ধা রা বা হি ক | পর্ব ১৫
নব্বইয়ের দশকের মফস্বলের একজন যুবকের কথা মনে পড়ে। রুচির তোয়াক্কা না করেই একই সিনেমা হলে সে দেখেছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘তাহাদের কথা’ এবং অঞ্জন চৌধুরী ঘরানার ছবি ‘মেজবউ’। সেদিন বন্ধুদের কাছে তার জাত গেলেও মনে মনে সে সুখী ছিল। কেননা তার মনে হয়েছিল বাংলা সিনেমায় লগ্নীকৃত অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দায় তার আছে। ব্যক্তিগত সামান্য আয়োজন তবুও সে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি সেদিন। অথচ ভালো ছবি সম্পর্কে তার ধারণা বা পড়াশোনার অভাব ছিল না। কিন্তু উন্নাসিকতার চেয়ে অপেক্ষার মূল্য তার কাছে ছিল অনেক বেশি। তখন নব্বইয়ের সূচনা। কিছুদিন আগেই ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ শহর- মফস্বলের দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিল। তারপর চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়। ‘অমরসঙ্গী’ বা ‘গুরুদক্ষিণা’র মতো ছবির ভরসায় সামান্য সজীবতা এসেছিল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। গৌতম ঘোষ ( পদ্মানদীর মাঝি), অপর্ণা সেন ( যুগান্ত), বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ( চরাচর) একটি দুটি ছবি করে দূরত্ববাচক ভূমিকা নিয়েছেন। মফস্বলের দুএকটি সিনে ক্লাবে বিদেশি ছবি দেখানো হয় বটে কিন্তু সেই ছবির দর্শক বা সদস্য হাতে গোনা। এবং বাংলা ছবি নিয়ে তাঁদের ভরসা বা ভাবনা নেই। এই আবহেই এসে পড়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘ উনিশে এপ্রিল ‘ । সাধারণ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শক হলে গিয়ে ছবি দেখবার আগ্রহ বোধ করেন আবার। রুচির সঙ্গে আপোষ করতে হয় না। অপরদিকে প্রভাত রায়, বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের একটি দুটি ছবি প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছে গুণমান বজায় রেখেই। তবুও থমকে আছে চারপাশ। নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়ে লড়ছেন অঞ্জন চৌধুরী,বাবলু সমাদ্দার,হরনাথ চক্রবর্তী, অনুপ সেনগুপ্ত এবং এক ও একমাত্র স্বপন সাহা প্রমুখ। শিক্ষিত দর্শক সেই ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। মূলত গ্রাম এবং মফস্বলে তার প্রধান বানিজ্য। বাংলা ছবি আরও বেশি আঞ্চলিক এবং অসহায়। দৈনিক কাগজে বিপুল হিন্দি ছবির বিজ্ঞাপনের পাশে তার অসহায় উপস্থিতি কোনোরকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। দর্শকদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন। ক্রুদ্ধ স্বরে কোনো কোনো পরিচালক বলছেন গ্রামের অশিক্ষিত দর্শকের জন্য আমি সিনেমা বানাই না। অশিক্ষিত শব্দটির ভুল প্রয়োগ নিয়ে সেদিন খুব বেশি কথা ওঠেনি ।
শুধু নব্বইয়ের দশকেই স্বপন সাহা ছবি বানাচ্ছেন পঁয়ত্রিশটি। বছরে গড়ে পাঁচটি। পাশাপাশি রয়েছেন আরও কয়েকজন পরিচালক, তাঁরা একাধিক ছবি তৈরি করে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির হাল ফেরানোর চেষ্টা করছেন। এই পর্বে তরুণ মজুমদার থমকে আছেন। ‘আপন আমার আপন’,’ পথ ও প্রাসাদ’ বা ‘সজনী গো সজনী’ উল্লেখযোগ্য নয়। তুলনায় প্রভাত রায়ের ‘লাঠি’, ‘শ্বেত পাথরের থালা’, ‘সেদিন চৈত্রমাস’ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং চিরাচরিত সাধারণ দর্শকদের মন জয় করছে। এই পর্বে তাপস পাল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং রঞ্জিত মল্লিক একাই হিট ছবি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনজন নায়ক ( চিরঞ্জিত- অভিষেক-তাপস) দিয়ে ছবি হিট করানোর অসহায় চেষ্টা চলছে। হয়তো খরচ কমাতেই নায়িকার মা নেই এবং নায়কের বাবা নেই। অথবা উল্টোটা। অবস্থা এমন ভিলেনের মারুতি ভ্যান এবং সাঙ্গোপাঙ্গ পর্যন্ত কমন হয়ে গেছেন। চিত্রনাট্যের যুক্তি খোঁজা অর্থহীন। এমনকি অভিনয়ের মাত্রা মেলোড্রামার দিগন্তে পাড়ি জমিয়েছে। ‘বাবা কেন চাকর’, ‘কমলার বনবাস’,’সখি তুমি কার’ এইসব ছবির নাম শুনে কোনো কোনো দর্শক ভাবছেন এখনকার সিনেমা আসলে যাত্রাপালা। কিছুদিন পর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রত্যাখান করবেন ‘ সাথী’ ছবির কাজ। তাঁর মনে হল নতুন কোনো অভিনেতা এই ছবির পক্ষে মানানসই। এরপর জিৎ,দেবের হাতে উঠে আসছে দায়িত্বভার। উত্তরসূরী নির্বাচন করে প্রসেনজিৎ অনিবার্য হয়ে রইলেন ভিন্ন ধারার ছবিতে এবং প্রাসঙ্গিক। বাংলা ছবির চিরাচরিত প্রেক্ষাপট বদলে গেল। বিদেশের লোকেশন ,উন্নত ক্যামেরা সর্বভারতীয় বানিজ্যিক ছবির আবেদন ফিরে এল বাংলা সিনেমায়। এখন আর বাজেটের দৈন্য নেই। দক্ষিণী ছবির রিমেক এবং তার পাশাপাশি পার্শ্ব চরিত্রের অভিনব গুরুত্ব নিয়ে সে কিছুদিন পথ এবং পন্থায় দ্বিধাগ্রস্ত। এই ছবির দর্শকের সঙ্গে সেদিনের দর্শকের যোজন যোজন দূরত্ব। সব একধাঁচ,সব এক রং তবু কী নিদারুণ দৈন্য! বিনিয়োগে এবং বিনোদনে কর্পোরেট চাহিদাই শেষ কথা। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে ইদানীং হয়তো বাংলা সিনেমা দর্শকের চেয়ে কর্পোরেট এবং মিডিয়ার আনুকূল্য প্রার্থনা করছে বেশি। তাঁর অন্ধ আকুলতা লগ্নীকৃত অর্থের উৎস নিয়ে বিচলিত নয়। তাই চতুর্দিকে আগাছার মতো প্রযোজকের বিনিয়োগকে সে সুদিন ভেবে নিশ্চিন্ত হতে চায়।
নব্বইয়ের বাংলা সিনেমায় ঋতুপর্ণ ঘোষের আবির্ভাব একটি ঘটনামাত্র নয়। বরং তার ঐতিহাসিক এবং সামাজিক তাৎপর্য আছে। ‘উনিশে এপ্রিল’ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শককে আবার হলমুখী করল। স্বপন সাহার ছবি দেখতে রুচিবোধের সমস্যা ছিল তাঁর। এই ছবি একইসঙ্গে বিনোদন এবং মার্জিত রুচির মেলবন্ধন। অনেকদিন দর্শক যেন এমন একটি ছবির অপেক্ষায় ছিলেন। চিত্রনাট্যের বাঁধন এবং ছবি নির্মাণের অনেকখানি পরিচ্ছন্ন ও মৌলিক বোধ দেখে দর্শক মনে করলেন এই পরিচালকের উপর ভরসা করা যায়। নব্বই দশকে ঋতুপর্ণর তেমন তাড়া ছিল না। ‘দহন’,’বাড়িওয়ালি’ এবং ‘অসুখ’ করেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর পরবর্তী ছবি ‘উৎসব’ একটি চ্যানেলের জন্মদিনে সম্প্রচারিত হল। আর দূরদর্শন নয়। বরং অনেক কেবল চ্যানেল আর প্রতিদিন হরেকরকম ছবির হাতছানি হয়ে উঠল দর্শকের ভবিষ্যৎ। হিন্দি কিংবা বাংলা ছবি প্রতিদিন এত বেশি সম্প্রচারিত হল যে সিনেমা যে হলে দেখতে হয় এই ভাবনা অবান্তর হয়ে গেল কিছুদিন। দর্শক ঘরের কোণে নিশ্চিন্ত হতে চাইলেন। এমনকি লোকাল কেবল চ্যানেল হল প্রিন্ট সাম্প্রতিক ছবির প্রচার শুরু করল গোপনে। সুখী গৃহকোণ গ্রামাফোনের বদলে স্মার্ট টিভি দখল করল। তখনও প্রযুক্তির হাত ধরে হরেকরকম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসেনি।
ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা সিনেমার প্রথম সেলিব্রিটি পরিচালক। এর আগে আমরা কিংবদন্তি বা প্রতিভাবান পরিচালক দেখেছি। এই প্রথম সেলিব্রিটি পরিচালকের দেখা পেলাম। এই পরিস্থিতি বাংলা চলচ্চিত্রের পক্ষে খুব সুখকর হয়নি। তাঁর পাশে দাঁড়াল জনপ্রিয় মিডিয়া। তাঁর দুর্বল ছবি ফাঁকা মাঠে জাতীয় পুরস্কার আনল ঘরে। দেশি বিদেশি নানা পুরস্কার, আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মুড়ি মুড়কির মতো কেবলই নির্বিচার স্বীকৃতি দিল তাঁকে। স্বঘোষিত এক অভিভাবকের সম্মান পেলেন তিনি। সাধারণ দর্শক বুঝতে পারছেন না তিনি কার প্রকৃত উত্তরসূরী? অজয় কর? সত্যজিৎ রায়? তরুণ মজুমদার? কার? নাকি তিনি নিজেই একটি পথভ্রষ্ট পথ! বিপুল উচ্ছ্বাসে বিচারের তেমন সুযোগ রইল না। শুধু অঞ্জন চৌধুরী বা স্বপন সাহাকে উপেক্ষার আগে আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা না করলে শিল্প শেষপর্যন্ত মুখথুবড়ে পড়ে।
তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠলেন একদল মধ্যমেধার অনুসরণকারী পরিচালক। তাঁদের হাতে প্রতিভার চেয়ে প্রযুক্তির কদর বেশি। এঁরাও তাঁরই মতো সেলিব্রিটি। কোনো বিষয়ে দুটি একটি বই পড়ে চিত্রনাট্যকে গবেষণা মনে করতে ওস্তাদ। ছবির আগে দৌড়োয় তাঁদের জীবন ও বিতর্ক। পঞ্চাশের দশকে কবিতার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল কবির রঙিন জীবন। এখানেও সিনেমা নয় মুখ্য হয়ে উঠল ব্যক্তিজীবন বা হাস্যকর এবং বিতর্কিত অগভীর গবেষণা। তবুও প্রশ্ন ওঠে না। নৈশভোজের অর্থই ঠিক করে দেয় রিভিউয়ের নামে জনস্বার্থে প্রচারিত অলৌকিক কয়েকটি সম্ভাবনা। আজ বাংলা ছবির বিপণন বদলেছে অনেকখানি। আজ প্রযোজক পরিচালক অভিনেতা অভিনেত্রীর তরফে প্রিমিয়ার নিয়ে যতখানি ভাবনা, ছবিটি সম্ভাবনা হিসেবে প্রিম্যাচিওর কিনা সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। এমনই এক পরিস্থিতিতে আওয়াজ উঠেছে ‘ বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান।’ হয় দাঁড়াবার জায়গা নেই অথবা প্রয়োজন নেই।
এইমুহূর্তে কী করছেন বাংলা সিনেমার সেইসব পরিচালকের দল? যাঁরা রুচির সঙ্গে সমঝোতা না করেই বানিজ্যসফল ছবি করে আমাদের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন একদিন । দক্ষিণী ছবির রিমেকের রুদ্ধ পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন আবার বাংলা ছবির দর্শকদের। সিনেমা হলে,হোক সে মাল্টিপ্লেক্স, তাঁরা আবার ভীড় জমাচ্ছেন। তবুও আজ তাঁদের অহেতুক আপোষ আর আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখে ভয় হয়। যে ভাবনা দিয়ে একটি দৃশ্য নির্মিত হয় সেই ভাবনাকে টেনেহিঁচড়ে একটা গোটা ছবি বানিয়ে ফেলছেন তাঁরা নির্দ্বিধায়। মাথায় যেকোনো ভাবনা এলেই তাকে চিত্রনাট্যে রূপ দিচ্ছেন। সর্বব্যাপী চিটফান্ডলালিত প্রযোজকের অভাব নেই। বহুপ্রসব হয়ে উঠেছে এখন তাঁর ধর্ম। প্রশ্ন করলেই শুনতে হয় আমাদেরও তো রোজগার করতে হবে, অন্তত আর্থিক নিরাপত্তাটুকু। যুক্তিহিসেবে অস্বীকারের উপায় নেই। শুধু বলা যায় রোজগারের জন্য অন্য কোনো পথ( চাকরি বা নিছক জমির দালালি) আরও নিরাপদ নয় কি? তাছাড়া রোজগারের জন্য আপোষ করব আবার শিল্পীর ( জাতীয় বা আন্তর্জাতিক) মর্যাদা চাইব একসাথে দুটি কিন্তু নাও মিলতে পারে! শিল্পীর অভিমান অতি বিষম বস্তু। এমনকি বেদনাও। তবুও আবেদন চলছে। নিবেদন চলছে। নিজের অতিকায় ছায়াটিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে লালন করেও চাহিদা ফুরোয় না। জীবনের সঙ্গে তাঁর প্রাত্যহিক যোগ শিথিল। তাঁকে কেউ বুঝিয়ে দেবার নেই একজন পরিচালককে সেলিব্রিটি হলে চলে না বরং সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পর্ক খুব কাছ থেকে না দেখলে সে পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। এদিকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত টাকার লেনদেনে ফুলেফেঁপে ওঠে নায়ক- নায়িকার মহিমা। প্রিমিয়ার, সাকসেস পার্টির তামাশায় কোটি কোটি টাকার ফানুশ ওড়ে। সেই আকাশে বাংলা সিনেমার জন্য সামান্য ভাবনার ছায়া পড়ে কি?আজ বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানো এক অর্থে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রযোজকের পাশে দাঁড়ানো। কয়েকজন সাংস্কৃতিক বেশ্যার জন্য অশ্রুসংবরণমাত্র। মিডিয়া – কর্পোরেটের গোপন আঁতাতের পাশে দাঁড়ানো। আজ দর্শক কিংবা সমালোচকের বলার অধিকার নেই আপনার ছবি কিস্যু হয়নি। বলা সাজে না আপনি এই চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেননি। শুধু গোলগাল রিভিউ। যাঁর পুঁজির জোর নেই তাঁর মুদ্রাদোষ নিয়ে আস্ফালন। নীরবতার রাজনীতি দিয়ে বাতিল করে দেওয়া স্বল্পপুজির সম্ভাবনাময় সিনেমাগুলিকে। আজ বাংলা সিনেমার পাশে অনেক রাজনৈতিক মাফিয়া, ছদ্মবেশী তোলাবাজ। তাই ‘ বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান ‘ কথাটি শেষপর্যন্ত জনান্তিকে ঝুলে থাকে। দর্শক না হলেও তাঁর দিব্যি চলে যায়। সব আয়োজন আজ প্রয়োজন বিমুখ। এখন নব্বইয়ের দশকের মফস্বলের সেই যুবকটি বেশ বুঝতে পারে বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য তার গোপন অনুরাগ আজ বৃথা এবং উচ্ছিষ্ট। বরং সিনেমা হলের দর্শক ছাড়াই আজ বাংলা সিনেমার দিব্যি চলে যায়। এখন তার কোন অসুখ সে চিনতে পারে না। আরোগ্যের প্রতিভা তার নেই। আজ চারপাশে শুধু রঙিণ মাল্টিপ্লেক্স। চারপাশে শুধু আলালের ঘরের দালাল।
* ক্রমশ