ধা রা বা হি ক | পর্ব ১৪
এই তো কিছুদিন আগে,করোনা- পূর্ববর্তী সময়ে ভাবছিলাম ছোটো প্রকাশনীর ঐশ্বর্য আর সুদিনের কথা। খুশি হয়েছিলাম এই দেখে বাংলা প্রকাশনার মনোপলি ভাঙছে। প্রযুক্তি এসে বদলে দিচ্ছে পুঁজির অলৌকিক সম্ভাবনা। ছোটো পত্রিকা আর প্রকাশনী হয়ে উঠছে আরও প্রতিস্পর্ধী। ছোটো পত্রিকার সুদিন এসেছে অন্তত পনের বছর আগে। কিন্তু ছোটো প্রকাশনীর বানিজ্যসাফল্য তেমন ছিল না। কিন্তু অবস্থা বদলালো। ছোটো পত্রিকা আর ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ সংখ্যা করতে রাজি নয়। অনেকেই বুঝলেন নামমাত্র একটি পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশনী খুললে নিরাপত্তা আরও বেশি। নব্বইয়ে জয় গোস্বামীর মতো কবি এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার অলীক স্বপ্নের পর এখন বাংলার নাবালক তরুণেরা প্রকাশক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আপত্তি কিছু নেই। পাঠকের ছদ্মবেশে অনেক ক্রেতার নীরব অনুমোদন তো আছেই! আর লেখকের তেমন অভাব কোনোদিনই ছিল না। আর তাই কলেজস্ট্রিটের আশেপাশে গজিয়ে উঠল প্রকাশনা দপ্তর কাম হরেক বইবিক্রির আউটলেট। কয়েকটি আউটলেট জনপ্রিয় হল। তারা ছোটো প্রকাশনীর বইকে গুরুত্ব দিয়ে প্রমোট করছেন দেখে আনন্দের সীমা নেই। অনেকেই হয়ে উঠলেন আমাদের সত্যিকারের আশ্রয়। মুহুর্তে ভেবে নেওয়া গেল দূর্দিন আর নেই। সোনার ডিম নিছক অপেক্ষামাত্র। করোনা আর আমফান আমাদের কাবু করতে পারেনি। শুধু দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দিলাম প্রযুক্তির ঘাড়ে। কত সহজেই ছোটো প্রকাশনীর প্রকাশক কাম একদা প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবি বা লেখক বুঝে গেলেন’ কঠোর বিকল্পের কোনো পরিশ্রম নেই।’
প্রথম এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল বিস্মৃত লেখকের লেখা এবং আত্মীয়স্বজনেরের খোঁজ। ঝোপ বুঝে কোপ মারার নৈতিক দায়বদ্ধতা। প্রয়োজনে একের কাজ ভাঙিয়ে নিজের দিকে টেনে আনা। আজ বিস্মৃত কবির চারপাশে শকুনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছেন ছোটো প্রকাশনীর সব কর্ণধার। মানবিক দায়বদ্ধতার ছলনায় কার আগে প্রাণ কে করিবে দান তাই নিয়ে গোপন ছুরি প্রস্তুত। এদিকে বিস্মৃত কবির অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ভেবে বসে আছে বাবা বুঝি সোনার খনি রেখে গেছে। তাই সর্বস্ব সমর্পণের আগে সে ও লাভ ক্ষতির হিসেব বুঝে নিতে চায়। কথার খেলাপ করে। আরও সুবিধাজনক সম্ভাবনাগুলি গোপনে খতিয়ে দেখতে চায়। প্রোমোটার আর দালালের আঁতাত পেরোতে পেরোতে দিন যায়, কেবলই চলে যায় অহেতুক বইমেলার দিকে। ‘কেউ কথা রাখেনি’ হয়ে ওঠে তার স্বধর্ম।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে বেশিরভাগ ছোটো প্রকাশনীর সাফল্য আসলে এক প্রতারণার ইতিহাস। দায়বদ্ধতার সুযোগে আত্মপ্রতারণাও। তার যা কিছু বৈভব প্রেস মালিকের টাকা ফাঁকি দিয়ে। নৈতিক চরিত্র বদলের চেয়ে একের পর এক প্রেস বদলেই তার আগ্রহ বেশি। প্রচ্ছদশিল্পীর অর্থকে সে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। বরং সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার নামে বিনে পয়সার কাজে বন্ধুর পরিশ্রমকে বিনিয়োগ করে। লেখকের রয়্যালটি নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে সে রুচিহীনতা ভেবে এড়িয়ে যেতে চায়। অথচ বানিজ্যে তার ঘাটতি নেই। বিপণনে পিছিয়ে নেই। বিপজ্জনক ছাড় দিয়ে ভুল কাস্টমারকে বই বেচতে তার রুচিতে বাধে না। কিন্তু সুবিমল মিশ্রর মৃত্যু নিয়ে বইমেলার মাঠেই তার মায়াকান্না সগৌরবে বিরাজমান রাখতে এখনও তার বুক কাঁপে না। চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এমন নমুনা বিরল।
আজ ছোটো প্রকাশনীর সব প্রকাশকই জানেন বিস্মৃতির বানিজ্যমূল্য কিছু কম নয়। ‘নির্জন সাধক’ হাটে বেচার আরেকটি জনপ্রিয় পদ্ধতিমাত্র। বাকি রইলেন কয়েকজন কাব্যপ্রিয় সরকারি আমলা। তাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকাতি করে সে আর্থিক ভরাডুবি থেকে বাঁচতে চায়। টাকা, বিজ্ঞাপন ,অনুষ্ঠানের খরচ, সভার দায়ভার পেরিয়ে সরকারি আমলা তারপরও খোয়াব দেখেন আর গোপনে পরিচিত মানুষদের ঠিকানায় নতুন নতুন বই পাঠান সামান্য পাঠপ্রতিক্রিয়ার আশায়।বস্তুতপক্ষে ছোটো প্রকাশনীর বেশিরভাগ বই আসলে এক অলীক নিরুদ্দেশ যাত্রা। ঠাঁই নেই ঠাঁই নাই বলেও আত্মমুগ্ধ কবিকে রোধ করবে এমন মনোরোগের চিকিৎসা আজও সুলভ নয় বাংলা বাজারে।
ছোটো প্রকাশনীর সব চেয়ে বড় অপরাধ সে প্রফেশনাল নয়। উদ্যোগের চেয়ে উদাসীনতাকে সে আজও মহৎ স্বভাব মনে করে। আর তাই পাঠক প্রতারণা দিকে দিকে। পিওডিকে সে আর্থিক সুবিধা মনে করলে অসুবিধা ছিল না কিন্তু তাকে সে ব্যবহার করে নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চায়। প্রুফ রিডারের দায়বদ্ধতা এড়াতে চায়। লেখকের চোখে কত সংখ্যক বই মুদ্রিত এই তথ্য লুকোতে চায়। তাঁর সমস্ত ‘ প্রথম মুদ্রণ নিঃশেষিত ‘ আসলে পিওডির খেলা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দায়িত্ববোধের অভাব। সত্তরের একজন কবির ‘ সাক্ষাৎকার সংগ্রহ ‘ অনুষ্ঠানে প্রকাশের জন্য কয়েক কপি আনা হয়। কিছুদিন পর একই বই টীকাভাষ্যসমেত বাজারে আসে। পঞ্চাশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবির মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটি সুসম্পাদিত গ্রন্থ বেশ কিছু কপি বিক্রি হয়ে গেলে দ্বিতীয় মুদ্রণে একটি নতুন লেখাসমেত হাজির হয়। দুটি ক্ষেত্রেই প্রথম দিকের ক্রেতা যে প্রতারিত হলেন এই দুর্ভাবনা প্রকাশক মাথায় রাখেন নি। (কেউ কেউ অবশ্য ‘ বিফলে মূল্য ফেরত’ আশ্বাস দিয়েছেন)। তৃতীয় উদাহরণটি আরও বড় প্রতারণার দৃষ্টান্ত। কিছুদিন আগে একটি একটি ছোটো প্রকাশনী মনীন্দ্র গুপ্তর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন লেখকের টুকরো টুকরো গদ্য বইয়ের একটি সিরিজ করেন। প্রথম সিরিজে পাঁচটি বই ছিল। কিছুদিন পরে তাঁরা এই সিরিজে আরেকটি ছোটো বই যুক্ত করেন। যেহেতু সিরিজের পূর্ববর্তী বইগুলি আছে তাই নতুন একটি বই কিনতে গেলে প্রকাশনার তরফে জানানো হয় পুরো সিরিজ( অর্থাৎ ৬টি বই) আবার নিতে হবে। পৃথকভাবে বইটি পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পরবর্তীতে আবার একটা বই যুক্ত হলে পুনশ্চ প্রতারণা। এভাবেই চলছে। এভাবেই চলবে। ছোটো প্রকাশনীর মহান দুঃখটিকে প্রসারিত করে নিতে পারলেই আর কোনো ভাবনা নেই।
এটাই ছোটো প্রকাশনীর একমাত্র চরিত্র তেমন কিন্তু নয়। বরং ছোটো প্রকাশনা স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকখানি, এই সাফল্য আমাদেরও গর্বিত করে। অকারণ পুলকে আঁখি জলে ভাসে। নিজের জীবন দিয়ে ছোটো প্রকাশনী তার গুরুত্ব এবং সম্ভাবনার অনেকগুলি দিগন্ত খুলে দিয়েছে। আটের দশকের একজন অকালপ্রয়াত কবির সামান্য চটি বইটিকে আরও অনেক লেখা দিয়ে বিস্তৃত করতে একজন প্রকাশক প্রায় কুড়ি বছর তিল তিল শ্রমে তাকে সংগ্রহযোগ্য করে তুলেছেন। সস্তায় বাজার ধরতে নেমে পড়েননি। ষাটের একজন উল্লেখযোগ্য কবিকে নিয়ে একটি সংখ্যার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছেন একজন সম্পাদক। নির্বিচার সংকলনের অকালপ্রসবের পথে হাঁটেনি। একটি জীবনীমূলক উপন্যাসের জন্য একজন প্রকাশক অর্থ ব্যয় করে একজন সম্পাদক নিযুক্ত করেছেন। সমস্ত তথ্য লেখকের সঙ্গে পরামর্শ করে যাচাই করে নিয়ে তারপর প্রেসে পাঠিয়েছেন। নির্বিচার থ্রিলার ছাপার যুগে এই উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তগুলি ছোটো প্রকাশনীর ভেবে গর্ব হয় বৈকি! এই দায়িত্বগুলি ভুলে শুধুমাত্র মুনাফার জন্য যারা প্রকাশক সেজে বসে আছেন তাঁদের নিয়ে ভাবনা হয়। ভাবনা কিন্তু দুর্ভাবনা নয়। তাঁর কারণ সাহিত্য,অভিনয়, শিল্প, রাজনীতি সর্বত্রই ফড়ে ও দালাল আছে। তাঁরা দুদিন বই হাসবেন না। কিন্তু তাঁদের বিক্রির বাড়বাড়ন্ত দেখে একজন সৎ প্রকাশক যখন কেবলই হতাশ হন, নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস হারান তখন ভয় হয়। নিছক তাসের ঘর গড়তে আমরা কি এতটা পথ হাঁটলাম?
তাই আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া। মনে করিয়ে দেওয়া প্রকৃত সত্যটি – ‘কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।’ মনে করিয়ে দেওয়া, প্রযুক্তির দক্ষতা আছে কিন্তু প্রতিভা নেই। এই কথাটি সৃজিত মুখোপাধ্যায় না বুঝলেও আপনার অন্তত বোঝা উচিত। আপনার কাজের গভীরতা যদি গুগলকে নিরর্থক এবং অপ্রয়োজনীয় না করে দেয় তাহলে জমি বাড়ির দালালি আপনার আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বেশি উপযুক্ত একথা সহজে বুঝে নিলে মঙ্গল। প্রকাশনায় আসার আগে,সম্পাদনায় আসার আগে, এমনকি লিখতে আসার আগে কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পার্থক্য সেটুকু অন্তত বুঝে নিন। তারপর না হয় পথে নামুন। সুপবন বহিতেছে – সেই সুযোগে ঝাঁপ দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। তারপরও যদি এটাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র পথ তাহলে কলেজস্ট্রিটে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বইয়ের আউটলেট আবার সায়া ব্লাউজের দোকান হয়ে উঠতে বেশিদিন নেবে না।
* ক্রমশ