ধা রা বা হি ক | পর্ব ৯
চল্লিশের কবিদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন যে পাঠকরা তাঁরা মনে করতেন রাজনৈতিক প্রসঙ্গ কবিতার শত্রু এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায় অনেকসময় কবিতা শেষপর্যন্ত স্লোগান হয়ে ওঠে। এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল বুদ্ধদেব বসুর মতাদর্শ। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের কবিরা বিষয়টি লুফে নেন এবং জীবনের নানা উচ্ছৃঙ্খলা দিয়ে চল্লিশের কবিদের অবান্তর করে দেন এক লহমায়। সামাজিক দায়বদ্ধ কবিদের পাশাপাশি চল্লিশের কবিতায় আরেকটি ধারা ছিল। নিভৃত এবং অনুচ্চার। একদিন তাঁরাই ‘ আরো কবিতা পড়ুন’ স্লোগান নিয়ে পথে নেমেছিলেন। নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকারের পাশাপাশি এইরকম একজন নিভৃতচারী কবি অরুণ ভট্টাচার্য। গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং সম্পাদক। অথচ আজকের পাঠক তাঁকে চেনেন না। তাঁর নামটি পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে আছে অনেকদিন।
কবি অরুণ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৫ সালে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। পিতৃনিবাস অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমায়। দীর্ঘদিন তিনি সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘উত্তরসূরি’। সংগীততত্ত্ব এবং নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিয়েছিল একদিন। ওস্তাদ আত্তা হোসেন খাঁ-এর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, কালীপদ পাঠকের কাছে প্রাচীন বাংলা টপ্পা এবং আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন দুই দশক ধরে। ছিলেন একজন সঙ্গীত সমালোচক। এসব ছাড়িয়ে শেষপর্যন্ত তাঁর প্রধান পরিচয় চল্লিশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে।
অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা। কখনও তা একমুখী, কখনও সর্বাত্মক। নিজেকে নিঃস্ব করে রচনা করে আত্মপরিচয়ের আড়াল। এই ভালোবাসা নির্জন আবার কখনও সংসারের গোপন বলয় থেকে উঠে আসে। অজস্র কবিতার থেকে একটি কবিতা তুলে নেওয়া যাক–
“কত দূর, দূরাগত সমুদ্রের কানে কানে অনেক আশ্বাস
শূন্য তীর,ছায়াবন প্রান্তরের তীরে নামে আরেক আকাশ।
হৃদয়ের অনাবৃত সুরে আজ যে প্রার্থনা উচ্চারিত,
সকল কান্নার শেষে সেই শ্লোক নিয়ত ধারায়
দূর প্রান্তে প্রবাহিত। তবু তার নাম
প্রাণের প্রসন্ন কোণে কি এক অপূর্ব অর্থে প্রত্যহই স্মরণীয়।
অথবা সে ভুল? যদি ভুলের অন্বিষ্ট শুধু প্রেমের প্রণাম
যদি কথার ধ্বনিতে শুধু সংগীতের গভীর ব্যঞ্জনা,
তবু তার দাম। সময়ের নির্ভুল হিসেবে
এ পৃথিবী,নদী,মাঠ মানুষের অমৃত সাধনা
নিঃসংশয়ে ব্যর্থকাম। শুধু সময়ের, জলের ধারায়
অথবা আশ্বিনে কোনো রাজহংসী মেঘের মিছিলে
এই সত্য অধিগত, অথচ এ কীসের প্রহার?”
(কবিতার জন্য)
অরুণ ভট্টাচার্য আদ্যন্ত প্রেমের কবি। তাঁর কবিতার প্রধান ভরকেন্দ্র সমর্পিত ভালোবাসার দিনগুলি। প্রত্যাখ্যান পেরিয়ে উজ্জ্বল এক স্মৃতির গোধূলি। আহত অভিমান আছে কিন্তু তা প্রকৃতির সর্বব্যাপী আনন্দে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে রাখে। দুঃস্বপ্নের রথে পাড়ি দেয় যে মন তা শেষপর্যন্ত ‘তোমাতে নিবিষ্ট’। সবচেয়ে বড়ো কথা এই আলো হাওয়ার সংসারে ধুলোবালিছাই মাখা এক নির্মল প্রেম কবিকে নিয়ে যায় যেকোনো প্রৌঢ়তা পেরিয়ে যৌবনের চিরন্তন স্মৃতিতে।
“যদি সে পাখির ডাক ভরে দেয় আমার আকাশ
এই আলো রোদ্দুরের গানে গানে ফিরে পাই প্রেম
জীবনকে ভালোবেসে, দুই হাতে জুঁই একরাশ
নিয়ে তাকে বলব এবার: রানি, আমাকে দিলেম।
নাও তুমি গ্লানিময় এই দেহ, অশুচি অন্তর,
ফিরে দাও যৌবনের নিরিবিলি দুরাশার ঘর।
( ফিরে দাও [অংশ] )
আর এখানেই অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় জয় গোস্বামীর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য যা বহুরৈখিক – ‘কবি অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতার দিকে তাকিয়ে আমি একটি মিলনের আয়োজন দেখতে পাই। এই মিলন এক সর্বজাগতিক মিলন। দুঃখ এখানে আছে, কিন্তু সেই দুঃখের পশ্চাৎপটে দেখা দিচ্ছে প্রসন্ন গোধূলির আলো। রক্তক্ষরণ কি নেই কবিতার অন্তঃস্থলে? আছে, কিন্তু তাকে মুছে দিচ্ছে, তার উপর প্রলেপ দিচ্ছে ব্যাপ্ত ভালোবাসার বনৌষধি।’ এই “ভালোবাসা’ শব্দটি তাঁর কবিতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনও কখনও এইসব কবিতায় এসেছে তরল আবেগ যেখানে ব্যঞ্জনা নেই শুধু আছে সরল বিশ্বাস। আর এখানেই মাঝেমধ্যে শিথিল এবং দুর্বল কবিতার জন্ম হয়েছে। একটি উদাহরণ দিই
“তোমার মুখ মনে পড়লে
এই মুহুর্তে
কাঙাল হয়ে ফিরতে পারি
হিরন্ময় আলোর রেখা দুহাত দিয়ে ধরতে পারি
এই মুহুর্তে
তোমার ও-মুখ মনে পড়লে
বিশ্বজোড়া আঁধার আমি ঘোচাতে পারি
টবের মধ্যে সরোবরের বিশাল পদ্ম ফোটাতে পারি।”
( তোমার ও-মুখ)
অরুণ ভট্টাচার্যর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সায়াহ্ন’ প্রকাশিত হয় ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে। এই বইটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল। এখানে কবির নিজস্ব স্বর নেই। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ ময়ূরাক্ষী’ (১৩৬০) থেকে কবি স্বতন্ত্র স্বর খুঁজে পেয়েছেন। এই বইটি কবির মনোধর্ম বোঝার জন্য অত্যন্ত জরুরি। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – মিলিত সংসার (১৩৬৬), সমর্পিত শৈশবে(১৩৭০), ঈশ্বর প্রতিমা(১৩৮২), সময় অসময়ের কবিতা (১৩৮৩), চারিদিকে খেলাঘর (১৩৯০)। এইসব কবিতায় তিনি ধরে রেখেছেন নিঃস্ব স্মৃতির এক যাপিত জীবন। এক সমর্পিত শৈশবের প্রচ্ছন্ন আলো। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর কবিতা আসলে পদ। সেখানে উত্থান পতনের চেয়ে বড়ো কথা একমুখী গীতিময়তার প্রবাহ। ফলত তাঁর কবিতায় কোনো উত্তরণের দেখা চাইলে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন।গুঞ্জনের মতো শুধু কিছু নম্র প্রতিমার যাতায়াত আছে। হে পাঠক, আসুন তাঁর কয়েকটি কবিতায় প্রবেশ করি।
১
বাঁশি বাজলে যেতে হয়।
যত দূর দেখা যায়
সামনে কিছু নেই শুধু
দিঘিকালো অন্ধকার।
অতীতে তাকালে কিছু ক্ষতচিহ্ন।
তাহাকে পাবার নেই তাহাকে দেবার কিছু নেই।
চারিদিকে শূন্যতার মাঝে
থেকে থেকে ট্রেনের সুতীক্ষ্ণ স্বর কানে বাজে:
বাঁশি বাজলে চলে যেতে হয়।
(বাঁশি বাজলে)
২
চারদিকে সব মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কারা
সং সেজেছে আপাদমস্তক
বলবে না কেউ এমন কথা অসীম দুঃসাহসে:
নদীর জলে রাখব আমার শব।
(রাখব আমার শব)
৩
প্রতিমাগৃহের কাছে একরাশ বাতাস বহিছে।
প্রতিমাগৃহের কাছে আমাদের
নতজানু হতে হবে।
ওইখানে উন্মুখর ইতিহাস
আমাদের বলে গেছে
মানুষের মৃত্যু আছে। মানুষের
দেশকালসন্ততির মৃত্যু নেই।
প্রতিমাগৃহের কাছে আমাদের
পিতামহীদের শব
উন্মনা বাতাস ঘিরে আজও স্থির
হিরন্ময় রয়ে গেছে।
(মহাকবি মাস স্মরণীয়েষু)
৪
একটু স্থির হও। এখন
পিছন ফিরে তাকাবার সময়। এখন
মগ্নতার সন্ধ্যা। আকাশের
নক্ষত্রদীপ তোমারই জন্য, সূর্যের
দাহ নয়। এখন
ধীরে ধীরে চৈতন্যের
নীলিম জ্যোৎস্নায়
অবগাহন। এখন
প্রসন্ন আঁখি মেলে
সরোবরের স্থির পদ্মটির দিকে
তাকাও।
(জন্মদিন)
প্রাথমিকভাবে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধের দ্বিমাসিক হিসেবে ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে নারায়ণ চৌধুরী এবং শিবনারায়ণ রায়ের সম্পাদনায়। পরবর্তী সময়ে বিশুদ্ধ কবিতাপত্র হিসেবে চল্লিশের কবি অরুণ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১৩৬১ বঙ্গাব্দ থেকে। এই পত্রিকা নিয়মিত গ্রামগঞ্জের কবিতা পত্রিকা থেকে নবীন কবির অজস্র কবিতার পুনর্মুদ্রণ করেছে। চিত্রকলা,ভাস্কর্য, সংগীতের পাশাপাশি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। ১৯৮৫ সালের শেষ সংখ্যাটির অনেক আগে থেকেই এই পত্রিকার প্রচ্ছদপটে মুদ্রিত হয়ে আসছে তরুণ কবিদের প্রতি আবেদন :
” ১৯৩০-৮০ পঞ্চাশ বছরের অস্থির দিনগুলি পার হয়েছে। বন্ধুগণ! এবার আপনারা র্্যাঁবো, বোদলেয়ার অথবা এলুয়ার,মায়াকভস্কি থেকে ফিরে আসুন মহাজন পদাবলী রামপ্রসাদের কবিতায় শ্রীধর কথক নিধুবাবুর গানে। দেশের মাটির গন্ধ বুক ভরে নিন। ধর্মকে আবার স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করুন। ধর্ম মানে কুসংস্কার নয়, ধর্ম মানে চিত্তের সুস্থির প্রতিবিম্ব, চৈতন্যের উন্মোচন। আসুন , একবার মা বলে তরী ভাসাই।”
সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্য সার্থক এবং শক্তিশালী। পুনরায় বলতে চাই তাঁর কবিতায় আছে পদের সৌন্দর্য। মনে হয় নির্জন প্রেমের কথা পৃথক পৃথক কবিতায় নয় বরং অন্তহীন গীতিময় প্রবাহে ধরা আছে।
অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন কবি জয় গোস্বামী। দ্বিতীয় পাঠ। তাঁর ধারণা প্রথম পাঠে উল্লেখযোগ্য মনে না হলেও দ্বিতীয় পাঠে অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতা গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাঞ্জনাময় মনে হয়। কথাটা সত্যি এবং কিছুটা অতিশয়োক্তি। এমন অনেক কবিতা পাওয়া যাবে যেখানে দ্বিতীয় পাঠে ও কবিতাটি শেষপর্যন্ত দুর্বল মনে হয়। আবার অনেক কবিতা আছে দ্বিতীয় পাঠে তার তাৎপর্য বোঝা যায়। এর একটি বড়ো কারণ হয়তো সংগীতধর্ম। হয়তো সুরের কারণেই অরুণ ভট্টাচার্য অনেক ক্ষেত্রে ইপ্সিত শব্দের অভাব বোধ করেননি। আরেকটি কথা বলা যায় তাঁর কবিতায় সময়ের উত্তাপ নেই। দু-একটি বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ ছাড়া জনতার জীবন এবং রাজনীতি নিয়ে তিনি নীরব। বরং ‘ব্যক্তিগত ছোটো একটা জগৎ’ তাঁর কবিতা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় অভাব নেই অথচ নিভৃত জীবনের বেদনা আছে। পথ চলা মানুষের চেয়ে ঘরের কোণে অন্ধকার মানুষের দিকেই তাঁর কবিতার অভিপ্রায়। একটি বই থেকে অন্য বইয়ে তাঁর স্বর খুব একটা বদলায় না। কোনো উত্তরণও জরুরি হয়ে দেখা দেয়নি। তবে তাঁর কবিতা সংহত এবং আঙ্গিকে নিপুণ। শব্দ মধ্যবর্তী শূন্যতায় কখনো কখনো সংবেদনশীল পাঠক খুঁজে পাবেন অক্ষরের ঐশ্বর্য, পুনর্নির্মাণের যাবতীয় সম্ভাবনা।
আজকের পাঠক অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতা পড়েন না। নামটুকু শোনেননি এমন পাঠকের সংখ্যাই বেশি। তবুও আমাদের এই চর্চা জারি রাখতে হবে নতুন দিনের পাঠকের জন্য, পুরোনো পাঠকের আবিষ্কারের জন্য। শক্তির জীবন এবং কিংবদন্তি বেঁচে আছে অথচ তাঁর পাঠক কমে গেছে আজ। আসলে যেকোনো বিস্মৃতি সময়ের ধর্ম। গ্রহণ- বর্জন, নস্যাৎ, বিস্মৃতি, আবিস্কার এবং পুনরাবিষ্কারের জটিল মনোধর্মেই লুকিয়ে আছে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ। হে পাঠক, আপনার চলার পথে একজন অরুণ ভট্টাচার্য আছেন মনে রাখবেন।
* ক্রমশ