ধা রা বা হি ক । পর্ব ১
Surréalisme-এর ফরাসি উচ্চারণ স্যুররেয়ালিসম। আমরা অনেকদিন ধরে শব্দটিকে করে নিয়েছি স্যুররিয়ালিজম, কারণ ফরাসিতে ‘রেয়াল’ হলেও আমরা ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে ‘রিয়াল’ করি। কিন্তু ফরাসি স্যুররেয়ালিসম কী করে কারো কারো কাছে সাররিয়ালিজম হয়ে ওঠে, তা বিস্ময়ের। স্যুররেয়ালিসম-এর বাংলা আমরা করেছি পরাবাস্তববাদ, এবং শব্দটি সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়েছে বাংলা ভাষায়। ‘স্যুররেয়ালিসম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করতে দেখি কবি গিয়োম আপোলিনেরকে। জীবনের শেষদিকে রচিত তাঁর নাটক , যা ১৯১৭ সালে অভিনীত হয়েছিল, ‘লে মামেল দ্য টাইটেরিয়াস’-এ আপোলিনের এই নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন দ্বিতীয় শিরোনাম—‘স্যুররেয়ালিস্ত’ নাটক। আর আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো সাত বছর যখন স্যুররেয়ালিসম একটি আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং শুধু ফরাসি শিল্প-সাহিত্য নয়, গোটা বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যকে প্রভাবিত করবে।
আঁদ্রে ব্রতঁ ১৯২৪-এর হেমন্তে স্যুরলেয়ালিসমকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করলেন তাঁর ‘মানিফেস্ত দ্যু স্যুররেয়ালিসম’-এ: স্যুররেয়ালিসম, বিশেষ্য, পুংলিঙ্গ। বিশুদ্ধমানসিক স্বয়ংক্রিয়তা (automatismepsychiquepur), যার সাহায্যে মৌখিক বা লিখিতভাবে চিন্তার প্রক্রিয়াকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়। এ হল নন্দনতাত্ত্বিক বা নৈতিক বিষয়ের বাইরে, যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় চিন্তার কর্তৃত্ব (dictée de la pensée)।
দার্শনিক অর্থ : স্যুররেয়ালিসম বিশ্বাস করে- নানা ধরনের অনুষঙ্গে প্রকাশিত, যা এতকাল অবহেলিত, এক উচ্চ বাস্তবে (réalitésupérieure), স্বপ্নের সার্বভৌমত্বে এবং চিন্তার নিস্পৃহতায়। এর উদ্দেশ্য অন্য সমস্ত মানসিক কলকব্জাগুলোর চিরতরে বিনাশ (ruinerdéfinitivementtous les autresmécanismespsychiques) এবং জীবনের প্রধান সমস্যাজাত সিদ্ধান্তের মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপন।
যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে ব্রতঁ-র জেহাদ ছিল এই রকম :
আমরা এখনো যুক্তির শাসনাধীনে বাস করি; এর মানে আপনারা বুঝবেন যে তার দিকেই আমি আসতে চাইছি। কিন্তু যুক্তির পদ্ধতিকে এখন প্রয়োগ করা হয় গৌণ সমস্যাগুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে। নিরঙ্কুশ যুক্তিবাদ যা এখন চলছে, তা কোনো সত্যকে বিবেচনার জন্য গ্রাহ্য করে না, অথচ সেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। অন্যদিকে, যৌক্তিক উদ্দেশ্যগুলো আমাদের হাতের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অভিজ্ঞতারও সীমাবদ্ধতা আছে। খাঁচার ভিতরে তা পাক খাচ্ছে আর সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া ক্রমে ক্রমে আরো জটিল হয়ে উঠছে। অভিজ্ঞতাও তাৎক্ষণিক ঐক্যের ওপর নির্ভর করে থাকে, আর তাকে রক্ষা করে সাধারণ ধারণা। সভ্যতার রঙে, উন্নতির অজুহাতে সবকিছু, ঠিকভাবে বা বেঠিকভাবে যা সব কল্পনা বা সংস্কার হিসেবে গণ্য হতে পারে, মন থেকে নির্বাসিত করে দেওয়া হয়েছে, সব অ-প্রথাগত সত্যানুসন্ধানকে নির্বাসিত করা হয়েছে। তবে বলা যেতে পারে, সৌভাগ্যক্রমে মনোজগতের একটি দিকের প্রতি সম্প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে— আমার মতে এটা খুবই জরুরি—আর যে বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমরা ভান করেছি যে এ একটা গ্রাহ্য করার ব্যাপার নয়। আবিষ্কারগুলোর জন্য সব কৃতিত্বপ্রাপ্য ফ্রয়েডের। আবিষ্কারগুলোর ওপর ভিত্তি করে জনমতের একটা ধারা তৈরি হচ্ছে যার সাহায্যে মানবমনের সন্ধানের জগৎকে আরো প্রসারিত করতে পারবে, নিজেকে শুধু মৌল বাস্তবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না। কল্পনা সম্ভবত তার অধিকার দাবি করার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মনের গভীর তলদেশে যদি বিস্ময়কর শক্তিগুলোকে লালন করা হয়, যে শক্তিগুলো উপরিতলের শক্তিগুলোর সামর্থ্য বাড়াতে সক্ষম কিংবা তাদের সঙ্গে সফলভাবেব প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারে, তাহলে আমাদের স্বার্থেই তাদেরকে করায়ত্ত করা উচিত এবং পরে প্রয়োজন হলে তাদেরকে যুক্তির নিয়ন্ত্রণের কাছে সঁপে দেওয়া দরকার। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষকদের নিজেদের হারানোর কিছু নেই। কিন্তু এটা লক্ষ করা যাবে, যে কোনো পদ্ধতিকেই এই কাজের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি এবং মেনে নেওয়া হচ্ছে যে কোনো নতুন ব্যবস্থা তৈরি হওয়া পর্যন্ত এটা কবি ও বিজ্ঞানীদের বিষয় হিসেবে গণ্য হবে, আর এর সাফল্য পরবর্তীসময়ে প্রয়োগ করা কম বেশি কোনো খেয়ালিপনার ওপর নির্ভর করবে না।
(মানিফেস্ত দ্যু স্যুররেয়ালিসম)
স্যুররেয়ালিসম যে কোনো দার্শনিক প্রস্তাবনা নয়, সাহিত্যশিল্পের এ এক নিরীক্ষামাত্র, তা স্পষ্ট করে দেন ব্রতঁ যখন তিনি বলেন, ‘কবিতা চর্চা করতে হবে’। ব্রতঁ স্যুরলেয়ালিস্ট হিসেবে যাঁদের নাম উচ্চারণ করেছেন, তাঁরা সবাই একসুরে কথা বলেছেন তা নয়। এঁদের প্রত্যেকেরই পূর্বলব্ধ নিজস্ব ধারণা ছিল, স্বীকার করেছেন ব্রতঁ। তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন :
১) আমাদের কোনো প্রতিভা নেই; উৎপাদনের স্বয়ংক্রিয় দ্রব্য এবং নিম্ন আয়ের বসবাস লম্বা শহরগুলোকে ধ্বংস করবে (ফিলিপ সুপো)
২) আমি যে গল্প বলছি তা বহুবার বলা, একটি কবিতা যা আমি পুনর্বার পড়ছি : আমার শ্যামলকান ও পুড়ে খাস্তা হয়ে যাওয়া ঠোঁট নিয়ে আমি ঝুঁকে পড়ছি দেওয়ালের দিকে। (পল এলুয়ার)
৩)পার্টির বিরতি হলে সব খেলোয়াড়রা যখন পানপাত্রের সামনে জড়ো হয় তখন আমি গাছটিকে জিজ্ঞেস করি সে কি সবসময় লাল রিবন পরে থাকে! ( লুই আরাগঁ)
স্যুররেয়ালিস্ট ভাষার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—“মানুষকে ভাষা প্রদান করা হয়েছে যাতে সে তার স্যুরেয়ালিস্ত ব্যবহার করতে পারে”। একজনের প্রশ্নের উত্তরে সঙ্গতিহীন কথা বলা, এমনই তার ভাষারীতি। কবিতার চিত্রকল্পের ক্ষেত্রে পূর্বভাবনাহীন এমন চিত্র পাই—“সাদা কাপড়ের মতো ভাঁজ করা দিন” (রভের্দি)। উদ্দেশ্য একটাই—দুই দূরবর্তী বাস্তবের মিলন। যেমন লোত্রেয়ামঁ-র বহুব্যবহৃত এই চিত্রকল্প—“কাটাছেঁড়ার টেবিলে হঠাৎ সাক্ষাৎ একটা সেলাইকলের সঙ্গে একটা ছাতার”। আপাত সংযোগহীন সেলাইকল ও ছাতার এই ব্যবহার স্যুররেয়ালিস্ট ভাবনার পরিচয় দেয়। কোলাজ কবিতা বলতে যা বোঝানো হয়েছিল তা হল খবরের কাগজের কর্তিকা থেকে উদ্দেশহীনভাবে তুলে নেওয়া সঙ্গতিহীন শব্দ বা বাক্যের সমাহার।
ম্যানিফেস্টোর শেষ অংশে আঁদ্রে ব্রতঁ তাঁদের ইস্তাহার শেষ করেছেন এইভাবে :
স্যুররেয়ালিসম বলতে আমি যা বুঝি তা প্রকাশ করে নিয়মনীতির প্রতি এত স্পষ্ট এক বিরোধিতা যে বাস্তব পৃথিবী কাঠগড়ায় উঠলে তার সাক্ষ্য দেবারও প্রশ্ন নেই। বরং, তা একসম্পূর্ণ চিত্তবিক্ষেপের সাক্ষ্য দেয়। কান্টেটা চিত্তবিক্ষেপের কারণ নারীরা, পাস্তুর মনোযোগ বিচ্যুত হয়েছিলেন ‘আঙুর’ দ্বারা, যানবাহন ক্যুরির চিত্তবিক্ষেপের কারণ। সবই এই বিষয়ের গভীর লক্ষণযুক্ত। চিন্তার সঙ্গে আপেক্ষিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই বিশ্ব; আর এই ধরনের ঘটনাগুলি হল স্বাধীনতা যুদ্ধের উজ্জ্বল অধ্যায়, যেখানে অংশ নিতে পেরে আমি গৌরব বোধ করি। স্যুররেয়ালিসম এক ‘অদৃশ্য রশ্মি’ (rayon invisible) যা একদিন আমাদের শত্রুদের জয় করতে সামর্থ্য জোগাবে। “তুমি আর কেঁপে উঠো না, শবদেহ”। এই গ্রীষ্মে গোলাপেরা নীল। কাচ দিয়ে তৈরি হয়েছে কাঠ। পৃথিবী তার ডালপালা জড়িয়ে ভূতের মতোই আমার ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকার বিরতি হল কাল্পনিক সমাধান। অস্তিত্ব অন্য জায়গায়।
ক্রমশ