Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক পর্ব ১০

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

আন্তর্জাতিক সেমিনার: একটি গরুপাচার প্রকল্প

‘গবেষণা’ শব্দটির ভার লঘু হয়ে গেছে অনেকদিন। কত আঁচলের তলায় মৃত শব্দের কোষ! না জেনেই লিটল ম্যাগাজিনের জন্য অ্যাকাডেমিক করুণা। জিভে জল আসে। লালার বিগ্রহের কাছে প্রতিদিন আত্মসমর্পণ। উষ্ণ শরীরের বিনিময়ে বেনামে ভরে ওঠে পাতার পর পাতা। অপ্রস্তুত এবং অপদার্থ গবেষকের তেলেনাপোতা ছদ্মবেশ। এই যখন অবস্থা তখন কেমন আছে সভাসমিতি, আন্তর্জাতিক সেমিনার, পুরস্কার বিনিময়ের অ্যাকাডেমিক রাজনীতি? তার স্বাস্থ্য এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দেখে মনে হয় ভয় নেই কোনো? সকলেই নানা চোখে দেখেন আর মৌলিকতার নামে ‘ জলের মতো সহজ ‘ করে বোঝান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজার দখল করেন। তপ্ত সেমিনারে হাত সেঁকে বাড়িয়ে নেন কেরিয়ারের গ্রাফ। আজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সেমিনার তাঁদের দখলে। মেধা নেই। শ্রম নেই। অযোগ্যতার জন্য দুঃখও নেই। শুধু আছে অনুশাসন। দাসপ্রথা। বিনিময়ের হাট। টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনে প্রমোশনের পথটুকুর সুযোগ্য ব্যবহার। আগামী সফরের জন্য আগাম পদলেহন প্রবীণ ‘অনির্বচনীয় হুণ্ডি’র কাছে।

গত দশ বছরে হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে নানা সেমিনার। হাস্যকর বিষয়। ততোধিক হাস্যকর গবেষণাপত্র উপস্থাপনের নামে স্বেচ্ছাচার। বেশ কিছুদিন আগেই ইউজিসি বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার বাধ্যতামূলক করেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা অধ্যাপকদের পদোন্নতির জন্য তা জরুরি। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের সার্বিক মূল্যায়নের এসব প্রয়োজনীয় উপাচার। শুধু মাত্র ভালো পড়ালেই চলবে না। চাই সেমিনার, বিভিন্ন পত্রিকায় গবেষণাপত্রের মুদ্রণ। আর তাই কিছুদিন ধরে সকলেই হয়ে উঠেছেন গবেষক এবং লেখক। অর্বাচীন আর অপদার্থদের পোয়া বারো। একমাসে দশটি সেমিনারে গবেষণা পত্রের উপস্থাপন। বিষয় যাই হোক কয়েকটি বই জড়ো করে টুকতে কতক্ষণ! চৈতন্যদেব, অনুবাদ সাহিত্য, আধুনিক কথা সাহিত্যিক,সস্তা চোখের জলের দেশভাগ , সব বিষয়ে এইসব গবেষক এবং অধ্যাপক প্রস্তুত। বিচারের প্রয়োজন নেই। বিবেচনার মূল্য নেই। রাশিরাশি নিম্নমানের সম্পাদিত গ্রন্থে বাঘ আর গরু একঘাটে জল খাচ্ছে। রাশিরাশি পাতার অপচয়। লাঞ্চপ্যাকেট আর সার্টিফিকেট কিনে বাড়ি ফেরা। পাঠক সম্ভাবনা নেই। শুধু সারহীন সম্ভার ছুটছে কেরিয়ার -প্রমোশনের দিকে। ইন্টারভিউয়ের গোলকধাঁধায় নিজের কাজ হাসিলের হাজার পন্থা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় – কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে গুপ্তচর। পিয়ার রিভিউ জার্নালের সম্পাদক সেজে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে অযোগ্য অধ্যাপক -গবেষকের নিম্নমানের লেখা মুদ্রিত হচ্ছে। ছাত্রের ছদ্মবেশে লেখক শিকারের দালাল ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আন্তর্জাতিক সেমিনারের কদর অবশ্য সবচেয়ে বেশি। নম্বর বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া সুযোগ ও সম্ভাবনা অনেক। আপাতত বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সেমিনারের কথাই ধরা যাক। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে বক্তা আনা আবশ্যক। আর এ বিষয়ে আমাদের দৌড় বাংলাদেশ পর্যন্ত। ওদেরও তাই। ফলে প্রায় প্রতিদিনই পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ থেকে বক্তা বিনিময়। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অথবা স্বনামধন্য লেখক বা কোনো আধিকারিক। বিষয় যাই হোক সকলেই সব জানেন। এমনকী দেহটুকু রাখলেই যথেষ্ট। যে যত বেশি অযোগ্য, অর্ধশিক্ষিত তার তত বেশি বক্তব্যের সুযোগ। প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। শ্রোতা মূলত কিছু গবেষক, অংশগ্রহণকারী অধ্যাপক এবং ছাত্রছাত্রীরা। প্রশ্নের সুযোগ অবশ্য আছে। কিন্তু উত্তরের কোন দায় নেই। কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্নের ছলে উত্তর নিক্ষেপ করে ভরসাযোগ্য হয়ে ওঠেন । এভাবেই বাংলাসাহিত্যের আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রতিদিন গরুপাচারের মতো অধ্যাপক এবং বক্তা বিনিময় চলছে। বিষয় আছে। অযোগ্য হলেও বক্তা আছে। শুধু ভাবনার পরিসর নেই। কথা বেশিদূর এগোয় না। শুধু পুস্পস্তবক, উপহার আর মধ্যাহ্নভোজের নীচে ঢাকা পড়ে যায় জ্ঞানচর্চার পথটি। খারাপ লাগে এইভেবে অনেক স্বনামধন্য মানুষ এইসব সেমিনারে সভা আলো করে থাকেন। তাঁদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে জাতে উঠতে চায় তাঁরা। পবিত্র সরকার থেকে আনিসুজ্জামান, সুমিতা চক্রবর্তী থেকে সেলিনা হোসেন সকলের অযাচিত প্রশ্রয় ঢেকে রাখে অনেক বিপজ্জনক প্রবণতা। কেন প্রত্যাখ্যান নেই তাদের তরফে? হয়তো সামাজিক দাবি। হয়তো স্নেহ অতি বিষম বস্তু। কুলাঙ্গার সন্তালতুল্য ছাত্রের জন্য অতিরিক্ত মায়া। নাকি নিরাপত্তার অভাব? নিজেকে খ্যাতির কাঠামোয় সাম্প্রতিক আর প্রাসঙ্গিক করে তোলার আয়োজন? জানি ষাট পেরোলেই শুরু হতে পারে খ্যাতি আর পুরস্কারের জন্য অনিবার্য লোভ। ক্ষমতার জন্য মরিয়া আত্মসমর্পণ। হীনম্মন্যতার বশে মাছের কাঁটার সফলতা’র দিকে যাত্রা। আর সত্তর পেরিয়ে আঙুল সর্বস্ব যৌনতারও বাজারমূল্য আছে সেকথাও আমরা ভুলিনি সম্ভবত।

এই যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেমিনারের নমুনা তখন কেমন আছে অন্যান্য সভাসমিতি, পুরস্কার -সম্বর্ধনা বা কবিসম্মেলনগুলি যারও রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্ভাবনা এবং বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ। ব্লার্বের আত্মজীবনীমূলক উজ্জ্বলতা। এখানেও কম বেশি একই অবস্থা। দু- একটি দুর্ঘটনা বাদ দিলে এখানেও অবৈধ গরুপাচার। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে অযোগ্য, উচ্ছিষ্ট এবং ধান্দাবাজ কবিদের অভাব নেই। তাই দুই ক্ষেত্রেই অনেক সংগঠক, পত্রিকা সম্পাদক দায়িত্ব নিয়ে কবি বিনিময় করেন। এবং বিনিময়ে জোটে ফুলের মালা, পুরস্কার, মানপত্র এবং কবিতা পাঠের সুযোগ। তারপর নিয়ম মেনে আপ্যায়নের অপ্রত্যাশিত আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ছবিসহ ফেসবুক উদযাপন। দেখে মনে হয় শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ পেয়ে তারা বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। এবং তার প্রতিভার যে এত গুরুত্ব এবং মূল্য তা বুঝতে পেরে মাথা নত হয়ে গেছে কৃতজ্ঞতায়। এর কোনো গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যে আদৌও আছে কি? শুধু পিতৃপুরুষের ভিটে নিয়ে আদেখলাপনার জল গড়ায় অনেকদূর। একুশে ফেব্রুয়ারির কঙ্কাল কেঁপে ওঠে অন্ধকারে।

অবশ্যম্ভাবী সংগ্রাহক আর ছদ্মবেশী পাঠকের ভীড়ে আজ আর প্রশ্ন তোলার তেমন সুযোগ নেই। সমালোচকও শেষপর্যন্ত কবি হয়ে ওঠেন। নানা আপোষে ভরে ওঠে তাঁর পথ। কয়েকটি প্রচলিত শব্দের বিনিময়ে অযোগ্য কবিতাকে যুগান্তকারী ভাবার সুযোগ করে দেন তিনি। তারও তো সম্ভাবনা আছে। মঞ্চের আলো আরও কিছুদিন নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষা করবে। বাৎসরিক যজমানি নিশ্চিত। তবুও সার্বিক চিত্র এমন হলেও সবটাই এমন নয়। অধ্যাপক – কবি বিনিময়ে অনেক মেধাবী এবং যোগ্য মানুষ ,কম হলেও আছেন। তাই ভাবনার সমস্ত দ্বার এখনও রুদ্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো মৌলিক চিন্তার পথ তৈরি করতে পারেনি এইসব প্রাতিষ্ঠানিক লোকাচার। তার সমস্ত সম্ভাবনা টাকার হিসেব আর তথৃ সাজাতে সাজাতেই চলে যায় আরেকটি প্রকল্পের দিকে। যেকোনো উদ্যোগকে শেষপর্যন্ত অসার গতানুগতিকতার পথে ঠেলে দিতে আমাদের রুচিতে বাধে না আজকাল। অথচ এইসব কেজো অনুষ্ঠানের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে ভাবনা উদ্রেককারী সেমিনার করে আসছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গবেষণার নামে নির্বিচার এবং নির্বিকার সংকলন তখন এত জরুরি হয়ে দেখা দেয়নি। রুচিহীন পিয়ার রিভিউ জার্নালের চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেদিনের এক্ষণ,অনুষ্টুপ, বারোমাস,মাননবন ইত্যাদি পত্রিকা। কোনো লোভের বশবর্তী না হয়েই। আজ বিপজ্জনক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবনা দখল করে নিচ্ছে সব আলোচনাসভা,ক্লান্ত সেমিনার। ‘আনিস কাকু’র পাজামার দড়ি ঠিক করে দেওয়া বাংলা সাহিত্য এবং গবেষণার কাজ নয় অনেকেই শেষপর্যন্ত একথা মনে রাখেননি।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...