ধা রা বা হি ক । পর্ব ২
যে অযৌক্তিক জগতের কথা স্যুররেয়ালিস্টরা বলেন, তার নমুনা আমরা তাঁদের কবিতাতেই প্রথম পেয়েছি তা কিন্তু নয়। বোদল্যের, র্যাঁবো, লোত্রেয়ামোঁ, নেরভাল ও আরো কয়েকজন কবির মধ্যে তার উপাদান আমরা আগেই পাই। গি মঁজো তাঁর ‘স্যুররেয়ালিসম-এর ইতিহাস’ (১৯৩৪)-এ লিখেছেন—
রোমান্টিকদের ও র্যাঁবোর প্রচেষ্টা এবং লোত্রেয়ামোঁর সাফল্য তখন বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। তখনও তাঁদের মধ্যে অযৌক্তিকতা ও স্যুররেয়াল-এর প্রতি কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়াস ছিল না। সংস্কার ও আইনের যে পুরু শিকল মনের ওপরে চেপ্টে বসেছিল তা তখনও ভাঙেনি। কিছু মানুষ খুব আস্তে আস্তে সেই কাজ করছিলেন এবং রাস্তা তৈরি করছিলেন। লোত্রেয়ামোঁর পর এই কাজ তার গতি হারায়। র্যাঁবো ও লোত্রেয়ামোঁ তাঁদের যুগের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের ইঙ্গিতগুলো সময়ের সঙ্গে অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
(Histoire du Surréalisme, ১৯৩৪)
স্যুররেয়ালিসমের ইতিহাসকারেরা, বিশেষ করে, ডেভিড গাসোয়ান (১৯৩৬) কবি মারকুইজ দ্য সাদ-এর কবিতায় প্রথম অযৌক্তিকতার উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। স্যুররেয়ালিস্ট পল এল্যুয়ার, লা রেভোল্যুসিয়োঁ স্যুররেয়ালিস্ত পত্রিকায় (১৯২৬) লিখেছেন –
সভ্য মানুষকে তার আদিম স্বজ্ঞা (instincts) ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায়, প্রেমের কল্পনাকে মুক্তি দিতে চাওয়ায়, এবং একমাত্র ন্যায় ও সমতার জন্য প্রাণপণ লড়াই করায় মারকুইজ দ্য সাদকে সারাজীবনের জন্য বাস্তিল, ভ্যাঁসন ও শারতঁতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাঁর রচনা আগুনের মধ্যে অথবা পর্নোগ্রাফিক লেখকদের ঔতসুক্যের জন্য দেওয়া হয়েছে আর তারা তাঁকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করেছে। তাঁর নাম নিষ্ঠুর ও খুনির সমার্থক হয়েছে।
তা সত্ত্বেও, সাদ-এর একগুঁয়ে মনোভাবের কথা কবিরা জানতেন এবং তাঁরা তাঁকে বিপ্লবী নীতিবাগীশ বলে বলে প্রশংসা করেছেন। বিখ্যাত রোম্যান্টিক আন্দোলনের শুরু তাঁর হাতেই। শুধু সাদ, বোদল্যের, র্যাঁবো, লোত্রেয়ামোঁ ও নেরভাল নয়, আরো অনেক লেখকের মধ্যেই অযৌক্তিক জগতের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, যা ক্রমশ স্যুররেয়ালিস্ট আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্য হয়েছে। লুই বার্ট্রান্ড নামের একজন অচেনা লেখকের ১৮৩৬ সালে রচিত Gaspard de la Nuit সম্ভবত প্রথম গদ্যকবিতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এইসময়। আর এই গদ্যকবিতাই বোদল্যের, র্যাঁবো, লোত্রেয়ামোঁ প্রমুখ কবিদের হাতে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।
উনিশ শতকেই স্তেফান মালার্মে তাঁর ‘আপ্রে-মিদি দাঁ ফন’ (Après-midi d’un Faune) কাব্যে শব্দ ও বাক্যবিন্যাসে যেসব বিপর্যয়মূলক নিরীক্ষা করেছিলেন সেই সবও তাঁকে স্যুররেয়ালিস্টদের কাছাকাছি নিয়ে যায়। ত্রিস্তাঁ জারা প্রমুখ দাদাবাদীদের বিদ্রোহ, যা আসলে হয়ে উঠেছিল নৈরাজ্য ও প্রলাপময় হট্টগোলের আশ্রয়; আঁদ্রে ব্রঁতো, ফিলিপ সুপো ও লুই আরাগঁ-র সাহচর্য পেলেও তাঁদের ধরে রাখতে পারেনি। নঞর্থক এই আন্দোলন থেকে সরে এসে তাঁরা বিদ্রোহকে নতুন মাত্রা দিতে চেয়েছেন স্যুররেয়ালিসম-এর আশ্রয়ে। সমাপ্তি ঘটেছে দাদাবাদের। বস্তুত, এই আন্দোলনের মধ্যেই সুপ্ত হয়ে ছিল স্যুররেয়ালিজম-এর বীজ। দাদাবাদের সঙ্গে স্যুররেয়ালিজম-এর সম্পর্কও দ্বান্দ্বিকতামূলক। দাদাবাদ যদি ‘নাস্তি’র আশ্রয়, স্যুররেয়ালিসম তবে নাস্তির নাস্তি—এক নতুন স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি পরিলক্ষিত হয়েছে সদর্থক সৃষ্টিশীলতায় ও আদর্শবাদী ভাবনায়। ১৯২৪-এ প্রকাশিত ‘দ্য স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’-র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে লেখা হয়েছিল—‘মানুষের অধিকারের নতুন ঘোষণা করা অবশ্যই দরকার’। ১৯২০ থেকে ১৯২৪, দাদাবাদ থেকে স্যুররেয়ালিসম—বিবর্তনের এই কালকে বলা হয়েছে ‘লা পেরিয়দ দে সোমেই’, নিদ্রার সময়।
দাদা শব্দটির অর্থ শখের ঘোড়া (hobby-horse)। শব্দটি নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। বলা হয় যে অভিধান খুলে এই শব্দটি চোখে পড়েছিল বলেই সেটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। দাদা-দলের এক সদস্য কবি ও শিল্পী হান্স আর্প বলছেন—
আমি স্পষ্ট করে জানাতে চাই যে ত্রিস্তান জারা শব্দটি আবিষ্কার করেন ১৯১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায়। আমি আমার বারোটি ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানে ছিলাম যখন জারা প্রথম শব্দটির কথা বলেন এবং আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক ঔৎসুক্য তৈরি হয়েছিল। এটা ঘটেছিল জুরিখের টেরেস কাফেতে। আমাদের বলা হয়েছিল যে শুধুমাত্র আহাম্মক ও স্পেনীয় অধ্যাপকেরা তারিখের ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। আমাদের যা আগ্রহান্বিত করে তোলে তা দাদা চৈতন্য, আর আমরা সবাই দাদা শুরুর আগেই দাদা হয়ে গেছিলাম।
নঙর্থকতা, বিদ্রোহ, সমস্ত মূল্যবোধের ধ্বংসের দাদা ছিল শিল্প, সাহিত্য, নীতিকথা, সমাজের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রতিবাদ। অনেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে আত্মহত্যা ছিল জীবনের সমস্যা সমাধানের এক পথ, আর দাদা ছিল আত্মহত্যার দর্শনীয় ভঙ্গি, পাগলামি ও হতাশার অভিব্যক্তি। এই মানসিকতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ছিল এবং এ ছিল এক বিশ্বজনীন মানসিক অবস্থা। যেমন মার্শেল দুশ্যাঁ-র বিখ্যাত ছবি ‘কন্যাটিকে তার পাণিপ্রার্থীরাই নগ্ন করেছিল’ শুরু হয়েছিল ১৯১১ সালে। দুশ্যাঁ অবশ্য দাদাদের দলে ভেড়েননি। জাক ভাশে আর এক উদাহরণ। নৈরাজ্যবাদী ভাশে ১৯১৮ সালে আত্মহত্যা করেন। আঁদ্রে জিদের লাফসাদিয়ো্ চরিত্রের মতো তিনিও ছিলেন দাদা এবং যুদ্ধের সময় নাঁতের হাসপাতালে আঁদ্রে ব্রতোঁর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। শোনা যায় তিনি স্যুররেয়ালিস্ট আন্দোলনের হোতা ব্রতোঁর ভাবনাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলেন। দাদাবাদী প্রশ্ন—“সৌন্দর্য কী? কুৎসিত কী? বিখ্যাত, শক্তিমান, দুর্বল কী? কারপেনতিয়ের, রেনাঁ, ফশ কী? আমিই বা কী? জানি না। জানি না। জানি না।”
দাদা ইস্তেহার লিখেছিলেন ত্রিস্তান জারা। তাঁর একটি দাদাবাদী কবিতা এইরকম –
তোমার ভিতরে আছে জ্বলন্ত বাতিরা
আছে জলাভূমির নীল মধু
একটা বিড়াল গুটিসুটি বসে আছে ফ্লেমীয় সরাইখানার সোনার ভিতরে
বুম বুম
অনেক বালি-হলুদ রঙের সাইকেলচালক
পোপেদের শাতোনফ
ম্যানহাটান যেখানে তোমার সামনে বিষ্ঠার বালতিগুলো
মাবেজ মাবেজ মাজেবাজ মেগাঁগাঁ গারু
দ্রুত তুমি চোখ বুলিয়ে নিচ্ছ আমার ভিতরে
নৌকার পেটের মধ্যে ক্যাঙ্গারুরা…
দাদাবাদীদের মুখপত্রের নাম ‘ক্যাবারে ভলতের’। প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৯১৬ সালে। সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল জারা, হুয়েলসেনবেক, এনি হেমিঙ্গস, জানকো ও অন্যদের কবিতা। তাদের ছিল দাদা গ্যালারি। সেখানে ছবির প্রদর্শনী হয়েছে পল ক্লি, ক্যান্দিন্সকি, আর্প, ম্যাক্স আর্নস্ট প্রমুখ শিল্পীদের। দাদাবাদীদের দ্বিতীয় পত্রিকা ছিল দাদা-১, ক্রমশ দাদা-২ ইত্যাদি। কোনো পত্রিকাই কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। একটি বন্ধ হয়েছে, রাতারাতি আর একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্রোহ ছাড়া দাদার আর কিছুই ছিল না – একটা প্রলাপের মতো, যা সাধারণ পাঠকের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না।
যে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে সেটি হল আঁদ্রে ব্রতোঁর ‘লিতেরাচ্যুর’, পল এল্যুয়ারের ‘প্রোভার্ব’ ও জারার কিছু লেখা। ১৯২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে দাদাবাদীদের মধ্যে অসন্তোষ ও মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। এই বিরোধ স্পষ্ট হয় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যার নাম La Mise en accusation et
jugement de M. Maurice Barres par DADA (দাদা কর্তৃক মরিস বারে-র বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার), যা ঘটেছিল ১৩ মে, ১৯২১, সাবান্ত সোসাইটির হলে। আঁদ্রে ব্রতোঁ ঘোষণা করলেন দাদাবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই। অনেকেই ব্রতোঁর পক্ষে থাকলেও দাদাবাদের স্রষ্টা জারা মানতে পারেননি যে দাদাবাদ শেষ হয়ে যাবে। তিনি শেষ চেষ্টা করেছিলেন দাদাবাদী নাটক ‘দাড়িওয়ালা হৃদয়’ মঞ্চস্থ করার। সেখানেও দাদা-বিরোধীরা গিয়ে নাটক বানচাল করে দেয়। আর এভাবেই দাদা-অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
ক্রমশ