ছো ট গ ল্প । ১
রিপন হালদার কবিতার সাথে সাথে লেখেন গল্পও। সম্প্রতি ‘তবুও প্রয়াস’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি ছোট গল্পের সংকলন ‘এখানে অমল নামে কেউ থাকে না’। প্রতি সংখ্যায় আমরা হাজির করব এমন কাউকে যিনি কবিতার সাথে সাথে লেখেন গল্পও। ধন্যবাদ রিপনকে এই সংখ্যায় তাঁর গল্পের জন্য।
প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটার পর দোকানে পৌঁছে ছেলেটা আজো দেখল বাবা নেই। বেশ কিছুক্ষণ দোকানের ডানপাশের কোণটিতে দাঁড়িয়ে থাকল। ঘামে সারা শরীর জবজব করছে। সাদা জামাটা ভিজে গিয়ে কামড়ে আছে চামড়ার সাথে। ডানহাতের আঙুল দিয়ে বারবার কপালের ঘাম চেঁছে চলেছে।
আগের দিনের সেই লোকটার চোখ এবার পড়ল ছেলেটির দিকে। “বাবাকে চাই?” বলে লোকটা আবার মাথা ডুবিয়ে দিল কোলের উপর রাখা কুলোর উপর। ছেলেটি আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না। হাতের কাজ হঠাত্ বন্ধ রেখে লোকটা ছেলেটির দিকে আরেকবার তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, “সেইই খানে আছে। চলে যাও!” কেমন যেন টেনে টেনে বলল কথাগুলো। তাচ্ছিল্যের সুর।
ছেলেটি দোকানের পিছন দিকের রাস্তাটায় চলে এল। তাকালো সামনের দিকে। আবার এতটা রাস্তা! ক্লান্তি আর হতাশা ছেয়ে ফেলল। আশেপাশে ট্যাপকলের সন্ধান করল। ইঁটের টুকরো বসানো রাস্তা। এখনো পাকা হয়নি। তাই হয়ত ট্যাপকলের লাইনও এখনো বসেনি। ফিরে আসল দোকানে। জল চাইল। বোতলের প্রায় অর্ধেকটা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে নতুন উদ্যমে শুরু করল হাঁটা। সেই ‘ওয়াই’ চিহ্নটা সামনে এসে পড়েছে। আরো দেখা যাচ্ছে ইঁটভাটার চিমনিটা ঐ ওয়াইয়ের সংযোগবিন্দু ফুঁড়ে যেন উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ছেলেটা এসে দাঁড়াল সেখানে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল খানিকক্ষণ। শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে ওর পা হাত মাথা এরা আলাদা আলাদা কিছু। একে অন্যের সাথে যুক্ত অবস্থায় থাকতে তীব্রভাবে আপত্তি জানাচ্ছে। হয়ত যখন তখন ছিটকে খুলে পড়েও যেতে পারে।
এবার মাঠে নামতে হবে। রাস্তার উচ্চতার তুলনায় মাঠটা ঢালু। দুপুরের এই সাদা রোদের মধ্যে মাঠটা যেন ডুবে আছে। ছেলেটা নেমে গেল মাঠে। শূন্য মাঠ ভেদ করে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিমনিটা এবার ওর আগে আগে চলছে। অবশ্য কোনো ধোঁয়া উঠতে দেখা যাচ্ছে না। এই চিমনি লক্ষ্য রেখে ওকে এগিয়ে যেতে হবে। উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো মাঠটার উপর দিয়ে টলতে টলতে চলা শুরু করল। এখানে সোজাভাবে হাঁটা যায় না।
অবশেষে অনেকটা পথ অতিক্রমের পর সেই খালটা দৃশ্যমান হল। আর তার পাশেই ইঁটভাটা। ইঁটভাটার দিকে এগোতে থাকল। বেশ কিছুটা যেতেই নাকে আসল সেই বিশ্রী গন্ধটা, যা পুরো জায়গাটার হাওয়াকে বিশ্রীভাবে দখল করে রেখেছে। খিদে পেটে গন্ধটা বমির ভাব জাগাচ্ছে। আরেকটু যেতেই সামনেই পড়ল সেই ড্রামের উপর সাজানো অদ্ভুত যন্ত্রটা। হাঁড়ির নিচে জ্বলছে আগুন। তার থেকে সরু একটা পাইপ মাটিতে বসানো ড্রামের সাথে যুক্ত। ছেলেটি দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে। একটু দূরে একটা মাঝারি উচ্চতার ঝোঁপের পাশে নিচে জটলা দেখা যাচ্ছে। ভালো করে তাকাল ঐদিকে। রোদের মধ্যে দৃশ্যটা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। বাবা নিশ্চয় ঐখানে আছে। যদিও এখান থেকে ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। রোদ থেকে মাথা বাঁচাতে হাতের প্লাস্টিকটা ধরে রাখল মাথার উপর। সামনে কী এগিয়ে যাবে আরেকটু! কিন্তু যা ঝাঁঝালো গন্ধ! বমি হয়ে যেতে পারে। তাই এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয় মনে করল।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কেউ আসাযাওয়া করছে না এইদিকে। কাউকে ডাকতেও ইচ্ছা করছে না। বাবা ওখানে কী সত্যি সত্যি আছে! ওর দিকে কেউ তাকাচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে না। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! ওদিকে খিদেও পেয়েছে খুব। ছেলেটি বসে পড়ল উঁচু মত মাটির ঢিবির উপর। আগের দিনও সম্ভবত এই জায়গাটাতেই বসেছিল। রোদের তেজ ওর হাড়সর্বস্ব দেহটা থেকে সমস্ত রস শুষে নিচ্ছে। ক্রমশ বুজে আসছে চোখ। প্লাস্টিকের ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য হল। রোদে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে অনাবৃত অংশের চামড়া। রোদ এড়ানোর জন্য মাথাটা ঘুরিয়ে খালের দিকে রাখল। চোখ মুখের উপরে রাখল বাঁহাতের ছায়া। জলের স্বচ্ছ পাতলা একটা রেখা যেন দুলছে চোখের উপর। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথার মধ্যে সৃষ্টি হয় একধরনের ধোঁয়াশা। তবু এখন দেখতে ভালো লাগছে ওর। তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ চোখ খোলা রাখতে সক্ষম হল। বন্ধ হয়ে আবার খুলে যাচ্ছে। খুলে গিয়ে আবার মৃদুভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ বা খোলা থাকছে না। একধরনের অর্ধচেতন অবস্থায় ওর মন এখন দোদুল্যমান।
কয়েক মুহুর্ত পর ঐ রেখাটার সামনের দিকটা কেমন যেন আকার পালটাচ্ছে মনে হল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বিরাট এক সাপের মুখের মত হয়ে গেল। এদিক ওদিক নড়াচড়া করে তাকিয়ে কী যেন দেখছে মুখটা। তারপর কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যের সন্ধান পেয়েছে এমন ভাব করে তীব্রবেগে ছুটে আসছে ওর দিকে। আসার পথে পড়ল ছোট্ট বেড়ার ঘর। সাপটা আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে ধুধু মাঠের উপর অবস্থিত ওদের ঐ ছোট্ট ঘরটা। কড়মড় শব্দও যেন পাওয়া গেল। তারপর দ্রুত ছুটে একদম কাছে চলে আসল ছেলেটির। বিরাট এক হা করে ওর পুরো দেহটা একবারে গিলে ফেলল। অর্ধতরল স্রোতে ভেসে বেরানোর স্মৃতি ভেসে এল। শৈশবে মায়ের কোলে দুলতে থাকার মত। কোলে হয়ত নয়। চারদিক আবৃত কোনো চামড়ার মত আবরণে। দলা পাকানো মাংসপিণ্ড যেন হয়ে গেছে ছেলেটি এখন। চেতনা বা বোধের কোনো বিন্দু ধীরে ধীরে ওকে জানান দিচ্ছে কিছু। কারো আবছা ডাক ঐ স্ফীত চামড়ার বাইরে দিয়ে যেন কেউ কিছু বলছে, “ছেলে হবে, না মেয়ে?” সঙ্গে শোনা যাচ্ছে মোছা মোছা হাসি। একটা হাত চামড়ার বাইরে ওর গড়নের উপর দিয়ে বুলিয়ে চলেছে কারো। আর খুব আবছা ভাবে কোনো দূর জগতের পার থেকে যেন বার বার বলছে, “বাবা বলে ডাকো তো!”