Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক পর্ব ১৩

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

উদাসীন তাঁতঘর

pankaj

পাঠকের মতামত অথবা ব্যাজস্তুতি অলংকার

ধরা যাক আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি একটি কিংবদন্তি এবং অনেকের মতে একটি মাইলস্টোন। কী হতে পারে আপনার? আসতে পারে জনপ্রিয়তা ও সহজ খ্যাতি। পাঠকের বিস্তার দেখে আপনার মনে হতেই পারে এরপর আপনি আজীবন উল্লেখযোগ্য। যদি উদাসীন পাশ কাটিয়ে যাবেন ভেবেছেন জানবেন নিস্কৃতি নেই। যদি ভাবেন উপেক্ষা করবেন সন্দেহ আরও গভীর হবে। যদি উপভোগ করেন তাহলে আপনি নিশ্চিত কবির ছদ্মবেশে নিছক সরবরাহকারী।  একজন পুতুল প্রস্তুতকারকের মতো কারণে অকারণে কেবলমাত্র উৎপাদনশীল। প্রথম কবিতার বইয়ের নিজস্বতা বিপজ্জনক। প্রথম কাব্যগ্রন্থের উপর যেকোনো উন্মাদনা এবং কিংবদন্তির ছায়া একজন কবিকে সারাজীবন তাড়া করে। এক হিসেবে তাঁর জীবন অভিশপ্ত। কেননা আজীবন তাঁকে নিজের অতিকায় ছায়ার বিরুদ্ধে লড়তে হয়। যা পাঠক নির্মিত। পুরস্কার নির্মিত। মিডিয়া নির্মিত। চেনা জলে স্নান না করলে পাঠক দুঃখ পান। ভাবেন কোথায় সেই পূর্বপরিচিত অসামান্য আলো? কোথায় সেই মধ্যরাত্রির মুগ্ধ মুহূর্ত, যখন একটা গোটা পাঠকজীবন বদলে যায়? অন্যায় নেই এই আচরণে। একটি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ লিখে ফুরিয়ে যান এমন কবির সংখ্যা কম নয় । একটি কাব্যগ্রন্থের অজস্র অনুকরণে অজস্র কাব্যগ্রন্থ লিখে অহেতুক টিকে থাকতে চান এমন কবির অভাব নেই। কিন্তু যিনি প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন পথে চলেছেন পাঠকের মতামত কতখানি সাহচর্য দেয় তাঁকে? নাকি তার নিয়তি পাঠকহীনতায়? নাকি শুধু কয়েক দশক পেরিয়ে নতুন পাঠকের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো সদুত্তর নেই তাঁর হাতে। এ কী গো বিস্ময়।

আপাতত কবিতার পাঠকের কথাই বলতে চাইছি। বাকি পাঠকদের কথা এখানে বিচার্য নয়। কবিতার পাঠকেরা কখনও কখনও অনেক বেশি সংক্রামক। স্বধর্মে অবিচল থেকেও নতুন স্বরের প্রত্যাশা করেন। কিন্তু যেকোনো উন্মাদনার দূরের অতিথি তাঁরা ছিলেন একদিন। অথচ পঞ্চাশের দশক থেকে পাঠকের চরিত্র বদলে গেছে অনেকখানি। অনিবার্য কবিসম্মেলনের হাত ধরে একদিন তাঁরা কবির কাছাকাছি এলেন। প্রত্যক্ষ সাহচর্যে আগ্রহ তৈরি হল কবির বেপরোয়া জীবনের প্রতি। কবিতার বদলে তাঁদের মনোযোগ দেখা গেল কবিকে নিয়ে গড়া নানা মিথের দিকে। সম্মেলনমনস্ক এইসব পাঠক নিজের পাঠকসত্তা নিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার কোনো সুযোগ পেলেন না। বরং জনপ্রিয়তা এবং পুরস্কারের নানা লক্ষণ মিলিয়ে খুঁজে নিলেন আরাধ্য কবিকে। আর তাই মিডিয়ার শান্ত অপেক্ষা একদিন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়। মনীন্দ্র গুপ্ত এঁদের চিহ্নিত করেছেন কীভাবে দেখুন:

 “এক সময় শিক্ষিত এবং দীক্ষিত পাঠকদের জন্য কবিদের আকাঙ্ক্ষা ছিল। আজকাল কেউ আর অপেক্ষায় বিশ্বাসী নন, মুরুব্বীরা দ্রুত বলে দেন,অমূক অমূক ভালো লিখছে।পাঠকেরা সেই অন্যের পছন্দ শিরোধার্য করে কবিতা পড়েন,প্রকাশকেরা সেই পছন্দ অনুসারেই বই বার করেন, পুরস্কারকর্তারা সেই পছন্দ অনুযায়ীই পুরস্কার দেন। চাকা ঘুরতে ঘুরতে মোমেনটাম সংগ্রহ করে – কবিকে ঘিরে একটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে।

এই যদি অবস্থা তাহলে পাঠক বাড়লেই বা কি,কমলেই বা কি! অলস পাঠক, নির্বিবাদী পাঠক, লেখকের কৃপাধন্য হতে চাওয়া পাঠক, কোনো অন্য মতলব নিয়ে চলা পাঠক তো সবসময় মিথ্যে কথা বলবেন। এঁদের কথায় নির্ভর করলে সাধারণ পাঠককে ঠকতে হবে।”

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

এইমুহুর্তে কবিতার পাঠক অনেক দূরদর্শী। সে অনেকদূর দেখতে পায়। আসলে কবি ও প্রকাশকের মাঝখানে আজকের পাঠক মধ্যবর্তী এক সুবিধাভোগী। পাঠকের ছদ্মবেশে কবিতার অধিকাংশ পাঠক মূলত কবি, সম্পাদক এবং নানা সম্মেলনের প্রচ্ছন্ন হোতা। তাঁর প্রয়োজন নানা কুহক, সংকেত। যা স্পষ্ট নয় এবং দুদিক খোলা একাধিক অর্থে প্রয়োজনীয় সুবিধাটুকু আদায় করে নেয়। এছাড়াও আছেন পাঠকের ছদ্মবেশে নবীন কবি যশোপ্রার্থী। এইসব পাঠক ক্ষমতার অভিপ্রায় বুঝে মতামত তৈরি করে। সম্মেলনের সুযোগ বুঝে কোন কোন কবির প্রশংসা করতে হবে তার গোপন তালিকা তৈরি করে রাখে। যেহেতু সে নিজেও কবি তাই মনোগত ঈর্ষা ছলনার ছায়া পড়ে তাঁর পাঠক সত্তায়। নিজের বলয়ের বাইরের কবিতার পাঠককে রুচিহীন ভাবতে তাঁর দ্বিধা নেই। এঁদের মাথায় সবসময় ঘুরছে শ্রেষ্ঠ কবির একটি ছোটো তালিকা। উন্নাসিক এক আচ্ছন্ন এবং সংক্রামক তালিকা। গ্রহণের আগে বর্জনেই সে বুঝে ফেলে পথ কতদূর। অতিবিপ্লবীর এই তালিকা তারপর একদিন সুযোগ সুবিধা বুঝে বদলে যায় সম্পাদকের চাপে, সম্মেলনের প্রয়োজনে আর পুরস্কারদাতার গোপন শিকারে। ‘ কিছুই তো হল না’ এই গান গাইবেন এমন বোকা পাঠক কলকাতার আকাশে কাক- শকুনের আগেই বিলীয়মান।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (যৌবনবাউল), ভাস্কর চক্রবর্তী( শীতকাল কবে আসবে সূপর্ণা), শামসের আনোয়ারের ( মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) ক্ষেত্রে এই সমস্যা দীর্ঘদিন ছিল। মৃদুল দাশগুপ্তর (জলপাই কাঠের এসরাজ) ক্ষেত্রে হয়তো আজও আছে। তাঁরা শুধু অলোকরঞ্জনকে যৌবনবাউলের কবি ভাবলেন ‘ জবাবদিহির টিলা’য় উঠলেন না। দেখলেন না বিপন্ন বিশ্বের প্রতিটি অমানবিক চিহ্নের প্রতি অলোকরঞ্জনের ধিক্কার এবং প্রতিবাদ। ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘ কীরকম আছো মানুষেরা’ পড়ে দেখবার প্রয়োজন হল না তাঁর। ‘জলপাই কাঠের এসরাজে’র সাধারণ পাঠক আজ ‘ আগুনের অবাক ফোয়ারা ‘ পর্যন্ত পৌঁছেছেন কিনা আমরা জানি না। সাম্প্রতিক সময়ে শ্যামসুন্দর মুখোপাধ্যায়কেও শুনতে হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ হলুদ দাগের বাইরে পথচারীর’মেধা তিনি এখনও পেরোতে পারেননি। অথচ পরবর্তী অসামান্য তিনটি কাব্যগ্রন্থ ( রঞ্জন রশ্মির ক্লিনিক, সার্কাসের আলো, বকুলমন্দ্রিত) পড়লে পাঠক বুঝতেন এই নবীন কবির জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করা যায়। এসবই উদাহরণমাত্র। আরও অনেক নাম জড়ো করে তালিকা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

প্রথম কাব্যগ্রন্থের কিংবদন্তি পেরিয়ে কবি হয়তো আরও নতুন এবং গভীর পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে অপ্রত্যাশিত বাঁক আর ভাষাবদলের মুখে দাঁড়িয়েছেন। সেই পথ চর্বিতচর্বন নয়,  হয়তো আরও তীব্র এবং সুদূরপ্রসারী। কিন্তু প্রথম কাব্যগ্রন্থের পরিচিত ঢেঁকুর তুলে আজও পাঠক তাঁকে বলছেন, ‘যাই বলো লিখেছিলে বটে একটা মাস্টারপিস, তুলনা নেই, এখনও বিস্ময় ফুরোয়নি!’ কবি অপ্রস্তুত। এই মতামত আসলে নিন্দা না প্রশংসা তা বুঝে ওঠার আগেই পাঠক অন্য পালে হাওয়া দিচ্ছেন। আর কবি ভাবছেন শূন্য এখন ফুলের বাগান। পাঠকের তার সামগ্রিক লেখার প্রতি আগ্রহ নেই।

ভয়? খুব ভয়? না ভয়ের কিছু নেই। আপনি হয়তো জানেন না আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাঠক আপনার আর কোনো বই পড়েননি। শুধু বিজ্ঞাপন দেখে খোঁজ রেখেছেন আপনার কি কি বই প্রকাশিত হয়েছে। আর স্থানে অস্থানে নিজেকে আপনার একান্ত পাঠক প্রমান করতে ওই কথাগুলি বলে চলেছেন। সুতরাং এখন আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রশংসার ছলে যে নিন্দা আপনাকে তাড়া করে তা পাঠকের মতামত না একজন দর্শকের মতামত। আপনিই শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিন। পথভ্রষ্ট হবেন না। কয়েকজন তরুণ কবি আজ প্রথম বইয়ের অপ্রত্যাশিত সাফল্যের চাপে দ্বিতীয় বইয়ের কথা ভাবতে ভয় পাচ্ছেন । কেউ কেউ অহেতুক থমকে আছেন। অনেকের উন্নাসিক পাঠ নিজের ঘরেই সিঁদ কেটেছে। কোথায় এর শেষ আমরা জানি না। তবুও বলব এবার বোধহয় বলার সময় এসেছে মনের অহেতুক আনন্দ বা বিস্ময়টুকু যত ছোটোই হোক তাতেই আমাদের চলবে। বাংলা কবিতা থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পাঠকের কুয়াশাচ্ছন্ন মতামত বিদায় নিক।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...