বইয়ের অন্য কবিতাগুলো যেমন ‘বিজলীবালা’, ‘তদন্ত’, ‘রক্ষাকবচ’, ‘রণনিমিত্ত হৃদয় আমার’ সবেতেই এই ডায়ালেক্ট লক্ষ করি না। এই নিপাট গল্পের মধ্যে ভীন ভাষার উচ্চারণ প্রবণতাও লক্ষ করি। আরেকটি খুবই উল্লেখযোগ্য দিক হল এই কবিতারই দুই নম্বর কবিতাটি কিন্তু প্রথমটা থেকে অনেকটাই আলাদা। এই হল জীবন যা কবিতায় প্রতিবার খোঁজ করি। এই খোঁজের তীব্র অনন্য প্রয়াস কিন্তু লুকিয়ে থাকে কবি কীরকম ভ্রমের উৎপাদন করেন কিংবা কবিতাকেই জীবনের উপায় বলে বেছে নেন কিনা এর মধ্যে। চলতে চলতে যার ভেতর অসংখ্য অনুপুঙ্খ স্মৃতি উপার্জন করে কবিতা হয়ে ওঠে স্মৃতির দলিল। ইতিহাসচেতনা আমি একেই বলব তাই নয় কি!
এই কাব্যগ্রন্থের ‘রাক্ষস’ কবিতাটি খুব আলোচিত কবিতা। এর মধ্যে একটা সহজ ইঙ্গিত আর ভাষার আবহে আস্তিত্বিক কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করি। কবিতাটি একটু পড়া যাক:
“যেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি : এই তো তোমারই ঠিকানালেখা চিঠি, ডাকে দেব,
তুমি মনপড়া জানো নাকি? এলে কোন্ ট্রেনে?
আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত, নতুন চিরুনি।
দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ, কালো চুল লেগে আছে।”
একেই কি আমি অন্ধকারের কবিতা বলব? চিরুনির দাঁতে লেগে থাকা দীর্ঘ কালো চুল আসলে কিসের প্রতীক হিসেবে ধরব? এখানে কোন উত্তরই পর্যাপ্ত নয়। তাই উত্তরের অপর্যাপ্ত রেশ কাটিয়ে উঠে এই বিভ্রমে মজে থাকার কথাই বারবার মনে হয়। পুনরায় আবার ‘সংসার’ নামক কবিতায় ফিরে আসে ঘুম। এই অবচেতন বারবার মুগ্ধ করে। আর এই মুগ্ধ করার থেকে বেশি বিভ্রম সৃষ্টি করে। এরকম একটি মহৎ বই সম্পর্কে খুব বেশি বলতে ইচ্ছে হয় না। আর এই বইয়ের শেষ কবিতাও সেই পূর্বাপর অনন্তের ইঙ্গিত রাখে।
প্রকাশ কাল । ১৯৮২, প্রকাশক । প্রতিবিম্ব