ধা রা বা হি ক । পর্ব ৯
পরের বছর, ১৯৩৫ সালে আঁদ্রে ব্রতোঁ ও পল এলুয়ার প্রাগ-এ গেছেন। সেখানে অনেক বামপন্থী সংগঠনের সভায় বক্তৃতা করেছেন তাঁরা। সেই সব বক্তৃতা খুবই সমাদৃত হয়েছে। আর এই ভ্রমণের ফলেই আন্তর্জাতিক স্যুররিয়ালিস্ট বুলেটিনের প্রথম প্রকাশ ঘটেছে। এ বছরই মে মাসে ব্রতোঁ ও বেনিয়ামিন পেরে তেনেরিফ-এ গিয়ে স্যুরলিয়ালিস্ট ছবির প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। বেরিয়েছে বুলেটিনের আর একটি সংখ্যা। প্যারিসে ফিরে দ্বিগুণ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছেন স্যুররিয়ালিস্টরা। অনেকগুলো আলোচনাসভার আয়োজন করেছেন তাঁরা। বক্তা স্যুররিয়ালিস্টরাই। যেমন, আঁদ্রে ব্রতোঁর বিষয় ‘বর্তমানে শিল্পের রাজনৈতিক অবস্থান’, আর্নস্ট বলেছেন মানসিক নিরীক্ষা বিষয়ে, পেরের বিষয় ধর্ম বিষয়ে একটি প্রতর্ক, আর্প বলেছেন নারী স্যুররিয়ালিস্টদের সম্পর্কে। এমন অনেক বিষয়। বক্তা থেকেছেন পল এলুয়ার, সাল্ভাদর দালিসহ অনেকে।
নানা ধরনের বক্তৃতাসভা আয়োজনের মধ্যেই এক দুঃখজনক ঘটনা সবাইকে বিহ্বল করেছে। আত্মহত্যা করেছেন স্যুররিয়ালিস্ট রনে ক্রভেল। এই মৃত্যুতে সবাই মর্মাহত হয়েছেন। কিন্তু এই আকস্মিক বিহ্বলতা কাটিয়ে আবার তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। গত এক বছরে যেভাবে এই আন্দোলন অন্যান্য দেশে বিস্তারলাভ করেছে, তাতে তাঁরা সবাই উদ্দীপ্ত বোধ করেছেন। তাঁরা ইংল্যান্ডে আন্দোলনের প্রসার চেয়েছেন এবং ব্রতোঁ ও এলুয়ার পরের বছর লন্ডনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। ক্রমশ তাঁদের স্বপ্ন যেন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে।
১৯৩২ সালে ‘Ce Trimestre’ পত্রিকার স্যুররিয়ালিস্ট সংখ্যায় ব্রতোঁ লিখেছিলেন—
ক্রমশ আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে পৃথিবীর চার প্রান্ত জুড়ে ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ ও নিরীক্ষার আয়োজন করা মোটেই আর অবাস্তব ভাবনা নয়। (স্যুররিয়ালিজম) প্রয়োগ করার বিষয়ে এই পরিকল্পনা সম্ভব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সব দেশের তরতাজা তরুণদের মধ্যে অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষার আদানপ্রদান ঘটছে এবং বিধ্বংসী শক্তিগুলির পরিমাপ করে নির্দিষ্ট একটা সময়ে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। আমাদের হাতে পরিসর অপর্যাপ্ত হওয়ায় এখন এই পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেওয়া যাবে শুধু। কিন্তু সাবধান! স্যুররিয়ালিজমকে তার যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে তুলে আনাই যথেষ্ট এবং আমাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই যদি দেখি কোনোদিন যে চায়ের পেয়ালাতেই ঝড় উঠছে।
শুধুমাত্র চায়ের পেয়ালাতেই নয়, স্যুররিয়ালিজম ১৯৩৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশেই শিল্পসাহিত্যের জগতে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং ঝড়ের ইঙ্গিত দিয়েছে। জর্জ য়্যুনে (Georges Hugnet) ১৯৩৪ সালে দীর্ঘ ভূমিকাসহ সম্পাদনা করেছেন স্যুররিয়ালিস্ট রচনাসংকলন Petite Anthologie Poètique du Surréalisme, যেখানে সংকলিত হয়েছে ১১ জন স্যুররিয়ালিস্ট লেখক ও ১৩ জন শিল্পীর কাজ। গ্রন্থের ভূমিকাটিকে এখন পর্যন্ত স্যুররিয়ালিজম সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য রচনা বলে মনে করা হয়। এই বছরই প্রকাশিত হয়েছে আঁদ্রে ব্রতোঁর গত ১০ বছর ধরে রচিত নিবন্ধের সংকলন Point du Four, প্রকাশিত হয়েছে ব্রতোঁর কবিতার সংকলন L’Air de l’eau, এলুয়ার-এর নতুন কবিতা La Rose publique, বেনিয়ামিন পেরে-র De Derrière les Fagots এবং আর্নস্ট-এর অসাধারণ ‘কোলাজ উপন্যাস’ Une Semaine de Bonté ইত্যাদি। ১৯৩৫ সালের গোড়াতেই ত্রিস্তাঁ জারা লিখেছেন নিরীক্ষামূলক স্বপ্নের কথা–Grains et issues, যে গ্রন্থ L ‘Homme approximatif এর পর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। প্রথম অংশে জারা গদ্যের সঙ্গে মিশিয়েছেন কবিতা এবং তৈরি করেছেন স্বপ্ন ও অনিয়ন্ত্রিত ভাবনার অযৌক্তিক জগৎ; এবং দ্বিতীয়াংশে এই ‘স্যুররিয়াল’ কেন ও কীভাবে নির্মিত হয়েছে তার বিশ্লেষণ করেছেন জারা। মার্কসীয় বিচার অনুসারে তিনি সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন স্যুররিয়ালিস্ট কবিতাকে। স্যুররিয়ালিজম তাঁদের মতে জন্ম দেবে এক নতুন সমাজের সংস্কৃতি যা হবে বিপ্লবের ফসল। জারা বলছেন যে, স্যুররিয়ালিজম এক নতুন মানসিকতার বীজ, পৃথিবীকে জানার এক নতুন পদ্ধতি, যা পুরনো বিচারধারা ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে বদলে দেবে।
আমরা দেখেছি যে স্যুররিয়ালিজম মনোজগতের এক কার্যকলাপ। এর সঙ্গে দেশ বা কালের সম্পর্ক নেই। উনিশ শতকের ফ্রান্সের চিন্তাচেতনার জগতে যা ঘটছিল তার প্রকাশ হয়েছে এই আন্দোলনের ভিতর দিয়ে। আর এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন একদল কবিলেখকশিল্পী, যাঁরা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে মনের অতুল সম্ভাবনার সন্ধান করতে চেয়েছেন। আন্দোলন হিসেবে স্যুররিয়ালিজম একটি পর্ব অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে, যেমন ইংল্যান্ডে, ভাবা হয়েছে যে স্যুররিয়ালিজম ইংরেজি ঐতিহ্যের অনুকূল নয়, এবং জাতীয় মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায় না, কারণ তা প্যারিস থেকে আমদানি করা। কিন্তু কেউ কেউ আবার শেক্সপিয়র, মারলো, কোলরিজ, ব্লেক প্রভৃতির রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে স্যুররিয়ালিস্ট উপাদান খোঁজার চেষ্টা করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ভিয়েনায় উদ্ভুত বলে ইংল্যান্ডে অচ্ছুত হয়ে যায়নি। আর স্যুররিয়ালিজমও ফরাসি সংস্কৃতির অঙ্গীভূত ছিল না। এর সঙ্গে মিশে আছে হেগেল, ফুয়েরবাক, মার্কস, এঙ্গেলস প্রমুখ চিন্তাবিদের দর্শন। স্যুররিয়ালিজম যে কোনো জাতীয়তাবাদী ভাবনার ঊর্ধ্বে। তা সৃষ্ট হয়েছে মানুষের সাম্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
কবিতার আন্দোলন হিসেবে স্যুররিয়ালিজম-এর লক্ষ্য থেকেছে স্বতঃস্ফূর্ত লেখনি, ‘বিশুদ্ধ’ কবিতা এবং কবিতা ও স্বপ্নের পরিপূরক সম্পর্ক। এর পাশাপাশি শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে কোলাজ এবং সৃষ্টির তাৎক্ষণিকতা বা চান্স উপাদান। দাদাবাদীদের কবিতায় এলোমেলো শব্দসংগ্রহের প্রবণতা থেকে দালির প্যারানোইয়াক পদ্ধতি পর্যন্ত যে ধাঁরা তা ছিল আসলে ফ্রয়েডের স্বপ্নবিশ্লেষণ থেকে দৈনন্দিন জীবনের সাইকো-প্যাথোলজি প্রভাবিত। স্যুররিয়ালিস্ট জীবনচেতনায় বাস্তবের বাধাবিপত্তি যে প্রধান নিয়ন্ত্রক তা আঁদ্রে ব্রতোঁর চিন্তায় সক্রিয় থেকেছে। দালি ভেবেছেন যে স্যুররিয়ালিস্ট দ্রব্যেরা ‘আকাঙ্ক্ষার রূপ পরিগ্রহ করে’। স্যুররিয়ালিস্টরা অপেক্ষা করেনি কখন অভিজ্ঞতার বৃহৎ অসচেতনতা থেকে উঠে আসবে কবিতার ইমেজ। বরং তাঁরা তাঁদের ইচ্ছা ও অবসেশানজাত ইমেজকে বাস্তবের জগতের ওপর স্থাপন করেছেন।
এ সবের পাশাপাশি ছিল স্যুররিয়ালিস্টদের অপরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থান। তাঁরা আক্রমণ করেছেন বুর্জোয়া সমাজ, ধর্ম, দেশপ্রেম, এমনকি, পরিবারের ধারণাকেও। তাঁরা কম্যুনিজম-এর নীতির পক্ষে স্পষ্টভাবে কথা বলেছেন এবং সব দেশের সর্বহারাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
আর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন আঁদ্রে ব্রতোঁ। তাঁর কর্মক্ষমতা, উৎসাহ, উদ্ভাবনী চিন্তা স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে চালিত করেছে। তাঁর জন্যই স্যুররিয়ালিজম শুধুমাত্র কবিতা বা শিল্পের আন্দোলনমাত্র হয়ে ওঠেনি, তা হয়েছে এক স্বতন্ত্র ভাবনা ও চর্চার ধারা। আর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাই পালন করেছিলেন স্যুররিয়ালিস্ট কবিলেখকশিল্পীরা।
সমাপ্ত