Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক পর্ব ১১

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

একটি সাংস্কৃতিক চরিত্রের সন্ধানে

এই মানুষটির সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে। বাজারের মোড়ে অথবা নির্দিষ্ট কিছু চায়ের দোকানে। সবসময় ব্যস্ত। জীবনে এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশ্নাতুর। সাম্প্রতিক ছেলে মেয়েদের চলাফেরাকে সে সন্দেহের চোখে দেখে। আর প্রতিমুহূর্তে ভাবে সংস্কৃতি গোল্লায় যাচ্ছে। তার হাতে কিছু নেই। তবুও সে লুকিয়ে রেখেছে দুরারোগ্য কিছু রঙিন প্রস্তাব। যেন গর্ভের অন্ধকার থেকেই সে সাংস্কৃতিক এবং বাঙ্ময়। যেন বিংশ শতাব্দীর সকল মনীষী মৃত্যুর আগে তাঁকে খুঁজে ছিল। এমনই এক উত্তরসাধক বসে আছে আপনার পাশে । শুধু মাত্র কথার বিনিময়ে বিনা পয়সায় চাইছে চা এবং সিগারেটের অধিকার। আমরা সামান্য শিক্ষিত এবং কিছুটা সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ দায় নিয়েছি এদের আর আড়ালে হাসাহাসি করেছি।

কিছুদিন আগেও,নব্বই দশকে স্পষ্ট দেখা যেত তাঁদের। কোনো সাংসারিক বা পারিবারিক কাজের জন্য জন্ম হয়নি যাদের। এদের সব কাজ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য। গভীর রাতে বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কোনো সামাজিক কর্তব্য নেই। সারাদিন মনীষীদের বাণী বয়ে বেড়ানো ছাড়া অন্য কোনো সংবেদনা নেই। তাঁরা উদ্যোগী এবং উদ্যমী পুরুষ। প্রতিদিন কোন কবি বা মনীষীর জন্মদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নিতে হয় তাঁকে। যেকোনো ছুতোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং তার মুরুব্বী হয়ে ওঠাই তাঁর একমাত্র ভবিষ্যৎ। কোন কুক্ষনে সামান্য কিছু সাহিত্যের বুলি সে আত্মস্থ করেছিল ভেবে অবাক হই। দু-একটি কবিতা শিরোধার্য করে হয় সে আবৃত্তির মাস্টারমশাই অথবা মঞ্চের ঘোষক। কোনো অনুষ্ঠানে দুই শিল্পীর মাঝের ফাঁকটুকু সে ভরিয়ে রাখতে চায় স্বরোচিত কবিতায়। তথ্য যাচাই না করেই নানা সাহিত্য গুজবকে সারাজীবন বয়ে চলে। পড়াশোনা নেই। সেই প্রয়োজনও নেই। শুধু সংস্কৃতির অবনতি দেখলে তাঁর মাথার পোকা নড়ে ওঠে। সেই সংস্কৃতি যার কোনো উত্তরণ নেই শুধু প্রাচীন এক পন্থায় প্রথাগত আত্মসমর্পণ ছাড়া।

কৈশোরে অভিভাবকের হাত ধরে সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক পুরস্কার জিতে নিয়েছে। আবৃত্তি,ক্যুইজ, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। পড়া নয় বলার কৌশলে সে হয়েছে সংস্কৃতিমনস্ক। তারপর একদিন নিজেকে করে তুলেছে উদ্যোক্তা। এদেরই গোপন দালালিতে সেজে উঠেছে মফস্বলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একদিন এরাই আদায় করে নিয়েছেন অভিভাবকের সমীহ, নানা কালচারাল কমিটির সম্মান। পড়াশোনা চেনা ছকে বাঁধা। নতুন যা কিছু সবই চলার পথে কোনো না কোনো ব্যক্তির সভাসমিতির কথা সূত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ বা ‘প্রশ্ন'(ভগবান তুমি যুগে যুগে…) নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ বা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ এইরকম দু- একটি কবিতা গলা কাঁপিয়ে নাটকীয়ভাবে পরিবেশন করতে করতে তাঁর দিন ফুরোয়। কিছুটা এগিয়ে আছেন যিনি তাঁর অস্ত্র নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (উলঙ্গরাজা), শঙ্খ ঘোষ (যমুনাবতী), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( রাজা আসে রাজা যায়), পূর্ণেন্দু পত্রীর (কথোপকথন) কিছু জনপ্রিয় কবিতা। এইটুকু সম্পদ আর কণ্ঠের নানা মুদ্রাদোষ নিয়ে সে হয়ে ওঠে মফস্বলের অনিবার্য সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। এদেরই ঘোষণায় মফস্বলের রবীন্দ্র -নজরুল সন্ধ্যা,বিচিত্রানুষ্ঠান, রক্তদান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদেরই কণ্ঠ আমাদের ছোটবেলার ঘুমজাগানিয়া স্বপ্ন, হয়তো বা সংস্কৃতির প্রথম প্রেরণা। আজ নব্বইয়ের সেই দিন গিয়াছে। চাকরির স্বপ্ন ছেড়ে শুধু এক সাংস্কৃতিক যাযাবর জীবন নিয়ে আজ আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ কেউ তাড়ায় না। সাংস্কৃতিক দাদার পদটি মফস্বলে বহুদিন ফাঁকা পড়ে আছে।

আজ কোথায় কীভাবে আছেন তাঁরা? সম্প্রতি তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন আর রবীন্দ্র -নজরুল সন্ধ্যা পাড়ায় পাড়ায় হয় না। এখন মফস্বলের অলিতে গলিতে শোনা যায় না কিশোরী কণ্ঠের ‘ বসন্তে ফুল গাঁথল’ বা’ ম্লান আলোকে ফুটলি কেন ‘ এইসব গান। আমরা পাড়া বেপাড়া ঘুরে সংগ্রহ করতাম শিল্পীদের নাম। অনুষ্ঠান সাজানো হত গান, আবৃত্তি,নৃত্যের এমন এক সমন্বয়ে যাতে দর্শকাসন খালি হয়ে না যায়। সভাপতির দীর্ঘ বক্তৃতার মাঝে চিরকূট পাঠাতে হত থামার জন্য। আর প্রতিমুহূর্তে তাকাতে হত আকাশের দিকে কারণ কোনো এক অবশ্যম্ভাবী কারণে সেইদিন বৃষ্টি হত। আমাদের ঘোষক বা সভাপতির তেমন পড়াশোনা নেই সেসব যখন বুঝলাম তখন বড়ো হয়ে গেছি। তবুও এসব নিয়েই দিব্যি চলছিল দিন।

আজ সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দখল করে নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল। এমনকী ধর্মীয় অনুষ্ঠানও স্থানীয় বিধায়কের উপস্থিতি ছাড়া অসম্ভব। রক্তদানের অরাজনৈতিক উদ্দেশ্যর ভিতরে বসে আছেন লোকাল কমিটির সদস্য, কাউন্সিলর,বিধায়ক এবং উঠতি মস্তান ঘোষক যাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘বিশিষ্ট সমাজসেবী’ বলে। এখন শিল্পী খোঁজার অবসর বা পরিশ্রম করার লোক নেই। তার বদলে একটি নাচের স্কুলকে দায়িত্ব দিলে তিন ঘন্টার ধামাকা মজুত। দর্শক খুশি। দল খুশি। ক্যাডার খুশি। পারিশ্রমিক পেয়ে নাচের দলও খুশি। এভাবেই চলবে রক্তদান, স্বাধীনতা দিবস সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। আর নাচের দলও সাপ্লাই দেবে উদ্দেশ্য বুঝে। লতা মঙ্গেশকরের চটজলদি দেশাত্মবোধক গানের নিচে ঢাকা পড়ে যাবে সবিতাব্রত দত্তর গান। ফলত আজ আর ঘোষকের অবশ্যম্ভাবী চাকরি নেই।

এমনই এক সাংস্কৃতিক দাদার সঙ্গে দেখা হল চায়ের দোকানে। তিনি একাধারে ঘোষক-কবি-বাচিকশিল্পী। তাঁর দাপট দেখেছি একদিন। আজ আবৃত্তি ক্লাসের হাঁটুর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা এগোয় সাংস্কৃতিক দুঃসময় নিয়ে। উঠে আসে শিক্ষা ও রাজনৈতিক নানা প্রসঙ্গ। চা সিগারেট খেতে খেতে আজও দেখছি তিনি অপ্রয়োজনে কবিতা গুঁজে দিচ্ছেন স্বকণ্ঠে। অভ্যাসের অভাবে ভুলে যাচ্ছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। তাঁর গলায় আক্ষেপ। অথচ এখনও তিনি স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় একজন বড়ো সাহিত্যিকের জন্মভিটে সংস্কারের। প্রয়োজনে স্মৃতিরক্ষা কমিটি তৈরির। এখন তার দিন যায় বিধায়ক আর রাজনৈতিক দালালদের পিছনে পিছনে। একদিন অনেক রাতে মঞ্চ থেকে নামলে জুটত মিষ্টির প্যাকেট, বড়জোর রিক্সাভাড়া। আর আজ পাওয়া যায় বিরিয়ানির প্যাকেট এবং কিছুটাকা। অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় কোনো নেতা বাইকে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। প্রায় প্রতিদিনই চার পাঁচটা অনুষ্ঠান। সংস্কৃতির ছলে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে রোজগার মন্দ হয় না। তাই ছদ্মবেশী শোকের ভিতরে দেখছি তার চোখ ম্রিয়মান লোভে চকচক করছে। এই তো সেদিনও তাঁকে দেখলাম চায়ের দোকানে বসে শঙ্খ ঘোষের কবিতার উচ্চারণরীতি শেখাচ্ছেন অকারণে। আবার সন্ধ্যায় লোকাল কেবল চ্যানেলে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রার সরাসরি সম্প্রচারে ব্যস্ত।কণ্ঠে কখনও ঝড় কখনও বিষাদ। অনেক রাতে আজ লম্বা একটা সিগারেট ধরিয়ে বাড়ি ফিরবেন তিনি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার চেয়েও লম্বা।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...