Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ১০

সে লি ম   ম ণ্ড ল

সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কমরেড: কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়

কথা দিয়েছিলাম— এই ধারাবাহিকে দশটি পর্ব লিখব। ন-টি পর্ব লেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, কাকে দিয়ে শেষ করব। দীর্ঘ লিস্ট বানিয়ে রেখেছি… বাংলায় এখন বিধানসভা নির্বাচন চলছে। নির্বাচন ঘিরে চারিপাশ উত্তপ্ত। এবারের ভোট ঘিরে মানুষের আগ্রহও অনেক। এইসময় আমার মনে পড়ছিল একটি নাম। কবি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়। যিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পেশাগতভাবে ছিলেন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার একজন শ্রমিক। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক কনভেনর।

 

কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় অদ্ভুতভাবে। সে-ও বছর চার-পাঁচ হবে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে দেখি— কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা সংগ্রহ’ পড়ে। কবির স্বাক্ষরসহ। দু-চার পাতা পড়ে বেশ ভালো লাগে। পুরোনো বইয়ের দাম হিসেবে অনেক বেশি দাম বলছিল। তখন হাতখরচ বাঁচিয়ে বই কিনতাম। সেদিন আর কেনা হয়নি… পরে যেদিন কলেজ স্ট্রিট যাই, দেখি— বইটি তেমনই পড়ে। কিনে নিই।

কবিতায় কোনো মৌলবাদে আমি বিশ্বাসে নই। সব ধরণের কবিতা পড়তে ভালোবাসি। তবে হ্যাঁ, লেখার ক্ষেত্রে তাঁকে গ্রহণ করব কিনা সেটা অন্য ব্যাপার। যদিও আমরা যাঁরা লিখিয়ে তাঁরা একটি লেখা পড়ি ‘gain’ করার জন্যই। সেটাও আবার নির্ভর করে কে কী ‘gain’ করতে চায়!

 

জীবন সবসময় সোজা লাইনে থাকে না। কখনো কখনো বেঁকে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও। সেখানে রণহুঙ্কারে প্রয়োজন। কবিতা কেন সবসময় নিশ্চুপ বা অবস্থানহীন অসাড় সম্ভাবনা হয়ে সাদা পাতায় গুমরে থাকবে! কখনো কখনো জাগিয়ে তুলতে হয়। কেষ্ট চট্টোপাধ্যায় রাজনীতি সচেতন কবি। রাজনীতির মানুষ। কারখানার ইউনিয়নের নেতা। তিনি অনুভব করেছিলেন— মানুষের জন্য, স্বৈরচারী শাসকের বিরুদ্ধে লিখতে হবে। তাঁর অধিকাংশ কবিতা মিছিলের কবিতা, আন্দোলনের কবিতা, মানুষের রুজির কবিতা, মানুষের রুটির কবিতা…

 

পড়া যাক তাঁর কিছু কবিতা—

 

শ্রমিক

 

এখনো হুইলখানা মেশিনের উপর চাপানোই আছে

কী সুন্দর উজ্জ্বলতা তার ধাঁধাচ্ছে চোখ

কারখানার শপে।

আমার মুখের ছবি তারই উপর পড়ে

খুলে যাচ্ছে পর্দার আড়াল।

 

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার নিখাদ প্রতিচ্ছবি—

দীনতার কী অস্থির ছিবড়ে কঙ্কাল।

 

দিল্লির মসনদ

 

এখন আমরা সকলে সাফ-সুফ বুঝে ফেলেছি

কারখানার কিছুই আমাদের হাতে দেয়নি মালিক সাহাব

হররোজ উৎপাদনের সব রেকর্ড নস্যাৎ করে

গোপন চক্রান্তে তসবিরে ঢালিস কালি

তবু     আমরা একরকম গায়ে পড়ে আলোচনায় গেছি

এবং বিক্ষোভ হরতাল করে সাফ-সুফ সমঝ গিয়া

এদের কাছে আমরা     বিদেশি।

 

অভি    কুছ-কুছ আমলা লোগ।

দ্বন্দ্বের ঘোলা জলের ডোবার মধ্যে পড়ে বুঝেছে

তারা কত মরদ

যারা খিলৌনা হতে চায়নি তাদের দু-একজনের বুকের পাটা ছিঁড়েছে সুতো

এর কিছু কথা শেডের নীচে ফাঁক বুঝে পালিয়ে এসেছে।

 

ভাই লোগ

কোথায় কি ফুল ফোটালে বাগানের শোভা বাড়ে

তা আমরা যতই জানি     দিল্লির মসনদ    বেহদ গুস্তাখী।

 

মুখোশ

 

ছোটবেলায় আমি যখন মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াতাম

খুব মজা লাগত।

বন্ধুদেরও বিভিন্ন রকমের ছিল;

দেখতাম পরস্পরের মুখ।

বড়ো হতে-হতে দেখছি তার সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে গেছে।

 

সেই— ছোটবেলার মুখোশটা যেমন থেকে গেছে আমার মুখের সাথে

তেমনি অন্যদের মুখেও আছে; রক্তে মিশে গেছে সে সব।

এখন আমার ছেলেকে আর মুখোশ কিনে দিতে হয় না

সে পেট থেকেই নেমে এসেছে খচ্চরের মতো

দ্বিতীয়টি প্রধান মন্ত্রীর মতো, তৃতীয়টি শিক্ষামন্ত্রী

একটাও মানুষের মতো হল না।

 

উপরের তিনটি কবিতা পড়ে আমরা বুঝতে পারি—  তিনি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত শূন্যতা বা অ্যামেচারের জন্য লেখেননি। কবিতা তাঁর কণ্ঠ। এই কণ্ঠকে যে অবরুদ্ধ করা যায় না, এর প্রমাণ, এই আজ আমি ভাবছি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা! শাসক আসে যায়, চেয়ার বদলায় না। সব চেয়ারের একই দৌরাত্ম্য!

 

যুগ যুগ ধরে সেই একই প্রতিচ্ছবি। দীনতার অস্থির ছিবড়ে কঙ্কাল। এ কি কখনো বদলাবে? “ভাই লোগ/ কোথায় কি ফুল ফোটালে বাগানের শোভা বাড়ে/ তা আমরা যতই জানি     দিল্লির মসনদ    বেহদ গুস্তাখী।” কিন্তু সাধারণ মানুষ কী করবে? কীভাবে ছিনিয়ে নেব তার অধিকার। সবই মুখ আর মুখোশ। মুখোশ কবিতাটিতে কবি যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা আঁতকে ওঠার! সদ্যজাত শিশু পেট থেকে নেমে আসছে খচ্চরের মতো! কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ শিক্ষামন্ত্রী! এই দেশে বিপ্লব ছাড়া কী আসতে পারে?

 

কবির আরও কিছু কবিতা পড়ব—

 

পয়লা ফাল্গুন

 

তোমার মুখের মতো সন্ধ্যা নেমেছিল হঠাৎ এখানে

মনের মতো কি অনির্বচনীয় ছায়া

মমতার স্নেহ-বৃক্ষে সারাদিন খেলে গেছে পাখি

দিনান্তের নির্ভরতায় আকাশ হয়েছিল অপরূপ

 সেদিন এখানে!

 

তথাপি নীরবে সে-বৃক্ষের পাখি উড়ে গেছে অজ্ঞাত কারণে

আর তো ফেরেনি।

 

এত আলো দিতে পারে

 

চলে গেছ আরও কোনো বড়োসড়ো সুখের আশায়

যাও—

যারা যায় তারা তো বোঝে না কিছু!

 

যন্ত্রণা যে এত আলো দিতে পারে—

সে যদি জানত!

 

উপরের দুটো কবিতা পড়লে বোঝা যায়, কবির আরও এক জগৎ আছে। যে জগতে তিনি অজ্ঞাত কারণে উড়ে যাওয়া পাখির সন্ধান করেন। খোঁজেন তার ছায়া। আবার এও অনুভব করেন যন্ত্রণার আলো কতটা ধারালো। 

 

প্রস্তুতি পর্ব

 

উষা লগ্ন। কালো আকাশের পরে তুলির সে লাল টান

মাটিতে পাখির ডাকে নেমে আসে সুপ্রভাত

দিনকালে অন্য কথা। সেফটি জুতোর শব্দে ভেঙে যায় সেসব নির্বাণ

যা আসে কোন গতি নেই তাতে। সুখ না ভিতরে। শুধু দুঃখের প্রপাত

তবুও থামে না কিছু। সূর্য ওঠে। পালিতে শ্রমিক যায়

দু-ধারে সবুজ মাঠ। মাঠে চাষি

ভোর থেকেই প্রস্তুতিপর্ব। বিষন্ন সন্ধ্যায় ভুখা দিন বলে— আসি

আমাদের ঘুরে ঘুরে আসা। যাওয়া নেই

যতই থাকুক দুঃখ তবু সেই অন্ধকারে কী এক রহস্য আছে

থাকে জীবনের গভীরেই চিরকাল নদীর স্পন্দন। চলমান প্রস্তুতির পর্বে

বিশ্বাসে অপার

তাকে সরাতে পারে না কেউ। সৃষ্টি করে ভেঙে-চুরে রক্তাক্ত অঙ্গার।

 

জ্বলছে

 

না, ও কিছু নয়

ওটা একজন শ্রমিকের বাড়ি

ঢুকে পড়েছে সল্টলেকে কখন

অবাক হচ্ছেন খুব, জ্বলছে

মর্যাদায় ঘা-লাগছে— ঘেমে যাচ্ছেন বুঝি

 

ঘেমে গেলে কী করে চলে বলুন— ছিঃ

 

বিকল্প নেই

 

ঘুরেই দাঁড়াতে হবে, বহুকাল সন্ত্রাসেই গেল

ঘর পোড়ে, লুঠ হয়, শিশু কাঁদে অসহায় কোলে

প্রাণ নিয়ে গ্রামছাড়া বসবাস ত্রাণের শিবিরে

ছয় ঋতু চলে যায় এই মন কখনো কি ভোলে?

 

ঘুরেই দাঁড়াতে হবে— মৃত্যুপুরী কতদিন থাকে

স্মৃতি-মধ্যে আছে সব ঘরপোড়া দাউ দাউ শিখা

 কে ওখানে আর্তনাদ করে ওঠে, অন্ধকার পথে

লাশ হয়ে গেল কেউ, খুনি সব গুম করে টীকা।

 

ঘুরেই দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ, প্রতিঘাতে আজ

মুখোশের অন্তরালে ঘাতকের বীভৎস চেহারা

খুলে দিতে হবে রোজ ক্লান্তিহীন উদাত্ত আজানে

ক্ষমা নেই, কাকে ক্ষমা জেগে থাকে সেই ধ্রুবতারা।

 

ক্ষমতার ক্রুর আশা স্পষ্ট করে দেওয়াল লিখন

স্বখাত সলিলে ডোবে, দেখে খুনি নিজস্ব পতন।

 

প্রভুত্বের স্বভাব

 

তোমার নীচে থাকলে ভালো বলো, কাছে ডাকো

প্রভুর মতো ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলো

তোমার পাশে বসলে তাকাও তির্যকভাবে

কখনো-কখনো ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দাও অবস্থানের কথা

এগিয়ে যেতে গেলে জাল বোনো মাকড়সার মতো।

 

আমাদের রাষ্ট্র এক মৃত্যুপুরী। কৃষক, শ্রমিক সবাই যেখানে অঙ্গার-শরীরে জ্বলছে। জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। অসহায় শিশু বা বৃদ্ধের আর্তনাদ পৌঁছাবে না। সব লাশ হয়ে যাবে গুম। ত্রাণের শিবিরে বসবে নেতাদের জুয়ার আড্ডা। কী করবে?

 

কবির কথায়, “এগিয়ে যেতে গেলে জাল বোনো মাকড়সার মতো”

মাঝেমাঝে ভাবি— এই কবিতা কী হবে? কেন আমরা লিখি? আমাদের চোখ এত dynamic! এরপরও কেন আমরা তুচ্ছতার সঙ্গে নিজের গণ্ডি এঁকে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধানোর চেষ্টা করি। চোখ যত বেশি যায়, ততই আলো আসে। কিন্তু আমরা কি সেই আলো সন্ধান করি? হতাশার অন্ধকার আমাদের ভিতর এত বেশি monopoly করে, দৃশ্যের খণ্ডচিত্র নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতি।

 

কবিতা মানে শুধু নন্দন চত্বর বা বাংলা আকাদেমি নয়… কেষ্ট চট্টোপাধ্যায় তা পদে পদে দেখিয়েছেন…

 

কবিতা পড়তে যাচ্ছি

 

প্রতিদিন এত দৃশ্য দেখি

প্রতিদিন এত দুঃখ, প্রতিদিন এত কষ্ট।

 

আজও বসে আছে সানকি পেতে সারাটা দিন

একটাও পয়সা পড়েনি

বাচ্চাছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে কখন।

 

আমরা পাশ কাটিয়ে, পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি

আকাদেমিতে কবিতা পড়তে।

কবি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়

kesto book

আরও পড়ুন...