Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক । পর্ব ৭

সৈয়দ কওসর জামাল

jamal_sm

স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলন ও ফরাসি কবিতা

১৯৩০ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে স্যুররিয়ালিস্ট কবি রনে শারের ‘আরতিন’ সিরিজের গদ্য। এক অনির্বচনীয় অস্তিত্বের তাগিদে তিনি লিখে গেছেন অস্পষ্ট ভাবনাসূত্রের প্রতিবেদন। যেমন তিনি লিখলেন—“কখনও একটি অসতর্ক আন্দোলনের ফলে তৈরি হল মাথা, সেটা আমার ছিল না তবু আরতিনের গলায় গিয়ে বসেছিল। তারপর অনেকটকা গন্ধক নিজের ভিতরকার ধোঁয়া ও কম্পমান নৈঃশব্দ ছাড়াই আস্তে আস্তে নিজেকে খেয়ে ফেলল।” রনে শারের এই সময়কার গদ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালে, গ্রন্থের নাম ‘মালিক ছাড়াই হাতুড়ি’ (Le Marteau sans maître)। স্যুররিয়ালিস্ট কবিদের মধ্যে একমাত্র শার-ই কবিতার স্বচ্ছতা ও অন্যান্য খুঁটিনাটি দিকে নজর রাখতেন। এই সময় থেকে তাঁর স্যুররিয়ালিজম থেকে দূরে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত মেলে। রনে শারের স্যুররিয়ালিজম যোগ সম্পর্কে আলব্যের কাম্যু খুব সুন্দর একটি মন্তব্য করঞ্ছিলেন। তিনি বলেন যে ‘রনে শারের এই সংযোগ অনুগামীর মতো ছিল না, তা ছিল সঙ্গীর মতো—আর তাতেই তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন যে নিজের পথে একা চলার মতো প্রত্যয় তাঁর আছে’। অথচ এও সত্যি যে স্যুররিয়ালিস্ট ঐতিহ্য বহন করার ক্ষেত্রে রনে শার অন্যদের চেয়ে বেশিই সমর্থ ছিলেন। Le Poèmepulvérisé নামক গদ্যে শার বলেছেন যে আঁদ্রে ব্রতোঁ ও অন্যদের মতো তিনিও ‘বৈপরীত্যের এই বৈপ্লবিক ও নির্জন জগতে’-র মুখোমুখি হন এবং তাঁর সামনের অপরিচিত চিত্রগুলো ছাড়া চলতে পারেন না। আবার চিত্রগুলোকে তিনি ঠিকমতো বুঝে উঠতেও পারেন না। এও স্যুররিয়ালিস্টদের হতাশার কারণ। এই জগতে তাই একজন শিল্পীকে হতে হয় অন্বেষক বা অভিযানকারী। আর কবিতা হল সেই অন্বেষণের মাধ্যম যেখানে শব্দ ও অর্থ সদা বিবাদমান। ইল্যুশনের জগতকে সরিয়ে রেখে সামনে স্বপ্নের জগতের দিকে তাকাতে প্রয়োজন অযৌক্তিকতার শক্তি। তাই তাঁর কবিতা খণ্ডতা দিয়ে গড়া, অসম্পূর্ণ বাক্য ও খণ্ড মেটাফরে ভরা।

     কবিদের মতো চিত্রশিল্পীরাও প্রথম থেকেই স্যুররিয়ালিজম আন্দোলনের সঙ্গে থেকেছেন। প্রথাগত চিত্রসমালোচকদের অভিযোগ যে স্যুররিয়ালিস্ট চিত্রীরা গঠনগত দক্ষতা, সুক্ষ্ম ড্রয়িং, ক্র্যাফটম্যানশিপ ইত্যাদির পুরোনো স্তর মানেন না। যেভাবে ব্রতোঁরা মিলিতভাবে কবিতা লিখেছেন, শিল্পীরা তেমনভাবে একসঙ্গে মিকে ছবি আঁকলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে ভেবে তাঁরা চিন্তিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে শিল্পীব্যক্তিত্বের কী হবে? বস্তুত, স্যুররিয়ালিস্ট ছবির জন্য শিল্পীরা প্রয়োজন বোধ করেছিলেন বাঁধনহীন কল্পনার। স্যুররিয়ালিজম-এর এইসব দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন লুই আরাগঁ তাঁর La Peinture au Défi নামে ক্যাটালগের ভূমিকায়, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩০ সালে প্যারিসে কোলাজ পেন্টিং-এর প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে। তিনি কোলাজ ছবির প্রধান চারটি ধারার কথা বলেছেন। ১) কিউবিস্ট কোলাজ (জর্জ ব্রাক, পাবলো পিকাসো) ২) দাদাইস্ট কোলাজ (মারসেল দ্যুশ্যাঁ, ফ্রাসিস পিকাবিয়া) ৩) স্যুররিয়ালিস্ট বা কাব্যিক কোলাজ ( মাক্স আর্নস্ট, রনে মারগ্রিত) এবং ৪) প্রচারের জন্য কোলাজ। আরাগঁ-র উদ্দেশ্য এটা বোঝানো যে কোলাজ শুধুমাত্র স্যুররিয়ালিস্ট অনুশীলন নয়। তবে স্যুররিয়ালিস্টরা কোলাজের পরিসর বাড়িয়েছেন। খবরের কাগজ, দেয়ালপেপার, সিগারেটের প্যাকেট কোলাজে ব্যবহার করেছেন পিকাসো ও ব্রাক। এ সম্পর্কে ত্রিস্তাঁ জারা বলেছেন যে, এইভাবে যে ডিজাইন বা ছবি তৈরি হয়েছে তাতে আপাত বাস্তবের মধ্য দিয়ে মনোজগতের আর এক বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে। কিউবিস্টদের থেকে এগিয়ে স্যুররিয়ালিস্ট আর্নস্ট কোলাজ করলেন অন্য পুরোনো দিকের বিস্মিত ছবির অংশ জুড়ে। মিরো ব্যবহার করেছেন পেরেক, দড়ি, কাঠের টুকরো ও সেইসঙ্গে ছেঁড়া কাগজ। আর এইসব  নিরীক্ষা স্যুররিয়ালিস্ট বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করেছে, বলেছেন সালভাদর দালি, ডিসেম্বর, ১৯৩১-এ স্যুররিয়ালিস্ট পত্রিকা ‘ল্য স্যুররেয়ালিসম ও সারভিস দ্য লা রেভোল্যুসিইয়ঁ’-তে। স্যুররিয়ালিস্ট বিষয়গুলো নানা ধরনের, নানা আকারের এবং নানা জটিলতায় ঘেরা। এগুলোকে বলা যায় প্রতীক হিসেবে কাজ করা বিষয়। যেমন মারসেল দ্যুশ্যাঁর চিনির খাঁচা, ব্রতোঁর  Nadja-য় বর্ণিত ব্রোঞ্জের দস্তানা, জিয়োমেত্তির ভাস্কর্যের কিছু অংশ, মিরোর কিছু কাজ—সবকিছুই সুয়ররিয়ালিস্ট বিষয়, যা কংক্রিট ফ্যান্টাসি, অযৌক্তিক ও স্বেচ্ছাচারী। অচেতনার স্বয়ংক্রিয় ভাবনার মধ্যে এই বিষয়গুলো জন্ম দেয় এক অতিবাস্তবতার। ‘ল্য স্যুররেয়ালিসম ও সারভিস দ্য লা রেভোল্যুসিয়ঁ’ পত্রিকার তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যায় দালির স্যুররিয়ালিস্ট বিষয় ছাড়া ছিল হেগেলের প্রতি স্মরণলেখ, আর আঁদ্রে ব্রতোঁর ‘লে ভাস কম্যুনিকান্ত’ এর অংশবিশেষ। আর কবিতা ছাড়াও ছিল লুই আরাগঁর দুটি রচনা—লুইস ক্যারোল, আর স্যুররিয়ালিজম ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ। চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশত হয়েছে ব্রতোঁর আগের রচনার পরবর্তী অংশ, ত্রিস্তাঁ জারার কবিতার পরিস্থিতি বিষয়ে প্রবন্ধ, দালির রচনা ‘স্বপ্ন’, এবং পল এল্যুয়ার-এর গুচ্ছকবিতা।  কবিতা প্রসঙ্গে এল্যুয়ার নিজের কবিতায় লিখেছেন—

     আমি অবশ্যই ঘৃণা করি বুর্জোয়াদের দিন

     এ রাজত্ব পুলিসের, পুরোহিতদের

     কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তাঁকে

     যিনি আমার মতন সর্বশক্তি দিয়ে

     ঘৃণা করেন না ঘৃণ্য এ রাজত্বকাল।

     আমি সেই ঘৃণ্য মানুষের মুখে থুতু দিই

     আমার সমস্ত কবিতার মধ্যে যিনি

     পছন্দ করেন না কবিতার এই বিশ্লেষণ-কথা।

 

অনেকের ধারণা, লুই আরাগঁ তাঁর প্রবন্ধ ‘স্যুররিয়ালিজম ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’ লেখার সময় থেকেই স্যুররিয়ালিজম সম্পর্কে তাঁর মনে মতদ্বৈততার বীজ রোপিত হয়েছিল। ১৯৩০ সালে তিনি ও জর্জ শাদুল স্যুররিয়ালিজম আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত  বিপ্লবী লেখকদের খারকভ কংগ্রেস-এ। আর এই সময় থেকে তাঁর মনে স্যুররিয়ালিজম সম্পর্কে দ্বিধার সূচনা হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রবন্ধে যদিও তিনি স্যুররিয়ালিজম-এর পক্ষে বলেছেন এবং খারকভ কংগ্রেস-এ স্যুররিয়ালিজম-বিরোধী প্রস্তাবের নিন্দা করেছেন, তবু কোথাও দ্বিধার ইঙ্গিত ধরা পড়েছে কারো কারো কাছে। স্পষ্টভাবে তিনই তাঁর মনোভাব প্রককাশ করেননি হয়তো এই কারণে যে তখন পর্যন্ত তিনি নিশ্চিত ছিলেন না গোঁড়া কম্যুনিস্টরা তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করবেন। তিনি মস্কো থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিপ্লবী লেখকদের সংগঠনের ফরাসি সংস্করণের মুখপত্রে ‘লাল সীমানা’ নামের একটি আক্রমণাত্মক কবিতা লেখেন, আর এর ফলে ফরাসি পুলিস এক মাস পরে পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করে এবং আরাগঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। মূলত দুটি অভিযোগ ছিল আরাগঁ-র বিরুদ্ধে। এক) হত্যার প্ররোচনা এবং দুই) সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভাঙার প্ররোচনাদান।  প্ররোচনা দানের অভিযোগ উঠেছিল কবিতার এমন কিছু পঙক্তির জন্য—

    

আগুন লাগুক লিয়োঁ ব্লুমে

     আগুন লাগুক বঁকুর ফ্রোসার দি-তে

        আগুন লাগুক সামাজিক গণতন্ত্রের প্রশিক্ষিত ভল্লুকদের গায়ে।

 

১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে এই ঘটনার পর স্যুররিয়ালিস্ট গ্রুপ, আরাগঁ যার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, একটি প্রতিবাদপত্র সারা ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়। আশঙ্কা করা হয় যে অভিযুক্ত আরাগঁ-র পাঁচ বছর অবধি জেল খাটার সম্ভাবনা, যা ফ্রান্সে কখনও ঘটেনি। কোনো কাব্যিক রচনার জন্য আইনের এই প্রয়োগের বিরুদ্ধে আহ্বান করা হয়েছে এবং অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। তিন হাজারের বেশি গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখকেরা এই আবেদনে স্বাক্ষর করেন এবং আন্তর্জাতিক ‘রেড এড’-এর ফরাসি শাখার ষাট হাজার সদস্য তাঁকে সমর্থন করেন। ফরাসি সরকার আরাগঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে আর এগোয়নি, বা আরাগঁ-র কবিতাকে আর গুরুত্ব দিতে চায়নি।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...