ধা রা বা হি ক । পর্ব ৫
স্যুররিয়ালিজম-এর সঙ্গে ফ্রান্সের কম্যুনিস্ট দলের যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার কথা আগেই বলেছি। সে সময়ের লেখাপত্রেও এই অস্বস্তি ধরা পড়েছে। পিয়ের নাভিল-এর ‘লা রেভোল্যুসিয়ঁ এ লে আঁতেলেকচ্যুয়েল’ (La Révolution et les Intellectuels) এবং আঁদ্রে ব্রতোঁর ‘লেজিতিম দেফঁস’ (Légitime Défense) এই অস্বস্তি বহন করছে। অন্যদিকে, Au Grand Jour নামে কম্যুনিস্টদের ঘোষণাপত্রেও সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা গেছে। এ সবই ঘটেছে ১৯২৭ সালে। স্যুররিয়ালিস্টরা বারবার এটা বলতে চেয়েছেন যে, শ্রেণি সংগ্রামের চেতনা সবসময় ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’র মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় না; এবং প্রচারধর্মী রচনা সবসময় গবেষণাধর্মিতাকে এড়িয়ে চলে না।
কম্যুনিস্টদের সঙ্গে সবচেয়ে পার্থক্যের জায়গাটা হল, স্যুররিয়ালিস্টরা ভেবেছে যে পুঁজিবাদী বুর্জোয়াতন্ত্রের প্রতি ঘৃণার সাযুজ্যে একত্রিত হওয়া ঘোষিত বিপ্লবীদের চিন্তার স্বাধীনতা ও তা প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে কম্যুনিস্ট দলের কোনো লাভ হবে না। কারণ সুযোগ পেলেই বিপ্লবীরা দ্বন্দ্ববাদী বস্তুবাদের প্রতি তাদের বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভাবনা স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছে।
এইসব কারণে স্যুররিয়ালিস্টদের কার্যকলাপকে শুধুমাত্র ‘অটোম্যাটিজম’ এর ব্যাখ্যায় ধরা যাবে না। তাঁদের রচনা সাধারণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁদের দাবি এই যে তাঁদের রচনা ও ছবি বিশ্বকে নতুন করে নির্মাণ করার একটি প্রকল্পের অঙ্গ, আর এই পুনর্নির্মাণের কাজে লোত্রেয়ামঁ ও লেনিন সমানভাবে সক্রিয়।
স্যুররিয়ালিস্টদের পত্রিকা ‘স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’-এর প্রকাশ বন্ধ হয়নি। অক্টোবর, ১৯২৭-এ বেরিয়েছে ৯-১০ যুগ্ম সংখ্যা। এই সংখ্যার বিশেষত্ব হল এই যে, এখানে একটি চাঞ্চল্যকর রচনা প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম ইংরেজিতে—HANDS OFF LOVE, যেখানে যৌন নৈতিকতা বিষয়ে স্যুররিয়ালিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এই রচনার সূত্র অবশ্য অভিনেতা চ্যাপলিনের বিবাহবিচ্ছেদের মামলা। একই বিষয়ে আর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে মার্চ, ১৯২৮-এ সংখ্যা ১১তে। শিরোনাম—সেক্সচ্যুয়ালিটি বিষয়ে গবেষণা। স্যুররিয়ালিস্টরা সব ব্যাপারেই সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দাবি করে এসেছে, এবং ‘সেক্সচ্যুয়ালিটি’র ক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়।
১৯২৮-এর মার্চের পর ‘স্যুররিয়ালিস্ট বিপ্লব’ আবার বেরিয়েছে ডিসেম্বরে। এই দীর্ঘ সময় পর পত্রিকা বের করার কারণ হল স্যুররিয়ালিস্টদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব এক সংকটের চেহারা নিয়েছিল বলে আঁদ্রে ব্রতোঁকে দ্বন্দ্ব নিরসনে নামতে হয়। তিনিই লিখলেন দ্বিতীয় স্যুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো। এই ম্যানিফেস্টো বেরিয়েছে পত্রিকার ডিসেম্বর, ১৯২৯ সংখ্যায়। অনেক কারণেই এই ইস্তাহারকে কেউ কেউ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। গত পাঁচ বছরের স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলন চালানোর অভিজ্ঞতা ব্রতোঁকে নতুন চিন্তায় পরিচালিত করেছে। তিনি যেন নতুন করে শুরু করতে চাইলেন। এ ছাড়া হয়তো উপায়ও ছিল না। কারণ ইতিমধ্যে আর্তো, কারিভ, দেলতেল, জেরার, ল্যাঁবুর, মাসোঁ, সুপো ও ভিত্রাক সাংবাদিকতা, ব্যবসা ও অন্যান্য পেশা গ্রহণ করেছেন; আর রবের দেসনস ও রিবমঁ-দেসাইন স্যুররিয়ালিজম ত্যাগ করে সাহিত্য জগতে সাফল্যের সন্ধান করেছেন। এইসব ঘটনাক্রম স্যুররিয়ালিজম আন্দোলনকে দুর্বল করেছে। কিন্তু ব্রতোঁ সব উপেক্ষা করেছেন। স্যুররিয়ালিজম-এর শুদ্ধতার প্রতি তাঁর নিষ্ঠা এতো গভীর যে তিনি আবার নতুন করে আন্দোলনে মনোযোগ দিতে চেয়েছেন।
দ্বিতীয় ইস্তাহারে ব্রতোঁ লিখলেন—
“স্যুররিয়ালিজম-এর প্রাক্তন ও বর্তমান অনুগামীদের মধ্যে যতোই বিতর্ক থাক, একটা বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে স্যুররিয়ালিজম-এর পথভ্রষ্টতা ঘটেছে সাধারণ ও বিশেষভাবে চেতনার সংকটের দিকে, আর যখন এমন ঘটছে বা অসম্ভব মনে হচ্ছে যে আন্দোলন সফল হবে কিংবা বিলীন হয়ে যাবে তা তখনই নির্ধারিত হয়ে যাবে।”
“বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে এটা ছিল এবং এখনো আছে যেকোনো ভাবে সব প্রকট করে দেবার প্রশ্ন এবং যেকোনো মূল্যে দ্বন্দ্বের কৃত্রিম চরিত্রকে চিনে নেবার শিক্ষা, যাতে দ্বন্দ্বের মধ্যে কপটতাপূর্ণভাবে হিসেব করে অস্বাভাবিক উদ্দীপনার পথে পা রাখায় বাধা দেওয়া যায়, অথচ যে পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতিকে যেকোনো বন্ধন থেকে যেকোনো মূল্যে মুক্ত করা। মৃত্যুর বিভীষিকা, দুর্মর ভাঁড়ামি, স্বপ্নে অতি উত্তম মেধার ভেঙে পড়া, বাবেল টাওয়ার, অসঙ্গতির আয়না, মস্তিষ্কের অলঙ্ঘনীয় রৌপ্যখচিত দেওয়াল— মানবজাতির এই সমস্ত বিপর্যয়ের চমকপ্রদ চিত্রকল্প শেষ পর্যন্ত চিত্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।”
“এই সব কিছু একটা ইঙ্গিত দেয় যে আধ্যাত্মিক স্তর বলে একটা ব্যাপার আছে যেখানে জীবন ও মৃত্যু, বাস্তব ও কাল্পনিক, অতীত ও ভবিষ্যত, সংযোগ সমর্থ ও সংযোগ অসমর্থ, উচ্চ ও নিচু ইত্যাদিকে বিপরীত বলে মনে করা হয় না। আমার পক্ষে তাই নির্বুদ্ধিতা হবে যদি এই স্তরটিকে নির্ধারণ করা ছাড়া স্যুররিয়ালিজম-এর অন্য কোনো উদ্দেশ্যের কথা আমি বলি। কারণ এর সম্পূর্ণ ধ্বংসকারী বা সম্পূর্ণ সৃষ্টিকারী চরিত্রের কথা ভাবা যায় না। ব্যাপারটা পরিষ্কার— ধ্বংস ও নির্মাণকে একে অপরের বিরুদ্ধে স্থাপন করা যাবে না। এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে স্যুররিয়ালিজম-এর পাশাপাশি শিল্পের নামে যা কিছু চলছে তাতে স্যুররিয়ালিজম-এর কোনো মাথাব্যথা নেই; কারণ এ হলো বিরোধী-শিল্প, দর্শন বা বিরোধী-দর্শন।…”
“আমরা বিশ্বাস করি যে স্যুররিয়ালিস্ট কাজপত্রের সাফল্য নির্ভর করছে কতটা নৈতিক জীবানুমুক্তিকরণের সঙ্গে এই কাজ হচ্ছে তার ওপর, আর এই নৈতিক নির্বীজন এমন বিষয় যে কিছু মানুষ এখনও তাকে প্রশ্রয় দেয়। তা না হলে মনের ক্যানসার প্রতিরোধের উপায় থাকত না।…”
“যে মানুষ ভুল করে নিজেকে দানবিক ঐতিহাসিক ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে নিজেকে ফেলে, তারও এই স্বাধীনতায় বিশ্বাস করার অধিকার আছে। পুরনো মেঘ ঘোরাফেরা করছে এবং মানুষটির অন্ধ শক্তিগুলো মুখ থুবড়ে পড়লেও সে নিজেই নিজের প্রভু। তার কি সংক্ষিপ্ত ও হারানো সৌন্দর্যের অনুভূতি কিংবা প্রবেশযোগ্য, সহনশীল সৌন্দর্য নেই? ভালোবাসার চাবি পেয়েছেন বলে কবি দাবি করেন, আর এই মানুষটিও তাই করতে পারবে যদি সে চারপাশে দৃষ্টিপাত করে। সবকিছু নির্ভর করছে সেই লোকটি বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থাকা ও মৃত্যুর অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে কি না তার ওপর। সমস্ত নিষেধকে সে ঘৃণা করতে শিখুক, প্রতিরোধের অস্ত্র ‘চিন্তা’কে সে ব্যবহার করুক জীবিতের ও বস্তুর সব ধরনের পাশবিকতার বিরুদ্ধে, আর সে ব্যর্থ হবে যদি এই পৃথিবী ব্যর্থ হয়, অসহায় রাইফেলের গুলিকে সে অভ্যর্থনায় পরিণত করুক।”
স্পষ্টতই, আঁদ্রে ব্রতোঁ এই ইস্তাহারে প্রথম দিকের ‘অটোম্যাটিজম’-এর স্যুররিয়ালিস্ট পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা করছেন, স্যুররিয়ালিজম-এর নৈতিক ভিত্তি খুঁজেছেন, সংজ্ঞা দিয়েছেন এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে স্যুররিয়ালিস্টদের বিশ্বাসকে নতুন করে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলছেন, এই দর্শনে বিশ্বাস রেখেও ভালোবাসার, স্বপ্ন দেখার, পাগলামির, শিল্পের, ধর্মের সমস্যার কথা আমরা ভাবতে পারি, কারণ আমরাও বিপ্লবের কথা ভাবি।
স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় ইস্তাহার যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা আমরা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনায় লক্ষ করব।
ক্রমশ